বইঃ ইগো আত্ম অহমিকার স্বরূপ
লেখকঃ সালমান আল আওদাহ
অনুবাদকঃ আলী আহমাদ মাবরুর
"ইগো আত্ম অহমিকার স্বরুপ" একটি আত্মউন্নয়নমূলক বই। বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণই জীবন থেকে নেয়া। মোটিভেশন পাওয়ার হাজারও কলাকৌশল বিদ্যমান এই বইটিতে। আত্ম উন্নয়ন, আত্ম বিকাশ, আত্মোপলব্ধির এক সুনিপুণ মিশেল হলো এই বইটি। মেধা-সময়-বোধ-শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সচেতন মুসলিম হিসাবে নিজেকে তৈরি করার প্রত্যয়ে একজন সম্ভাবনাময় ব্যক্তি কিভাবে আত্মগঠন-মানোন্নয়ন-ফিটনেস অর্জন-সামাজিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়ে এক স্বপ্নিল পৃথিবী উপহার দিতে পারবে তার প্র্যাক্টিক্যাল উদাহরণ ও জীবন ঘনিষ্ট আলোচনা রয়েছে এই বইয়ে।
আমাদের প্রাকটিক্যাল জীবনের অনেক সংকটের নেপথ্যের কারণ যে এই ইগো তা লেখক অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আমরা যদি ইগো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তবে আমাদের জীবনের জটিলতার অনেক কিছুই নিরসন করা সম্ভব হবে। অনেক ভালো মানুষ - পরিচিত মানুষ - প্রসিদ্ধ মানুষও ভেতরে ভেতরে ইগোতে আক্রান্ত হয়ে আছেন - এটি তাদের সাথে কথা বললে বা একটু সময় কাটালে অনুভব করা যায়।
প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক সৌদি আরবের কারাগারে আটক প্রসিদ্ধ আলেমে দ্বীন শায়খ সালমান আল আওদাহর লেখার বৈশিষ্ট্য হল তার লেখনীতে ভালো আলেমের পাশাপাশি একজন মোটিভেশনাল ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবিও চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। এই ইগো বইটিতেও তিনি জীবন ঘনিষ্ঠ বেশ কিছু ঘটনা এবং বিশ্বখ্যাত লোকদের রেফারেন্স ও জীবনী থেকে ইগো সংক্রান্ত সমস্যাকে খুবই চমৎকারভাবে আলোচনা করেছেন। ডেল কার্নেগী, শেক্সপিয়ার, আলবার্ট আইনস্টাইন, জর্জ ওয়াশিংটন, টলস্টয়, এডিসন, পাবলো পিকাসো, মোহাম্মদ আলী ক্লে, ইবনে বতুতা, জাবির ইবনে হাইয়ান, ভিক্টর ফ্রাংকল, ফ্রয়েড, উইলিয়াম জেমসসহ আরো অনেক খ্যাতিমান ব্যাক্তির সাথে ইসলামিক স্কলার ইবনে বাজ, ইমাম গাজালী, আহমেদ দীদাত, ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল, উমর ইবনে আব্দুল আজিজ, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম আল যাহাবীর আলোচনা নিয়ে এসেছেন।
কুরআনের বিভিন্ন ঘটনা ও নবীদের কাহিনী যেমন জুলকারনাইন, ইয়াজুজ-মাজুজ, মুসা (আ), খিজির (আ), ইউসুফ (আ), লোকমান (আ), ইবরাহীম (আ), ফেরাউন ইত্যাদির উপরেও আলোকপাত করেছেন।
"আমি" শব্দটির পরিচয় কি, নামের বিশেষণ জরুরী না ব্যক্তিত্ব, হাসি কিভাবে জীবন পরিবর্তন করে, খ্যাতি বা সুনাম নাকি কল্যাণ কামনা - কোনটা প্রয়োজন, মানুষকে কিভাবে হ্যান্ডলিং করবেন, দায়িত্ববোধ কিংবা এড়িয়ে চলা - কোনটি কখন প্রয়োজন, অতীতের দুঃসহ স্মৃতি ভুলে থাকার উপায়, সুখী ও কর্মমুখী জীবনযাপনের উপায়, হাসিখুশি-টেনশনমুক্তও থাকব মৃত্যুভয়ও থাকবে না আবার রবের সন্তুষ্টিও পাবো জান্নাতেও যাব - কিভাবে সম্ভব, সৌভাগ্যের বরপুত্র হয়ে থাকা মানুষগুলো কীভাবে ভিন্নতর হয়, অপরকে সম্মানের মাধ্যমে কিভাবে নিজে সম্মানিত হওয়া যায়, সুখের ভাষা, দিন মাস বছরের ক্রমাগত হিসেবকে এড়িয়ে গিয়ে জীবনকে কার্যকর করার সহজ এবং বড় উপায়, শয়তান কিভাবে ধোঁকা দেয় এবং তা ঠেকানোর উপায় কি, আর্থিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি অপচয়-অপব্যয়-লোভ লালসা না করা, অযাচিত কথাবার্তার কুফল, হিংসা-ভয়-স্ট্রেস কিভাবে জীবনকে ধ্বংস করে, শিশুকে আদর্শ মানুষ করার উপায় ইত্যাদিসহ আরো অনেক জীবনঘনিষ্ঠ বিষয় আমাদের সামনে এনে জীবনে সফলতার উপায় বাতলে দিয়েছেন লেখক।
মস্তিষ্কে অক্সিটোসিন হরমোনের ভূমিকা, ভালবাসা ও যৌনতা, লোগোথেরাপি, দূরদর্শিতা, জৈবিক চাহিদা, ইনসোমনিয়াসহ মানবদেহের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়াকলাপের আলোচনা লেখাকে আরো ঋদ্ধ করেছে।
জায়োনিজম, নাৎসী বাহিনীর বিভৎসতা, বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, বহুজাতিক কোম্পানি - সায়েন্স ফিকশন - মার্কেট - শপিংমল - মিডিয়ার আগ্রাসী ভূমিকা জাতিসমূহকে কিভাবে ধ্বংস করে সেসবের আলোচনা করে আমাদের সতর্ক করেছেন লেখক।
লেখক গল্প থেকে বুঝিয়েছেন মানুষ তার শৈশব থেকে যত বড় হয় তার ভিতরে আস্তে আস্তে ইগো-অহংকার-দাম্ভিকতা চলে আসে; কিন্তু যারা শৈশবে আমাদেরকে সেবা দেন - যত্ন করেন আমরা যতই বড় হই না কেন তাদের কাছে আমরা বরাবরই ছোট হয়েই থাকি।
ইগো হলো মানুষের চরিত্রের এমন একটি সংকট, যা তাকে দোষ স্বীকার করতে বাধা দেয়। ইগো মানুষকে ভুল পথে এবং অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ করার দিকে ধাবিত করে। যখন কেউ আমার সমালোচনা করে বা আমাকে অপমান করে, তখন আমার ইগোতে আঘাত লাগে। তখন আমার ভাবমূর্তিকে ভালো রাখার জন্য অথবা তর্কযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য আমার হাতে দুটো উপায় থাকে। হয় নিজের যৌক্তিক অবস্থানকে তুলে ধরা অথবা প্রতিপক্ষকেও একইভাবে সমালোচনা ও অপমান করার মাধ্যমে তাকে অপদস্থ করে দেওয়া। প্রতিপক্ষের অবস্থানটি যৌক্তিক ছিল কি ছিল না, তখন তা আর মুখ্য থাকে না। নিজের অপমানের একটি প্রতিশোধ নিতে হবে- এ বাস্তবতাই তখন মুখ্য হয়ে যায়। আমাদের যতটুকু দায় আছে কিংবা পরিস্থিতি যতটা প্রত্যাশা করে, ইগো আমাদেরকে তার চেয়েও অনেক বেশি সংবেদনশীল বানিয়ে দেয়।
অনেক সময় দেখা যায়, সমাজে যারা একটু দুর্বল অবস্থায় থাকে, তারাও অনেক সময় রাগে বা ক্ষোভে শ্রেণি বৈষম্য বা অন্য কোনো জটিলতর বিষয়কে ঝগড়ার সময় নিয়ে আসে। ধরুন, একজন সাধারণ ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করল। পাশ দিয়ে যাওয়া কোনো দামি গাড়ি থেকে কোনো একজন সে বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষন করল। গাড়িতে থাকা লোকটি হয়তো ভালোভাবেই বুঝিয়েছে, তার ব্যবহারেও হয়তো কোনো সমস্যা ছিল না, তারপরও রাস্তায় থাকা লোকটি গোটা ঘটনাকে ব্যক্তিগতভাবে নিবে এবং বলবে, ‘আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটি দেখে আমাকে কি মানুষ বলে মনে হয় না? আমাকে কি কাজের ছেলে বা রিকশাওয়ালার সন্তান বলে মনে হয়?
ইসলামের শাশ্বত শিক্ষাকে সামনে রেখে জীবন ঘনিষ্ঠ আলোচনা এবং উদাহরণ দিয়েছেন লেখক যা মানুষের আচার-আচরণের সাথে শতভাগ মিলে যায়। একজন মানুষকে পার্থিব জীবনের সাফল্যের শেকড় ছুঁয়ে দিয়ে নিজেকে পরকালীন জীবনের শিখরে পৌঁছে দিতে এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হয়ে পথ দেখাবে এই বইটি।
বইয়ের পরতে পরতে লেখক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিনয়, উন্নত চরিত্র, অনুপম আদর্শ, অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আচরণ, সাহাবীদের প্র্যাকটিক্যাল জীবনীও তুলে ধরেছেন বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্য রেখে।
বইটির প্রচ্ছদ যথেষ্ট আকর্ষনীয়, মনোমুগ্ধকর। সচেতন, রসবোধসম্পন্ন ও বোদ্ধা পাঠক সহজেই আকৃষ্ট হবে। বইয়ের গঠন প্রণালী, বাঁধাই, বর্ণশৈলী বলতে গেলে এক কথায় অসাধারণ। হাতে নিলেই পুলকিত হয়ে যাই। কালার-ফন্ট-উপস্থাপনা-কাগজ ইত্যাদি এক্সট্রা অর্ডিনারি স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখেছে যা প্রকাশনা সংস্থা বিন্দুকে একটি সমুন্নত অবস্থান ধরে রাখতে সহায়ক হবে। আর বাঁধাই তো বরাবরের মত অদ্বিতীয়।
বইটি অনুবাদ করেছেন বর্তমান সময়ের অন্যতম পাঠকপ্রিয় অনুবাদক আলী আহমাদ মাবরুর। অনুবাদ কর্মের ক্ষেত্রে মাবরুর ভাইয়ের প্রতি আমি যথেষ্ট দুর্বল। এ বই অনুবাদের ক্ষেত্রেও তিনি বরাবরের মতো যথেষ্ট ক্যারিশমার পরিচয় দিয়েছেন। এমন হয়েছে যে, অনুবাদে মূল লেখার চেয়েও প্রাঞ্জল ভাষায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যা মৌলিক কর্ম বলেই মনে হয়। শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে সহজ-সরল-সাবলীল-প্রচলিত শব্দের পাশাপাশি আভিজাত্য ধরে রেখেছেন যা সৃষ্টিশীল এবং উন্নত রুচির পরিচয় বহন করে। সামগ্রিকভাবে অনুবাদ কর্মটি নিঃসন্দেহে সুখপাঠ্য, ঝরঝরে এবং অসাধারণ।
শেষ কথা
"ধনী মানুষ", "সেরা পজিশন", "দুনিয়াবী সফলতা" ইত্যাদির পিছে ছুটতে গিয়ে মনুষ্যত্ব হারিয়ে আজ আমরা "আধুনিক জীব" এ পরিণত হয়েছি যেখানে রয়েছে শুধুমাত্র যান্ত্রিকতা। আমরা অগোচরে এড়িয়ে চলছি বিবেকবোধ, আত্মার খোরাক আর রবের সন্তুষ্টি। বিনয়-দয়া-মূল্যবোধ-ভ্রাতৃত্ব-সমাজ সেবা আর সৃষ্টিকর্তার ইবাদাত যেন একসাথে চলেনা। ইগো বই গতানুগতিক এসব ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করে অনুপম জীবন গঠনের এক আলোকবর্তিকা আমাদের সামনে তুলে ধরেছে।
এই বইয়ের আহ্বান সঠিকভাবে অনুসরণের মাধ্যমে দুনিয়াবী জীবনের সফলতা একজন মানুষের পদচুম্বন করে তাকে শেষ বিচারের কঠিন সময়ে সফলতার পথ দেখানোর এক উজ্জ্বল আলোক বর্তিকা হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে।
বইটি প্রত্যেকের সংগ্রহে থাকা উচিৎ। দাওয়াহ ও তারবিয়াত কাজের জন্য একটি অনুপম বই।
সত্যিই দারুণ একটা বই!!
বইটি নিজে পড়ুন এবং অপর মুসলমানকে পড়তে উৎসাহিত করুন। সচেতন মুসলমান হিসেবে আসুন ইগো সম্পর্কে জানি এবং বাস্তব জীবনে ইগো থেকে দূরে থেকে জীবনকে সুন্দর করি।
No comments:
Post a Comment
আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।