আমার
আব্বা মাওলানা আবু তাহের-একজন প্রশান্ত মানুষঃ ফারুক আমীন
(মাওলানা
আবু তাহেরের ছেলে)
আব্বা ইন্তেকাল করার পর আমি ভাবতে চেষ্টা করলাম, কত পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে। একটা স্মৃতি আবছাভাবে মনে পড়ে। আব্বা আমাকে টাকা দিয়ে
বলেছিলেন বাসার সামনের হকারের দোকান থেকে দৈনিক আজাদী কিনে আনতে। পত্রিকা আনার পর তিনি
দাঁড়িয়েই মন দিয়ে পড়ছিলেন। আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে ভাবছিলাম আব্বা এতো
লম্বা কেন?
পত্রিকা পড়ায় তাঁর মনযোগ দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কি হয়েছে? তখন আব্বা বলেছিলেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তারপর আমার হাতে পত্রিকা
দিয়ে বলেছিলেন পড়তে পারি কি না। তখন সম্ভবত আমি ক্লাশ টু’তে পড়ি।
আশির দশকের শেষের দিকের আমার শৈশবের সব ঘটনা আজ
পরিস্কারভাবে মনে নেই। তবে প্রতিটি মানুষের জীবনেই শৈশবের অনেক মধুর স্মৃতি থাকে।
ঐ সময়টাতে মানুষের মন থাকে সরল, দৃষ্টি অবারিত, জীবনও খুব সহজ। সে সময়ের টুকরো টুকরো অসংখ্য ঘটনাই মনে পড়ে। বছরে এক দুইবার
আব্বার সাথে গ্রামের বাড়ি যেতাম। কর্ণফুলী নদী পার হওয়ার সময় সাম্পানে বসে দেখতাম একটু দূরে শুশুক
মাছ লাফিয়ে উঠছে। একটা মাছ লাফালেই আব্বা বলতো দেখো দেখো। আরেকদিকে আরেকটা মাছ
লাফলে তখন ঐদিকে তাকিয়ে বলতেন দেখো দেখো।
নদী পার হওয়ার পর তখন রিকশায় চড়ে দেড়-দুই ঘন্টার
মতো লাগতো আমাদের বাড়ি যেতে। তখন রাস্তা ছিলো এঁটেল মাটির কাঁচা রাস্তা। এইসময় অবধারিতভাবে
আব্বা একটা কাজ করতেন। রাস্তার পাশে নীরব গ্রামের জমিতে বাচ্চারা গরু ছাগল চড়াতো। আব্বা তাদেরকে
দেখিয়ে বলতেন, আমি ছোটবেলায় মাদ্রাসা ছুটির পর
এইরকম গরু চড়াতাম। এই গরীব বাচ্চারা পড়ালেখা করার সুযোগ পায়নি, অন্যদিকে তুমি আল্লাহর রহমতে পড়ালেখা করছো। এই কথাটা সবসময় মনে রাখবে। যখনই আব্বার সাথে
বাড়িতে যেতাম, নদী পার হওয়ার পর দূরে কোথাও
রাস্তার পাশে গরু-ছাগল চড়ানো বাচ্চা দেখলেই মনে মনে প্রস্তুতি নিতাম ঐ কথা শোনার জন্য।
পৃথিবীতে আমার আব্বার কাছে নামাজের পরে সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো পড়ালেখা। এই দুইটা বিষয় নিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে সম্ভবত তিনি
একটা দিনও বাদ দেননাই, যতদিন কাছে ছিলাম। তাঁর এই অবধারিত
প্রশ্নের ভয়ে মোটামুটি পালিয়ে বেড়াতাম, কারণ বুঝতে পারতাম কোন সময়গুলোতে তিনি
আমাকে ধরে বসবেন।
এই স্বভাব সম্ভবত তিনি তার বাবার কাছ থেকে
পেয়েছিলেন। আমার দাদাকে আমি দেখিনি। অর্থ্যাৎ মনে নেই। আমার বয়স যখন দুই বা তিন বছর, তখন আমার দাদা ইন্তেকাল করেন। আম্মার কাছ থেকে আমি দাদার অনেক গল্প শুনেছি। আমি যখনই কোন
দুষ্টামি করতাম আম্মা তখন বলতেন, তোর আব্বা তো তোকে মারে না। যদি তোর দাদা
বেঁচে থাকতেন তাহলে একদম সোজা করে ফেলতেন। দাদার অসুস্থতার সময়ে একমাত্র পুত্রসন্তান হওয়ার পরও
আব্বা ঢাকা থেকে আসতে পারেননি সংগঠনের ব্যস্ততার কারণে। তারপর যখন এসে পৌছেছিলেন ততক্ষণে
দাদা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
আমি আমার বাবা-মায়ের মাঝে এমন একটা প্রজন্ম দেখেছি
যাদের কাছে ইসলামী আন্দোলন ছিলো আক্ষরিক অর্থেই এই জীবনের ধ্যানজ্ঞান। তবে তাই বলে তারা
তাদের পরিবারের প্রতি দায়িত্বও খুব যে অবহেলা করেছেন তা নয়। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার প্রতি
আব্বার মনযোগ আমি খেয়াল করেছি সারা জীবন, খুব ভালোভাবে খেয়াল না করলে
বুঝা যেতো না। এতো ব্যস্ততার পরও সব আত্মীয়রাই তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। আমার দাদীর কাছে
আব্বা ছিলেন কলিজার টুকরার মতো। দাদী যদি বলতেন আজ সুর্য পশ্চিম দিকে উঠেছে তাহলে আব্বা মুচকি হেসে তাতেই মাথা নাড়াতেন। দাদী কোন কিছু
চাইলে আব্বা তা পূরণ করবেনই, যাই হোক না কেন।
আমি মাঝে মাঝে আব্বার বেড়ে উঠার সময়ের কথা কল্পনা
করতে চেষ্টা করি। সাতচল্লিশের দেশভাগের মাত্র দুই বছর পরে তাঁর জন্ম। আমার দাদা ছিলেন
একজন মাদ্রাসা শিক্ষক। এলাকায় না কি তার পরিচিতি ছিলো কট্টর নৈতিকতার জন্য। চট্টগ্রামের যে জায়গায়
আমার বাবার জন্ম, আনোয়ারা থানায় বঙ্গোপসাগরের
সৈকতের এক গ্রামে, এখানে মুসলমানরা বেরেলভী চিন্তায় প্রভাবিত।
সুতরাং আব্বা নিজেও শুরুতে পড়ালেখা করেছেন সুন্নিয়া মাদ্রাসায়। যেহেতু অতিরিক্ত ভালো রেজাল্ট করতেন
এবং সবসময়েই দুই তিন ক্লাশ উপরে পড়তেন তাই একসময় পড়ালেখা করতে চলে আসেন চট্টগ্রাম শহরের
মাদ্রাসায়।
একবার জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের ইমাম মাওলানা
জালালউদ্দিন আল কাদেরী সাহেব হেসে হেসে বলেছিলেন, আমি এক বছর ক্লাশে ফার্ষ্ট
হতাম তো তোমার আব্বা আরেকবছর ফার্ষ্ট হতেন। উনি যদি 'মওদুদীবাদের' পথে না যেতেন তাহলে এই মিম্বরে হয়তো আমার বদলে উনিই থাকতেন!
শিক্ষাজীবনের বাকী পর্বে আব্বা নিজ মেধার জোরে পড়ালেখা করতে
ঢাকায় চলে যান। মাদ্রাসা থেকে কামিল পাস করেন, আবার ঢাবি থেকে মাস্টার্স
করেন। ইসলামী আন্দোলন ও ছাত্ররাজনীতি দুটোই করেছেন। তবে কখনো তিনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা তেমন
বলতেন না। একবার একটা আইডি কার্ড দেখেছিলাম এসএম হলের। তিনি তাঁর দ্বীনি শিক্ষাকেই
বেশি ভালোবাসতেন। ঢাকা আলীয়ার শিক্ষকদের কথা বলতেন। তার অন্য পরিচয় কদাচিত টের
পাওয়া যেতো। যখন হঠাৎ হয়তো দেখা যেতো বিমানের কোন একজন এমডি আব্বার ক্লাশমেট ছিলেন, অথবা কোন এনজিওর কেতাদূরস্ত পরিচালিকা ভদ্রমহিলা। কোথাও দেখা হয়ে গেলে, কথা হয়ে গেলে তারা বলতেন তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পড়ালেখার স্মৃতির কথা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বাঘা বাঘা প্রফেসরদের প্রিয় ছাত্র হিসেবে আব্বার কথা। ডাকসু নির্বাচনের কথা।
ঢাকায় একবার বিমানবন্দরে আমাকে বিদায় দিতে এসে দেখা হওয়াতে আব্বা কথা বলছিলেন অনেক বয়স্কা একজন মহিলার সাথে।
তিনি বলেছিলেন, তাহের আমি কিন্তু তোমাকে ভোট
দিয়েছিলাম। আব্বা হাসছিলেন। কিন্তু মেলাতে পারতাম না চোখের সামনে যেই আব্বাকে শুধু একজন মাওলানা হিসেবে দেখেছি
ছোটবেলা থেকে তার সাথে। আব্বার শার্ট পরা টুপি ছাড়া চেহারা শুধু সেই একটা সাদাকালো
ছবিতেই দেখেছি, অন্যদিকে বোধবুদ্ধি হওয়ার পর
থেকে সারাজীবন নিজ চোখে দেখেছি সেলাই করা সাদা পাঞ্জাবী ও টুপি পরা একজন মানুষ।
আমি একটা ডিজার্টেশন লেখছিলাম সেক্যুলারিজম
সম্পর্কে মাওলানা আবদুর রহীম রা. এর দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে। যখন বিষয়টা চিন্তাপর্যায়ে
ছিলো, আমি মাওলানার লেখা বাংলা বইপত্র যোগাড় করছিলাম তখন একদিন কথায় কথায়
আব্বা বললেন, জন লক এবং থমাস হবসের মতো
পন্ডিতরা সেক্যুলারিজমকে কিভাবে ডিফাইন করেছেন তাও পড়তে হবে ভালো কিছু লিখতে হলে। এইসব অপরিচিত নাম আব্বার মুখে
শুনে আমি বোকার মতো তাকিয়ে ছিলাম। এরপর বলেছিলেন, তুমি শাহ আবদুল হান্নান ভাইয়ের কাছে গিয়ে কি পড়তে হবে তার পরামর্শ নাও। যে যেই বিষয়ের
বিশেষজ্ঞ, তাকে তিনি সে বিষয়ের জন্য
মুল্যায়ন করতেন সম্মান করতেন। তবে আমার আড়ষ্টতা ছিলো এতো ছোট বিষয়ের জন্য বড় মানুষদের কাছে
যাওয়াতে। তখন আমি যাইনাই। পরবর্তীতে অন্য আরেকটা বিষয়ে জানার জন্য গিয়েছিলাম, আব্বার নাম শুনেই তিনি আমাকে পুরো সকাল সময় দিয়েছিলেন। সব ধরণের মানুষরাই তাকে খুব
ভালোবাসতেন।
আমার আব্বার মাঝে এইরকম কিছু অবোধগম্য বৈপরীত্য
ছিলো। চালচলনে দর্শনধারীতে তিনি খুব সাদামাটা একজন আলেম মানুষ। কিন্তু সব ধরণের
মানুষকে তিনি বুঝতেন ও সহজভাবে গ্রহণ করতেন। নিজে ইসলামের বিভিন্ন ধারাকে দেখেছেন
এবং কোন ধারারই বিরোধীতা করতেন না। আবার আমাদের সমাজে যাকে অনৈসলামিক মনে করা হয়, তাও দেখার ও বুঝার চেষ্টা করতেন। তিনি প্রতিদিন রাতে কিছু না কিছু পড়তেন। হয়তো আরবী
ম্যাগাজিন আল-মুজতামা' পড়ছেন, নয়তো উর্দু ম্যাগাজিন পড়ছেন নয়তো ঢাকা ডাইজেস্ট কলম পৃথিবী পালাবদল অঙ্গীকার ডাইজেস্ট
নোঙ্গর আল হুদা। গোলাম আযম বা নিজামী চাচার লেখা প্রত্যেকটা বই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন কয়েকদিন ধরে। ইসলামী সাহিত্য
পড়া শেষ করে ব্যক্তিগত রিপোর্ট লিখতে বসবেন। আবার কোনদিন উঁকি মেরে দেখতাম পড়ছেন হয়তো তসলিমা
নাসরিনের লেখা ক।
আমি হয়তো রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প পড়ছি। দেখে কিছু
বলবেন না। সাইমুম সিরিজ বা ইউসুফ কারাদাভীর লেখা বা আবদুশ শহীদ নাসিম চাচার লেখা কোন বই বা
নিতান্তই পাঠ্যবই। দেখে খুশি হয়ে যেতেন। কিছু বলতেন না কিন্তু চেহারা দেখে বুঝা যেতো। মাসুদ রানা, ধমক খেতে হতো। মাঝে মাঝে বই সাময়িক বাজেয়াপ্ত হয়ে যেতো। অবশ্য বেশিরভাগ শাসন আমার উপরেই হতো, আমার পিঠাপিঠি ছোটবোনকে একই অপরাধে তেমন কোন শাস্তি দেয়া হতো না। সে ছিলো আব্বার নয়নের মণি।
তাই মনে হয় আম্মা আমাকে একটু সাপোর্ট দিতেন। বাজেয়াপ্ত করা বই পরে গিয়ে আম্মার কাছ থেকে ফেরত পাওয়া যেতো।
আমরা ঘরের ভেতরে থাকায় এসব দেখার সুযোগ পেয়েছি।
এছাড়া তার জ্ঞান বুঝতে পেতো যারা ভালো ভালো আলেম আছেন তারা। তিনি যে ঘরানারই হোক না
কেন। দেওবন্দী, নদভী, সালাফি, সুন্নী সবাই আব্বাকে পছন্দ করতেন। আব্বাও
পছন্দ করতেন তাদের সাথে কোরআন সুন্নাহ ফিকহ এসব নিয়ে কথা বলার সুযোগ করতে পারলে।
রাজনৈতিক ব্যস্ততায় এমন সুযোগ হতো কালেভাদ্রে। কিন্তু পড়ালেখার প্রতি তাঁর আত্মিক
টান বুঝা যেতো কালেভাদ্রের এসব উপলক্ষে। তাই সুলতান যওক নদভী হোন কিংবা মুফতি ইজহার, কিংবা বায়তুশ শরফের মরহুম পীর সাহেব অথবা পটিয়া মাদ্রাসার মুহতামিম সাহেব, চট্টগ্রামের সব ঘরানার আলেমরা তাকে খুব বেশি ভালোবাসতেন। নিজের মানুষ মনে করতেন। এটা
আমি বিভিন্ন সময়ে দেখেছি। আব্বাও তাদেরকে মন থেকে শ্রদ্ধা করতেন, ক্বদর করতেন। বুঝা যেতো। যে কোন আলেমকেই অথবা তালেবে এলেমকে তিনি বুকে জড়িয়ে
নিতেন। আব্বা যখন বিভিন্ন এলাকায় যেতেন তখন স্থানীয় মাদ্রাসায় যেতেন আলেমদের সাথে দেখা
করতে। যখন শুনতাম, বুঝতাম না কেন ওখানে গেছেন।
পরে মনে হয়েছে মাদ্রাসাগুলোতে গিয়ে বাচ্চাদের ছুটাছুটি দেখে সম্ভবত তিনি নিজের শৈশবকে
মনে করতেন।
ছোটবেলাতেই বুঝে ফেলেছিলাম আমার আব্বা অন্য সবার মতো না।
উনি অনেক ব্যস্ত, উনি অনেক পরিচিত। সবাই তাকে
সম্মান করে। চট্টগ্রামে মাওলানা আবু তাহেরের সন্তান এই কথাটা কাঁধের উপর কিছু বাড়তি বোঝা
যোগ করে। তাছাড়া সবাই যেমন তাহের ভাইয়ের আদর্শ পুত্র আশা করে, আমার মনে হতো আমাকে কেন তেমন হতে হবে? আব্বা সাধারণত চাননা আমি তাঁর পরিচয়ে কোন
সুবিধা পাই, আমিও আন্তরিকভাবে এর সাথে
একমত। তাই আমি প্রথম সুযোগেই পালানোর জন্য নানা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি লেখা শুরু করেছিলাম। বৃটিশ কাউন্সিল
থেকে ম্যাগাজিন যোগাড় করে পোল্যান্ড জার্মানী কিংবা আমার শিক্ষকদের কাছে থেকে ঠিকানা
যোগাড় করে মিশর সউদি আরব ভারত সবখানেই। মানুষ মরিয়া হয়ে লেগে থাকলে একটা না একটা ব্যবস্থা হয়েই
যায়। সুতরাং দুই হাজার চার সালে যখন বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পেয়েই গেলাম, তখন একদিন আব্বা বললেন, একটা কথা ভুলে যেও না। এই
মাটিতে এই ভাষার মানুষদের মাঝে তোমাকে জন্ম দেয়ার সিদ্ধান্তটি আল্লাহর। হয়তো এর মাঝে কোন কারণ আছে। আমি বু্ঝতে
পেরেছিলাম আব্বা কি বলতে চাচ্ছেন। তিনি পৃথিবীর অনেক দেশে গিয়েছেন শিবির ও জামায়াতের
নেতা হিসেবে, অসংখ্য সংস্কৃতি ও সমাজ
দেখেছেন, ফুয়াদ আল-খতীব সাহেব তাকে সাথে নিয়ে যেতে
চেয়েছিলেন বলে মীর কাশেম আলী চাচার কাছে শুনেছি কিন্তু সংগঠনের কারণে তিনি দেশ ছেড়ে
যাননাই, সুতরাং এই কথা বলার সুযোগ তাঁর ছিলো।
আব্বার সাথে যে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো তা নয়। উনি
আমাদেরকে সবসময় সব কথা বলতেন আমরা সবসময় সবকথা তাকে বলতাম, এমন পরিস্থিতি কখনোই ছিলো না। তবে একটু বড় হওয়ার পর যখন ধমক খেয়েও হাত-পা কাঁপা কিছুটা
বন্ধ হলো তখন মাঝে মাঝে কিছু কথা হতো। একবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম আব্বার
সাথে। সেদিন ছিলো স্বাধীনতা দিবস। দাউদকান্দির দিকে একদল ছেলে গাড়ি থামিয়ে সামনের আয়নায় কাগজের
পতাকা লাগিয়ে দিলো। ঐ গাড়িটাতে সরকারী পতাকার স্ট্যান্ড ছিলো তাই তারা তখন গাড়িটাকে
আটকাতে একটু ইতঃস্তত করছিলো। কিন্তু আব্বা ড্রাইভার ভাইকে গাড়ি স্লো করতে বলেছিলেন
এবং ছেলেগুলোকে পঞ্চাশ টাকা দিয়েছিলেন।
তখন আব্বাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা এই জমিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছেন, কিন্তু একাত্তর সালে সালে এদেশের মানুষদের গণমতের বিপক্ষে চলে গেলেন কিভাবে? আব্বা প্রথমে বললেন, এটা অনেক বিস্তারিত বিষয়।
বিভিন্ন জটিল ও সমস্যার প্রসঙ্গকে তিনি সহজে এড়িয়ে যেতেন। এই উত্তরের পর আর কিছু
বলার সাহসও আমার হতো না।
কিন্তু সেদিন একটু পরে কি মনে করে তিনি নিজেই বললেন, যখন পাকিস্তানী আর্মি ক্র্যাকডাউন শুরু করলো তখন আমরা ধারণাও করতে পারিনি তারা জুলুম
শুরু করবে, পোড়ামাটি নীতি নেবে। এরপর সময়ের সাথে সাথে
আর কিছু করার থাকলো না। তিনি ছাত্রসংঘের একজনের কথা বললেন যিনি পাকিস্তানী আর্মির নির্যাতনের
প্রতিবাদ করাতে উল্টা তাকেই হত্যা করার জন্য ধরে নিয়ে গেছিলো। বললেন, এক পর্যায়ে অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে আলবদর সদস্য হিসেবে নির্যাতিত মানুষদেরকে
বাঁচানোর চেষ্টা করাই ছিলো তাদের মূল কাজ। যুদ্ধ শেষের কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিলো না এবং তারাও এক
পর্যায়ে না কি সিদ্ধান্তহীন হয়ে পড়েছিলেন, কি করবেন। এমন সময় ভারত ঢুকে
পড়াতে আচমকা যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়।
এ সময় তিনি পালিয়ে মহেশখালীর এক গ্রামে কিছুদিন
ছিলেন। ওখানে তিনি লবণশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন।
তারপর স্থানীয় লীগাররা টের পেয়ে গেলে এক রাতে
নৌকায় চড়ে বার্মা চলে যান। আরাকান হয়ে সোজা রেঙ্গুন। গ্রামের পরিচিত এক মানুষ তাকে কাজ জুটিয়ে দেন
এক বিড়ি কারখানায়। প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক বিড়ির বান্ডেল বাঁধতে হতো।
পাশের এক মসজিদে নামাজ পড়তেন। ছয়-সাত মাস পর একদিন ফজরের নামাজের সময় ইমাম সাহেব
সুরা আল ইমরানের কিছু আয়াত পড়ার সময় একটা আয়াত ভুলে বাদ দিয়ে যান। তখন আব্বা অভ্যাসবশে লোকমা দিয়ে বসেন। নামাজ শেষে
ইমাম সাহেব আব্বাকে ধরে বসলেন, বিড়িশ্রমিক কিভাবে এই আয়াত জানে। ঐ ইমাম
সাহেব কিছুদিন পর দেশে ফিরে যান, যাওয়ার আগে আব্বাকে ইমামতির চাকরিটি
দিয়ে যান। বাকী কয়েক বছর আব্বা ওখানেই ছিলেন।
এই ঘটনা বলে আব্বা বললেন, সবমিলে একাত্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা গ্রে এরিয়া। এখানে হক্ব ও বাতিলের যুদ্ধ হয়নি, বরং নানামুখী জটিল সংঘাত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদেরকে এর দায় বহন করতে
হচ্ছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে আপনাদের ভবিষ্যত চিন্তা কি? উত্তর দিলেন, আল্লাহ যা চায় তাই হবে। সংগঠনের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত। সামস্টিক সিদ্ধান্তের উপর
আল্লাহ রহমত দেবেন।
তাঁর নিজের কাছে সংগঠন ও আনুগত্যের চেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু ছিলো না। আরেকবার কথায় কথায় বলেছিলেন, যদি একান্তই কোন মুসলিম নিরুপায় হয়ে যায় তাহলে আবু জর গিফারী রা. এর মতো একাকী
জীবন যাপন করাও ইসলামী আন্দোলনের ভেতরে মতপার্থক্য সৃষ্টি করার চেয়ে বেহতর।
তবে আরো নানা কথা, সবকিছু মিলে আমি বুঝতে পারতাম, তিনি ইসলামী সংগঠনকে ইসলামের সমার্থক মনে
করতেন না। বরং ইসলাম ও মানবজীবন তাঁর কাছে ছিলো সমার্থক। তার জীবনের লক্ষ্য ছিলো
এই আদর্শের উপর টিকে থাকা। এবং এই লক্ষ্যে পৌছার জন্য তাঁর বেছে নেয়া পথ ছিলো ইসলামী আন্দোলন।
এই পথটিকে তিনি নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন।
ইসলাম তাঁর কাছে ছিলো অনেক উদার, অনেক বিশাল পরিসর। সবাইকে তিনি খোলামনে গ্রহণ করতে পারতেন। কারণ তিনি ইসলামের বিভিন্ন
ধারাকে, পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজকে স্বচক্ষে দেখেছন। এশিয়া থেকে আফ্রিকা, আরব থেকে ইউরোপ। ছোটবেলা থেকে নিজে ইসলামের বিভিন্ন ধারায় হেঁটে বেড়িয়েছেন। তিনি মাঝে
মাঝে কোরআনের বিভিন্ন কেরাআত বা বিভিন্ন মাযহাবের মতপার্থক্যের কথাও বলতেন। কাউকেই
কখনো খারিজ করতেন না। তবে নিজের জন্য ইসলামী সংগঠনকে তিনি 'ওয়াজিব' করে নিয়েছিলেন।
অন্যদিকে আমার আম্মার কাছে বিষয়টা একটু অন্যরকম। আম্মাও
সত্তরের দশকে ঢাবি থেকে পাশ করা ছাত্রী। কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ অন্য ধরণের পরিবার থেকে আসা।
তিনি ইসলামকে চিনেছেন ইসলামী সংগঠন দিয়ে। সুতরাং তাঁর কাছে ইসলামী আন্দোলনই শেষ কথা। জামায়াত করতেই
হবে।
এই গূঢ় পার্থক্যের পরও তাদের মাঝে রসায়ন ছিলো
ব্যতিক্রমী। আমার আব্বা একজন আড়ম্বরহীন বাহুল্যহীন মানুষ হিসেবে জীবন কাটিয়ে গেছেন, এর পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা আমার আম্মার। শেষপর্যন্ত গিয়ে আম্মার চিন্তার সাথে তিনি একমত
হতেন। এটা একটা অব্যখ্যনীয় বিষয়, যা অল্প কথায় বুঝানো সম্ভব না। বেশ
কয়েকবার এমন ঘটেছে অন্য দলের মন্ত্রী এমপি মেয়র এরা চট্টগ্রামে আব্বাকে এটা সেটা
উপহার দিয়েই দিয়েছেন। জমি, ফ্ল্যাট, ট্রাকে করে আসবাবপত্র। আব্বা আটকাতে পারেননাই, কিন্তু শেষপর্যন্ত আম্মার
কারণে ফেরত পাঠাতে হয়েছে। শুনতে মনে হয় গল্পকাহিনী, কিন্তু বাস্তবেই যে ঘটেছে
আমাদের জীবনে।
আজ যখন পিছনে তাকিয়ে দেখি, আমার আব্বা কেমন মানুষ ছিলেন? তাঁর নানারকম গুণ ছিলো।
কিন্তু তার সবচেয়ে বড় গুণ সম্ভবত তার প্রশান্ত হৃদয়। আন-নাফসুল মুতমাইন্নাহ। তিনি
জীবনযাপন করেছেন মুসাফিরের মতো। ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। তৃপ্ত ও শান্ত চিন্তে।
আক্ষরিক অর্থেই। তাঁর পাঞ্জাবী ছিলো হাতেগোণা কয়েকটা। কিন্তু তাতেই কেন জানি তাকে
সুন্দর মানাতো। একটা ব্রিফকেসে সার্টিফিকেট আর পুরনো সাংগঠনিক ডায়রীগুলো। আর শেলফভর্তি বই। এই হলো তাঁর
সারা জীবনের সঞ্চয়। আর্থিক বিবেচনায় বরং আমার দাদা তার পুত্রের চেয়ে কিছুটা বেশি
স্বচ্ছল ছিলেন। পার্থিব কোন কিছুতে তাঁর আকর্ষণ দেখিনাই, হাতঘড়ি ছাড়া। আব্বা ভালো হাতঘড়ি পড়তে পছন্দ করতেন। সেই ভালোর মাত্রা আবার সিকো ফাইভ
বা সিটিজেন পর্যন্ত, এর উপরে না।
একানব্বই এর ঘুর্নিঝড়ের পর যখন বিদেশ থেকে কোটি টাকার
ত্রাণসামগ্রী আসলো, অফিসের একজন একটা টুনা মাছের ক্যান
পাঠিয়েছিলো বাসায়। দুপুরে বাসায় খেতে এসে মাছের সেই ক্যান দেখে আব্বা খুব কষ্ট
পেয়েছিলেন। আমি কোনদিন অফিসে আব্বার রুমে ঢোকার সুযোগ পাইনাই। অফিসের গাড়ি
ব্যক্তিগত কাজে তিনি ব্যবহার করতেন না। কালেভাদ্রে কখনো করতে হলে, যেমন কাউকে হাসপাতালে নেয়ার মতো দরকারে বা আমাকে বিমানবন্দরে রিসিভ করার মতো দরকারে, তেল কিনে দিতেন এবং হিসাব রাখতেন। তাঁর চারপাশে ঘিরে থাকা ক্ষমতা ও রাজনীতির বলয় থেকে তিনি আমাদেরকে একটু দূরে রাখতেন।
আবার একই সাথে চেষ্টা করতেন শিবিরের দায়িত্বশীলরা অথবা মাদ্রাসার শিক্ষকরা যেন
আমাদের লাগাম ধরে রাখে। অন্তঃসলিলা প্রবাহের মতো, মাঝেসাঝে টের পেয়ে যেতাম।
চট্টগ্রামে আব্বা ছিলেন রাজনীতিবিদ। কিন্তু দলের
সিদ্ধান্তে ঢাকা আসার পর তিনি যেহেতু জামায়াতের আভ্যন্তরীণ কাজে জড়িত ছিলেন বেশি, কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ার পরও জামায়াতের বাইরের মানুষ তাকে তেমন চিনতো না। কিন্তু
জামায়াতের যারা তাকে চিনতেন, তাই এতো বেশি ছিলো যে প্রায়শ
এই পরিচয় লুকাতে হতো। কোন এক অবোধগম্য কারণে মানুষ তাকে খুব বেশি ভালোবাসতো। তার প্রতি
অন্যদের এই ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা কখনো কখনো আমি তৃতীয় পক্ষ হিসেবে খেয়াল করে দেখতাম এবং
চিন্তা করতাম এর কারণ কি?
সম্ভবত এর বড় একটা কারণ হলো তিনি খুব মেধাবী ও
তীক্ষ্ণধী হওয়ার পরও কিভাবে জানি খালেস ও নিরহংকারী মানুষ ছিলেন। সব বুঝতেন কিন্তু কাউকে
শত্রু বা অপছন্দের মানুষ হিসেবে গণ্য করতেন না। মানুষকে কোনভাবেই জাজ করতেন না। একবার আমি
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা প্রাণপাত করে নিয়ে
এসে পত্রিকা চালু করলেন, এই দৈন্যদশা দেখে এখন হস্তক্ষেপ করতে
ইচ্ছা করে না আপনার? হেসে বলেছিলেন, আমার যা চেষ্টা তা তো করেছি। বাকীটা আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছি।
তাঁর এই নিরহংকারী ও পিছুটানবিহীন স্বভাব আমাকে মাঝে
মাঝে আশ্চর্য করতো। বিমানের বিজনেস ক্লাশে তিনি স্বাভাবিক, আবার ট্রেনের সুলভ শ্রেণীতেও তিনি খুশী। ফাইভ স্টার হোটেল না কি রাস্তার পাশের হোটেল, তাঁর কিছু আসতো যেতো না। চারপাশের নানা পার্থিক বিষয় তাকে প্রভাবিত করতো না। কোন
দেশের রাষ্ট্রদূত হোক, এমনকি প্রেসিডেন্ট হোক
কিংবা কর্ণফুলী ব্রিজের গোড়ার চা দোকানদার, সবার কাছে তিনি পছন্দের
মানূষ হয়ে যেতেন। কারণ তার মাঝে কৃত্রিমতা ছিলো না। আল্লাহ তায়ালার উপর তাওয়াক্কুল সম্ভবত
এর বড় একটা কারণ।
এছাড়াও তাঁর একটা সহজাত ক্ষমতা ছিলো, যা মাঝে মাঝে আমার মনে হতো একটা অলৌকিক ক্ষমতা। অনেক বছর আগে দেখা হওয়া কথা হওয়া
মানুষের নাম ও নানা কথাবার্তা তাঁর অবলীলায় মনে থাকতো।
হয়তো কুমিল্লার বরুড়ার কোন জামায়াতকর্মী, কিংবা বগুড়ার একজন শ্রমিক যে মগবাজারে কাজ করে, অনেকদিন পর দেখা হলেও তার
নাম ধরে খোঁজখবর নিতেন। ঐ মানুষটা তখন আপ্লুত হয়ে যেতো। তবে এটাও তিনি কোন ট্রিক
হিসেবে করতেন তা না। বরং তিনি মানুষকে গুরুত্ব দিতেন। মর্যাদা দিতেন। মানুষের দুঃখকষ্টকে
সুন্দর কথা দিয়ে হাসি দিয়ে সামর্থ্যমতো সাহায্য দিয়ে কমিয়ে দিতেন। এইরকম কয়েকটা ঘটনা আমি খেয়াল করে দেখেছি, এইটা ছিলো তাঁর স্বভাবজাত স্বাভাবিক বিষয়। ড্রাইভার, স্টাফ এই ধরণের মানুষদেরকে তিনি নিজের সমপর্যায়ের মনে করতেন। উনারাও তাঁর জন্য জীবন
দিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকতো। অনেকে ভালোবাসার আতিশয্যে আমাকেও শাসন করতেন। আব্বা তাদের বাড়িঘরে
চলে যেতেন। পরিবারের খোজখবর রাখতেন। বাচ্চাদের পড়ালেখার ব্যবস্থা করতেন।
অনেক জায়গায় তাঁর প্রতি জামায়াতের মানুষদের ভালোবাসা
এতোটা বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে যে এমনকি আমি নিজের পরিচয় প্রকাশ করিনাই। বরং এমনিতেই
কথাবার্তা চালিয়ে যেতাম। বুঝতে চেষ্টা করতাম ঘটনা কি। যে মানুষটা তাঁর সাথে একটু
পরিচিত হয় সেই তাকে পছন্দ করা শুরু করে কেন? এমনকি কোন মন্ত্রী, কোন মুক্তিযোদ্ধা, কোন কমিউনিষ্ট, কোন হিন্দু? চট্টগ্রামে জামায়াত অফিস ও আমাদের বাসা
যেখানে ছিলো, ওখানে প্রচুর হিন্দু মানুষ
বসবাস করেন। এলাকার হিন্দু দোকানদাররাও দেখা যেতো আব্বার কাছের মানুষ। আব্বাকে
দেখলে খুশি হয়ে যায়। কেন? তখন বারবার আমার মনে পড়েছে
একটা হাদীসে নববীর কথা। রাসুল সা. বলেছেন, আল্লাহ যদি পছন্দ করেন তাহলে
তিনি ফেরেশতাদেরকে বলেন তোমরা গিয়ে জমিনবাসীদের কানে কানে বলে দাও তাকে আমি ভালোবাসি। কে
জানে, হয়তো এমনও হতে পারে। এই পৃথিবীর জীবনে আল্লাহ তায়ালার
প্রিয়পাত্র হওয়ার চেয়ে বড় অর্জন আর কিইবা আছে? আমরা মানুষেরা পার্থিব নানা
স্বার্থ ও প্রবৃত্তির কারণে তার মূল্য বুঝে উঠতে পারিনা।
প্রশান্ত মানুষ হওয়ার অর্থ যে তিনি একদম শান্তশিষ্ট
ছিলেন এমন না। মাঝে মাঝে তাঁর রাগ বুঝা যেতো। তবে সেই রাগকে তিনি আটকে রাখতে পারতেন।
আমার ধারণা, এই রাগ সামলে একদম স্বাভাবিক থাকার কারণে
তার মস্তিস্কের উপর চাপ পড়েছিলো দীর্ঘদিন ধরে। চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অসংখ্য ডামাডোল, বাইরের মারামারি, অনেক মানুষ নিহত আহত গ্রেফতার হওয়ার অনেক
ঘটনা, দলের আভ্যন্তরীণ সমস্যা এসব তিনি সহজে পার হয়ে
গিয়েছেন। কিন্তু এসবের প্রভাব নিঃসন্দেহে মানুষ হিসেবে তাঁর মনের উপর পড়েছিলো।
যখন জামায়াত নেতাদেরকে একের পর এক ফাঁসি দেয়া শুরু
হলো, তখন থেকে আব্বা একদম চুপ হয়ে গেলেন। আম্মা
বলতেন, বিছানায় শুয়ে থাকা তাঁর চোখের কোণা দিয়ে
শুধুপানি গড়িয়ে পড়ে। আমি যেহেতু সাধারণত আব্বার সাংগঠনিক পরিচয় থেকে সরে থাকতাম, সুতরাং অন্য নেতাদেরকে আমি খুব কাছ থেকে দেখিনি। আব্বা যখন ঢাকায়, তখন আমি আর বাংলাদেশে নাই। তথাপি ছুটিতে গেলে অনেকের সাথে হঠাৎ করে দেখাতো হতোই। কিছুটা
ভেতর থেকে জানার সুযোগ পেতাম। জামায়াতের যেসব নেতাদেরকে বাংলাদেশে ফাঁসি দেয়া
হয়েছেন এরা প্রত্যেকেই ছিলেন প্রায় একইরকম মুখলেস মানুষ।
একেকজনের গুণের বিকাশ ঘটেছিলো একেকদিকে। দর্শকের সারিতে
বসে নয় বরং মঞ্চের একপাশে একটু আড়াল কিন্তু কাছে থেকে দেখে আমার মনে হতো সাহাবীদের
কথা। যাদের একেকজনের গুণ ছিলো একেকরকম। সারাজীবনে আব্বার বন্ধু ও কাছের মানুষ বলতে ছিলেন এরাই।
এমন মানুষগুলো একসাথে হয়েছিলেন বলেই বাংলাদেশে এমন কালজয়ী একটা মুভমেন্ট শুরু
হয়েছে।
প্যারালাইজড হয়ে আব্বা অনেকদিন অসুস্থ ছিলেন। এসবি পুলিশের
অফিসাররা আসতো নিয়মিত, মেডিক্যাল রেকর্ড কাগজপত্র
নিয়ে যেতো। একটু সুস্থ হলে, উঠে বসতে পারলে যদি
ট্রাইবুনালে দেয়া যায়। কিন্তু তাদের আশা পূরণ হয়নাই। এই ক্ষেত্রে আব্বার আশাটাও অবশ্য পূরণ
হয়নাই। তাঁর শহীদি মৃত্যুর ইচ্ছা ছিলো। আল্লাহ তাকে শাহাদাতের দারাজাত দিন।
আব্বার কথা ভাবতে গিয়ে শুধু ভালো কথাই মনে পড়ছে। মানুষ
হিসেবে তাঁর কি কোন দোষত্রুটি ছিলো না? নিঃসন্দেহে ছিলো। রাসুল সা. বলেছেন, কেবলমাত্র আমল দিয়ে নাজাত পাওয়া কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু আমার মনে পড়ছে না
এখন। এতো সংযমী এবং নিয়ন্ত্রিত মানুষের কোন ত্রুটি বের করা পরিশ্রমসাধ্য কাজ।
আগেই বলেছি, আমরা অন্য সবার মতো বাবা পাইনি।
রাতদিন ব্যস্ততায় তাঁর জীবনে জামায়াতই ছিলো আসল পরিবার। আমার আব্বার কাছে আমার যে
স্থান, শিবিরের যে কোন ছেলেরও একই স্থান। এমন মনে
হয়েছে বিভিন্ন ঘটনায় সারাজীবন, বারবার। তথাপি এমন বাবা এমন
মা কয়জন পায় এ জীবনে? আজ আত্মাটা বিদীর্ণ হয়ে যায় আপনার কথা
মনে করলে। আল্লাহ যদি আমার অবশিষ্ট আয়ুগুলো আপনাকে দিয়ে দিতেন, তবে নির্দ্বিধায় দিয়ে চলে যেতাম। যে সময়গুলো আপনার কাছে ছিলাম, তখন যদি বুঝতে পারতাম তার মূল্য। তাহলে হয়তো আপনার জান্নাতি চেহারাটা আরেকটু দেখতাম।
আম্মার কাছে শুনেছি, একাশি সালে বিয়ের পর একবার ঢাকার কোন রাস্তায় রিকশা দিয়ে যেতে যেতে আপনি আম্মাকে
বলেছিলেন, এই যে বড় বড় দালানে
মানুষগুলো ঘুমায়, রাস্তায় ঘুমানো মানুষগুলোকে দেখেনা, এই দেশে ইসলাম কায়েম হলে এই অবস্থা আর থাকবে না। সম্পূর্ণ বদলে যাবে।
তারুণ্যের সেই স্বপ্নের তাড়না নিয়ে আপনি সারাজীবন কাটিয়ে
গেছেন। চল্লিশ বছর আগে আপনার হাত ধরেছিলেন আমার মা, এখন তিনি একা। আল্লাহর ইচ্ছা
আমাদেরকে মেনে নিতে হয়। যেই সাধারণ গ্রাম থেকে আপনি নিজ মেধা ও যোগ্যতায় নির্বিকার অনেক
দূর গিয়েছিলেন, জিন্দেগির এই সফর শেষে চুপচাপ সেখানেই
ফিরে গেছ্নে। আপনি এই পৃথিবীতে নিজের জন্য কিছু চাননাই। আপনার এই চাওয়া আল্লাহ পূরণ
করেছেন বলেই আমার মনে হয়।
তাই রাহমানুর রাহীম আল্লাহর কাছে চাওয়া, তিনি যেন আপনাকে মাফ করে রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দেন। আপনার সওয়াল-জওয়াব, আপনার আলামে বরযখ যেন তাঁর প্রিয় আবেদদের মতো হয়। আমি নিতান্তই আপনার অযোগ্য এক
সন্তান, তথাপি তিনি যেন আমাদের সবাইকে সেই চিরস্থায়ী
জীবনে একসাথে থাকার সুযোগ দেন।
অধ্যক্ষ আবু তাহের যখন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি |
(অধ্যক্ষ
মাওলানা আবু তাহের (রাহি.) এর বড় মেয়ে)
রবিবার সকালে মেয়েরা ঘুম থেকে উঠার পর বড্ডা অবাক
হয়ে আমার ফোলা চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী হইছে
মাম্মা? তুমি কানতেছো কেনো?মেয়েকে
কীভাবে খবরটা দিবো ভাবছিলাম। মেয়েদের বাবা হেজিটেট না করে সরাসরিই বললো 'আব্বু, তোমার নানাভাই কালকে রাতে মারা গিয়েছেন'।
বড্ডার বয়স এখন আট। আমি বুঝিনি আট বছরের মেয়ে এভাবে কাঁদবে তার নানাভাই'র জন্য! কাঁদতে কাঁদতে তার
হেঁচকি উঠে গেলো। এক পর্যায়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতেই আমার বুকের
ভিতর থেকে বার বার বলতে লাগলো, ma, I need to
say bye bye to nanavai for one last time! ma! please! I need to say bye
bye to nanavai for one last time!
মেয়ে তার নানাভাইকে লাষ্টবারের মত বাই বলতে
চাচ্ছিলো। কীভাবে বলবে? আমিই বা কীভাবে বিদায় দেই আব্বুকে? আদৌ কি কোনোদিন বিদায় দিতে পারবো আব্বুকে?! আমার মনে হয় না। জীবিত আব্বু ফিজিক্যালি হাজার হাজার মাইল দূরে
আরেক মহাদেশে থাকলেও, মৃত আব্বু যেনো এখন আমার খুব
কাছে। আমি বাড়ির পিছনে বারান্দায়
গিয়ে বসি। মনে হয় যেনো আব্বু আমার পাশেই এসে বসেছেন। শুরু থেকেই জানতাম এই স্বপ্ন কখনো বাস্তব হবে না, তারপরও স্বপ্ন দেখতাম একদিন আব্বুকে গাড়িতে
পাশে বসিয়ে আমি ড্রাইভ করবো। আব্বু অবাক হয়ে ঠিক সেই ছোটবেলার
মত বলবে, ‘বুড়ি! তুমি গাড়ী চালাইতে শিখছো কখন?!’
বড্ডার ফোঁপানো যেন শুনতে পাচ্ছিনা আর। বড্ডার বয়সে থাকতে আব্বুকে কেমন দেখেছিলাম? ঠিক আট বছর বয়সের একটা স্মৃতি খুব স্পষ্ট মনে আছে। সে বছর একানব্বই'র
ঘূর্ণিঝড় হলো। মূলতঃ আব্বুর হাত দিয়েই সৌদি সরকারের অনুদান এসেছিলো আমাদের দাদুর গ্রামে। অনুদানের টাকায় যাদের
বাড়িঘর ভেসে গিয়েছিলো তাদের সেমি-পাকা বাড়ি করে দেয়া
হচ্ছিলো। আমি চোখ বন্ধ করলেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ঘুর্ণিঝড়ের কয়েকদিন পরের
সময়। বাসায় প্রচন্ড টেন্সড পরিবেশ। আব্বু একদম চুপ। আম্মু
অনবরতঃ থেকে থেকে চোখ মুছছে। আম্মু তার পাঁচ ননদের মধ্যে যে ননদকে সবচে বেশী আদর করতো, সেই হাসিনা ফুপু তার এক বাচ্চা রেখে
বাকী সব বাচ্চা আর ফুপা সহ ঘূর্ণিঝড়ে মারা গিয়েছেন। সব
ফুপুদের বাড়ি, দাদুর বাড়ি সব শেষ। ভিটা ছাড়া কারো কিছু
নাই। সে কারনে বাসায় টেনশান না, টেনশান দাদুকে নিয়ে। দাদু অসম্ভব রেগে গিয়ে আব্বুকে যা তা বকেই
যাচ্ছে। কারন আব্বুর এনে দেয়া অনুদানের টাকায় অন্যদের সেমি-পাকা
বাড়ি হয়ে যাচ্ছে, অথচ আব্বু নিজের ভিটায় বেড়া আর টিন
দিয়ে কোনোরকমে একটা বাড়ি বানিয়েছে। দাদু আর সেইসাথে
ফুপুরাও সবাই অসম্ভব রেগে আছে। আব্বুকে শুধু একটা কথাই বলতে শুনেছিলাম,
‘ঐ অনুদানের টাকা আমার বা আমার পরিবারের জন্য না। আমার যতটুকু
সামর্থ্য ততটুকু দিয়ে আমি আপনাকে করে দিচ্ছি আম্মা'। দাদী আব্বুকে অসম্ভব পছন্দ করতো। মৃত্যু পর্যন্ত। টোটালি বায়াসড পছন্দ। কারন আব্বু দাদীর
একমাত্র ছেলে। কিন্তু সেই ছেলেকে রেগে গেলে গালিও দিতো
দাদী। কিন্তু দাদীর গালি, ফুপুদের
রাগ, কিছুই ছুঁতে পারেনি আব্বুকে। আব্বুকে এজন্যেই আমার কাছে দূরের মনে হতো। দূরের তারার মত। যে মানুষ একজন অসম্ভব টাইপ সৎ নেতা। আব্বুকে তাই আমার কাছে
বাবার চেয়ে নেতা মনে হতো বেশী। দাদীর আমৃত্যু আফসোস
ছিলো আব্বু তাকে পাকা বাড়ি করে দিতে পারেনি কখনো। আর আব্বু? পৃথিবী একদিকে আর মা আরেকদিকে।
আম্মু যে অল্প কিছু তার জীবনের গল্প শুনিয়েছে
আমাকে, তারমধ্যে একটা গল্প হলো- দাদী যেহেতু আম্মুকে
অসম্ভব পেইন দিতো- যা আমি বড় হয়েও অনেক দেখেছি- একবার
আম্মু কাঁদছিলেন। আব্বু অফিস থেকে ফিরে আসার সাথে সাথে যথারীতি দাদী সাথে সাথে, একদম
সাথে সাথে আম্মুর নামে কমপ্লেইন। ঠিক যেভাবে বড় হয়েও দেখেছি। অবশ্য একবার আমার দাদীর বিরুদ্ধে এই নিয়ে যুদ্ধ ঘোষনার পরে দাদী এমন ভয় পেয়েছিলো, আমার সামনে আর কোনোদিন আমার মা-কে নিয়ে আব্বুকে
কমপ্লেইন করেনি। আমি বাসায় থাকলে লুকিয়ে লুকিয়ে করতো বা আমি হলে চলে যাওয়ার পর করতো। কিন্তু তখন আমি নাকি
অনেক ছোট ছিলাম। বড়ভাইয়াও ছোট। দাদী আব্বুকে কয়েক ঘন্টা
ধরে কমপ্লেইন করলেন। আম্মু আর না পারতে সেই প্রথম নাকি
আব্বুকে বলতে চেয়েছিলো দাদী যা বলছে তা ঠিক না। আব্বু
আম্মুকে কথা শেষ করতে দেয়নি। শুধু নাকি বলেছিলেন, ফজিলা, তুমি এম এ পাশ। আর আম্মা অশিক্ষিত মানুষ। তুমি
আর আম্মা কি এক? আম্মা যা বলে শান্তি পায় আম্মাকে বলতে দাও। আমি তোমাকে কিছু না বললেই তো হলো। ব্যাস, এজন্যেই বড় হতে হতে দেখেছি দাদীর স্বৈরাচার!
আম্মু কষ্ট পেলেও কিছুই না বলা। আর আব্বু তো আরো চুপ! আমি মাঝে মাঝে নিজেই বিরক্ত হয়ে যেতাম! এমন ঘন্টার পর ঘন্টা আব্বুর কানের কাছে দাদী
ঘ্যান ঘ্যান করেই যাচ্ছে আম্মুর নামে, গ্রামের এই মানুষের নামে, সেই মানুষের নামে, আর আব্বু পুরো সময়টা ধরেই হয় বই পড়ছে অথবা
পত্রিকা পড়ছে আর শুধু একটু পর পর বলে যাচ্ছে, হুম!...
জ্বী আম্মা! ...আচ্ছা! ...ঠিক আছে।...... হুম!... জ্বী
আম্মা! আব্বুর কথায় খাস চিটাইংগা এক্সেন্ট ছিলো। কিন্তু আব্বু যখন উর্দূ বা আরবী বলতো, আমি অবাক হয়ে
দেখতাম আব্বু যেন কথা বলছেন না, যেন কবিতা বলছেন!
যেবার আব্বু আমাকে IIUI এ সাথে নিয়ে গেলেন রেখে আসতে, ঢাকা টু ইসলামাবাদ পুরো জার্নিতে আব্বুকে
আমাকে উর্দূ শেখাতে শেখাতে গিয়েছিলেন। আমার খুব প্রাউড
লাগতো আব্বুর এই ভাষার দক্ষতা নিয়ে। আরবী, ফার্সী, উর্দূ, ইংলিশ ঝড়ঝড় করে বলতে পারতেন আব্বু। আমি জানিনা আরো ভাষা জানতেন কিনা। আমাকে আব্বু কয়েকবার বলেছে, সুযোগ হলে ফার্সিটাও যেন শিখে নেই। আমি জানতাম আব্বু ভাষার প্রতি এই ভালবাসা
পেয়েছে দাদা থেকে। আম্মু অনেকবার বলেছে, আম্মুর বিয়ের পর দাদা একবার লম্বা সময়ের জন্য
ঢাকা ছিলেন আব্বুম্মুর সাথে। সে সময় প্রতিদিন আম্মু যদি মাগরিবের নামাযের পর দাদার কাছে ফার্সি আর উর্দূ শিখতে না বসতো, দাদা সে রাতে মন খারাপ করে আম্মুর সাথে কথাই
বলতেন না! আর বেচারী আম্মু! আব্বুর
সামর্থ্য অনুযায়ী চিলেকোঠার মত এক রুমের সংসার।
তারমধ্যে আমি আম্মুর পেটে। বড়ভাইয়া তখনো দুধের বাচ্চা।
এই অবস্থায় শ্বশুড় অসম্ভব কড়া যেভাবেই হোক এম এ পাশ বউকে এবার পড়ালেখা বাকীটুকুও করিয়ে ছাড়বে উর্দূ আর ফার্সী শিখিয়ে!!
আব্বুকে নিয়ে আরো প্রাউড লাগতো আব্বুর
অভিজ্ঞতার জন্য। একবার হাতে গুনে গুনে আব্বু বলেছিলো পৃথিবীর জাষ্ট অল্প কয়েকটা
দেশে-এক্সেক্ট সংখ্যাটা ভুলে গিয়েছি- মাত্র কয়েকটা দেশে যাওয়া হয়নি আব্বুর। আমাকে
যখন ইসলামাবাদ রেখে আসছেন, তখন
আব্বু বলেছিলো, পাকিস্তানে মারী নামে একটা জায়গা আছে।
আব্বু পৃথিবীর যত দেশে গিয়েছে, যে কয়েকটা জায়গা অন্যরকম ভালো লেগেছে, তারমধ্যে ‘মারী’ ওয়ান অফ দেম। এর
কয়েক মাস পরেই IIUI থেকে শিক্ষা সফরে মারী গিয়েছিলাম। আমি আব্বুর মত অত দেশে তো যাইনি। আট/নয়টা দেশে গিয়েছি মাত্র। কিন্তু নিউজিল্যান্ড’র পরে এখনো মারী আমার কাছে সবচে’ প্রিয় জায়গা। কী জানি! হয়তো আব্বুর ভাললাগার জায়গা বলেই মনে হয়। কিন্তু এটা ঠিক
জানি, বিভিন্ন দেশে দেশে যাওয়ার, ট্রাভেল করার যে স্পীরিট আমার রক্তে রক্তে, তা পুরোপুরি পেয়েছি আব্বু থেকে। আব্বু যখন দেশ বিদেশের গল্প করতো আমার
সাথে, আব্বুকে আমার কাছে মনে হতো যেনো গল্পের যাদুকর। যে ঘুরে ঘুরে দেশ বিদেশ দেখে দেখে গল্পের ঝুড়ি
বানিয়েছে ইয়া বিশাল! সেই অদৃশ্য যাদুময় গল্পের ঝুড়ি’র প্রতি আমার আকর্ষণ ছিলো অসম্ভব দূর্বার!
কিন্তু আব্বু আসলে কেমন ছিলো? আব্বু মানুষ ছিলো। মহামানুষ না। আব্বুর অনেক অনেক ভুল ত্রুটি ছিলো। জাষ্ট লাইক এনি আদার
হিউম্যান বিয়িং। বিশেষ করে
আম্মুকে নিয়ে আব্বুর উপর আমার কমপ্লেইন ছিলো আকাশ সমান।
উলটা আম্মু আমাকে বুঝাতো আব্বুর পক্ষ নিয়ে। কিন্তু আমি রেগে যেতাম। আব্বু কেনো আম্মুকে
কখনো শাড়ী কিনে দেয়না?! আম্মু
হেসে হেসে বলতো, তোর আব্বুর কাপড় আছে কয়টা আগে তা গুনে দেখ! একবার গুনেছিলামও! যথারীতি আব্বুর একমাত্র সাদা পাঞ্জাবী পায়জামার
সেট ছিলো মোট চারটা। তিনটার মত লুংগি। চারটা কি পাঁচটা সেন্ডো
গেঞ্জি। একটা নাকি দুইটা ওভারকোট যা বিদেশে যাওয়ার সময় নিয়ে যেতেন। সাত আটটা টূপি। কয়েকটা আন্ডিজ। দুই জোড়ার মত স্যান্ডেল। একটা হাতের ব্রিফকেস।
আর সব কাগজ পত্র আর বই খাতা। ব্যাস, আব্বু সারাজীবন এই এতটুকু সম্পত্তি দিয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছেন।
টিনেজ সময়ে কমপ্লেইন করতাম, আব্বু আব্বুর মত না! আব্বু হচ্ছে নেতা! আমার নেতা লাগবে না। আমার বাপ লাগবে! টিনেজ সময় আসলে মানুষের জীবনে একটা ব্লাইন্ড স্পটের মত। অনেক কিছুই তখন চোখে পড়েনা। আমারো পড়েনি। নাহলে আব্বু যে নিরবে নিরবে বাবা হিসেবে আমাকে
কীভাবে গড়ে যাচ্ছিলেন, গ্রুমিং করে যাচ্ছিলেন, আদর দিয়ে যাচ্ছিলেন, আহ্লাদ দিয়ে যাচ্ছিলেন, বড় মেয়ে হিসেবে আমার হাজার রকমের বিদ্রোহ দেখেও
না দেখার ভান করে যাচ্ছিলেন, সহ্য করে যাচ্ছিলেন, কিছুই তখন খেয়াল করিনি। তাই নিয়ে আমার আফসোস
নেই। কারন আব্বুর সাথে আমার রিলেশান
নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। কারন আমি জানি, আমি যাইই
করেছি জীবনে, তা বেয়াদবী করি বা বিদ্রোহ করি বা যাইই করি; আব্বু আমাকে বুঝতো। আব্বুর যে উইজডম, সে উইজডমে আব্বু আমাকে বুঝতো। সেজন্যেই আমি যখন আমার বিয়ের এত এত প্রস্তাব আসছে দেখে একদিন সোওওজা আব্বুর সামনে গিয়ে আম্মুকে
শুনিয়ে শুনিয়ে জোড়ে জোড়ে বলেছিলাম, ‘আব্বু, আমি মরে গেলেও জামাত শিবিরের কাউকে বিয়ে
করবোনা। কথাটা মনে রাখবেন। আমাকে জোড় করলে কিন্তু ঘর
ছেড়ে বের হয়ে যাবো’। আব্বু যথারীতি আমি যখন আগ্নেয়গিরি হয়ে আব্বুর
সামনে কিছু বলতে যেতাম, আব্বু কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু
ঐ বই বা পেপারের উপর চোখ সেঁটে রেখেই জাষ্ট বলতো ‘হু’। আব্বু
সেবারও বললো ‘হু’। ব্যাস। ফয়সালা
হয়ে গেলো। আম্মু কাঁদতে কাঁদতে পারলে যেনো অজ্ঞান হয়ে যায়। আমার অবশ্য তাতে আর ভয় পাওয়ার কিছু ছিলো না।
কারন আমি জানতাম আব্বু যে ঐ ‘হু’ বলেছে, আব্বু
আমাকে আর কিছুই বলবে না। এবার আম্মু যতই কাঁদতে কাঁদতে দুনিয়া ডুবিয়ে ফেলুক।
আব্বুকে জীবনে দু’বার বাচ্চাদের মত চোখ মুখ ভাসিয়ে
শব্দ করে হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদতে দেখেছি। একবার যখন আমাদের সবচে’ ছোটভাই ফুয়াদ মারা
গেলো। আরেকবার যখন আমাকে বিয়ের সময় শ্বসুড়বাড়ীর গাড়ীতে তুলে দিচ্ছিলো। আমার
শ্বশুড় বিয়ের পরে আমাকে খুব মজা করে গল্প শুনিয়েছে
অনেকবার। কীভাবে আমার মোহরানা কত হবে তা নিয়ে উপস্থিত
মুরুব্বীরা দেনদরবার করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু মাঝখান থেকে কে যেনো ফস করে বলে বসলো, ‘পাঁচলাখ ঠিক আছে?’
কথাটা মাটিতে পড়ার আগেই আব্বু যেই বললো ‘আলহামদুলিল্লাহ’, সাথে সাথে আমার শ্বশুড়ও বললেন ‘আলহামদুলিল্লাহ’! ব্যাস! জাষ্ট একটা প্রশ্ন আর দুইটা আলহামদুলিল্লাহতে আমার মোহরানা ফিক্সড! যারা দেনদরবার করার জন্য
রেডী হচ্ছিলেন, সবাই বোকা
হয়ে গেলেন! এটা কী হলো?! এভাবে বিয়ে হয় নাকি?! এ কেমন বউ আর জামাই’র বাপদের কান্ড?!
আব্বু আমাকে বিয়ে দেয়ার সময় আমার শ্বশুড়কে
বলেছিলেন, আপনাকে আমার মেয়ে দিলাম। শুধু একটা অনুরোধ, আমার মেয়েটা জীবনে যতটুকু পড়েলখা করতে চায়, করাবেন। এই কাহিনী আমি শুনেছিলাম যখন আমি পিএইচডি ছেড়ে
দিতে চাচ্ছিলাম। আমার শ্বশুড় ফোনের ওপাশ থেকে গম্ভীর হয়ে এই কাহিনী শুনিয়ে বলেছিলেন, তাহের সাহেবকে আমি কথা
দিয়েছি মা। আমার সে কথা যেনো ভংগ না হয়। যত কষ্টই হোক পিএইচডি
তুমি শেষ করবা। যেবার আব্বুকে সামনাসামনি পিএইচডি’র সার্টিফিকেটটা দেখালাম, আব্বু তখনো বিছানায় পার্শিয়াল প্যারালাইজড, আব্বুর চেহারায় যেন
হাজার হাজার লাইট জ্বলছিলো খুশীতে। সেই আলোজ্বলা চেহারায় আব্বু শুধু জিজ্ঞেস করেছিলো ‘পোষ্ট ডক্টরালটা
তাহলে বাকী আছে এখন। রিয়াদ এ একটা প্রিন্সেস নোরা
ইউনিভার্সিটি আছে মেয়েদের। ওখানে ট্রাই করে দেখতে পারো’। আমার মনে মনে রিয়েকশান তখন, পাগল নাকি?! আমাকে
কী পাগলা কুত্তায় কামড়েছে যে আমি আরো পড়তে যাবো?! আব্বুকে
মুখে কিছু বলিনি। সন্তানের পড়ালেখার জন্য পৃথিবী বিলিয়ে দিতে যে বাবা এক পায়ে খাড়া, সেই
বাবাকে বলা যায় না, আব্বু এনাফ পড়ালেখা!
বলিনি। বলা সম্ভব ছিলো না। কিন্তু এখন আব্বুর মৃত্যুর পর এই একটা আফসোস
হচ্ছে। আব্বু বেঁচে থাকতেই পোষ্ট ডক্টরাল’র জন্য যদি ট্রাই
করতাম! আব্বুকে আরেকটা খুশী এনে দিতে পারতাম তাহলে।
জীবনে আব্বুকে পড়ালেখা ছাড়া আর কোনো কিছু দিয়েই তো খুশী
দিতে পারিনি।
এই খুব ব্যক্তিগত গল্পগুলো কেনো করছি জানেন? কারন এই গল্পগুলোর সাথে শুধু ব্যক্তি আমি জড়িত না, এই যে মানুষটার গল্প
করছি, যে মানুষটা চলে গেলেন এই শনিবার, এই মানুষটার চলে যাওয়ার ভিতর দিয়ে বাংলাদেশের
একটা অধ্যায় শেষ হলো। একটা দূর্লভ চ্যাপ্টার ক্লোজড হলো। কারন আব্বু শুধু আমার আর আমাদের আব্বু ছিলেন না। আব্বুর মত মানুষরা একটা দেশের, একটা জাতির, একটা সময়ের সবচে’ দূর্লভ সম্পদ। আব্বু এবং আব্বুর রাজনৈতিক কলিগরা ছিলো এমন দূর্লভ কিছু মানুষ, যাদের
গল্প মানুষ যুগ থেকে যুগে শুনে। মুভিতে দেখে। বইয়ে পড়ে।
বাস্তবে এদেরকে অবাস্তব মনে হয়। আমি আব্বুর মেয়ে হয়েও
তাই আব্বুদের গল্পগুলো চোখের সামনে দেখেও কুলিয়ে উঠতে
পারতাম না। বুঝতাম না। এখন যখন একটু একটু বুঝতে শিখছি, গল্পের নায়কদের হয় এ দেশ খুন করে ফেলেছে, ফাঁসি
দিয়ে দিয়েছে, অথবা মরে গিয়েছে। আব্বুর গল্প আমার আব্বুর মেয়ে হওয়ার গল্প না। আব্বুর
গল্প বাংলাদেশের গল্প। আব্বুর
গল্প বাংলাদেশের ইতিহাসের গল্প। যে ইতিহাস শেষ হয়ে গেলো
আব্বুর মৃত্যূর সাথে সাথে। এই শনিবার রাতে। আব্বু বেঁচে
থাকতে আব্বুর পরিচয় কখনো দেইনি। কখনোই জোর গলায় বলতে পারিনি আমি জামায়াতের এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারী মওলানা আবু তাহের সাহেবের
বড়মেয়ে। ছোটবেলাতেও পারিনি। বড়বেলাতেও পারিনি।
যারা সোশাল মিডীয়ায় বিভিন্ন লেখায় আব্বুর সাথে
আমার আর বড়ভাইয়ার “অভিমানী” সম্পর্কের
কথা লিখছেন, তারা কেনো, পৃথিবীর
কেউ কোনোদিন বুঝতে পারবে না, আব্বুর মত যারা ইতিহাস তৈরী করে, তাদের মত
নেতাদের সন্তান হওয়া কী কঠিন!! আমার, আমাদের এভরি সিংগল মুভমেন্টকে জাজ করা হতো ‘তাহের ভাইয়ের সন্তান’ হিসেবে! ‘ফজিলা আপার সন্তান’ হিসেবে! আমরা কখনোই কোথাও শুধু আমি বা আমরা হতে পারতাম না। আমি কোথাও ফারজানা
ছিলাম না। ছিলাম তাহের ভাই
আর ফজিলা আপার বড় মেয়ে! বোরকায়
পকেট লাগিয়েছি কেনো?! তাহের
ভাইয়ের মেয়ের একী কান্ড! ছেলেদের মত পকেট লাগিয়েছে বোরকায়! সেই পকেটে হাত দিয়ে হাঁটে! অমুক মুভি দেখেছি কেনো?! হায় হায়! তাহের ভাইয়ের মেয়ে সিনেমা দেখে!
ইন্নালিল্লাহ! কলকাতার অমুক লেখকের অমুক বই পড়েছি কেনো?! একী কলিকাল চলে এলো! তাহের
ভাইয়ের মেয়ে সিলেবাসের বাইরে অমুক অমুক বই পড়ে বেড়াচ্ছে!! তাহের ভাইয়ের মেয়ে আর ফজিলা আপার মেয়ে হওয়া
থেকে পালিয়ে পালিয়ে থাকা ছিলো তাই আমার নিয়তি। যেখানেই যাই, যাই করি না কেনো, কেউ না কেউ থাকে যে আব্বুম্মুকে চিনে। আব্বুম্মুকে রিপোর্ট দেয়।
সে বান্ধবীদের সাথে ফার্ষ্টফূডের দোকানে
বার্গার খাওয়া হোক, বা রাস্তায় রাস্তায় হিমু স্টাইলে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে হাঁটা হোক, বা যাইই হোক না
কেনো! তাই বড় হতে হতে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, জীবনে কোনোদিন নিজ থেকে কাউকে বুঝতে
দিবো না আমি কার মেয়ে। এবং আমি যে তাদের মেয়ে এটা যেনো
কেউ ঘুনাক্ষরেও বুঝতে না পারে তাই তাদের মেয়ে না হওয়া প্রমান করতে যা যা করতে হয় তাই তাই করার প্রতি ছিলো আমার দূর্বার আগ্রহ! তাহের ভাই আর ফজিলা আপার পরিচয়ের বাবল- থেকে
বের হওয়ার জন্য আমার সাধ্য আর সাধনার অন্ত ছিলো না। আর
তা করতে গিয়ে আমি হয়ে গিয়েছি না ঘরকা না ঘাটকা।
জামাত-শিবির-ছাত্রী সংস্থার সাথে এক চিমটিও
সম্পর্ক রাখিনি সে না হয় হলো। কিন্তু বাইরের দুনিয়ায় পা রেখে দেখি, সে কী! বাইরের
দুনিয়ায় আব্বুদেরকে নিয়ে এ যে চরম মিথ্যার বেসাতী
সাঁজিয়ে বসেছে বাংলাদেশ! সামু ব্লগে গোলাম আযম নানু, নিজামী নানু, মীর
কাশেম আলী আংকল, মোল্লা আংকল আর কামরুজ্জামান চাচাদেরকে
নিয়ে যে অজস্র মিথ্যা আর হাজার হাজার বানানো অপবাদ
দেখতে হচ্ছিলো প্রতিদিন, আমি তখন না পারি সইতে, না পারি কইতে! জামাত-শিবির-ছাত্রী সংস্থার কোনো সম্পর্ক আমি রাখবো না, তাই
তাদেরকে ডীফেন্ডও করতে পারিনা, আবার তাদেরকে নিয়ে এত এত কোটি কোটি মিথ্যা সহ্য করাও অসম্ভব! আর না
পারতে একদিন যখন কামরুজ্জামান চাচার উপর হামলা হলো, আমি পোষ্ট দিয়েছিলাম ‘কুকুরের কাজ কুকুরে করেছে, কামড় দিয়েছে পায়’; ব্যাস, ভার্চূয়ালি আমাকেও সামু ব্লগে যেনো ফাঁসিতে
ঝুলিয়ে দেয় পারলে! এত মিথ্যার আর এত বিশ্রী মন মানসিকতা এই চেতনাধারীদের ব্লগে আর থাকিনি এরপর। সামূ ব্লগ ছেড়ে দিয়েছিলাম যখন ঐ ব্লগের আওয়ামী
লীগের পা চাটা এডমিনরা আমার পোষ্ট ব্যান করা শুরু করলো। এখানেই হলো আয়রনি। যে পরিচয় আমি লুকিয়ে রাখতে চেয়েছি সবসময় নিজের পরিচয়ে পরিচিত হবো বলে, সেই মানুষগুলোকেই ডিফেন্ড করতে হচ্ছিলো আমাকে
বাধ্য হয়ে। কারন মিথ্যার লোড নেয়ারও তো একটা সীমা আছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে কেউ যদি
তাকায়, সে
ইজিলি দেখবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামু ব্লগ যে গ্রুমিং করেছে, যে প্লাটফর্ম তৈরী
করেছে, সাধারন মানুষকে যেভাবে মিথ্যা বুঝিয়েছে, যেভাবে একের পর এক বানানো
গল্প লিখে লিখে জামাত শিবিরকে ট্যাগ করেছে, সেই ছিলো
শাহবাগী আন্দোলনের প্রেগনেন্সির সময়কাল। এই সামু ব্লগের পেটেই প্রথম ফ্যাসিষ্ট শাহবাগী
সময়ের বীর্য বুনানো হয়েছিলো। আয়রনী কী জানেন? আয়রনি হলো- সেই শাহবাগীরাই এখন তাদের জন্ম দেয়া
ফ্রাংকেন্টস্টাইনের হাতে গুম হচ্ছে। এর হাত থেকে পালাচ্ছে
বিদেশে বিদেশে। আমি কখনো ভাবিনি এত শর্ট টাইমের ভিতর ইতিহাস আমাদেরকে এই আয়রনির উইটনেস বানাবে!
যেই শাহবাগীরা উম্মাদের মত নাগিন সুর বাঁজিয়ে
বাংলাদেশের মানুষের ইমোশনকে পুঁজি করে, সেনসিটিভিটিকে
পুঁজি করে, একাত্তুরের কষ্ট আর ব্যাথাকে পুঁজি করে গণ জাগরন মঞ্চ সাঁজিয়ে একে একে ফাঁসি দিয়েছে নিজামী
নানু, মীর কাশেম আলী আংকল, কামরুজ্জামান
আংকল, মোল্লা আংকল, কামরুজ্জামান
চাচাদের মত দূর্লভ রকমের নেতাদেরকে, জেলের ভিতরে মরে যেতে বাধ্য করেছে গোলাম আযম নানুর মত মানুষকে, যে মানুষরা ইতিহাসে দুইবার জন্ম নেয় না; সেই শাহবাগীরাই এখন নিজেরাই আওয়ামী ফ্যাসিজমের
ভিক্টিম! ইতিহাসের কী অদ্ভুত লীলাখেলা!
সামু ব্লগ ছেড়ে দিয়ে ফেইসবুকে লেখালেখি শুরু
করলেও, তারপরও
আব্বুর পরিচয় কখনো দেইনি। কেউ
জিজ্ঞেস করলে চুপ থেকেছি। উত্তর দেইনি। কারন শাহবাগী আওয়ামী পা চাটা দালালেরা
বাংলাদেশের একাত্তুরের ইতিহাসের যে চরম বিকৃতি ঘটিয়েছে, বইয়ে লেখায় সাহিত্যে কথায় গল্পে বক্তৃতায়, সবজায়গায়,
আব্বুর পরিচয় দেয়ার অর্থই ছিলো সেই ইতিহাসকে
ক্লারিফাই করার দায় নিজের ঘাড়ে টেনে নেয়া! তারপরও তাও
হয়তো নিতাম। নিতে যাচ্ছিলামও। কিন্তু যেদিন শাহবাগী দালাল নির্ঝর না কী যেন
নাম ফালতু লোকটা একটা পোষ্টে কীভাবে মোল্লা আংকলকে নিয়ে মিথ্যা লিখেছে তা হাতে নাতে প্রমান দিয়ে পোষ্ট দিয়েছি, ফেইসবুকে আমার পরিচয় কখনোই প্রকাশ না করার পরও
তারপরদিনই আমাদের বাসায় রমনা থানা থেকে স্পেশাল ফোর্স এসে
হাজির! তারা সোওজা আব্বুর রুমে গিয়ে ঢুকলো। বার বার ভালভাবে চেক করলো এটলিষ্ট আব্বু অন্ততঃ বসতে পারে কিনা হুইল চেয়ারে! যদি অন্ততঃ বসতেও পারতো, তাহলে তখনই তারা আব্বুকে ধরে নিয়ে যেতো। এই স্পেশাল ফোর্স প্রায়ই সাত/আট সপ্তাহ পর পর, কখনো মাসে/দুইমাসে আসতো বাসায়। কিন্তু আল্লাহ’র কী
ইচ্ছা, আব্বু যেহেতু ঘাড়ের নীচ থেকে অলমোষ্ট পুরোটাই প্যারালাইজড, আব্বুকে ধরে
নিয়ে যেতে চাইলেও তারা নিতে পারছিলো না। সারা শরীর
প্যারালাইজড মানুষকে তারা ফাঁসি দিবে কীভাবে?! তখনই
নতুন করে বুঝেছিলাম, আমি একদিকে যেমন অসম্ভব সৌভাগ্যবান আব্বুম্মুর সন্তান হতে পেরেছি তাই, এই
পরিচয়ই আমার জন্য অভিশাপ কারন বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে
আমি একটা লাইন লেখা মানে সে লাইনের লাষ্ট মাথায় আমার আব্বুর
ফাঁসির দঁড়ি! আমি এদিকে লিখবো আর ওদিকে স্পেশাল ফোর্স তৈরী আব্বুকে নিয়ে যেতে। আমি যে
আদতে একজন ভীরু আর কাপুরুষ মানুষ তা এর আগেও অনেকবার
লিখেছি। আমার জন্য আব্বুর গায়ে একটা টোকাও পড়বে তা সহ্য
করার সাহস আমার নেই। ব্যাস, আমি রাজনীতি নিয়ে লিখা বন্ধ
করে দিলাম। আমার মত রাজনীতি
সচেতন নাগরিকের জন্য তা সহজ ছিলো না। বিশেষ করে মীর
কাশেম আলী আংকল আর কামরুজ্জামান আংকল’র যেদিন যেদিন ফাঁসি হলো, আমার মনে হচ্ছিলো
ভার্চূয়ালি আমার হাতে পায়ে যে শেকল পড়ানো, এই শেকল আর বইবার শক্তি নেই আমার। একেক সময় মনে
হচ্ছিলো লিখতে না পারার যন্ত্রনায় ল্যাপটপটা ছুঁড়ে ফেলে
ভেংগে ফেলি। একেক সময় মনে হচ্ছিলো চিৎকার করে বাংলাদেশের মানূষদেরকে বলি, কী ভুল
করছেন আপনারা!! হায়! যদি বুঝতেন! এই মানুষগুলোকে
রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় এই যে খুন করছেন, এদেরকে যে আর
পাবেন না! এরা যে ইতিহাসের সোনালী সন্তান! বাংলাদেশের
সৌভাগ্য যে এরা বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছে! আর আপনারা একী
ভুল করছেন!!
মীর কাশেম আলী আংকল ছিলেন শিবিরের প্রথম
সেন্ট্রাল সভাপতি। কামরুজ্জামান আঙ্কল ছিলেন দ্বিতীয় সভাপতি। আর আব্বু তৃতীয়। আব্বু ছাড়া বাকী দুইজনেরই ফাঁসি দিয়েছে এই
ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী সরকার। সম্পূর্ণ অন্যায় অপবাদ দিয়ে। সম্পূর্ণভাবে
ইতিহাসকে পুরোপুরি বিকৃত করে। সম্পূর্নভাবে এদের চরিত্র হনন করে। এদের ফলস আইডেন্টিটি বানিয়ে। সেসব কথা এখন
লিখতে গেলে আমার এই লেখা হবে না, আলাদা করে বই লিখতে বসতে হবে!
আমি আগেও বলেছি, এই যে পরিবারগুলোর সন্তানেরা, বিশেষ করে গোলাম আযম নানু, নিজামী নানু, মীর কাশেম আলী আংকল, কামরুজ্জামান চাচা, মোল্লা আংকল, এই পরিবারগুলোর সন্তানেরা, যে যেখানেই আছে
তাদের খুব করে দরকার তাদের বাবাদেরকে নিয়ে লেখালেখি
করা। তাদের বাবাদের জীবনকে বাংলাদেশের মানুষের
সামনে তুলে ধরা। হ্যা, তাদের
ফাঁসি হয়ে গিয়েছে ঠিক, কিন্তু
ঠিক ইতিহাসটাকে বাংলাদেশের মানুষের সামনে নিয়ে আসার
দায়িত্ব, বাংলাদেশের ইতিহাসকে ইতিহাসের ঠিক জায়গায় নিয়ে আসার দায়িত্ব এই সত্নানদের ঘাড়ের উপর সবচে’ বেশী। কারন বাংলাদেশের মানুষকে শাহবাগ চিনিয়েছে
এরা মনষ্টার! বাংলাদেশের মানূষকে শাহবাগ বুঝিয়েছে এরাই
বাংলাদেশের শত্রু! তাই ছোট ছোট বাচ্চারাও প্ল্যাকার্ড
নিয়ে রাত জেগেছে এই মানুষগুলোকে ফাঁসি দেয়ার দাবীতে! জবাই করার দাবীতে! আমি প্রতিটা মুহুর্ত পারলে নিজের
আংগুল নিজে চিবিয়ে খেতে বাকী রেখেছি, একটা দেশ কীভাবে ম্যানিপুলেটেড হয়! কীভাবে হিংস্র জংলীদের মত রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় বর্বর হয়ে উঠে সভ্য আইন কানুনকে কলা দেখিয়ে মব-লিঞ্চিং’র উন্মাদনায় উম্মাদ হয়ে
উঠে- তা দেখতে দেখতে একেক সময় মনে হয়েছে, জীবনে এরচে’ বড় ট্রাজেডী বুঝি আর নেই!
যে জামাত শিবিরকে উঠতে বসতে সমালোচনা করি, ন্যায্য সমালোচনা করি, এখনো করি, এখনো আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি জামাত শিবির বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশের বিশেষ করে
মেয়েদের কপালে খারাবী আছে; কারন
ধর্ম আর ক্ষমতার মধ্যে কী ধরনের সম্পর্ক এবং তা সিটিজেনদেরর জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কীভাবে প্রভাব ফেলবে- এর স্পষ্ট উত্তর জামাত-শিবিরের
নিজের কাছেই স্পষ্ট না; কিন্তু
তার মানে এই না যে জামাত-শিবির বাংলাদেশের খলনায়ক! কারন আমার মনে হয় না জামাত-শিবির কখনো
বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসার মত সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। অন্ততঃ নিকট ভবিষ্যতে তো নাই। এখনতো আরো না। কারন জামাত
শিবিরের সবচে বড় সম্পদ ছিলো যে কয়েকটা মানুষ, যে কয়েকজন ঐতিহাসিক নেতা, আওয়ামী লীগের মেইন
মদদদাতা যে ইন্ডিয়ার র’, তারা
খুব ভাল করেই জানতো, বাংলাদেশে যদি ইন্ডিয়ার আধিপত্য
বিস্তারে সত্যিকার কোনো থ্রেট থাকে, সেই থ্রেটস হচ্ছে এই কয়েকজন নেতা। তাই তারা
ঢাকার পরিবাগে র’ এর স্পেশাল রেষ্ট্রিক্টেড অফিস খুলে বসে, সেই অফিস থেকে পুরো বাংলাদেশে আস্তে আস্তে শাহবাগীদের হাত দিয়ে নাটক সাজিয়ে, একের পর এক প্ল্যান করে করে, ফাঁসি দিয়ে দিয়েছে এই মানুষগুলোকে। এটা বাংলাদেশের ট্রাজেডী। আমি জানিনা বাংলাদেশ
কখনো কোনোদিন এই ভুল শোধরাতে পারবে কিনা।
গোলাম আযম নানু চাইলেই খুব সহজেই ইতিহাসের আরো
অনেক বড় বড়
নেতাদের মত বিদেশে এক্সাইলে থেকে অনেক বড় স্কলার হিসেবে ইন্টারন্যাশনালি মুসলিম উম্মাহ’র খেদমত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি
করেননি। জীবনের রিষ্ক নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। খুব ভাল
করেই জানতেন এই দেশ তাকে খুন করবে। হয়েছেও তাই। কিন্তু জেনে শুনেও দেশে থেকেই ইসলামকে যেভাবে বুঝেছেন সেভাবে খেদমত করতে চেয়েছেন তিনি। তার
পরিণতিতে আজকে তার নিজের খুনের পাশাপাশি তার বড়ছেলে
বিগ্রেডিয়ার আব্দুল্লাহি আযমী আংকলও গুম! নিজামী নানুকেউ জীবনে কোনোদিন আব্বুর মত সাদা পাঞ্জাবী
পায়জামা ছাড়া অন্য কিছু পড়া দেখিনি। আব্বুর সাথে নিজামী নানুর পার্থক্য ছিলো আব্বু সাদা গোল সুতার টুপি পড়তেন সবসময়, আর
নিজামী নানু টার্কিশদের স্টাইলের টুপি পড়তেন। ব্যাস, বাকী সেই একই সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা! উনাদের
সবার মধ্যে আমার ব্যক্তিগতভাবে সবচে’ প্রিয় ছিলেন মীর
কাশেম আলী আংকল। আংকল’র গলার স্বর
অনেক ভরাট ছিলো। খুব ভারী পার্সোনাটিলি ছিলো। কিন্তু একই সাথে খুব ফান-প্রিয়। হাসিখুশী উচ্ছ্বল। ইন্ডিয়ার র’এর স্পেশাল
টার্গেট ছিলো মীর কাশেম আলী আংকল। কারন কোনো দেশে কোনো
মানুষ একলাই যদি কোনো নিরব বিপ্লব ঘটাতে পারে, তা
একমাত্র সম্ভব ছিলো মীর কাশেম আলী আংকল’র পক্ষে। জামাত শিবিরের হাজার হাজার, এক ফোঁটা বাড়িয়ে বলছি না, হাজার হাজার পরিবারকে ফাইনানশিয়ালি দাঁড় করিয়ে
দিয়েছেন উনি। এবং সবচে’ আশ্চর্য্যের ব্যপার হলো
কোনো বেআইনি পথে উনি তা করেননি! ন্যায় এবং সততার প্রশ্নে
বাকী সবার মত উনিও ছিলেন একদম আলিফের মত সোজা। কিন্তু
উনার প্র্যাগমেটিজম, উনার
দূরদর্শিতা এবং উনার সোশাল বিপ্লব ঘটানোর জন্য যে কারিশমা আর ইন্টেলিজেন্ট’র দরকার, তা, এইসব মিলে উনি ছিলেন ইন্ডীয়ার জন্য স্পেশাল থ্রেট। তাই ফাঁসিতে ঝুলানো
হয়েছে উনাকেও।
একবার আমি যখন হসপিটালে, কামরুজ্জামান চাচাকে তখনো গ্রেফতার করা হয়নি, চাচা দেখতে গেলেন আমাকে।
আমি অসম্ভব অবাক হয়েছিলাম! কারন চাচাদের কাছে, আব্বুর ঐ
কলিগদের সার্কেলে আমি হলাম হাজীর ঘরে পাজী! অনেকে তো
নূহ আঃ এর অভিশপ্ত ছেলের সাথেও আমাকে তুলনা করতে বাদ
রাখেননি! এখনো রাখেন না! তো আমি সত্যি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম! কিন্তু চাচা যে মমতা নিয়ে হসপিটালের কেবিনের দরজার ওপাশ
থেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘আম্মু
তুমি এখন কেমন আছো?’, আমার এখনো মনে পড়তেই শরীরের লোম
সব দাঁড়িয়ে যাচ্ছে! চাচার মত মানূষকে এই শাহবাগীরা যে বিশ্রী বিশ্রী আর যে চরম মিথ্যা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ফাঁসি
দিয়েছে, ভাবতেই নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাই। একটা লাইন প্রতিবাদ করতে পারিনি চাচার জন্য ওরা আব্বুকেও ধরে নিয়ে যাবে এই ভয়ে! মোল্লা আংকলকে আমি কাছ থেকে তেমন জানিনা। কারন যে সময়টাতে আসলে আমার উনাদেরকে আরো কাছ থেকে দেখার কথা, জানার কথা, ঐ সময়টাতেই আমি সংগঠন ছেড়েছি। জামাত-শিবির-ছাত্রীসংস্থার বড় শত্রুতে পরিণত হয়েছি। আমাকে দেখলে
ছাত্রী সংস্থার আপুরা সালাম পর্যন্ত দিতো না! যেন কাফির
হয়ে গিয়েছি এমন একটা অবস্থা! কিন্তু আম্মুর কাছে মোল্লা আংকল’র কথা সবসময় শুনতাম। কে যেন বলেছিলো
মোল্লা আংকল ব্যক্তিগত জীবনে সাধাসিধা চলনে অনেকটাই
আব্বুর মত। আব্বুর যেসব ঘটনা আমি এর আগেও অনেকবার
লিখেছি, বলেছি, গোলাম আযম
নানু, নিজামী নানু, মীর
কাশেম আলী আংকল, কামরুজ্জামান চাচা, মোল্লা আংকল এরা সবাই এই ধরনেরই মানুষ ছিলেন
বিভিন্ন দিক থেকে।
একাত্তুরে উনাদের ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে
কেনো উনারা
শুরুর দিকে পাকিস্তানের সাপোর্টার ছিলেন। মজার কথা হচ্ছে, কেউ যদি ইতিহাসের ই-টাও সত্যী জানে, আপনাদের বাবা-মা’র জেনারেশনের কয়েকজন মানুষকে
জিজ্ঞেস করলেই জানবেন, শুরুর দিকে বাংলাদেশের এক তৃতিয়াংশেরও বেশী মানুষ পাকিস্তানের সাথে “সংগ্রাম”র বিপক্ষে ছিলো। যে মূল ধর্মীয় কারনে ইন্ডিয়া পাকিস্তান আলাদা হয়েছিলো, বাংলাদেশের
সংখ্যাগরিষ্ঠ বেশীরভাগ মুসলিম জনসাধারন সেই পাকিস্তান
থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার চেষ্টায় রাজী ছিলো না। কিন্তু
শাহবাগীরা এই ইতিহাসকে এমনভাবে বিকৃত করেছে, এখন এই ইতিহাস পুরাই ক্লোজড ইতিহাস! সত্যি এখন অবিশ্বাস্য
শোনায়! কিন্তু জামাত-শিবিরের রাজনৈতিক ভুল হয়েছিলো পঁচিশে মার্চের পর। ঢাকার এমন গণহত্যার পর
জুলুমকারীদেরকে তখনো সাপোর্ট করে গিয়ে মজলুমদের বদদোয়ার
লিষ্টে নাম লিখিয়েছিলো জামাত। কিন্তু আমরা যে ‘রাজাকার’ আর ‘আলবদর’ চিনি গণহারে, এই যে মানুষগুলোকে ফাঁসি দেয়া হলো, এদেরকে যদি আপনি সেইসব রাজাকার আর
আলবদর মনে করেন যারা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ধরিয়ে দিয়েছিলো, তাহলে আপনি ইতিহাসের কিছুই জানেন না। এই
মানুষগুলো উলটো ব্যক্তিগতভাবে অনেককেই পাকিস্তানী
সৈন্যদের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেকে মৃত্যুর মুখ
পর্যন্ত ঠেলে দিয়েছিলো। এরা বাংলাদেশের একাত্তুরের ডিসকোর্সে যে সাধারন রাজাকার আর আলবদরদের কাহিনী শোনা যায়, তাদের মধ্যে ছিলেন না। কিন্তু শাহবাগ ইতিহাস পরিবর্তন করতে করতে, করতে করতে, করতে করতে এই মানুষগুলোকে এমনভাবে বাংলাদেশের সামনে পোট্রে করেছে, যেনো এরাই একমাত্র রাজাকার আর আলবদর! অথচ আসল
রাজাকার আর আলবদর ছিলো শেখ হাসিনার বেয়াইদের মত মানুষেরা। কিন্তু সে কথা কে কাকে বুঝাবে!
আব্বুর মৃত্যুতে আমার আফসোস নেই এক ফোঁটা। আমি
মুসলিম হিসেবে
বিশ্বাস করি প্রতিটা মানুষ ঠিক তার যখন মৃত্যু লেখা, তখনই
মারা যাবে। আব্বুর মৃত্যু রমজানের এই পনের দিনের দিনই লেখা ছিলো। আলহামদুলিলাহ আব্বু এখন আল্লাহ’র কাছে। কিন্তু আমার আফসোস আব্বু এবং আব্বুর মত
এই যে কয়েকজন
মানুষকে বাংলাদেশ পেয়েছিলো, বাংলাদেশ তার যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পারেনি। এই মানুষগুলো ছিলো বাংলাদেশের সোনালী মানুষ। এই মানুষগুলোর জীবন
ছিলো বাংলাদেশ না শুধু, বর্তমান
পৃথিবীতে অসম্ভব রেয়ার, চরম দূর্লভ সৎ নেতাদের গল্পের
জীবন। এই শনিবার আব্বুর মৃত্যূর ভিতর দিয়ে এই অধ্যায় চিরদিনের জন্য ক্লোজড হয়ে গেলো। বারো বছর বিছানায় প্যারালাইজড থাকার পর আল্লাহ ডেকে নিলেন আব্বুকে। আমি আর আমার ভাইবোনরা এতিম হলাম। সেই সাথে এতিম হলো বাংলাদেশ।
আব্বুকে নিয়ে অনেক কিছু লেখার ছিলো। কিন্তু কী
ফেলে কী লিখি! শুধু লাষ্টে একটা কথা বলি, আব্বু আব্বুর মত মানুষ হয়ে উঠার পিছনে যদি কোনো
কারনকে সিংগল আউট করতে বলা হয় আমাকে, আমি বলবো,
‘আম্মু’। আম্মু আব্বুর বউ হয়েছিলেন বলেই আব্বুর পক্ষে
আব্বুর মত মানুষ হওয়া সম্ভব হয়েছিলো।
আব্বুর সাথে আমার না যতটা যুদ্ধ ছিলো, তারচে’ হাজারগুন বেশী যুদ্ধ ছিলো আম্মুর সাথে।
এখনো যুদ্ধ হয়। কিন্তু এখন যুদ্ধ এক পক্ষের। আম্মু বলে
যায়, আমি শুনে যাই। আর আব্বুর মতে করে বলি, হুম! ঠিক আছে! আচ্ছা! ওকে! ঠিক আছে আম্মু!
আচ্ছা আম্মু! হ্যা, শুনতেছি আম্মু! আচ্ছা! ওকে! আম্মুর চাওয়া একটাই। আমি কোরান নিয়ে গবেষনা
করি। এই চাওয়া আমার জন্য ব্যক্তি
আমি হিসেবে পূরন করা অসম্ভব। কারন গবেষনা দূরের কথা, কোরান
পড়ার জণ্য যে নূন্যতম যোগ্যতা, সে যোগ্যতাও যোগাড় করতে পারিনি এতবছর পড়ালেখা করে! কিন্তু সে কথা আম্মুকে কেমনে বুঝাই! একসময় এই চাওয়ার কারনে আম্মুকে শত্রু ভাবতাম। এখন বুঝি, আব্বু যতটা না মানুষ হিসেবে দূর্লভ, আম্মুর তারচেও আরো বেশী দূর্লভ। আমার দাদা আব্বুকে ঠিকই বলেছিলেন,
"আবু তাহের, এই মেয়ে আরো একশ বছর
আগে জন্মানোর কথা। কিন্তু আল্লাহ তোমার সাথে তাকে বিয়ে
দিবে বলেই এই মেয়ে একশ বছর পরে জন্মেছে”।رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
©Farjana
Mahbuba
অধ্যক্ষ
আবু তাহের ভাইঃ আমার জীবনে পাওয়া সেরা
জান্নাতি উপহারঃ ড. মুহাম্মদ আব্দুস সালাম আযাদী
(প্রাক্তণ
শিক্ষকঃ চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়)
১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র শিবিরের
প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে একটা বক্তৃতা শুনে থমকে দাঁড়াই। সাধারণতঃ চিৎকার করে যে সব
বক্তৃতা গুলো তখন শুনতাম, তাতে আবেগ থাকতো
বেশি। রক্ত উছলে উঠতো। হাত মুষ্টিবদ্ধ হতো, মুখে না’রাহ ধ্বনি উচ্চকিত হতো। এগুলোকে বলা
চলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবীয় নির্ঘোষ, অথবা শায়খ আব্দুল হামিদ কিশকের উন্মাতালকরা ওয়াজ। এই দুইটার কোনটাই আমার
ছোট বেলা থেকে পছন্দ নয়।
১৯৮৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারিতে
প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর এই ধরণের বক্তৃতা আমাকে শুনতেই হচ্ছিলো। অধ্যক্ষ আবু তাহরের
নাম হতেই মাথায় টুপি পরা ছিপছিপে খুব সাদামাঠা একজন ভাইয়ের নাম বলা হলো। পরিচয়ে
বলা হলো প্রাক্তন সেন্ট্রাল প্রেসিডেন্ট। তিনিও তার আলোচনায় ‘গতে’ থাকার কোশেশ করলেন, আলোচনায় তর্জন গর্জন করলেন, তর্জনীর ব্যবহার করলেন। কিন্তু
আলোচনা সবটাই করলেন ইসলামের সম্মোহনী দলীলের ভিত্তিতে। কুরআনের আয়াত পড়লেন, ব্যাখ্যা দিলেন। হাদীসের প্রসঙ্গ
আনলেন। নবী (সা) এর জীবনের সাথে আন্দোলনের রিলেট করলেন। ইরশাদ শাহীর মুন্ডপাতের
চেয়ে তার ক্ষমতা দেশের অভ্যন্তর ও বাইরের জগতে বাংলাদেশের কি কি ক্ষতি নিয়ে এসেছে
তার বর্ণনা দিলেন। আমি জ্ঞানের কিছু পেলাম, শেখার কিছু নিলাম, এবং অন্তরে কিসের একটা ছোঁয়া অনুভব
করলাম।
আমি ছাত্র শিবিরের সাথে
যুক্ত হবো কিনা এই ব্যাপারে পরামর্শ নেই আমার বড় চাচা ডঃ প্রফেসর ইয়াহইয়া আর
রাহমানের কাছে। তিনি তার পরামর্শে কখনো ডিসাইসিভ কিছু বলেন না। তিনি বললেন, ইস্তেখারা করো। তবে ওদের একজন খুব
ভালো নেতা আছেন। চিটাগাংএর আবু তাহের। আমি বললাম, কিভাবে জানেন? চাচাজান বললেন, আমি তখন ঢাকার তারা মসজিদের ইমাম ও
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এক ভাই আমাকে বললেন, আমাদের কেন্দ্রীয় সভাপতি আবু তাহের
আপনাকে দেখা করতে বলেছেন। আমি গেলাম। তিনি বললেন, ইয়াহইয়া ভাই, আমি চেষ্টা করছিলাম দুনিয়ার
প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে আমাদের দেশের ছাত্রদের পাঠায়ে ভালো শিক্ষিত করে নিয়ে
আসি। আমি দেশের ভালো ছাত্রদের খবর নিয়ে দেখলাম, আপনি একজন সম্ভাবনাময় ছাত্র। আপনি
আপনার কাগজ পত্র গুলো নিয়ে আসুন আমি সাঊদী আরব সহ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায়ে দেই।
চাচাজান, বলেছেন, আমি তাজ্জব হলাম। ভালো সুযোগ নিতে
সাতক্ষীরার এলাকার ছাত্ররা কারো নজরে পড়বে ভাবতাম না। দেখলাম এই একমাত্র ছাত্র
নেতা যার নজরে কোন মলিনতা নেই, এবং অন্তরে কোন এলাকাপূজা নেই। যদিও আমি বাইরে যাবার ব্যাপারে চিন্তা
করিনি বলে তার ডাকে সাড়া দেইনি। তবু তার ব্যবহারে আমি আজো আপ্লুত। আমি এই গল্পে
বুঝলাম ছাত্র শিবিরের এই একজন নেতাকে তিনি অনেক শ্রদ্ধার সাথে মনে রেখেছেন।
১৯৯১ সালে আমি রিয়াদ
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। ঐ বছর একটা বড় ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস বাংলাদেশের দক্ষিন
পূর্বাঞ্চল লন্ড ভন্ড করে দেয়ে। চিটাগাং এর আনোয়ারা হয়ে যায় একদম শেষ। সেই
দূর্যোগে অধ্যক্ষ আবু তাহেরের পরিবার মারত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ক্ষতি
পুষিয়ে নেয়ার জন্য তিনি সাঊদির সাহায্যের ব্যাপারে উদ্গ্রীব হন। ঐ বছরেই আমার সাথে
তার পরিচয় হয়, এবং আল্লাহর কসম, এই দূর্যোগে তার যে এতো বড় ক্ষতি হয়েছে, তা আমাদের বুঝাতেও দেননি। নিজের
দিকে না তাকিয়ে অন্য মানুষের খিদমতে রাতদিন খেটেছেন তিনি। আমার চোখে তাকে তিনি
অনেক বড় হয়ে আছেন সেই থেকেই।
১৯৯৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল
ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে আমি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই। যোগ দেয়ার এক মাসের মাথায় আমার
মুহাব্বাতের দাওয়াত আসে প্রিন্সিপ্যাল আবু তাহেরের অফিসে। আমি যাই। তার অফিসে দিকে
আমার পা, দেখি কী এক স্বর্গীয় হাসি নিয়ে তিনি মসজিদের দোতলায় দাঁড়িয়ে আমার অপেক্ষা
করছেন। আমাকে নিয়ে গেলেন অফিসে। চিটাগাঙের ঐতিহ্যবাহী বেলা বিস্কুটের সাথে দেশি
চায়ের কাপ সামনে নিয়ে নিজেই হাতে ধরিয়ে দিলেন। এর পরে বসলেন আমীরের চেয়ারে। অনেক
কথা হলো। আমার সংসারের গভীরে গেলেন, আমার ওয়াইফের মা মরার ঘটনা জানতে চাইলেন, আমাদের ইনকামের সোর্স জানতে চাইলেন।
পি এইচডি কবে করবো, কিভাবে করবো তার প্লান জানতে চাইলেন। তার নাকি ধর্মীয় ও ইলমি ব্যাপারে
আমা্কে সাহায্য করতে হবে জানালেন। তাই তার পাশে দাঁড়ায়ে তাকে কোন কোন ক্ষেত্রে আমি
সাহায্য করতে পারবো তার ব্যাপারে জানতে চাইলেন। আমাকে বিদায় দেয়ার সময় রিক্সা ভাড়া
এগিয়ে দিলেন। আমি এক অনাস্বাদিতপূর্ব ইসলামি নেতার পরিচয় পেলাম। জামাআতে ইসলামির
মধ্যে এমন বিনয়ী, সহজ সরল ও ইলম পাগল মানুষ থাকে দেখে অভিভূত হলাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি
বিভিন্ন পর্যায়ে দ্বায়িত্বশীল ছিলেন। ফলে নানান দিকে তার সাথে মিশে গেলাম। ভাবী
ফাজিলা তাহেরের সাথে আমার স্ত্রীর সুন্দর সম্পর্কে আরো কাছে এলাম। তার ছেলে
মেয়েদের শিক্ষক হওয়ায় সম্পর্কটা মুরুব্বিয়ানায় যেয়ে পৌঁছায়। নানা ব্যপারে তার সাথে
দেখা হওয়া জরুরি হয়ে যেতে লাগলো। এবং আমি মনে করা করা শুরু করলাম, চিটাগাংএ আমার যারা আত্মার আত্মীয়, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। ছেলে
ফারুক কোথায় যেতো তার হিসেব দিতে হত। কিন্তু আমার বাসায় ঘন্টার পর ঘন্টা কাটালেও
তিনি খুশি হতেন।
একবার পারিবারিক এই জটিলতায়
কি সিদ্ধান্ত নিবেন তার জন্য আমাকে ও আমার বন্ধু শায়খ আব্দুর রহমান মাদানীকে তিনি
দাওয়াত দিলেন বাসায়। জামাআতে ইসলামির নেতাদের বাসায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার নেই
বললেই চলে। তিনিই হলেন দ্বিতীয় নেতা যার বাসায় আমি দাওয়াত খেতে যাই। আমরা দুইজন
গেলাম। ভেতরে ঢুকলাম। যেখানে বসলাম, সে সব আসবাব পত্র দেখলাম-তা দেখে আমার অন্তর হু হু করে উঠলো। একি দৈন্য দশা?! আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
ভাড়া করা ফ্লাটে থাকি। সোফাটা চিটগাংএর সেরা সেগুনকাঠের। বইএর আলমিরা অনেক দামের
সেগুনের জ্বলজ্বলে পলিশ। কিন্তু উনার বাসায় যা দেখলাম তা অসলেই ইসলামের ইতিহাসের
প্রথম দিককার সালফে সালেহীনের জীবনে থাকতো বলে পড়েছি। আমি খাওয়া দাওয়া করলাম।
ভাবীর হাতের রান্নায় যৌগিকতা ছিলো। চিটাগাং ও ঢাকাইয়া রান্নার কম্বিনেশান ছিলো।
এরপর যে সমস্যাটার কথা শুনলাম তা শুনে হাসি এলো। তিনি ফারজানার লেখাপড়া নিয়ে
চিন্তা করছেন। ভাবী চান ছেলে
মেয়েগুলোকে দীনের দাঈ ইলাল্লাহ বানাবেন। ভাই চান ছেলে মেয়েদের প্রতিভা ও মেধার
সাথে তাদের ইচ্ছার স্বাধীনতা দেবেন। সব শুনে আমি ভাবীর পক্ষে মত দিলাম, মাদানী সাহেব ভায়ের কথাটাকে
প্রাধান্য দিলেন। আমরা চলে এলাম। এবং তার বিনয়, সারল্য ও দীনী মেজাজ দেখে মন ভরে
দুয়া করে এলাম।
চিটাগাংএ জামাআতে ইসলামের
একটা বড় অনন্যতা আমার চোখে পড়েছে। তা হলো সেখানে উলামায়ে কিরামের সাথে জামাআতের
উলামায়ে কিরামের সদ্ভাব। এটা আমি আর কোথাও দেখিনি। আমরা আই আই ইউ সির শিক্ষক। এটা
জেনেও আমাদের পটিয়াতে আমন্ত্রণ জানানো হতো। হাটহাজারীতে যাইতে চাইলে শায়খ আহমাদ
শফী হাফিযাহুল্লাহ আমাদের বুকে টেনে নিতেন। দারুল মাআরিফের শায়খ সুলতান যাওকের
নয়নমনি ছিলাম আমরা। লালখান মাদ্রাসাকে আমরা নিজেদেরই মনে করতাম। তারাও আমাদের
প্রিয়তা দিতেন। আর বায়তুশ শরফের পীরের দরবার ছিলো আমাদের নিত্যদিনের পছন্দের
যায়গা। এই সবের পেছনে ছিলো মাওলানা আবু তাহের সাহেবের উদার বুকের বিস্তীর্ণ জমিন।
ক’বছর আগে আস্ট্রেলিয়ায় যাই এক
প্রোগ্রামে গেস্ট হয়ে। আমার হোস্টগণকে বললাম, আমার সারা প্রোগ্রাম আপনাদের ইচ্ছে
মত সাজান, তবে ডঃ ফারুক আমীনের সাথে আমার একটা রাত কাটাবার ব্যবস্থা করবেন। ফারুকের
বাসা থেকে কথা হলো মারাত্মক অসুস্থ অধ্যক্ষ আবু তাহের ভায়ের সাথে। তিনি আমার অনেক
কথা জানতে চাইলেন। ইসলামি শিক্ষার জন্য কিছু করছি কিনা তারও খোঁজ নিলেন। আই আই ইউ
সিতে আবার ফিরবো কিনা তার জন্য সকাতর আবেদন জানালেন। এবং বললেন, ফারুকের ঐখানে যখন গেছেন, ফারজানাকেও দেখে দুয়া দিয়ে আসবেন।
আমিও তার নির্দেশ পালন করে আসি।
অনেকদিন তাহের ভাইএর সাথে
কথা হয়নি। তবে তিনি খুব অসুস্থ তার খবর পেতাম ফারুকের মাধ্যমে। তার জন্য ভাবীর
অনবদ্য কুরবানীর আমাদের জন্য ইতিহাস হয়ে থাকবে।
আজ তিনি আল্লাহর কাছে হাজিরা দিয়েছেন। বাংলাদেশের এমন কোন উপজেলা নেই, ইসলামের সেবায় তার পা যেখানে পড়েনি। আল্লাহর কাছে দুয়া করি বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতিতে ক্ষণজন্মা এই শায়খ কে আল্লাহ যেন ক্ষমা করেন। দীর্ঘ দিনের রোগ ভোগের কারণে আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দিন ও মর্যদা বৃদ্ধি করে দিন। তার শোক সন্তপ্ত পরিবারকে শোক কাটিয়ে ওঠার তাওফীক্ব দিন। ভাবীকে কি বলবো, তিনি আমাদের রৌলমডেল। তিনি হবেন ধৈর্যের পারাকাষ্ঠা এই দুয়া করি। আমার নয়নজোড়া ডঃ ফারুক ও ডঃ ফারজানাকে আল্লাহ সবর দিন।
স্মৃতিতে
মরহুম মাওলানা আবু তাহের... আলী আহমদ মাবরুর
(শহীদ
আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ-এর ছেলে)
গতকাল মাওলানা আবু তাহের চাচা ইন্তেকাল করলেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। একটি প্রজন্মের অবসান ঘটলো। একটি
সোনালী ইতিহাসের
নায়কের প্রস্থান। আমরা তখন মগবাজারে থাকি। আবু তাহের চাচা চট্টগ্রাম মহানগরীর আমীর। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি
সেখানকার দায়িত্বে। নিজামী চাচা আমীর হওয়ার পর নতুন সেটাপে তিনি কেন্দ্রের সহকারী
সেক্রেটারী জেনারেলের দায়িত্ব পান। আমি মগবাজারের বেপারি গলি মসজিদে
আব্বাকে বহু সময় নিয়ে তাহের চাচার সাথে কথা বলতে দেখেছি। তৎকালীন সময়ে কাউকে দায়িত্ব দেয়ার
সময় বা অন্য কোথাও থেকে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে এভাবেই অনেকটা সময় নিয়ে পারস্পরিক
বোঝাপোড়া করতে হতো।
পারষ্পরিক নির্ভরতার জায়গাটা
কতটা দৃঢ় ছিল তাও বোঝা যায় সহজেই। আমরা যে বাসাটি ছেড়ে সরকারী বাসায় উঠেছিলাম, এক্সাক্টলি সেই বাসাতেই মাওলানা আবু তাহের চাচা
ভাড়া নিলেন। ঐ একটি বাসাতেই জীবনের এতগুলো বছরও পার করে দিলেন তিনি।
২০০৮ সালের কথা। আব্বা আর
তাহের চাচা মিলে সাংগঠনিক সফরে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে সফরে যাবেন। আমি বিমানবন্দরে তাদেরকে বিদায়
দিতে গিয়েছিলাম।
আব্বা সাবেক মন্ত্রী হিসেবে বিমানবন্দরে ভিআইপি টার্মিনাল ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিলেন। কিছু সময় পর
মাওলানা আবু তাহের চাচাও সেখানে উপস্থিত। তিনি কেমন যেন গড়িমসি করছিলেন। আনইজি ফিল
করছিলেন।
আমি আব্বার পাশে বসা। তাহের
চাচা এসে আব্বাকে বললেন, মুজাহিদ ভাই, আপনি আমাকে এই বিপদে ফেললেন। আমাকে এই দায়িত্ব না দিলেও পারতেন। আব্বা
মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, আপনার এই কথার জরিমানা হিসেবে এই পুরো সফরে আপনি আমার আমীর হবেন। তাহের চাচা আর
কিছু না বলে চুপ হয়ে গেলেন।
মোদ্দা কথা হলো, আব্বা এর আগে দীর্ঘসময় মধ্যপ্রাচ্যের
দেশগুলোর সাংগঠনিক কার্যক্রম তদারকির দায়িত্বে ছিলেন। তাহের চাচা কেন্দ্রে আসায়
তিনি বেশ দায়মুক্ত হলেন। এই সফরটির মাধ্যমে আব্বা তাহের চাচাকে বেশ কয়েকটি দেশে পরিচয়
করিয়ে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বটি তাকে হস্তান্তর করবেন- এমনই কথা ছিল।
কাল থেকে সেই সফরের কথা খুব মনে পড়ছিল। অনেক খুঁজে সেই সফরের কিছু বৈঠকের ছবি পেলাম। একটি ছবি গতকালই শেয়ার করেছিলাম। আজ আরো কিছু ছবিও দিলাম।
মাওলানা আবু তাহের চাচার অনেক বেশি খেদমত আমরা পেতে পারতাম। বিশেষ করে, গত ১০-১২ বছরের কঠিন এই সময়ে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারতেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা, ঢাকায় আসার বছর কয়েকের মধ্যেই তিনি এমনই দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হলেন যে, আর দায়িত্বই পালন করতে পারলেন না। চ্ট্টগ্রামে তিনি একটি ইতিহাস রচনা করেছিলেন। অসংখ্য মানুষের কাছে তার বিষয়ে অনেক গল্প শুনেছি। ইনশাআল্লাহ এই জনপদের ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস একদিন রচিত হবে আর মাওলানা আবু তাহেরের নাম সেখানে সোনালী অক্ষরে লেখা থাকবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার সকল দ্বীনি খেদমত কবুল করে তাকে জান্নাত নসীব করুন। আমিন।
মাওলানা
আবু তাহের একজন সাদাসিধে রাজনীতিবিদঃ মুজিবুর রহমান মনজু
(প্রাক্তণ কেন্দ্রীয়
সভাপতিঃ বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির)
মাওলানা আবু তাহের একজন
সাদাসিধে রাজনীতিবিদ। প্রথম দেখাতেই মনেহবে একজন সিম্পল আলেম। অথচ তিনি
ছিলেন বিশাল মনের মানুষ এবং নেতা। ব্যক্তিগত চিন্তায় বাস্তববাদী ও আধুনিক মনন ধারন করেন। তাঁর সন্তানরাও তাঁর মত
স্পষ্টবাদী চরিত্র পেয়েছে।
তাঁকে নিয়ে তাৎপর্যময়
স্মৃতিবহুল অনেক কিছু আছে লিখার। কিন্তু এখন লিখতে বহু কিছু ভাবতে হয়। কারণ ‘বি টীম’ ট্যাগ আর ‘মুনাফিক’ ‘বিশ্বাসঘাতক’ ট্যাগ এই দুইয়ের মাঝখানে আমাকে পথ
চলতে হচ্ছে। এই মূহুর্তে একটা দারুণ রোমাঞ্চকর সময় পার করছি আমি ও আমার সতীর্থরা।
লিখার, বলার
কিম্বা কিছু প্রকাশ করার পর বুঝতে পারি আমার স্বাধীনতা আমার বন্ধুদের কাছে কতটুকু
স্বীকৃত। আমাদের কী বলা উচিত, কতটুকু বলা উচিত, কীভাবে বলা উচিত বা উচিত নয় সব কিছুর নির্ণায়ক আমার কোন কোন সুহৃদ ও
বন্ধুমহল। এটা অসুস্থ রাজনীতির ফল, যা সারানো সহজ নয়, অত্যান্ত কঠিন। ফ্যাসিবাদ গণভবন
থেকে ক্রমান্বয়ে আমাদের কারও কারও মনের কোঠরে স্থান করে নিয়েছে অজান্তে সংগোপনে!
কুরআনের একটি আয়াতাংশ (সূরা
বাকারা : ১৫৬) ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রা-জিউন’ আল্লাহ তায়ালার একটি নির্দেশনা যার
আগে বলা হয়েছে ক্বালু মানে ‘তারা পড়ে বা তারা বলে’। নাজিলের প্রেক্ষাপট যা তা থেকে
জানতে পারি যে, একজন মুমিন যে কোন ধরনের দূ:খ, মুসিবত সামনে আসলেই আল্লাহ তা পড়তে
বলেছেন— যার
বাংলা অর্থ, “আমরা
আল্লাহর এবং নিশ্চয় আল্লাহর কাছেই ফিরে যাব”। মন দূ:খ ভারাক্রান্ত হলে আল্লাহ
তায়ালা যা পড়তে বলেছেন তা পড়তেও এখন আমাকে অনেক চিন্তা করতে হয়!
মাওলানা আবু তাহের
ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি, জামায়াতের তিনি সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থতার জন্য
বিছানায় শায়িত ছিলেন। গত ঈদ-উল-ফিতরের দিন তাঁকে দেখতে তাঁর মগবাজারের বাসায়
গিয়েছিলাম। তিনি আনন্দে কেঁদে দিয়েছিলেন। মিসেস ফজিলা তাহের ভাবী জানিয়েছিলেন ‘আপনাদের তাহের ভাই এত অসুস্থতার
মাঝেও সবগুলো রোজা রেখেছেন’।
মাওলানা তাহের অনেকের স্মৃতিতে গুমোট অবস্থায় ছিলেন গত প্রায় এক যুগ। তাঁর জীবন যৌবন সব উৎসর্গ করেছেন আন্দোলন ও রাজনীতির জন্য। কিন্তু এই মানুষটি যখন নিস্প্রভ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন তখন একাকীত্ব তাঁকে গ্রাস করেছে। তাঁর বড় ছেলে ও মেয়ে খুবই অভিমানী ছিলেন বাবা’র সর্বউজাড় করা রাজনীতির উপর। শিক্ষা ও পেশাগত কারণে তাঁরা দূর দেশে। মেঝ মেয়েটা ডাক্তার হওয়াতে এবং কাছে থাকাতে বাবার অনেক দেখভাল করতে পেরেছে। ভাবী এবং ছোট ছেলে ফয়সাল ছিল তাঁর দূ:খী জীবনের সাথী। মাওলানা তাহের একটি অধ্যায়ের নাম। বর্তমান প্রজন্মের কাছে তিনি কিংবদন্তী। আমাদের বিশেষ করে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীক সমসাময়িক রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে তিনি গুরু সমতূল্য। তাঁর মত স্বচ্ছ মানুষ যে কোন রাজনৈতিক দলে বিরল। বহুদিন তাঁর সাথে খাওয়া দাওয়া সফর করার সুযোগ আমার হয়েছে। তিনি খুব স্বল্পাহারী ছিলেন। দোকান থেকে বাসার জন্য দরকারী জিনিষপত্র কিনতে গিয়ে দেখতাম তিনি আধাকেজি ডাল, এক পোয়া চিনি কিনতেন। পোষাকের বাহুল্যে তাঁকে দেখেছে একথা কেউ বলতে পারবেনা। তাঁকে দেখলেই এক ধরনের নির্ভরতা বুকে জাগ্রত হতো। আমার ভিন্নমত, দুর্বিনীত ভাবকে তিনি বেশ প্রশ্রয় দিতেন। রাজনৈতিক কারণে তাঁর সাথে উচ্চস্বরে, গলা চড়িয়ে কথা বলতে হয়েছে একাধিকবার। পরক্ষণে তিনি বুকে জড়িয়ে সব ভুলে গিয়েছিলেন কখনো কিছু মনে রাখেননি।
তিনি কাল ইন্তেকাল করেছেন। করোনাকাল না হলে হয়তো ঢাকা ও চট্টগ্রামে তাঁর বিশাল জানাজা হতো। তাঁর হাত দিয়ে দেশে একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিশ্চয়ই এসবের মূল্যায়ন তিনি ইহকাল ও পরকালে পাবেন। তাঁর জন্য কাল সেহরীর সময় অনেক দোয়া করেছি। আল্লাহ তায়ালা যেন তাঁর সওয়াল জওয়াব সহজ করে দেন, কবর কে শান্তির আবাসে পরিণত করেন এবং ইয়াওমাল হাশরে সফলকামদের অন্তর্ভুক্ত রাখেন- আমীন।
No comments:
Post a Comment
আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।