বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
ভূমিকা
সাহাবা কারা?
‘সাহাবী’ শব্দটি আরবী ভাষার ‘সুহবত’ শব্দের একটি রূপ। একবচনে ‘সাহেব’ ও ‘সাহাবী’ এবং বহুবচনে ‘সাহাব’ ব্যবহৃত হয়। আভিধানিক অর্থ সংগী, সাথী, সহচর, এক সাথে জীবন যাপনকারী অথবা সাহচর্যে অবস্থানকারী। ইসলামী
পরিভাষায় ‘সাহাবা’ শব্দটি দ্বারা রাসূলুল্লাহর সা. মহান সংগী-সাথীদের বুঝায়। ‘সাহেব’ শব্দটির বহুবচনের
আরো কয়েকটি রূপ আছে। তবে রাসূলুল্লাহর সা. সংগী-সাথীদের বুঝানোর জন্য ‘সাহেব’-এর বহুবচনে ‘সাহাবা’ ছাড়া ‘আসহাব’ ও ‘সাহব’ও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
আল্লামা ইবন হাজার রাহ. ‘আল-ইসাবা ফী
তাময়ীযিস সাহাবা’ গ্রন্থে সাহাবীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে
বলেনঃ ইন্নাস সাহাবিয়্যা মান লাকিয়ান নাবিয়্যা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা
মু’মিনান বিহি ওয়া মাতা আলাল ইসলাম’- অর্থাৎ সাহাবী সেই ব্যক্তি যিনি রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি
ঈমান সহকারে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং ইসলামের ওপরই মৃত্যুবরণ করেছেন।
উপরোক্ত সংজ্ঞায় সাহাবী হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে।
১. রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি ঈমান ২. ঈমানের অবস্থায় তাঁর সাথে সাক্ষাৎ (আল-লিকা) ৩.
ইসলামের ওপর মৃত্যুবরণ (মাউত ’আলাল ইসলাম)।
প্রথম শর্তটি দ্বারা এমন লোক সাহাবী বলে গণ্য হবে না যারা রাসূলুল্লাহর সা.
সাক্ষাৎ তো লাভ করেছে কিন্তু ঈমান আনেনি। যেমনঃ আবু জাহল, আবু লাহাব প্রমূখ মক্কার কাফিরবৃন্দ।
দ্বিতীয় শর্ত অর্থাৎ সাক্ষাৎ দ্বারা এমন ব্যক্তিও সাহাবী বলে গণ্য হবেন, যিনি হুজুরের তো সাক্ষাৎ লাভ করেছেন, কিন্তু অন্ধত্ব বা এ জাতীয় কোন অক্ষমতার কারণে চোখে দেখার
সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যেমনঃ অন্ধ সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা.।
তৃতীয় শর্ত অর্থাৎ মাউত ’আলাল ইসলাম দ্বারা
এমন লোকও সাহাবীদের দলে শামিল হবেন, যাঁরা ঈমান অবস্থায়
রাসূলুল্লাহর সা. সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হয়েছেন। তারপর মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) হয়েছেন।
তারপর আবার ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন। পুনরায় ইসলাম
গ্রহণের পর নতুন করে রাসূলুল্লাহর সা. সাক্ষাৎ লাভ না করলেও তিনি সাহাবী বলে গণ্য
হবেন। এটাই সর্বাধিক সঠিক মত। যেমনঃ হযরত আশয়াস ইবন কায়েস রা. ও আরো অনেকে। হাদীস
বিশারদগণ আশয়াস ইবন কায়েসকে সাহাবীদের মধ্যে গণ্য করে তাঁর বর্ণিত হাদীস সহীহ ও
মুসনাদ গ্রন্থসমূহে সংকলন করেছেন। অথচ তিনি ইসলাম গ্রহণের পর মুরতাদ (ধর্মত্যাগী)
হয়ে যান এবং হযরত আবু বকরের রা. খিলাফতকালে আবার ইসলামে ফিরে আসেন।
শেষোক্ত শর্তের ভিত্তিতে এমন ব্যক্তি সাহাবী বলে গণ্য হবেনা যে ইসলামের অবস্থায়
রাসূলুল্লাহর সা. সাক্ষাৎ লাভ করেছে, কিন্তু পরে মুরতাদ
অবস্থায় মারা গেছে। যেমনঃ আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ আল-আসাদী। সে মুসলমান হয়ে হাবশায়
হিজরাত করার পর খৃস্টান হয়ে যায় এবং সেখানে মুরতাদ অবস্থায় মারা যায়। তাছাড়া
আবদুল্লাহ ইবনে খাতাল, রাবীয়া ইবন উমাইয়্যা প্রমুখ মুরতাদ
ব্যক্তিবর্গ। সাহাবী হওয়ার জন্য ইসলামের ওপর মৃত্যুবরণ শর্তটি উল্লেখিত
ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।
উপরোক্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী, ঈমান সহকারে
রাসূলুল্লাহর সা. সাথে সাক্ষাতের পর তাঁর সাহচর্য বেশী বা অল্প দিনের জন্য হউক, রাসূলুল্লাহর সা. থেকে কোন হাদীস বর্ণনা করুক বা না করুক, রাসূলুল্লাহর সংগে কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করুক বা না করুক, এমন কি যে ব্যক্তির জীবনে মুহূর্তের জন্য রাসূলুল্লাহর সা.
সাক্ষাত লাভ ঘটেছে এবং ঈমানের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে, এমন সকলেই সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত।
যারা রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি ঈমান আনেনি; কিন্তু পূর্ববর্তী
অন্য কোন নবীর প্রতি ঈমান সহকারে রাসূলুল্লাহর সা. সাক্ষাৎ লাভ করেছে, তারা সাহাবী নয়। আর ‘বুহাইরা’ রাহিবের মত যাঁরা পূর্ববর্তী কোন নবীর প্রতি ঈমান সহকারে
রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত লাভের পূর্বে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং বিশ্বাস করেছেন, তিনি ভবিষ্যতে নবী হবেন- এমন ব্যক্তিদের সাহাবা হওয়া
সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। মুসলিম মনীষীরা তাঁদের সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করতে
পারেননি।
উল্লেখিত সংজ্ঞার শর্তাবলী জ্বীনদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
জ্বীনরাও ‘সাহাবা’ ছিলেন। কুরআন মজিদে এমন কিছু জ্বীনের কথা বলা হয়েছে যাঁরা
রাসূলুল্লাহর সা. কুরআন তিলাওয়াত শুনে ঈমান এনেছিলেন। নিঃসন্দেহে তারা অতি
মর্যাদাবান সাহাবা ছিলেন।
সাহাবীর উল্লেখিত সংজ্ঞাটি ইমাম বুখারী, ইমাম আহমাদ ইবন
হাম্বলসহ অধিকাংশ পণ্ডিতের নিকট সর্বাধিক সঠিক বলে বিবেচিত। অবশ্য সাহাবীর সংজ্ঞার
ক্ষেত্রে আরো কয়েকটি অপ্রসিদ্ধ মতামতও আছে। যেমন, কেউ কেউ
সাক্ষাতের (আল-লিকা) স্থলে চোখে দেখার (রু’ইয়াত) শর্ত আরোপ
করেছেন। কিন্তু তাতে এমন সব ব্যক্তি বাদ পড়ে যাবেন যাঁরা মুমিন হওয়া সত্ত্বেও
অন্ধত্বের কারণে রাসূলুল্লাহকে সা. চোখে দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যেমনঃ
আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম রা.। অথচ তিনি অতি মর্যাদাবান সাহাবী ছিলেন।
হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব বলেনঃ সাহাবী হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে, এক বা দু’বছর রাসূলুল্লাহর
সা. সাহচর্য অথবা তাঁর সাথে দু’একটি গাযওয়া বা
যুদ্ধে অংশগ্রহণ। কিছু সংখ্যক উলামায়ে উসূল ও উলামায়ে ইলমুল কালাম-এর মতে, সাহাবী হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে, রাসূলুল্লাহর সা. দীর্ঘ সাহচর্য ও সুন্নাতে নববীর সা.
অনুসরণের ক্ষেত্রে তাঁর পরিচিতি ও খ্যাতি। কেউ কেউ আবার বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার শর্ত
আরোপ করেছেন। একদল আলিমের মতে যে ব্যক্তি বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর এক নজর রাসূলুল্লাহকে
সা. দেখেছেন, তিনি সাহাবী। আর যিনি বয়ঃপ্রাপ্ত
হওয়ার পূর্বে রাসূলুল্লাহকে সা. দেখেছেন, তিনিও সাহাবী। তবে এ
হিসেবে যে, রাসূল সা. তাকে দেখেছেন। তিনি
রাসূলকে সা. দেখেছেন সে হিসেবে নয়। কিন্তু হাদীস বর্ণনার দিক দিয়ে এমন ব্যক্তি
সাহাবী নন, বরং তাবঈর মর্যাদা লাভ করবেন।
প্রশ্ন হতে পারে, যদি কেউ রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকালের
পর দাফনের পূর্বে তাকে দেখে থাকেন, যেমনটি ঘটেছিল
প্রখ্যাত আরবী কবি ‘আবু জুয়ারিব আল-হুজালীর’ ক্ষেত্রে- তাঁর ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত হবে? আলিমদের মধ্যে এ ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। তবে গ্রহণযোগ্য মত
হলো, এমন ব্যক্তি সাহাবীদের দলভুক্ত হবেন না।
ইসলামী বিশেষজ্ঞগণ এ ব্যাপারে একমত যে, রাসূলুল্লাহর সা.
সাহচর্য বা ‘সুহবত’ এমন একটি মর্যাদা, যার সমকক্ষ আর কোন
মর্যাদা মুসলমানদের জন্য নেই। সুহবতের মর্যাদা ছাড়াও দ্বীনের ভিত্তিকে শক্তিশালী ও
মজবুত করা, ইসলামের তাবলীগ ও শরীয়াতের খিদমতের
ক্ষেত্রে কঠোর শ্রমদান ও আত্মত্যাগের কারণে প্রতিটি মুসলমানের কাছে সাহাবায়ে
কিরামের একটি পবিত্র ও উচ্চ মর্যাদা আছে। এ কারণে কোন কোন আলিমের মতে সাহাবীদেরকে
হেয় প্রতিপন্নকারী ব্যক্তি ‘যিন্দীক’। আবার কারো মতে, এটা একটি
শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
------------------সাহাবায়ে কিরামের
আদর্শ সমাজের অনুরূপ সমাজ যদি আজ আমরা গড়তে চাই, আমাদের
অবশ্যই তাঁদের সম্পর্কে জানতে হবে। তাঁদের মত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতা অর্জন
করতে হবে। বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে কুরআনী সমাজ গড়ার যে চেতনা দেখা যাচ্ছে, তাকে সঠিক লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যেতে হলে সাহাবীদের জীবনীর
ব্যাপক চর্চা হওয়া দরকার। তাঁদের জীবন থেকেই দিক নির্দেশনা নিতে হবে। কিন্তু
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাঙ্গালী মুসলিম সমাজে সাহাবীদের
জীবনের চর্চা খুব কম। এখানে পীর-আওলিয়ার জীবনের কাল্পনিক কিস্সা-কাহিনী যে পরিমাণে
আলোচিত হয় তার কিয়দংশও সাহাবীদের জীবনীর আলোচনা হয়না।
আরবী-উর্দুসহ পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায় সাহাবীদের জীবনীর ওপর বহু বড় বড় গ্রন্থ
রচিত হয়েছে। ইসলামী সাহিত্যের অন্যান্য শাখার ন্যায় এক্ষেত্রেও বাংলা ভাষায়
উল্লেখযোগ্য তেমন কোন গ্রন্থ রচিত হয়নি। মাসিক ‘পৃথিবী’-র নির্বাহী সম্পাদক ও বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টারের পরিচালক
অধ্যাপক নাজির আহমদ তাঁর পত্রিকার মাধ্যমে সাহাবীদের জীবনের কিছু কথা পাঠকদের কাছে
তুলে ধরার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মূলতঃ তাঁরই উৎসাহে আমি ধারাবাহিকভাবে ‘পৃথিবী’র পাতায় লিখতে থাকি।
‘পৃথিবী’র পাতার লেখাগুলিই ‘আসহাবে রাসূলের জীবনকথা’ নামে বই আকারে
প্রকাশিত হচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে লেখা ও বই আকারে প্রকাশের ব্যাপারে অধ্যাপক নাজির
আহমদের উৎসাহ ও ভূমিকা না থাকলে হয়তো আমি কখনো লিখতাম না এবং বই আকারেও প্রকাশও
হতো না। তাই দু’আ করি, আল্লাহ তা’আলা তাঁকে উত্তম
বিনিময় দান করুন।
‘আসহাবে রাসূলের জীবনকথা’র প্রথম খণ্ডে মোট তিরিশজন সাহাবীর জীবনের আলোচনা এসেছে।
তাঁরা সকলেই মুহাজিরীন তাবকার অন্তর্ভুক্ত। তাঁদের মধ্যে ‘আশারা মুবাশ্শারা’র সেই গৌরবান্বিত দশ
জন সাহাবীও সন্নিবেশিত হয়েছেন। লেখাগুলো সংক্ষিপ্ত হলেও তথ্যসমূহ আরবী-উর্দুর মূল
সূত্রসমূহ থেকে গৃহীত হয়েছে। বিতর্কিত বিষয় যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি।
এই হলো আসহাবে রাসূলের জীবনকথা বইয়ের প্রথম খন্ডের ভূমিকা থেকে চুম্বক।
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা-১ম খন্ড
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা-২য় খন্ড
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা-৩য় খন্ড
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা-৪র্থ খন্ড
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা-৫ম খন্ড
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা-৬ষ্ট খন্ড
📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘
আমার প্রিয় বাংলা বই হোয়াইটসআপ গ্রুপে যুক্ত হতে এখানেক্লিক করুন, টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং ফেইসবুক গ্রুপে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
No comments:
Post a Comment
আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।