ভূমিকা
পৃথিবীর কোন বস্তুই এমনিতেই সৃষ্টি হয়নি। সকল সৃষ্টির পিছনে থাকে এক একজন
কারিগর। আমাদের পৃথিবী তেমনি এক বিশাল সৃষ্টিকর্ম। যা তায়ালা সৃষ্টি করেছেন।
পৃথিবীর সকল উপকরণ মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত রয়েছে। আর মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে
একমাত্র ইবাদত করার জন্য। তাই মানুষ যেন সঠিক পদ্ধতিতে ইবাদত করতে পারে সেজন্য
তিনি পথ প্রদর্শক হিসেবে নবী রাসূল পাঠিয়েছেন। যারা নবী-রাসূলকে মেনে নিয়ে সে
অনুযায়ী নিজেদের জীবন-যাপন করবে তারাই মুসলিম। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর
মাধ্যমে নরুওয়াতের সে ধারা সমাপ্ত হয়েছে। আর কোন নবী-রাসূল পৃথিবীতে আসবেন না।
নবী রাসূলদের অনুপস্থিতিতে তাদের রেখে যাওয়া দাওয়াতী কাজের আঞ্জাম দিবে
মুসলমানরা। বাংলাদেশের প্রায় সকল লোক মুসলমান। কিন্তু ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও
তার অনুসৃতি থেকে তারা অনেক দূরে সরে গেছে। বিশেষ করে তরুন সমাজ। তরুন সমাজকে
ইসলামের রঙে রাঙিয়ে তুলে আগামী দিনে জাতির কান্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ করার মহৎ
উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।
মহাবিশ্বের
স্রষ্টা ও পরিচালক
অসংখ্য জিনিস আমরা নিয়মিত
ব্যবহার করছি। বই, কলম, গাড়ি,
কম্পিউটার, রেডিও, মাইক
প্রভৃতি হাজার রকম জিনিস। এগুলো সবই নির্ধারিত নিয়মে তৈরি হয়েছে। আপনা আপনি
হয়নি। কিন্তু কলকব্জা জড়ো করলেই গাড়ি হয় না, এক টুকরো
প্লাষ্টিক যেমন ইচ্ছেমতো কাটলেই কলম হয় না। মানুষ উন্নত মস্তিস্কের সাহায্যে অনেক
চিন্তা ভাবনার পর এসব জিনিস তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এগুলো ব্যবহারেরও নির্ধারিত
নিয়ম আছে। ছোট নিবটি ভেঙে গেলেই আর সে কলম দিয়ে লেখা যায় না। গাড়ি চালানো না
শিখে কেউ চালাতে শুরু করলে নির্ঘাত দুর্ঘটনায় পড়ে তাকে মরতে হবে। এ পৃথিবী আর
মহা বিশ্বেও সবকিছু তেমনি সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী সৃষ্টি হয়েছে, আর চলছেও নির্ধারিত নিয়ম মেনে। কেউ যদি বলে, হঠাৎ
করে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে, কোন নিয়ম ছাড়াই পাহাড় সমুদ্র
বন-বনানী স্থাপিত হয়ে গেছে, তাহলে তাকে নির্বোধ, বোকা, মিথ্যাবাদী ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। তেমনি
একথাও চরম মিথ্যা যে এ বিশ্বের কোন কর্তা বা পরিচালক নেই।
মূলত: এ মহাবিশ্বে সবচেয়ে বড় সত্তা হচ্ছেন মহান রাব্বুল
আলামীন। তায়ালা এ বিশ্ব এবং যাবতীয় কিছু সৃষ্টি করেছেন ও পরিচালনা করছেন। এ
মহাসৃষ্টির পেছনে রয়েছে তার বিরাট পরিকল্পনা। সবচেয়ে সুন্দর নিয়ম বা বৈজ্ঞানিক
বিধি মেনে চলছে এ মহাজগতের প্রতিটি বস্তু। তাই বলেন, পৃথিবী
ও আকাশের সবকিছুই এক মহাবিজ্ঞানী পরিকল্পনার নিদর্শন।
অর্থাৎ “নিশ্চয় আকাশ-পৃথিবীর সৃষ্টি এবং দিন রাত্রির পরিবর্তনের মাঝে
চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে যারা সব সময় কথা স্মরণ রাখে এবং
আসমান-জমিনের সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে; এরপর
স্বত:স্ফূর্ত-ভাবেই সাক্ষ্য দেয়, হে আমাদের প্রভু, তুমি এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করোনি।(আলে ইমরান : ১৯০-১৯১)
মানুষ ও
বিশ্বজগৎ
তাহলে প্রশ্ন জাগে কেন এ মহাবিশ্ব
আর পৃথিবীর এতসব নিয়ামত সৃষ্টি করে রেখেছেন? এই
উত্তর পেতে হলে আমাদের আরেকটু এগুতে হবে। মূলত: এ বিশ্বজগতের সবকিছু মানুষের
কল্যাণার্থে সৃষ্টি করা হয়েছে। তায়ালা পৃথিবীতে মানুষের বসবাসের সকল প্রকার
প্রয়োজনীয় উপকরণ সৃষ্টি করার পরই মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সৃষ্টির সকল আদি
থেকে সৃষ্টি নির্ধারিত নিয়মেই পরিচালিত হয়ে আসছে। যেমন আমরা সূর্যকে দেখি
প্রতিদিনই সে পূর্বদিকে উদিত হয়ে পশ্চিমে অস্ত যায়। ছক বাঁধা এ নিয়মের বাইরে
যাওয়ার কোন শক্তি তার নেই। কিন্তু মানুষ অন্য সবার মতো ধরাবাধা নিয়মে চলতে বাধ্য
নয়।
বস্তুত: মহান আল্লাহ
সব কিছুকে মানুষের জন্যে তার নিদর্শন বানিয়েছেন। যেমন একটু আগে কালামে পাকের
উদ্ধৃতি দেয়া হল। ক্ষুদ্রতম থেকে বৃহত্তম সব সৃষ্টিই র ইবাদত করছে বা তার বিধান
মেনে চলছে। এজন্যে তাদের মধ্যে পূর্ণ শান্তি অনাদিকাল থেকে বিরাজমান। এতে মানুষের
জন্যে বড় শিক্ষা রয়েছে। তা হচ্ছে মানুষেরও উচিত আল¬াহর বিধান মত চলা। অন্যদিকে এ সৃষ্টিসমূহ মানুষের উপকারের
জন্যই মওজুদ রয়েছে, মানুষ তার যাবতীয় প্রয়োজন এগুলো
দিয়েই পূরণ করে। বলেন-
“এ পৃথিবীর সবকিছুই তোমাদের জন্য
সৃষ্টি করা হয়েছে (আল কুরআন)
মানুষের
দায়িত্ব
তাহলে বুঝা গেল, দুনিয়ার সব কিছুকেই দয়াময় আল্লাহ্ মানুষের খেদমতে নিয়োজিত
রেখেছেন। অথচ বিভিন্ন সময় দেখা গেছে মানুষ দুনিয়া বা এর বিভিন্ন বস্তুর গোলামী
করেছে, কখনও সূর্যের, কখনও চন্দ্রের,
কখনও প্রতিমার। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার! দুনিয়ার সব মানুষ সৃষ্টি-
এক জাতের সৃষ্টি। তাই তারা সবাই সমান। জন্মগত মর্যাদায় কেউ কারো বড় ছোট নয়। অথচ
মানুষের মাঝে কিছু লোক বিভিন্ন সময় অন্য মানুষকে গোলাম বানিয়েছে, তাদের শাসক বা মনিব হয়েছে। এটা মানবতার জন্যে জঘন্য অপমান। অতীতে ফেরাউন
নমরুদরাই এটা করেনি, আজকের যুগেও তাদের উত্তরসূরী রয়েছে।
এরা নিজেদের মনগড়া মতবাদ বা শাসন সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। আর মানুষ
তাদের স্রষ্টা ও তাঁর বিধানকে না জানার কারণে তাদের আনুগত্য করে চলেছে।
অথচ বলেন মানুষ
দুনিয়াতে আমার প্রতিনিধি। মানব সৃষ্টির সময় তিনি ফেরেশতাদের বলেছিলেন:
“আমি দুনিয়াতে আমার প্রতিনিধি
নিয়োগ করতে চাই।” তাই মানুষ ফেরেশতার চাইতেও বড়। তারা
প্রতিনিধি। দুনিয়াতে তাদের কাজ হল তারা কেবল দেয়া বিধান অনুযায়ী চলবে আর
দুনিয়াকে সেভাবে চালাবে। এটা বুঝতে না পারার কারণেই মানুষ বিভিন্ন বস্তুর বা অপর
কোন মানুষের গোলামী করে থাকে।
মানুষের
প্রকৃত পরিচয়
সে আধা অধীন আর আধা স্বাধীন, যেমন, আল্ল¬াহ
তাকে মুখ দিয়েছেন কথা বলার জন্যে। সে কান দিয়ে বলার কাজ সম্পন্ন করতে পারে না।
তাই এখানে সে খোদার
অধীন, কিন্তু মুখ দিয়ে সে সত্য বলবে, না মিথ্যে বলবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা তাকে দিয়েছেন।
এজন্য দেখা যায় নেহাত
খারাপ লোকরাও নিজেদের জনদরদী পরিচয় দিতে ভালোবাসে। এ অনুভূতি আসে মানুষের বিবেক
থেকে। বিবেক হলো ভালো ও মন্দ পার্থক্য করার ক্ষমতা।
শেষ নবী
হযরত মুহাম্মাদ (সা)
নবীদের সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ হচ্ছেন
হযরত মুহাম্মাদ (সা)। তাঁর ওপর নাজিল হয়েছে আল কুরআন। এতে সর্বকালের সর্বযুগের
মানুষের জন্যে তাঁর পছন্দনীয় পথ কি, তা
বলে দিয়েছেন। রাসূল (সা)আল্লাহর দ্বীন ইসলামকে পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত করে
গিয়েছেন। এ জীবনব্যবস্থা সব মানুষের জন্যে খোদা মনোনীত একমাত্র জীবন ব্যবস্থা।
তাই আল কুরআনের সর্বশেষ নাজিল হওয়া আয়াতে আল্লাহ বলে দিয়েছেন।
“... আজ আমি তোমাদের জন্যে আমার
জীবন ব্যবস্থাকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, আমার নিয়ামতকে
পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের জন্যেই ইসলামকে একমাত্র জীবন-বিধান হিসেবে
নির্ধারিত করলাম। (সূরা আল মায়েদা: ৩)
মানুষের
আসল পরিণাম
যারা দুনিয়াতে আল্লাহ প্রদত্ত
বিধান এবং রাসূল (সা) প্রদর্শিত পথ অনুযায়ী চলবে আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়ায়
সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা দেয়ার ওয়াদা করেছেন। যেমন খোলাফায়ে রাশেদীন এবং যুগে
যুগে ন্যায়পরায়ণ খোদাভীরু শাসকের অধীনে মানুষ ইনসাফ, সুবিচার পেয়েছিল: শোষণ, নির্যাতন থেকে
সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল। কিন্তু এ থেকেও আল্লাহ বড় সফলতা দিবেন আখিরাতে। আখিরাত হচ্ছে
মৃত্যুর পরবর্তীকাল। কিয়ামাতের পর আল্লাহ পৃথিবীর সব মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করবেন
ও একত্রিত করবেন। সেদিন মানুষের যাবতীয় কাজের হিসেব নেয়া হবে। দুনিয়ায় যারা
হুকুম মেনেছে, নবীর পথে চলেছে, তাদেরকে
চিরকালের জন্যে জান্নাত (চিরন্তন সুখের স্থান) দেয়া হবে। আর যারা কর্মের
স্বাধীনতার সুযোগে উচ্ছৃংখলতা ও খোদাদ্রোহীতার পথ অবলম্বন করছে, তাদেরকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। তাদের পরিণাম হবে জাহান্নাম।
বোকা, অহংকারী, স্বল্পজ্ঞানী আর পন্ডিত
নামধারী কিছু গোঁড়া ব্যক্তি আখিরাতকে অস্বীকার করতে চায়। শয়তান এসব পন্ডিতদের
মতই ছিল। সে জ্ঞানের অহংকারে ডুবে গিয়েছিল। তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কেউ হতে পারে তা সে
মানতে চাইল না। ফলে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হল। আখিরাতের
প্রতি অবিশ্বাসী পন্ডিতরাও জ্ঞানের অহংকারে ডুবে থাকে। তাদের ধারণার বাইরে যে আরো
কিছু থাকতে পারে তা তারা বিশ্বাস করতে চায় না। অথচ একটু খোলা মনে চারিদিকে তাকালে,
চিন্তা করলে বুঝতে পারা যায়- শুকিয়ে যাওয়া মাটিতে বৃষ্টি হবার
পরই ঘাস গজায় কেন? কিভাবে শীতের জীর্ণতার পরেই আসে বসন্তের
সজীবতা। দিনের পরেই বা রাত্রি কিভাবে নেমে আসে? আল্লাহর
দেয়া নিয়ম অনুযায়ী প্রকৃতিতে যখন এ বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে তখন সেই
আল্লাহ মৃত মানব সমষ্টিকে আবার সহজেই জীবন দিতে পারবেন না কেন?
দুনিয়া হলো পরীক্ষার
স্থান। আখিরাত ফল লাভের স্থান। কাউকে কোন মর্যাদা আর পদ দেয়া হলে সে তার উপযুক্ত
কি না তা যাচাই করে দেখা দরকার। আর যাচাই করে তার যথাযোগ্য পুরস্কার বা শাস্তি
দেয়া দরকার। তেমনি দুনিয়ায় মানুষের মর্যাদা- সব জীবের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের
মর্যাদা। আর পদ বা দায়িত্ব- খিলাফত বা আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব। সে এ মর্যাদা বা
দায়িত্বের কতটুকু উপযুক্ত তা যাঁচাই করার স্থান হলো এই দুনিয়া। তাই সে আল্লাহ
এবং রাসূলের (সা) পথে চলে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিতে পারে। আর যাচাই হলে
যথাযোগ্য পুরস্কার বা শাস্তি। পুরস্কার বা শাস্তি দেয়ার স্থান আখিরাত। আখিরাতের
সফলতাই মানুষের আসল সফলতা।
উম্মাতে
মুসলিমার দায়িত্ব
রাসূলে কারীম (সা) গোটা
বিশ্বমানবতাকে সফলতার এ পথ দেখিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ব্যক্তি জীবন ও চরিত্র
গোটা মানবতার জন্যে একমাত্র আদর্শ। তিনি আল্লাহর বিধানকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত
করার এবং এ পথে সব প্রতিবন্ধকতাকে নির্মূল করার জন্যে কাজ করে গেছেন। মানুষ যে
আল্লাহর প্রতিধিত্বের যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, সে
চেষ্টাই তিনি করে গিয়েছেন। তাঁর ওফাতের পর তাঁর উম্মাতের ওপর মানবতাকে পথ দেখানোর
দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে।
তারা দু’পর্যায়ে এ কাজ করবে- (১) নিজেদের জীবনে ইসলামকে মেনে চলবে।
তাদের জীবন হবে পৃথিবীর মানুষের কাছে শ্রেষ্ঠ মানুষদের নমুনা। (২) দুনিয়াতে
ইসলামী বিধানের ভিত্তিতে সত্যিকার ইসলামী সমাজ কায়েম করবে। যাতে মানুষ জাহেলী
সমাজের অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে রেহাই পায়। তাই আল্লাহ পাক ঈমানদারদের আহ্বান
করেন এইভাবে:
“তোমাদের কি হয়েছে, তোমরা কেন আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করছো না? অথচ
দুর্বল, নির্যাতিত নারী, শিশু, বৃদ্ধরা আল্লাহর কাছে চিৎকার করে ফরিয়াদ করছে, হে
প্রভূ! আমাদেরকে এ জালিমদের এলাকা থেকে বের করে নাও। আর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের
জন্যে বন্ধু এবং সাহায্যকারী নিযুক্ত করে দাও। অতএব যারা ঈমানদার তারা আল্লাহর
রাস্তায় সংগ্রাম করে। আর যারা কাফের তারা খোদাদ্রোহীতার পথে সংগ্রাম করে। তাই
তোমরা শয়তানের মিত্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর। নিশ্চয় তাদের (শয়তানের) চক্রান্ত
দূর্বল। (সূরা আন নিসা : ৭৫-৭৬)
তাই উম্মাতে মুসলিমার
দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম করা। এ সংগ্রামের মাধ্যমে
আসবে মানবতার মুক্তি। আর আল্লাহ এ সংগ্রামের ফলশ্র“তি হিসেবে উম্মাতে মুসলিমাকে দিবেন আখিরাতের সফলতা। আল কুরআনে আল্লাহ পাক
বলেন:
“হে ঈমানদারগণ! আমি কি তোমাদেরকে
এমন এক ব্যবসার সন্ধান দেব যা তোমাদেরকে কঠিন আযাব থেকে বাঁচাবে। (তা হচ্ছে তোমরা)
আল্লাহ ও রাসূলের ওপর প্রকৃত ঈমান রাখবে এবং আল্লাহর রাস্তায় জান, মাল দিয়ে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের সত্যিকার উত্তম পথ। যদি তোমরা উপলব্ধি
করতে সক্ষম হও! (সূরা আস-সাফ ১০-১১)
জিহাদের সঠিক অর্থ
হচ্ছে- আল্লাহ মানুষকে যত প্রকার গুণাবলী, যোগ্যতা
ও ক্ষমতা দিয়েছেন সব কিছুকে রাসূলের (সা) প্রদর্শিত পন্থায় আল্লাহ দ্বীন
প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত করা। জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর বাংলা পরিভাষা হচ্ছে- ইসলামী
আন্দোলন।
অতএব, আল কুরআনের আলোকে উম্মাতে মুসলিমার দায়িত্ব হলো- নিজেদের সব
রকম যোগ্যতা ও সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহ পথে ইসলামী আন্দোলন করা।
দায়িত্ব
পালন একাকী নয়, সবাই মিলে
রাসূল (সা) একা দায়িত্ব পালন
করেননি। তিনি এ কাজ শুরু করেছেন, অন্যদেরকে দাওয়াত
দিয়েছেন। যারা দাওযাত গ্রহণ করলো তাদেরকে সংগঠিত করলেন, প্রশিক্ষণ
দিলেন, তাদেরকে নিয়ে একসাথে আন্দোলন করলেন এবং চূড়ান্ত
পর্যায়ে যুদ্ধও করলেন। ফলে পৃথিবীতে দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হলো। আল কুরআনে আল্লাহ
ঐক্যবদ্ধভাবে দ্বীনের পথে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন-
“তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর
রজ্জুকে আঁকড়ে ধর। আর পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।
আল কুরআনের নির্দেশ
মানা ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য। তাই কুরআনের পথ- রাসূলের (সা) পথ, সাহাবায়ে কিরামের (রা) পথ হচ্ছে ঐক্যবদ্ধভাবে বা সংঘবদ্ধভাবে
দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রামের পথ। অতএব ঈমানী দায়িত্ব পালন করার জন্য অবশ্যই
সংঘবদ্ধ হতে হবে।
ইতিহাসের
ধারায় শিবিরের আবির্ভাব
রাসূল (সা)- এর পর যুগে যুগে
আল্লাহর নেক বান্দারা এভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে চেষ্টা করে গেছেন। তারা কেউ
কখনও একাকী ইসলাম নিয়ে বসে থাকেননি। তাই ইতিহাসের ধারা অনুসরণ করে ছাত্র সমাজকে
মহান সংগ্রামের পথে সংঘবদ্ধ করার জন্যে জন্ম লাভ করেছে বাংলাদেশ ইসলামী
ছাত্রশিবির।
বাংলাদেশের
অবস্থা
আমাদের দেশের শতকরা প্রায় ৯০ জন
মুসলমান। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে এখানে ইসলামী বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র
পরিচালিত হওয়ার কথা। কেননা, ইসলাম একটি
পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা।
একজন মানুষ পরিবারের
সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব,
প্রতিবেশী প্রভৃতির সাথে কেমন সম্পর্ক রক্ষা করবে; সমাজের কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক,
বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী,
রাজনীতিবিদ-কার কি দায়িত্ব হবে; দেশের বিবিধ
সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সমস্যার সমাধান কিভাবে হবে; বিশ্বের
বিভিন্ন দেশের সাথে কেমন সম্পর্ক রাখতে হবে-সব কিছু ইসলামে বলে দেয়া আছে। কিন্তু
৮৯.৭% মুসলমানের এ দেশে কোন দিকেই তা মেনে চলা হচ্ছে না। দেশের প্রচলিত শিক্ষা
ব্যবস্থায় এ সম্পর্কে শিখানোরও কোন ব্যবস্থা নেই। ফলে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক
দৈন্যতা, শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশের অভাব ও সামাজিক নানা
প্রকার সমস্যাগুলো দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে।
আমরা এ অবস্থা
পরিবর্তনের চেষ্টা না করলে কিয়ামতের ময়দানে কাছে কঠিন জবাবদিহির সম্মুখীন হতে
হবে।
শিবিরের
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের জন্ম
ছাত্র সমাজকে আগামী দিনের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দিয়েছে।
শিবির প্রদত্ত আর রাসূল (সা) প্রদর্শিত বিধানের ভিত্তিতে মানবতার সার্বিক
পুনবির্ন্যাসের মাধ্যমে সন্তোষ অর্জন করতে চায়। আর এ কাজ করা যেহেতু প্রত্যেক
মুসলমানের দায়িত্ব এবং সমষ্টিগতভাবে মুসলিম জাতির দায়িত্ব, অতএব আলী, খালিদ, তারিক
ও মুহাম্মদ বিন কাশিমদের উত্তরসূরী সংগ্রামী তরুণদের জন্যে শিবিরের পথ হচ্ছে
আলোকিত জীবনের পথ। ইসলামী ছাত্রশিবির ছাত্রসমাজকে রাহে নিজেদেরকে বিলিয়ে দেবার
জন্যে উদাত্ত আহ্বান জানায়। জান্নাতের পথে ডাক দিয়ে যায় বার বার, অবিরত।
পাঁচ দফা
কর্মসূচি
পথে নিজেদেরকে বিলিয়ে দেয়া সহজ
কথা নয়। আবেগের বলে এটা সম্ভব নয়। রবং আগেই আলোচিত হয়েছে- নিজেদের যাবতীয়
যোগ্যতা আর সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগানোই হচ্ছে এর সঠিক পন্থা। এজন্যে দরকার
বৈজ্ঞানিক কর্মসূচী। যে কর্মসূচীর মাধ্যমে আজকের ছাত্ররা সবচেয়ে যোগ্যরূপে গড়ে
উঠতে পারবে। আর কঠিন সাধনায় গড়ে তোলা যোগ্যতা এবং ব্যক্তিত্বকে মহান পথে লাগাবে।
তাই শিবিরের পাঁচ দফা কর্মসূচী রয়েছে।
এক: দাওয়াত
এ দফার কাজ সাধারণ
ছাত্রদেরকে ইসলামের সঠিক দাওয়াত দেয়া, ইসলাম
সম্পর্কে পড়াশুনা করার জন্যে তাদেরকে উৎসাহিত করা আর তাদের মাঝে ইসলাম মেনে চলার
অভ্যাস সৃষ্টি করা।
দুই: সংগঠন
যারা ইসলামের দাওয়াত
গ্রহণ করে নিজেদের জীবনে একে মেনে চলে এবং পৃথিবীর মাঝে একে প্রতিষ্ঠার মহান
সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় তাদেরকে সংঘবদ্ধ করাই এ দফার কাজ।
তিন: প্রশিক্ষণ
যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার
জন্যে সংঘবদ্ধ হবে তাদেরকে সাহাবায়ে কিরামের আদর্শ অনুযায়ী তৈরি হতে হবে।
তাদেরকে উন্নত নৈতিক আর চারিত্রিক যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। তাদেরকে দুনিয়ার
সবকিছু রাস্তায় কুরবানী করায় অভ্যস্ত হতে হবে। তাদেরকে ভাল ছাত্রও হতে হবে যাতে
সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তারা ইসলাম কায়েমের পথ সুগম করতে পারে।
তাই এসব ধরণের যোগ্যতা ও অনুভূতি সৃষ্টি করার জন্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া এ
দফার কাজ।
চার: শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন ও
ছাত্র সমস্যার সমাধান
বর্তমান শিক্ষা
ব্যবস্থা আমাদেরকে যোগ্য নাগরিক, চরিত্রবান মানুষ
এবং উপযুক্ত মুসলমান হবার শিক্ষা দেয় না। তাই সমাজে ইসলাম কায়েমের জন্যে চাই
ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা যার মাধ্যমে ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের সৈনিক তৈরি হবে। যারা
উপযুক্ত শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, চাকুরিজীবি,
ডাক্তার প্রভৃতি হবার সাথে সাথে একজন যথার্থ মুসলিম এবং যোগ্য সৈনিক
হবেন। তাই ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যে সংগ্রাম করা এ দফার কাজ। ইসলাম
প্রতিষ্ঠাই মানবতার সবচেয়ে বড় খিদমত। খিদমত যারা করবেন তারা মানবতার উপকারের সকল
সুযোগই কাজে লাগাবেন। তাই ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রশিবির এ দফায় ছাত্রদের প্রকৃত
সমস্যার সমাধানে সার্বিক প্রচেষ্টা চালানোর সিদ্ধান্তও নিয়েছে।
পাঁচ: ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ ও
মানবতার মুক্তি
পূর্ববর্তী দফার
কাজগুলোর মাধ্যমে এমন নেতৃত্ব ও কর্মীবাহিনী তৈরি হবে, যারা ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ ও ইসলামী সমাজ পরিচালনায় যাবতীয়
যোগ্যতার অধিকারী হবেন। তাই এ যোগ্য জনশক্তিকে সে দায়িত্ব পালনে সুষ্ঠুভাবে
পরিচালিত করা এ কর্মসূচীর কাজ। সমাজে, রাষ্ট্রে ইসলাম বিরোধী
যে কোন তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রয়োজনে প্রতিরোধ গড়ে তোলাও এ দফার অন্তর্ভূক্ত।
বিশ্বব্যাপী
পুর্নজাগরণ
আজ বিশ্বব্যাপী ইসলামের পূনর্জাগরণ
দেখা দিয়েছে। এ পুনর্জাগরণে নেতৃত্বে দিচ্ছে মুসলিম যুবকেরা। দুনিয়ার দেশে দেশে
জাগরণ শুরু হয়েছে। হাজারো লাখো তরুণ উচ্চশিক্ষিত যুবক সংগ্রামী প্রেরণা নিয়ে
রাস্তায় এগিয়ে আসছেন। পরিবারের ভালবাসা,দুনিয়ার
মোহ-সব কিছু ত্যাগ করে তারা রাস্তায় নিজেদেরকে উৎসর্গ করে দিচ্ছেন,অনেক যুবক এ সংগ্রামে শাহাদাতও বরণ করেছেন। ইরান, পাকিস্তান,
মিশর, সুদান, তুরস্ক,
মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত এবং দুনিয়ার অন্য সকল দেশের শত-সহস্র তরুণের মহা-বিপ্লবী প্লাবনের
ধাক্কায় মজলুম মানবতার রক্তে গড়া ক্রেমলিন আর পেন্টাগনের উঁচু উঁচু প্রাসাদগুলো
ভেঙে ভেঙে পড়ে প্রায়। জয়গান মানুষের কণ্ঠে দিকে দিকে মুখরিত হয়ে উঠেছে। ইসলামী
ছাত্রশিবিরের সংগ্রাম বিশ্বময় প্লাবনের সাথে একাত্ম ও একাকার হয়ে গেছে। আজ সময়
এসেছে মুক্তির কাক্সিক্ষত মঞ্জিলের দিকে এগিয়ে যাবার। তাই বাংলাদেশের সংগ্রামী
ছাত্রসমাজকেও আজ ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে পরিচালিত এ মহাসংগ্রামে এগিয়ে আসতে
হবে। জাহেলিয়াতের প্রাসাদকে ইউসুফ (আ) এর চরিত্র নিয়ে রুখতে হবে। খতম করতে হবে
শত বছরের খোদাদ্রোহী শক্তির জুলুমশাহীকে। গড়তে হবে রাসূলের (সা) আদর্শে, মদীনার অনুকরণে নতুন পৃথিবী। আর এগিয়ে যেতে হবে পথে, চির ও চূড়ান্ত মঞ্জিল জান্নাতের পথে।
--- সমাপ্ত
----
এসো আলোর পথে বইটি পিডিএফ ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন।
No comments:
Post a Comment
আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।