(শহীদ মাওলানা নিজামী স্মরণে তার ছেলে কর্তৃক স্মৃতিচারণমূলক লিখনি)
১ম পর্বঃ
আব্বুকে ইলেকশনের ঝামেলার মধ্যে রেখে পড়াশুনার উদ্দেশ্যে
যে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে ছিলাম ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। দশ বছর পরে ২০১০ সালের মার্চ মাসে আবার ফিরে
এলাম আব্বুর কাছে আরেক মহা ঝামেলার মাঝে। ২০১৬ সালের মে মাসের ১১ তারিখে বহুবছর
আগে দেখা আব্বুর স্বপ্নটা সত্য হল। আমাকে মহা ঝামেলার এই
দুনিয়ায় ফেলে আব্বু আল্লাহর কাছে চলে গেলেন। মানুষের সাথে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়টি ভাষায় ব্যক্ত করাটা এমনিতেই
কঠিন। আর আমার মত আনাড়ী লেখকের পক্ষে সেটা একটা অসম্ভব ব্যাপার
হয়ে দাড়িয়েছে। অনেকেই বলেছেন আব্বুকে নিয়ে কিছু লিখতে, বহু
বার চেষ্টা করেছি কিছু লিখব, কিন্তু লিখতে বসলে হাত
থেমে যায়, মনের বাস্পে চোখ ঝাপসা
হয়ে যায়। আজও যখন লিখছি, চোখের জলেই লিখছি। তাই
হয়ত লেখাটা এলেবেলে টাইপের হতে পারে। সুতরাং পাঠকদের কাছ থেকে আগাম ক্ষমা চেয়ে
নিচ্ছি। আব্বুর সাথে আমার সম্পর্কটা কিরকম ছিল সেটা কোন দিনও হয়ত আমার পক্ষে সঠিক
ভাবে ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব হবেনা। তিনি ছিলেন আমার পিতা, নেতা, শিক্ষক
এবং আরও অনেক কিছু। আব্বু অনেক গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন, আমি
সেটা পারিনা। কিন্তু আমার আর আব্বুর মাঝে একটা মিল হল আমরা দুই জনেই কম কথা বলার
মানুষ। আব্বু কথা না বলেও অনেক কিছু বুঝাতে পারতেন, উনার
চোখের একটা ভাষা ছিল, অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তিনি
মাঝে মাঝে তাকিয়ে থাকতেন, সেই দৃষ্টি আমাকে ভরসা দিত, প্রেরনা
দিত, আরেকটা দিন লড়াই করার সাহস যোগাত। ছোট বেলা থেকেই আমি
অল্পতে মন ভেঙ্গে যাওয়া, হাল ছেড়ে দেয়া ছেলে, আব্বুর
না বলা চোখের ভাষা, মনের কথা ছোট বেলা থেকে
শুরু করে বড় বেলা পর্যন্ত, এমনকি চোদ্দশিকের ওপার
থেকেও বারে বারে ঘুরে দাড়াবার শক্তি যোগাত। মনে পড়ে আওয়ামী জুলুমতন্ত্রের বৈরী
পরিবেশেও আল্লাহর রহমতে অনেকটা নির্বিঘ্নে জজকোর্ট আর হাইকোর্টে এডভোকেট হিসাবে
নিবন্ধিত হলাম। আব্বু জেলে বসেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন আর বললেন, ‘প্রতিদিন শেষ রাতে তোদের সব ভাইবোনের জন্য নাম ধরে দুআ করি’। আমি তো
জানতামই আব্বু আমাদের জন্য প্রতিদিন শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুত
নামাযের পড়ে দোআ করেন, ছোট বেলায় কতদিন শেষ রাতে
আব্বুর কুরআন তেলাওয়াতের শব্দে, অনুচ্চ কান্নামিশ্রিত
দোয়ার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেছে। আব্বুর শাহাদাতের সময় তাইতো এই স্বার্থপর আমি আমার
কি ক্ষতি হয়ে গেল সেই চিন্তায় ব্যস্ত ছিলাম। অতি চালাকে ভরা এ দুনিয়ায়, এই বোকাসোকা মোমেনের
দিকে কেও আর সেই মায়াভরা প্রশ্রয়ের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকবেনা, রবের
কাছে শেষ রাতে উঠে দুআ করবেনা, আমি চলবো কিভাবে? এটাই
আমার কাছে তখন বড় ভাবনার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছিল।
২য় পর্বঃ
ছোটবেলা থেকেই কিছু মানুষের অতি প্রত্যাশা আবার কিছু মানুষের ওকে দিয়ে কিছু হবেনা টাইপের আচরণ আমার জন্য বেশ ক্ষতির কারণ হয়েছে। আমার অংক আর আরবী নাহু সরফের শিক্ষকেরা আমার ব্যাপারে উচ্চ ধারনা পোষণ করলেও, ভাষা, সাহিত্যের শিক্ষকেরা বিশেষভাবে আরবী, ইংরেজী শিক্ষকেরা আমাকে অপদার্থ মনে করতেন। অতি তোষন, অতি প্রেষন, অতি প্রত্যাশা আর অতি নিরাশার যাতাকলের মাঝে আমার মনে হতো আব্বুই আমাকে সবচেয়ে বেশী ভাল বুঝতেন। কেউ আমার প্রশংসা করলে যেমন তিনি খুব বেশী খুশি হতেন না-ক্ষেত্র বিশেষে অখুশী হতেন, আবার কেউ আমার সম্পর্কে নেগেটিভ কিছু বললেও তিনি হতাশ হতেন না। টেবিল চাপড়ে, ঝাড়ি দিয়ে দুনিয়া উল্টে দেয়ার নীতিতে আব্বু বিশ্বাস করতেন না। অপ্রয়োজনীয় নীতি বাক্য দিয়ে কিছু বুঝানোর চেষ্টা করতেননা। মনের কথা আন্তরিকতা দিয়ে, চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিতেন। আবার প্রয়োজনে অল্প কথায় যা বলার বলতেন। যখন আমি ফাঁকি দিতাম-আব্বু বুঝতেন। কিন্তু সেভাবে বকা না দিয়ে বলতেন, ‘অভ্যাস খারাপ করিস না’। কেউ আমাদের আগ্রহ নিয়ে দেখতে চাইলে বলতেন, ওরা কি প্রদর্শনীর ঘোড়া? ছোটবেলায় আব্বুর বুকটা অনেক চওড়া মনে হতো। বুকের উপর কান লাগিয়ে শুয়ে হার্টবিটের শব্দ শুনতে খুব ভাল লাগত। আব্বুর সুঠাম দেহ, সুন্দর চেহারা, তেল দিয়ে আঁছড়ানে ঘন চুল দাড়ি, ভরাট কন্ঠ, মোটা চশমা, সাদা পানজাবী, শেরওয়ানি, উঁচু টুপি সবকিছুতেই একটা আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল। ক্লাস ত্রিতে পড়া ছোট্র আমি, আব্বুর মত হব বলে যখন মাদ্রাসায় পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, আব্বু অনেক খুশি হয়েছিলেন। আব্বুর চোখে মুখে খুশীর ঝলক আমার চোঁখে আজও ভাসে। ঘুরে ফিরে কয়েকবার শুধু একটা কথাই জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘তুই কি সত্যি সত্যিই মাদ্রাসায় পড়বি?’ কালের বিবর্তনে আমি বড় হতে লাগলাম আর দুনিয়ার কঠিন বাস্তবতা যখন একটু বুঝতে শুরু করলাম, হতাশা, নিরাশা আমাকে অন্য দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। আব্বু বিচলিত হতেন না, দরদ নিয়ে বলতেন, “সবকিছু ছেড়ে ভাল আলেম হওয়ার চেষ্টা করতো!” আবার কখন আমার দাদার গল্প, উনার নিজের জীবনের গল্প বলতেন। দাদা তার একমাত্র ছেলেকে আলেম বানাতে চেয়েছিলেন, দোয়া করতেন, আব্বু যেন রাসূল সা. এর ছায়া হয়ে বেড়ে উঠেন। আব্বুর মেধা দেখে লোকেরা আফসোস করত আর বলতো আহারে এত ভাল ছাত্রটা মাদ্রাসায় পড়ে ভবিষ্যত নষ্ট করে ফেলছে! আব্বুও এই সকল কথায় কিছুটা বিভ্রান্ত হওয়ার উপক্রম হলে দাদা আব্বুর মাদ্রাসায় গিয়ে আব্বুর সামনে উনার শিক্ষককে বললেন, আমার ছেলেকে বলে দিবেন, সে আমাকে কামাই করে খাওয়াক সেটা আমি চাই না। সে আমার একমাত্র ছেলে, আমার যা আছে সেটা দিয়ে তার চলে যাবে। আমি চাই সে যেন বড় আলেম হয়, রাসূলে ছায়া হওয়ার চেষ্টা করে। কখনওবা আব্বুর লাইব্রেরীর আরবী বইগুলোর দিকে তাকিয়ে কোন এর বিখ্যাত আলেমের গল্প বলতেন। যার ছেলেরা কেউ আলেম না হওয়ার কারণে শেষ বয়সে তার দুষ্প্রাপ্য আরবী বই গুলো মানুষদের মাঝে বিলি করে দিতে হয়েছিল। আবার কখনবা বলতেন উনার আরবী বইগুলোর যে সময়ের অভাবে যত্ন নেয়া হয় না, বেশী পড়া হয়না, এই কারণে তারা আল্লাহর কাছে বদ দোয়া করে কিনা! কখনোবা আরেক বিখ্যাত আলেমের গল্প শোনাতেন, যার ছেলে বাবার মত হতে চাইতো। কিন্তু তিনি বললেন, “বাবা আমিতো আলী রা. এর মত হতে চেয়ে হয়েছি এই আমি, তাই তুমি আমার মতো হতে চেয়ে আর কতই বা বড় হতে পারবে?” ছোট বেলায় কোন এক সময় আমার কবিতা লেখার বাতিক উঠল। বিষয়টা আব্বুর তেমন পছন্দ না হলেও তিনি আমাকে সরাসরি কিছু বললেন না। আব্বু আমার ভাইকে বললেন, মোমেন কে বলিস এই গুলোর পিছনে সময় বেশি নষ্ট না করতে। প্রসঙ্গক্রমে আব্বু তখন খালেদকে (আমার ভাই) উনার জীবনের কবিতা চর্চার গল্প বলেছিলেন। আব্বুও ইন্টারমিডিয়েটে (আলিমে) পড়ার সময় কবিতা চর্চা করতেন। কোন কারণে পরীক্ষায় অপেক্ষাকৃত খারাপ রেজাল্ট করায় দোষ পড়ল উনার সাহিত্য চর্চার উপর। আব্বুর বড় চাচা এই নিয়ে আব্বুকে বকা দিলে আব্বু উনার লেখা সব কবিতা একটা সুটকেসে ভরে নদীতে ফেলে দেন। আবার কখন আমি বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেললে আব্বু বিচলিত হতেন ঠিকই। মনে পড়ে ক্লাস টেনে উঠার পরে আমার সদ্য গজানো হালকা দাড়ি শেভ করায় আব্বু বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন। সেভাবে কিছু না বললেও বলেছিলেন, তোর চেহারার উজ্জলভাবটা নষ্ট হয়ে গেল। আবার আমার এই কাজের একটা ব্যাখ্যা নিজে নিজেই দাড় করাবার চেষ্টা করতেন। বলতেন, মোমেন হয়ত দাড়ি যাতে ভাল করে উঠে এই জন্য শেভ করেছে। আমি এর পরে আর কোনদিন দাড়ি শেভ করিনি।
৩য় পর্বঃ
সময় গড়িয়ে আমিও বড় হতে শুরু করলাম। আব্বুর চুল দাড়িগুলোও খুব
দ্রুত সাদা হয়ে গেল। প্রাকৃতিক নিয়মে আব্বু সাথে দুরত্ব তৈরী না হয়ে কিভাবে যেন
উনার আরও কাছে চলে এলাম। এই সময় আব্বু
একদিন স্বপ্ন দেখলেন যে, আমার মরহুম দাদা খুব দুর্বল হয়ে
গিয়েছেন আর আব্বু দুর্বল দাদাকে আমার কাছে রেখে হজ্জ্ব করতে চলে গেছেন। এই স্বপ্নের অর্থ সেই সময় বুঝতে না পারলেও
আব্বুর শাহাদাতের সময় ঠিকই বুঝতে পেরেছি। যাই
হোক বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেল, বড় ভাই পড়তে চলে গেলেন বিদেশে,
জমজ ভাইটিও ক্যাডেট কলেজের জীবন শেষ করে
বিদেশে পড়তে চলে গেল, ছোট ভাই বেশ ছোট। আমি আর আমার পিঠা-পিঠি ছোট বোনটি হয়ে গেলাম
আব্বু আম্মুর হাতের লাঠি। আব্বু মনের দিক দিয়ে সব সময়ই নরম ছিলেন। এই সময় আরও নরম হয়ে গেলেন। আম্মু চাইতেন এই অলস আমি দেশের বাইরে পড়তে যাই।
আব্বু কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আসলে আমার অন্য ভাইয়েরা তাদের নিজেদের উদ্যোগে স্কলারশীপ যোগার করে বিদেশে পড়তে গিয়েছিলেন, এ
বিষয়ে আব্বু খুব একটা রাজী ছিলেননা-নিম রাজী ছিলেন। তিনি চাইতেন আমরা সবাই যেন তার আশে পাশে থাকি। আব্বুর প্রশ্রয়ে ২০০১ সালে
কামেল পরীক্ষা দেয়া পর্যন্ত আমি আর কোথাও যাওয়ার কথা চিন্তা
করি নাই। ১৯৯৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত
সময়টা কঠিনই ছিল। সাংগঠনিক, পারিবারিক, শারিরিক অসুস্থতা সকল কিছু মিলে আব্বু আর
আমাদের পরিবারের জন্য ছিল কঠিন পরিক্ষার সময়। ।পিঠের ব্যাথায় আব্বু শয্যাশায়ী
হলেন। মরার উপর খরার ঘার মত আম্মুকে উনার
হাতেগড়া প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হল। আম্মুর চাকরীই ছিল আমাদের পরিবারের একমাত্র আয়ের
উৎস। বিপদে পরিবারের সবাই কাছাকাছি আসে,
আমিও আব্বুর আরও কাছে আসলাম। কম কথা বলা আব্বু উনার জীবনের অনেক কিছু আমার
সাথে শেয়ার করলেন। আব্বু প্রায় বছর খানেক শয্যাশায়ী ছিলেন।
এ সময় আমরা এক সাথে অনেক বই
পড়তাম, আব্বুর নিয়মিত অযিফাগুলো শিখলাম। একটার পর একটা বিপদ আসতেই থাকলো। আমার টিবি ধরা
পড়ল, আব্বুর চোখের ছানির অপারেশন হল, সেখানেও
সমস্যা দেখা দিল। বহু
চিকিৎসার পরেও শেষ পর্যন্ত এক চোঁখে আব্বু আর ভালভাবে দেখতে
পেতেননা। ব্যক্তিগত
ভাবে সেই সময়টাকে আমি অনেক কারণে ভূলে যেতে চাইব, কিন্তু সেই সময় আমি আব্বুর জীবনে সবর ও ইস্তিকামাতের যে বাস্তব রূপ কাছে
থেকে দেখেছি, উনার থেকে দ্বীনের মৌলিক বিষয়ের হাতে কলমে যে
শিক্ষা লাভ করেছি, সেটা আর অন্য কোন
ভাবে সম্ভব হতো কিনা জানি না।
৪র্থ পর্ব
২০০০ সালে আব্বু জামায়তের আমীর নির্বাচিত
হলেন, আর ২০০১
সালে চার দলীয় জোট বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসল। আব্বু আর মুজাহিদ চাচা গুরুত্বপূর্ণ ২টি মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পেলেন। অনেকের
কাছে সেই সময়টা বাংলাদেশে জামায়াতের জন্য স্বর্নযুগ বলে মনে
হত। কিন্তু আব্বু বলতেন বিপদ আসছে। আব্বুকে উনার নেতাকর্মীরা সেই সময়ের পরিস্থিতির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তরে বলতেন, ‘আমি যেন
পুলসিরাত পারি দিচ্ছি’। এই সময়ের বাস্তবতা
উপলব্ধি করতে হলে আমাদেরকে এর পটভূমি তথা বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের সামগ্রিক
ইতিহাসকে বুঝতে হবে। এর বিস্তারিত আলোচনা অন্য কোন সময় হয়ত
করা যাবে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে পটভূমিটা এরকম ছিল, কমিউনিষ্ট
রাশিয়া যখন মুসলিম বিশ্বে আদর্শিকভাবে বিস্তার লাভ করছিল, ইরাক,
মিশর সিরিয়া সহ অনেক দেশে বামপন্থীরা একে একে ক্ষমতা দখল করে ফেলেছিল,
পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতা তখন একান্ত বাধ্য
হয়েই বামপন্থীদের ঠেকাতে ইসলামপন্থীদের সাথে ঐক্য গড়ে তোলে। সৌদী আরব ও অন্যান্ন আরব রাষ্ট্র সমুহের
প্রত্যক্ষ সহায়তায় সারাবিশ্বে ইসলামপন্থীরা একটা অবস্থান
তৈরী করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম ছিলনা। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর পাশ্চাত্য
পুঁজিবাদী সভ্যতার একমাত্র আদর্শিক শত্রু হয়ে দাড়ায় ইসলাম তথা ইসলামপন্থীরা। ৯০ এর দশকে এই আদর্শিক লড়াইয়ের অংশ হিসাবে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে ২টি ভাবধারার উদ্ভব ঘটানো হয়। একটি হল জংগীবাদ, অন্যটি মডারেট ইসলাম। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল
ইসলামী মুভমেন্টকে লক্ষ্যচূত করা, ধ্বংস
করা। ৯০ এর দশকের পূর্বে যারা আফগানিস্তান বা অন্যান্ন দেশে
জিহাদে লিপ্ত ছিলেন, তাদের সাথে মুসলিম দেশ সমুহের ইসলামী
মুভমেন্ট সহ অধিকাংশ মুসলিম সরকারগুলোর একধরনের বোঝাপড়া ছিল। মুসলিম দেশ সমুহে
এই মুজাহিদ লিডাররা রাষ্ট্রিয় সম্মান লাভ করতেন। ৮০ এর দশকের শেষ দিকে আফগান মুজাহিদ নেতা
গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের বাংলাদেশ সফরের কথা মনে আছে, তাকে
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদ রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়েছিলেন। তখন এটাও একধরনের বুঝাপড়া ছিল যে, মুসলিম প্রধান রাষ্ট সমুহে ইসলাম প্রতিষ্টার কাজ সেই দেশের রাজনৈতিক নিয়ম
মেনেই চলবে। যার কারণে আমরা দেখি ৯০ এর দশকের আগে মুসলিম প্রধান দেশ সমুহে, শুধুমাত্র মিসর ছাড়া, কোথাও জংগীবাদের তেমন
অস্তিত্ব ছিলনা। কিন্তু হঠাৎ করে ৯০ এর
দশকে মুসলিম প্রধান দেশ সমুহে জংগীবাদের উত্থান ঘটে এবং দেশি
বিদেশী মিডিয়া সমুহে এদেরকে বিশাল কাভারেজ দেয়া শুরু হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম
ছিলনা। কিন্তু বাংলাদেশে এই জংগীবাদের
ফাঁদে মুলধারার ইসলামী আন্দোলনকে ফেলা সম্ভব হয় নাই। এর প্রধানতম শিকার হয় মুলত কওমী মাদ্রাসার কিছু
সরল সোজা ছাত্র শিক্ষকবৃন্দ। আমি সেই
সময়কার মাদ্রাসার ছাত্র হিসাবে দেখেছি, কিভাবে আফগান ফেরত
মুজাহিদদের বেশধরে, মাদ্রাসায় বিশাল অংকের ডোনেশনের লোভ
দেখিয়ে কিছু ভীনদেশী গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে বিভ্রান্ত
করত, জংগী ট্রেনিংয়ে উদ্বুদ্ধ করত। আল্লাহর রহমতে জামায়াত ও শিবিরের নেতৃবৃন্দ এই
ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক থাকায় জামায়াত শিবিরের কোন
জনশক্তি এই ষড়যন্ত্রে পা দেয় নাই।
ইসলামী আন্দোলনকে লক্ষ্যচূত করতে পাশ্চাত্য
পূঁজিবাদী গোষ্ঠির আরেকটি উদ্যোগ ছিল মডারেট
ইসলাম। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ইসলামী মুভমেন্টের একটা অংশ এই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেয়। তাত্ত্বীককভাবে এই মডারেট
ইসলামের উদ্দেশ্য ছিল প্রথমে ইসলামের সুপ্রতিষ্ঠিত কিছু নীতি
নৈতিকতার ব্যাপারে প্রশ্নের অবতারণা
করা, বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা। এক্ষেত্রে নারীর অধিকার, নারীর
ক্ষমতায়নের পশ্চিমা সস্তা স্লোগান গুলোকে ব্যবহার করা হয়। ২য় পর্যায়ে, ইসলামের সার্বজনীন
আদর্শগুলোকে পশ্চিমা মানবাধিকার, বাকস্বাধিনতা, গনতন্ত্র ইত্যাদি আদর্শের সমার্থক হিসাবে প্রচার করা
হয়। ৩য় পর্যায়ে এসে বলা হতে থাকে যে,
ইসলামের আদর্শগুলোকে ইসলামের নাম না নিয়েও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এই এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য মুসলিম স্কলারদেরকে পাশ্চাত্য বিশ্বে দাওয়াত দিয়ে
নিয়ে যাওয়া হত, বিভিন্ন সেমিনার সিম্পজিয়ামের আয়োজন করা হত।
দূঃখজনক ব্যাপার হল, বিশ্ব ইসলামী
আন্দোলনের একজন শীর্ষস্হানীয় ব্যক্তিত্ব প্রাথমিকভাবে এই
ফাঁদে পা দেন। কিন্তু পরবর্তীতে ২০০১ সালে নাইন ইলেভেনের পরিপ্রেক্ষিতে এই
চক্রান্তের স্বরূপ যখন তিনি বুঝতে পেরে পাশ্চাত্য শক্তির
ইসলামী আন্দোলন বিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন,
তখন তিনি পশ্চিমা বিশ্বের চক্ষুশুলে পরিণত হন।
মডারেট ইসলামের অন্যতম পুরোধা হওয়ার পরও এখন উনার পশ্চিমা বিশ্বে প্রবেশ নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের
জামায়াত ঘরণার ২জন বুদ্ধিজীবীকে আমেরিকায় ৯০ এর দশকের শুরুর
দিকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। যাদের একজনের হাতধরে
বাংলাদেশে মডারেট ইসলামের বিস্তার লাভ করে। অপরজন আমেরিকার নেতৃত্বে একটি নতুন বিশ্বব্যাবস্থা সৃষ্টির প্রচেষ্টার ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে
বিস্তারিত জানতে পেরে উদ্বিগ্ন হন, এ ব্যাপারে সংগঠনকে সতর্ক করেন। আব্বু এ
ব্যাপারে প্রথম থেকেই সতর্ক ছিলেন, উনার
কলিগদের অনেকে এ ব্যাপারে আব্বুকে নমনীয় হওয়ার পরামর্শ দিলেও
আব্বু ইসলামের মৌলিক বিষয়ে ছাড় না দেয়ার ব্যাপারে সবসময়
আপোষহীন ছিলেন। এক্ষেত্রে সংগঠনের মহিলা বিভাগের নেত্রী হিসাবে আম্মুর ভূমিকাও
ছিল উল্লেখযোগ্য। মাদ্রাসায়
পড়ুয়া ছাত্র হিসাবে আমিও অল্পবিস্তর আব্বু আম্মুর এই সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ
নিতাম। আম্মু এই দ্বীনের মৌলিক বিষয়ে অটল থাকার ব্যাপারে
বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার কারণে ষড়যন্ত্রমুলক ভাবে উনার
প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুল ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। আব্বুর
অনমনীয় মনোভাবের কারণে গোলাম আযম চাচার উপর একটি গোষ্ঠির
প্রচন্ড চাপ থাকা স্বত্বেও সংগঠনের ভিতরে মডারেট ইসলামের কিছুই বাস্তবায়ন করা
সম্ভব হয় নাই। কিন্তু দূঃখজনক হলেও সত্য যে, একটি দেশের
দুতাবাস ও এনজিওর সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রোগ্রামের মাধ্যমে
কিছু লোকেকে তারা ঠিকই বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়, যার পরিণতিতে আজকে একটি নতুন দলের উদ্ভব হয়েছে যাদের নেতাকর্মীরা একসময় ইসলামের জন্য
জীবন দিতে প্রস্তুত থাকলেও এখন দলের কাগজ পত্রে ইসলামের নাম নিশানা
পর্যন্ত রাখতে লজ্জা পান।
৫ম পর্ব
২০০১ সালে নাইন ইলেভেনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে
এই মডারেট ইসলাম প্রজেক্টে নতুন মাত্রা যোগ হয়। ইসলামের কিছু মৌলিক পরিভাষা, জিহাদ, শরিয়া আইন, এগুলোকে জংগীবাদের সমার্থক করে ফেলা হয়।
প্রেসিডেন্ট বুশ প্রকাশ্যে ঘোষনা দেয়, হয় তুমি আমাদের সাথে থাকবে, নতুবা শত্রু হিসাবে
পরিগনিত হবে। এ সময় ইসলামী দলগুলোকে তাদের অবস্থান পরিস্কার করতে ক্লিয়ার ম্যাসেজ দেয়া হয়। বাংলাদেশে জামায়াত ইসলামী ক্ষমতার অংশীদার হওয়ায় তাদের ব্যাপারে আলাদা ভাবে নজর দেয়া হয়। বাংলাদেশ সরকারের উপর আফগানিস্তান ও ইরাকের
অন্যায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য
প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু জামায়াত ও বেগম জিয়ার দৃঢ়তার কারণে এই চাপ উপেক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল। আব্বু সংসদে পরিষ্কার ভাষায় আমেরিকার
চাপিয়ে দেয়া এই ওয়ার অন টেররকে অন্যায় যুদ্ধ বলে সমালোচনা করেন।
মডারেট ইসলামপন্থীরা এসময় যে কোন মূল্যে পশ্চিমা বিশ্বকে
আস্থায় রাখার লক্ষে ইসলামী দলগুলোকে ব্যাপক আদর্শিক
সংস্কারের ব্যাপারে চাপ দিতে থাকে। এসময় পশ্চিমা স্টেক
হোল্ডাররা আব্বুকে বিভিন্ন মিটিংয়ে প্রায়ই প্রশ্ন করত, জামায়াত
ক্ষমতায় গেলে শরীয়া আইন কায়েম করবে কিনা। এক পর্যায়ে আব্বু সহ বিশ্ব ইসলামী
আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে লন্ডনে দাওয়াত দিয়ে এনে মডারেট ইসলামের সবক দেয়ার চেষ্টা
করা হয়। আব্বুর অবস্থান এক্ষেত্রে
পরিষ্কার ছিল, তিনি বলতেন, আমরা ইসলামী
রাজনীতি করি আল্লাহর আইন কায়েম করার জন্যই। কারও যদি এই বিষয়ে ভূল বুঝাবুঝি থেকে থাকে আমরা
সেটা দূর করার জন্য সংলাপে প্রস্তুত, কিন্তু
কারও ডিকটেশনে আদর্শকে জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত নই । আব্বু
এক্ষেত্রে একটা জিনিস বিশ্বাস করতেন এবং আমাদেরকে বলতেনও, তাগুতী
শক্তিকে যতই ছাড় দেয়া হোক তাদের পরিপূর্ন অনুসরণ না করা
পর্যন্ত তারা কখনই সন্তুষ্ট হবেনা (সূরা বাকারাঃ ১২০)। সুতরাং আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে তাদেরকে সন্তুষ্ট
করার চেষ্টার কোন মানে নেই।
আসলে হয়েছেও তাই। বিশ্বব্যাপি ইসলামী আন্দোলনের কিছু অংশ পশ্চিমা
শক্তিকে আস্থায় নেয়ার জন্য মডারেট ইসলামের প্রজেক্টকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখান করতে পারে নাই। আজকে তাদের ভাগ্যও জামায়াতের থেকে ভিন্নতর নয়, বরং ক্ষেত্র বিশেষে
আরও খারাপ। সুতরাং ইসলামই হল সমস্যা, যতক্ষণ পর্যন্ত এর নাম নিশানা আমাদের মধ্যে থাকবে ততক্ষন
পর্যন্ত তাগুতী শক্তির কাছে আমরা শত্রু হিসাবেই
পরিগণিত হব। আব্বু
এই বিষয়টিই উনার শেষকটি বছর বিভিন্ন লিখনী, বক্তৃতা বিবৃতির
মাধ্যমে বুঝাতে চেষ্টা করেছেন, যে আমরা
জংগীও না আমরা মডারেটও না। আমরা মধ্যমপন্থী ইসলামী দল,
আমরা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আল্লাহর জমীনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা
করতে চাই। এই পথে চলতে গিয়ে কিছু লোক টিকতে না পেরে ডানে বামে ছিটকে পড়বে,
কিছু লোক শাহাদাত বরন করবে, কিন্তু যারা শত
বাধা বিপত্তির মুখে আল্লাহর উপর ভরসা করে সবর ও ইস্তিকামাতের সাথে টিকে থাকতে
পারবে আল্লাহ তাদের হাতেই বিজয় পতাকা দান করবেন ইনশাআল্লাহ।
মডারেট ইসলামের উপর আব্বুর একটি আলোচনা এই
লিংকে দেখতে পারেন
৬ষ্ঠ পর্ব
আমার দেখা আব্বুর জীবনীটাকে চার ভাগে ভাগ করা
যেতে পারে। জ্ঞান হওয়া থেকে ৯৩/৯৪ সাল
পর্যন্ত আব্বু ছিল আমার কাছে
ডাসিং হিরো। আব্বুর চেহারা, দৈহিক
গড়ন, মাপা কিন্তু আকর্ষনীয়,
জ্বালাময়ী
বক্তৃতা দেয়ার যোগ্যতা, সংগঠনে
উল্কার মত উত্থান, নির্বাচনী এলাকায় উনার
আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা, সংসদের ভূমিকা, মাত্র
৩/৪ ঘন্টা ঘুমিয়ে সারাদিন কাজ আর অনেক সময় নিয়ে ইবাদত করার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা। সবকিছু মিলে সন্তান হিসাবে আমার
মত ১২/১৩ বছরের কিশোরের কাছে তিনি ছিলেন একজন পার্ফেক্ট হিরো। এর পরে এল গ্রহণের কাল। আব্বু শারিরিক ভাবে অসুস্থ হতে শুরু করলেন, পারিবারিক
ভাবে আমরা কিছু বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া শুরু করলাম। আন্দোলন,
সংগঠনে
আব্বুর সাথে সংখ্যাগরিষ্ট পলিসি মেকারদের
কিছু
বিষয়ে ভালই মতপার্থক্য
দেখা দিল। পরিশেষে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আব্বুও হেরে গেলেন, সংগঠনও
বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গেল। ১৬/১৭ বছর বয়সী আমি
হঠাৎ করেই বুঝতে শুরু করলাম আব্বুতো একজন মানুষও বটে। ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু করে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ছিল
আব্বুর জীবনের আরেকটি পর্ব।
যখন তিনি ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে আবার
উঠে দাড়িয়েছিলেন, শয্যাশায়ী অবস্থা থেকে উঠে
দাঁড়িয়ে সংগঠনের আমীর নির্বাচিত হলেন,
এমপি, মন্ত্রী
হলেন। যার একটা অংশে ২০০১ সাল পর্যন্ত আব্বুর পাশে থেকে দেখেছি শিখেছি, মানুষকে
নিজের দুর্বলতাকে, সীমাবদ্ধতাকে জেনে বুঝে, সেটা
অনুযায়ী পরিকল্পনা করে কিভাবে ভবিষ্যতের পথ তৈরী করে নিতে হয়। বিপদে কিভাবে আল্লাহর উপর ভরসা করে সবর করতে
হয়। হকের উপর অবিচল থেকে
বাতিলের মুকাবেলা করতে হয়। আব্বুর জীবনের
শেষ অধ্যায়টি ছিল
২০০৫-০৬ সালের দিকে অসুস্থতা। ২টি অপারেশন থেকে নিয়ে শাহাদাত পর্যন্ত। এ সময়ের একটা অংশে
২০১০ থেকে নিয়ে শাহাদাত পর্যন্ত আব্বুর অন্ধের যষ্ঠী আমি।
৭ম পর্ব
এই চারটি উত্থান পতনের অধ্যায়ে আমি আব্বুর ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আমলী জিন্দিগীতে কোন পরিবর্তন দেখতে পাইনি। যেকোন
পরিস্থিতিতে হকের উপর টিকে থাকা,
সবর
করা, দ্বীনের মৌলিক বিষয় গুলো ঠিক করার দিকে মনোযোগ দেয়া, সর্বপরি
আল্লাহর কাছে ধরনা দেয়াটা ছিল আব্বুর জীবনের চালিকাশক্তি। এর কোন পরিবর্তন আব্বুর জীবনে আমার চোখে
পড়েনি। আব্বু মন্ত্রী থাকা অবস্থায়ও যেমন কখনো তাহাজ্জুদ নামাজ কাযা করতেন না, আবার জেলে যাওয়ার পরেও কাজা করতেন না। শত ব্যস্ততা, অস্থিরতার
মাঝেও আব্বুর নামাযে দাড়ালে উনার দুনিয়া থমকে দাড়াতো। নামাজে কখনো আব্বু
তাড়াহুড়ো করতেন না। আব্বু পিঠে ব্যাথার কারণে যে কয়
বছর শয্যাশায়ী ছিলেন, সে
সময় অন্য কোন কিছুর
চাইতে শুয়ে বসে নামায পড়ার বিষয়টা উনাকে বেশী কষ্ট দিত। কিছুটা সুস্থ হতেই আব্বু কষ্ট করে হলেও দাড়িয়ে
নামাজ পড়তেন, পরিপূর্ণ সেজদা দিতেন। জীবনের শেষ দিন গুলোতে বসা থেকে উঠতে গেলে মাথা
ঘুরত। কিন্তু কখন আব্বুকে বসে নামাজ পড়তে দেখিনি। নামাজের প্রতি আব্বুর আন্তরিকতা ছিল এমনই। আজও কানে বাজে নামাজে তেলাওয়াত করা আব্বুর
ফেভারেট আয়াতগুলো। একাগ্রচিত্তে তিনি প্রায়ই নামাযে পড়তেন, “ইয়া আইয়াতুহান নাফসুল মুতমাইন্নাহ, ইরজি’ই
ইলা রাব্বিকি রাদিয়াতাম মারদিয়্যাহ-হে প্রশান্ত আত্না, ফিরে
চল সন্তুষ্ট চিত্তে তোমার রবের দিকে।” আব্বুর কাছে শুনতে শুনতে এরকম কত আয়াত আমার
মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। একটু সময় পেলে আব্বু
সূরা আনআমের শেষ ক’টি আয়াত তেলাওয়াত করতেন,
“কুল
ইন্নানি হাদানি রাব্বি ইলা সিরাতিম মুসতাকিম…..বলো,
আমার
রব নিশ্চিত ভাবেই আমাকে সোজা পথ দেখিয়ে দিয়েছেন ৷ একদম সঠিক নির্ভুল দীন, যার
মধ্যে কোন বত্রুতা নেই,” এর পরবর্তী আয়াতের ঈমানের ঘোষনাটি আব্বু যখন বলিষ্ট
ভরাট কন্ঠে তেলাওয়াত করতেনঃ
কুল
ইন্না সালাতি ওয়া
নুসুকি ওয়া মাহইআ ইয়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন..
বল আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার
জীবন ও মৃত্যু সবকিছু আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জন্য, যার
কোন শরীক নেই,
এরই নির্দেশ আমাকে দেয়া হয়েছে এবং সবার আগে
আমিই আনুগত্যের শির নতকারী”।
আমার ক্লাস এইটের আরবী জ্ঞান দিয়েও এর
মর্মার্থ বুঝতে পারতাম। উপলব্দি করতে পারতাম অন্তরের কত গভীর থেকে
দৃঢ়তার সাথে এই ঘোষনাটি আব্বু করছেন। কুরআন শরীফের দোয়া সংশ্লিষ্ঠ
আয়াতগুলো, বিশেষভাবে সূরা আলে
ইমরানের শেষের দিকের দুআ গুলোও আব্বুর খুব প্রিয় ছিল। এই আয়াতগুলো পড়ার সময় আব্বু মাঝে মাঝে কেঁদে
ফেলতেন। বিশেষ করে যখন তেলাওয়াত
করতেনঃ রব্বানা
ওয়া আতিনা মা ওয়াদতানা আলা রুসুলিক…“হে আমাদের রব! তোমার রসূলদের
মাধ্যেমে তুমি যেসব ওয়াদা করেছো আমাদের সাথে, সেগুলো
পূর্ণ করো এবং কিয়ামতের দিন আমাদের লাঞ্ছনার গর্তে ফেলে দিয়ো না৷ নিঃসন্দেহে তুমি ওয়াদা
খেলাপকারী নও৷”
ইব্রাহীম আ. এর দুআ গুলো আব্বুর বিশেষ
ভাবে প্রিয় ছিল, এসংক্রান্ত সুরা আনআমের ৭৪
থেকে ৭৯ নম্বর আয়াতগুলো। সূরা ইব্রাহীমের শেষের দিকের আয়াতগুলো আব্বু নামাযের মাঝে
অনেক সময় তেলাওয়াত করতেন। নামাযের পর আব্বু লম্বা দুআ করতেন। মাসনুন দুআ মুখস্ত করাটা আব্বুর একটা অবসেশন
ছিল। আব্বু যখন ১৯৯৬-৯৭ দিকে শয্যাশায়ী। আব্বুকে কোন হাদীসের নতুন দুআ বের করে দিতে পারলে আব্বু
খুব খুশী হতেন। আমরা প্রতিযোগিতা করে তখন দুআ মুখস্ত করতাম। সেই সময়ই সম্ভবত
হিসনুল মুসলিম নামক মাসনুন দুআর বইটি বাজারে আসে। আমি বইটি আব্বুকে দিলে আমার আগেই
আব্বুর এর অধিকাংশ দুআ মুখস্ত করে ফেলেন। দুআ মুখস্তের ব্যাপারে আব্বুকে পিছনে ফেলা
আমার পক্ষে কখনই সম্ভব হয় নাই।
বিপদের দিনগুলোতে আব্বু মাঝে মাঝে আমাকে
কুনুতে নাযেলা পড়ার জন্য
ইমামতি করতে বলতেন।
সেই সময়গুলোতে দোয়া কতটুকু মুখস্ত করতে
পেরেছি তার একটা পরীক্ষা হয়ে যেত। আব্বু আমার ভুলগুলো নামাজের পরে সবার অগোচরে
সুন্দর করে ধরিয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে অনুযোগ করতেন-দোয়া গুলো ভালভাবে কেন
মুখস্ত করিনা। জীবনের শেষের দিকে জেলখানায় দেখা করতে গেলে আমাকে মাঝে মধ্যে দুআ পড়ে মাথায় ফু দিয়ে দিতে বলতেন, আবার
কখন কিছু দুআ লিখে দিয়ে বলতেনঃ তুইও পড়বি আর সবাইকে পড়তে বলবি।
৮ম পর্ব
রমাদান মাসের শেষ দশদিন ছিল আব্বুর কাছে
বিশেষ কিছু। দুনিয়ার সব ঝামেলা পিছনে ফেলে আব্বু এই সময়ে এতেকাফে বসে যেতেন, অধিকাংশ
সময়ে মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় অফিসের কাছের মসজিদটিতে বসতেন। আব্বুর এতেকাফের
সাথী হতেন মরহুম মকবুল আহমেদ চাচা,
ডাঃ
আব্দুস সালাম চাচা, মাজাহার চাচা, ফজলু
চাচার আব্বা, মুজিবুর রহমান চাচা ও আরও
অনেকে। এই সময়ে আব্বুর জন্য ইফতার নিয়ে যাওয়া,
আব্বুর
সাথে ইফতার করা আমাদের জন্য ছিল বিশেষ কিছু। একটু বড় হলে দু’একটি রাত আব্বুর সাথে
মসজিদে কাটাবার চেষ্টা করতাম। আব্বু তাফসীর করতেন আমরা শুনতাম।
সৌদী আরবে পড়তে যাওয়ার আগের বছর শেষবার
আব্বুর সাথে এক রমজানে রাত কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। আব্বু সূরা লোকমানের কয়েকটি
আয়াতের তাফসীর করেছিলেন আমাদের জন্য। যা ছিল হযরত লোকমানের তার সন্তানের প্রতি
নসিহত। মনে আছে আমরা তাওহীদ ও শিরক বিষয়ে অনেক আলোচনা করেছিলাম। আব্বু বললেন,
তাওহীদের বিষয় গুলো বুঝতে হলে মক্কী সুরা গুলা ভালভাবে পড়তে হবে। ঐ রাতে আমি নাস
ফালাকের তাফসীর তাফহীমুল কোরআন থেকে পড়েছিলাম।
আব্বু
রাব্বিন্নাস, মালিকিন্নাস ও
ইলাহিন্নাসের ব্যাপারে বেশ অনেক্ষণ আলোচনা করলেন। আল্লাহর বিশালত্ব তার সৃষ্টির
মাধ্যমে অনুধাবন করার গুরুত্ব বুঝাতে আমপারার আরও কতগুলো সূরা পড়তে বললেন। সেই
রাতটি আসলেই অনেক অর্থবহ আর শিক্ষনীয় ছিল আমারা জীবনে।
আব্বু কখনই সারারাত জেগে ইবাদত করতেন না। রাসূল
সা. এর সুন্নত অনুযায়ী কিছু সময় ঘুমিয়ে আবার উঠে ইবাদত করতেন। আমি ঘুমালে আর উঠতে
পারতামনা। আব্বু এটা পছন্দ করতেন না।
তিনি বলতেন, তাহাজ্জুদের
ট্রেনিংটাই হল ঘুম থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উঠতে পারার ট্রেনিং।
মানুষের জীবনের উত্থান পতনে মানুষের চিন্তা
চেতনায় আচার আচরণে আকাশ পাতাল পরিবর্তন খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু
বড় মানুষের, প্রকৃত ঈমানদাররের পরিচয়
পাওয়া যায় বিপদকালে তার চরিত্রে। প্রকৃত আদর্শবাদী মানুষ বিপদে পড়ে আদর্শের ব্যাপারে
হীনমন্যতায় ভোগে না। কিন্তু যাদের অন্তরে আদর্শ ঠিকভাবে শিকড় গড়তে পারেনাই, খারাপ
সময়ে তারাই চিন্তায় পড়ে যায়, আদর্শের ব্যাপারে সংশয়
আচ্ছন্ন হয়। আব্বু প্রায়ই বলতেন, যারা আন্দোলন থেকে ছিটকে
যায় দেখবি কোরআনের সাথে তাদের সম্পর্কের ঘাটতি আছে।
আব্বুদের জেনারেশনে যারা সংগঠনে যুক্ত হয়েছিলেন, তাদের
অধিকাংশই দ্বীন খুজতে গিয়ে, দ্বীনের পথে চলতে গিয়েই
সংগঠনেকে পেয়েছিলেন, যার কারণে সংগঠনকে উনারা
দ্বীনের চশমা দিয়ে দেখতেন। তৎপরবর্তী আমরা যারা জামাতী জেনারেশন, আমাদের
অনেকেই বিভিন্ন কারণে দ্বীনকে যেন সংগঠনের চশমায় দেখতে চেষ্টা করি। রাজনীতির
মাপকাঠিতে বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পাই। আব্বুর কাছে বিষয়টা কোরাআনের সাথে যথাযথ
সম্পর্কের ঘাটতির পরিণতি মনে হত।
৯ম পর্ব
রাসূল সা. এর হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি, ইসলাম
হল আন্তরিকার নাম। জিজ্ঞাস করা হল আন্তরিকতা কার জন্য? রাসূল
সা. বললেন, আল্লাহর জন্য, তার
কিতাবের জন্য, রাসূলের জন্য, নেতৃবৃন্দের
জন্য ও সাধারণ মুসলমানদের জন্য (সহীহ মুসলিম)।
আব্বুর জীবনে আমরা এই হাদীসের বাস্তব
প্রতিফলন দেখতে পাই। আমি ইতিপূর্বে স্মৃতিচারণ করেছি যে, আব্বুর
জীবনে নামাজের গুরুত্ব ছিল সবার উপরে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কখনই তিনি তাহাজ্জুদ
নামাজ কাযা করেননি। মনে পড়ে চট্রগ্রামে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা চলাকালে অনেক সময়
ধরে আব্বুর সাথে পাশাপাশি বসে গল্প করার সুযোগ হত। কোন এক প্রসংগক্রমে আব্বু
বলেছিলেন, তাহাজ্জুদ নামায সুন্নত হলেও
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য এটার গুরুত্ব ওয়াজিবের পর্যায়ের। আব্বুর ব্যক্তিগত একজন সহকারী বলতেন, স্যার
নামাজে দাড়ালে মনেই হয়না যে উনার কোন ব্যস্ততা আছে। নামাযের পরে লম্বা দুআ করা, কারণে
অকারণে আল্লাহর দরবারে ধরণা দিয়ে পড়ে থাকা ছিল আব্বুর অভ্যাস। আব্বুর ব্যক্তিগত
সহকারী সিদ্দিক চাচার মুখে শুনেছি, ৯০
এর দশকের শুরুর দিকে গোলাম আযম চাচার নাগরিকত্ব নিয়ে চলা সংকটের একপর্যায়ে
তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বুকে ফোনে জানায়, সরকার
সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে গোলাম আযম চাচাকে ইউরোপে পাঠিয়ে দিবে। আব্বু অভ্যাসবশতঃ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তার পরে বললেন, মতিন
সাহেব মনে রাখবেন আপনাদের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভত পরিস্থিতির দায়দায়িত্বও
আপনাদেরকেই নিতে হবে। আব্বু এর পরে সিদ্দিক চাচাকে বললেন, নামাযের জায়নামাযটি
বিছিয়ে দিতে আর আধাঘন্টার জন্য উনার অফিসের দরজাটা বন্ধ করে দিতে। তারপর আব্বু
নামাজে দাড়িয়ে গেলেন। দীর্ঘক্ষণ ধরে সেজদায় পড়ে থাকলেন। নামাজ শেষে তিনি অন্যান্য দায়িত্বশীলদেরকে
নিয়ে বসে পরবর্তী কর্মসূচী ঠিক করেন। আল্লাহর রহমতে জামায়াতের আদালতের ভিতরে ও
বাইরে যুগপৎ কর্মসূচীর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আর গোলাম আযম চাচাকে দেশের বাইরে
পাঠাতে সাহস করে নাই। আব্বুর সাংগঠনিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমি উনাকে এভাবেই
আল্লাহর উপর ভরসা করে মাঠে ময়দানে ভূমিকা রাখতে দেখেছি।
আব্বু বলতেনঃ দাদা
দোয়া করেছিলেন, আল্লাহ যেন আব্বুকে রাসূল
সা. এর ছায়া বানায়। আল্লাহ হয়ত দাদার দোয়া কবুল করেছিলেন। সেই জন্য আব্বুর সকল
কাজ কর্মে রাসূল সা. এর অনুসরণ করার একটা সচেতন
প্রচেষ্টা ছিল। আব্বু যখন সাইটিকায় আক্রান্ত হয়ে পিঠের ব্যথায় শয্যাশায়ী হলেন, তখন
তিনি এটা ভেবে সান্তনা পেতেন যে রাসূল সা. ও সাইটিকায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। আব্বুর কাছ থেকে তখন জেনেছি সাইটিকা রোগের একটা আরবী নাম
আছে (عرق النسا) যার বর্ণনা হাদীসে এসেছে। আব্বু জেলখানার
ভিতরে বসেও রাসূল সা. এর উপরে একটি বই লিখেছেন।
তিনি
বলতেন, কুরআনকে ভালভাবে বুঝতে হলে রাসূল সা. এর সীরাতকে ভালভাবে জানতে হবে। আর
রাসূলের সীরাতকে ভালভাবে জানতে হলে কুরআনকে ভালভাবে বুঝতে হবে। কেননা
হাদীসের ভাষায় ‘রাসূল সা: এর চরিত্রই ছিল কুরআন’। আব্বু কুরআনে বর্ণিত দুআ গুলো
নিয়মিত চর্চা করতেন। মাসনুন দুআ গুলো নিজেও পড়তেন আমাদেরকেও পড়তে উৎসাহীত করতেন।
আল্লাহর কিতাব ও রাসূল সা. এর প্রতি উনার মহব্বত ছিল
এমনই।
একইভাবে আব্বু এতবড় দায়িত্বশীল হওয়া স্বত্বেও
উনার সাংগঠনিক জীবনের দায়িত্বশীলদের প্রতি তার আন্তরিকতা ছিল অনুকরনীয়। আব্বুর
মুখে শুনেছি, আব্বু যখন ছাত্র সংগঠনের
সর্বোচ্চ পদে দায়িত্বপালন শেষে জামায়াতের একজন সাধারণ কর্মী হিসাবে কাজ শুরু
করলেন, অনেকেই আড়ালে আবডালে বলতেন এতবড় নেতা কি আর আমাদের কথা
শুনবে? কিন্তু আব্বু উনার আন্তরিকতা দিয়ে সকলের আস্থা অর্জন
করেছিলেন। আব্বুর এক ছাত্রজীবনের সাথী তার স্মৃতিচারণে
বলেছেনঃ উনার কাছে নেতা নিজামীর পরিচয় থেকে কর্মী নিজামীর পরিচয় অনেক বড়। আব্বুর
সংগঠনের সকল পর্যায়ের জনশক্তি সহ সাধারণ মানুষের প্রতি আন্তরিকতাও ছিল দৃষ্টান্ত
মুলক। আব্বু কার নাম কোনদিন ভূলতেন না। জীবনে একবার দেখা হলেও পরবর্তীতে তার নাম
চেহারা ঠিকই মনে করতে পারতেন। আব্বুর কাছে যখন আমাদের এলাকা থেকে কেউ দেখা করতে
আসতেন, আব্বু তাদের বাবা চাচাদের নাম ধরে তাদের খোঁজ খবর নিতেন। আমি মনে করি
মানুষকে মনে রাখার এই অদ্ভুত ক্ষমতা আব্বুর মানুষের প্রতি আন্তরিকতার কারণেই সম্ভব
হয়েছিল।
আব্বুকে দেখেছি দেশের কোথাও যদি গন্ডগোল বা
মারামারি হত, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে
যখন শিবিরের উপর হামলা হত, তিনি সারারাত ঘুমাতে
পারতেন না। পায়চারী করতেন আর কিছুক্ষণ পরপর ফোনে খবর নিতেন। আব্বুর সাথে ৯০ এর
দশকের শেষের দিকে উত্তরবঙ্গে রোড মার্চে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তখন দেখেছিলাম
রাত্রে বেলা ক্লান্ত হয়ে আমরা সবাই ঘুমিয়ে গেলেও আব্বু ঠিকই সতর্ক থাকতেন। একরাতে
বৃষ্টি শুরু হলে তিনি আমাদের সবাইকে ডেকে নিয়ে কর্মীদের খোঁজ খবর নিতে বের হন।
শহীদ কামারুজ্জামান চাচার মুখে সেদিন শুনেছিলাম, ৮০
এর দশকে আজিমপুরে শিবিরের কর্মী সম্মেলন হয়েছিল। সে
সময় মাঝ রাতে ঝড়ে প্যান্ডেল উড়ে যায়। ঝড় থামার পরে আব্বু রাতের বেলাই
দায়িত্বশীলদের মধ্যে সবার আগে খোঁজ খবর নিতে হাজির হন।
জামায়াতের নির্বাচনী শ্লোগান ছিল, “আল্লাহর আইন চাই, সৎলোকের
শাসন চাই”। জামায়াতের পক্ষ থেকে জনগনের নির্বাচিত
প্রতিনিধি ও ২টি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে আব্বু সততা ও
যোগ্যতার এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আব্বুর কাছে সততার বিষয়টি নিছক
অর্থনৈতিক সততা ছিলনা বরং এটা ছিল কোরআনে বর্ণিত আমানতদারীতা। যার দাবী হল জীবনের
প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি সহকারে দায়িত্ব পালন
করা। আম্মুর কাছে শুনেছি আব্বুর আমানতদারীতার উদাহরণ। একবার
উনার কাছে বাইতুল মালের কিছু টাকা জমা হলে আব্বু সেটা সংগঠনের একাউন্টে জমা দিতে
বললেন। আম্মুর তখন নগদ কিছু টাকার দরকার ছিল। তাই আম্মু বললেন, “এই টাকাটা আমি খরচ করে আমার একাউন্ট থেকে
সমপরিমান টাকা সংগঠনের একাউন্টে জমা করে দেই?”
আব্বু
তখন বললেনঃ এটা আমানতদারীতার বরখেলাপ।
আমানতদারীতা
হল তুমি সংগঠনের টাকা কোন অবস্থাতেই ব্যক্তিগত টাকার সাথে মিলিয়ে ফেলবেনা।
সংগঠনের টাকা সংগঠনের একাউন্টে জমা দিবে আর তোমার প্রয়োজনের টাকা নিজের একাউন্ট
থেকে তুলে খরচ করবে।
আব্বুর জেল জীবনেও আমি দেখেছি আমানতদারীতা
রক্ষার ব্যাপারে তিনি কতটা সচেতন। একবার আমরা জেলে আব্বুর সাথে দেখা করতে গেলে
আমার ভাতিজা জেলখানার একটি পানি খাওয়ার গ্লাস অসাবধানে ভেঙ্গে ফেলে। আব্বু তখন
আমাদেরকে বললেন, পরবর্তী সাক্ষাতের সময় এই
রকম একটি গ্লাস কিনে নিয়ে এসে জেল কর্তৃপক্ষকে দিতে। আমরা পরবর্তীতে গ্লাস কিনে
জেল কর্তৃপক্ষকে দিলে তারা অবাক হয়ে যায়।
আব্বু একদিকে যেমন অন্তন্ত বিনয়ী ছিলেন, আবার
একই সাথে প্রচন্ড আত্নমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ছিলেন। তিনি কখনো নিজের ব্যাপারে বা
সংগঠনের ব্যাপারে হীনমন্যতাবোধে ভুগতেন না। কেউ কখনো বলতে পারবেনা যে, আব্বুর
মাঝে কোন অহংকার বোধ বা ইগো কাজ করত।
কিন্তু
তিনি নিজের আত্নসম্মানের বা তার সাংগঠনিক পজিশনের মর্যাদার বিষয়ে কখনোই ছাড় দিতেন
না। আব্বু এ ব্যাপারে সংগঠনের নেতৃবৃন্দকেও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিতেন। সংগঠনের
কোন আঞ্চলিক পর্যায়ের দায়িত্বশীল প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরকে স্যা বলে সম্মোধন
করলে আব্বু রেগে যেতেন। আব্বু সংগঠনের সেক্রেটারী জেনারেল থাকা কালে একবার কোন এক
বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রদুতের সাথে নির্ধারিত বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য তার বাসভবনে গেলে
আব্বুর গাড়ীকে ৫ মিনিট গেটে অপেক্ষা করতে বলা হয়। আব্বু বিষযটি পছন্দ করলেন না। তিনি
গাড়ী ঘুরিয়ে বৈঠকে অংশ না নিয়েই চলে আসেন। পরবর্তীতে সেই রাষ্ট্রদূত আব্বুর অফিসে
এসে এ ব্যাপার ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
১০ম পর্ব
আল্লাহ তায়ালা আব্বুকে উনার কলিগদের থেকে
তুলানামুলকভাবে লম্বা হায়াতই দান করেছিলেন।
আব্বু
৭৫ বছর বয়সে শাহাদাত লাভ করেন। এক জীবনে একজন মানুষের ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার
সবটুকুই আল্লাহ উনাকে দান করেছিলেন।
ছাত্রজীবনে
ছাত্রসংগঠনের প্রধান, পরবর্তীতে জামায়তের প্রধান, এমপি, মন্ত্রী
সর্বশেষে বিনা যুদ্ধে শাহাদাতের মৃত্যু। এর বাইরে দুনিয়ার সাময়িক অসুবিধা, জেল
জুলুম নির্যাতন, এইগুলোতো সাধারন মানুষের
ভাগ্যেও জোটে। আব্বুর এই নিয়ে কোন আফসোস ছিল না। আমাদের শেষ সাক্ষাতকারে তাইতো
আমাদেরকে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে বলে গিয়েছিলেন আর বলে গিয়েছিলেন বেশী করে আমল
করতে। আমল ছাড়া স্বয়ং নবী সা.
তার কন্যার জান্নাতের নিশ্চয়তা দিতে পারেননি। শেষ
সময়ে আব্বু অন্য যে কোন সময়ের চাইতে বেশী প্রশান্ত ছিলেন। আমাকে
অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞাসা করেছিলেনঃ মোমেন
ফাঁসীর মঞ্চে কি পায়জামা না লুঙ্গী পরে যাব?
আব্বুর সাথে শেষবারের মত দেখা করে আমরা ঢাকা
কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের হয়ে আসলাম। আম্মু ও পরিবারের অন্য সদস্যদেরকে বাসায় যেতে
বলে আমি আর খালেদ মিঠু ভাই আর মফিজ ভাইকে নিয়ে বেলালের গাড়িতে করে সাঁথিয়ার দিকে
ছুটলাম। ফোনে ফোনেই মনমথপুরের পারিবারিক কবরস্থানে আত্মীয় স্বজনদের মাধ্যমে কবর
খুড়ার ব্যবস্থা করতে হল। খবর পেলাম রাস্তায় আওয়ামী লীগের গুন্ডারা ব্যরিকেড দিয়েছে
লাশ নাকি পাবনায় দাফন করতে দিবেনা। আম্মু বারবার ফোনে জানতে চাচ্ছেন আমরা ঠিক আছি
কিনা। আব্বুর শাহাদাতের সময় ঘনিয়ে আসছে আর আমরাও এক মনে দোয়া এস্তেগফার পড়তে পড়তে
রাতের আঁধারে ছুটে চলেছি। বেলাল রেডিওটা ছেড়ে দিল
খবর শুনার জন্য। আমি বন্ধ করে দিতে বললাম। সার্বক্ষনিক বাজতে
থাকা ফোনটা সাইলেন্ট মুডে দিয়ে দিলাম।
অপরিচিত
কোন কল ধরছিনা। আস্তে আস্তে চারিদিকে সবকিছু শুনসান নিরব হয়ে গেল। যমুনা সেতুর
কাছাকাছি আসতেই মনটা হুহু করে উঠল,
এই
পথ ধরে কতবার আব্বুর সাথে সাঁথিয়ায় গিয়েছি। সামনে বরাবরের মত মিঠু ভাই আর পিছনে
মফিজ ভাই। মাঝখানে শুধু আব্বু নেই।
গাড়িটা থামাতে
বললাম। পথের ধারে একটি মসজিদে অজু করে নিলাম। খালেদ বলল, ফাঁসি
মনে হয় কার্যকর করে ফেলেছে। আমি কিছুই বললাম না। আমাকে শান্ত থাকতে হবে আব্বুর শেষ
বিদায়টা যেন ভালভাবে হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আব্বু মাঝে মাঝেই আমার সাথে অনেক
বিষয়ে এডভান্স আলাপ করতেন। আব্বুর জানাযা নিয়ে জেলখানায়া যাওয়ার শুরু থেকেই বহুবার
আমার সাথে আলাপ করেছেন। তিনি বলতেন,
ওরাতো
ফাঁসী দিলে রাতের বেলাই দিবে। তোর আম্মাকে কষ্ট করে রাতের বেলা সাঁথিয়ায় নেয়ার
দরকার নেই। তুই আমার জানাযা পড়াবি। জানাযা পড়ার সময় ভাল দেখে একটা পান্জাবী পড়ে
যাবি। আর যদি তোদের কে যেতে না দেয়,
চাঁদু
(আমার ফুফাতো ভাই) কে বলবি যেন আমার লাশটা রিসিভ করে।
সিরাজগঞ্জ পার হয়ে খবর পেলাম পুলিশ মনমথপুরের
রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়েছে। কোন গাড়ী ঢুকতে দিচ্ছেনা।
তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল মুহতারাম ডা. শফিক চাচা সিরাজগঞ্জে এসে আগেই অবস্থান
নিয়েছিলেন। আমরা চাচাকে গাড়িতে তুলে নিলাম। পুলিশ গাড়ি থামাল। তবে
আমরা পরিবারের সদস্য দেখে আমাদেরকে মনমথপুরে ঢুকতে দিল। ফজরের আগেই মনমথপুর লোকে লোকারন্য। মানুষ পুলিশি বাঁধা ডিঙ্গিয়ে বহু দূর দুরান্ত
থেকে পায়ে হেঁটে এসেছে। নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে কবরস্থানের সামনের ফসলের
মাঠে জানাযার নামাজের আয়োজন করা হল। কোন ধরনের বিশৃংখলা যাতে না হয় সেজন্য
সবাইকে লাশ আসার আগেই সকাল সকাল জানাযার জন্য মাঠে সারিবদ্ধ হয়ে যেতে বলা হল। এত
মানুষের এক মাঠে কি আর জায়গা হয়? শোকাহত মানুষ তাই রাস্তার
দুই ধারে দাড়িয়ে থাকল। প্রশাসন কয়েকবার লোকজনকে সরানোর জন্য হম্বিতম্বি করলেও এত
মানুষ দেখে আর বেশী কিছু করার চেষ্টা করেনি।
আব্বু শেষবাবরে মত জন্মভূমি মনমথপুরে ফিরে
এলেন এম্বুলেন্স করে। সামনে পিছনে পুলিশের গাড়ি।
আমি দস্তখত দিয়ে আব্বুকে রিসিভ করলাম। আমাদের কয়েকজনকে শেষ বারের মত আব্বুর চেহারা
দেখার সুযোগ দিল। আব্বুর রক্তমাখা মুখটা শেষবারের মত ধরে দেখলাম। মাথায়
হাত বুলিয়ে দিলাম। খালেদ একটু ইমোশনাশ হয়ে
উঠল। আমি নির্বিকার।
আব্বুর চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছিল। ইচ্ছা করছিল একটু আঁচড়িয়ে দেই। আব্বুর পকেটে একটা ছোট
চিরুনী থাকত। ঘন চুল দাড়ি গুলোকে তিনি সবসময় পরিপাটি করে রাখতেন। আমিতো আব্বুর মত এত
পরিপাটি নই। আমার পকেটে কোন চিরুনীও
থাকেনা। তাই শেষ বেলায় আব্বুর চুলগুলোকে আর পরিপাটি করে দিতে পারলামনা। একদিক
দিয়ে ঠিকই আছে। জালেমেরা যেভাবে আব্বুকে
শহীদ করেছে তিনি সেভাবেই রাব্বে করিমের ঘোষনা
অনুযায়ী হাশরের মায়দানে উঠবেন ইনশাআল্লাহ।
প্রশাসনের সাথে কিছু বদানুবাদ হলেও জানাযা ও
দাফন মোটামুটি নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হল। আমি আর খালেদ আব্বুকে কবরে নামালাম, সাদা
কাফন ততক্ষণে তাজা রক্তে লাল হয়ে ঊঠেছে। আব্বুকে শেষবারের মত আরেকবার দেখার ইচ্ছা
হলেও এত লোকের ভিড়ে সেটা আর সম্ভব হল না। মানুষকে আর নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব হচ্ছিল
না। তাই তাড়াতাড়ি দাফন করে ফেলতে হল। আব্বুকে দাদা দাদীর পাশে শুইয়ে রেখে বিদায়
নিলাম।
ছোটবেলায় প্রথম যখন মনমথপুরে আসি, তখন বিদায়
বেলায় দাদীকে আধোবোলে সদ্য কথা বলতে শিখা আমি নাকি
বলেছিলাম, ‘দাদী দাদী আবার আসব’। এবার বিদায় বেলায় আব্বুর কানে কানে
বলে গেলাম ‘আব্বু আব্বু আাবার আসব, আপনার কোলে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকার জন্য’।
শেষ পর্ব
আব্বুর শাহাদাতের কয়েকদিন পরে ঢাকা কেন্দ্রীয়
কারাগারের তৎকালীন জেল সুপার আমাকে ফোন করে উনার অফিসে আসতে বিশেষভাবে অনুরোধ
করলেন। সাক্ষাতে তিনি বললেন, “আপনার আব্বা অত্যন্ত ধীরস্থির ভাবে কালেমা পড়তে পড়তে দুনিয়া
থেকে বিদায় নিয়েছেন। যাওয়ার আগে শুধু আমাকে কাছে ডেকে উনার চশমা আর ঘড়িটি হাতে
দিয়ে বলেছেন, আমার ছেলে মোমেনের কাছে
এই গুলো পৌছে দিবে। আপনার আব্বার আমানত আমি আপনাকে নিজ হাতে বুঝিয়ে দিব বলে
আপনাকে আজকে আসতে বলেছি।”
আব্বুর আমাদের ভাইবোনদের প্রতি লিখিত শেষ
অসিয়ত ছিল, “আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়
মুহসিনা, তারেক, মোমেন, খালেদ, খাদিজা
ও তালহা। তোমাদের সকলের প্রতি রইল আমার প্রাণ উজাড় করা দোআ। তোমরা ভাই বোন
মিলে মিশে থাকবে। আল্লাহ ও রাসূলের পথে
চলবে। মায়ের খেদমত করবে। মায়ের মাঝেই আব্বুকে দেখতে পাবে। আর তোমাদের আম্মু যেন তোমাদের মাঝেই তোমাদের
আব্বুকে দেখতে পায়।
তোমাদের জন্য সার্বক্ষনিক দোআয় নিয়জিত
আব্বু।”
আব্বুর শাহাদাতের কিছুদিন পরে আব্বুর জেল
জীবনের সুখ-দূ:খের সাথী মুহতারাম সাঈদী চাচা একদিন আব্বুকে স্বপ্নে দেখেন। চাচা বলেন,
“তাহাজ্জুদের
নামাজ পড়ে জায়নামাজেই শুয়ে পড়েছি। কখন
ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। স্বপ্নে দেখি,
আলো
ঝলমলে বিশাল এক রুমের মাঝে নিজামী ভাই বসা। নাম না জানা অসংখ্য ফল-ফলাদি দিয়ে রুমটা ভরা। তিনি সেগুলো খাচ্ছেন আর কার সঙ্গে যেন কথা
বলছেন। আমি রুমে ঢুকেই তাকে সালাম দিলাম।
আমরা একে অপরের কুশল বিনিময় করলাম। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘নিজামী ভাই! এতো ফল আপনি কোথায় পেলেন! এগুলোর নাম কি?’ তিনি আমাকে বললেন,
‘এগুলোই
তো নাজ নেয়ামত।’ এরপর আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়ির
দিকে তাকিয়ে দেখি ফজরের সময় হয়ে এসেছে।”
আব্বুর শাহাদাতের মধ্যদিয়ে আমার জীবনের একটা
অধ্যায় শেষ হল। ২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত
আমার সবকিছুই ছিল আব্বু কেন্দ্রীক। সাথে
ছিলেন অনেকে। কিন্তু বিশেষভাবে স্মরণ করি মিঠু ভাইয়ের কথা। আব্বু তাকে ছেলের মত স্নেহ করতেন। উনিও
পরম আন্তরিকতায় বিগত বছর গুলোতে সার্বক্ষনিক আব্বুর সেবা করে গিয়েছেন। মিঠু ভাইয়ের সহায়তা না পেলে কঠিন দিনগুলো আরও
কঠিনতর হতে পারত বৈকি। শাহাদাতের পূর্বক্ষণে
আব্বু মিঠু ভাইকে অসিয়ত করে গিয়েছেন,
“একান্ত
স্নেহের মিঠু! তুমি আমার পরিবারের একজন সদস্য হিসাবেই দীর্ঘদিন আন্তরিকভাবে যে সহযোগিতা
করেছ, সে জন্য প্রাণ খুলে দোআ করি। আল্লাহ যেন তোমাকে দুনিয়া এবং আখেরাতে
সর্বোত্তম পুরস্কার প্রদান করেন। খালেদ
মোমেনদের মতই তুমি আমার সন্তানতূল্য। তুমি ওদের চার ভাইয়ের সাথে আপন ভাইয়ের মতই
সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে। তোমার পিতামাতা তোমাকে এলমে দ্বীন শেখার সুযোগ
দিয়েছিলেন। এটা আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত
একথা কখনও ভুলবেনা। খোদাভীতি মুমিনের
সর্বোত্তম পূঁজি, এই পূঁজি সঞ্চয়কে সর্বাধিক
গুরুত্ব দেবে এবং সত্যাশ্রয়ীদের সাথে থাকবে। তোমার চাচা।”
সেই কঠিন দিনগুলো নিয়ে ভবিষ্যতে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা আছে ইনশাআল্লাহ। তবে এবারের মত স্মৃতিচারণের ইতি টানছি। আমাকে ছাড়া আব্বু হয়ত আল্লাহর ইচ্ছায় ভালই আছেন। কিন্তু এই দুনিয়ায় চলতে গিয়ে পদে পদে আমি আজ আব্বুর অভাব বোধ করছি। আল্লাহই আমাদের প্রকৃত অভিভাবক । আল্লাহ যেন আমাদেরকে আজীবন দ্বীনের পথে অটল রাখেন, আর ঈমানের সাথে মৃত্য দিয়ে জান্নাতে আব্বুর সাথে মিলিত হওয়ার তাওফীক দান করেন। আমীন।।
শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী রচিত বই সমূহ পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন।
📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘
আমার প্রিয় বাংলা বই হোয়াইটসআপ গ্রুপে যুক্ত হতে এখানেক্লিক করুন, টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং ফেইসবুক গ্রুপে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
No comments:
Post a Comment
আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।