শাহ আব্দুল হান্নান। যার পরিচয় দেয়ার জন্য কোন বিশেষণের প্রয়োজন নাই। আর বিশেষণ দিতে গেলে কোনটা রেখে কোনটা দেই। কারণ তিনি তার পরিচয়ের সকল ক্ষেত্রে ছিলেন সূউচ্চ চূড়ায়। তাই শাহ আব্দুল হান্নান নামেই উনি সকলের কাছে পরিচিত সমাদৃত।
২ জুন ২০২১ তারিখের সকাল ১০টায় তিনি দুনিয়ার সফর শেষ করে তার মালিকের দরবারে উপস্থিত হয়েছেন। তার ইনতিকালে তার সহকর্মী, তার অনুজ অনেকেই অনেক কথা লিখেছেন। তার মধ্যে বাছাইকৃত কিছু লিখা নিয়ে আমাদের এই প্রতিবেদন।
শাহ আব্দুল হান্নান
চাচাঃ অনুপ্রেরণাদায়ক কিছু
স্মৃতি ও কিছু কথা
লেখক: আব্দুদ্দাইয়ানমুহাম্মদ ইউনুছ
আমি ১৯৮০ এর দশকে ইসলামী
অর্থনীতিতে সরকারের ভুমিকা বইটি যখন পড়ি তখন শাহ আব্দুল হান্নান-কে
(১৯৩৯-২০২১)জানতাম একজন অর্থনীতিবিদ, ইসলামী চিন্তাবিদ,
লেখক, গবেষক ও বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ
একজন আমলা হিসাবে।ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয় ১৯৯৬ সালে। তখন
আমি ঢাকায় কলাবাগান থাকতাম। তারপর থেকেই তাঁকে চাচা ডাকি। ২০০০ সালে আমি লন্ডন
আসার পর যতবারই দেশে গিয়েছি প্রায়ই চাচার সান্নিধ্যে কিছু সময় কাটানোর চেষ্টা
করতাম। চাচা যুক্তরাজ্যে বসবাসরত তাঁর চেনা-জানা লোকজনদের খোঁজখবর নিতেন আর দাওয়াহ
কাজের অবস্থা জানতেন। আর আমিও বাংলাদেশসহ মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন বিষয়ে চাচার
মতামত জানার চেষ্টা করতাম এবং নোট করতাম। মাঝে মধ্যে ইমেইল এ চাচার সাথে যোগাযোগ
হতো। মূলত ইমেইলে দাওয়াহ কাজ ও যোগাযোগে চাচা ছিলেন অনন্য।
চাচা ছিলেন আমার অভিাবক, মেন্টর,গাইড ও অনুপ্রেরণার উতস। তিনি বিভিন্ন
অর্থ-সামাজিক, একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন। তাঁর
অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি অনেক বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। ১২/১০/২০০৬ ‘ফাউন্ডেশন ফর ইসলামিক নলেজ এন্ড রিসার্চ’ (ফিকর)
গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন মিলনায়তনে ‘ইসলামী গবেষণা ও প্রকাশনা সংস্থার সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শিরোনামে একটি কর্মশালা এবং ‘ইসলামের প্রচার ও
প্রসারে গবেষণা ও প্রকাশনা সংস্থার ভূমিকা’ শীর্ষক একটি
আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। কবি আল মাহমুদ এবং চাচা উক্ত প্রোগ্রামে অতিথী ছিলেন।চাচা
গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ‘‘ এ যুগ হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগ। এ
যুগে যেসব দেশ নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে সবার চেয়ে এগিয়ে। সে সব দেশে
সামাজিক সমসা ব্যাপক এবং নৈতিকতার মারাত্মক বিপর্যয়ের সন্মুখীন হওয়া সত্বেও কেবল
জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসর হওয়া এবং উচ্চতর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কারণে
বিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমাদের জন্য পাশ্চাত্যের মূল চ্যলেঞ্জ হচ্ছে
বৃদ্ধিবৃত্তিক। তারা প্রশ্ন তুলছে যে ইসলামে মানবাধিকার নেই। নারীর অধিকার বিপন্ন।
সেক্যুলার ব্যবস্থা শ্রেষ্ঠ ইত্যাদি। এসব অসংখ্য প্রশ্নের বৃদ্ধিবৃত্তিক এবং
একাডেমিক জবাব দিতে হবে। মুসলিম বিশ্বের সামনে অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে অসংখ্য
যোগ্য লোক বিশেষ করে রহঃবষষবপঃঁধষ তৈরী করা।আমাদের জন্য উসওয়ায়ে হাসানাহ হচ্ছেন
আখেরী নবী সাইয়্যিদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ (সা)। আমরা শাহ আব্দুল হান্নান সাহেব
এর জীবনী আলোচনা করছি এইজন্য যে, আল্লাহর রাসুল (সা) বলেছেন ,
উযকুরু মাহাসিনা আমওয়াতিকুম‘ তোমরা তোমাদের
মৃতদের ভাল দিকগুলো আলোচনা করা। কারো মুত্যুর পর তার ভাল বা মন্দ কাজের
স্বতস্ফুর্ত সাক্ষী দিয়ে মানুষ ভাল বা মন্দ যে মন্তব্য করে আল্লাহর ফেরেশতারা তা
রেকর্ড করে। আল্লাহ তায়ালা তা শোনেন। শাহ আব্দুল হান্নান চাচার মৃত্যুর পর দলমত
নির্বিশেষে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যেভাবে দুআ হচ্ছে এমন সৌভাগ্য কয়জনের হয়?
তিনি জীবিত অবস্থায় হ্রদয় দিয়ে সকল স্তরের মানুষকে ভালবাসতেন। তাঁর
মৃত্যুর পর প্রমানিত হয়েছে যে তাঁকে অসংখ্য মানুষ কত বেশী ভালবাসে? মানুষের এই ভালবাসার বহিপ্রকাশ এই কথাই প্রমান করে যে , তিনি আল্লাহর মাহবুব বান্দাহদের একজন। তাই তাঁর জীবন থেকে আমাদের জন্য
শিক্ষনীয় দিকগুলো আলোচনা করা গুরুত্বের দাবীদার। কারণ আজকের পৃথিবীতে ৮ বিলিয়ন এর
মত মানুষ আছে। কিন্ত আদর্শ মানুষ কতজন আছে ? সমাজে আদর্শ
মানুষের বড় অভাব। উন্নত চিন্তার অধিকারী মহত মানুষের অভাবেই আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা
করা যাচ্ছেনা। যারা আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চান তাদেরকে শুধু সত হলে চলবেনা।
সততার সাথে যোগ্যতা ও দক্ষতার সমন্বয় থাকতে হবে। আদর্শ সমাজ গঠন করতে হলে শাহ
আব্দুল হান্নানের মত সত, যোগ্য, দক্ষ,
বহু-মুখী মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মহত মানুষ হতে হবে।
আমরা আসহাবে রাসুল দেখিনি।
তাবেঈ-তাবঈ তাবেঈী দেখেনি। কিন্তু তাঁদের জীবনী পড়েছি। শাহ আব্দুল হান্নান এর সততা,অনাড়ম্বরজীবন যাপন, আমানতদারীতা, উদারতা, মহানুভবতা, সময়
ব্যবস্থাপনা, সঠিক কথা স্পষ্টভাষায় বলা, আদর্শের প্রতি দৃঢ়তা, কথা ও কাজের মিল থাকা, মুআমেলাত ও কুরআন-সুন্নাহর সঠিক বুঝ এবং তার প্রচারে সার্বক্ষনিক
প্রচেষ্টাসহ নানাবিধ গুণাবলীর প্রতি লক্ষ্য করলে এই কথা আমার হ্রদয় সাক্ষ্য দিচ্ছে
যে, তাঁর চরিত্রে আসহাবে রাসুলের বাস্তব অনুসরণের অনেক নমুনা
পাওয়া যায়। যা বর্তমান সময়ে অনেক জ্ঞানী-গুণীদের জীবনে দেখা যায়না। অনেক গুণী
মানুষের কাছে গেলে তার প্রতি পোষণ করা শ্রদ্ধায় ভাটা পড়ে। কিন্তু চচা ছিলেন
ব্যতিক্রম। তাঁর কাছে গেলে আরও কাছে যেতে মন চাইতো।
প্রতিবারই দেখা হলে শ্রদ্ধা
বৃদ্ধি পেতো। ইমাম ইবনে তাইমিয়ার ক্লাসে যেমন প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চিন্তার খোরাক
পাওয়া যেতো চাচার সাথে আলাপ -আলোচনায় সব সময় নতুন কিছু চিন্তার খোরাক মিলতো। তিনি
সব সময় উপেদেশ দিতেন, আমাদেরকে অধিক পড়াশুনা, অধিক লেখ এবং অধিক দাওয়াতের কাজ করতে হবে।চাচা বাংলাদেশ সরকারের সচিব,
জাতীয় রাজস্ববোর্ডের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ
ব্যংকের ডেপুটি গভর্ণর এর মত গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব পালন শেষে ইসলামী ব্যংকের
চেয়ারম্যান, মানারাত বিশ্ববিদ্যালয় ও ইবনে সীনার
ট্রাস্টিবোর্ডের চেয়ারম্যানসহ বহুগুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব পালণ করেন। এর মধ্যেও তিনি
অসংখ্য মানুষকে ব্যক্তিগত সাহচর্য্য দিয়েছেন। আমার ভাবতে অবাক লাগে
আমার মত একজন নগন্য ব্যক্তির
কয়েকটি বই তিনি সম্পাদনার সময় পেলেন কি করে? সমাজ সংগঠন
ইসলামী দৃষ্টিভংগী,ভারসাম্যপুর্ণজীবন ও সময় ব্যবস্থাপনা বইতে
তিনি অভিমত লিখেছেন। ক্যরিয়ার গঠন ও দক্ষতা উন্নয়ন মুসলিম যুব সমাজে সময়ের দাবী,
মানুষের শেষ ঠিকানা ও সাইয়েদ কুতুব জীবন ও কর্মসহ বিভিণ্ণ বিষয়ে দিক
নির্দেশনা দিয়ে আমাকে উতসাহিত করে বলতেন , ‘‘ চাচু তোমাকে
কারজাভী হতে হবে‘‘। যদিও তাঁর আশে পাশে যাওয়া আমার পক্ষে
সম্ভব হয়নি। কিন্তু চাচার দেয়া ভিশন, উতসাহ, মোটিভেশন, বাস্তব গাইডলাইন আমার জীবনে গুরুত্বপুর্ণ
ভুমিকা পালন করছে। তিনি আমার দেখা ভাল মানুষদের মাঝে অন্যতম সেরা ভালমানুষ। আমার
দৃষ্টিতে তিনি প্রচলিত অর্থে নেতা ছিলেননা বরং অনেক নেতার মেন্টর ছিলেন। তাঁর কোন
পিএইচডি ডিগ্রি ছিলনা। কিন্তু অসংখ্য পিএইচডি ডিগ্রিীধারীর তিনি বাস্তব গাইড
ছিলেন। আমি মনে করি তাঁর জীবনের বিভিণœ দিক ও চিন্তাধারা
নিয়ে পিএইচডি গবেষনাসহ রিসার্চ হওয়া দরকার। তিনি কুরআন- সুন্নাহর টেক্ট বর্তমান
কনটেক্ক্রট এর আলোকে বুঝতে এবং প্রয়োগ করার প্রবক্তা ছিলেন। তাঁর চিন্তা, ভাষা ও উপস্থাপনায় ছিল ওয়াসাতিয়্যাহ মানহাজের বহিপ্রকাশ। উগ্রতা বা
গোঁড়ামী তিনি সাপোর্ট করতেননা আবার ফাহেশা-অশ্লীলতা বন্ধে তিনি ছিলেণ আপোষহীন।
তিনি সরকারের সর্বোচ্চপর্যায়ের
দায়িত্ব পালন করে দুর্নীতি ত দুরের কথা বৈধভাবে ঢাকায় একটি প্লট পাওয়ার সুযোগ
থাকলেও তা গ্রহণ করেননি। তিনি বলেছেন, ‘‘ ঢাকায় গোড়ানে
আমার পৈত্রিক সম্পদে আমার অংশ আছে। ঢাকায় আমার কিছু নেই এই ধরনের মিথ্যা কাগজে
সাক্ষর আমি দিতে পারবনা। আর আমি মাসিক কিস্তির টাকাই বা কিভাবে পরিশোধ করব‘‘?
আমি তাঁর সেগুণ বাগিচার বাসাতেও গিয়েছি এবং গোড়ানের বাসাতেও গিয়েছি।
ভোগ বিলাস পরিহার করে সাদা-সিধে জীবন যাপন করেতিনি আজ সকলের শ্রদ্ধা ও অনুপ্রেরণার
উতস।
আমরা অনেক সময় অপরের সমালোচনায়
প্রচুর সময় নষ্ট করি এবং হর-হামেশা গীবত করি। আমি চাচাকে কখনও কারো গীবত করতে
দেখেনি। তিনি সব সময় সকলের ইতিবাচক দিক নিয়ে কথা বলতেন। তিনি অনর্থক বা
অপপ্রয়োজনীয় কথা বলতেননা।শুধু অর্থের অপচয় নয় তিনি কথা বলার সময় শব্দের অপচয়
করেছেন আমি তা দেখেনি। তিনি অনেক বড় বড় বা জটিল বইর সার সংক্ষেপ বোধগম্য ভাষায়
সংক্ষেপে প্রচার করতেন। ফিকহসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর মতের যারা সমালোচনা করতো তিনি
তাদের প্রতিও ছিলেণ শ্রদ্ধাশীল। তাঁর চিন্তার কোন ভুল সঠিক প্রমানসহ কেউ ধরিয়ে
দিলে সাথে সাধেথ সংশোধন করে নিতেন।অহেতুক বিতর্ক করতেননা। ইখতিলাফ যেন ইফতেরাক তথা
বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে না যায় তিনি তা বারবার বলতেন।
শাহ আব্দুল হান্নান চাচার অনেক
গুণাবলী রয়েছে। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে তাঁর বড় গুণ হচ্ছে, তিনি ছিলেন সত্যিকারের দায়ী ইলাল্লাহ। শুধু মৌখিক দাওয়াত নয় বরং বাস্তব
জীবনে সত্যের সাক্ষ্য ছিলেন। যার কাছে সব সময় অপরকে দাওয়াত দেয়ার জন্য কোন বই বা
আর্টিকেল থাকতো। যিনি হাসপাতালে ডাক্তার-নার্সদের মাঝে দাওয়াত দিতেন। রিকশায় চলতে
রিকশা চালককেও দাওয়াত দিতেন। আবার বড় বড় সরকারী আমলাদেরকেও দাওয়াত দিতেন। তিনি
সর্বস্তরের মানুষের কাছে সার্বক্ষনিক দায়ী ছিলেন। তাঁর অনেক অবদান রয়েছে। সদকায়ে
জারিয়ার অনেক কাজ তিনি করেছেন। তিনি অনেক প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে
তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে তিনি ছিলেন আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগর; তিনি অনেক লোক তৈরী করেছেন। পৃথিবীতে অনেক যোগ্য মানুষ আছেন। কিন্তু শাহ
আব্দুল হান্নান চাচার মত কয়জন আছেন যারা সত যোগ্য লোক তৈরীকে জীবনের মিশন হিসাবে
গ্রহণ করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অসংখ্য তুরণ-তরূনী আজ তাঁর জন্য অশ্রুসিক্ত
নয়নে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করছে। তিনি মানুষের সমস্যা সমাধানে ছিলেণ অত্যন্ত
আন্তরিক। আমার মনে পড়ে ২০১৪ সালে তিনি আমাকে ইমেইল করেছেন এবং ফোন করেছেন তাঁর
কাছে যাওয়া একজন ভাইয়ের একটি সমস্যা সমাধানে আমি কিছু করতে পারি কিনা?
মানুষ মরণশীল। কার কখন মরণ হবে
জানিনা। মৃত্যুই পৃথিবীর সব চেয়ে বড় বাস্তবতা। মানুষের মৃত্যুর পর চেনা-জানা
মানুষেরা কিছু দিন শোকাহত থাকে। তারপর আস্তে আস্তে ভুলে যায়। কিন্তু পৃথিবীতে কিছু
মানুষ জন্ম নেয় তারা মরেও হ্রদয়ে অমর থাকে। তাদের চিন্তা ও কর্মের প্রভাব জীবিত
থাকার সময়ের চেয়েও অনেক সময় মরণের পর বেশী অনুভত হয়। শাহ আব্দুল হান্নান এমন একজন
ব্যক্তি যিনি মৃত্যু বরণ করার পরও সকলের হ্রদয় রাজ্যে অমর। যাঁর চিন্তা ও কর্ম
অসংখ্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। তাই সকলের হ্রদয়ে আজ রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সকলেই
অশ্রুভেজা নয়নে মনীবের দরবারে ফরিয়াদ করছে, ‘‘হে আরশে আজীমের
মালিক শাহ আব্দুল হান্নানের সকল নেক আমল সমূহ কবুল কর। মানবিক দুর্বলতাসমূহ ক্ষমা
করে দাও।তাঁকে রহমতের চাদরে জড়িয়ে জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা দান কর‘। হে আল্লাহ শাহ আব্দুল হান্নান যে ভাবে সদকায়ে জারিয়ার অনেক কাজ করেছেন।
আমাদেরকে সদকায়ে জারিয়ার কিছু কাজ করার তাওফিক দান কর। হে আল্লাহ আমাকে এমনভাবে
আমরণ আমলে সালেহ করার তাওফিক দান কর যাতে জান্নাতে তোমার নেক বান্দাহরা যখন তোমার
দীদার লাভ করবে আমিও তাদের সাথে জান্নাতে তোমাকে দেখতে পারি। আমীন
টিনের বাক্স ও শূন্য হস্তের
একজন ডেপুটি গভর্নরের লুপ্ত কথা
লেখক: মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান
সচিব এবং উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের
ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান,
বারিধারা, উত্তরা, পূর্বাচল,
লালমাটিয়া, ডিওএইচএসে অট্টালিকা, প্লট, ফ্ল্যাট থাকে। বাগানবাড়ি থাকে গরু-মহিষের বাথান,
চিংড়ি ঘের, রিসোর্ট, ইন্ডাস্ট্রি
ইত্যাদি নানান কিছু থাকে। আবার অনেকের নিউইয়র্ক, টরন্টো,
দুবাই, সিঙ্গাপুর, হিউস্টনে
অ্যাপার্টমেন্ট, বাড়ি, মলের মালিকানা থাকে।
শাহ আব্দুল হান্নানের কিছুই ছিল না অথচ তিনি শুল্ক ও আবগারি বিভাগের কালেক্টর,
দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালক, জাতীয় রাজস্ব
বোর্ডের সদস্য এবং চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর,
অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও ব্যাংকিং বিভাগের সচিব ছিলেন।
তার শেষ ঠাই ছিল পিতা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে
প্রাপ্ত ভাইবোনদের সঙ্গে যৌথ
মালিকানায় উত্তর গোড়ানে গড়ে তোলা বাড়ি। কয়েক মাস আগে করোনা থেকে আরোগ্য লাভ করলেও গতকাল বুধবার তিনি ইন্তেকাল
করেন। শাহ আব্দুল হান্নানের রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে তর্কবিতর্ক থাকতে পারে। তাঁকে নিয়ে
আমার এই লেখা। ব্যক্তিগত সম্পর্কের স্মৃতিচারণা। তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৬৬
বা '৬৭ সালে চট্টগ্রাম মুসলিম ইনষ্টিটিউট হলে ঈদে মিলাদুন্নবীর এক অনুষ্ঠানে। তখন তিনি চট্টগ্রাম শুল্ক
ভবনে ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। সে অনুষ্ঠানে যত দূর মনে পড়ে, চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান কমোডর আসিফ আলভীও ছিলেন। তারপর ১৯৭৯ সালে
আমি নিজে শুষ্ক ও আবগারি বিভাগে যোগ দিই। এর কিছুদিন আগেই আমি বিয়ে করি। খালাশাশুড়ির বাসায় বিবাহোত্তর দাওয়াত খেতে টেবিলে তিনি কথায়
কথায় বললেন, 'আমাদের বুলবুলের (হান্নান ভাইয়ের স্ত্রী)
জামাইও তো কাস্টমসে
চাকরি করে।' আমার স্ত্রী শুনে বললেন, ‘হান্নান সাহেব যে বুলবুল আপার জামাই তা তো জানি, কিন্তু তিনি যে কাস্টমসে কাজ করেন, তা তাতো জানতাম না। যাহোক, আমি চট্টগ্রাম শুল্ক
ভবনে পদস্থ হই। পরবর্তীকালে ঢাকা শুল্ক, আবগারি, কালেক্টরেটে তার অধীনে কাজ করি। এ সময় আমাদের সম্পর্ক উর্ধ্বতন-অধস্তন কর্মকর্তায়
সীমাবদ্ধ ছিল। আমাদের দুজনের ওপরই এ সময় ঢাকা এয়ার ফ্লাইটে ঘড়ি চোরাচালান নিয়ে বেশ ঝড়
ঝাপটা যাচ্ছিল।
কিছুদিন পর আমি বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য
চলে যাই এবং এসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে যোগ দিই। তখন তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য। একদিন বললেন, 'বিয়ের পর তোমাদের বাসায় খেতে ডাকা হয়নি। তোমাদের
আপা আগামী শুক্রবার দুপুরে খেতে বলেছেন।' সদ্য যুক্তরাষ্ট্র
ফেরত, আমরা সামান্য কিছু উপহার নিয়ে তাঁদের ইস্কাটনের সরকারি
বাসায় যাই। খাবার টেবিলে বুলবুল আপা খানিকটা অনুযোগের স্বরে হান্নান ভাইকে বললেন, 'দেখো, কবির ভাই
(আমি) কেমন আমার বোনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক বছর থেকে এলে তুমিও তো একই বিভাগে কাজ করো, তোমার এত দিন চাকরি হলো, তুমি তো আমাকে কোথায় নিয়ে গেলে না!' হান্নান ভাই বললেন,
‘কবির ব্রিলিয়ান্ট অফিসার, ওর কথা আলাদা!'
আমতা আমতা করে একটা জবাব দিয়ে বিষয়টি এড়াতে চাইলেন। স্ত্রী তো দূরের কথা, অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ হান্নান ভাইয়ের সরকারি কাজে বিদেশে যেতেও প্রবল অনীহা ছিল।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য হিসেবে ভ্যাট প্রবর্তনের আগে
একটি সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে ফিলিপাইন, ভারতসহ কয়েকটি দেশ সফরে গিয়েছিলেন। তাঁর সফরসঙ্গীরা আমাকে বলেছেন,
তিনি প্রায়ই হোটেলের মূল খাবার বাদ দিয়ে ফলমূল ও ডেজার্ট খেয়ে থাকতেন। নিজের খাবারের জন্য তিনি দেশ
থেকে সঙ্গে কিছু বিস্কুট নিয়ে গিয়েছিলেন।
হান্নান-বুলবুল দম্পতির বিদেশযাত্রী। তার বাসায়
বেড়ানোর বছরখানেক পর আমি ব্রাসেলসে ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউসিও)
একটি সভায় যোগ দিই। সেখানে
তখন আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন আমার জ্যেষ্ঠ সহকর্মী মনযুর মান্নান (পরে দুদকের
সদস্য)। সেখানে মান্নান ভাইকে খাবার টেবিলে
আপার আক্ষেপের কথা তুলে তাঁদের কীভাবে বিদেশে পাঠানো যায়, তা নিয়ে আলাপ করি। মান্নান ভাই বললেন, হান্নান ভাইয়ের
স্ত্রীর আক্ষেপ সঠিক। সার্ভিসের আমরা সবাই নিজেও স্ত্রীসহ নানান দেশে সফর করেছি। আমরা
দুজন আলাপ করে স্থির করি, ডৱিউসিওর মহাসচিব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান শাহ আবদুল হান্নানকে
ব্রাসেলসে তাদের সদর দপ্তর ব্যক্তিগতভাবে পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানাবেন। ডব্লিউসিও তার
সফরের সব ব্যয়ভার বহন করবে।
হান্নান-বুলবুল দম্পতি মান্নান ভাইয়ের বাসায় তাঁদের সঙ্গে থাকবেন। এই সুযোগে মিসেস হান্নান। একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। তবে নিমন্ত্রণপত্রটি আমার ঠিকানায় পাঠানো হবে। না হলে হান্নান সাহেবের হাতে সরাসরি গেলে তিনি না করে দেবেন। আমি তাদের সস্ত্রীক সফরে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য সারসংক্ষেপ তৈরি করে আমাদের নতুন চেয়ারম্যান শাহ আবদুল হান্নানের কাছে নিয়ে যাই। তিনি কোনোমতেই সারসংক্ষেপে স্বাক্ষর করতে রাজি হচ্ছিলেন না। এ সময় মান্নান ভাইও ব্রাসেলস থেকে তাকে ফোন করে বারবার আমন্ত্রণটি গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করেন। প্রায় এক ঘন্টা বসে থেকে, তর্কবিতর্ক করে, শেষমেশ বিরক্ত হয়ে তিনি সই করলেন। আমি সারসংক্ষেপ হাতে হাতে নিয়ে অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া স্যারের কাছে যাই। তিনি কেবল একটি কথাই জিজ্ঞেস করলেন, 'হান্নান সাহেব কি বিদেশে যাবেন? তাকে তো যখনই বিদেশ যাওয়ার কথা বলি, তিনি না করেন। আমি অর্থমন্ত্রীকে সবকিছু খুলে বললাম এবং জানালাম, অনেক কষ্টে আমি রাজি করিয়েছি। অর্থমন্ত্রী কী একটা কাজে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাচ্ছিলেন। বললেন, সারসংক্ষেপ তিনি নিয়ে যাবেন।
পরদিনই প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদসহ সারসংক্ষেপ চেয়ারম্যানের কাছে
ফিরে এলে আমার ডাক পড়ে। আগেরবার রাগের মাথায় পুরো সারসংক্ষেপ পড়েননি। এবার পড়েছেন, বললেন, 'ব্রাসেলসে তোমার আপার কাজ কী? তাঁর বিমান ভাড়া, থাকা-খাওয়ার খরচ কে দেবে?'
আমি বললাম, 'বাংলাদেশ বিমান পরিচালনা পর্ষদের সদস্য
হিসেবে আপনার স্ত্রী ১০ শতাংশ ভাড়ায় যাতায়াত করতে পারেন। আর ব্রাসেলসে আপনারা মান্নান
ভাইয়ের বাসায় থাকবেন।' তিনি নিমরাজি হলেন। সমস্যা হলো, তাদের বাসায় বিদেশে যাওয়ার কোন ভালো ব্যাগ নেই। টিনের বাক্স আছে, তা নিয়ে তো আর ব্রাসেলসে যাওয়া যায় না! আমরা সদ্য বিদেশ ফেরত। সুটকেস, ট্রলি সবই আমাদের আছে। তাদের বাসায় পৌছে দিলাম। আমাদের পরিকল্পনা সফল হলো, হান্নান-বুলবুল দম্পতি বিদেশ সফর
করে ফিরে এলেন।
উত্তর গোড়ান থেকে অনেকবার আমি এবং অন্য অনেকে
তাকে রাজউকের জমির জন্য আবেদন করতে বলেছেন। তিনি বারবারই বলেছেন, 'ঢাকায় আমার এজমালি হলেও একটি পৈতৃক সম্পত্তি আছে। আমি মিথ্যা ঘোণাণা স্বাক্ষর করতে পারব না। তা ছাড়া
আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়ার ও কিস্তির ঢাকাই-বা আমি কোথা থেকে দেব?' আমরা রাজউকের দুজন চেয়ারম্যান ও পূর্তসচিবকে তাঁকে বলতে শুনেছি, 'স্যার, আপনি কেবল আবেদন করেন। বাকিটা আমরা দেখব।'
তিনি কোন মতেই রাজি হননি। আর্থিক, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক
সততার যে নজির শাহ আবদুল হান্নান রেখে গেছেন, তা বিরল।
আমি ক্ষণজন্মা এই মানুষটির আত্মার মাগফিরাত কামনা
করি। তাঁদের সন্তান ইমু ও ফয়সালের প্রতি সমবেদনা। তাদের বলি, এমন একজন মানুষকে পিতা হিসেবে পাওয়া যেকোনো সন্তানের জন্য একটি বিরল সম্মান।
আর নিজেদের বলি, এমন একজন সরকারি কর্মকর্তা পাওয়া একটি জাতির
জন্য ভাগ্যের বিষয়।
লেখক # সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ।
শাহ আব্দুল হান্নান :
একজন মর্দে মুজাহিদের প্রতিচ্ছবি !
লেখকঃ গোলাম মাওলা রনি
শাহ আব্দুল হান্নান সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম
সাক্ষাৎ ঘটে সেই সময়ে যখন আওয়ামী লীগের শাসন চলছিল এবং শাহ এএমএস কিবরিয়া
অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে মরহুম আব্দুল
হান্নান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার দক্ষতা-সততা এবং গণমুখী
চরিত্র তখন কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল। ব্যক্তিগত জীবনে জামায়াতে ইসলামীর প্রতি
তার দুর্বলতা অথবা জামায়াত সংশ্লিষ্টতা ছিল। কিন্তু এসব নিয়ে তার মধ্যে
লুকোচুরিভাব বা হীনম্মন্যতা ছিল না। অন্য দিকে আওয়ামী লীগ সরকার তার ‘জামায়াতি’ পরিচয় সত্ত্বেও তাকে যেভাবে সম্মান ও
সমীহ করত মূলত সততা ও নীতিনিষ্ঠার কারণে তা অন্য কোনো সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার
ভাগ্যে জোটেনি।
শাহ আব্দুল হান্নান যে ব্যক্তিত্ব নিয়ে অফিস
পরিচালনা করতেন এবং যে সততা নিয়ে উঁচু উঁচু করে চলতেন; যে
বিশ্বাস-জ্ঞান-মেধা-আধুনিকতা ও আন্তরিকতা নিয়ে স্পষ্টভাবে কথা বলতেন তার ফলে কোনো
দুর্নীতিবাজ, ধান্ধাবাজ-দলবাজ তার সামনে দাঁড়াতে সাহস পেত
না। স্বয়ং অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া সাহেবের মতো মেধাবী মানুষকে তিনি কিভাবে ম্যানেজ
করতেন সেই দৃশ্যটি আমি নিজে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম তার সঙ্গে সাক্ষাতের প্রথম
দিনটিতে। এ বিষয়ে আলোচনার আগে আপনাদের জানাচ্ছি কেন এবং কি কারণে ১৯৯৬-৯৭ সালের দিকে
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান শাহ আব্দুল হান্নানের কাছে গিয়েছিলাম।
আমার ব্যবসায়িক জীবন শুরু হয়েছিল ১৯৯১
সালে। অন্যান্য ব্যবসার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কনটেইনার পরিবহন বা শিপিং ব্যবসার
সুবাদে বন্দর ও কাস্টমস অফিসের সাথে আমাদের যোগাযোগ রক্ষা করতে হতো কিন্তু ব্যবসা
পরিচালনার জন্য কোনো সরকারি অফিসে তোয়াজ-তদবিরের দরকার পড়ত না। সেবার হঠাৎ এমন
এক আনকোরা সমস্যা দেখা দিলো যার কারণে খুব পেরেশানিতে পড়ে গেলাম। কোরিয়া থেকে
আমাদের কনটেইনারে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের স্যাকারিন আমদানি করেন পুরান ঢাকার এক
ধান্ধাবাজ ব্যবসায়ী। কনটেইনার চট্টগ্রাম পৌঁছার পর ওই ব্যবসায়ী তার রফতানিকারকের
কাছে বিশাল ডিসকাউন্ট দাবি করে বসেন। রফতানিকারক তার মালামাল ফেরত নিতে চাইলেন যা
ওই সময়ে সম্ভব ছিল না। কারণ এ ধরনের ক্ষেত্রে যেভাবে মালামাল ফেরত পাঠাতে হয় সেই
পদ্ধতির নাম ‘রি-এক্সপোর্ট’। বাংলাদেশ কাস্টমসের প্রচলিত আইন
অনুযায়ী রি-এক্সপোর্ট খুবই জটিল একটি প্রক্রিয়া যা অনুসরণ করে এর আগে একটি
রি-এক্সপোর্টও তখন পর্যন্ত বাংলাদেশে হয়নি। কাস্টমসের সে আইনের সুযোগ নিয়ে অনেক
ধান্ধাবাজ ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে মূল্যবান পণ্য আমদানির নামে বিরাট এক প্রতারণার
সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিল। তারা আমদানিকৃত পণ্যের জাহাজ বা কনটেইনার চট্টগ্রামে
পৌঁছার পর রফতানিকারককে জিম্মি করে ফেলত; মাল খালাস করত না
এবং রফতানিকারকে কোনো টাকাও দিত না। কাস্টমসের নিয়ম মতে পণ্যগুলো নির্দিষ্ট সময়
পর নিলামে যেত আর সিন্ডিকেটের সদস্যরা নামমাত্র মূল্যে তা কিনে নিতো।
আমি যে চালানটির কথা বলছি, সেটির রফতানিকারক কোরিয়ার
ভদ্রলোক সরাসরি বাংলাদেশে চলে এলেন এবং আমাকে বললেন, যত কষ্ট
হোক, তিনি দুর্নীতিবাজদের খপ্পরে পড়বেন না। যেকোনো মূল্যে
তিনি তার পণ্য কোরিয়ায় ফেরত নেয়ার জন্য আমাকে ‘পাওয়ার অব
অ্যাটর্নি’ দিলেন। প্রথামতো সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের মাধ্যমে
পণ্যটি পুনঃরফতানিতে ব্যর্থ হয়ে নিজেই নেমে পড়লাম। কাস্টমস, পোর্ট, প্রধান আমদানি-রফতানিকারকের অফিস, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইত্যাদি সব জায়গায় গেলাম এবং ‘হাতির
পাঁচ পা’ দেখতে দেখতে কাস্টমস বিভাগে এসে হোঁচট খেলাম। কোনো
কর্মকর্তাই আমার সাথে সহযোগিতামূলক আচরণ করলেন না। একজন শুভানুধ্যায়ী বললেন,
‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে আলাদা এসআরও লাগবে, যা কেবলমাত্র চেয়ারম্যান সাহেব দিতে পারেন। তিনি সৎ ও সজ্জন মানুষ।
সুতরাং তার সাথে সরাসরি সাক্ষাতে সুফল পাওয়া যেতে পারে।’
আমি কালবিলম্ব না করে শাহ আব্দুল হান্নান
সাহেবের রুমে ঢুকতে গিয়ে রীতিমতো তাজ্জব হয়ে গেলাম। গিয়ে দেখলাম, তার রুম খোলা এবং লোকজন
অবাধে যাতায়াত করছে। সুতরাং আমিও কারো কোনো অনুমতি ছাড়াই সোজা ঢুকে গেলাম।
সেখানে দেখলাম, তিনি দাঁড়িয়ে ১০-১২ জনের কথা শুনছেন এবং
ঝড়ের গতিতে একের পর এক সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। তার টেবিলের সামনে দুটো চেয়ার
মুখোমুখি ছিল, যার একটিতে তৎকালীন সময়ের নামকরা মিডিয়া
ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বসা ছিলেন। আর অন্যটি খালি ছিল। আমি যেভাবে রুমে
ঢুকলাম তা চেয়ারম্যান সাহেবের নজর এড়াল না। তিনি আগে সালাম দিলেন এবং কোনো কিছু
জিজ্ঞাসা না করেই জাহাঙ্গীর সাহেবের সামনের চেয়ারে বসতে বললেন। তার সাথে আমার
পূর্ব পরিচয় তো দূরের কথা- সামনাসামনি এর আগে সাক্ষাৎও হয়নি। তা ছাড়া তখন আমার
বয়স এবং ব্যবসায়িক অবস্থা এমন ছিল না যার কারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান
দূরের কথা, একজন কাস্টমস কমিশনারের রুমে সরাসরি ঢুকে এবং তার
সামনে বসে প্রয়োজনের কথা বলার মতো আত্মবিশ্বাস দেখাতে পারি। সুতরাং সাহস করে
ঢুকলাম বটে; কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেবের বিনয় ও ভদ্রতায়
হতবাক হয়ে চেয়ারে বসে ঘামতে থাকলাম।
আমি দেখলাম, চেয়ারম্যান সাহেব ১০
মিনিটের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আগত লোকদের সমস্যার সমাধান করে নিজের চেয়ারে
বসলেন। তারপর আমার দিকে না তাকিয়ে জাহাঙ্গীর সাহেবকে উদ্দেশ করে জানতে চাইলেন-
তিনি কী প্রয়োজনে এসেছেন। জাহাঙ্গীর সাহেব বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য রাজস্ববিষয়ক
একটি অনুষ্ঠানে চেয়ারম্যান সাহেবের সাক্ষাৎকার চাইলেন। উত্তরে শাহ আব্দুল হান্নান
বললেন, ‘আপনার প্রস্তাব উত্তম এবং বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু মন্ত্রীর অনুমতি ছাড়া আমি তো কথা বলতে পারব না।’ তিনি
সাথে সাথে মন্ত্রীকে ফোন দিলেন। অপরপ্রান্ত থেকে বলা হলো- মন্ত্রী মিটিংয়ে। এখন
কথা বলা যাবে না। তিনি বললেন- খুব জরুরি! এখনই বলতে হবে- ফোন দিন। অপর প্রান্তে
যিনি ছিলেন, তিনি আর সাহস পেলেন না। মন্ত্রীকে ধরিয়ে দিলেন।
শাহ আব্দুল হান্নান এক নিঃশ্বাসে বললেন, স্যার! আসসালামু
আলাইকুম। বিটিভি থেকে লোক এসেছে সাক্ষাৎকারের জন্য। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং আমি
মনে করছি এই বিষয়ে আমার কথা বলা উচিত। তাই আপনাকে ফোন দিলাম। আজ সন্ধ্যায়
বিটিভিতে যাবো; আমি কিন্তু আপনার অনুমতি নিয়ে নিলাম স্যার।
আচ্ছা রাখি- আসসালামু আলাইকুম।’
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর এবং আমি অবাক হয়ে শাহ
আব্দুল হান্নান সাহেবের কর্মকাণ্ড দেখলাম এবং আমাদের উভয়কে আশ্চর্য করে দিয়ে
জাহাঙ্গীরকে বললেন- ‘ঠিক আছে- আপনি আসুন। সন্ধ্যায় দেখা হবে।’ এরপর আমার
দিকে তাকালেন। আমি ইতোমধ্যে তার কর্মকাণ্ড বুঝে ফেলেছি। সুতরাং ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে
আমার সমস্যাটি বললাম। তিনি আমার দরখাস্তটি নিয়ে নোট লিখলেন। তারপর শাহনাজ হুদা
নামে দ্বিতীয় সচিব পদের এক মহিলা কর্মকর্তাকে ফোন করে বললেন- শাহনাজ! একটি
দরখাস্ত পাঠালাম। এসআরও হবে। ফাইল করে আমার টেবিলে নিয়ে আসতে কতক্ষণ লাগবে। তারপর
বললেন- ওকে, ডু ইট। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- ‘আমি যত সহজে হুকুম দিলাম, অত সহজে কিন্তু কাজ হবে
না। হয়তো আমার রুমে আরো কয়েকবার আসতে হবে। চিন্তা করবেন না। কাজ হবে ইনশা
আল্লাহ!’
মানুষের শরীরে বিদ্যুতায়িত হলে যা হয়- আমার
অবস্থাও তাই হলো। আমি শাহ আব্দুল হান্নানের রুম থেকে বের হলাম। এরপর আরো কয়েকবার
তার রুমে গিয়েছি এবং তার সাথে আমার একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা আমি কোনো দিন কাজে
লাগাইনি; এমনকি তার সাথে পরবর্তীকালে আর কোনো যোগাযোগ রাখিনি
এ কারণে যে, বিনা প্রয়োজনে বড় মানুষের সাথে সম্পর্ক রাখা
এক ধরনের অযোগ্যতা এবং যারা এই কাজ করে তারা কেউ হয়তো ধান্ধাবাজির জন্য করে;
আবার কেউ কেউ নিজেকে হীনম্মন্য ভাবে- অসহায় ভাবে এবং ক্ষেত্র
বিশেষে কারো কারো মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও ভিখারীপনার প্রবৃত্তি থাকে যা ঢেকে রাখার
জন্য তারা বড় বড় মানুষের সাথে সংযোগ রেখে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালায়। এ কারণে শাহ
আব্দুল হান্নান সাহেবের স্মৃতি আমার মনে মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা-আবেগ এবং
ভালোবাসার স্থানে সংরক্ষণ করে আমার মতো জীবনযুদ্ধ চালাতে চালাতে ২০১১ সাল অবধি
পৌঁছে গেলাম। ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ একদিন একটা ফোন ফেলাম। অপরপ্রান্ত থেকে বললেন- ‘আমার নাম শাহ আব্দুল হান্নান। আমি নিয়মিত আপনার লেখা পাঠ করি। পাঠক
হিসেবে যদি মাঝে মধ্যে ফোন করি তবে কি আপনি বিরক্ত হবেন?’
সম্মানিত পাঠক! একবার বুঝার চেষ্টা করুন! যে
দিন শাহ আব্দুল হান্নান সাহেবের ফোন পেয়েছিলাম সে দিন আমার মনের অবস্থা কিরূপ
হয়েছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বিমূঢ় হয়ে পড়লাম। বলতে পারলাম না যে, আপনি এক সময়ে আমায় চিনতেন
অথবা আমি সেই লোক যাকে আপনি সে দিন...। ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল অবধি তিনি নিয়মিত
আমাকে ফোন করতেন এবং আমিও মাঝে মধ্যে ফোন করে নানা বিষয়ে তার সাথে কথা বলতাম যার
সাথে রাজনীতি বা অন্য কোনো বিষয়ের সম্পৃক্ততা ছিল না। ইসলামাইজেশন এবং মানবিকতা ও
সভ্যতা নিয়ে আমাদের মধ্যে একাডেমিক আলোচনা হতো কিন্তু কোনো দিন সরাসরি সাক্ষাৎ
হয়নি। ২০১৩ সালে আমি যখন একটি চাঞ্চল্যকর চক্রান্তের শিকার হয়ে ঊনপঞ্চাশ দিন জেল
খেটে বের হলাম, তখন শাহ আব্দুল হান্নান সাহেব ফোন করে
জানালেন যে- তিনি আমাকে দেখতে আসতে চান। সে ঘটনার পর তিনি আমার অফিস ও বাসায়
একাধিকবার বেড়াতে এসেছেন এবং আমিও তার গোড়ানের বাসায় বেড়াতে গিয়েছি। আমরা
যতবার সাক্ষাৎ করেছি ততবারই পরস্পরের প্রতি অধিক মাত্রায় মুগ্ধ হয়েছি। আমাদের
সাক্ষাৎগুলোকে সাহিত্যের ভাষায় ‘আড্ডা’ বলা যেতে পারে এবং একেকটি আড্ডায় অসম বয়সের দু’জন মানুষ
একান্তে চার-পাঁচ কিংবা ছয়-সাত ঘণ্টা কিভাবে একনাগাড়ে অতিবাহিত করত তা নিয়ে তার
সাথে আসা লোকজন অথবা আমার অফিস বা বাসার লোকজন দূরে বসে বড় বড় হাই তুলত এবং
ভাবত।
শাহ আব্দুল হান্নানের সাথে আমার উল্লেখিত
যোগাযোগ বহাল ছিল ২০১৯ সালের তত দিন পর্যন্ত যত দিন তিনি শারীরিকভাবে একা চলাফেরা
করতে পারতেন। পরে তিনি যখন দুর্বল হয়ে পড়লেন এবং অন্যের সাহায্য নিয়ে প্রয়োজনে
বাইরে বেরুতেন তখন থেকে আমাদের মধ্যে ফোনেই কথাবার্তা হতো। আমাদের উভয়ের মধ্যে
একটি ‘রূহানী
সম্পর্ক’ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ফলে আমি যা চিন্তা করতাম অথচ
লিখতাম না, সেসব বিষয় তিনি লিখতেন। অন্য দিকে তিনি যেসব
বিষয় চিন্তা করতেন অথচ লিখতেন না সেসব বিষয় আমার লেখনিতে প্রকাশ পেত এবং দৈনিক
নয়া দিগন্ত পত্রিকায় আমরা পরস্পরের দর্পণরূপে সপ্তাহের প্রতি শুক্রবারে একজন
অন্যজনকে দেখতে পেতাম।
আজ দুই হাজার একুশ সালের জুন মাসের দুই
তারিখে বসে যখন নিবন্ধটি লিখছি, তখন শাহ আব্দুল হান্নান সাহেব আর ধরাধামে
নেই। মহান আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় বান্দাকে তার আপন আশ্রয়ে নিয়ে গেছেন। দেশের
সব পত্রপত্রিকা-সামাজিকমাধ্যমে এবং সুধীজনের আলোচনায় শাহ আব্দুল হান্নানের
কর্মময় জীবনের ইতিকথা যেভাবে আলোচিত হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে-
মানবের জীবন আসলে শাহ আব্দুল হান্নানের মতোই হওয়া উচিত। তার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে
আমার কলম বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কত স্মৃতি কত কথা- কত স্বপ্ন। কোনটি রেখে
কোনটি বলব- এসব ভাবনায় যখন তালগোল পাকিয়ে ফেলছি, তখন লক্ষ্য
করলাম- নিবন্ধের প্রান্তে এসে গেছি। এ অবস্থায় তার জন্য দোয়ার পাশাপাশি তার
উসিলায় আল্লাহর দরবারে দোয়া প্রার্থনা করে নিবন্ধের ইতি টানছি। মহান আল্লাহ
পাকের দরবারে আমার বিনীত প্রার্থনা-
‘হে মহামহিম, তুমি
তোমার প্রিয় বান্দা যিনি তার জীবনের শেষক্ষণটি পর্যন্ত তোমার খলিফারূপে এই জমিনে
যেভাবে একজন মর্দে মুজাহিদের মতো দায়িত্ব পালন করে গেছেন সেভাবে অনাগত দিনে শত
সহস্র শাহ আব্দুল হান্নান যেন বাংলার মাটিতে তোমার হুকুম তামিল করতে পারেন,
সেই পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দাও। ইয়া আল্লাহ! তাকে জান্নাতের
সর্বোচ্চ মাকাম দান করো এবং পবিত্র সেই জান্নাতে আমাকে তার প্রতিবেশী বানিয়ে দিও।
তার জীবন ও কর্মকে সদকায়ে জারিয়া হিসাবে কবুল করো এবং তার রেখে যাওয়া আদর্শ
অনুসরণ করার হিম্মত আমাদের দান করো। আমিন! ছুম্মা আমিন!
লেখক # সাবেক সংসদ
সদস্য
ছায়াটি সরে গেলো
মাসুম খলিলী
শাহ আবদুল হান্নানের গল্প শুনি কলেজের পর্ব
শেষ করে যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা শুরু করি। তখন আমি চট্টগ্রাম শহরের
এক প্রান্ত খতিবের হাটে থাকি। দুপুরের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে আসি আর
বিকেল বেলা আমার বড় ভাইতুল্য ডা: আবদুল মান্নানের চেম্বারে গল্প করতে যাই। এই
আবদুল মান্নান এক সময় ছিলেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ছাত্র নেতা। কর্মজীবনে কিছু
ব্যবসা বাণিজ্য করার চেষ্টা করে খানিকটা ব্যর্থ হয়ে হোমিও ডিগ্রি নিয়ে ডাক্তারি
শুরু করেন। মান্নান ভাইয়ের ছিল অভূতপূর্ব এক সম্মোহনি শক্তি। ডাক্তার হিসাবে বেশ
খ্যাতি অর্জন করেন অল্প দিনের মধ্যেই। শাহ আবদুল হান্নান চট্টগ্রামের ডেপুটি
কালেক্টর থাকাকালে ‘শাহিন ফৌজ’ নামের একটি শিশু সংগঠনের উপদেষ্ঠা ছিলেন।
সেই সুবাদে মান্নান ভাইয়ের সাথে শাহ আবদুল হান্নানের ছিল বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ
যোগাযোগ। আর মান্নান ভাইয়ের কাছে শাহ আবদুল হান্নানের গল্প শুনে আমার মনের মধ্যে
এই ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষ এক রকম সত্যনিষ্ট বড় মাপের সরকারি কর্মকর্তার
ভাবমর্যাদা তৈরি হয়। এ সময় আরেক তরুণের গল্প মান্নান ভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম যিনি
শাহীন ফৌজের সাথে যুক্ত ছিলেন আর চট্টগ্রাম কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র ছিলেন।
তার বাবা ছিলেন চট্টগাম কলেজের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল এবং জনপ্রিয় শিক্ষক। যতদূর মনে
পড়ে তার নাম ছিল ফৌজুল কবির খান।
এরপর ১৯৮৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের
মাস্টার্সের ছাত্র থাকাকালে কিছুটা লম্বা সময়ের জন্য ঢাকায় আসি। একটি বিশেষ
প্রকাশনার কিছু কাজের দায়িত্ব আসে আমার উপর। এই কাজের অংশ হিসাবে বন্ধু সুুহৃদ আবু
জাফর মোহাম্মদ ওবায়েদ উল্লাহর সাথে সৌদি দূতাবাসে শাহ আবদুল হালিমের সাথে দেখা
করতে যাই। হালিম ভাই তখন সৌদি দূতাবাসের অনেক উচ্চ পদে কাজ করতেন, কিন্তু আমার কাছে তখন বড়
আকর্ষণের বিষয় ছিল আমি শাহ আবদুল হান্নানের ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। সেদিন
সৌদি দূতাবাসের ভেতরের একটি লনে হালিম ভাইয়ের সাথে আমাদের অনেক কথা হয়। তার
ব্যক্তিত্বে আপ্লুত হই, হান্নান পরিবারের প্রতি সম্মান আরো
বেড়ে যায়।
পরে সেই ওবায়েদ ভাইয়ের সাথেই একদিন শাহ আবদুল
হান্নানের কাকরাইলের সরকারি বাসায় সাক্ষাত করতে যাই। তখন সম্ভবত শাহ আবদুল হান্নান
ঢাকার কাস্টম কালেকটরের পাশাপাশি কাস্টমস ইন্টেলিজেন্সের দায়িত্বও পালন করছিলেন।
একেবারে সাদামাটা জৌলসহীন তার সুপরিসর বাড়িতে পৌঁছার একটু পরেই আসেন জনাব
হান্নান। চা বিস্কিটের সাথে সাথে যে কাজে আমরা গিয়েছিলাম তার জন্য সুনির্দিষ্ট
পরামর্শ দেন। তার কথায় ছিল অন্য রকম এক স্নেহ, দরদ। এর কিছু দিন পর, তখন ওবায়েদ ভাই শিশু কিশোর সংগঠন ফুলকুঁড়ি আসরের প্রধান পরিচালক আর আমি
মাস্টার্স পরীক্ষা দেবার পর স্থায়িভাবে ঢাকায় চলে আসি। এ সময় ওবায়েদ ভাই, আমি ও ডা বুলবুল সারওয়ার ‘অঙ্গিকার’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করি। কবি আল মাহমুদ ছিলেন এই পত্রিকার
উপদেষ্টা। আমরা পত্রিকাটিকে এগিয়ে নেবার ব্যাপারে পরামর্শের জন্য আর একবার বেইলি
রোডের কাস্টম ইন্টেলিজেন্স অফিসে শাহ হান্নানের সাথে দেখা করতে যাই। নানা
ব্যস্ততার মধ্যেও শাহ আবদুল হান্নান বেশ কিছু সময় দেন এবং কিভাবে সামনে এগুতে হবে
তা নিয়ে পরামর্র্শ দেন।
ঢাকায় দুয়েকটি ম্যাগাজিনে কাজ করার পর ১৯৮৫
সালে একটি দৈনিকে পূর্ণকালীন সাংবাদিক হিসাবে যোগ দেই। বছর খানেক সহ সম্পাদক
হিসাবে কাজ করার পর রিপোর্টিং এ বদলি হলে আমার কর্মক্ষেত্র হয় বহির্মুখি। এর মধ্যে
দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করার পর আবার শাহ আবদুল হান্নান
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য কাস্টমস পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। সরকারের রাজস্ব আহরণে
নতুন শুল্ক ব্যবস্থা প্রবর্তনের ব্যাপারে গঠিত ভ্যাট সেলের প্রধানের দায়িত্ব আসে
তার উপর। নতুন এই কর ব্যবস্থা নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা ও প্রস্তুতিমূলক কর্মকান্ডে
কেন্দ্রীয় ব্যক্তি হয়ে পড়েন তিনি।
এ সময় পর্যন্ত আমার পত্রিকা দৈনিক সংগ্রামে
অর্থনৈতিক বিট কাভার করতেন অগ্রজ সাংবাদিক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু। মঞ্জু ভাই বিশেষ
সংবাদদাতা হবার পর বাজেট কাভার করার মতো বড় বড় ইভেন্ট ছাড়া অন্য দায়িত্ব জুনিয়রদের
উপর অর্পিত হয়। এর মধ্যে চীফ রিপোর্টার বাবর ভাই দৈনন্দিন অর্থনৈতিক বিট কাভার
করার দায়িত্ব আমার উপর অর্পন করেন। এসময় শুনি শাহ আবদুল হান্নান জাতীয় রাজস্ব
বোর্র্ডের চেয়ারম্যান হতে পারেন। কিন্তু সিনিয়রিটি নির্ধারণে সিএসপি কর্মকর্তাদের
এক বিশেষ ব্যাখ্যার কারণে সেবার তাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয়নি।
ঢাকা কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে শাহ আবদুল হান্নান ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান ফিনান্স সার্ভিস
ক্যাডারে যোগদান করেন। সিএসপি অফিসাররা ব্যাখ্যা দেন যে, পাকিস্তানের অন্যান্য
সেন্ট্রাল সার্ভিসের তুলনায় সিএসপি অফিসাররা দুই বছর সিনিয়র হিসাবে গণ্য হবেন এবং
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য পদটি অতিরিক্ত সচিবের সমমর্যাদার হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে
অতিরিক্ত সচিব হিসাবে সিনিয়র সার্ভিস পুলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে সচিব পদে দায়িত্ব লাভ
বা পদোন্নতি পেতে হবে।
ব্যাখ্যার এই টানাপড়েনে শাহ হান্নানের জুনিয়র
একজন সিএসপি কর্মকর্তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত হলে তাকে
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্ণর পদে বদলি করা হয়। এর মধ্যে পত্রিকায় অর্থনৈতিক
বিটের মূল কাজটি আমার উপর অর্পিত হয় আর সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং চেম্বার ও এসোসিয়েশনগুলো হয় আমার কাজের মূল ক্ষেত্র।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার মূল বিষয় অর্থনীতি ছিল না, ফলে
অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলোর প্রায়োগিক ধারণা আমার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এক্ষেত্রে মঞ্জু ভাইয়ের সহযোগিতা বেশ কাজে লাগতো। বড় সড় বিষয়গুলো বোঝার জন্য এর
সাথে যুক্ত বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের স্মরণাপন্ন হতাম।
তখন বাংলাদেশ ব্যাংকে বিশ্ব ব্যাংকের
সহযোগিতায় ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সংস্কারের একটি প্রকল্প চলমান ছিল। ফরেস্ট এম
কুকশন বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে এই প্রকল্পের কনসালটেন্ট ছিলেন আর এ ব্যাপারে
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি গভর্ণর ছিলেন শাহ আবদুল হান্নান। এর আগে
এরশাদ সরকারের সময় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের কালচার চরম এক অবস্থায়
চলে গিয়েছিল। বিশ্ব ব্যাংক আইএমএফের চাপ ছাড়াও অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা আনার জন্য
তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান বিশেষভাবে এই প্রকল্পের বাস্তবায়নের উপর
জোর দিচ্ছিলেন।
এই সময়টাতে বাংলাদেশের ব্যাংক এবং আর্থিক
ব্যবস্থা কিভাবে কাজ করে তার খুটিনাটি বিষয়গুলো শাহ আবদুল হান্নান একজন ছাত্রের
মতো করে বুঝিয়ে দিতেন। অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ কাঠামো এবং এর আন্ত:সম্পর্কের বিষয়
তার কাছ থেকে যত সহজভাবে বুঝতে পেরেছি এরপর সচিব পর্যায়ের অনেকের সাথে হৃদ্যতা
তৈরি হয়েছে কিন্তু এরকমটি আর কাউকে পাইনি। সম্ভবত একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের
দ্রষ্টা,
কাজের ব্যাপারে নিষ্টা এবং শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করার
প্রভাব তার কর্মদক্ষতা ও ব্যক্তিত্বের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল।
বাংলাদেশে ব্যাংকে ডেপুটি গভর্ণর হিসাবে
দায়িত্ব পালনের পর সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসাবে বদলি হন শাহ
হান্নান। সম্ভবত ফজলুর রহমান পটল ছিলেন এই মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী।
প্রতিমন্ত্রী ফজলুর রহমান যথেষ্ট সম্মান এবং গুরুত্ব দিতেন তাকে। এখান থেকে শাহ
হান্নান বদলি হয়ে যান অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের সচিব হিসাবে। ব্যাংক ও
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কারে যে কাজ তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে করেছিলেন সেটি আরো বড়
নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে দেখার দায়িত্ব অর্পিত হয় অর্থমন্ত্রণালয়ে। ততদিনে সিনিয়র
অর্থনৈতিক রিপোর্টার হিসাবে আমার কাজের ব্যাপ্তি আর গভীরতাও বৃদ্ধি পায়। ব্যাংকিং
বিভাগের সচিব হিসাবে শাহ হান্নানের ব্যস্ততা অনেক বৃদ্ধি পায়। ফলে আগের মতো
প্রয়োজন হলেই সাক্ষাত করাটা আর হয়ে উঠতো না। ফোন করে অথবা পিএসের মাধ্যমে সময় নিয়ে
কথা বলতাম। তখন তার পিএস ছিলেন ১৯৮৫ ব্যাচের মেধাবি কর্মকর্তা সিরাজ ভাই।
ব্যাংকিং বিভাগ থেকে শাহ আবদুল হান্নানকে তার
পুরণো কর্মক্ষেত্র জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের
সচিব হিসাবে বদলি করা হয়। তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন শাহ এ এম এস কিবরিয়া। আমরা
অর্থনৈতিক সাংবাদিক হিসাবে তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। তার মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম
পরিচালনার ধরনটি সাইফুর রহমানের মতো ছিল না। তবে তিনি সততা এবং চাপের কাছে নতি
শিকার না করার ব্যাপারে বেশ সাহসী ছিলেন। সরকারি দলের সংশ্লিষ্টতার চাইতেও মেধাকে
বেশি মূল্য দিতেন। সম্ভবত এই কারণেই তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে যোগ্য ও সৎ
ব্যক্তিদের বেছে নেবার চেষ্টা করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রীকে সেভাবে তিনি কনভিন্স
করতে পেরেছেন। এভাবেই হয়তো শাহ আবদুল হান্নান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে
নিয়ুক্ত হয়েছেন এবং স্বাভাবিক অবসরের পরে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগও পেয়েছেন। অনেকে
অবশ্য মনে করতেন,
শাহ আবদুল হান্নানের মামা শামসুল হক গোলাপের আওয়ামী লীগের নিবেদিত
নেতা এবং ৫ বারের এমপি হওয়া এবং তদানীন্তন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ
আশরাফুল ইসলামের ঘনিষ্ট আত্মীয় হবার কারণেই এটি হয়েছে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একই
সময়ের অন্যান্য নিয়োগে আমার কাছে সেটি মনে হয়নি।
১৯৯৮ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান
থাকা অবস্থায় শাহ আবদুল হান্নান তার আমলা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান। তখনো তার
চুক্তির কিছু সময় বাকি ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের একটি প্রভাবশালী শিল্পগ্রুপকে উচ্চ
পর্যায়ের চাপে নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে কর সুবিধা দেবার চেয়ে তিনি দায়িত্ব ছেড়ে চলে
যাওয়াটাকে শ্রেয় মনে করেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বটি সরকারের
মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সবচেয়ে সংবেদনশীল পদগুলোর মধ্যে একটি। রাষ্ট্রের রাজস্ব নীতি
নির্ধারণে যুক্ত বাজেট প্রণয়ণের মূল কাজটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সম্পন্ন করে। একই
সাথে প্রতিষ্ঠানটির ছোট খাট সিদ্ধান্তে অনেকের শত কোটি টাকার লাভ লোকসানের বিষয়
নির্ধারিত হয়।
শাহ আবদুল হান্নানের দায়িত্ব পালনের বড় অংশ
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত
মেধাবি একজন ছাত্র হিসাবে সিএসপি কর্মকর্তা হওয়াকে বেছে নিতে পারতেন। সম্ভবত তার
মরহুম পিতার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে কাজ করার স্মৃতি তাকে এই ক্যাডার পছন্দ করতে
ভূমিকা রেখেছে। শুধু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেই নয় দুর্নীতি দমন ব্যুরো অথবা বাংলাদেশ
ব্যাংকে দায়িত্ব পালনের সময়ও সততা ও কর্তব্যনিষ্টার সাথে তিনি কখনো আপস করেননি।
তবে ক্ষমা করা,
সুযোগ দেয়ার পাশাপাশি প্রান্তিক অবস্থান না নেয়াটাকে তিনি বেছে
নিয়েছিলেন। ৮০ বছর বয়স পার হবার পর তিনি ‘আমার জীবনের
উপলব্ধি’ নামে ২০ দফা পরামর্শ সম্বলিত একটি ছোট লেখা
লিখেছিলেন। এতে তিনি বলেছিলেন, ‘মধ্যপন্থাই উত্তম।
আল্লাহতায়ালা কুরআনে মধ্যপন্থার কথা বলেছেন। মুসলিম জাতিকে তিনি ‘মধ্যপন্থী’ উম্মত বলেছেন। আর হঠকারিতা ও বাড়াবাড়ি
ভালো নয়। কুরআনের বিভিন্ন জায়গাতে বাড়াবাড়ির নিন্দা করা হয়েছে। সূরা নাহলের ৯০
আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন।’ প্রশাসনিক
দায়িত্ব পালনে তার এই নীতির অনুসৃতি আমরা দেখতে পেতাম। হয়তো এ কারণে পরবর্তীতে
কেবলমাত্র আদর্শগত কারণে অনেকে তার প্রতি ব্যক্তিগত শত্রুতায় যুক্ত হতে চেয়েছেন।
কিন্তু এতে তার ক্ষতি হয়নি অথবা তার সম্মান ও মর্যাদা কেউ কেড়ে নিতে পারেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকে তিনি সম্ভবত বছর তিনেক
ছিলেন। এসময় তাকে অপছন্দ করতেন এমন কাউকে আমি দেখিনি। তার জীবনের একবারে শেষ দিকের
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি ঘটনা আমার মনে পড়ে। একটি ব্যক্তিগত কাজে তিনি বাংলাদেশ
ব্যাংকে যান এবং গিয়ে তদানীন্তন ডেপুটি গভর্ণর সিতাংশু সুর চৌধুরির চেম্বারে গিয়ে
বসেন। তার কাজটি এস কে সুর চৌধুরি নিজে উদ্যোগি হয়ে দ্রুত সম্পন্ন করে দেন। এরপর
তিনি চলে যান। ঘটনাক্রমে সেদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের চল্লিশ তলা ভবনে ছোট একটি
অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। কিছু লোক প্রচারণা চালাতে থাকেন শাহ সাহেব বাংলাদেশ
ব্যাংকে গিয়ে নাশকতার পুরো ঘটনা ঘটিয়ে চলে গেছেন। এ জন্য বেশ দৌড়ঝাপও শুরু হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকে আসা যাওয়া ও একেবারে অল্প সময়ের অবস্থানের পুরো ঘটনা ডেপুটি
গভর্ণর সুর বাবুর সাথে হওয়ায় শেষ পর্যন্ত কাহিনীটি তৈরি করা সম্ভব হয়নি। শাহ আবদুল
হান্নান নিজেও জানতেন না তাকে নিয়ে এত বড় এক ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল।
শাহ আবদুল হান্নান সরকারি দায়িত্ব পালনের সময়
মনে হয়েছে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সততার ব্যাপারে সামান্যতম আপসও করেননি। তবে রাষ্ট্রীয়
নীতি প্রণয়নের ব্যাপারে এর সাথে সাংঘর্ষিক কিছু মনে হলে তিনি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের
দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন এরপর যে সিদ্ধান্ত আসতো তা নিজের মনপুত না হলেও বাস্তবায়নে
বাধা হয়ে দাঁড়াতেন না। যার ফলে কোন সরকারের সময় দায়িত্ব পালনে শাহ আবদুল হান্নানের
বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়নি যদিও সব সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ জানতেন
তিনি একজন প্রাকটিসিং মুসলিম এবং সৎ কর্মনিষ্ট ব্যক্তি। একই সাথে তিনি বেশ কিছু
দাতব্য শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত রয়েছেন যেগুলোর বিশেষ পরিচিতি
রয়েছে।
শাহ আবদুল হান্নান একটি বুদ্ধিবৃত্তিক
আন্দোলনকে গন্তব্যে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখতেন। এ লক্ষ্যে তিনি ‘পাইওনিয়ার’ প্রতিষ্ঠিত করেন যুবকদের শিক্ষা ও গাইড দেয়ার জন্য। আর ‘উইটনেস’ প্রতিষ্ঠা করেন মেয়েদের জন্য। এর সাথে
নিয়মিত কোরান ক্লাসের মাধ্যমে সর্বস্তরের আমলা ও পেশাজীবীদের সত্য ও কল্যাণের পথে
আহবান করে গেছেন। শাহ আবদুল হান্নান একাধারে ছিলেন চিন্তাবিদ, প্রায়োগিক অর্থনীতিবিদ এবং একজন সংস্কারকামী ব্যক্তিত্ব। তিনি ইসলামী
অর্থনীতি, ব্যাংকিং, সামাজিক সংস্কার
এবং ইসলামের বিভিন্ন দিকের উপর বই ও অসংখ্য প্রবন্ধ লিখে গেছেন। উসুলে ফেকাহর উপর
তিনি একটি গুরুত্বপূর্ন বই তিনি লিখেছেন। এই বিষয়ে তিনি আমাদের এক সভায় আলোচনা
করেন। এই বিষয়ে তিনি কতটা পারদর্শী তা আমরা সাধারণ শিক্ষিতরা অতটা বুঝতে পারার কথা
নয়। দুইজন মাদ্রাসার কামেল পাস করা আলেম বলেছেন, উসুলে
ফেকাহর উপর তিনি যে উচ্চ মার্গের আলোচনা তাদের একটি ক্লাসে করেছেন তা মাদ্রাসার
সর্বোচ্চ শ্রেণীতেও কোন ওস্তাদের কাছে তারা কোন দিন শুনেননি। তিনি আমাদেরকে বলতেন
কোরআন হাদিস গভীরভাবে বুঝতে হলে উসুলে ফেকাহ জানতে হবে।
শাহ আবদুল হান্নান বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং
প্রবর্তন এবং এর এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছেন। অবসরের পর দেশের
বৃহত্তম বেসরকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান
হিসাবে সরাসরি প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, দারুল এহসান ইউনিভার্সিটি
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়
চট্টগ্রাম এবং মানারত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠায় তার গুরুত্বপূর্ন
ভূমিকা ও নেতৃত্ব ছিল। দেশে বিদেশে হাজার হাজার শিক্ষিত পেশাজীবী আমলা শিক্ষকের
নির্দেশকের ভূমিকা রেখেছেন তিনি। তার উত্তর গোডানের বাসায় যখনই গেছি কোন না কোন
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা সাবেক বা বর্তমান আমলাকে পেয়েছি যারা শাহ হান্নানের
কাছে গাইডলাইন বা পরামর্শের জন্য এসেছেন।
২০০৪ সালে দৈনিক নয়া দিগন্ত আত্মপ্রকাশ করলে
আমি এই প্রতিষ্ঠানে চীফ রিপোর্টার হিসাবে যোগ দেই। নয়া দিগন্তের স্বত্তাধিকারী
প্রতিষ্ঠান দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা এবং
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বোর্ড চেয়ারম্যান। সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তা, সচিব বা বাংলাদেশ ব্যাংকের
ডেপুটি গভর্ণর হিসাবে তাকে যেভাবে দেখেছিলাম এবার দেখার সুযোগ হয় বেশ খানিকটা অন্য
রকম। তিনি পত্রিকার নীতি নির্ধারণের দৈনিন্দন কাজের সাথে সম্পৃক্ত হতেন না। নিত্য
প্রশাসনিক বিষয়গুলোও তিনি দেখতেন না। কেবল কনন্টেন্টের ব্যাপারেই তিনি কথা বলতেন
এবং পরামর্শ দিতেন। সপ্তাহে বা মাসে একবার সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে তিনি বসতেন।
বার্তা সম্পদক হিসাবে দায়িত্ব নেয়া, এর পর সম্পাদকীয় বিভাগের
দায়িত্বে যাওয়া, আবার শেষে আবার ডেপুটি এডিটর হিসাবে বার্তা
বিভাগে ফিরে আসার পরে জনাব শাহ হান্নানের যোগাযোগটি অনেকটাই নিয়মিত বিষয়ে পরিণত
হয়। তিনি ফোন করেই আগে সালাম দিয়ে বলতেন আমি কি কয়েক মিনিট কথা বলতে পারবো?
তিনি ছিলেন আমাদের বোর্ড চেয়ারম্যান কিন্তু কথা বলতেন এটি কি করা
যাবে বা এভাবে করলে কি ভালো হবে- ভেবে দেখো। এই ধরনের একটি নির্দেশনার ব্যাপারে
শেষ দিকে একবার ফোন করলে তখন আমি জানাই যে এখন চট্টগ্রামে আছি আম্মাকে নিয়ে ঢাকায় ফেরার
পর অফিসে গিয়েই কাজটি দেখবো ইনশাল্লাহ। তখন আম্মার বয়স আর শরীরের কী অবস্থা তার
খুটিনাটি জিজ্ঞেস করেন। আমি বলি যে আম্মার বয়স এখন ছিয়াশির কোটায় তখন তিনি বলেন
আমার চেয়ে চার বছর বড়। এর পর যত বারই তিনি ফোন করেছেন প্রায় প্রতিবারই আম্মা কেমন
আছেন সেটি আগে জিজ্ঞেস করতেন।
সর্বশেষ করোনা থেকে সুস্থ হয়ে উঠার পর যখন
হান্নান ভাইয়ের আওয়াজ আবার ফোনে ভেসে আসে, তখন উনার কণ্ঠটা একবারে ম্রিয়মান মনে হয়।
তিনি কাজের কথাটি বলে জানান যে শরীরটা বেশ দুর্বল হয়ে গেছে। আমার জন্য দোয়া করো।
হান্নান ভাইয়ের শরীরের কথা বিবেচনা করে ফোন
করার কথা ভাবতাম না। হালিম ভাইয়ের কাছ থেকে জেনে নিতাম কি অবস্থা। সর্বশেষ শারিরীক
অবস্থার অবনতি এবং হাশপাতালে ভর্তি হওয়া এবং সেখানে পিছলে পড়ে পা ভেঙে যাওয়া আর
শেষ পর্যন্ত লাইফ সাপোর্টে যাওয়ায় আমরা দুহাত তুলে হান্নান ভাইয়ের জন্য জন্য দোয়া
করেছি। কিন্তু পরম করুণাময় আল্লাহই জানেন কিসে তার বান্দার মঙ্গল। সর্বশক্তিমান
নিজের কাছেই নিয়ে গেছেন সৎ ও কল্যাণের পথে চির আহবানকারী মানুষটিকে। শিশুকালের
অতিদুষ্ট হীরা নামের এই ছেলেটি হিরকের চেয়ে দামি এক ব্যক্তি হয়ে ফিরে গেলেন প্রভুর
কাছে। বায়তুল মোকাররমে মরহুমের দ্বিতীয় জানাজা শেষে শেষ বারের মতো এই মহান
মানুষটির নিষ্প্রাণ উজ্জল চেহারা দেখে মনে হয়েছে জান্নাতের অনেক উচ্চ কোন স্থান
সর্বশক্তিমান তার জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন। মহাপ্রভু আমাদের প্রিয় মানুষটির জন্য
স্থায়ী জীবনে জান্নাতুল ফেরাদাউস মঞ্জুর করুন- এই আমাদের প্রার্থনা।
মাসুম খলিলীঃ বিখ্যাত সাংবাদিক
আমার দেখা শাহ আব্দুল
হান্নান
Shakil Abdullah
শাহ আব্দুল হান্নান ইন্তেকালের পর আমার কেবলই
মনে হচ্ছিল হয়ত তিনি শেষ যে বইটি পড়ছিলেন সেটা বালিশের পাশে উল্টে রাখা আছে। আর
বইয়ের ভেতর গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো তার স্বভাবসূলভ ইষৎ এবড়োথেবড়ো ভাবে আছে দাগানো।
হয়ত তিনি পরিকল্পনা করছিলেন এ বইটি যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা কাউকে বলবেন। হয়তো যে
বইগুলো-লেখাগুলো তিনি বিলি করবেন বলে ভেবেছিলেন সেগুলো এখনও খাটের পাশে স্তুপ করে
রাখা আছে। কারণ এভাবেই জীবনের একেবারে শেষ পর্যায় পর্যন্ত তিনি কনসিস্টেন্টলি কাজ
করে গেছেন, সর্বোচ্চ যতদূর সম্ভব। শাহ আব্দুল হান্নানকে
পরিচয় করিয়ে দেবার সময় সাবেক সচিব কথাটি যুক্ত করা হয়। এটা সত্য। তবে তার
বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের ব্যপ্তির মাধ্যমে এ পরিচয়টি তিনি অনেক আগেই অতিক্রম করে
গেছেন। এদিক থেকে প্র্রথম আলোতে প্রকাশিত হওয়া তার সহকর্মীর “উত্তর গোড়ান নিবাসী এক সচিবের কথা” লেখাটি তার
জীবনের শুধুমাত্র একটি দিককে আলোকপাত করেছে। তবে একথা সত্য যে তার কাজের ক্ষেত্র
এতটাই বহুমাত্রিক যে কোন একজন ব্যক্তির পক্ষে সবদিক জানা বা আলোকপাত করা কঠিন হতে
পারে। এখানে আমি তাকে যতটুকু দেখেছি সেই সম্পর্কে সামান্য আলোচনা, স্মৃতিচারণ করব।
২০০৯ সাল, পিলখানা হত্যাকান্ডের দ্বিতীয় কি তৃতীয়দিন
চলছে। তখনও তীব্র উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। আমাদের সামনেই তিনি
প্রধানমন্ত্রীর একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টাকে ফোন করে বললেন বর্তমান পরিস্থিতিতে
প্রধানমন্ত্রী যেন সব দলকে নিয়ে বসে আলোচনা করেন। যদিও আমরা বা তিনিও জানতেন এটা
কখনই ঘটবেনা। কিন্তু এভাবেই বিভিন্ন বিষয়ে রাষ্ট্রীয় বা ইসলামী শীর্ষ পর্যায়ের
ব্যক্তিদের দেশের জন্য, ইসলামের জন্য যেটা ভাল ও সঠিক মনে
করতেন সেই পরামর্শ তিনি সরলভাবে দিতেন, দিয়ে গেছেন সারা
জীবন। একবার মোসাদ্দেক আলী ফালুর সাথে দেখা হল, যিনি তখন
এনটিভির মালিক। শাহ আব্দুল হান্নান তাকে বললেন, আপনি সব
চ্যানেল মালিকদের নিয়ে বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন যে আপনারা অশোভন-অশ্লীল বিজ্ঞাপন
আপনাদের চ্যানেলে দেখাবেননা। সম্ভবত তিনি তাকে নানাভাবে কনভিন্স করার চেষ্টা করে
ভালভাবে চেপে ধরেন, ফলে তিনি একাজ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি
দিতে বাধ্য হন। অনেক কিছুই হয়ত এরকম ভাল কিন্তু অবাস্তব ছিল, কিন্তু আবার অনেক পরামর্শ আমরা নিশ্চিতভাবে জানি অনেককে এবং অনেক ঘটনাকে
প্রভাবিত করেছে।
এভাবে তিনি ছোট ছোট থেকে শুরু করে বড় অনেক
কাজের প্রত্যক্ষ উদ্যোক্তা বা পরোক্ষ অণুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি সবাইকে তার
পটেনশিয়াল পূর্ণভাবে ইসলামের জন্য ব্যবহার করতে উৎসাহিত করতেন। এজন্য যত বড় বা
নগণ্য মানুষই হোক না কেন তার পেছনে সময় দিতেন। তিনি আমাদেরকে পড়াচ্ছিলেন ড. ইসমাইল
রাজী আল ফারুকীর লেখা একটি উচুমানের বই “Al Tawhid:
Its Implications for Thought and life” । বইটি শেষ অধ্যায়ে ছিল aesthetics বা নন্দনত্ত্ব নিয়ে
আলোচনা। লেখকের প্রস্তাবনা ছিল পাশ্চাত্য, মুসলমানরা নন্দনত্ত্বে পিছিয়ে আছে বলে দাবী
করলেও, পাশ্চাত্য ধারার (Figurization) এর বাইরে গিয়ে তৌহিদের
মূলনীতির আলোকে মুসলমানরা একটি উচুমানের নন্দনতাত্ত্বিক নীতিমালা (stylization) তৈরী করে, যার ফলে Arabesque এবং caligraphyর মত দু’টি উচ্চমানের শিল্পধারা তৈরী হয়। যাইহোক,
তিনি আমাকে বল্লেন, এই আলোচনাটা খুবই মৌলিক
এবং তার ধারণা এ বিষয়ে বাংলাদেশে হাতেগোণা কিছু লোক ছাড়া সম্ভবত কেউ জানেনা। এটি
প্রচার হওয়া দরকার। তিনি আমাকে এ অধ্যায়টি অনুবাদ করতে উৎসাহিত করলেন। অনুবাদ করতে
যেয়ে দেখি এই আলোচনার বড় অংশ দর্শনকেন্দ্রিক, যাকে সহজ ও
বোধগোম্যভাবে অনুবাদ করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। কিছু অংশ আসলেই সঠিক অর্থ প্রকাশ
করছে কীনা এ বিষয়ে আমি খুবই বিচলিত হয়ে পড়লাম। তিনি সহজ সমাধান দিলেন, সমস্ত ambiguous অংশ পুরোপুরি কেটে লেখাটিকে ছোট করে ফেললেন।
এক লাফে যে চাপ আমি বোধ করছিলাম তা দূর হয়ে গেল। এভাবে তিনি সহজভাবে সবকিছু
উপস্থাপন ও সম্পন্ন করতে পছন্দ করতেন। যাইহোক শেষ পর্যন্ত একটি সারসংক্ষেপিত
ভাবানুবাদ দাড়ালো। এটাকে একটি বুকলেটের মত করে তিনি ছাপাতে বললেন এবং ছাপার জন্য
তিনিই টাকা দিলেন। পরবর্তীতে তার বিভিন্ন ইসলামিক ক্লাসে সেগুলো নিজেই বিতরণ
করেছেন।
বাংলাদেশে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি আধুনিক
শিক্ষিত বিশেষত দেশের শির্ষস্থানীয় বিদ্যাপীঠগুলোর ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ইসলামী
ক্লাস বা পাঠচক্র চালু করেন আশির দশকে। নিয়মিত ক্লাসের মাধ্যমে ইসলামের ধারণাগুলো
পরিষ্কার করে,
ইসলামের জন্য কাজ করতে উৎসাহিত করে মানুষ গঠনের এক অনন্য, কার্যকর ধারা তিনি চালু করেন। ইসলামের জন্য সামান্য কিছু কাজ হওয়ারও
সম্ভাবনা আছে এমন লোকগুলো তিনি বিভিন্নভাবে খুজে খুজে বের করে তার সাথে যোগাযোগ
করতেন। এভাবেই কোন একভাবে তার সাথে যোগাযোগ ও দীর্ঘ সময় প্রতি সপ্তাহে তার বাসায়
ক্লাস করার সুযোগ হয়। তার আগে বাংলাদেশে একাজ এভাবে কেউ করেছে বলে আমার জানা নেই।
অন্যান্য অনেক বিষয়ের মত এ বিষয়ে তিনি অগ্রপথিক।
নব্বই দশক-এর শেষ দিক। বাংলা ব্লগ চালুর আগে
এবং সোশ্যাল মিডিয়ার অ-নে-ক আগের কথা। যখন বাংলাদেশে ইন্টারনেট সাধারণ মানুষের
মধ্যে প্রায় নতুন,
তিনি এ সময়ই ইন্টারনেটে ইসলামের জন্য কাজ করার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন
এবং এদিকে মনোনিবেশ করেন। তখন বড় মাধ্যম ছিল ই-মেইল group। তিনি অসংখ্য ই-মেইল group মেম্বার হন, তাছাড়া তার নিজের একটি group তৈরি করেন। দেখেছি ঐসময়টাতে
আল্লার ওয়াস্তে যার সাথে দেখা হত, যিনিই তার বাসায় আসতেন,
তার কাছে থেকে ইমেইল এড্রেস নিতেন এবং তার groupএ তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত
করতেন। এভাবে একদিকে তিনি নিজের group এবং অন্যান্য group-এর মাধ্যমে বিভিন্ন
গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক ম্যাটেরিয়াল ছড়িয়ে দিতেন। অন্যদিকে নাস্তিক্যবাদ ও অন্যান্য
ইসলাম বিরোধী প্রচারণার জবাব দিতেন। এই বিতর্কগুলো বাংলা ব্লগ এবং তারপর সোশ্যাল
মিডিয়াতে যাওয়ার আগে ই-মেইল groupএ হত । মনে আছে মুক্তমনা
নামে একটি ই-মেইল group ছিল যাদের মূল এজেন্ডা ছিল নাস্তিক্যবাদ এবং
তারা ইসলাম বিরোধী প্রচারণা করত। তাদের তোলা বিভিন্ন প্রসংগ-প্রশ্নের তিনি জবাব
দিতেন। এতে সেখানে তুমুল বিতর্ক লেগে যেত। এ প্রেক্ষিতে তিনি ইসলাম বিরোধীতার জবাব
দেবার কিছু মূলনীতির কথা বলতেন যেগুলো তিনি মেনে চলতেন এবং আমাদের মেনে চলতে
উৎসাহিত করতেন। যেমন, একটি হলো কোনভাবেই polemicsএ না জড়ানো। অর্থাৎ একটি
বিষয়ে উত্তর-প্রতিউত্তরের মাধ্যমে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে পেতে যখন ভাষা উগ্র আকার
ধারণ করে এবং অপর পক্ষ গালিগালাজ শুরু করে তখন তিনি সেখানে কথা বলা সম্পূর্ণ বন্ধ
করে দিতেন। অন্য আরেকটি মূলনীতি হল প্রতিপক্ষের সব কথার জবাব না দিয়ে মূল দুই একটি
পয়েন্টের দিকে ফোকাস করা। তিনি বলতেন, একটি বিল্ডিংয়ের মূল কিছু পিলার ধ্বসিয়ে
দিলে সেটা দাড়িয়ে থাকতে পারেনা। এজন্য তার উত্তরগুলো হতো সবসময় সংক্ষিপ্ত।
তিনি অন্যদেরকেও একাজ করতে বলতেন। অনেকসময়
তিনি টিম ওয়ার্ক করতেন। সবসময় তিনি সরাসরি জবাব না দিয়ে ফোন করে জবাব লিখতে বলতেন।
তিনি হয়ত শুরুতে বা শেষে অংশগ্রহন করতেন। তার এই ইন্টারনেট ভিত্তিক কাজ শুধু
বাংলাদেশ কেন্দ্রিক ছিলনা। এজন্য অনেক সময় তার গুরুত্বপূর্ণ বাংলা লেখা ছড়িয়ে দেবার
জন্য ইংরেজীতে অনুবাদ করিয়ে নিতেন। এরকম বেশকিছু অনুবাদ করার সুযোগ তিনি দেন, অনেক সময় সাথে সাহায্যকারী
হিসেবে ছিল তখন ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র, এখন যুক্তরাষ্ট্র
নিবাসী Mehrab Bakhtiar। এসব কাজকে তিনি এত গুরুত্ব দিতেন যে তার
কম্পিউটার এক মূহুর্তের জন্য খারাপ থাকলেও তিনি দারুণ পেরেশান হয়ে পড়তেন এবং ফোন
করে বাসায় ডেকে পাঠাতেন। এমকি মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগ পর্যন্তও তার এসিসটেন্টের
সহায়তায় তিনি তার ই-মেইল কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। আসলে আমি জানিনা এরকম সিনিয়র
পর্যায়ের স্কলারলি কোন লোক এ ধরণের কাজ এত গুরুত্ব দিয়ে রিলেন্টলেসলি এভাবে করেছে
বা করছে কী-না। হতে পারে এ বিষয়েও তিনি অন্যতম, অনন্য।
তিনি আলেমদের সম্মান করতেন, দেখেছি বড় বড় আলেমরাও তাকে
সম্মান করত। অথচ তেমন বড় আলেম নয় কিংবা আলেমই নয় (হয়ত কোন ডিগ্রী আছে) এমন অনেককে
তার সমালোচনা করতে শুনেছি যে ‘তিনি কী জানেন?’ এ বিষয়টি খুবই হাস্যকর লাগত আমার। তিনি আলিমদের কাছ থেকে শিখতেন, আবার আলেমদেরকেও তার যুক্তি দিয়ে প্রভাবিত করতেন। বায়তুল মুকাররমের সাবেক
খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তারা পরষ্পরকে সম্মান
করতেন। “বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন”-এর মত
ফিকহী বিষয়ের একটি কঠিন প্রযেক্টে ও অন্যান্য এরকম আরও কাজে তিনি মাওলানা উবায়দুল
হকের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন।
উসুল আল ফিকহ, ইসলামী জ্ঞানের একটি অন্যতম
গুরুত্বপূর্ণ শাখা। তিনি এর গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং প্রায় বিশ বছর ধরে এ বিষয়ে
পড়াশুনা করেন এবং আরও প্রায় দশ-পনেরো বছর ধরে সহজভাবে সবার মধ্যে এ জ্ঞান বিতরণের
প্রচেষ্টা চালান। এ বিষয়ে তিনি প্রথম একটি অনলাইন কোর্স চালু করেন এবং ঐ কোর্সকে
উদ্দেশ্য করে ইংরেজীতে একটি বই লিখেন। পরে বইটি বাংলায় অনুবাদ হয়। সম্ভবত এখন
পর্যন্ত বাংলা ভাষায় এটিই উসুলের উপর সহজ করে লেখা একমাত্র পূর্ণাঙ্গ বই। তার
উৎসাহেই এ বিষয়ে আগ্রহ বোধ করি ও পড়াশুনায় উৎসাহিত হলে তিনি খুব খুশি হন। একসময়
আমি তার বই-এ কিছু বিষয় যুক্ত করার পরামর্শ দিলে তিনি সে বিষয়গুলি আমাকে যোগ করে
তাকে দেখানোর জন্য বলেন, এবং তিনি বলেন আমি কাজটি করতে পারলে,
পরবর্তী সংস্করণে তিনি তা যোগ করে দেবেন। এটা তার একটি আশ্চর্য গুণ,
আমার মত অত্যন্ত নগণ্য ব্যক্তিই হোক বা অন্য যে কেউ হোক তিনি
সমালোচনা, পরামর্শ খুব সহজভাবে নিতেন, যুক্তিপূর্ণ
হলে গ্রহন করতেন।
এর কারণ হলো তিনি নিরহংকার ছিলেন। ইসলাম
সম্পর্কে সারাজীবন পড়াশুনা করার কারনে তিনি প্রচুর জানতেন। কিন্তু এজন্য কোন
অহংকার করতে কখনও দেখিনি। কষ্ট লাগে, বর্তমানে দেখি অনেকেই আরবী ভাষার কোর্স করে
বা পিএইচডি করে, সামান্য কিছু জ্ঞান অর্জন করে নিজেদের লেখায়,
কথায়, আচরণে এমন হামবড়া, সবজান্তা ভাব দেখায় যেন মনে হয় তারা বিরাট কিছু হয়ে গেছে, তাদের চেয়ে বড় আলেম, জান্নেওয়ালা ও সঠিক মতের
অধিকারী আর কেউ নাই। আসলে এরা প্রকৃত জ্ঞানের কিছুই এখনও অর্জন করতে পারেনি। আমি
মনে করি, শাহ আব্দুল হান্নান একজন প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি
ছিলেন, এজন্য তিনি নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করতেননা। অনেক
বিষয়েই প্রচুর পান্ডিত্য থাকার পরও তিনি অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় লিখতেন। পান্ডিত্য
জাহিরের জন্য বাগাড়ম্বরপূর্ণ লেখা বা বক্তব্য তিনি দিতেননা। তার সব কাজের উদ্দেশ্য
ছিল দাওয়াহ।
দোয়া করি, আল্লাহ তার দ্বীনের এই একনিষ্ঠ দায়ীকে কবুল করুন। তার সব গুনাহ মাফ করে দিয়ে তাকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন।
শাহ আবদুল হান্নান
একটি উদ্যোগী জীবনের নাম
লেখক: ইবনে কারীম আহমদ মিঠু
দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান শাহ
আবদুল হান্নান চাচা আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। রাজধানীর
একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার তিনি ইন্তেকাল করেন।
মরহুমের ভাই শাহ আবদুল হালিম বলেন, গত ৮ মে থেকে তিনি হাপাতালে
চিকিৎসাধীন ছিলেন। আজ বুধবার সকাল সাড়ে ১০টায় দ্বিতীয় দফায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে
তিনি ইন্তেকাল করেন।
আজ বাদ জোহর মরহুমের প্রথম জানাজা ধানমন্ডি
ইদগাহ মসজিদে, বাদ আসর দ্বিতীয় জানাজা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে এবং এর পরে শাহজাহানপুরের
কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হবে বলে জানানো হয়েছে।
শাহ আবদুল হান্নান ছিলেন একজন ইসলামী
চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, লেখক, অর্থনীতিববিদ ও সমাজ সেবক। তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ছিলেন। এছাড়াও তিনি দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়
ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ
লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন। এমন শতশত প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি।
শাহ আবদুল হান্নান ১৯৩৯ সালের ১ জানুয়ারি
বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী থানার বিখ্যাত শাহ পরিবারে
জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ও
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক এবং ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
শাহ হান্নান তার কর্মজীবন শিক্ষকতার পেশা
দিয়ে শুরু করেন। তিনি ১৯৬২ সালে ঢাকা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসাবে যোগ
দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি পাকিস্তান ফিন্যান্স সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে সর্বশেষ
বাংলাদেশ সরকারের সচিব পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন।
এর মাঝে তিনি ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের
চেয়ারম্যান, যেখানে তিনি ভ্যাট চালুর অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের
ব্যাংকিং বিভাগ, সমাজ কল্যাণ ও সর্বশেষ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আভ্যন্তরীন সম্পদ বিভাগের সচিব
ছিলেন। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালক
হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। হান্নানের এক ছেলে, এক মেয়ে, তিন ভাই
অনেক আত্মীয় স্বজন ও গুণগ্রাহি রয়েছেন।
বাংলাদেশে এবং ইসলামী আন্দোলনে ওনার হাত ধরেই
অনেক প্রতিষ্ঠান ও কল্যাণকর কাজের শুভ সূচনা হয়েছে। ওনার লেখা, চিন্তা
ভাবনা গুলো সমাজে নতুন নতুন কাজ সৃষ্টি করতো। যখনই কোন ভালো উদ্যোগ নিয়ে ওনার কাছে
কেউ ছুটে যেতেন তিনি সেই ভালো কাজকে নিজের কাজ হিসেবে লেগে পরতেন বাস্তবায়নে।
আমাদের একটি উদ্যোগ নিয়ে যখন কথা বলতে ওনার সাথে কথা বললাম তিনি এতো উৎসাহ দিলেন
যেন ওনার কাজ আমরা সহযোগিতা করছি মাত্র এমন মনে হলো। ক্বরদান হাসানা ব্যাংক এনজিও, এর
কাজটাকে সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেয়ার উদ্যোগকে উনি সুদের বিরুদ্ধে মুজাদ্দিদের
ন্যায় কাজ হবে বিবেচনায় মন্তব্য করেন। উনি একাজটাকে বেশি প্রচারনার চেয়ে নিরবে কাজ
করে যাওয়ার বিষয়ে আমাদেরকে শক্ত ভাবে নির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। ওনার
চিন্তা ছিল কাজটা ভালোভাবে হওয়া দরকার, উনাকে যখন কোন Branch এর অগ্রগতির খবর দিতাম তিনি মহান
রবের ভূয়সী প্রশংসা করতেন। কাজটাকে আরো নিরবে এগুতে নানা ভাবে উৎসাহিত করতেন। ওনার
দেয়া রেফারেন্সের সূধী শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিকট ক্বরদান হাসানার বিষয়ে আহবান পৌঁছাতে
গেলেই দেখেছি সূধী মহলে অভাবনীয় সাড়া। মানুষ যে কি পরিমাণে সম্মান আর শ্রদ্ধা করেন
চাচাকে তা আপ্লূত হওয়ার মতো। তখন আমাদের
মনে হতো আমরা
চাচাকে মনে হয়
সাধারণ সূধী শুভাকাঙ্ক্ষীর ন্যায় এতো শ্রদ্ধা বা সম্মান করতে ব্যর্থ হচ্ছি। তখন
আমার কাছে একটা অপরাধবোধ কাজ করতো। চাচাকে মাঝে মাঝে বলতামও। তিনি হেসে উড়িয়ে
দিতেন।
ইয়া আল্লাহ! আমাদের চাচাকে আপনার জন্য নিয়ে
গেলেন কিন্তু আমাদের জন্য শুন্যতা পূরণে আব্দুল হান্নান চাচার মতো আরকে? যেখানে
তোমার আন্দোলনের জন্য শতশত আব্দুল হান্নান দরকার সেখানে আমাদের একমাত্র সম্বল সেই
প্রিয় চাচাকেওতো আপনি নিয়ে গেলেন! আব্দুল হান্নান চাচার স্বপ্ন গুলো পূরণে নতুন
প্রজন্ম ও নেতৃত্বকে এগিয়ে আসতে হবে। নিজেদেরকে গড়ে তুলতে হবে মানুষ ও দেশের
কল্যাণে যোগ্যরুপে।মেলে ধরতে হবে সব চেষ্টা সবার উপকারে। ওনার আদর্শের একঝাঁক
সৈনিক গড়ে উঠুক দেশের সকল প্রান্তে। সকল অঙ্গনে।
আমার জানা ৫ টি ঘটনাঃ
১)আমার ফুপা শশুর চাচার অধীনে অফিসার ছিলেন।
ফুপা শশুর আব্দুল হান্নান চাচার আমল
আখলাকে এতো অনুপ্রাণিত এতোটা উদ্বীপ্ত হয়েছিলেন যে, উনি লোভনীয় চাকুরী ছেড়ে দিয়ে ছ'মিলের ব্যবসাকে নিজের জীবনের
পাথেয় হিসেবে গ্রহন করেছিলেন। আব্দুল হান্নান
চাচাও ফুপার ভূয়সী প্রশংসা করেন সৎ ও নিষ্ঠাবান অফিসার হিসেবে। মানুষকে কেমন প্রভাবিত করলে এমন
ঘটনা ঘটতে পারে। ফুপার আত্নীয় জানার পর
থেকে চাচা আমাকে জামাই হিসেবে সম্বোধন করতেন।
২) একজন ভাই যিনি এখন লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত। তিনি
নিজে তার জীবনের ঘটনাটি আমাকে বলেছেন। ঐ ভাইয়ের আর্থিক সমস্যার কারণে একসময় পড়া লেখা বন্ধ হওয়ার
উপক্রম। ঘটনাক্রমে একদিন হান্নান চাচার কাছে উনি ওনার পরিবারের সমস্যার বিষয় খুলে
বললেন। চাচা সব শুনে কোন কথা না বলেই বললেন এই নাও একটি খাতা আর যখন তোমার যা টাকা
লাগবে আমার থেকে নিবে এবং এই খাতায় লিখে রাখবে। যখন পরিশোধ করার সামর্থ হবে তখন ফেরত
দিবে। শর্ত একটাই পড়াশোনা করতে হবে বড় কিছু হতে হবে... । তিনি আজ লন্ডনে
প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। উনি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ওই খাতা এবং হিসেবের টাকা (লক্ষাধিক
টাকা) নিয়ে যখন চাচার কাছে ফেরত দেয়ার
জন্য গেলেন তখন চাচা বললেন এটাকা লাগবেনা এটা তোমার কাছে রাখো আর পারলে তোমার মতো
অন্য কারো জন্য তুমিও এমন ভাবে কিছু সহযোগিতা চালু রাখতে পারো কি না দেখ!
৩) একজন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক একটি
সমস্যায় পরে সমাধানের জন্য হান্নান চাচার
বাড়িতে গিয়েছিলেন। গিয়ে তিনি খুবই আশ্চর্য হতবাক হয়ে গেলেন। এতো বড় জব করতেন। এতো
বড় মাপের মানুষ। বসার ঘর পুরোনা কাঠের
চেয়ার টেবিল। খুবই সাদামাটা। তিনি এ অববস্থা দেখে চাচার অনুমতি নিয়ে বললেন আমি আপনাকে একটা ছোফা সেট ও টেবিল উপহার
(হাদীয়া) দিতে চাই। চাচা হেঁসে বললেন এটা আপনার মহানুভবতা। আল্লাহ তায়ালা আপনার
উপহার কবুল করুন। আমি এভাবে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আমি খুশি হবো আপনি যদি
একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (নাম বললেন সেখানে) লাইব্রেরী রুমটাকে যদি এসি করে দেন
তাহলে খুব ভালো হয় তাহলে মানুষ আরামে বসে গবেষণা ও পড়াশোনা করতে পারবে। পরে ওই
ভদ্রলোক খুশি হয়ে চাচার বলা ওই প্রতিষ্ঠান পুরোটাই সেন্ট্রাল এসি করে দেন। ওই
ভদ্রলোক দাতা নানান সময়ে এর থেকে বড় বড়
জনহিতকর কাজ করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। যা আমরা অনেকে স্বাক্ষী। সাম্প্রতিক
সময়ে সেই সম্মানিত দাতা একটি অনন্য সাদাকায় যারিয়ার কাজ করেছেন খুব নিরবে।
জাযাকাল্লাহু খয়রান। হান্নান চাচা চাইলেই এমন অনেক গিফ্ট হরহামেশাই নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি নিজের জন্য তা না
নিয়ে মানুষের কাজে লাগে এমন জায়গায় দিয়ে তৃপ্ত হয়েছেন।
৪) চাচা অবসরের সময় পাওয়া পেনশনের সমূদয় টাকা হিসেব করে সুদের অংশ
আলাদাভাবে বের করে তা সাধারণ মানুষের জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন। এমন নজির অনন্য।
৫) আব্দুল হান্নান চাচার সমসাময়িক জুনিয়র একজন
কর্মকর্তা চাচাকে নিয়ে বলেছেন একদিন আব্দুল হান্নান স্যারের বাসায় গেলাম। গিয়ে
দেখি স্যারের কাপড় রাখার মতো কোন আলনা পর্যন্ত নেই। রুমে বসার জন্য একটি মাত্র
চেয়ার। চেয়ারের হ্যান্ডেলের উপর স্যারের পরিধেয় কাপড় রাখা। চেয়ারটাও নড়বড়ে । একজন
চেয়ারে বসলে আর একজনকে বসতে হয় বিছানায়।
আমরা সকলে এমন গল্প জীবন কাহিনী গুলো শুনতে
খুব পছন্দ করি। কখনোবা
শুনতে শুনতে চোখের পানি ফেলি। কিন্তু আবছোস আমরা কেউ আব্দুল হান্নান চাচা হতে চাই
না। আব্দুল হান্নান চাচার ন্যায় যারা জীবন বেঁচে নিতে চায় তারা সমাজে হয় অবহেলিত।
উপেক্ষিত। তবুও আব্দুল হান্নানদের জন্ম হয় যুগে যুগে। শতাব্দীতে এমন আব্দুল
হান্নানদের এক দুজনই দেখা মেলে। এখনকার ছাত্ররা ছাত্র জীবন শেষ করা পর্যন্ত
অপেক্ষায় থাকতে চায় না,
এর আগেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হতে চায়। ছাত্র জীবন শেষ
করেই বনে যায় দু চারটা কোম্পানির এমডি চেয়ারম্যান। মানুষের আমানতের টাকায় গাড়ি হাঁকানো । এসি অফিস, নিজস্ব
ফ্ল্যাট বা বাড়ি ইত্যাদি নানা স্বপ্নে বিভোর। আমি ব্যক্তিগত জীবনে আর্থিক
স্বাবলম্বিতার প্রয়োজন আছে এর বিরোধী নই। সমাজে তারা সততার স্বাক্ষী রুপে দাঁড়াতে
চায় না। দুচারটা মানুষের উপকারের নামে ফটো
সেশন করে ভাইরাল হতে চায়। এই ট্রেন্ড
ভাঙতে হবে। গড়তে হবে দিকে দিকে আব্দুল
হান্নান চাচাদের উত্তরসূরী। জাগতে হবে এক সাথে হাতে হাত ধরে। যুবকরা এগিয়ে
এলে অসম্ভব নয় বরং সম্ভাবনার আগামী
ইনশাআল্লাহ আমাদের আগামী। আমি আশাবাদী
আমাদের মাঝ থেকেই বেরিয়ে আসবে শতশত আব্দুল হান্নান। আব্দুল হান্নান চাচাদের
উত্তরসূরী। আসুন আজ এক সাথে শপথ করি চাচা
আব্দুল হান্নানের আদর্শে নিজেকে ঢেলে সাজাতে। দিকে দিকে জালিয়ে দেই আলোর মশাল।
ছুটে চলি কাংখিত মঞ্জিল পানে। তবেই আগামী দিন শুধু সম্ভাবনার।
আব্দুল হান্নান চাচা কাজ পাগল মানুষ ছিলেন।
অবসর সময় খুব কম কেটেছেন জীবনে। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির আগেও চাচার কাজ বন্ধ
থাকেনি। আল্লাহ তায়ালা ওনাকে চিরতরে অবসর দিয়ে নিয়ে গেলেন তার একান্ত সান্নিধ্যে ।
পরিশেষে
মহান রব্বে কারীমের নিকট চাওয়া আমাদের আত্মার আত্মীয়
প্রিয় চাচার সকল গুনা ক্ষমা করে জান্নাতের উত্তম মর্যাদার আসনে যেন স্থান দান
করেন।
লেখক # শিক্ষক, উম্মুক্ত
বিশ্ববিদ্যালয়
তিনি চলে গেলেন
লেখক: আজাদ সোবহান আহমাদ
তিনি সবার চাচা। আবার অনেকে তাকে স্যার
বলতেন। সমীহ করার মত জীবন তার। তার নিজ প্রফেশনের বাহিরে মুহাক্কীক আলেম ও ফকীহ ছিলেন।
জীবন চলার প্রতিটি মুহর্তে ছিলেন ইসলামী
আন্দোলনের রাহবার। সরল জীবন যাপনের অনুকরণীয় ছিলেন। ছিলেন সততার উদাহরণ। কঠিন পরিস্থিতিতে যখন কেউ কথা বলতেন না। সেই
সময়গুলোতে সাহসের সাথে সব জায়গায় কথা বলতেন। ইউনিক চরিত্রের ছিলেন তিনি।
সামাজিক সকল অনুষ্ঠানে ইসলামী সাহিত্য হাদিয়া
করতেন। তিনি ফূল টাইম দ্বীনের দ্বায়ী ছিলেন। নিরন্তর উম্মাহর চিন্তা করতেন। আগামী
প্রজন্মের ঠিকানা গড়তে তিনি সার্বক্ষনিক কাজ করতেন।
গত বছর একটি প্রোগ্রামের (অনলাইন) জন্য ফোন
করেছিলাম। নিজের ও পরিবারের খোঁজ খবর নিলেন। লেখাপড়ার বিষয় পরামর্শ দিলেন। একই
দিনে আরেকটি প্রোগ্রাম থাকায় অপরাগতা জানালেন। সাংগঠনিক কিছু নাসিহা করলেন। বেশ
কিছু সালাম পৌছানোর দায়িত্ব দিলেন। আর আমাকে দেশে ফিরতে তাগাদা দিলেন।
তিনি ইমাম মওদুদীর (রঃ) সরাসরি ছাত্র ছিলেন।
ইমাম মওদুদীর (রঃ) চিন্তাধারার সঠিক ফাহাম (বুঝ) ছিল। তিনি বলতেন, বিগত
শতাব্দীতে মুসলিম উম্মাহ ও পাশ্চাত্য জগতে যে কয়জনের মুজতাহিদদের ফোকাস বেশী
পড়েছে। তার মধ্যে প্রথম ইমাম মওদুদী (রঃ) কে প্রাধান্য দিতেন। প্রথম মনে করতেন।
তার পর ঈমাম হাসান আলবান্না। তার পর শহীদ সাঈয়্যেদ কতুব, মুহাম্মদ
কতুব এবং আসাদ (রঃ)।
এই পাঁচজনের চিন্তাধারায় বর্তমান পৃথিবীতে
সঠিক মানহাযে (পদ্ধতি) ইসলামী আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে। মরহুম চাচা এটা বুঝাতেন। এই
বুঝ নিয়ে তিনি বিদায় নিয়েছেন।
আমি মনে করি তার এই গবেষণা সঠিক ছিল। যদিও বর্তমানে
আমাদের মধ্যে অনেকের আজীব ধরনের সহীহ হওয়ার প্রতিযোগীতা রয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ
কথিত সহীহ মানহাজ বা কথিত সহীহ আ’মাল নামের নতুন ফিতনা থেকে
আমাদের চাচা পরিপূর্ণ হেফাজত ছিলেন।
ইমাম মওদুদীকে পড়া ও তাকে সামাজিক ব্যপ্তিতে
গ্রহণ করার সামগ্রিক চেষ্টা কম হওয়াতে আমাদের মধ্যে দ্বীনের সঠিক বুঝ কমে যাচ্ছে।
আরো সহজ করে বললে–দ্বীন কায়েমের ফরজিয়াতে আমাদের মধ্যে যে
বিভ্রান্তি পয়দা করার চেষ্টা চলছে,
তার
কারণ সঠিক ভাবে শাহ আব্দুল হান্নান সাহেব বুঝতেন। এই পয়েন্টে
তিনি ইউনিক ছিলেন।
প্রত্যাশা করি আমাদের চাচা ভাল থাকবেন। মহান
আল্লাহ তাকে জান্নাতের মেহমান হিসাবে কবুল করবেন। তার রেখে যাওয়া কাজ সমুহ সাদাকায়ে
জারিয়া হিসাবে নিরন্তর পাবেন।
আমরা সবাই তার মত সরল ও অল্পে তুষ্ট জীবন এবং
ইসালামী আন্দোলনে নিরন্তর লেগে থাকার শিক্ষা গ্রহন করব ইনশাআল্লাহ। আমীন।
লেখক # প্রবাসী সংগঠন, লেখক, অনলাইন এক্টিভিস্ট
আমাদের চাচা...
লেখক: নুর মুহাম্মদ
এক.
ছোট্ট ড্রয়িং রুম। কম দামের সোফা আর বেডের
ওপর বসে আছেন ১৫/২০ জন সাবেক সচিব। শাহ আব্দুল হান্নান চাচার আমন্ত্রণে তাঁরই
বাসায় তিনি সাবেক সচিবদের চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। চায়ের আমন্ত্রণ মানে আক্ষরিক
অর্থে 'চা', সাথে টোস্ট বিস্কুট ছিল; আর
কিছু নয়। তিনি সাবেক সচিবদের একটা স্টাডি সার্কেল পরিচালনা করতেন। সেখানে কুরআন ও
হাদিস থেকে দারস দিতেন হান্নান চাচা,
আর
অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তন্ময় হয়ে তা শুনতেন।
আমাকে তিনি ডেকেছেন তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে
দিবেন বলে; যেন ভবিষ্যতে তাদের সাথে
একাডেমিক কিছু কাজ করতে পারি।
দরজায় আমাকে রিসিভ করলেন চাচা নিজেই। ভেতরে
ঢুকিয়ে সচিবদের সামনে নিলেন। সবাইকে সালাম জানালাম। হান্নান চাচা এক এক করে সবার
নাম ধরে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মনে হচ্ছিল আমি চিফ গেস্ট আর বাকিরা সাধারণ কেউ!
কিছুক্ষণ পর যেন আমি তাদের ক্লাস নেবো!
ভীষণ রকমের লজ্জা পাচ্ছিলাম। সর্বশেষ আমাকে
পরিচয় করিয়ে দিলেন ঠিক এভাবে- ''ওর নাম নূর মোহাম্মাদ।
আমার ভাতিজা। আমার কলিজার ভাতিজা। ভাতিজা আমার বই তৈরি করে। অনেক মেধাবী। এই
ভাতিজা একদিন আমার চেয়েও বড়ো বুদ্ধিজীবী হবে। আপনারা ছেলেটাকে দেইখে রাইখেন। আমার
ভাতিজা।''
(কথাগুলো হুবহু মনে আছে, কারণ
এ আমার জীবনের অমূল্য সম্পদ।)
এসব বলে তিনি আমার থুতনির নিচে টান দিলেন।
বললেন—কী ভাতিজা, আমি ঠিক বলিনি?
আমি নির্বাক!
আমার সম্পর্কে এসব কথা কে বলছেন?
ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান, সাবেক
সচিব, সাবেক ডেপুটি গভর্নর,
দুটো
ট্রাস্টের বর্তমান চেয়ারম্যান! খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী!
কাদের সামনে বলছেন?
দেশের খ্যাতিমান সাবেক সচিব ও বুদ্ধিজীবীদের
সামনে।
ঘটনাটা কেবল আমার সাথে ঘটেনি। আমাদের চাচা
অসংখ্য তরুণকে এভাবেই মাথায় তুলতেন। আমি জানতাম, চাচা
এক শিক্ষানবিশ তরুণ হিসেবে আমাকে কেবলই অনুপ্রেরণা দিতে কথাগুলো বলছেন। জানতাম, চাচা
যা বলছেন, তা কেবলই শিশুদের প্রবোধ
দিয়ে কিছু খাওয়ানোর মতো।
কিন্তু বিশ্বাস করুন, চাচার
এই ইন্সপাইরেশন কতটা আমাদের জীবনে প্রভাবক হয়ে উঠেছিল, আপনাদের
বুঝাতে পারব না। এভাবেই তিনি তরুণদের স্নেহ করতেন, তরুণদের
ভেতরে স্বপ্নের বীজ বুনে দিতেন। এভাবেই তিনি বারুদ জ্বালিয়ে দিতেন। ছোটোদের
কলিজাটাকে কীভাবে বিরাট বড়ো করে দিতে হয়,
তিনি
খুব ভালো করে তা জানতেন।
দুই.
বিআইআইটির একটা বই আমরা প্রকাশের চিন্তা
করছিলাম। আমরা জানতাম, হান্নান চাচা বাংলাদেশ
চ্যাপ্টার দেখেন। গেলাম চাচার কাছে। আমাদের কথা শুনলেন। সাথে সাথে বইয়ের ইংরেজি
কপিতে লিখে দিলেন- ''Take
steps to print 50 thousand copy without any roalty''.
এরপর তিনি তাঁর আত্মজীবনী 'আমার
কাল, আমার চিন্তা'র একটা কপি আমাদের হাতে
তুলে দিলেন। বইটা নিয়ে তিনি কিছু হতাশা প্রকাশ করলেন। তিনি বিনয়ের সাথে বললেন, চাচা, তুমি
কি বইটা নতুন করে প্রকাশ করতে পারো?
তিনি
তাঁর বইয়ের ইনারে লিখে দিলেন,
''Giving permission to reprint this book without any royalty''.
আমার একটা দুঃখ আছে। চাচার এই আবদার রাখতে পারিনি।
আমরা কেবলই চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে বইটার নতুন সম্পাদনা করেছি প্রায় ৬ মাস
পরিশ্রম করে। কিন্তু একটা পর্যায়ে কেবল পেশাদার কারণে বইটা প্রিন্ট করতে পারিনি।
কারণ, এই বইটা আরেকটা প্রকাশনী থেকে বের হয়েছিল এবং তারা এখনও
ছাপাতে চায়।
চাচা এই ইস্যুতে বেশ কয়েকবার আমাদের ডেকে
খোঁজ নিয়েছিলেন। কিন্তু...
ভীষণ খারাপ লাগছে চাচার এই আদেশ পালন করতে
পারিনি। চাচা...
তিন.
চাচার গোড়ানের বাসায় যারা গেছেন, তারা
কেবল বুঝতে পারবেন—কী অসাধারণ এক সাধক দুনিয়া থেকে আজ বিদায়
নিলেন। একজন সাবেক সচিব, সাবেক ব্যাংক চেয়ারম্যান, সাবেক
ডেপুটি গভর্নরের বাসা দেখলে আপনি তব্দা খেয়ে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়াবেন। বাসার
ডেকোরেশন দেখলে ভীষণ কষ্ট পাবেন। চাচা যা খেতেন, তা
দেখলে আপনি বাজার করে দেওয়ার আয়োজন করবেন। আমাদের এক কাপ চা আর বিস্কিট দিতেন; ভীষণ
সম্মান নিয়ে তা খেতাম।
বড়ো মানুষদের অনাড়ম্বর জীবনের গল্প শুনেছি
বইয়ের পাতায়, দেখিনি কখনো। তবে আমার
সৌভাগ্য এই জীবনে শাহ আব্দুল হান্নান চাচাকে দেখেছি। আমার মতো ছোটো মানুষ সমাজের
বড়ো মানুষদের সাথে মেশার সুযোগ খুব কমই পেয়েছি। কিন্তু আমাদের চাচার স্মৃতি কখনো
ভুলতে পারব না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম চাচার গল্প করে যেতে পারব।
চাচা তাঁর অসংখ্য ভাতিজা ফেলে আল্লাহ রাব্বুল
আলামিনের সান্নিধ্যে পৌঁছে গেছেন আজ। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
চাচা,
চাচা
গো... আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি। মিসিং ইউ চাচা। আপনি ডেকে নিয়ে বকা দিবেন না। পাঁচ
মিনিট দেরি হলে পাঁচ মিনিট দাঁড় করিয়ে রাখবেন না। আপনার নিজ হাতে দেওয়া চা আর
বিস্কিট খেতে পারব না।
ইবনে সিনায় পরিচিত এক ভাইয়ের চাকুরির সুপারিশ
নিতে গিয়েছিলাম। আপনি যা বলেছিলেন,
তা
আমৃতু পালন করে যাব ইনশাআল্লাহ্।
আপনাকে দেখে শিখেছি, কীভাবে
উম্মাহর জন্য স্বার্থহীন বিনা বেতনে পরিশ্রম করতে হয়। শিখেছি, কীভাবে
সর্বোচ্চ পদে থেকেও লোভ পরিহার করতে হয়। শিখেছি, বৈধ
স্বার্থও কীভাবে উপেক্ষা করতে হয়। শিখেছি,
সমালোচনার
মুখেও কীভাবে অভীষ্ট লক্ষ্যে অটুট থেকে কাজ করে যেতে হয়। শিখেছি, বিশাল
বড়ো মানুষ হয়েও কীভাবে ছোটোদের বড়ো করে তুলে ধরতে হয়।
চাচা...
Love you chacha.
আপনি আমাদের মহানায়ক।
আপনি আমাদের মহানায়ক।
আপনি আমাদের সুপার হিরো।
লেখক # তরুন উদ্যোক্তা, প্রকাশক এবং এমডি: গার্ডিয়ান পাবলিকেশন
ইনশাআল্লাহ আল্লাহ
আপনার সাথে রহমান ও রহিম, গাফফার ও গফুর
হিসেবেই আচরণ করবেন
লেখক: জিয়াউল হক
স্যারের সাথে আর দেখা হলো না। গেল বছর (২০২০)
বইমেলা থেকে ফেরার পথে হঠৎ করেই একটা ফোন পেলাম, এক
পরিচিত অধ্যাপক ও ম্যাগাজিন সম্পাদকের ফোন দেখে ধরলাম। তিনি ওপার থেকে সালামের
জবাব দিয়েই বলে উঠলেন জিয়া ভাই স্যার কথা বলবেন, এই
নেন, বলেই তিনি ফোনটা ধরিয়ে দিলেন।
এরপর ওপার থেকে খুবই পরিচিত কন্ঠের সালাম।
স্বনামধন্য ব্যংকার, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক
সচিব ও বুদ্ধিজীবি শাহ আব্দুল হান্নান স্যার। সকল পরিচিতাকে ছাড়িয়ে তাঁর এক অনন্য
পরিচিতি তিনি গড়ে তুলেছিলেন; একজন সমাজচিন্তক ও লেখক।
একজন বুদ্ধিজীবি। স্যারের সাথে প্রথম পরিচয় সম্ভবত ১৯৯৮-৯৯ সালে ইসলামি ব্যংকের
হেড অফিসে। প্রখ্যাত ব্যাংকার ও লেখক গবেষক আব্দুল মান্নান ভাইয়ের সাথে
গিয়েছিলাম।
অনেকক্ষণ সময় দিলেন প্রথম স্বাক্ষাতেই। মনে
হয়নি যে তাঁর আমার মধ্যে সেটা ছিল প্রথম স্বাক্ষাৎ। তাঁর সামনে তিনি আমাকে শ্রদ্ধা
আর ভয়ে কুন্ঠিত হতে দেননি। আড়ষ্ঠ হতে দেননি। বলা চলে, আমি
আড়ষ্ঠ ও কুন্ঠিত হবার সময়ই পাইনি। তিনি অতি আদরে টেনে নিলেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও
লেখালেখির খোঁজ নিলেন, পরামর্শ দিলেন। সে সময়
স্যার একটা ইউনিভার্সিটিতে ক্লাসও নিতেন মাঝে মধ্যে। সেই ক্লাসে যাবার সময় হলে তিনি উঠলেন, বললেন; আমার
সাথে চলো; যেতে যেতে কথা হবে, তুমি
কোথায় নামবে, বলিও, নামিয়ে
দেবো।
লিফটেও একই সাথে নামলাম। প্রথম স্বাক্ষাতে
এতোটা আপন করে নেবার অনন্য ক্ষমতা তাঁর ছিল বলেই তিনি হতে পেরেছিলেন শাহ আব্দুল
হান্নান।
হাজার
হাজার যুবক যুবতীকে তিনি চিন্তা ও চেতনার জগতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দিন রাত কাজ
করতেন। বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তাজগতের একটা শক্ত ভীত তৈরিতে তাঁর নিরন্তর
প্ররিশ্রম ছিল চোখে পড়ার মতো।
গত বছরে ফোনে কথা বলার সময় স্যার আমার
সর্বশেষ বই (একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ ও যুবমানস) নিয়ে কথা বলেছিলেন, সময়
পেলে দেখা করার জন্য বলেছিলেন। আমার মতো অখ্যাত ও নগণ্য একজনকেও তিনি স্মরণ করেছেন
দূর থেকে। কথা দিয়েছিলাম, ইনশাআল্লাহ স্যার আসবো
দেখা করতে। কিন্তু হায়, সময় হয়নি আমার। একজন
প্রবাসীর কাছে সময় যেন সোনার হরিন!
স্যারের সাথে দেখা হলো না। স্যার আজ তাঁর
রবের কাছে চলে গেলেন। ইনশাআল্লাহ স্যার,
আল্লাহ
আপনার সাথে রহমান ও রহিম, গাফফার ও গফুর হিসেবেই
আচরণ করবেন বলে বিশ্বাস করি, কারণ সারাটা জীবন আপনি
আমার, আমাদের মতো হাজার হাজার তরুণ যুবকের সামনে এই রাহমান ও রহিম, গাফফার
ও গফুরকেই তো চেনাতে ব্যস্ত থেকেছেন!
আল্লাহর কাছে আপনার জন্য মাগফেরাতের ফয়সালা
কামনা করি স্যার।
লেখক: সাংবাদিক
The departure of a great Ustadh and guide Shah Abdul
Hannan:
Hamid H Azad
I am saddened to hear that one of the great Islamic Thinkers and Founding member of many Islamic Institutions and organisations in Bangladesh, former chairman of Islami Babk Bangladesh, our beloved “Uncle”, a loving and trusted Murabbi *Shah Abdul Hannan* (Hannan Chacha) died this morning 2nd May 2021.
انا لله وانا اليه راجعون
اللهم اغفر له وارحمه واسكنه في
الجنة الفردوس الأعلى
May Allah accept all of his
contributions for the ummah and humanity, all good deeds of his colourful life
and grant him the highest Place in Jannah.
Mr. Shah Abdul Hannan was the
Chairman of BIIT Trust and Founder of BIIT. He has responded to the call of his
beloved Lord today 2 June 2021 at the age of 82 years. He had been undergoing
treatment at Ibn Sina Hospital, Dhanmondi since May 3 and died on 10:30 am
today.
Inna Lillahi Wa Inna Ilaihi
Rajiun!!
A seasoned civil servant, Shah
Abdul Hannan started his career with Pakistan Civil Service in 1963. After
Bangladesh was created in 1971, he served the country and held such important
positions as Collector of Customs and Value Added Tax (VAT), Director General
of the Bureau of Anti-Corruption, Deputy Governor of Bangladesh Bank, Member of
the National Board of Revenue (NBR). He subsequently served as the Secretary of
the Ministry of Social Welfare, Banking Division, Ministry of Finance and
finally Internal Resource Division (IRD), the Ministry of Finance and
concurrently Chairman, National Board of Revenue (NBR).
Shah Abdul Hannan was one of the
founders of North South University, Darul Ihsan University, International
Islamic University Chittagong (IIUC) and Bangladesh Institute of Islamic
Thought (BITT). He was also the founding President of the Council for
Interfaith Harmony, the Chairman of Ibn Sina Trust and the Chairman of the
Diganta Media Corporation.
Shah Abdul Hannan was a renowned
scholar of Tafsir, Hadith, Usul-al-Fiqh, Political Science, Economics, Banking
and Taxation. He has authored Soviet Union-e-Islam (1976), Islamer Arthonititey
Sarkerer Vumika (1985), Nari Somosya O Islam (1988), Islami Arthoniti: Darshan
O Karmakaushal (2002), Nari O Bastabata (2002), Desh Samaj Rajniti (2003),
Biswa Poristhiti Orthoniti O Islam Bishoyok Bishleshon (2006), Amar Kal Amar
Chinta (2008), Usul-ul-Fiqh (2011), Oshtom Kolam (2011), Nari: Islam O
Bastobata (2011), Somaj Sangskriti O Rajniti Vabna (2012), Bishoy Chinta (2013)
and Nirbachito Shankalon (2013) - all in Bangla. His English works include
Islam in Russia-Central Asia (1976), Social Laws of Islam (1995), Usul-al-Fiqh
(2000) and Law Economics and History (2003).
He played a prominent role in
the compilation of Economics in Qur’an (2 Volumes) and Bidhibaddho v by Islamic
Foundation Bangladesh in 1995.
He was a great shadow. By his
demise we have lost a trusted guardian. Hannan Chacha will not call anymore!
Please remember him in your duas.
লেখক # ব্যারিস্টার, ইউকে প্রবাসী, প্রাক্তণ সভাপতি: বাংলাদেশ
ইসলামী ছাত্রশিবির
বিদায় চাচ্চু
লেখক: ইমরান
আনসারী
চলে গেলেন খ্যাতিমান ইসলামি চিন্তাবিদ, পাবলিক পলিসি বিশেষজ্ঞ,
লেখক, গবেষক, বুদ্ধিজীবী
, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও ইসলামী ব্যাংকস কনসালটেটিভ ফোরাম ও
ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান, সেন্ট্রাল শারী'আহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অফ বাংলাদেশ-এর প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্ণর ও সাবেক সচিব, দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশন ও ইবনে সিনা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান জনাব শাহ আবদুল
হান্নান । এক জীবনে এত কাজের সাথে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত থাকা সৌভাগ্যের বিষয়।
তিনি পেরেছিলেন। একজন প্যান্ট শার্ট পড়া লোক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যেভাবে
দাওয়াতে দীনের কাজ করছিলেন তা বীরল। দিগন্ত টেলিভিশনের ঢুকার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত
মনে মনে ভাবতাম তিনি হয়তো জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ কোনো নেতা হবেন। পরে জানলাম
তিনি শুধুমা্ত্র জামাতের শুভাকাঙ্ক্ষী। একদিন দিগন্তে উনার সাথে দেখা, বলল চাচ্চু সময় পেলে একটু বাসায় এস। বাসায় যাওয়ার পর হাতে দু’টি বই ধরিয়ে দিলেন। বললেন, সাংবাদিকের অভাব নেই
দেশে, কিন্তু মুসলিম সাংবাদিকের বড় অভাব। এজন্য নিজে নিজে
ইসলামের জ্ঞান আহরণ চালিয়ে যেতে হবে। সম্ভবত বিআইআইটি প্রকাশিত উসুলল ফিকহ-এর উপর
একটি বই উপহার দিয়েছেলেন তিনি আমাকে। বছর খানেক পর আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে দাওয়াত
দিতে গেলাম, মনে মনে ভাবলাম উনি দিগন্ত মিডিয়া
কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান দাওয়াত রাখবেন কি না? কার্ড হাতে দিতেই বললেন এত কম বেতনে চাকুরি
কর , খামোকা কেন এত বড় দাওয়াতের আয়োজন করতে গেলে। ঠিক আছে দাওয়াত যেহেতু দিলে আমি যাব। ঠিকই
তিনি এসেছিলেন,
কিন্তু সবার আগে। ধারণা করছিলাম কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান বড় গিফট
বক্স নিয়ে আসবেন। কিন্তু না তিনি আসলেন কিছু বই নিয়ে । আমি তখনও ক্লাবে পৌঁছি
নাই । আমার বড় ভাই ফোন করে বলল, সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান
সাহেব এসেছেন, খাবার তো এখনও রেডি নেই। আমি বল্লাম আমি আসছি
। বললে তো আর আসা যায় না । নতুন জামাই । ক্লাবে এসে আর ওনাকে পাইনি। তো উনার
পিএস ফোন করে বলল, স্যার কথা বলবে। ফোন করেই বলল চাচ্চু
দোয়া করি সুখী হও। এরপর সুপ্রীম কোর্টে ফতোয়া নিয়ে শুনানী চলছে। ইতিমধ্যে
মরহুম ব্যারিষ্টার রফিক উল হক ফোন করলেন আনসারী একটু বাসায় এসোতো। যাওয়ার পর
বললেন আমি ফতোয়া সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রীম কোর্টের অ্যামিকাস কিউরি। এর উপর একটা
পেপার রেডি করে নিয়ে আস, সময় মাত্র তিন দিন। কি করবো ভেবে
চিন্তে কূল কিনার করতে পারছি না। এমন সময় হঠাত মাথায় এল হান্নান চাচার কথা । ফোন
দিলাম চাচা , একটু বাসায় আসতে চাই । বাসায় পৌঁছেই এ বিষয়ে
লিটারেচার পেতে উনার সাহায্য চাইলাম। সাথে সাথেই উনী কিছু বই আমাকে দিলেন । বললেন
জাতির একটা বিরাট দায়িত্ব তোমার হাতে এসে পড়েছে। খামখেয়ালি করা
যাবে না। পড়ের দিন তিনি নিজেই আবার ফোন দিয়ে বললেন আরো কিছু লিটারেচার তোমার
জন্য রেডি করেছি । পরের দিন এগুলো আনতে গেলে আমি আমার প্রাথমিক ড্রাফটি দেখাই ।
এক নজর দেখেই বললেন চাচ্চু তুমি রাইট ট্রাকে আছ। পড়ে পুরো
লেখাটি নিয়ে ব্যারিষ্টার রফিক উল হক এর সামনে হাজির হলাম অত্যন্ত দূরু দূরু বুকে
। একবার চোখ বুলিয়ে বললেন আনসারী, গুড জব, অপূর্ব। আমি
কালই জাষ্টিস খায়রুল হক-এর সামনে এটি উপস্থাপন করবো। এভাবে হান্নান চাচার সঙ্গে
আমার সম্পর্ক বাড়তে থাকে। একদিন কথায় কথায় তিনি বলে উঠলেন, আমি
বোধহয় বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাক্তি যিনি বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সাথে খুব
ঘনিষ্ঠভাবে বাংলাদেশের পাবলিক পলিসি নিয়ে কাজ করেছি। আমি বললাম, সরকার তো জামায়াত নেতাদের গ্রেফতার করছে । আপনাকে সরকার জামাতের উপদেষ্টা
মনে করে।
আপনাকেও
তো গ্রেফতার করবে মনে হয়। তিনি বললেন, শেখ হাসিনা আমাকে গ্রেফতার করবে বলে মনে হয়
না। কারণ তিনি আমার পেশাদারিত্ব সততা
সম্পর্কে ব্যাক্তিগতভাবে জানেন। পরপারে ভাল থাকবেন চাচ্চু। আল্লাহ আপনার দাওয়াতি
কার্যক্রম কবুল করুন এবং জান্নাতে সর্বোচ্চ মাকাম দান করুণ । আমিন।
লেখক # যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী
এবং প্রাক্তণ সাংবাদিক, দিগন্ত টেলিভিশন
শাহ আবদুল হান্নান
ছিলেন বাংলাদেশে অর্থনীতির মুক্তিসূর্য
লেখক: সাঈদ চৌধুরী
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বাংলাদেশ সরকারের
সাবেক সচিব ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ শাহ আবদুল হান্নান ছিলেন বাংলাদেশে অর্থনীতির
মুক্তিসূর্য। যুগন্ধর প্রতিভার এই মানুষ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের অন্যতম
উদ্যোক্তা ও সাবেক চেয়ারম্যান, দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান,
দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম
উদ্যোক্তা-প্রতিষ্ঠাতা এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের
ডেপুটি গভর্নর ছিলেন।
১৯৮৯ সালে প্রথম তাঁর মুখোমুখি হই। দিনটা
যতদূর মনে পড়ে ১ আগস্ট। আমার অন্তরে এই মানুষটি সেদিনই জায়গা করে নিয়েছিলেন।
প্রথম দিনের কথাগুলো আজও মনে রয়ে গিয়েছে৷ আল ফালাহ ভবনের তৃতীয় তলায় কয়েকজন
ইসলামী স্কলারদের সাথে অর্থনীতি বিষয়ে এক বিশেষ আলোচনা ছিল। ইসলামী ব্যাংকের সাবেক
নির্বাহী চেয়ারম্যান মরহুম মুহাম্মদ ইউনুছ আমাকে সেখানে নিয়েছিলেন।
সেদিনের প্রায় প্রতিটি কথা বার বার মনে পড়ে।
এরপর যতবার দেখা হয়েছে,
কী আপন হৃদয়তা দিয়ে তিনি কাছে টানতেন। খুব সহজে সবাইকে আপন করে
নিতেন তিনি। সেই মমতাভরা চেহারা আজ বাঙ্ময় হয়ে ওঠেছে হৃদয় কোনে।
আশির দশকে পারিবারিক ব্যবসায় যখন সাউদী আরব
ছিলাম তখন মুহাম্মদ ইউনুছের সাথে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ট হয়। ৮৫ সালের এক ঐতিহাসিক ক্ষণে
আবহা থেকে পবিত্র মক্কা হয়ে মদীনায় এসে পৌছি। আমাদের জন্য অপেক্ষমান ছিলেন ভাইজান
মাওলানা রশীদ আহমদ চৌধুরী। তিনি মদীনায় ব্যবসা পরিচালনা করেন। তখন আমাদের
পারিবারিক মূল ব্যবসা খামিস মতির মাহাইল আল আবহা।
বড় ভাইজান ডা. শাব্বির আহমদ চৌধুরী ১৯৭২ সাল
থেকে সাউদী আরবে বসবাস করেন। প্রায় এক যুগ ছিলেন মক্কা মুকাররমায়। তারপর চলে যান
মদীনা মুনাওয়ারায়। খামিস মতির বানিজ্য সম্প্রসারিত হয়েছে, খুব বেশি দিন হয়নি। সেখানে
তিনি আমাদের কন্সট্রাকশন ব্যবসা তদারকি করেন। মেঝো ভাইজান হাফেজ মাসউদ আহমদ চৌধুরী
ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ও গাওয়া দেখাশোনা করেন। সেঝো ভাইজান মাওলানা ফায়্যাজ আহমদ
চৌধুরী ওয়েল্ডিং এবং আমি ওয়ার্কশপ এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট পরিচালনা
করি।
বাদশাহ ফাহাদ আসবেন মদীনা মুনাওয়ারায়। তিনি
আসছেন খাদেমুল হারামাইন শরিফাইন উপাধি ধারণ করে অর্থাৎ কাস্টোডিয়ান অফ টু হলি মস্কস
বা দুই পবিত্র মসজিদের অভিভাবক হিসেবে। হিজ ম্যাজেস্টি উপাধি বাদ দিয়ে নতুন উপাধি
গ্রহণের পর এটি তাঁর প্রথম মদীনায় আগমন। বাদশাহ ফাহাদকে কাছ থেকে দেখা এবং তাঁর
প্রতিষ্ঠিত কুরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স পরিদর্শন এবং মক্কা-মদীনা জিয়ারত ও সরেজমিন
ফিচার তৈরী করাই ছিল আমার মুখ্য উদ্দেশ্য।
বিশ্বব্যাপী পবিত্র কুরআনের বিশুদ্ধ চর্চা ও
অনুশীলন ছড়িয়ে দেয়ার ব্রত নিয়ে সে বছর (১৯৮৫ সালে) ২ লাখ ৫০ হাজার বর্গ মিটার
এলাকা জুড়ে মদীনায় এ কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেছেন বাদশাহ ফাহাদ। যেখান থেকে
অনুবাদ ও অনুবাদ ছাড়া দু’ধরনের কুরআন মুদ্রণ ও বিতরণ করা হয়। অন্ধজনও যাতে কুরআন তেলাওয়াত করতে
পারেন সেজন্য রয়েছে ব্রেইল পদ্ধতির সংস্করণ। এ প্রকল্পে বিশুদ্ধ তেলাওয়াতের অডিও
ও ভিডিও ফর্মে কুরআনের সিডি, ডিভিডি তৈরি ও সরবরাহ করা হয়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ২৭ কোটি কুরআন ছেপে বিশ্বব্যাপী বিনামূল্যে বিতরণ
করা হয়েছে।
বাংলাদেশে সাউদি আরবের সাবেক রাষ্ট্রদূত
ফুয়াদ আব্দুল হামিদ আল খতীব কর্তৃক আমন্ত্রণের সুযোগ পেয়ে নিজেকে খুব প্রসন্ন মনে
হল। এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে যারা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে মুহাম্মদ ইউনুছও
ছিলেন। খতীবের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে মন। ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা হাসপাতাল সহ
বাংলাদেশে তার অনেক সৃষ্টিশীল কর্মকান্ড ইতিহাস হয়ে আছে। তারপরও একজন রাষ্ট্রদূত
হিসেবে তাকে যেভাবে জেনেছি,
সেদিন মনে হল তিনি তার চেয়ে অনে বড় মাপের মানুষ।
ইসলামী ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান
মুহাম্মদ ইউনুছ ছিলেন শাহ আবদুল হান্নানের খুবই আপনজন। ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সফল
সংগঠক ছিলেন। তিনি যখন সেক্রেটারি জেনারেল তখন থেকেই পরস্পরে ঘনিষ্ট। ইসলামী
ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সময় তাঁরা আরো কাছে এসেছিলেন। দু’জনেই ইন্টেলেকচুয়াল পর্যায়ে
কাজ করেছেন ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্যে। তখন ইসলামিক ইকোনোমিকস রিসার্চ ব্যুরোর
মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং ভাবনার ভিত্তি রচনা হয়। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং খাতের
অন্যতম পথিকৃত এম আজিজুল হক ছিলেন একাজের অন্যতম নিয়ামক।
ইন্টেলেকচুয়াল ওয়ার্ক, ট্রেনিং ওয়ার্ক ও উদ্যোক্তা
সংগ্রহ তিনটিই কাজ চলছিল এক সাথে। তবে উদ্যোক্তা প্রস্তুত না হলে ব্যাংক
প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল না। সে কাজে মুহাম্মদ ইউনুছ ছিলেন সেরা। ইসলামী ব্যাংকের
জন্য বিদেশী উদ্যোক্তা গ্রহণের ক্ষেত্রে ফুয়াদ আবদুল হামীদ আল খতীবের সাথে কাজ
করতেন। সাউদী আরবে বিভিন্ন স্থানে তিনি আমাকে নিয়েও ঘুরেছেন। সেই স্মৃতিসরণি
অন্যত্র আলোচনা করেছি।
মূলত মুহাম্মদ ইউনুছ প্রায়ই শাহ আবদুল
হান্নান সম্পর্কে কথা বলতেন। আর তাঁর মাধ্যমেই এই ক্ষণজন্মা পুরুষের সাথে আমার
পরিচয় ঘটে। শাহ আবদুল হান্নানকে যারা কাছে থেকে দেখেছেন, কেবল তারাই বলতে পারবেন তিনি
কেমন মানুষ ছিলেন। স্বভাবের মৌলিক কাঠামো ও রকম অন্য আর দশজনের মত নয়। একেবারে
নির্মোহ, নির্লোভ ও নিরহংকারী বলতে যা বুঝায়। শিক্ষাবিদ ও
ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে তিনি মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকতা লাভ করেছিনে। লেখক হিসেবে
দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে গেছেন। যেখানে ঋদ্ধ হতে হয় ভিন্ন এক পাঠ-অভিজ্ঞতায়।
ইস্কাটন গার্ডেন রোডের তাঁর সরকারি কোয়াটারে
এবং গোড়ানের বাসায় বহুবার গিয়েছি। অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন-যাপন করতেন। পরিচয়ের পর
থেকে প্রায়ই শাহ আবদুল হান্নানকে ঘিরে এক ধরনের আলোর বিকিরণ অনুভব করতাম। ২০০০
সালে লন্ডন আসার পরও যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা করেছি। ২০০১ সালে সাপ্তাহিক ইউরো বাংলা
প্রতিষ্ঠার খবর পেয়ে তিনি খুব খুশী হয়েছেন এবং নিয়মিত তাঁর লেখা আমরা প্রকাশ
করেছি।
শাহ আবদুল হান্নান অর্থনীতি ও সমাজ সংস্কার
বিষয়ে আশ্চর্যময় দিক নির্দেশক। প্রতিটি বিষয়ে বাস্তব ও বিজ্ঞান সম্মত যৌক্তিকতা
দিয়ে লিখেছেন একের পর এক প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। তাঁর সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের ধারালো
রচনাশৈলী পাঠকের হৃদয় ছুয়েছে। এতে প্রচারের আতিশয্য নেই, বরং আছে নিখাদ অনুভবের
আলপনা। বহুবার তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। গভীর বিশ্লেষণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। শুধু
রাজনৈতিক ইতিহাস নয়, দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থাও
বর্ণনা করেছেন। মননশীল আলোচক হিসেবে তাঁর কথা বলার ধরণ খুবই আকর্ষণীয়। আলোচনার
মাঝে জীবন থেকে নেয়া রসালো গল্প বলার ক্ষমতা আজও মনে পড়ে।
শাহ আবদুল হান্নান ছিলেন সৃজনশীল মানুষ।
প্রভাব বিস্তারকারী লেখক। তাঁর গ্রন্থ সমূহ এবং আত্মজীবনী 'আমার কাল, আমার চিন্তা' পড়লে তাকে কিছুটা উপলব্ধি করা যাবে।
অন্তরের তাগিদে লেখা। যে ইন্সপাইরেশন বহু মানুষের জীবনে প্রভাবক হয়ে উঠেছিল।
লেখাগুলি টেনে নেয় শিকড়ের কাছাকাছি৷ তরুণ প্রজন্ম আত্মপ্রত্যয়ী হয় এই লেখা থেকে।
বর্তমানের সাথে অতীতকে মিলিয়ে দেখার সুযোগ করে দেয় এ লেখাগুলি৷ বহুদিন পরেও তাঁর
বইয়ের পাতা ওল্টালে লেখাগুলিকে হয়তো অন্য রঙে আবিষ্কার করবেন পাঠক৷
২০১৪ সালে বিশ্বসেরা ১০০০ ব্যাংকের তালিকায়
মনোনীত হয় বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংক ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’। বৃটেনের শতাব্দী প্রাচীন আর্থিক ম্যাগাজিন ‘দি ব্যাংকার’ বিশ্বের এক হাজার শীর্ষ ব্যাংকের তালিকায় প্রথম বারের মতো বাংলাদেশের
একমাত্র ব্যাংক হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের নাম অন্তর্ভুক্ত করে। এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠায়
জড়িতের মধ্যে তখন শাহ আবদুল হান্নানের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। ইসলামী ব্যাংক
প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে তিনি বলেছিলেন, ১৯৭৪ সালে সেনেগালের রাজধানী
ডাকারে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি) চার্টারে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ সহ
২৮টি মুসলিম দেশ। পর্যায়ক্রমে নিজেদের দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইসলামী মডেলে ঢেলে
সাজাবার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয় সে চার্টারে। আর তখন থেকেই ইসলামী ব্যাংক
প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন জাগে তাঁদের মনে।
সরকারি ও বেসরকারি যেকোন ভাবে ইসলামী ব্যাংক
প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পরিকল্পনা তখন থেকেই শুরু হয়। ১৯৭৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে
নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো: মহসীন আইডিবির চার্টার বাস্তবায়নে দুবাই ইসলামী
ব্যাংকের আদলে বাংলাদেশে একটি ব্যাংক করা যায় কিনা সে বিষয়ে একটি প্রস্তাব
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠান। ওই প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ
ব্যাংকে যায়। এটাই ছিল ভেতরে ভেতরে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রাতিষ্ঠানিক
প্রয়াস। তখন তাদের সহায়তা ও প্রেরণায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এএসএম
ফখরুল আহসান বিভিন্ন দেশের ইসলামী ব্যাংক সমূহ পরিদর্শন করে বাংলাদেশে ইসলামী
ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা যাচাই করে একটি রিপোর্ট পেশ করেন। এতে বাংলাদেশে
ইসলামী ধারায় ব্যাংক করা যেতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয়।
তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে সোনালী, রূপালী, জনতা, অগ্রণী সহ রাষ্ট্রায়ত্ত সব ব্যাংকের
ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের একটি বৈঠক হয়। সেখানে এসব ব্যাংকে ইসলামী শাখা খোলার
সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর নুরুল ইসলাম
বেসরকারি খাতে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আহবান জানান। এরপর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে
আইডিবি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করেন।
ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হিসেবে
তাঁরা তখন ব্যাপক কর্ম তৎপরতা পরিচালনা করেন। আইডিবির নেতৃত্বে বাংলাদেশে ইসলামী
ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য এগিয়ে আসে কুয়েত ফাইন্যান্স হাউজ, জর্ডান ইসলামী ব্যাংক,
কাতারের ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট এন্ড এক্সচেঞ্জ কর্পোরেশন, বাহরাইন ইসলামী ব্যাংক, লুক্সেমবার্গের ইসলামিক
ব্যাংকিং সিস্টেম ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং এসএ, সৌদি আরবের
আল-রাজী কোম্পানি ফর কারেন্সি এক্সচেঞ্জ এন্ড কমার্স, দুবাই
ইসলামী ব্যাংক সহ বহু বিদেশী ব্যাংক ও ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউট।
পর্যায়ক্রমে যুক্ত হয় কুয়েতের পাবলিক
ইনস্টিটিউশন ফর সোস্যাল সিকিউরিটি, মিনিস্ট্রি অব আওকাফ এন্ড ইসলামিক
এ্যাফেয়ার্স এন্ড মিনিস্ট্রি অব জাস্টিস, ডিপার্টমেন্ট অব
মাইনরস এ্যাফেয়ার্স সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। এতে আরো যুক্ত হন সৌদী আরবের সাবেক
বাণিজ্য মন্ত্রী আহমদ সালাহ জামজুম এবং ওআইসির তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল
ফুয়াদ আব্দুল হামিদ আল খতীব। আল্লাহর রহমতে সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায়
১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইসলামী ব্যাংকের কর্ণধারদের কথা স্মরণ করে
শাহ আবদুল হান্নান বলেন,
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্ণর এবং পূবালী ব্যাংকের সাবেক
ম্যানেজিং ডিরেক্টর এম খালেদ ছিলেন প্রথম উপদেষ্টা। শিল্প ব্যাংক এবং রূপালী
ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজিং ডিরেক্টর এম এ করিম ছিলেন প্রথম এক্সিকিউটিভ
প্রেসিডেন্ট। সোনালী ব্যাংক থেকে এসে যোগ দেন আযীযুল হক ও এএফএম গোলাম মোস্তফা।
অগ্রণী ব্যাংক থেকে ইউসুফ চৌধুরী। তাদের নিয়ে প্রথম ব্যবস্থাপনা টীম কাজ শুরু করে।
এছাড়া শীর্ষ নির্বাহীদের মধ্যে কাজ করেছেন সোনালী ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক
ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর লুৎফর রহমান সরকার, অগ্রণী ব্যাংক থেকে এসে যোগদানকারী কামাল উদ্দীন চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আবদুর রকিব প্রমুখ।
শাহ আবদুল হান্নান বাংলাদেশে ইসলামী
অর্থনীতিকে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। কল্যাণমুখী কার্যক্রমের লক্ষ্য
নিয়ে ১৯৮৩ সালে যাত্রা শুরু করে ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংক সফল হওয়ায় অনেক ব্যাংকই
এখন ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংকিংয়ে এসেছে। দুটি ব্যাংক প্রচলিত ধারা থেকে ইসলামী
পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সারা দুনিয়াতে এ ধারার ব্যাংকিং চালু হচ্ছে। বিভিন্ন
বহুজাতিক ব্যাংকও এখন ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করেছে।
অভিনব জীবনবোধের অধিকারী শাহ আবদুল হান্নান
তাঁর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দিয়ে মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় অমর হয়ে থাকবেন।
জীবনকে অনুভবের জন্য তাঁর এক অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা ছিল। সমাজ গঠনে আত্মপ্রত্যয়ী এই
মানুষটি ছিলেন সফল সাধক। তাঁর চিরায়ত সৃজন-কর্মগুলিকে সমাজ সংস্কারক সহ মানবতাবাদী
মানুষ বহুকাল মনে রাখবেন। আমাদের ইতিহাসে ও সংস্কৃতি-ঐতিহ্যে এই বাস্তবতা
প্রখরভাবে উজ্জ্বল।
আজ (২ জুন ২০২১) বুধবার সকাল ১০টা ৩৭ মিনিটে
রাজধানী ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া
ইন্না- ইলাইহি রা-জিউ‘ন। মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা
জ্ঞাপন করছি। আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।
লেখক # প্রতিতযশা সাংবাদিক
শাহ আব্দুল হান্নান
(রহ) বিদায় নিলেন
শাহ আব্দুল হান্নান চাচা আজ ০২/০৬/২০২১
বুধবার ইন্তেকাল করেছেন। তিনি ১৯৩৯ সালে মোমেনশাহীতে জন্ম গ্রহন করেন। এবং ১৯৫৯
সালে ঢাকা বিশেবিদ্যালয় থেকে ইকোনোমিক্স ও পলিটিক্যাল সাইয়েন্সে বি এ ও ১৯৬১ সালে
পলিটিক্যাল সিয়েন্সে এম এ করেন। এরপর তিনি যোগদেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে।
আমাদের প্রজন্মে তিনি মুরুব্বি, এবং আমাদের আগের প্রজন্মে
তিনি ছিলেন স্যার। পাকিস্তান আমলে তিনি সরকারের আমলা হিসেবে যোগদেন। বাংলাদেশ
হওয়ার পর শেখ মুজিব সরকার থেকে শুরু করে সব সরকারের আমলে তিনি আমলা হিসেবে কাজ
করেছেন। দেশ চলে যে সব সেক্টরে, তার প্রায় প্রতিটিতেই তিনি
কাজ করেছেন। জাতীয় রাজস্ব বিভাগে তিনি শুধু দ্বায়িত্ব পালন করেছেন তাই না, তিনি দেশকে উন্নত করার অনেক অনেক সংস্কার সাধনের পাশাপাশি আধুনিকায়নে অগ্র
নায়ক হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের ডিপুটি গভর্নর হিসেবে কাজ করে দেশের
অর্থ কাঠামোকে শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে সাহায্য করেছেন। ব্যুরো অফ এন্টি
করাপশনে ডাইরেক্টর জেনারেল হিসেবে কাজ করার সময় একজন প্রগাঢ় ঈমানদারের কাছ থেকে যা
যা আশা করা যায়, তার সবটাই আদায় করেছেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ও অর্থ
মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে কাজ করতে যেয়ে তিনি দেশপ্রেমী কর্মকর্তা হিসেবে নিজকে
প্রশংসিত করেছেন।
তিনি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ও দারুল
ইহসান ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। তিনি ইন্টারন্যাশনাল ইসলামি
ইউনিভারসিটি চিটাগাং ও মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সিন্ডিকেট সদস্য
ছিলেন।
ইসলামিক ইকোনমিক্স রিসার্চ ব্যুরো, বাংলাদেশ ইনিস্টিটিউট অফ
ইসলামিক থট, ইসলামিক ইন্স্যুরেন্স, ইসলামি
ব্যাঙ্ক সমূহের নানা ধরণের সেক্টরে তিনি একাধারে অর্থনীতিবিদ হিসেবে, অন্যদিকে ইসলামিক স্কলার হিসেবে যুগপত দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইবনে সিনা ট্রাস্ট, মানারাত স্কুল এন্ড কলেজ,
দিগন্ত টিভি ওপত্রিকা সহ নানা সামাজিক সংস্কৃতিক প্রকল্পে তিনি মেধা
ও শ্রম দান করেছেন। এইভাবে গণনা করলে দেখা যাবে তিনি সারা দেশের সব কাজেই ছিলেন
যেন। আমরা একবার এক মিটিং এ বলেছিলাম, "চাচা কোথায় নেই
তাই বলো"।
তার লেখা ১১টা বই আমার দেখা হয়েছে। যার
প্রতিটিতে মেধা,
সৃষ্টিশীলতা ও দার্শনিকতার পরিচয় ফুটিয়ে তুলেছেন এমন ভাবে, যার স্বীকৃতি আদায় করতে ঘুষ দেয়াও লাগবেনা, তেল
মালিশ করাও লাগবেনা।
তিনি মুরব্বি ছিলেন। ইসলামি পরিভাষায়
মুরুব্বি বুঝাতে আধুনিক “মেন্টর” শব্দটাই দাঁড় করানো যায়। আমার একজন আত্মীয়া
বলেছেন, তিনি বাংলাদেশ ব্যাঙ্কে অনেকের আন্ডারে কাজ করেছেন,
কিন্তু শাহ আব্দুল হান্নান ছিলেন ব্যতিক্রম। আমাদের ভুল হলে বা কোন
কাজের কমতি হলে তিনি সংশোধন করতেন ভালোবাসা দিয়ে ও একটু বই পড়িয়ে। তিনি প্রশাসনের
প্রতিটা অফিসে প্রতিভাবানদেরকে মেন্টরিং করতেন। তিনি বাংলাদেশের সেরা
প্রতিষ্ঠানগুলোর মেধাবি ছাত্র ছাত্রিদের সাথে তৈরি করতেন আলাদা সম্পর্ক। ঐটার নাম
ছিলো “চাচা ভাতিজার” সম্পর্ক। সবাই
আমরা তাকে চাচা বলতাম। আমার মনে আছে প্রথম যেদিন আমি তাকে দেখেছিলাম, স্যার বলে সম্বোধন করায় তিনি সংশোধন করে দিয়েছিলেন। এই সম্পর্ক তিনি ফাও
ফাও করতেন না। তিনি এ ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার গাইডেন্স দিতেন। বই পড়াতেন। চোখ খুলতেন।
বাংলাদেশ ও মুসলিম বিশ্বে যেসব মানুষের দরকার তা তৈরিতে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি
আমাদের বিয়ের ব্যাপারেও নাক গলাতেন। কার সাথে কার বিয়ে হলে ভালো হয় তার ঘটকালীও
করতেন। এমনকি বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর সমস্যা হলে তিনি হতেন কাউন্সিলর ও
মিমাংসাকারী।
তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির খুব কমিটেড
ছিলেন। যা সকল সরকারের কাছে জানা থাকলেও তার সততা, নিষ্ঠা, যোগ্যতা, নিয়মানুবর্তিতা, ঈমানদারিতা
ও সর্বোপরি দেশপ্রেমের কাছে সকল সরকারই তা ধর্তব্যে আনেন নি।
দুনিয়াবি জ্ঞানের পাশাপাশি তিনি ছিলেন ইসলামি
জ্ঞানে খুবই সমৃদ্ধ। আধুনিক বিশ্বের সকল স্কলারদের সাথে তার সংযোগ ছিলো, ছিলো মুসলিম বিশ্বের নামকরা
দার্শনিকদের সাথে গভীর সম্পর্ক। এমনকি এই সম্পর্ক তিনি রাজনৈতিক নেতাদের সাথেও
প্রলম্বিত করেছেন। এইজন্য তার প্রভাব বলয় ছিলো বহুমাত্রিক। আমি আজো বাংলাদেশে এমন
ব্যক্তিত্ব শুধু বিরল মনে করিনা, অতুলনীয়ও মনে করি।
একবার কোন এক কাজে উনার অফিসে যাই। আমার শালা
নুরুল্লাহ তখন মালয়েশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে
ক্যানাডায় যাচ্ছে। উনার সাথে দেখা করতে চাই এটা জানানোর সাথে সাথে তিনি আমাদের
ডাকলেন। তার অন্য মিটিং এ যাবার মাঝে মাত্র ৫ মিনিট সময় তার আছে ঐটাই দিলেন
আমাদের। আমাদের কথা শুনেলন,
তবে নুরুল্লাহর ক্যানাডা যাওয়াটা পছন্দ করলেন না। বললেন, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট তোমরা না নিলে ঐখানে আর কারা পড়বে? সময়ের পরে তিনি যাওয়ার সময় এমনভাবে মাফ চাইলেন, যেন
আমাদের ঐভাবে এপোয়েন্ট নিয়ে না আসাটাও আমাদের অধিকার, আর উনি
আমাদের বেশি সময় না দিতে পারাটা তার অপরাধ। এত বড় মানুষের এমন বিনয় আমি জীবনে খুব
কম দেখেছি।
ইসলামি দৃষ্টি দর্শনে তিনি অর্থডক্স চিন্তার
বাইরেও যেতেন। যদিও আক্বীদাহ বিশ্বাসে তিনি খুবই শক্ত ভাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল
জামাআতের ছিলেন,
কিন্তু ফিক্বহতে ছিলেন কোন নির্দিষ্ট মাযহাবের গন্ডীর বাইরে। তার
পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়ে আমি এক সময় ঢাকায় একটা ইন্টেলেকচুলা ডিসকোর্স ফোরামে “ফিকহুসসুন্নাহ” বই পড়ানো শুরু করেছিলাম। তিনি ডঃ
ইউসুফ কারাদ্বাওয়ী দ্বারা খুবই প্রভাবিত ছিলেন। ফলে বাংলাদেশের সরকারি পরিমন্ডলে
অনেক আইন রচনার ক্ষেত্রে তার মতামত আমাদের উস্তাযগণকে রাগন্বিত করে। আমি মদিনা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর মগবাজারে দারুল আরবিয়াতে আরবি ম্যাগাযিন “আলহুদা” সম্পদনায় জড়িত ছিলাম। ঐ সময় দুই তিনটা বিষয়
নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্ক আসে। মেয়েদের মীরাস, তিন তালাক এক
সাথে দেয়ার মাসআলাহ, মেয়েদের মুখ ঢাকা ফরদ্বিয়্যাত ইত্যাদি।
দেখেছি তার আলোচনা থাকতো মাযহাবের মধ্যে সীমায়িত করা নয়, বৃহত্তর
ইসলামি চিন্তা দর্শনের আলোকে এগুলোর সমাধানের প্রস্তাবনা। অনেকে এই ক্ষেত্রে
পদস্খলনের শিকার হন, কিন্তু তার বিনয় ও অন্যমত সহিষ্ণুতা
তাকে সে সব বিপদ থেকে রক্ষা করেছে।
কেও মারা গেলে যদি মাত্র একজন মেয়ে থাকে তা
হলে স্ত্রীর অংশের পর মেয়ে অর্ধেক পাবে। বাকি অংশ চলে যাবে মৃতব্যক্তির মা বাবা
ভাইবোনের দিকে। তিনি এই মতের বাইরে একটা প্রস্তাবনা দাঁড় করান। যে মেয়েই সব
সম্পদের মালিক হতে পারে। এই ব্যপারে তার অনেক ঋদ্ধ একটা আর্টিকেল প্রকাশ পায়। আমি
এর বিপরীতে খুব জোরালো কিছু কথা তাকে বললে, দেখলাম তিনি আমার কথায় কনভিন্সড হলেন না।
কিন্তু আমার আলোচনাও দৃষ্টিভংগীর প্রশংসা করলেন এবং তার ভুল হতে পারে সেটার ও
জানান দিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথেই। এরপরেই তার প্রতি আমার ভালোবাসা বেড়ে যায়
শতগুণ। মতের বাইরের লোকদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তা শাহ আব্দুল হান্নান চাচার
সান্নিধ্যে না এলে জানা যেতো না।
তিনি কাজ পছন্দ করতেন। একরত্তি সময় তিনি নষ্ট
করেননি। মুজিবুর রহামান মঞ্জু ভাই হস্পিটালে তিনি কেমন কাটাচ্ছলেন তার খবর
দিয়েছিলেন কয়দিন আগে। সেখানে তিনি বলেছেন, শাহ আব্দুল হান্নান চাচা শরীর থেকে
অক্সিজেন, ইঞ্জেকশনের নিডল ও হার্ট বিটের চেকার খুলে ফেলতে
চাচ্ছিলেন। ঐখানে তার সবচেয়ে বড় কষ্ট ছিলো তিনি কাজ করতে পারতেছেন না। অথচ তিনি
মৃত্যু সজ্জায়। আজ তার মৃত্যুতে আমার মনে হচ্ছে শাহ আব্দুল হান্নান চাচা আমাদের আর
জিরানোর সময় দিয়ে যাননি।
একজন মানুষের মর্যাদা নির্ধারণে সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হলো, ওই ব্যক্তির বন্ধুও ভক্তদের মূল্যায়নের পাশাপাশি আদর্শগত শত্রুদের মূল্যায়ন দেখা। আমার সুযোগ হয়েছে উভয় পাশের লোকদের কাছ থেকে শাহ আব্দুল হান্নান চাচার বিভিন্ন ব্যাপারে শোনা ও বোঝার। তাদের সকল আলোচনার মর্মার্থ হলো তিনি আসলেই একজন ভালো মানুষ, ভালো মুসলিম ও দেশ প্রেমিক তো ছিলেন ই, তিনি ছিলেন আসলে একজন সব্যসাচী ও যোগ্য মানুষ। আলহামদুলিল্লাহ, আমি গর্বিত, বাংলাদেশে আজ তার মৃত্যুতে সবাই কাতর হয়েছে। তিনি আসলেই মুত্তাক্বীনদের ইমাম ছিলেন। আল্লাহ তাকে মাফ করুন ও জান্নাতুল ফিরদাওস দান করুন, আমীন।
লেখক # বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন, প্রাক্তণ শিক্ষক: চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী
বিশ্ববিদ্যালয়
সবশেষে আমরা শাহ আব্দুল হান্নান-এর একটি দিক নির্দেশনামূলক লেখা দিয়ে শেষ করছি:
আমার জীবনের উপলব্ধি
শাহ্ আব্দুল হান্নান
আমি ৮০ বছর বয়স পার করেছি। এই দীর্ঘ জীবনে
নিজের অনেক অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি হয়েছে। সেসব উপলব্ধি থেকে কিছু এটা পাঠকদেরকে
অবিহিত করছি,
যাতে তারা চিন্তার খোরাক পেতে পারেন। সব সময় আমি সংযত চিন্তা করেছি।
গভীরভাবে ভেবেছি। কারণ সেই হিসেবে আমার উপলব্ধি হয়েছে যা পাঠকদের জন্য উপকারী হতে
পারে। একে একে আমার পনেরোটি উপলব্ধি নিম্নে উপস্থাপন করছি।
১. কাউকে যোগ্য লোক হতে হলে তার উচিত
গুরুত্বপূর্ণ অনেক বই পড়া। এসব বই হতে পারে ইসলামের ওপর এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয়
বিষয়ের ওপর। গণ্যমান্য লেখকের বই বাছাই করা উচিত। কারণ সব লেখকের উপলব্ধি সমান হয়
না। যারা সিনিয়র লেখক,
তারা অনেক চিন্তা করে লিখে থাকেন।
২. ইসলামের জন্য কাজ করতে হলে পবিত্র কুরআনের
অর্থ প্রতি বছর অন্তত একবার পড়া উচিত। কুরআনের সাথে গভীর সংযোগ ছাড়া ইসলামের মহৎ
কর্মী হওয়া সম্ভব নয়। কুরআন শরিফ অসাধারণ গ্রন্থ। এতে রয়েছে আল্লাহ তায়ালা
সম্পর্কে বা তাওহিদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা; নৈতিকতা সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা; শিরকের বিরুদ্ধে যুক্তি এবং অনৈতিকতার বিরুদ্ধে বড় শাস্তির ঘোষণা।
৩. ইসলামের জন্য যোগ্য লোক তৈরি করা জরুরি। এ
জন্য সিনিয়র লোকদের উচিত ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ক্লাস করা। একেকটি ক্লাসে ১৫-২০ জন
থাকতে পারে। এই কোর্স এক বা দুই বছরের জন্য হতে পারে। নিজে এ রকম ১০টি কোর্স
করেছি। এসব কোর্স কুরআনভিত্তিক ও উন্নত ইসলামী সাহিত্যভিত্তিক হতে হবে।
৪. নারীদের সব সময় খুব গুরুত্ব দিতে হবে।
তাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছাড়া ইসলামের বা দেশের সত্যিকার কল্যাণ হতে পারে না। তাদের
মর্যাদা ও অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে।
৫. বর্তমানে যেসব ইসলামী সংগঠন রয়েছে
সেগুলোকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। সংগঠন ছাড়া বড় কাজ করা যায় না। প্রত্যেকেরই উচিত
তার পছন্দের ইসলামী সংগঠনে যোগদান করা।
৬. অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী বইগুলো বেশি
করে ছড়িয়ে দেয়া দরকার। ইসলামী দাওয়াতের অগ্রগতি নির্ভর করে মানুষকে ইসলামী বই
দেয়ার ওপর। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী বই। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী বই ভালো
করে ছড়ানো হয়নি। এসব গুরুত্বপূর্ণ বই ছড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. সমাজসেবার মাধ্যমে প্রত্যেকের উচিত নিজের
গ্রাম বা এলাকার দারিদ্র্য দূর করা। সব কিছুই সরকার করতে পারে না। সে জন্য ব্যক্তি
উদ্যোগের প্রয়োজন অনেক।
৮. মধ্যপন্থাই উত্তম। আল্লাহতায়ালা কুরআনের
মধ্যপন্থার কথা বলেছেন। মুসলিম জাতিকে তিনি ‘মধ্যপন্থী’ উম্মত
বলেছেন।
৯. হঠকারিতা ও বাড়াবাড়ি ভালো নয়। কুরআনের
বিভিন্ন জায়গাতে বাড়াবাড়ির নিন্দা করা হয়েছে। সূরা নাহলের ৯০ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা
বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন।
১০. শ্রমিকরা আমাদের দেশে বেশির ভাগ
ক্ষেত্রেই বঞ্চিত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা উপযুক্ত মজুরি পান না। বাধ্য হয়ে তাদেরকে
অনেক আন্দোলন করতে হয়। অথচ শ্রমিকদের সমস্যা বোঝা আমাদের সবারই দায়িত্ব।
১১. গৃহকর্মীদের/গৃহে যারা কাজ করে, তাদেরই খুবই কম মজুরি দেয়া
হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বর্তমানে তাদেরকে দুই থেকে তিন হাজার করে টাকা দেয়া হচ্ছে।
অথচ এই মজুরি যা দেয়া উচিত তার অর্ধেকও নয়।
১২. যারা অফিসে কাজ করেন তাদের উচিত সব
সাক্ষাৎপ্রার্থীকে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া। এর ফল খুব ভালো হয়। এমনকি সুবিচার করতেও
এটা সহায়ক হয়ে থাকে।
১৩. অফিসের কাজ ফেলে রাখা উচিত নয়। কাজ ফেলে
রাখলে পরে তা জটিলতা সৃষ্টি করে।
১৪. বিদেশ সফরে গেলে কিছু ইসলামী বই সাথে
নিয়ে গেলে ভালো হয়। এতে বিদেশে ইসলামের দাওয়াত দিতে অনেক সুবিধা।
১৫. বিদেশ সফরে গেলে সেই দেশের স্থানীয় মসজিদ
ও স্থানীয় ইসলামী সংগঠনের অফিস পরিদর্শন করে আসা উচিত। এতে উম্মাহর মধ্যে
পারস্পরিক সর্ম্পক বৃদ্ধি পায়।
১৬. বিশ্বের বড় শক্তিগুলো আন্তর্জাতিক
ক্ষেত্রে সুবিচারের নীতি অনুসরণ করে না। তারা নিজেদের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী
স্বার্থে কাজ করে। অনেকসময় শোষণ করে।
১৭. সবর (ধৈর্য) মহা ওষুধ। সবর সব সময় সব
অবস্থায় মানুষকে সাহায্য করে।
১৮. যে রাগারাগি করে, তার ভুল করার সম্ভাবনা বেশি।
১৯. সাধ্যমতো দান করা উচিত। দান করলে কেবল
অন্যের নয়,
নিজেরও কল্যাণ হয়।
২০. মানবজাতির সংশোধনের জন্য সাধ্যমতো ভালো
কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ করা উচিত।
আমি নিজের উপলব্ধিগুলো বললাম।
যদি এগুলো আপনাদের ভালো লেগে থাকে, তবে আপনারাও এগুলোকে আপনাদের কাজের ভিত্তি বানাতে পারেন।
📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘
আমার প্রিয় বাংলা বই হোয়াইটসআপ গ্রুপে যুক্ত হতে এখানেক্লিক করুন, টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং ফেইসবুক গ্রুপে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
No comments:
Post a Comment
আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।