ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের বিধান
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
শিক্ষার্থী, আরবী বিভাগ,
ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়।
ভূমিকাঃ
মানুষ সামাজিক জীব। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই
মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে আসছে। আর এই সামাজিকতার এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা
হচ্ছে কোন মানুষ একা সবসময় নিজের সব প্রয়োজন পূরণে সক্ষম হয় না। এজন্যই পরস্পরকে
বিভিন্ন উপায় বা লেনদেনের মাধ্যমে মানুষ একে অপরকে সহযোগিতা করে থাকে। এরকমই একটি
বড় উপায় হচ্ছে ঋণ। মানব জীবনের পথচলায় ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ
একটি বিষয়। ইসলাম এ বিষয়ে মানুষকে উৎকৃষ্ট পদ্ধতি ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে।
মহান আল্লাহ মানবজাতিকে ঋণ গ্রহণ করার যেমন অনুমতি দিয়েছেন, তেমনি
যথাসময়ে সেই ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ প্রদান করেছেন। যাপিত জীবনের
বাঁকে-বাঁকে যেহেতু আমরা ঋণের সাথে জড়িত থাকি,
সেহেতু
ঋণের ক্ষেত্রে ইসলামী শরী‘আতের দিক-নির্দেশনা ও বিধি-বিধান সম্পর্কে আমাদের স্বচ্ছ
ধারণা থাকা প্রয়োজন। তাছাড়া ঋণের ভয়াবহতার ব্যাপারে সম্যক ধারণা না থাকার কারণে
আমরা ঋণকে হালকা চোখে দেখি। যা পরকালীন জীবনের জন্য হুমকি স্বরূপ। আলোচ্য নিবন্ধে
আমরা এই বিষয়ে কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
ঋণের পরিচয়ঃ
ঋণের আরবী প্রতিশব্দ قَرْض, যা বাংলা ভাষায় ‘কর্য’ নামে পরিচিত। এর বাংলা
প্রতিশব্দ হচ্ছে দেনা, ধার, হাওলাত
ইত্যাদি। শরী‘আতের পরিভাষায়دَفْعُ
مَالٍ إِرْفَاقًا لِمَنْ
يَنْتَفِعُ بِهِ وَيَرُدُّ
بَدَلَهُ، অর্থাৎ ‘ঋণ হ’ল সহযোগিতার জন্য অপরকে মাল-পণ্য প্রদান করা, যেন
গ্রহীতা এর মাধ্যমে উপকৃত হয়, অতঃপর দাতাকে সেই মাল
কিংবা তার অনুরূপ ফেরত দেওয়া’। ইসলামী পরিভাষায় একে ‘কর্যে হাসানা’ বলা হয়। আল্লাহর
সন্তুষ্টি লাভের আশায়, ছওয়াবের নিয়তে বিনা শর্তে
কাউকে কোন কিছু ঋণ দিলে তাকে ‘কর্যে হাসানা’ বা উত্তম ঋণ বলা হয়। এতে মানুষ দুনিয়া
ও আখেরাতে উপকৃত হয় এবং পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পায় ও সামাজিক ঐক্য সুদৃঢ় হয়।
আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় কর্যে হাসানার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। মহান আল্লাহ
বলেন, مَنْ ذَا
الَّذِي يُقْرِضُ اللهَ
قَرْضًا حَسَنًا فَيُضَاعِفَهُ لَهُ
أَضْعَافًا كَثِيرَةً وَاللهُ
يَقْبِضُ وَيَبْسُطُ وَإِلَيْهِ
تُرْجَعُونَ ‘কোন সে ব্যক্তি যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিবে, অতঃপর
তিনি তার বিনিময়ে তাকে বহুগুণ বেশী প্রদান করবেন? বস্ত্ততঃ
আল্লাহ্ই রূযী সংকুচিত করেন ও প্রশস্ত করেন। আর তাঁরই দিকে তোমরা ফিরে যাবে’ (বাক্বারাহ ২/২৪৫)। অন্যত্র তিনি বলেন,وَأَقْرَضُوا اللهَ
قَرْضًا حَسَنًا يُضَاعَفُ
لَهُمْ وَلَهُمْ أَجْرٌ
كَرِيْمٌ `নিশ্চয় দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী এবং যারা
আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেয়, তাদেরকে দেওয়া হবে বহুগুণ
বেশী। আর তাদের জন্যে রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার’ (হাদীদ ৫৭/১৮)। এখানে আল্লাহকে ঋণ দেওয়া অর্থ আল্লাহর পথে
দান করা এবং আল্লাহর বান্দাকে কর্য দেওয়া উভয় মর্ম বহন করে। কেননা হাদীছে কুদসীতে
এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ
বলেন, اسْتَقْرَضْتُ عَبْدِي
فَلَمْ يُقْرِضْنِي ‘আমি
আমার বান্দার কাছে ঋণ চেয়েছিলাম, কিন্তু সে আমাকে ঋণ
দেয়নি’। এতে বুঝা যায় যে, ইসলাম মানুষের নৈতিক ও
অর্থনৈতিক দু’দিকেরই উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথ দেখিয়েছে।
ঋণ গ্রহণের বিধানঃ
ইসলামে ঋণ আদান-প্রদান করা বৈধ। যা
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত। কেননা রাসূল (ছাঃ) ঋণ গ্রহণ
করেছিলেন, ঋণ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়েছেন এবং
তার উম্মতকে ঋণ মুক্তির দো‘আ শিখিয়েছেন। এমনকি রাসূল (ছাঃ) অমুসলিমের কাছ থেকেও ঋণ
গ্রহণ করেছেন। সুতরাং ইসলাম মুসলমানদেরকে বিপদে-আপদে এবং বিভিন্ন প্রয়োজনে অপরের
কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করার অনুমতি প্রদান করেছে। সঙ্গে সঙ্গে সঠিক সময়ে তা পরিশোধ
করার প্রতি কঠোর নির্দেশও দিয়েছে।
ঋণ দান ব্যবসা নয়, সহযোগিতাঃ
ইসলামে ঋণের উদ্দেশ্য হচ্ছে স্রেফ আল্লাহর
সন্তুষ্টির নিমিত্তে মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করা ও তাদের প্রতি দয়া করা। কিন্তু
এই সহযোগিতার আড়ালে ব্যবসায়িক বা অন্য কোন সুবিধা অর্জন উদ্দেশ্য নয়। একজন মুমিনের
জীবনে ঋণ দানের উদ্দেশ্য আর্থিক প্রবৃদ্ধি নয়;
বরং
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। সেকারণ ঋণ গ্রহীতা ঋণ ফেরত দেয়ার সময় যা নিয়েছে তা
কিংবা তার অনুরূপ ফেরত দিতে আদিষ্ট,
এর
অতিরিক্ত নয়। ঋণ দাতা এর অতিরিক্ত নিলে তা সূদ হিসাবে গণ্য হবে। আমরা সমাজিক জীবনে
ঋণের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে সূদের সাথে জড়িয়ে পড়ি। যেমন- চাকরী বা অন্য কোন
সহযোগিতার উদ্দেশ্যে কাউকে ঋণ দেওয়া অথবা কোন হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বা
দোকান-ঘর ভাড়া পাওয়ার জন্য ঋণ প্রদান প্রভৃতি সহযোগিতা সূদের পর্যায়ভুক্ত।
অনুরূপভাবে জমি বন্ধক প্রথাও একপ্রকার সূদ। কারণ এভাবে জমি নিলে চাষের খরচ ব্যতীত
বাকী শস্য জমির মালিককে ফেরত দিতে হবে। কেননা এটা একটা কর্য। আর কর্যের লাভ ভোগ
করা যায় না। ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন,
যে
ঋণের বিনিময় লাভ করা হয়, তা সূদ।
আজকাল বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিওগুলো
গ্রামে-গঞ্জে, নগর-বন্দরে সহযোগিতার নামে
সূদী ঋণের কারবারী করছে এবং সূদী লেনদেনের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর গযবের দিকে
ঠেলে দিচ্ছে। কেউ আবার সূদে ঋণ দানকে ব্যবসা হিসাবে গ্রহণ করেছে, যা
অবশ্যই পরিত্যাজ্য। ঋণ কখনো ব্যবসা হ’তে পারে না। কারণ যে ঋণের মাধ্যমে ব্যবসা করা
হয়, তা মূলত সূদী ব্যবসা।
ঋণ গ্রহণে সতর্কতাঃ
জান্নাত পিয়াসী মুমিন বান্দাকে ঋণের ব্যাপারে
সদা সতর্ক থাকা যরূরী। ছাওবান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল
(ছাঃ) বলেছেন,مَنْ مَاتَ وَهُوَ
بَرِيءٌ مِنْ ثَلَاثٍ:
الكِبْرِ، وَالغُلُولِ، وَالدَّيْنِ دَخَلَ
الجَنَّةَ، ‘যে ব্যক্তির মৃত্যু হবে অহংকার, খিয়ানত
এবং ঋণ থেকে মুক্ত হয়ে, সে জানণাতে প্রবেশ করবে’। অর্থাৎ
ঋণগ্রস্ত হয়ে মারা গেলে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) মৃত ব্যক্তির সম্পদ তার উত্তরাধিকারীদের মাঝে বণ্টনের পূর্বে মৃতের ঋণ
পরিশোধ করার ব্যাপারে জোর তাকীদ দিয়েছেন। কারণ আল্লাহর পথে শহীদ হওয়া ব্যক্তিও তার
ঋণের কারণে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। যতক্ষণ না তার পক্ষ থেকে তার ঋণ পরিশোধ করা
হয়। সেকারণ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, لَوْ كَانَ لِي
مِثْلُ أُحُدٍ ذَهَبًا
مَا يَسُرُّنِي أَنْ
لاَ يَمُرَّ عَلَيَّ
ثَلاَثٌ، وَعِنْدِي مِنْهُ
شَيْءٌ إِلَّا شَيْءٌ
أُرْصِدُهُ لِدَيْنٍ، ‘আমার কাছে যদি ওহোদ পাহাড়ের সমান সোনা থাকত, তাহ’লে
আমার পসন্দ নয় যে, তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পর
আমার কাছে তার কিছু অংশ অবশিষ্ট থাকুক। তবে সেই পরিমাণ ব্যতীত, যা
আমি ঋণ পরিশোধ করার জন্য রেখে দেই’।
ঋণের কারণে মানুষ সামাজে লাঞ্ছিত হয়। তাই
প্রয়োজন ছাড়া ঋণ গ্রহণ থেকে সতর্ক থাকা উচিত। অপরদিকে পরিশোধ না করার উদ্দেশ্যে ঋণ
গ্রহণ করা আত্মসাতের শামিল, যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
ঋণ দানের ফজিলতঃ
পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে ঋণ বলতে ‘কর্যে
হাসানাহ’ বুঝানো হয়েছে। আর কর্যে হাসানাহ প্রদানে রয়েছে অশেষ ফযীলত।
(ক) ঋণ দান ছাদক্বাহর ন্যায় ফযীলতপূর্ণঃ
কাউকে নেকীর আশায় বা সহযোগিতার জন্য কর্যে
হাসানা প্রদান করা আল্লাহর পথে দান-ছাদাক্বাহ করার সমতুল্য। এমনকি ঋণ দানকে
দান-ছাদাক্বার চেয়েও বেশী মর্যাদাপূর্ণ বলা হয়েছে। আবূ উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল
(ছাঃ) বলেছেন,دخل رجل الجنة،
فرأى مكتوباً على
بابها: الصدقةُ بعشرِ
أمثالها، والقرضُ بثمانية
عشر ‘এক ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করে তার দরজায়
একটি লেখা দেখতে পেল যে, ছাদাক্বার নেকী দশ গুণ
বৃদ্ধি করা হয় এবং ঋণ দানের নেকী আঠারো গুণ বৃদ্ধি করা হয়’।
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেছেন, كُلُّ قَرْضٍ صَدَقَةٌ ‘প্রত্যেক ঋণই ছাদক্বাহ’। অপর এক বর্ণনায় তিনি বলেন,مَا
مِنْ مُسْلِمٍ يُقْرِضُ
مُسْلِمًا قَرْضًا مَرَّتَيْنِ إِلَّا
كَانَ كَصَدَقَتِهَا مَرَّةً ‘কোন মুসলিম অপর কোন
মুসলিমকে দুইবার ঋণ দিলে সে একবার ছাদক্বাহ করার নেকী পাবে’।
(খ) দাস মুক্তির নেকীঃ
কর্যে হাসানা বা ঋণ প্রদানের মাধ্যমে দাস
মুক্ত করে দেওয়ার নেকী লাভ করা যায়। বারা ইবনু আযেব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি
বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,مَنْ
مَنَحَ مَنِيحَةَ لَبَنٍ
أَوْ وَرِقٍ أَوْ
هَدَى زُقَاقًا كَانَ
لَهُ مِثْلَ عِتْقِ
رَقَبَةٍ ‘যে ব্যক্তি একবার দোহন করা দুধ দান করে অধবা
টাকা-পয়সা ধার দেয় অথবা পথহারা লোককে সঠিক পথের সন্ধান দেয়, তার
জন্য রয়েছে একটি গোলাম মুক্ত করার সমপরিমান ছওয়াব’।
(গ) ফেরেশতাদের দো‘আ লাভের সৌভাগ্যঃ
যারা আল্লাহর কোন বান্দাকে সহযোগিতার জন্য ঋণ
দেয়, আকাশের ফেরেশতা তার জন্য বরকতের দো‘আ করে। আবূ হুরায়রা
(রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَا
مِنْ يَوْمٍ يُصْبِحُ
الْعِبَادُ فِيهِ إِلاَّ
مَلَكَانِ يَنْزِلاَنِ فَيَقُولُ
أَحَدُهُمَا اللَّهُمَّ أَعْطِ
مُنْفِقًا خَلَفًا، وَيَقُولُ
الآخَرُ اللَّهُمَّ أَعْطِ مُمْسِكًا
تَلَفًا ‘প্রতিদিন সকালে দু’জন ফেরেশতা অবতরণ করেন।
তাঁদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! দাতাকে তার
দানের উত্তম প্রতিদান দিন। আর অপরজন বলেন,
হে
আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস করে দিন’। সুতরাং ঋণ দান এমন একটি ছাদাক্বাহ, যার
মাধ্যমে ফেরেশতাদের দো‘আ লাভে ধন্য হওয়া যায়। আল্লাহর নিষ্পাপ ফেরেশতাদের দো‘আ লাভ
করা কতইনা সৌভাগ্যের ব্যাপার!
(ঘ) বিপদ থেকে মুক্তি ও আল্লাহর সাহায্য লাভঃ
যখন কোন মুমিন বান্দা নিঃস্বার্থভাবে কারো
দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। তখন আল্লাহ এত খুশি হন যে, তিনি
স্বয়ং সেই বান্দার সাহায্যকারী হয়ে যান এবং তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের বিপদ থেকে
রক্ষা করেন। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,
রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোন মুমিনের
দুনিয়ার বিপদসমূহের কোন একটি বিপদ দূর করে দিবে, আল্লাহ
তার আখেরাতের বিপদসমূহের মধ্য হ’তে একটি (কঠিন) বিপদ দূর করে দিবেন। যে ব্যক্তি
অভাবগ্রস্ত লোকের অভাব (সাহায্যের মাধ্যমে) সহজ করে দিবে, আল্লাহ
দুনিয়া ও আখেরাতে তাকে সহজতা দান করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুমিনের দোষ-ত্রুটি গোপন
করবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন।
আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর বান্দাদেরকে সাহায্য করতে থাকেন, যতক্ষণ
সে তার ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে’। আর নিঃসন্দেহে ঋণ একটি সহযোগিতা, যার
মাধ্যমে ঋণগ্রহীতার বিপদাপদে তার পাশে দাঁড়ানো হয়। মহান আল্লাহ আমাদেরকে কর্যে
হাসানা বা নিঃস্বার্থ ঋণ প্রদানের মাধ্যমে উক্ত ফযীলতগুলো হাছিল করার তাওফীক্ব দান
করুন-আমীন!
ঋণ দানের আদবঃ
কাউকে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে ঋণ দান করা নেক
আমলের অন্তর্ভুক্ত। আর ঋণ দানের ক্ষেত্র ইসলাম কতিপয় শিষ্টাচার ও নীতিমালা বর্ণনা
করেছে। যেমন-
(ক) ঘুষ গ্রহণ না করাঃ
ঋণ দানের ক্ষেত্রে বিনিময় গ্রহণ করা এবং এর
মাধ্যমে কোন উপকার হাছিল করা হারাম। ইবনু কুদামা বলেন,
وَكُلُّ قَرْضٍ
شَرَطَ فِيهِ أَنْ يَزِيدَهُ،
فَهُوَ حَرَامٌ،
بِغَيْرِ خِلَافٍ.
قَالَ ابْنُ الْمُنْذِرِ: أَجْمَعُوا
عَلَى أَنَّ الْمُسَلِّفَ إذَا شَرَطَ عَلَى الْمُسْتَسْلِفِ زِيَادَةً
أَوْ هَدِيَّةً،
فَأَسْلَفَ عَلَى ذَلِكَ، أَنَّ أَخْذَ الزِّيَادَةِ
عَلَى ذَلِكَ
رَبًّا. وَقَدْ
رُوِيَ عَنْ أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ، وَابْنِ
عَبَّاسٍ، وَابْنِ
مَسْعُودٍ، أَنَّهُمْ
نَهَوْا عَنْ قَرْضٍ جَرَّ مَنْفَعَةً.
‘যে সকল ঋণে অতিরিক্ত কোন
কিছু গ্রহণ করার শর্তারোপ করা হয়, তা হারাম হওয়ার ব্যাপারে
কোন মতভেদ নেই। ইবনুল মুনযির বলেন,
বিদ্বানগণ
এ ব্যাপারে একমত যে, যদি ঋণ দাতা ঋণ গ্রহীতার
উপর কোন অতিরিক্ত লাভ বা উপঢৌকনের শর্তারোপ করে এবং ঋণী ব্যক্তি যদি সেটা তাকে
প্রদান করে, তাহ’লে সেই অতিরিক্ত কিছু
সূদ হিসাবে গণ্য হবে। উবাই ইবনে কা‘ব,
ইবনু
আববাস ও ইবনু মাসঊদ (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবী থেকে এমনটাই বর্ণিত হয়েছে যে, তারা
ঋণে লাভ গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন’। আজকের বিশ্ব এই সূদী ঋণের জাতাকলে পিষ্ট হয়ে
অশান্তির দাবানলে পরিণত হয়েছে। আমাদের সামাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সূদী ব্যাংকগুলো
সহযোগিতার ফাঁকা বুলি কপচিয়ে মানুষের রক্ত চুষে খাচ্ছে। সূদী ঋণের আগ্রাসী ছোবলে
আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও
অশান্তির মূল কারণ হ’ল এই সূদ ভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থা। তাই দুনিয়া ও আখেরাতে শান্তি
পেতে হ’লে সার্বিক জীবনে সূদমুক্ত অর্থ ব্যবস্থা চালু করা আবশ্যক। কারণ সূদী ঋণ
দান সহযোগিতা নয়; বরং মহাপাপ।
(খ) উপঢৌকন গ্রহণ না করাঃ
ঋণ দানের অন্যতম আদব হ’ল ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে
কোন উপঢৌকন গ্রহণ না করা। কারণ ঋণের বিনিময়ে হাদিয়া বা উপহার গ্রহণ করা হারাম। আবূ
বুরদাহ ইবনে আবূ মূসা (রহঃ) বলেন, একবার আমি মদীনায় এসে আব্দুল্লাহ
বিন সালামের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি আমাকে বললেন,
إِنَّك بِأَرْض
فِيْهَا الرِّبَا
فَاش إِذا كَانَ لَكَ عَلَى رَجُلٍ
حَقٌّ فَأَهْدَى
إِلَيْكَ حِمْلَ
تَبْنٍ أَو حِملَ شعيرِ أَو حَبْلَ
قَتٍّ فَلَا تَأْخُذْهُ فَإِنَّهُ
رِبًا.
‘তুমি এমন এলাকায় বসবাস করছ, যেখানে
সূদের প্রচলন অত্যধিক। অতএব কারো কাছে যদি তোমার কোন পাওনা থাকে, আর
সে যদি তোমাকে হাদিয়া বা উপহার হিসাবে এক বোঝা খড় অথবা এক বোঝা যব অথবা এক আঁটি
ঘাসও দেয়; তুমি তা গ্রহণ করবে না।
কারণ এটা সূদ হিসাবে গণ্য হবে’। এই আছারের মর্মার্থ অন্যান্য ছাহবীদের ইজমা দ্বারা
প্রমাণিত। ইবনুল কাইয়িম (রহঃ) বলেন,
وَقَدْ تَقَدَّمَ
عَنْ غَيْرِ
وَاحِدٍ مِنْ أَعْيَانِهِمْ كَأُبَيٍّ
وَابْنِ مَسْعُودٍ
وَعَبْدِ اللهِ بْنِ سَلَامٍ
وَابْنِ عُمَرَ
وَابْنِ عَبَّاسٍ
أَنَّهُمْ نَهَوْا
الْمُقْرِضَ عَنْ قَبُولِ هَدِيَّةِ
الْمُقْتَرِضِ، وَجَعَلُوا
قَبُولَهَا رِبًا.
‘উবাই বিন কা‘ব, ইবনে
মাসঊদ, আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম,
ইবনে
ওমর এবং ইবনু আববাস (রাঃ)-এর মত উল্লেখযোগ্য ছাহাবায়ে কেরামের পক্ষ থেকে এটা
বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁরা ঋণদাতাকে ঋণগ্রহীতার
কাছ থেকে উপঢৌকন গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। তাঁরা এই উপহার গ্রহণকে সূদ হিসাবে সাব্যস্ত
করেছেন’।
আল্লামা শাওক্বানী (রহঃ) বলেন, ‘যদি কর্যের কারণে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মাঝে হাদিয়া বা
উপঢৌকন আদান-প্রদান হ’লে এটা সূদ বা ঘুষ হিসাবে গণ্য হবে। যা স্পষ্ট হারাম। তবে
ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মাঝে যদি আগে থেকেই হাদিয়া আদান-প্রদানের অভ্যাস থাকে তাহ’লে
সেই উপহার প্রদান বা গ্রহণ করাতে কোন সমস্যা নেই’। যেমন একবার ইবনে ওমর (রাঃ) উবাই ইবনে কা‘বকে দশ হাযার
দিরহাম ঋণ দিলেন। অতঃপর উবাই বিন কা‘ব তাকে জমির কিছু ফল হাদিয়া দিলেন। কিন্তু
ইবনু ওমর সেই ফল গ্রহণ না করে ফিরিয়ে দিলেন। তখন উবাই (রাঃ) বললেন, মাদীনাবসীরা
জানে যে আমি উৎকৃষ্ট ফল-মূল আবাদ করি। তাহ’লে আপনি এই ফল-মূল নিচ্ছেন না কেন? এরপর
তিনি আবার অনুরোধ জানালে ইবনু ওমার সেই হাদিয়া গ্রহণ করলেন। ইবনুল কায়্যিম (রহঃ)
বলেন, ইবনু ওমর প্রথমে মনে করেছিলেন, ঋণদানের
কারণেই হয়তো এই হাদিয়া তাকে দেওয়া হচ্ছে,
সেকারণ
তিনি প্রথমে তা গ্রহণ করেননি। কিন্তু যখন তিনি নিশ্চিত হ’লেন যে, এই
হাদিয়া তার ঋণ দানের কারণে নয়, তখন সেটা গ্রহণ করলেন’।
(গ) অক্ষম ঋণগ্রহীতার প্রতি কঠোর না হওয়াঃ
ঋণী ব্যক্তি তার ঋণ পরিশোধ করতে অপারগ হ’লে
তার উপর কঠোর হওয়া উচিৎ নয়। মা আয়েশা ছিদ্দীক্বা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল
(ছাঃ) বলেছেন,مَنْ طَلَبَ حَقًّا
فَلْيَطْلُبْهُ فِي عَفَافٍ
وَافٍ، أَوْ غَيْرِ
وَافٍ، ‘কোন ব্যক্তি পাওনা আদায়ের তাগাদা দিলে, যেন
বিনীতভাবেই তাগাদা দেয়। এতে তার ঋণ আদায় হোক বা না হোক’।আল্লাহর রাসূলের এই হাদীছের
মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের মহানুভবতা ফুটে ওঠে। সুতরাং প্রকৃত অক্ষম ও দরিদ্র ঋণীদের
প্রতি সদয় হওয়া উচিত।
অক্ষম ঋণগ্রহীতাকে ছাড় প্রদানের ফযীলতঃ
সমাজে যেমন কিছু লোক পাওয়া যায়, যারা
সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও ঋণ শোধ করতে ঢিলেমি করে,
তেমন
সত্যিকারে এমন লোকও রয়েছে যারা নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম। এ রকম
ব্যক্তিকে ইসলাম অতিরিক্ত সময় দিতে উদ্বুদ্ধ করে। যারা অক্ষম ঋণগ্রহীতাকে অবকাশ
দেয় বা তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতের মহা পুরস্কার। মহান আল্লাহ বলেন,وَإِنْ
كَانَ ذُو عُسْرَةٍ
فَنَظِرَةٌ إِلَى مَيْسَرَةٍ
وَأَنْ تَصَدَّقُوْا خَيْرٌ
لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ
تَعْلَمُونَ، ‘আর ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি অভাবী হয়, তাহ’লে
তাকে সচ্ছল হওয়া পর্যন্ত অবকাশ দাও। আর যদি ঋণ মাফ করে দাও, তাহ’লে
সেটা তোমাদের জন্য আরো উত্তম, যদি তোমরা তা জানতে’ (বাক্বারাহ ২/২৮০)।
(ক) দানের ছওয়াব অর্জনঃ
ঋণদাতা যদি অক্ষম ঋণীকে দেনা পরিশোধে ছাড় দেন, তাহ’লে
তিনি এর মাধ্যমে আল্লাহর পথে দান-ছাদাক্বাহ করার নেকী অর্জন করেন। বুরাইদা
আল-আসলামী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ
أَنْظَرَ مُعْسِرًا كَانَ
لَهُ بِكُلِّ يَوْمٍ
صَدَقَةٌ، وَمَنْ أَنْظَرَهُ
بَعْدَ حِلِّهِ كَانَ
لَهُ مِثْلُهُ، فِي
كُلِّ يَوْمٍ صَدَقَةٌ. ‘যে ব্যক্তি (ঋণগ্রস্ত)
অভাবী ব্যক্তিকে অবকাশ দিবে, সে দান-খয়রাত করার ছওয়াব
পাবে। আর যে ব্যক্তি ঋণ পরিশোধের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও সময় বাড়িয়ে দিবে, সেও
প্রতিদিন দান-খয়রাত করার নেকী লাভ করবে’।
(খ) আল্লাহর রাসূলের দো‘আ লাভঃ
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেই পাওনাদার ব্যক্তির
জন্য রহমতের দো‘আ করেছেন, যে অভাবী কর্যগ্রহীতার
প্রতি সহনশীল হয়। জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,
রাসূল
(ছাঃ) ইরশাদ করেছেন,رَحِمَ اللهُ عَبْدًا
سَمْحًا إِذَا بَاعَ،
سَمْحًا إِذَا اشْتَرَى،
سَمْحًا إِذَا اقْتَضَى،
‘আল্লাহ সেই বান্দার প্রতি রহমত বর্ষণ করুন, যে
বান্দা ক্রয়-বিক্রয়ের সময় উদারচিত্ত হয় এবং (ঋণের) পাওনা আদায়ের ক্ষেত্রে সহনশীল
হয়’। ঋণীর প্রতি সহনশীলতা
প্রদর্শনের মাধ্যমে যদি রাসূল (ছাঃ)-এর দো‘আ লাভ করা যায়, তাহ’লে
এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কি হ’তে পারে!
(গ) আরশের নিচে ছায়া লাভের সৌভাগ্যঃ
যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য অক্ষম ঋণী
লোকের প্রতি কোমলতা প্রদর্শন করে অথবা তার ঋণ মাফ করে দেয়, ক্বিয়ামতের
দিন আল্লাহ তাদেরকে তাঁর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে
বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ
أَنْظَرَ مُعْسِرًا، أَوْ
وَضَعَ لَهُ، أَظَلَّهُ
اللهُ يَوْمَ القِيَامَةِ تَحْتَ
ظِلِّ عَرْشِهِ يَوْمَ
لَا ظِلَّ إِلَّا
ظِلُّهُ ‘যে ব্যক্তি কোন অভাবী ঋণগ্রস্তকে সুযোগ
প্রদান করে অথবা ঋণ মাফ করে দেয়, ক্বিয়ামতের দিন মহান
আল্লাহ তাকে তাঁর আরশের ছায়ায় আশ্রয় প্রদান করবেন। যেদিন তার আরশের ছায়া ছাড়া আর
কোন ছায়া থাকবে না’।
(ঘ) আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা লাভঃ
ক্বিয়ামতের ময়দানে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা
লাভ করার অন্যতম উপায় হ’ল অভাবী ও দরিদ্র ঋণগ্রস্তদের ঋণ মাফ করে দেওয়া।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন,
রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেছেন,
حُوسِبَ رَجُلٌ
مِمَّنْ كَانَ قَبْلَكُمْ، فَلَمْ
يُوجَدْ لَهُ مِنَ الْخَيْرِ
شَيْءٌ، إِلَّا
أَنَّهُ كَانَ يُخَالِطُ النَّاسَ،
وَكَانَ مُوسِرًا،
فَكَانَ يَأْمُرُ
غِلْمَانَهُ أَنْ يَتَجَاوَزُوا عَنِ الْمُعْسِرِ. قَالَ: قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ:
نَحْنُ أَحَقُّ
بِذَلِكَ مِنْهُ،
تَجَاوَزُوا عَنْهُ.
‘তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের
মধ্যে এক লোকের হিসাব গ্রহণ করা হয়,
কিন্তু
তার মধ্যে কোন প্রকার সৎ আমল পাওয়া যায়নি। কিন্তু সে মানুষের সাথে লেন-দেন করত এবং
সে ছিল সচ্ছল। তাই দরিদ্র লোকদের মাফ করে দেওয়ার জন্য সে তার কর্মচারীদের নির্দেশ
দিত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ (ফেরেশতাদেরকে)
বললেন, ‘এ ব্যাপারে (অর্থাৎ তাকে ক্ষমা করার ব্যাপারে) আমি তার চেয়ে
অধিক যোগ্য। একে ক্ষমা করে দাও’। অপর এক বর্ণনায় তিনি বলেন,مَنْ
سَرَّهُ أَنْ يُنْجِيَهُ
اللهُ مِنْ كُرَبِ
يَوْمِ الْقِيَامَةِ، فَلْيُنَفِّسْ عَنْ
مُعْسِرٍ، أَوْ يَضَعْ
عَنْهُ ‘যে ব্যক্তি এটা চায় যে, আল্লাহ
তাকে ক্বিয়ামত দিবসের দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি দিক, সে
যেন অক্ষম ঋণগ্রস্ত লোকের সহজ ব্যবস্থা করে কিংবা ঋণ মওকূফ করে দেয়’।
ঋণ গ্রহণকারীর আদব
১. সূদের
মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ না করাঃ
সূদের উপর ঋণ গ্রহণ করা এবং সেই সূদী অর্থ
দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা জায়েয নয়। আল্লাহ তা‘আলা সূদখোরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা
করেছেন (বাক্বারাহ ২/২৭৮-৭৯) এবং সূদগ্রহীতা ও সূদদাতা
উভয়কে লা‘নত বা অভিসম্পাত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يَمْحَقُ اللهُ الرِّبَا
وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ ‘আল্লাহ
সূদকে সংকুচিত করেন এবং ছাদাক্বাহকে প্রবৃদ্ধি দান করেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ কোন
অকৃতজ্ঞ পাপিষ্ঠকে ভালবাসেন না’ (বাক্বারাহ ২/২৭৬)। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِنِ
الرِّبَا وَإِنْ كَثُرَ
فإِنَّ عاقبتَه تصيْرُ
إِلَى قُلِّ، ‘সূদের দ্বারা সম্পদ যতই বৃদ্ধি পাক না কেন, তার
শেষ পরিণতি হ’ল নিঃস্বতা’।সুতরাং কোন সূদী ব্যাংক, এনজিও
এবং সূদখোরের কাছ থেকে সূদ প্রদানের শর্তে ঋণ গ্রহণ করা বৈধ নয়।
২. নির্ধারিত সময়ে যথাসম্ভব দ্রুত ঋণ পরিশোধ করাঃ
ঋণ পরিশোধের অন্যতম আদব হ’ল নির্ধারিত সময়ের
মধ্যেই যথাসম্ভব দ্রুত ঋণ পরিশোধ করা। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, نَفْسُ
الـمُؤْمِنِ مُعَلَّقَةٌ بِدَيْنِهِ
حَتَّى يُقْضَى عَنْهُ ‘মুমিনের আত্মা ঋণের সাথে
ঝুলন্ত থাকে, যতক্ষণ না তার পক্ষ থেকে
ঋণ পরিশোধ করা হয়’।সুতরাং ঋণের বোঝা থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য নির্ধারিত সময়ের
মধ্যে দ্রুত ঋণ পরিশোধ করা কর্তব্য।
৩. ঋণ পরিশোধে আল্লাহর উপর ভরসা করাঃ
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির কর্তব্য হ’ল ঋণ পরিশোধের
ব্যপারে সর্বদা আল্লাহর উপর ভরসা করা। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ
يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ
لَهُ مَخْرَجًا، ‘যে আল্লাহর উপর ভরসা করে আল্লাহই তার জন্য
যথেষ্ট’ (ত্বালাক ৬৫/৩)। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেছেন,مَنْ أَخَذَ أَمْوَالَ
النَّاسِ يُرِيْدُ أَدَاءَهَا
أَدَّى اللهُ عَنْهُ،
وَمَنْ أَخَذَ يُرِيْدُ
إِتْلاَفَهَا أَتْلَفَهُ اللهُ،
‘যে ব্যক্তি মানুষের মাল (ধার) নেয় পরিশোধ
করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা আদায়ের ব্যবস্থা করে দেন। আর যে ব্যক্তি মানুষের সম্পদ
গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা গ্রহণ করে,
আল্লাহ
তাকে ধ্বংস করবেন’।] ক্বিয়ামতের দিন সে চোর
হিসাবে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে। অন্যত্র তিনি বলেন,مَنْ
أَخَذَ دَيْنًا وَهُوَ
يُرِيْدُ أَنْ يُؤَدِّيَهُ، أَعَانَهُ
اللهُ عَزَّ وَجَلَّ،
‘যে ব্যক্তি ঋণ পরিশোধের নিয়তে ঋণ গ্রহণ করে, আল্লাহ
তাকে ঋণ পরিশোধে সহযোগিতা করেন’।
সুতরাং যে আল্লাহর উপর ভরসা করে পরিশোধের
নিয়তে ঋণ গ্রহণ করে, আল্লাহ তাকে অবশ্যই
সাহায্য করেন। তার অনুপম দৃষ্টান্ত রয়েছে নিমেণাক্ত হাদীছে।
রাসূল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘বনী ইসরাঈলের জনৈক ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তির নিকটে এক হাযার
দীনার ঋণ চাইল। তখন সে (ঋণদাতা) বলল,
কয়েকজন
সাক্ষী নিয়ে আস, আমি তাদেরকে সাক্ষী রাখব।
সে বলল, সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট। তারপর (ঋণদাতা) বলল, তাহ’লে
একজন যামিনদার উপস্থিত কর। সে বলল,
যামিনদার
হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট। ঋণদাতা বলল,
তুমি
সত্যই বলেছ। এরপর নির্ধারিত সময়ে পরিশোধের শর্তে তাকে এক হাযার দীনার দিয়ে দিল।
তারপর ঋণ গ্রহীতা সামুদ্রিক সফর করল এবং তার প্রয়োজন সম্পন্ন করে সে যানবাহন
খুঁজতে লাগল, যাতে সে নির্ধারিত সময়ে ঋণদাতার
কাছে এসে পৌঁছতে পারে। কিন্তু সে কোন যানবাহন পেল না। তখন সে এক টুকরা কাঠ নিয়ে তা
ছিদ্র করল এবং ঋণদাতার নামে একখানা পত্র ও এক হাযার দীনার তার মধ্যে ভরে ছিদ্রটি
বন্ধ করে সমুদ্র তীরে এসে বলল, হে আল্লাহ! তুমি তো জান
আমি অমুকের নিকট এক হাযার দীনার ঋণ চাইলে সে আমার কাছে যামিনদার চেয়েছিল। আমি
বলেছিলাম, আল্লাহই যামিন হিসাবে
যথেষ্ট। এতে সে রাযী হয়। তারপর সে আমার কাছে সাক্ষী চেয়েছিল, আমি
বলেছিলাম সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট,
তাতে
সে রাযী হয়ে যায়। আমি তার ঋণ (যথাসময়ে) পরিশোধের উদ্দেশ্যে যানবাহনের জন্য
যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু পাইনি। তাই আমি
তোমার নিকটে সোপর্দ করলাম, এই বলে সে কাষ্ঠখন্ডটি
সমুদ্রে নিক্ষেপ করল। আর কাষ্ঠখন্ডটি সমুদ্রে প্রবেশ করল। অতঃপর লোকটি ফিরে গেল
এবং নিজের শহরে যাওয়ার জন্য যানবাহন খুঁজতে লাগল।
ওদিকে ঋণদাতা এই আশায় সমুদ্রতীরে গেল যে, হয়
তো ঋণগ্রহীতা কোন নৌযানে করে তার মাল নিয়ে এসেছে। তার দৃষ্টি কাষ্ঠখন্ডটির উপর পড়ল, যার
ভিতরে সম্পদ ছিল। সে কাষ্ঠখন্ডটি তার পরিবারের জ্বালানীর জন্য বাড়ী নিয়ে গেল। যখন
সে তা চিরল, তখন সে সম্পদ ও পত্রটি
পেয়ে গেল। কিছুদিন পর ঋণগ্রহীতা এক হাযার দীনার নিয়ে এসে হাযির হ’ল এবং বলল, আল্লাহর
কসম! আমি আপনার মাল যথাসময়ে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে সর্বদা যানবাহনের খোঁজে ছিলাম।
কিন্তু আমি যে নৌযানে এখন আসলাম, তার আগে আর কোন নৌযান
পাইনি। ঋণদাতা বলল, তুমি কি আমার নিকট কিছু
পাঠিয়েছিলে? ঋণগ্রহীতা বলল, আমি
তো তোমাকে বললামই যে, এর আগে আর কোন নৌযান আমি
পাইনি। সে বলল, তুমি কাঠের টুকরার ভিতরে
যা পাঠিয়েছিলে, তা আল্লাহ তোমার পক্ষ হ’তে
আমাকে আদায় করে দিয়েছেন। তখন সে আনন্দচিত্তে এক হাযার দীনার নিয়ে ফিরে এল’। সুবহানাল্লাহ। আল্লাহ এভাবেই তাঁর উপর
ভরসাকারী বান্দাদের সহায্য করেন।
৪. ঋণ পরিশোধে টাল-বাহানা না করাঃ
ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে গড়িমসি করা অন্যায়।
পাওনাদার যদি ধনীও হয়, তবুও তার ঋণ পরিশোধ করা
ওয়াজিব। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,
রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেছেন, مَطْلُ الغَنِيِّ ظُلْمٌ،
فَإِذَا أُتْبِعَ أَحَدُكُمْ
عَلَى مَلِيٍّ فَلْيَتْبَعْ، ‘ধনী ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করা যুলুম।
যখন তোমাদের কাউকে (তার জন্যে) কোন ধনী ব্যক্তির হাওয়ালা করা হয়, তখন
সে যেন তা মেনে নেয়’।
তবে ঋণ পরিশোধে অক্ষম ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির বিলম্ব করা যুলুমের
অন্তর্ভুক্ত হবে না।
৫. উত্তমভাবে ঋণ পরিশোধ করাঃ
ঋণগ্রহীতার অন্যতম কর্তব্য হ’ল উত্তমভাবে ঋণ
পরিশোধ করা। একবার রাসূল (ছাঃ) এক ব্যক্তির কাছ থেকে একটি উটের বাচ্চা ধার নেন।
এরপর যখন তার নিকটে বায়তুল মালের উট আসল,
তিনি
আবূ রাফি‘কে সেই ব্যক্তির উটের ধার শোধ করার নির্দেশ দেন। আবূ রাফি‘ রাসূল
(ছাঃ)-এর নিকট এসে জানালেন যে, বায়তুল মালে সেই রকম উটের
বাচ্চা দেখছি না। বরং তার চেয়ে উৎকৃষ্ট উট আছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,أَعْطِهِ
إِيَّاهُ، إِنَّ خِيَارَ
النَّاسِ أَحْسَنُهُمْ قَضَاءً،
‘ওটাই তাকে দিয়ে দাও। কেননা মানুষের মধ্যে সেই
ব্যক্তি উত্তম, যে উত্তমরূপে ঋণ পরিশোধ
করে’।
জাবির (রাঃ) বলেন, ‘নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে আমার কিছু পাওনা ছিল। তিনি পরিশোধের
সময় আমার প্রাপ্যের চেয়ে বেশী দিয়েছিলেন’। অতএব ঋণগ্রহীতার কর্তব্য হ’ল উত্তমভাবে দেনা শোধ করে দেওয়া।
আর ঋণগ্রহীতা সন্তুষ্টচিত্তে পাওনার বেশী কিছু প্রদান করলে তা গ্রহণ করাতে সমস্যা
নেই। তবে ঋণদাতা যদি ঋণে কোন শর্তারোপ করে বা বেশী পাওয়ার
সুপ্ত কামনাও
রাখে,
তাহ’লে তা
সূদে পরিণত
হবে।
৬. পাওনাদারের প্রতি কোমলতা প্রদর্শন করাঃ
আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি
বলেন, এক বেদুঈন নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে তার ঋণ পরিশোধের জন্য
তাঁকে কঠোর ভাষায় তাগাদা দিল। এমনকি সে তাঁকে বলল, আমার
ঋণ পরিশোধ না করলে আমি আপনাকে নাজেহাল করব। ছাহাবীগণ তার উপর চড়াও হ’তে উদ্ধত হয়ে
বললেন, তোমার অনিষ্ট হোক! তুমি কি জানো কার সাথে কথা বলছ? সে
বলল, আমি আমার পাওনা দাবী করছি। তখন নবী করীম (ছাঃ) বলেন, هَلَّا
مَعَ صَاحِبِ الْحَقِّ
كُنْتُمْ؟ ‘তোমরা কেন পাওনাদারের পক্ষ নিলে না?’ অতঃপর তিনি কায়েসের কন্যা খাওলা (রাঃ)-এর নিকট লোক পাঠিয়ে
তাকে বললেন,إِنْ كَانَ عِنْدَكِ
تَمْرٌ فَأَقْرِضِينَا حَتَّى
يَأْتِيَنَا تَمْرُنَا فَنَقْضِيَكِ، ‘তোমার কাছে খেজুর থাকলে আমাকে ধার দাও। আমার
খেজুর আসলে তোমার ধার পরিশোধ করব’। খাওলা (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ, আমার
পিতা আপনার জন্য উৎসর্গিত হোক, ইয়া রাসূলাল্লাহ! রাবী
বলেন, তিনি তাঁকে ধার দিলেন। তিনি বেদুঈনের পাওনা পরিশোধ করলেন
এবং তাকে আহার করালেন। সে বলল, আপনি পূর্ণরূপে পরিশোধ
করলেন। আল্লাহ আপনাকে পূর্ণরূপে দান করুন। তিনি বলেন, أُولَئِكَ
خِيَارُ النَّاسِ، إِنَّهُ
لَا قُدِّسَتْ أُمَّةٌ
لَا يَأْخُذُ الضَّعِيْفُ فِيْهَا
حَقَّهُ غَيْرَ مُتَعْتَعٍ، ‘উত্তম লোকেরা এমনই হয়। যে জাতির দুর্বল
লোকেরা জোর-যবরদস্তি ছাড়া তাদের পাওনা আদায় করতে পারে না সেই জাতি কখনো পবিত্র হ’তে
পারে না’।
৭. ঋণদাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ও তার জন্য
দো‘আ করাঃ
ঋণ প্রদান একটি বড় ধরনের সহযোগিতা। সেকারণ
ঋণদাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা বাঞ্ছনীয়। আব্দুল্লাহ ইবনু আবী রাবী‘আহ (রাঃ)
বলেন যে, ‘হুনায়ন যুদ্ধের সময় নবী
করীম (ছাঃ) তার কাছ থেকে ত্রিশ বা চল্লিশ হাযার দিরহাম ঋণ নিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি
যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে তার পাওনা পরিশোধ করলেন এবং তার জন্য দো’আ করে বললেন, بَارَكَ
اللهُ لَكَ فِيْ
أَهْلِكَ وَمَالِكَ، ‘বা-রাকাল্লাহু লাকা ফী আহ্লিকা ওয়া মা-লিকা’ (মহান
আল্লাহ তোমার ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজনে বরকত দান করুন)। তারপর বললেন, إِنَّمَا
جَزَاءُ السَّلَفِ الْوَفَاءُ
وَالْحَمْدُ ‘নিশ্চয়ই ঋণের প্রতিদান হচ্ছে ঋণ পরিশোধ করা
এবং ঋণদাতার প্রতি প্রশংসা করা’।
ঋণ পরিশোধ না করার পরিণাম
ঋণের বোঝা মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।
ঋণ পরিশোধ না করা হক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকার নষ্ট করার নামান্তর। আল্লাহর হক
নষ্ট করলে তওবার মাধ্যমে ক্ষমা হয়। কিন্তু বান্দার হক নষ্ট করলে সংশ্লিষ্ট বান্দার
নিকট থেকে ক্ষমা না পেলে ক্ষমা লাভের কোন উপায় নেই। যেকোন মূল্যে তার হক আদায় করতে
হবে ঐদিন আসার পূর্বে যেদিন টাকা-পয়সা থাকবে না। সেদিন হকদারকে হক বিনষ্টকারীর
নেকী দেওয়া হবে। নেকী শেষ হয়ে গেলে প্রাপকের পাপ হক বিনষ্টকারীর উপরে চাপানো হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ
تُؤَدُّوا الأَمَانَاتِ إِلَى
أَهْلِهَا، ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে এই মর্মে নির্দেশ
দিচ্ছেন যে, তোমরা আমানতকে তার
প্রাপকের নিকটে অর্পণ করবে’ (নিসা ৪/৫৮)।
উপরন্তু ঋণ পরিশোধ না করার ফলে তার দুনিয়া ও
আখেরাতের যিন্দেগী যন্ত্রণার কালো আঁধারে ঢেকে যায়। নিমেণ ঋণ পরিশোধ না করার কঠিন
পরিণতি আলোকপাত করা হ’ল-
১. নেক আমল বিসর্জন অথবা ঋণীর পাপ অর্জনঃ
ঋণ পরিশোধ না করা আত্মসাতের শামিল। যদি
পাওনাদার ঋণগ্রহীতাকে মাফ না করে বা ঋণ মওকূফ না করে অথবা ঋণীর ওয়ারিছ সেই ঋণ
পরিশোধ না করে, তাহ’লে ক্বিয়ামতের দিন নেক
আমল দানের মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। তবুও ঋণ পরিশোধ করতেই হবে। কারণ ঋণের পাপ
আল্লাহ ক্ষমা করবেন না।
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল
(ছাঃ) বলেছেন,مَنْ مَاتَ وَعَلَيْهِ
دَيْنٌ، فَلَيْسَ ثَمَّ
دِينَارٌ، وَلَا دِرْهَمٌ،
وَلَكِنَّهَا الْحَسَنَاتُ وَالسَّيِّئَاتُ، ‘কেউ ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মারা গেলে (ক্বিয়ামতের
দিন) তার সেই ঋণ পরিশোধ করার জন্য কোন দীনার বা দিরহাম থাকবে না; বরং
পাপ ও নেকীগুলোই অবশিষ্ট থাকবে’।
অর্থাৎ ক্বিয়ামতের ময়দানে নেকীর মাধ্যমে হ’লেও ঋণ পরিশোধ
করতে হবে। যদি ঋণী ব্যক্তির কোন নেকী না থাকে,
তাহ’লে
ঋণ দাতার পাপ থেকে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ
كَانَتْ عِنْدَهُ مَظْلِمَةٌ
لِأَخِيهِ فَلْيَتَحَلَّلْهُ مِنْهَا، فَإِنَّهُ
لَيْسَ ثَمَّ دِينَارٌ
وَلاَ دِرْهَمٌ، مِنْ
قَبْلِ أَنْ يُؤْخَذَ
لِأَخِيهِ مِنْ حَسَنَاتِهِ، فَإِنْ
لَمْ يَكُنْ لَهُ
حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ
سَيِّئَاتِ أَخِيهِ فَطُرِحَتْ
عَلَيْهِ ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের উপর যুলুম করেছে, সে
যেন তার কাছ থেকে ক্ষমা নিয়ে নেয়, তার ভাইয়ের পক্ষে তার নিকট
হ’তে পুণ্য কেটে নেওয়ার আগেই। কারণ সেখানে কোন দীনার বা দিরহাম পাওয়া যাবে না। তার
কাছে যদি পুণ্য না থাকে তবে তার (মাযলূম) ভাইয়ের গোনাহ্ এনে তার উপর চাপিয়ে দেয়া
হবে’। সুতরাং মৃত্যুর আগেই এই
ভয়াবহ ঋণ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা অবশ্য কর্তব্য।
২. শহীদ হওয়া সত্ত্বেও ঋণের গোনাহ মাফ হবে নাঃ
আবূ ক্বাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা
রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীগণের মাঝে দন্ডায়মান হয়ে বলেন, আল্লাহর
রাস্তায় জিহাদ করা ও আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। এ কথা শুনে এক
ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রসূল! আপনি কি
মনে করেন, যদি আমি আল্লাহর রাস্তায়
নিহত হই, তাহ’লে আমার পাপসমূহ মাফ
করা হবে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ।
যদি তুমি পশ্চাদ্ধাবন না করে ধৈর্যের সাথে ছওয়াবের আশায় অগ্রসর হও এবং আল্লাহর
রাস্তায় নিহত হও তাহ’লে। তারপর (সে কিছু দূর চলে যাওয়ার পর তাকে ডেকে) বললেন, তুমি
কি যেন বলছিলে? সে বলল, আপনি
কি মনে করেন, যদি আমি আল্লাহর রাস্তায়
নিহত হই, তাহ’লে আমার পাপসমূহকে মাফ
করা হবে? তখন রাসূল (ছাঃ) তাতে
সম্মতি দিয়ে বললেন,
نَعَمْ وَأَنْتَ
صَابِرٌ مُحْتَسِبٌ
مُقْبِلٌ غَيْرُ
مُدْبِرٍ إِلاَّ
الدَّيْنَ فَإِنَّ
جِبْرِيلَ عَلَيْهِ
السَّلاَمُ قَالَ لِى ذَلِكَ
‘হ্যাঁ, যদি
তুমি পশ্চাদ্ধাবন না করে ধৈর্যের সাথে ছওয়াবের আশায় অগ্রসর হও এবং আল্লাহর পথে
নিহত হও তাহ’লে। তবে ঋণের গোনাহ ব্যতীত (অর্থাৎ সকল গোনাহ ক্ষমা হ’লেও ঋণের গোনাহ
ক্ষমা করা হবে না)। কারণ জিবরীল (আঃ) আমাকে এ কথাই বললেন’। অন্যত্র তিনি বলেন, يُغْفَرُ
لِلشَّهِيدِ كُلُّ ذَنْبٍ
إِلاَّ الدَّيْنَ ‘শহীদ
ব্যক্তির সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে। কিন্তু ঋণ ব্যতীত’। অর্থাৎ আল্লাহর পথে জান-মাল বিলিয়ে দেয়া শহীদ ব্যক্তি ঋণের কারণে
আল্লাহর কাছে ধরা খেয়ে যাবেন। তার সকল পাপ ক্ষমা করা হ’লেও ঋণের পাপ ক্ষমা করা হবে
না। উল্লিখিত হাদীছদ্বয়ের মাধ্যমে ঋণের ভয়াবহতা উপলদ্ধি করা যায়।
৩. ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী জান্নাতে প্রবেশ
করবে নাঃ
মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনে জাহশ (রাঃ)
বলেন, একদা আমরা মসজিদের চত্বরে অবস্থান করছিলাম, যেখানে
জানাযা রাখা হ’ত। রাসূল (ছাঃ)ও আমাদের মধ্যে উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি মাথা উঠালেন এবং
আসমানের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। অতঃপর দৃষ্টি অবনত করে ললাটের উপর হাত রেখে বললেন, سُبْحَانَ
اللهِ سُبْحَانَ اللهِ
مَاذَا نَزَلَ مِنَ
التَّشْدِيدِ ‘সুবহানাল্লাহ! সুবহানাল্লাহ! কী কঠোরতাই না
অবতীর্ণ হ’ল!’ বর্ণনাকারী বলেন, আমরা সে দিন ও রাত এ
ব্যাপারে চুপ থাকলাম। তবে আমরা একে কল্যাণকরই মনে করছিলাম। রাবী মুহাম্মাদ বলেন, পরের
দিন সকালে আমি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে জিজ্ঞেস করলাম, কি
কঠোরতা অবতীর্ণ হয়েছে? তিনি বললেন,فِى
الدَّيْنِ وَالَّذِىْ نَفْسُ
مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَوْ
أَنَّ رَجُلاً قُتِلَ
فِىْ سَبِيْلِ اللهِ
ثُمَّ عَاشَ ثُمَّ
قُتِلَ فِىْ سَبِيْلِ
اللهِ ثُمَّ عَاشَ
وَعَلَيْهِ دَيْنٌ مَا
دَخَلَ الْجَنَّةَ حَتَّى
يُقْضَى دَيْنُهُ- ‘ঋণের ব্যাপারে কঠোরতা অবতীর্ণ হয়েছে। ঐ সত্তার কসম! যাঁর
হাতে মুহাম্মাদের জীবন। কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহর পথে শহীদ হয়ে পুনরায় জীবন লাভ করে, আবার
শহীদ হয়ে পুনরায় জীবন লাভ করে, আবার শহীদ হয়ে জীবিত হয়, অথচ
তার উপর ঋণ থাকে। তাহ’লে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ
না তার ঋণ পরিশোধ করা হয়’। ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেন,
‘আমার
জীবনে ঋণের ব্যাপারে এত কঠোর কথা আমি কখনো পাইনি’।
সামুরা বিন জুনদুব (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি
বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের উদ্দেশ্যে খুৎবারত অবস্থায়
জিজ্ঞেস করেন, অমুক গোত্রের কোন লোক
এখানে আছে কি? কিন্তু কেউ এতে সাড়া দিল
না। এমনকি তৃতীয়বার একই প্রশ্ন করার পর এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, ইয়া
রাসূলাল্লাহ! আমি উপস্থিত আছি। তখন তিনি বললেন,مَا مَنَعَكَ أَنْ
تُجِيْبَنِيْ فِي الْمَرَّتَيْنِ الأُولَيَيْنِ أَمَا
إِنِّي لَمْ أُنَوِّهْ
بِكُمْ إِلاَّ خَيْرًا
إِنَّ صَاحِبَكُمْ مَأْسُورٌ
بِدَيْنِهِ، ‘প্রথম দু’দফায় কিসে তোমাকে সাড়া দিতে বাধা
দিয়েছিল? জেনে রাখ! আমি তোমাদের
কেবল কল্যাণই কামনা করি। তোমাদের অমুক ব্যক্তি ঋণের দায়ে আটকে আছে। সামুরা (রাঃ)
বলেন, তখন আমি ঐ ব্যক্তিকে মৃত ব্যক্তির পক্ষে ঋণ পরিশোধ করতে
দেখি। যার পর আর কেউ তার কাছে আর কোন পাওনা চাইতে আসেনি’। অন্য বর্ণনায় এসেছে,
إنَّ صاحبَكم
حُبِسَ على بابِ الجَّنة
بديْنٍ كان عليه، فإنْ شئتُم فافْدوهُ،
وإنْ شئتُم فأسْلِموهُ إلى عذابِ الله.
‘তোমাদের অমুক সাথী
ঋণগ্রস্ত হওয়ার কারণে জান্নাতের দরজায় আটকে আছে। তুমি চাইলে তাকে মুক্ত করতে পার।
চাইলে তাকে আল্লাহর শাস্তি গ্রহণের জন্য সমর্পণ করতে পার। অতঃপর লোকটি তা পরিশোধ
করল।
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি
বলেন,
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, نَفْسُ
الْمُؤْمِنِ مُعَلَّقَةٌ بِدَيْنِهِ
حَتَّى يُقْضَى عَنْهُ ‘মুমিনের আত্মা তার ঋণের
সাথে ঝুলন্ত থাকে, যতক্ষণ না তা পরিশোধ করা
হয়’।
৪. ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত রাসূল
(ছাঃ) জানাযা পড়তেন নাঃ
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি
বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট যখন কোন ঋণী ব্যক্তির জানাযা উপস্থিত
করা হ’ত, তখন তিনি জিজ্ঞেস করতেন, هَلْ
تَرَكَ لِدَيْنِهِ فَضْلاً ‘সে তার ঋণ পরিশোধের জন্য
অতিরিক্ত মাল রেখে গেছে কি?’ যদি তাঁকে বলা হ’ত যে, সে
তার ঋণ পরিশোধের মতো মাল রেখে গেছে। তখন তার জানাযার ছালাত আদায় করতেন। নতুবা
বলতেন, صَلُّوْا عَلَى
صَاحِبِكُمْ ‘তোমাদের সাথীর জানাযা আদায় করে নাও’।
অপর বর্ণনায় জাবের (রাঃ) বলেন, كَانَ
النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا
يُصَلِّي عَلَى رَجُلٍ
عَلَيْهِ دَيْنٌ، ‘নবী কারীম (ছাঃ) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির জানাযা
ছালাত আদায় করতেন না’।
তবে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির জাযানা ছালাত আদায় করা জায়েয। কারণ
প্রথম পর্যায়ে রাসূল (ছাঃ) তাঁর উম্মতকে ঋণের ভয়াবহতা উপলব্ধি করানোর জন্য এটা
করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির জানাযা পড়েছেন। ইবনু মুনযিরী
(রহঃ) বলেন, ‘এটা সঠিক যে আল্লাহর রাসূল
(ছাঃ) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির জানাযা পড়তেন না,
কিন্তু
এটা পরে রহিত হয়েছে’।
ত্ববারানীতে ইবনু ওমর (রাঃ)-এর বর্ণনায় রয়েছে, ঋণ
দু’প্রকারঃ
ক. যে ব্যক্তি তার ওপর থাকা ঋণ পরিশোধের
ইচ্ছা নিয়ে মৃত্যুবরণ করল, আমি (রাসূলুল্লাহ) তার
অভিভাবক।
খ. যে ব্যক্তি ঋণ পরিশোধের ইচ্ছা না করে
(আত্মসাৎ করার ইচ্ছায়) মৃত্যুবরণ করল। এর কারণে সেদিন তার নেকী হ’তে কর্তন করা হবে, যেদিন
কোন দিরহাম ও দীনার থাকবে না।
আল্লামা শাওকানী (রহঃ) বলেন, এমন
অর্থবোধক অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। নবী করীম (ছাঃ) এটা বলেছেন, তবে
ঋণী ব্যক্তির ওপর জানাযা নিষিদ্ধ হওয়ার পর যখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে অনেক দেশে বিজয়
দান করলেন এবং প্রচুর সম্পদ অর্জিত হ’ল,
তখন
তিনি ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির জানাযা আদায় করতেন এবং বায়তুল মাল হ’তে তাদের ঋণ পরিশোধ
করতেন। আর এটা যাকাত বণ্টনের আটটি খাতের একটি।
৫. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি কবরের আযাবের সম্মুখীন হবেঃ
কেউ যদি ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মারা যায় এবং মৃত
ব্যক্তির পক্ষ থেকে সেই ঋণ পরিশোধ না করা হয়,
তাহ’লে
সে কবরে শাস্তির সম্মুখীন হবে। জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, জনৈক
ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে আমরা তার গোসল ও কাফন সম্পন্ন করলাম। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)
তার জানাযা পড়ার জন্য আসলেন। আমরা বললাম,
আপনি
তার জানাযা পড়বেন? রাসূল (ছাঃ) তার দিকে
দু’পা আগালেন। তারপর বললেন, তার কি কোন ঋণ আছে? আমরা
বললাম, দুই দীনার। তখন তিনি ফিরে গেলেন। তারপর আবু ক্বাতাদা (রাঃ)
ঐ দু’দীনারের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন এবং বললেন,
আল্লাহ
কি এর মাধ্যমে ঋণদাতার হক পূরণ করলেন এবং মাইয়েত কি এখন উক্ত ঋণের দায় থেকে মুক্ত
হ’ল? উত্তরে রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ।
অতঃপর তিনি তার জানাযার ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর একদিন পর তিনি আবূ ক্বাতাদাহকে
জিজ্ঞেস করলেন যে, দীনার দু’টি কি পরিশোধ করা
হয়েছে? তিনি বললেন,
তিনি
তো গতকাল মারা গেছেন মাত্র। পরের দিন তিনি আবার তার নিকটে গেলে তিনি জানালেন যে, দীনার
দু’টি পরিশোধ করা হয়েছে। একথা শুনে রাসূল (ছাঃ) বললেন, الآنَ
بَرَدَتْ عَلَيْهِ جِلْدُهُ،
‘এখন তার চামড়া ঠান্ডা হ’ল’। এতে বুঝা যায় যে, কেবল
দায়িত্ব নিলেই মাইয়েতের আযাব দূর হবে না,
যতক্ষণ
না তার ঋণ পরিশোধ করা হয়।
ঋণ সম্পর্কিত কতিপয় জ্ঞাতব্য বিষয়
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির যাকাতের হুকুমঃ
ঋণ করা সম্পদ যেহেতু ব্যক্তির মূল সম্পদ নয়, সেহেতু
ঋণ পরিশোধের আগে এই সম্পদের উপর যাকাত ফরয নয়। সুতরাং ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যাকাত
আদায়ের পূর্বে তার ঋণ পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট সম্পদ নিছাব পরিমাণ হ’লে তার যাকাত
আদায় করবে। ওছমান (রাঃ) বলেন, هَذَا شَهْرُ زَكَاتِكُمْ فَمَنْ
كَانَ عَلَيْهِ دَيْنٌ
فَلْيُؤَدِّ دَيْنَهُ حَتَّى
تَحْصُلَ أَمْوَالُكُمْ فَتُؤَدُّوْنَ مِنْهُ
الزَّكَاةَ، ‘এটি (রামাযান) যাকাতের মাস। অতএব যদি কারো
উপর ঋণ থাকে তাহ’লে সে যেন প্রথমে ঋণ পরিশোধ করে। এরপর অবশিষ্ট সম্পদ নিছাব পরিমাণ
হ’লে সে তার যাকাত আদায় করবে’।
আর যদি ঋণ পরিশোধ না করে তার নিকট গচ্ছিত রাখে, তাহ’লে
যাকাতযোগ্য সব সম্পদের উপরেই যাকাত আদায় করা ফরয। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,خُذْ
مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً
تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيْهمْ بِهَا،
‘তাদের সম্পদ হ’তে ছাদাক্বাহ্ (যাকাত) গ্রহণ
করবে। যার দ্বারা তুমি তাদেরকে পবিত্র করবে এবং পরিশুদ্ধ করবে’ (তওবা ৯/১০৩)।
প্রদানকৃত ঋণের যাকাতঃ
কোন ব্যক্তি কাউকে ঋণ প্রদান করলে এবং তা এক
চান্দ্র বছর অতিক্রম করলে উক্ত টাকার যাকাত আদায় করতে হবে কি-না? এ
ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে ছহীহ মত হ’ল, যদি
প্রদানকৃত ঋণের টাকা সহজে পাওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা থাকে, তাহ’লে
তার যাকাত আদায় করতে হবে। আর যদি সহজে পাওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা না থাকে, তবে
তা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত যাকাত আদায় করতে হবে না। এমন সম্পদ অনেক বছর পরে হাতে
আসলে পাওয়ার পরে মাত্র এক বছরের যাকাত আদায় করতে হবে।
ঋণ রেখে মারা গেলে করণীয়ঃ
কোন ব্যক্তি যদি ঋণ রেখে মারা যায়, তাহ’লে
মৃতের সকল সম্পদ বিক্রি করে হ’লেও পরিবারকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। কারণ ঋণ পরিশোধ
ব্যতীত মৃত্যুবরণ করলে হাশরের মাঠে নিজ নেকী থেকে ঋণের দাবী পূরণ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা মীরাছের আলোচনা শেষে বলেন, مِنْ
بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوْصِيْ
بِهَا أَوْ دَيْنٍ،
‘মৃতের অছিয়ত পূরণ করার পর এবং তার ঋণ
পরিশোধের পর (নিসা ৪/১১)। যদিও নিজ সম্পত্তি থেকে পিতা-মাতার ঋণ পরিশোধ
করা সন্তানের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। তথাপি ঋণ পরিশোধ করা পিতা-মাতার খেদমতের অংশ ও অশেষ ছওয়াবের
কাজ হওয়ায় সন্তান নিজ দায়িত্বে তা পরিশোধ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। রাসূল (ছাঃ)
বলেন, نَفْسُ الْمُؤْمِنِ مُعَلَّقَةٌ بِدَيْنِهِ
حَتَّى يُقْضَى عَنْهُ ‘মুমিনের আত্মা ঝুলন্ত
অবস্থায় রাখা হয় তার ঋণের কারণে, যতক্ষণ না তার পক্ষ হ’তে
ঋণ পরিশোধ করা হয়’। আর যদি ঋণগ্রস্ত মাইয়েতের
কিছুই না থাকে এবং তার স্ত্রী-সন্তানরাও যদি সক্ষম না হয়, সমাজ, সংগঠন
বা সরকার সে দায়িত্ব বহন করবে’।
তাহ’লে
এক্ষেত্রে সূদ না দিয়ে কেবল মূল অংশ দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে (বাক্বারাহ ২/২৭৮-২৭৯)। অতএব প্রত্যেকের উচিত যথাসম্ভব ঋণ গ্রহণ থেকে
বেঁচে থাকা। যা পরিশোধ করতে না পারলে ইহকালে পরিবারের জন্য এবং পরকালে নিজের জন্য
কঠিন বোঝা হয়ে দেখা দিবে।
ঋণগ্রস্ত অবস্থায় কুরবানীর বিধানঃ
কুরবানী সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। সামর্থ্য থাকা
অবস্থায় কুরবানী পরিত্যাগ করা মাকরূহ। কুরবানী হ’ল ইসলামের একটি শি‘য়ার বা মহান
নিদর্শন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ كَانَ لَهُ
سَعَةٌ، وَلَمْ يُضَحِّ،
فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا ‘যে কুরবানী করার সামর্থ্য
থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না
আসে’। অন্যত্র তিনি বলেছেন,إِذَا رَأَيْتُمْ هِلَالَ
ذِي الْحِجَّةِ، وَأَرَادَ
أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ،
فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعْرِهِ
وَأَظْفَارِهِ ‘তোমাদের মাঝে যে কুরবানী করতে চায়, যিলহজ্জ
মাসের চাঁদ দেখার পর সে যেন তার কোন চুল ও নখ না কাটে’।
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, এই
হাদীছে প্রমাণ আছে যে, কুরবানী দেওয়া ওয়াজিব নয়।
এই হাদীছে রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী ‘যে কুরবানী করতে চায়’ দ্বারা সেটা প্রমাণিত হয়।
যদি কুরবানী করা ওয়াজিব হ’ত তাহ’লে এভাবে বলা হ’ত ‘তাহ’লে সে যেন কুরবানী না দেয়া
পর্যন্ত নিজের চুল প্রভৃতি স্পর্শ না করে’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর উম্মতের মাঝে যারা
কুরবানী করেনি তাদের পক্ষ থেকে কুরবানী করেছেন। সুতরাং এটি ওয়াজিব নয় যে, যেকোন
মূল্যে প্রত্যেককে কুরবানী করতেই হবে। লোকেরা যাতে এটাকে ওয়াজিব মনে না করে, সেজন্য
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হযরত আবুবকর ছিদ্দীক,
ওমর
ফারূক, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর ও আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) প্রমুখ
ছাহাবীগণ কখনো কখনো কুরবানী করতেন না।
সুতরাং বোঝা গেল, কুরবানী
দেওয়া ওয়াজিব নয়; বরং সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।
অপরদিকে ঋণ পরিশোধ করা ওয়াজিব। আর উছূলে ফিক্বহের মূলনীতি হ’ল সুন্নাতের উপর
ওয়াজিব প্রাধান্য পাবে। অতএব ঋণ থাকলে আগে সেটা পরিশোধ করতে হবে। শায়খ উছায়মীন
(রহঃ) বলেন,أما العاجز الذي
ليس عنده إلا
مؤنة أهله أو
المدين، فإنه لا
تلزمه الأضحية، بل
إن كان عليه
دين ينبغي له
أن يبدأ بالدين
قبل الأضحية ‘ঋণগ্রস্ত
ব্যক্তি অথবা পরিবারের ভরণ-পোষণের ব্যয়ভার বহনে অক্ষম ব্যক্তির উপর কুরবানী অবশ্যক
নয়; বরং তার উপর যদি ঋণ থাকে, তাহ’লে
কুরবানীর পূর্বে সেই ঋণ পরিশোধ করা যরূরী’। তবে দাতার সম্মতিতে ঋণ দেরীতে পরিশোধ
করে কুরবানী দেওয়ায় কোন বাধা নেই। ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহঃ) বলেন,وَيُضَحِّي
الْمَدِيْنُ إذَا لَمْ
يُطَالَبْ بِالْوَفَاءِ وَيَتَدَيَّنُ وَيُضَحِّي
إذَا كَانَ لَهُ
وَفَاءٌ....إنْ كَانَ
لَهُ وَفَاءٌ فَاسْتَدَانَ مَا
يُضَحِّي بِهِ فَحَسَنٌ
وَلَا يَجِبُ عَلَيْهِ
أَنْ يَفْعَلَ ذَلِكَ ‘দাতা যদি পরিশোধের তাগাদা
না দেয়, তাহ’লে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিও কুরবানী দিতে পারে। আর সাময়িক
অসচ্ছল ব্যক্তি যদি ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা রাখেন,
তাহ’লে
তিনিও ঋণ করে কুরবানী দিতে পারেন। তবে পরিশোধ করার সামর্থ্য থাকলেও ঋণ করে কুরবানী না করাই
উত্তম। কেননা এটা অবশ্যক নয় যে, তাকে কুরবানী করতেই হবে’।
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির যাকাতুল ফিৎরঃ
স্বাধীন-ক্রীতদাস, ছোট-বড়
সকল পুরুষ ও নারীর উপর মাথা পিছু এক ছা‘ সমপরিমাণ যাকাতুল ফিৎর আদায় করা ফরয। এই যাকাত ফরয হওয়ার জন্য
নিছাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া শর্ত নয়। যেহেতু যাকাতুল ফিৎর ব্যক্তির উপর ফরয; ব্যক্তির
সম্পদের উপরে নয়। কারণ সকল প্রকার যাকাতের মূল উৎস হ’ল সম্পদ। পক্ষান্তরে
ছাদাক্বাতুল ফিৎরের মূল উৎস হ’ল ব্যক্তি। সেই জন্য ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকলকে এই
পরিমাণে যাকাতুল ফিৎর আদায় করতে হয়।
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির হজ্জের বিধানঃ
ঋণ পরিশোধ করলে যদি হজ্জের সামর্থ্য না থাকে, তবে
তার উপর হজ্জ ফরয নয়। এমতাবস্থায় তার ঋণ পরিশোধ করা ফরয। আর যদি ঋণ পরিশোধ করেও
হজ্জ করার সামর্থ্য থাকে, তাহ’লে ঋণ শোধ না করে হজ্জ
করলেও হজ্জ হয়ে যাবে। অবশ্য ঋণ পরিশোধ করে হজ্জে যাওয়াই উত্তম। কেননা তা পরিশোধ
ব্যতীত মৃত্যুবরণ করলে হাশরের মাঠে নিজের নেকী দিয়ে ঋণের দাবী পূরণ করতে হবে।
ঋণ থেকে বাঁচার উপায়ঃ
ঋণের বোঝা মানুষের দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে
অন্ধকার ডেকে আনে। সেকারণ সাধ্যানুযায়ী ঋণ মুক্ত থাকা উচিত। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব
(রাঃ) বলেন,إِيَّاكُمْ وَالدَّيْنَ، فَإِنَّ
أَوَّلَهُ هَمٌّ وَآخِرَهُ
حَرْبٌ، ‘তোমরা ঋণ থেকে বেঁচে থাক, কেননা
ঋণের শুরু দুশ্চিন্তা দিয়ে এবং শেষ হয় সংঘাতের মাধ্যমে’। এক্ষণে ঋণ থেকে বাঁচার কতিপয় উপায় নিম্নে
বর্ণনা করা হ’ল-
১. অল্পে তুষ্ট থাকাঃ
সুখী জীবন লাভের প্রধান উপায় দু’টি-
তাক্বদীরের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও অল্পে তুষ্টি। অল্পে তুষ্ট ব্যক্তি কখনো হতাশ হয়
না এবং অধিক পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাকে দুনিয়ার প্রতি আসক্ত করতে পারে না। তাই ঋণ থেকে
বাঁচার অন্যতম উপায় হ’ল আল্লাহ প্রদত্ত নে‘মতে তুষ্ট থাকা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
বলেছেন, وَارْضَ بِمَا
قَسَمَ اللهُ لَكَ
تَكُنْ أَغْنَى النَّاسِ،
‘আল্লাহ তোমার তাক্বদীরে যতটুকু বণ্টন করেছেন, তার
প্রতি তুষ্ট থাক, তাহ’লে মানুষের মাঝে
সবচেয়ে বড় ধনী হ’তে পারবে’। তিনি আরো বলেন,لَيْسَ الغِنَى عَنْ
كَثْرَةِ العَرَضِ، وَلَكِنَّ
الغِنَى غِنَى النَّفْسِ،
‘পার্থিব সম্পদের আধিক্য হ’লে ধনী হওয়া যায় না, বরং
মনের ধনীই প্রকৃত ধনী’। অন্যত্র তিনি বলেন,
قَدْ أَفْلَحَ مَنْ
أَسْلَمَ، وَرُزِقَ كَفَافًا،
وَقَنَّعَهُ اللهُ بِمَا
آتَاهُ ‘ঐ ব্যক্তি সফল হয়েছে, যে
ইসলাম গ্রহণ করেছে, তাকে প্রয়োজন মাফিক রিযিক
দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট রেখেছেন’। অল্পে তুষ্ট হৃদয় মানুষকে
সবসময় ঋণমুক্ত জীবনের দিকে আহবান জানায়।
২. উঁচু শ্রেণীর লোকদের দিকে না তাকানোঃ
ঋণ থেকে বাঁচার আরেকটি উপায় হ’ল উঁচু শ্রেণীর
লোকদের দিকে না তাকিয়ে সবসময় নীচু শ্রেণীর লোকদের দিকে তাকানো। কারণ আজকের সমাজে
অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ উচ্চাভিলাষী লোকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ঋণ করে থাকে।
সেজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,انْظُرُوْا إِلَى مَنْ
هُوَ أَسْفَلَ مِنْكُمْ،
وَلَا تَنْظُرُوْا إِلَى
مَنْ هُوَ فَوْقَكُمْ، فَإِنَّهُ
أَجْدَرُ أَنْ لَا
تَزْدَرُوْا نِعْمَةَ اللهِ
عَلَيْكُمْ، ‘তোমরা নিজেদের অপেক্ষা নিমণ পর্যায়ের লোকদের
দিকে তাকাও। এমন ব্যক্তির দিকে তাকাবে না,
যে
তোমাদের চেয়ে উচ্চ পর্যায়ের। যদি এই নীতি অবলম্বন কর, তাহ’লে
আল্লাহর নে‘মত তোমাদের কাছে ক্ষুদ্র মনে হবে না’।
তবে দুনিয়াবী কোন জেŠলুস দেখে মুগ্ধ হওয়া
অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেই পার্থিব চাকচিক্যে নিজেকে ডুবিয়ে দেওয়া ও আত্মনিয়োগ করা
মানুষকে আখেরাত বিমুখ করে দেয়। সেজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দুনিয়াবী কোন কিছু দেখে
বিমুগ্ধ হ’লে বলতেন, لَبَّيْكَ إنَّ العَيشَ
عَيشُ الآخِرَةِ ‘হে
আল্লাহ! আমি তোমার দরবারে হাযির! আখেরাতের জীবনই তো প্রকৃত জীবন’। শায়খ উছায়মীন
(রহঃ) বলেন, ‘এর কারণ হ’ল মানুষের হৃদয়
সব সময় দুনিয়াবী সৌন্দর্যের দিকে ঝুঁকে থাকে এবং পার্থিব মোহ তাকে আল্লাহর আনুগত্য
থেকে বিমুখ করে রাখে। তাই রাসূল (ছাঃ) এই বাক্যটি পাঠ করতেন, যাতে
তাঁর হৃদয় আখেরাতমুখী হয়।
একটু ভেবে দেখুন- যার নিকটে দুনিয়াবী এই
বর্ণাঢ্য জীবনোপকরণ দেখতে পাচ্ছেন,
এই
আয়েশী জীবন একদিন তার কাছ থেকে বিদায় নিবে অথবা সেই ব্যক্তি তার দুনিয়াবী ভোগ্য
সামগ্রী থেকে চির বিদায় নিয়ে কবরে চলে যাবে। কারণ দুনিয়াবী জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং
আখেরাতের জীবন চিরস্থায়ী। তবুও দুনিয়াবী সৌন্দর্য এবং কারো গাড়ী-বাড়ী, রঙমহল
ও বিলাসী জীবন যদি আপনাকে মুগ্ধ করে এবং এর প্রতি আপনাকে আগ্রহী করে তোলে, তাহ’লে
আপনি রাসূল (ছাঃ)-এর শেখানো এই বাক্যটি পাঠ করে মনকে শুনিয়ে দিন ‘লাববাইক! ইন্নাল আয়শা আয়শুল আখেরাহ’। দেখবেন মহান আল্লাহ এই বাক্যের মাধ্যমে আপনার
হৃদয়কে দুনিয়া বিমুখ করে দিয়েছেন এবং আপনার মনটাও পরিতৃপ্তি দ্বারা ভরপুর হয়ে
গেছে’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শিখানো এই পদ্ধতি কিছুটা হ’লেও
আমাদেরকে দুনিয়া বিমুখ হ’তে প্রণোদনা যোগাবে এবং ঋণ করার প্রবণতা থেকে রক্ষা করবে।
৩. বেশী বেশী দান করাঃ
সচ্ছলতা লাভের অন্যতম বড় উপায় হ’ল সাধ্যমত
বেশী বেশী দান-ছাদাক্বাহ করা। কারণ দানের মাধ্যমে আল্লাহ বান্দার সম্পদ বৃদ্ধি করে
তাতে বরকত দান করেন এবং তার অভাব দূর করে দেন। আবূ কাবশা আল-আনমারী (রাঃ) হ’তে
বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছেন যে, তিনি
বলেছেন, ‘আমি তিনটি বিষয়ে শপথ করছি এবং সেগুলোর ব্যাপারে তোমাদেরকে
বলছি। তোমরা এগুলো মনে রাখবে। তিনি বলেন,
مَا نَقَصَ
مَالُ عَبْدٍ
مِنْ صَدَقَةٍ،
وَلَا ظُلِمَ
عَبْدٌ مَظْلِمَةً
فَصَبَرَ عَلَيْهَا
إِلَّا زَادَهُ
اللهُ عِزًّا،
وَلَا فَتَحَ
عَبْدٌ بَابَ مَسْأَلَةٍ إِلَّا
فَتَحَ اللهُ عَلَيْهِ بَابَ فَقْرٍ-
(১) দান-ছাদাক্বাহ করলে কোন
বান্দার সম্পদ হ্রাস পায় না। (২) কোন বান্দার উপর যুলুম করা হ’লে সে যদি তাতে
ধৈর্য ধারণ করে, তাহ’লে আল্লাহ তা‘আলা
অবশ্যই তার সম্মান বাড়িয়ে দেন। (৩) কোন বান্দা ভিক্ষার দরজা খুললে অবশ্যই আল্লাহ
তা‘আলা তার অভাবের দরজা খুলে দেন’। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন,أَعَزُّ الْأَشْيَاءِ ثَلَاثَةٌ:
الْجُوْدُ مِنْ قِلَّةٍ،
وَالْوَرَعُ فِيْ خَلْوَةٍ،
وَكَلِمَةُ الْحَقِّ عِنْدَ
مَنْ يُرْجَى أَوْ
يُخَافُ، ‘তিনটি বিষয় সবচেয়ে দামী। ক. অল্প থাকা
সত্ত্বেও দান করা। খ. নির্জনে আল্লাহকে ভয় করা। গ. কারো কাছে কিছু পাওয়ার বা
হারানোর আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও তার সামনে হক্ব কথা বলা’।
সুতরাং দানের মাধ্যমে কখনো সম্পদ কমে যায় না।
বরং এর মাধ্যমে আমাদের সম্পদ বরকতমন্ডিত হয়। আল্লাহ বলেন, قُلْ
إِنَّ رَبِّيْ يَبْسُطُ
الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ
مِنْ عِبَادِهِ وَيَقْدِرُ
لَهُ وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ
شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ
وَهُوَ خَيْرُ الرَّازِقِيْنَ، ‘বল,
নিশ্চয়ই
আমার রব তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা রিযিক প্রশস্ত করেন এবং সংকুচিত
করেন। তোমরা যা কিছু আল্লাহর জন্য ব্যয় কর,
তিনি
তার প্রতিদান দিবেন এবং তিনিই উত্তম রিযিকদাতা’ (সাবা ৩৪/৩৯)।
৪. ঋণ থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়াঃ
ঋণ থেকে পরিত্রাণ লাভের সবচেয়ে বড় উপায় হ’ল
ঋণ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা এবং ঋণ থেকে মুক্তি লাভের দো‘আ করা।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বয়ং ঋণ থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর
রাসূল (ছাঃ) প্রত্যেক ছালাতে আল্লাহর কাছে গুনাহ এবং ঋণ হ’তে পানাহ চাইতেন। একজন
প্রশ্নকারী বলল, (হে আল্লাহর রাসূল)! আপনি
ঋণ হ’তে এত বেশী বেশী পানাহ চান কেন?
তিনি
জবাবে বলেন,إِنَّ الرَّجُلَ إِذَا
غَرِمَ حَدَّثَ فَكَذَبَ،
وَوَعَدَ فَأَخْلَفَ ‘মানুষ
ঋণগ্রস্ত হ’লে যখন কথা বলে মিথ্যা বলে এবং ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে’।
একদিন এক ক্রীতদাস আলী (রাঃ)-এর কাছে এসে বলল, আমি
আমার মনিবের সাথে সম্পদের লিখিত চুক্তির মূল্য পরিশোধ করতে পারছি না, আমাকে
সাহায্য করুন। উত্তরে আলী (রাঃ) বললেন,
আমি
কি তোমাকে এমন কিছু বাক্য শিখিয়ে দেব,
যা
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে শিখিয়েছেন?
এই
দো‘আর মাধ্যমে যদি তোমার উপর পাহাড়সম ঋণের বোঝাও থাকে, আল্লাহ
তা পরিশোধের ব্যবস্থা করে দিবেন। তুমি পড়,اللَّهُمَّ اكْفِنِيْ بِحَلَالِكَ عَنْ
حَرَامِكَ وَأَغْنِنِيْ بِفَضْلِكَ
عَمَّنْ سِوَاكَ، ‘আল্ল-হুম্মাক্ফিনী বিহালা-লিকা ‘আন্
হারা-মিকা, ওয়া আগ্নিনী বিফায্লিকা ‘আম্মান্ সিওয়াক’ (অর্থ-
হে আল্লাহ! তুমি আমাকে হালাল [জিনিসের] সাহায্যে হারাম থেকে বাঁচিয়ে
রাখ এবং তুমি
তোমার রহমতের
মাধ্যমে
আমাকে পরমুখাপেক্ষী হ’তে রক্ষা করো)।
আনাস (রাঃ) বলেন, আমি
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রায়ই বলতে শুনতাম,اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوْذُ
بِكَ مِنَ الهَمِّ
وَالحَزَنِ، وَالعَجْزِ وَالكَسَلِ، وَالبُخْلِ
وَالجُبْنِ، وَضَلَعِ الدَّيْنِ،
وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ ‘আল্লা-হুম্মা ইন্নী আঊযুবিকা মিনাল হাম্মি, ওয়াল হাযানি,
ওয়াল
‘আজযি, ওয়াল কাসালি, ওয়াল বুখলি,
ওয়াল
জুবনি, ওয়া যলাইদ্ দাইনি, ওয়া গলাবাতির্ রিজাল’ (হে
আল্লাহ! আমি তোমার কাছে, অস্বস্তি, দুশ্চিন্তা, অক্ষমতা, অলসতা, কৃপণতা, ভীরুতা, ঋণের
বোঝা এবং মানুষের জবরদস্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি)।
ঋণ খেলাপিরা সাবধানঃ
আমাদের সমাজের একশ্রেণীর প্রভাবশালী
ব্যক্তিবর্গ ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করছেন না। সরকারও তাদের
ব্যাপারে শিথিলতা প্রদর্শন করছেন। ফলে ঋণদুর্বৃত্তদের অপকর্মের খেসারত গুণতে হচ্ছে
গোটা জাতিকে। বলা চলে, দেশের ব্যাংকিং খাতে
ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে,
যার
জন্য দায়ী কিছু বড় ব্যবসায়ী। তারা ব্যাংক থেকে নানা কৌশলে ঋণ নিচ্ছেন। কিন্তু আর
ফেরত দিচ্ছেন না। আর এ বড় ঋণখেলাপির কারণে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের
পাহাড় জমে গেছে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে গত মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে
খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১০ হাযার ৮৭৪ কোটি টাকা। তিন মাস আগে অর্থাৎ ডিসেম্বরে
এ ঋণ ছিল ৯৩ হাযার ৯১১ কোটি টাকা।
চলতি বছরের শুরুতে অর্থমন্ত্রী ঋণখেলাপিদের
বিশেষ সুযোগ দেয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন
অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে দেশের
ব্যাংক খাতের ঋণ বিতরণ ৯ লাখ ৩৩ হাযার ৭২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে মোট ঋণের ১১ দশমিক
৮৭ শতাংশই খেলাপি।
ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারী
ব্যাংকগুলোর পরিচালকেরা নিজেদের মধ্যে ঋণ আদান-প্রদান করছেন। যে উদ্দেশ্যে এসব ঋণ
নেয়া হচ্ছে, তার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে
না। ঋণের অর্থ পাচারও হচ্ছে। এর সাথে জড়িয়ে পড়েছেন ব্যাংকের কিছু ঊর্ধ্বতন
কর্মকর্তাও। ফলে খেলাপি ঋণের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ
উদ্দিন আহমেদ বলেন, মূলতঃ দু’টি কারণে খেলাপি
ঋণ বেড়ে গেছে। একটি খেলাপিদের বিশেষ সুযোগ দেয়া এবং অপরটি দুর্নীতিগ্রস্তদের
বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়া।
এভাবে বর্তমান বিশ্ববাযারের ঋণ খেলাপিরা
হক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকার নষ্ট করে চলেছেন। যথাযথ আইনের অনুশাসন এবং দ্বীন
বিমুখীতাই এই লাগামহীন ঋণ খেলাপির মূল কারণ। আমাদের স্মরণ রাখা উচিত, হক্কুল
ইবাদ নষ্টকারীকে আল্লাহ ক্ষমা করেন না। আর জনগণের সম্পদ লুট করার পরিণাম আরোও
ভয়াবহ। দুনিয়াতে এই ঋণ পরিশোধ না করলে,
আখেরাতে
অবশ্যই তা পরিশোধ করতে হবে- নিজের নেকী প্রদান বা অন্যের গুনাহ গ্রহণের মাধ্যমে।
তাই অচিরেই বান্দার অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে তওবাহ করা আবশ্যক এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে
আল্লাহকে ভয় করা অপরিহার্য। নইলে আল্লাহর কঠোর শাস্তি থেকে কেউ আমাদেরকে রক্ষা
করতে পারবে না।
উপসংহারঃ
ঋণ একটি ভয়াবহ বিষয়। ঋণের কারণে শহীদ
ব্যক্তিও জান্নাতে প্রবেশ করতে বাধাগ্রস্ত হয়। সেকারণ ব্যক্তিগত ও সামাজিক
লেনদেনের ক্ষেত্রে সদা সতর্ক থাকা যরূরী। কোন মুনাফার উদ্দেশ্য ছাড়া মুসলিমকে ঋণ
প্রদানের মাধ্যমে সাহায্য করা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। অপরদিকে ঋণ গ্রহণ ইসলামী শরী‘আতে অনুমোদিত
হ’লেও, তা পরিশোধ করা ওয়াজিব। আর ঋণ পরিশোধ না করা আত্মসাৎ করার
শামিল। অপরিশোধিত ঋণের কারণে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি কবরে ও আখেরাতে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে।
কেননা ইচ্ছাকৃতভাবে দেনা শোধ না করা কবীরা গুনাহ এবং হক্কুল ইবাদ নষ্ট করার
নামান্তর। সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) হক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকার নষ্ট করার ভয়াবহতা
বর্ণনা করে বলেন, ‘বান্দার সাথে সম্পর্কিত
একটি পাপ নিয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করার চেয়ে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত সত্তরটি পাপ
নিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাত করা তোমার জন্য অধিকতর সহজ’। ইসলামী শরী‘আত ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ করার
ক্ষেত্রে যেসব নীতিমালা প্রনয়ণ করেছে,
সেই
নীতিমালা অনুযায়ী একজন মুসলিম ঋণ গ্রহণ করবে এবং তা পরিশোধ করবে। তাই আমরা ঋণের
মাধ্যমে যেমন মানব সেবায় এগিয়ে আসব,
তেমনি
কখনো ঋণগ্রস্ত হ’লে সেই ঋণ পরিশোধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করব। মহান আল্লাহ আমাদেরকে
ছোট-বড় সকল প্রকার ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত রাখুন এবং ঋণমুক্ত অবস্থায় পূর্ণ মুমিন
হিসাবে তাঁর সাথে সাক্ষাত লাভের তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!
প্রবন্ধটির সাইজের পিডিএফ ডাউনলোড করার জন্য এখানে ক্লিক করুন।
No comments:
Post a Comment
আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।