মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদঃঃ একে অন্যের প্রতি ভালবাসা একটি স্বভাবজাত বিষয়। মানুষ নিজের প্রয়োজনে, ভবিষ্যতে কারো সাহায্য পাওয়ার জন্য, অতীতে কারো কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার কারণে একে অপরকে ভালবেসে থাকে। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়ার কোন স্বার্থ ব্যতীত কোন মুসলিমের অন্য মুসলিম ভাইকে ভালবাসা একটি বড় ইবাদত। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অন্য মুমিনকে ভালবাসা ও একসাথে কাজ করা ঈমানের দাবী (তাওবা/৭১)। রাসূল (ছাঃ) মুমিনদের উদাহরণ দিয়েছেন একটি দেহের ন্যায়, একজন ব্যক্তির ন্যায় অথবা একটি দালানের ন্যায়। যার এক অংশ অন্য অংশকে শক্তিশালী করে। আবার কোন কারণে শরীরের কোন অঙ্গ অসুস্থ হ’লে পুরো শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু আজকে মুসলমানদের মধ্য থেকে এ গুণটি প্রায়ই উঠে গেছে। বিভিন্ন ঠুনকো অযুহাতে, ব্যক্তি স্বার্থের কারণে অথবা ফিক্বহী মাসআলার কারণে বা দলীয় ভিন্নতার কারণে মুমিনদের মধ্যে ভালবাসার অভাব দেখা যাচ্ছে। শুধু তাই নয় সামান্য কারণে তারা সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং পরস্পরে শত্রুতে পরিণত হয়। অনেক সময় মুসলিম ভাইয়ের পরিবর্তে বরং কোন অমুসিল বা শিরক ও বিদ‘আতী আক্বীদা সম্পন্ন লোককে সাহায্য করে। এ অবস্থা থেকে বাঁচার অন্যতম পথ হ’ল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোন মুসলিম ভাইকে ভালবাসা অথবা ঘৃণা করা। আলোচ্য প্রবন্ধে আল্লাহর জন্য ভালবাসা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা হ’ল।
আল্লাহর জন্য ভালবাসার অর্থঃ
الحب শব্দটি শব্দটি একবচন, বহুবচন হ’ল- أحباب। যার অর্থ ভালবাসা, বন্ধুত্ব, পসন্দ, আসক্তি, ঝোঁক ইত্যাদি। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِيْنَ ‘নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকে ভালবাসেন (বাক্বারাহ ২/১৯৫)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَاللهُ لاَ يُحِبُّ الْفَسَادَ ‘আল্লাহ অশান্তি পসন্দ করেন না’ (বাক্বারাহ ২/২০৫)। হাদীছেও শব্দটির ব্যবহার পাওয়া যায়। যেমন-
ومَنْ يَجْتَرِئُ عَلَيْهِ إلاَّ أُسَامَةُ بنُ زَيْدٍ، حِبُّ رَسُوْلِ اللهِ صَلّى اللهُ عليه وسلَّمَ
‘একমাত্র রাসূল (ছাঃ)-এর প্রিয়তম উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) এ ব্যাপারে আলোচনা করার সাহস করতে পারেন’। ইসলামী শরী‘আতের পরিভাষায় এর দ্বারাالحب في الله ‘আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসা’ বুঝায়। অর্থাৎ দুনিয়ার কোন স্বার্থ ব্যতীত একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাউকে ভালবাসা।
আল্লাহর জন্য কে কাকে ভালবাসবেঃ
মহান আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে পাঠানোর পূর্বে রূহের জগতে সকলের নিকট থেকে একত্বের সাক্ষ্য নিয়েছিলেন (আ‘রাফ ৭/১৭২)। কিন্তু তারা তাদের দ্বীনকে বহু ভাগে বিভক্ত করে ফেলে। আর প্রত্যেক দলই তাদের কাছে যা আছে, তাই নিয়ে সন্তুষ্ট (মু‘মিনূন ২৩/৫৩)। আল্লাহর এ ইচ্ছা অনুযায়ী যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে সৎ কাজ করে সে সকল মুমিন বা মুসলিমগণ পরস্পর ভাই ভাই। আর তারা একে অপরকে ভালবাসবে। যে মুসলিমের মত ছালাত আদায় করবে, ক্বিবলাকে ক্বিবলা মানবে এবং যবহকৃত পশু ভক্ষণ করবে তাকেই মুসলিম ব্যক্তি ভালবাসবে। এই ভালবাসা ভিন্ন কোন দেশের কারণে, মাযহাবের কারণে, পথ ও মতের কারণে বিনষ্ট করা যাবে না। শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) (৬৬১-৭২৮ হিঃ) বলেন, ‘বংশ, এলাকা, বিভিন্ন মাযহাব, তরীক্বা, পথ, সম্পর্ক ইত্যাদির কারণে মুমিনদের মধ্যে পার্থক্য করা চলবে না। বরং আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) নির্দেশিত নিয়মানুযায়ী প্রত্যেককে তার হক্ব প্রদান করতে হবে। মুসলিমগণ অবস্থানগত ভিন্নতা ও ভাষাগত ভিন্নতা থাকলেও তাদের সম্পর্ক হবে একটি দেহের মত। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
تَرَى المُؤْمِنِيْنَ فِيْ تَرَاحُمِهِمْ وَتَوَادِّهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ كَمَثَلِ الجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى عُضْوًا تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ جَسَدِهِ بِالسَّهَرِ وَالحُمَّى،
‘মুমিনদের দৃষ্টান্ত তাদের পারস্পরিক সম্প্রীতি, দয়ার্দ্রতা ও সহমর্মিতার দিক দিয়ে একটি দেহের মত। যখন তার কোন একটি অঙ্গ অসুস্থ হয়, তখন তার সমগ্র দেহে তাপ ও অনিদ্রা ডেকে আনে’।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ،
‘আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী এমন কোন সম্প্রদায়কে তুমি পাবে না, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করে। যদিও তারা তাদের বাপ-দাদা, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বেরাদর বা আত্মীয়-স্বজন হৌক’ (মুজাদালাহ ৫৮/২২)। এজন্য যাকে তাকে ভালবাসা যাবে না। বরং প্রত্যেকের দ্বীনের অবস্থা দেখে তাকে ভালবাসতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
الرَّجُلُ عَلَى دِيْنِ خَلِيلِهِ فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ
‘মানুষ তার বন্ধুর রীতি-নীতির অনুসারী হয়। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকেই যেন লক্ষ্য করে যে, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে’। রাসূল (ছাঃ) আরো বলেছেন,
لاَ تُصَاحِبْ إِلاَّ مُؤْمِنًا وَلاَ يَأْكُلْ طَعَامَكَ إِلاَّ تَقِيٌّ
‘তুমি মুমিন ব্যতীত অন্য কারো সঙ্গী হবে না এবং তোমার খাদ্য যেন কেবল পরহেযগার লোকে খায়’।
কোন অজুহাতেই মুসলিমগণের পরস্পরের ভালবাসা নষ্ট করা যাবে না। ঈমানদারগণের মধ্যে কখনই শত্রুতা বা ঘৃণা সৃষ্টি করা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক প্রকৃত ঈমানদারকে তার ঈমানের কারণে জাহান্নাম থেকে এক সময় মুক্তি দান করবেন। সুতরাং সকল মুসলমান ইসলামের বন্ধনে আবদ্ধ থাকা অবস্থায় তাদের মধ্যে ভালবাসা থাকতে হবে। ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘মুমিনের জানা দরকার যে, মুমিনকে ভালোবাসা ওয়াজিব, যদিও সে তোমার প্রতি যুলুম-অবিচার করে। পক্ষান্তরে কাফেরের সাথে সম্পর্কহীনতা বজায় রেখে চলা ওয়াজিব যদিও সে তোমাকে কিছু দেয় ও তোমার প্রতি দয়া করে’।
ঈমানের কারণে যেমন মুমিনকে ভালবাসবে অপরদিকে তার মধ্যে কোন অপরাধ থাকলে অপরাধের জন্য অপরাধ অনুযায়ী তাকে ঘৃণা করবে। ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে ভাল-মন্দ, পাপ-পুণ্য ও সুন্নাত-বিদ‘আত একত্রিত হয়, তবে সে ততটুকু ভালবাসা প্রাপ্তির যোগ্য হবে, যতটুকু ভাল তার মধ্যে রয়েছে। পক্ষান্তরে সে ততটুকু ঘৃণা ও শাস্তি প্রাপ্তির যোগ্য হবে, যতটুকু মন্দ তার মধ্যে রয়েছে। অতএব একই ব্যক্তির মধ্যে সম্মান ও অপমান উভয়ের কারণ সমবেত হ’তে পারে। যেমন চুরি করার অপরাধে গরীব চোরের হাত কাটতে হবে, তবে তার চাহিদা মিটানোর জন্য বায়তুল মাল থেকে তাকে দিতে হবে। এটি এমন একটি মূলনীতি, যে বিষয়ে আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত একমত পোষণ করলেও খারেজী-মু‘তাযিলী ও এদের পক্ষাবলম্বনকারীদের বিরোধিতা রয়েছে’।
আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসার ফযীলতঃ
মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই (হুজুরাত ৪৯/১০)। তারা একে অপরকে আল্লাহর জন্য ভালবাসবে এটা ঈমানের অন্যতম দাবী। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য মুসলমানদের পারস্পরিক ভালবাসার অনেক ফযীলত রয়েছে। এ বিষয়ে নিম্নে আলোচনা পেশ করা হ’ল।-
(১) ঈমানের স্বাদ পাওয়া যায়ঃ আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘যার মধ্যে তিনটি গুণ বিদ্যমান, সে ঈমানের স্বাদ পাবে- (ক) যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সর্বাধিক ভালোবাসে, (খ) যে একমাত্র আল্লাহরই জন্য কাউকে ভালোবাসে এবং (গ) আল্লাহ যাকে কুফরী থেকে মুক্তি দিয়েছেন, সে কুফরীতে ফিরে যাওয়াকে ঐরূপ অপসন্দ করে, যেরূপ অপসন্দ করে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ হওয়াকে’। অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
مَنْ سَرَّه أنْ يَّجِدَ طَعْمَ الإيْمانِ فليُحِبَّ الْمَرْءَ لاَ يُحِبُّهُ إلَّا للهِ عزَّ وجلَّ
‘যে ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ পেতে পসন্দ করে, সে ব্যক্তি কেবল সুমহান আল্লাহর উদ্দেশ্যেই অপরকে ভালবাসুক’।
(২) শিরক থেকে রক্ষাঃ মুশরিকরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যকে আল্লাহর মত ভালবাসে। ফলে তারা আল্লাহর জন্য ভালবাসার নে‘মত থেকে দূরে থাকে। অপরদিকে মুমিনগণ আল্লাহর জন্য একে অপরকে বেশী ভালবাসে। আল্লাহ বলেন,
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُوْنِ اللهِ أَنْدَادًا يُحِبُّوْنَهُمْ كَحُبِّ اللهِ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ وَلَوْ يَرَى الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا إِذْ يَرَوْنَ الْعَذَابَ أَنَّ الْقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيْعًا وَأَنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعَذَابِ-
‘আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে, যারা অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে। তারা তাদেরকে ভালোবাসে আল্লাহকে ভালোবাসার ন্যায়। কিন্তু যারা ঈমানদার তারা আল্লাহর জন্য সর্বাধিক ভালোবাসা পোষণ করে থাকে। আর যালেমরা (মুশরিকরা) যদি জানত যখন তারা আযাবকে প্রত্যক্ষ করবে যে সমস্ত ক্ষমতা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা (তাহ’লে তারা শিরকের অনিষ্টকারিতা ব্যাখ্যা করে দিত)’ (বাক্বারাহ ২/১৬৫)।
(৩) আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভঃ কোন মুসলমানকে ভালবাসার কারণে তার সাথে দেখা-সাক্ষাতের ফলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,
أنَّ رَجُلاً زَارَ أَخَاً لَهُ في قَريَة أُخْرَى، فَأرْصَدَ الله تَعَالَى عَلَى مَدْرَجَتِهِ مَلَكاً، وَذَكَرَ الحدِيثَ إلى قَولِهِ: إِنَّ اللهَ قَدْ أَحَبَّكَ كَمَا أحْبَبْتَهُ فِيْهِ-
‘এক ব্যক্তি তার কোন (মুসলমান) ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের জন্য অন্য গ্রামে রওয়ানা হয়, পথে আল্লাহ তার জন্য একজন ফেরেশতা বসিয়ে দেন। অতঃপর তিনি একথা পর্যন্ত হাদীছ বর্ণনা করেন যে, (ফেরেশতা তাকে বলেন) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে এরূপ ভালোবাসেন, যেরূপ তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাস’।
(৪) আল্লাহর সাহায্য লাভঃ আল্লাহর জন্য কোন মুমিনকে ভালোবেসে তার কোন সাহায্যে এগিয়ে আসলে আল্লাহ তার জন্য অনুরূপ সাহায্য নিয়ে হাযির হন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا نَفَّسَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ يَسَّرَ عَلى مُعْسِرٍ يَسَّرَ اللهُ عَلَيْهِ فِي الدُّنْيَا وَالْاۤخِرَةِ وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَاللهُ فِي عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِي عَوْنِ أَخِيهِ
‘যে ব্যক্তি কোন মুমিনের দুনিয়াবী বিপদসমূহের কোন বিপদ দূর করে দিবে, আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তার (কঠিন) বিপদসমূহের কোন একটি বিপদ দূর করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোন অভাবগ্রস্ত লোকের অভাব সহজ করে দিবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার অভাব সহজ করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন করে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ততক্ষণ পর্যন্ত সহযোগিতা করেন যতক্ষণ সে তার অপর ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে’।
(৫) আল্লাহর ভালবাসা লাভঃ কোন মুমিনকে ঈমানের কারণে ভালোবাসলে আল্লাহ তাকে ভালোবাসবেন। বারা বিন আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) আনছারদের সম্পর্কে বলেছেন,
لاَ يُحِبُّهُمْ إلاَّ مُؤمِنٌ، وَلاَ يُبْغِضُهُمْ إلاَّ مُنَافِقٌ، مَنْ أحَبَّهُمْ أَحَبَّهُ الله، وَمَنْ أبْغَضَهُمْ أبْغَضَهُ الله،
‘তাদেরকে কেবল মুমিনই ভালোবাসে এবং তাদের প্রতি কেবল মুনাফিকরাই বিদ্বেষ রাখে। যে ব্যক্তি তাদেরকে ভালোবাসে, আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন। আর যে ব্যক্তি তাদের প্রতি বিদ্বেষ রাখবে, আল্লাহ তার প্রতি বিদ্বেষ রাখবেন’। আবু ইদ্রীস খাওলানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَجَبَتْ مَحَبَّتي لِلْمُتَحَابِّينَ فِيَّ، وَالمُتَجَالِسينَ فِيَّ، وَالمُتَزَاوِرِينَ فِيَّ، وَالمُتَبَاذِلِينَ فِيَّ
‘আমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য যারা পরস্পরের মধ্যে মহববত রাখে, একে অপরের সঙ্গে বসে, একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ এবং একে অপরের জন্য খরচ করে, তাদের জন্য আমার মহববত ও ভালোবাসা ওয়াজিব হয়ে যায়’।রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন,
مَا تَحَابَّ رَجُلَانِ فِي اللهِ إِلَّا كَانَ أَحَبُّهُمَا إِلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ أَشَدَّهُمَا حُبًّا لِصَاحِبِهِ،
‘দুই ব্যক্তি পরস্পরকে ভালোবাসলে, তাদের মধ্যে যে অপরজনকে অধিক ভালোবাসবে সে আল্লাহর নিকটে অপরজন থেকে অধিক ভালোবাসার পাত্র হবে’।
(৬) একে অপররে ভালবাসা আল্লাহর বড় নেয়ামতঃ এই ভালোবাসা আল্লাহর পক্ষ থেকে বড় নে‘মত। আল্লাহ বলেন,
وَاذْكُرُوْا نِعْمَتَ اللهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوْبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُوْنَ-
‘আর তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর সেই নে‘মতের কথা স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তর সমূহে মহববত পয়দা করে দিলেন। অতঃপর তোমরা তার অনুগ্রহে পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে গেলে’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوْبِهِمْ لَوْ أَنْفَقْتَ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيْعًا مَا أَلَّفْتَ بَيْنَ قُلُوْبِهِمْ وَلَكِنَّ اللهَ أَلَّفَ بَيْنَهُمْ إِنَّهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ،
‘তিনি তাদের অন্তর সমূহে পরস্পরে ভালোবাসা সৃষ্টি করেছেন। যদি তুমি পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ ব্যয় করতে, তবুও তাদের অন্তর সমূহে ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে পরস্পরে মহববত পয়দা করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তিনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’ (আনফাল ৮/৬৩)।
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
الأَرْوَاحُ جُنُوْدٌ مُجَنَّدَةٌ، فَمَا تَعَارَفَ مِنْهَا ائْتَلَفَ، وَمَا تَنَاكَرَ مِنْهَا اخْتَلَفَ
‘সমস্ত রূহ সেনাবাহিনীর মত একত্রিত ছিল। সেখানে তাদের যে সমস্ত রূহের পরস্পর পরিচয় ছিল, এখানেও তাদের মধ্যে পরস্পর মতভেদ ও বিরোধ থাকবে’।
(৭) ঈমানের পূর্ণতা লাভঃ আবূ ইমামাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
مَنْ أَحَبَّ لِلّهِ وَأَبْغَضَ لِلّهِ وَأَعْطى لِلّهِ وَمَنَعَ لِلّهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الْإِيْمَان
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসে, আর আল্লাহর জন্য কারও সাথে বিদ্বেষ পোষণ করে এবং আল্লাহর জন্যই দান-খয়রাত করে আবার আল্লাহর জন্যই দান-খয়রাত থেকে বিরত থাকে সে যেন ঈমান পূর্ণ করল’।
(৮) আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবাসা ছাহাবীদের বৈশিষ্ট্যঃ ছাহাবীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন,
مُحَمَّدٌ رَسُوْلُ اللهِ وَالَّذِيْنَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ،
‘মুহাম্মাদ আল্লাহরত্মাসূল এবং যরা তার সাথী তারা কাফেরদের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। কিন্তু নিজেদের মধ্যে পরস্পরে রহমদিল’ (ফাতাহ ৪৮/২৯)।
আনছার ছাহাবীদের প্রশংসা করে আল্লাহ বলেন,
وَالَّذِيْنَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيْمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّوْنَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُوْنَ فِيْ صُدُوْرِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوْا وَيُؤْثِرُوْنَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ-
‘আর যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে এ নগরীতে বসবাস করত এবং ঈমান এনেছিল। যারা মুহাজিরদের ভালবাসে এবং তাদেরকে (ফাই থেকে) যা দেওয়া হয়েছে, তাতে তারা নিজেদের মনে কোনরূপ আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে না। আর তারা নিজেদের উপর তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তাদেরই রয়েছে অভাব। বস্ত্ততঃ যারা নিজেদেরকে হৃদয়ের কার্পণ্য হ’তে বাঁচাতে পেরেছে, তারাই হ’ল সফলকাম’ (হাশর ৫৯/৯)।
(৯) আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্মান লাভঃ আল্লাহর জন্য অন্য ভাইকে ভালোবাসলে আল্লাহ তাকে সম্মানিত করেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ما أحَبَّ عَبْدٌ عبْدًا للهِ، إلَّا أكْرَمَ رَبَّهُ ‘কোন বান্দা অন্যকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসলে, তার রব তাকে সম্মানিত করেন’।
(১০) ক্বিয়ামতের দিন আরশের নীচে স্থান লাভঃ আল্লাহ বলেন, ‘সেদিন মানুষ পালাবে তার ভাই থেকে, তার মা ও বাপ থেকে এবং তার স্ত্রী ও সন্তান থেকে। প্রত্যেক মানুষের সেদিন এমন অবস্থা হবে যে, সে নিজেকে নিয়েই বিভোর থাকবে’ (আবাসা /৩৪-৩৭) যেদিন মানুষ নগ্ন দেহে দাঁড়াবে এবং নিজের ঘামের মধ্যে হাবুডুবু খাবে। সেদিন যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একে অপরকে ভালোবেসেছিল তারা আল্লাহর আরশের ছায়ার নীচে থাকবে। রাসুল (ছাঃ) বলেন,
إنَّ الله تَعَالَى يَقُوْلُ يَوْمَ القِيَامَةِ : أيْنَ المُتَحَابُّوْنَ بِجَلاَلِيْ؟ اليَوْمَ أُظِلُّهُمْ فِيْ ظِلِّيْ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إلاَّ ظِلِّيْ-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন বলবেন, আমার মহিমা ও শ্রেষ্ঠত্বের জন্য পরস্পরকে যারা ভালোবেসেছিল তারা কোথায়? আজ আমি তাদেরকে ছায়া দিব আমার ছায়াতলে, যে দিন কোন ছায়া নেই আমার ছায়া ব্যতীত’।
আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত অন্য হাদীছে আছে, আল্লাহ সাত শ্রেণীর লোককে তাঁর সুশীতল ছায়াতলে স্থান দিবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না। তাদের একশ্রেণী হ’ল ঐ দুই লোক যারা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই একে অপরকে ভালবাসে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়’।
(১১) আখিরাতে উচ্চ মর্যাদা লাভঃ রাসূল (ছাঃ) বলেন, মহা সম্মানিত পরাক্রমশালী আল্লাহ বলেন,
المُتَحَابُّوْنَ فِيْ جَلاَلِي، لَهُمْ مَنَابِرُ مِنْ نُوْرٍ يَغْبِطُهُمُ النَّبِيُّوْنَ وَالشُّهَدَاءُ
‘আমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যারা পরস্পরকে ভালোবাসে, তাদের জন্য (পরকালে) থাকবে নূরের মিম্বর, যা দেখে নবী ও শহীদগণ তাদের ঈর্ষা করবেন’। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
إنَّ مِن عِبادِ اللهِ لَأُناسًا ما هم بأنبياءَ، ولا شُهداءَ، يَغبِطُهمُ الأنبياءُ والشُّهداءُ يَومَ القيامةِ لِمَكانِهم مِنَ اللهِ. قالوا: يا رَسولَ اللهِ تُخبِرُنا مَن هم. قال: هم قَومٌ تَحابُّوا برُوحِ اللهِ على غَيرِ أرحامٍ بَينَهم، ولا أموالٍ يَتعاطَوْنها، فواللهِ إنَّ وُجوهَهم لَنورٌ، وإنَّهم لَعَلى نُورٍ: لا يَخافونَ إذا خافَ الناسُ، ولا يَحزَنونَ إذا حَزِنَ الناسُ. وقَرَأ هذه الآيةَ أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মাঝে এমন কিছু লোক আছে যারা নবী নন এবং শহীদও নন। ক্বিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর দরবারে তাদের মর্যাদার কারণে নবীগণ ও শহীদগণ তাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হবেন। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাদের অবহিত করুন, তারা কারা? তিনি বললেন, তারা ঐসব লোক যারা আল্লাহর মহানুভবতায় পরস্পরকে ভালোবাসে, অথচ তারা পরস্পর আত্মীয়ও নয় এবং পরস্পরকে সম্পদও দেয়নি। আল্লাহর শপথ! তাদের মুখমন্ডল যেন নূর এবং তারা নূরের আসনে উপবেশন করবে। তারা ভীত হবে না, যখন মানুষ ভীত থাকবে। তারা দুশ্চিন্তায় পড়বে না, যখন মানুষ দুশ্চিন্তায় থাকবে। তখন তিনি এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন, ‘জেনে রাখো! আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হবে না’ (ইউনুস ১০/৬২)।
(১২) ক্বিয়ামতের দিন ব্যক্তি ভালবাসার মানুষের সাথে থাকবেঃ ক্বিয়ামতের কঠিন দিন আল্লাহর জন্য যারা একে অপরকে ভালোবেসেছে তারা পরস্পর এক সাথে শান্তিতে অবস্থান করবে। আল্লাহ বলেন,
وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا
‘বস্ত্ততঃ যে কেউ আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে, তারা নবী, ছিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের সাথী হবে, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন। আর এরাই হ’লেন সর্বোত্তম সাথী’ (নিসা ৪/৬৯)।
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, ক্বিয়ামত কখন হবে? তিনি বললেন, তুমি ক্বিয়ামতের জন্য কি জোগাড় করেছ? সে বলল, কোন কিছু জোগাড় করতে পারিনি, তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি। তখন তিনি বললেন,
أَنْتَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ قَالَ أَنَسٌ فَمَا فَرِحْنَا بِشَيْءٍ فَرَحَنَا بِقَوْلِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنْتَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ قَالَ أَنَسٌ فَأَنَا أُحِبُّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم وَأَبَا بَكْرٍ وَعُمَرَ وَأَرْجُوْ أَنْ أَكُوْنَ مَعَهُمْ بِحُبِّيْ إِيَّاهُمْ وَإِنْ لَمْ أَعْمَلْ بِمِثْلِ أَعْمَالِهِمْ
‘তুমি তাদের সঙ্গেই থাকবে যাঁদেরকে তুমি ভালোবাস। আনাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-এর কথার দ্বারা আমরা এত আনন্দিত হয়েছি যে অন্য কোন কথায় এত আনন্দিত হইনি। আনাস (রাঃ) বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে ভালোবাসি এবং আবূ বকর, ওমর (রাঃ)-কেও। আশা করি তাঁদেরকে আমার ভালোবাসার কারণে তাদের সঙ্গে জান্নাতে বসবাস করতে পারব, যদিও তাঁদের আমলের মত আমল আমি করতে পরিনি’।
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীদেরকে একটি ব্যাপারে এতটা আনন্দিত দেখতে পেলাম যে, অন্য কোন ব্যাপারেই এরূপ আনন্দিত হ’তে দেখিনি। তা হ’ল এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে তার সৎকাজের জন্য ভালোবাসে, কিন্তু সে তার মতো সৎকাজ করতে পারে না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, المَرءُ مَعَ مَن أَحَبَّ ‘প্রত্যেক ব্যক্তিই যাকে ভালোবাসে সে তার সাথী হবে’।
(১৩) ভাল লোকদের সাথে থাকা বা থাকার আকাঙ্ক্ষা করা এবং আল্লাহর কাছে এজন্য দো‘আ করা পূর্ববর্তী নবীদের শিক্ষা। যেমন-
(ক) ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর কাছে এই বলে দো‘আ করেছেন, رَبِّ هَبْ لِي حُكْمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমাকে প্রজ্ঞা দাও এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত কর’ (শু‘আরা ২৬/৮৩)।
(খ) ইউসুফ (আঃ) এই বলে দো‘আ করেছেন,
رَبِّ قَدْ آتَيْتَنِي مِنَ الْمُلْكِ وَعَلَّمْتَنِي مِنْ تَأْوِيلِ الْأَحَادِيثِ فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَنْتَ وَلِيِّي فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ تَوَفَّنِي مُسْلِمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ
‘হে আমার পালনকর্তা! আপনি আমাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছেন এবং আমাকে স্বপ্নসমূহের ব্যাখ্যাদানের শিক্ষা প্রদান করেছেন। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের হে সৃষ্টিকর্তা! আপনিই আমার কার্যনির্বাহী দুনিয়া ও আখেরাতে। আপনি আমাকে ‘মুসলিম’ হিসাবে মৃত্যু দান করুন এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের সাথে মিলিত করুন’ (ইউসুফ ১২/১০১)।
(গ) সুলায়মান (আঃ) দো‘আ করতেন,
رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَدْخِلْنِي بِرَحْمَتِكَ فِي عِبَادِكَ الصَّالِحِينَ-
‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমাকে সামর্থ্য দাও, যাতে আমি তোমার নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে দান করেছ। আর যাতে আমি এমন সৎকর্ম করতে পারি যা তুমি পসন্দ কর এবং আমাকে তোমার অনুগ্রহে তোমার সৎকর্মশীলবান্দাদের অন্তর্ভুক্ত কর’ (নমল ২৭/১৯)।
(১৪) একে অপরের সাথে ভালোবাসা স্থাপনকারী ব্যক্তিদের চেহারা নূরানী হবেঃ ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর জন্য পরস্পর ভালোবাসা স্থাপনকারী ব্যক্তিদেরকে মর্যাদা স্বরূপ নূরানী চেহারা দান করা হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
لَيَبْعَثَنَّ اللهُ أَقْوَامًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِيْ وُجُوْهِهِمُ النُّوْرُ، عَلَى مَنَابِرِ اللُّؤْلُؤِ، يَغْبِطُهُمُ النَّاسُ، لَيْسُوْا بِأَنْبِيَاءَ وَلَا شُهَدَاءَ. ... فَقَالَ: يَا رَسُوْلَ اللهِ، حَلِّهِمْ لَنَا نَعْرِفْهُمْ. قَالَ: هُمُ الْمُتَحَابُّوْنَ فِي اللهِ، مِنْ قَبَائِلَ شَتَّى، وَبِلَادٍ شَتَّى، يَجْتَمِعُوْنَ عَلَى ذِكْرِ اللهِ يَذْكُرُوْنَهُ.
‘আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন এমন একদল লোকদেরকে পুনরুত্থান করাবেন যাদের চেহারা হবে মণি-মুক্তার উপরে নূরানী, যাদেরকে দেখে লোকেরা ঈর্ষা করবে অথচ তারা নবীও নন শহীদও নন। ... অতঃপর সে (ছাহাবী) বলল, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের বৈশিষ্ট্য বলুন, যাতে আমরা তাদেরকে চিনতে পারি। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তারা বিভিন্ন গোত্রের যারা আল্লাহর জন্য পরস্পরকে ভালোবাসতেন এবং তারা বিভিন্ন দেশের যারা আল্লাহকে স্মরণ করার জন্য একত্রিত হ’তেন’।
(১৫) জান্নাত লাভের মাধ্যমঃ আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসা, তাঁর সন্তুষ্টির জন্য কারো সাথে সাক্ষাৎ করা জান্নাত লাভের অন্যতম মাধ্যম। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِرِجَالِكُمْ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ؟ النَّبِيُّ فِي الْجَنَّةِ وَالشَّهِيدُ فِي الْجَنَّةِ وَالصِّدِّيقُ فِي الْجَنَّةِ وَالْمَوْلُودُ فِي الْجَنَّةِ وَالرَّجُلُ يَزُورُ أَخَاهُ فِي نَاحِيَةِ الْمِصْرِ فِي الْجَنَّةِ،
‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতবাসীদের সম্পর্কে খবর দিব না? নব x জান্নাতী, শহীদ জান্নাতী, ছিদ্দীক্ব জান্নাতী, নবজাতক জান্নাতী, আর ঐ ব্যক্তিও জান্নাতী যে তার ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের জন্য দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে’। অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন,
مَنْ عَادَ مَرِيْضًا أَوْ زَارَ أَخًا لَهُ فِي اللهِ نَادَاهُ مُنَادٍ أَنْ طِبْتَ وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الجَنَّةِ مَنْزِلاً،
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির আশায় কোন অসুস্থ লোককে দেখতে যায় অথবা কোন ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে যায়, একজন ঘোষক (ফেরেশতা) তাকে ডেকে বলতে থাকেন, কল্যাণময় তোমার জীবন, কল্যাণময় তোমার এই পথ চলাও। তুমি তো জান্নাতের মধ্যে একটি বাসস্থান নির্দিষ্ট করে নিলে’।
উপরোক্ত আলোচনায় প্রমাণিত হয় যে, এক মুসলমান অপর মুসলমানকে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ও ক্বিয়ামতের দিন শান্তি পাওয়ার জন্য সর্বোপরি জান্নাত লাভের আশায় ভালোবাসবে। এই ভালোবাসা যেন দুনিয়াবী স্বার্থে ব্যাহত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মুমিনের ভুল-ত্রুটির প্রতি লক্ষ্য না করে তার ভাল কাজগুলোর প্রতি খেয়াল করতে হবে, আর ভুলগুলো সংশোধনের জন্য সাধ্যানুযায়ী, মার্জিত ভাষায় শরী‘আতের নির্দিষ্ট পন্থা অনুযায়ী চেষ্টা করতে হবে। সাথে সাথে আল্লাহর কাছে তার হেদায়াতের জন্য দো‘আ করতে হবে।
পরস্পরের মাঝে ভালবাসা বৃদ্ধির উপায়ঃ
বর্তমানে মানুষ স্বীয় স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। নিঃস্বার্থভাবে একমাত্র আল্লাহর জন্য অন্যকে ভালবাসার বিষয়টি অনেকেই ভুলে গেছে। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করা দরকার। তাহ’লে সমাজ ও দেশ সুন্দর হবে। পরবর্তী প্রজন্ম একটি সৌহার্দ্র্যপূর্ণ পরিবেশ পাবে। মানুষের মধ্যে ভালবাসা বৃদ্ধির জন্য নিম্নোক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে।
(১) ঈমান আনা ও নেক কাজ করাঃ ঈমানদার ব্যক্তিরা পরস্পরকে ভালবেসে থাকে। ঈমান ও নেক আমল যখন একত্রিত হয় তখন মুমিন যেমন আরেক মুমিনকে ভালবাসে আল্লাহ তা‘আলা এবং আকাশের ও যমীনের অধিবাসীগণও সেই বান্দাকে ভালবাসে। আল্লাহ বলেন,
إِنَّ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوْا الصَّالِحَاتِ سَيَجْعَلُ لَهُمُ الرَّحْمَنُ وُدًّا-
‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে এবং সৎ কর্ম সম্পাদন করে পরম করুণাময় অবশ্যই তাদের জন্য (বান্দাদের অন্তরে) ভালবাসা সৃষ্টি করবেন’ (মারিয়ম ১৯/৯৬)। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
إنَّ اللهَ إذا أحَبَّ عَبْدًا دَعا جِبْرِيلَ فقالَ: إنِّي أُحِبُّ فُلانًا فأحِبَّهُ، قالَ: فيُحِبُّهُ جِبْرِيلُ، ثُمَّ يُنادِيْ في السَّماءِ فيَقوْلُ: إنَّ اللهَ يُحِبُّ فُلانًا فأحِبُّوْهُ، فيُحِبُّهُ أهْلُ السَّماءِ، قالَ ثُمَّ يُوْضَعُ لَهُ القَبُوْلُ في الأرْضِ،
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন বান্দাকে ভালবাসেন তখন জিব্রীল (আঃ)-কে ডেকে বলেন, নিশ্চয়ই আমি অমুক ব্যক্তিকে ভালবাসি। অতএব তুমিও তাকে ভালবাস। তখন জিব্রীল (আঃ) তাকে ভালবাসেন। অতঃপর আকাশে ঘোষণা করেন যে, আল্লাহ অমুক ব্যক্তিকে ভালবাসেন। সুতরাং তোমরা তাকে ভালবাস। তখন আকাশবাসীও তাকে ভালবাসেন। অতঃপর তার গ্রহণযোগ্যতা জমিনে রাখা হয়’।
(২) সালাম বিনিময় করাঃ রাসূল (ছাঃ) মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা সৃষ্টির জন্য বেশী বেশী সালাম বিনিময়ের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,
أوَلاَ أدُلُّكُمْ عَلَى شَيْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ؟ أفْشُوْا السَّلَامَ بَيْنَكُمْ
‘আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি কাজ বলে দেবো না, যা করলে তোমরা পরস্পর ভালবাসতে পারবে? (তা হ’ল) তোমরা পরস্পর সালাম বিস্তৃত করো’।
(৩) হাদিয়া প্রদান করাঃ কোন মুসলিম ভাইকে হাদিয়া বা উপহার দেওয়ার মাধ্যমে ভালবাসা বৃদ্ধি পায়। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, تَهَادُّوْا تَحَابُّوْا، ‘তোমরা পরস্পরকে হাদিয়া দাও, তোমাদের মধ্যে ভালবাসা সৃষ্টি হবে’।
(৪) সৎ ও মুত্তাকী ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব করাঃ মানুষ তার বন্ধুর চরিত্রে বিশেষিত হয়। আর ভাল, সৎ ও মুত্তাকী ব্যক্তি তার বন্ধুকে একমাত্র আল্লাহর জন্য ভালবাসবে। আবু সাঈদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছেন,
لاَ تُصَاحِبْ إِلاَّ مُؤْمِنًا وَلاَ يَأْكُلْ طَعَامَكَ إِلاَّ تَقِيٌّ،
‘তুমি মুমিন ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো সঙ্গী হবে না এবং তোমার খাদ্য যেন পাহেযগার লোক ব্যতীত অন্য কেউ না খায়’। অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,
الرَّجُلُ عَلَى دِيْنِ خَلِيْلِهِ فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ،
‘মানুষ তার বন্ধুর রীতিনীতির অনুসারী হয়। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকেই যেন লক্ষ্য করে যে, সে কি ধরনের বন্ধু গ্রহণ করেছে’। অন্য হাদীছে রাসূল (ছাঃ) সৎসঙ্গীকে সুগন্ধ বহনকারীর সাথে তুলনা করেছেন। যার সাথে থাকলে সুগন্ধি পাওয়া যায়। আর অসৎ সঙ্গীকে কামারের হাফরের সাথে তুলনা করেছেন। যার সাথে থাকলে কাপড় জ্বালিয়ে দিবে অথবা দুর্গন্ধ পাওয়া যাবে।
(৫) বন্ধুর বাড়ীতে নিঃস্বার্থভাবে যাতায়াত করাঃ আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,
أَنَّ رَجُلاً زَارَ أَخًا لَهُ فِىْ قَرْيَةٍ أُخْرَى فَأَرْصَدَ اللهُ لَهُ عَلَى مَدْرَجَتِهِ مَلَكًا فَلَمَّا أَتَى عَلَيْهِ قَالَ أَيْنَ تُرِيْدُ قَالَ أُرِيْدُ أَخًا لِى فِى هَذِهِ الْقَرْيَةِ. قَالَ هَلْ لَكَ عَلَيْهِ مِنْ نِعْمَةٍ تَرُبُّهَا قَالَ لاَ غَيْرَ أَنِّى أَحْبَبْتُهُ فِى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ. قَالَ فَإِنِّىْ رَسُولُ اللهِ إِلَيْكَ بِأَنَّ اللهَ قَدْ أَحَبَّكَ كَمَا أَحْبَبْتَهُ فِيْهِ.
‘জনৈক ব্যক্তি তার এক (মুসলিম) ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের জন্য অন্য গ্রামে রওয়ানা হয়। পথে আল্লাহ তার জন্য অপেক্ষমান একজন ফেরেশতা নিযুক্ত করেন। যখন সে তার কাছে আসল তখন (ফেরেশতা) তাকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ? সে বলল, আমি এই গ্রামে আমার ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের জন্য যাচ্ছি। ফেরেশতা আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি যেখানে যার কাছে যাচ্ছ, সেখানে বা তার কাছে তোমার কোন স্বার্থ বা সম্পদ আছে কি যার কারণে তুমি সেখানে যাচ্ছ? লোকটি বলল, না আমি সেখানে যাচ্ছি এজন্য যে, আমি তাঁকে আল্লাহর জন্য ভালবাসি। ফেরেশতা বলল, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার নিকট দূত হিসাবে প্রেরিত হয়েছি, এই শুভ সংবাদ নিয়ে যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে এরূপ ভালোবাসেন, যেরূপ তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাস’।
(৬) সুন্দর কথা বলাঃ সুন্দর কথা বা আচরণের মাধ্যমে অনেক সময় শত্রু ও বন্ধুতে পরিণত হয়। এজন্য আল্লাহ মানুষকে সুন্দর কথা বলার নির্দেশ দিয়ে বলেন,وَقُوْلُوْا لِلنَّاسِ حُسْنًا، ‘তোমরা মানুষের সাথে উত্তম কথা বল’ (বাক্বারাহ ২/৮৩)।
(৭) চরিত্রবান হওয়াঃ সুন্দর চরিত্রের মাধ্যমে অন্যকে নিজের বন্ধু বানানো যায়। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّمَا بُعِثْتُ لأُتَمِّمَ مَكَارِمَ وفي روايةٍ صَالِحَ الأَخْلاَقِ، ‘নিশ্চয়ই আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য, অন্য বর্ণনায় সৎ চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য প্রেরিত হয়েছি’।[8] চরিত্রবান ব্যক্তি জানণাতের উচ্চস্থানে আসীন হবেন। ক্বিয়ামতের দিন রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটতম হবেন। রাসূল (ছাঃ)-এর চারিত্রক গুণাবলী দেখেই অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছে। তাই রাসূল (ছাঃ)-এর উম্মত হিসাবে আমাদের সকলের চরিত্রবান হওয়া উচিৎ। এতে আমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে।
(৮) কল্যাণ কামণা করাঃ সকলের জন্য কল্যাণ কামনা করা একজন মুসলমানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আর এর ফলে পরস্পরের ভালবাসা বৃদ্ধি পায়। জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ আল-বাজালী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,بَايَعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى إِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيْتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالنُّصْحِ لِكُلِّ مُسْلِمٍ. ‘আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে বায়া‘আত গ্রহণ করেছি ছালাত কায়েম করার, যাকাত প্রদান করার এবং সমস্ত মুসলিমের জন্য কল্যাণ কামনা করার’। রাসূল (ছাঃ) বলেন,الدِّيْنُ النَّصِيْحَةُ، قُلْنَا لِمَنْ قَالَ لِلَّهِ وَلِكِتَابِهِ وَلِرَسُوْلِهِ وَلأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِيْنَ وَعَامَّتِهِمْ، ‘দ্বীন হচ্ছে নছীহত বা কল্যাণ কামনা। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কার জন্য? তিনি বললেন, আল্লাহ, তাঁর কিতাবের, তাঁর রাসূলের, মুসিলম নেতাদের এবং সকল মুসলিমের জন্য’।
(৯) ক্ষমা করা ও রাগ নিয়ন্ত্রণ করাঃ মানুষকে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা করলে এবং নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে যে কোন মানুষই বন্ধু হয়ে যাবে। এমনকি চরম শত্রুও বন্ধুতে পরিণত হ’তে পারে। মহান আল্লাহ বলেন,وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِيْ بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيْمٌ، ‘ভাল ও মন্দ কখনো সমান হ’তে পারে না। মন্দকে প্রতিহত কর ভাল দ্বারা, যেন তোমার ও যার মধ্যে শক্রতা রয়েছে সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যায়’ (ফুছছিলাত ৪১/৩৪)। তিনি আরো বলেন,
هَلْ جَزَاءُ الْإِحْسَانِ إِلَّا الْإِحْسَانُ ‘উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম ছাড়া আর কি হ’তে পারে’ (আর-রহমান ৫৫/৬০)। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إنَّ اللهَ رَفِيْقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ، ويُعْطِيْ عَلَى الرِّفْقِ مَا لاَ يُعْطِيْ عَلَى العُنْفِ، ‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ নম্র, তিনি নম্রতা পসন্দ করেন। তিনি নম্রতার জন্য যা দান করেন, তা রুক্ষতার জন্য দান করেন না’।
(১০) কাউকে আল্লাহর জন্য ভালবাসলে তাকে অবহিত করাঃ কেবল আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসলে তাকে অবহিত করতে হবে। এতে ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِذَا أَحَبَّ الرَّجُلُ أَخَاهُ فَلْيُخْبِرْهُ أَنَّهُ يُحِبُّهُ، ‘যখন কোন মানুষ তার ভাইকে ভালবাসে, তখন সে যেন তাকে জানিয়ে দেয় যে, সে তাকে ভালোবাসে’। অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِذَا أَحَبَّ أَحَدُكُمْ صَاحِبَهُ فَلْيَأْتِهِ فِى مَنْزِلِهِ فَلْيُخْبِرْهُ أَنَّهُ يُحِبُّهُ لِلَّهِ، ‘যখন তোমাদের কেউ তার সাথীকে ভালবাসে, তখন সে যেন তার বাড়ীতে আসে এবং তাকে জানিয়ে দেয় যে, সে তাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে’।
(১১) উপকার করলে প্রশংসা করাঃ কোন মুসলিম ভাই উপকার করলে ‘তার’ শুকরিয়া আদায় করলে ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ صُنِعَ إِلَيْهِ مَعْرُوْفٌ فَقَالَ لِفَاعِلِهِ جَزَاكَ اللهُ خَيْرًا فَقَدْ أَبْلَغَ فِى الثَّنَاءِ، ‘কাউকে অনুগ্রহ করা হ’লে সে যদি অনুগ্রহকারীকে বলে, ‘তোমাকে আল্লাহ তা‘আলা উত্তম প্রতিদান দিন’ তবে সে উপযুক্ত ও পরিপূর্ণ প্রশংসা করল’।
(১২) ভাল কাজের অছিয়ত করাঃ মু‘আয (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) তার হাত ধরে বললেন, ‘হে মু‘আয! আল্লাহর শপথ! নিঃসন্দেহে আমি তোমাকে ভালবাসি। অতঃপর আমি তোমাকে অছিয়ত করছি, হে মু‘আয! তুমি প্রত্যেক ছালাতের পরে এ শব্দগুলো বলা ছাড়বে না,اللَّهُمَّ أَعِنِّى عَلَى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ، ‘হে আল্লাহ! তোমার যিকর করার, তোমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার এবং উত্তমরূপে তোমার ইবাদত করার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য কর’।
(১৩) দো‘আ করাঃ কোন মুসলিম ভাই অপর ভাইয়ের জন্য এই বলে দো‘আ করবে, أَحَبَّكَ الَّذِى أَحْبَبْتَنِى لَهُ، ‘যাঁর (আল্লাহর) ওয়াস্তে তুমি আমাকে ভালবাস, তিনি তোমাকে ভালবাসুন’।
(১৪) অন্যের প্রতি দয়াশীল হওয়াঃ অপরের প্রতি দয়াশীল হ’লে পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা বৃদ্ধি পায়। এজন্য আল্লাহ তাঁর রাসূলকে লক্ষ্য করে বলেন, فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظّاً غَلِيظَ الْقَلْبِ لانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ ‘অতঃপর আল্লাহর রহমতে তুমি তাদের জন্য প্রতি নম্র হয়েছিলে। যদি তুমি কঠোর স্বভাবের, কঠিন অন্তরসম্পন্ন হ’তে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়ত’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)। রাসূল (ছাঃ)-কে লক্ষ্য করে অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ، ‘আর মুমিনদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করে, তাদের প্রতি তুমি তোমার বাহুকে অবনত কর’ (শু‘আরা ২৬/২১৫)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ ‘মুমিনদের জন্য তোমার বাহু অবনত কর’ (হিজর ১৫/৮৮)। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মুমিনদেরকে পরস্পরের প্রতি দয়াশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
(১৫) কোন মুমিন মারা গেলে তার জন্য দো‘আ করা ও তার জন্য মনে কোন কুটিলতা না রাখা। আল্লাহ বলেন,
وَالَّذِيْنَ جَاءُوْا مِنْ بَعْدِهِمْ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِيْنَ سَبَقُوْنَا بِالْإِيْمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِيْ قُلُوْبِنَا غِلًّا لِلَّذِيْنَ آمَنُوْا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيْمٌ،
‘যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে, ‘হে আমাদের রব! আমাদের ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদের ক্ষমা করুন এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের রব! নিশ্চয়ই আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু’ (হাশর ৫৯/১০)।
(১৬) মানুষের নিকটে হাত পাতা বন্ধ করাঃ সাহল বিন সা‘দ আস-সা‘দী (রাঃ) বলেন, একজন লোক নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাকে এমন একটি আমলের কথা বলে দিন যে আমলটি করলে আল্লাহ আমাকে ভালবাসবেন এবং মানুষও আমাকে ভালবাসবে। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,ازْهَدْ فِى الدُّنْيَا يُحِبَّكَ اللهُ وَازْهَدْ فِيْمَا فِىْ أَيْدِى النَّاسِ يُحِبُّوْكَ النّاسُ، ‘তুমি দুনিয়া বিমুখ হও তাহ’লে আল্লাহ তোমাকে ভালবাসবেন। আর মানুষের কাছে যা আছে তা থেকে বিমুখ হও তাহ’লে মানুষ তোমাকে ভালবাসবে’।
(১৭) অন্যের জন্য শুভাকাঙ্খী হওয়াঃ কোন ব্যক্তির উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিতে তার কল্যাণ কামনা করলে পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা বৃদ্ধি পায়। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,الْمُؤْمِنُ مِرْآةُ الْمُؤْمِنِ وَالْمُؤْمِنُ أَخُو الْمُؤْمِنِ يَكُفُّ عَلَيْهِ ضَيْعَتَهُ وَيَحُوْطُهُ مِنْ وَرَائِهِ، ‘এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য আয়নাস্বরূপ এবং এক মুমিন অপর মুমিনের ভাই। তারা একে অপরের ক্ষতি করা হ’তে রক্ষা করে এবং তার অনুপস্থিতিতে তাকে রক্ষা করে’।
(১৮) অন্যকে নিরাশ না করাঃ কারো আপদ-বিপদে সাহস জোগালে অতি সহজেই ভালবাসা বৃদ্ধি পায়। রাসূল (ছাঃ) মু‘আয ও আবূ মূসা (রাঃ)-কে ইয়ামানে প্রেরণ করেন ও আদেশ দেন যে ,يَسِّرَا وَلاَ تُعَسِّرَا، وَبَشِّرَا وَلاَ تُنَفِّرَا، وَتَطَاوَعَا وَلاَ تَخْتَلِفَا، ‘লোকদের প্রতি সহজ করবে, কঠোরতা করবে না, তাদেরকে সুখরব দিবে, তাড়িয়ে দিবে না। পরস্পর একমত হবে, মতভেদ করবে না’।
(১৯) সংশোধনের জন্য নছীহত করা ও কল্যাণ কামনা করাঃ কোন ভাইকে সংশোধনের জন্য নছীহত করলে ভাল পথ দেখালে পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহ বলেন,
إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِيْ خُسْرٍ، إِلَّا الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ،
‘(সকল মানুষই ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত) তবে তারা ব্যতীত যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈযের উপদেশ দিয়েছে’ (আছর ১০৩/৩)।
জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ আল-বাজালী (রাঃ) বলেন, ‘আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে বায়‘আত গ্রহণ করেছি ছালাত কায়েম করার, যাকাত প্রদান করার এবং সমস্ত মুসলিমের মঙ্গল কামনা করার’। অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَقِيْلُوْا ذَوِى الْهَيْئَاتِ عَثَرَاتِهِمْ إِلاَّ الْحُدُوْدَ، ‘তোমরা উত্তম গুণাবলীর অধিকারী লোকদের পদস্খলন (ছোটখাট ত্রুটি) এড়িয়ে যাও, হদ্দের অপরাধ ব্যতীত’।
(২০) উপস্থিতি-অনুপস্থিতিতে তার ক্ষতি না করাঃ আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,الْمُؤْمِنُ مِرْآةُ الْمُؤْمِنِ وَالْمُؤْمِنُ أَخُو الْمُؤْمِنِ يَكُفُّ عَلَيْهِ ضَيْعَتَهُ وَيَحُوطُهُ مِنْ وَرَائِهِ ‘এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য আয়নাস্বরূপ এবং এক মুমিন অপর মুমিনের ভাই। তারা একে অপরের ক্ষতি করা হ’তে রক্ষা করে এবং তার অনুপস্থিতিতে তাকে রক্ষা করে’। দুনিয়াবী স্বার্থে মানুষ একে অপরের ক্ষতি সাধন করে। ফলে মুমিনদের মধ্যে ভালবাসা কমে যায়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,فَإِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ بَيْنَكُمْ حَرَامٌ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا، فِى شَهْرِكُمْ هَذَا، فِى بَلَدِكُمْ هَذَا. ‘তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন-সম্পদ, তোমাদের সম্মান তোমাদের পরস্পরের জন্য হারাম, যেমন আজকে তোমাদের এ দিন, তোমাদের এ মাস, তোমাদের এ শহর মর্যাদা সম্পন্ন’।
ভালবাসা নষ্ট হওয়ার কারণঃ
মুমিমগণ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পরস্পর ভালবাসবে এটা আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) নির্দেশ। কিন্তু প্রার্থিব কিছু স্বার্থ, শয়তানের প্ররোচনা ও অন্তরের কুটিলতাসহ বিভিন্ন করণে এই ভালবাসা নষ্ট হয়। এখানে ভালবাসা নষ্ট হওয়ার কিছু কারণ উল্লেখ করছি।
(১) দুনিয়ার চাওয়া- পাওয়াঃ আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসা নষ্ট হওয়ার প্রথম ও প্রধান কারণ হ’ল পরস্পর ভালবাসার মধ্যে দুনিয়াবী চাওয়া-পাওয়া থাকা। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ازْهَدْ فِي الدُّنْيَا يُحِبَّكَ اللهُ وَازْهَدْ فِيْمَا فِيْ أَيْدِي النَّاسِ يُحِبُّوْكَ، ‘তুমি দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত হও, তাহ’লে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। মানুষের নিকট যা আছে, তুমি তার প্রতি অনাসক্ত হয়ে যাও, তাহ’লে তারাও তোমাকে ভালোবাসবে’। আল্লাহর জন্য ভালবাসার মধ্যে দুনিয়াবী চাওয়া-পাওয়া ও স্বার্থ চলে আসলে সে ভালবাসা বেশী দিন টিকে না। বরং দুনিয়ার স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে ভালবাসাও শেষ হয়ে যায়।
(২) ছিদ্রান্বেষণ, গীবত, অহেতুক ধারণা করাঃ কোন মুসলিম ভাই সম্পর্কে খারাপ ধারণা, তার দোষ খুঁজে বের করা, তার পিছনে লেগে থাকা ভালবাসা নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ। আল্লাহ বলেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اجْتَنِبُوْا كَثِيْرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوْا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوْهُ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ تَوَّابٌ رَحِيْمٌ،
‘হে মুমিনগণ! তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পসন্দ করবে? তোমরা তো তা অপসন্দই করে থাক। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ অধিক তাওবা কবুলকারী, অসীম দয়ালু’ (হুজুরাত ৪৯/১২)। আল্লাহর জন্য ভালবাসা হয় পরস্পরের সহযোগিতার মাধ্যমে, কিন্তু সে ভালবাসার মধ্যে অন্যের দোষ-ত্রুটি খোঁজাখুঁজি করলে, গীবত অথবা অহেতুক ধারণা করলে সে ভালবাসা দিন দিন কমে যায়। এজন্য রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ، فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيثِ، وَلاَ تَحَسَّسُوا، وَلاَ تَجَسَّسُوا، وَلاَ تَحَاسَدُوا، وَلاَ تَدَابَرُوا، وَلاَ تَبَاغَضُوا، وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا. ‘তোমরা ধারণা থেকে বিরত থাকো। ধারণা বড় মিথ্যা। তোমরা দোষ তালাশ করো না, গোয়েন্দাগিরি করো না, পরস্পর হিংসা পোষণ করো না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করো না এবং পরস্পর বিরোধে লিপ্ত হয়ো না, বরং তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও’। অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,
يَا مَعْشَرَ مَنْ آمَنَ بِلِسَانِهِ وَلَمْ يَدْخُلِ الإِيْمَانُ قَلْبَهُ لاَ تَغْتَابُوا الْمُسْلِمِيْنَ وَلاَ تَتَّبِعُوا عَوْرَاتِهِمْ فَإِنَّهُ مَنِ اتَّبَعَ عَوْرَاتِهِمْ يَتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ وَمَنْ يَتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ يَفْضَحْهُ فِىْ بَيْتِهِ،
‘হে সেসব লোক, যারা কেবল মুখেই ঈমান এনেছে, কিন্তু ঈমান অন্তরে প্রবেশ করেনি! তোমারা মুসলিমদের গীবত করবে না ও দোষ-ত্রুটি তালাশ করবে না। কারণ যারা তাদের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ায় আল্লাহও তাদের দোষ-ত্রুটি খুঁজবেন। আর আল্লাহ কারো দোষ-ত্রুটি তালাশ করলে তাকে তার ঘরের মধ্যেই অপদস্থ করে ছাড়বেন’।
(৩) গোপন কথা প্রকাশ করাঃ মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা একটি বড় ব্যাপার। আর এতে পরস্পরের প্রতি ভালবাসা বৃদ্ধি পায়, অপর দিকে মুসলিম ভাইয়ে দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করলে ভালবাসা নষ্ট হয়। কয়েকজন একত্র থাকলে একজনকে আলাদা করে অন্য কোন কথা বললে বা পরামর্শ করলে পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা কমে যায়। এজন্য কুরআনে এরূপ কাজকে শয়তানের কুমন্ত্রণা বলা হয়েছে। (মুজাদালা ৫৮/১০)। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِذَا كُنْتُمْ ثَلاَثَةً فَلاَ يَتَنَاجَى رَجُلاَنِ دُوْنَ الآخَرِ، حَتَّى تَخْتَلِطُوْا بِالنَّاسِ، أَجْلَ أَنْ يُحْزِنَهُ، ‘কোথাও তোমরা তিনজন থাকলে একজনকে বাদ দিয়ে দু’জনে কানে-কানে কথা বলবে না। এত তার মনে দুঃখ হবে। তোমরা পরস্পর মিশে গেলে তবে তা করতে দোষ নেই’।
(৪) হিংসাঃ ভালবাসা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হ’ল হিংসা করা। পারস্পরিক দয়া-মহববতের মধ্যেই ভালবাসা গড়ে উঠে। হিংসা সেই ভালবাসাকে ধ্বংস করে দেয়। যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, دَبَّ إِلَيْكُمْ دَاءُ الأُمَمِ قَبْلَكُمُ الْحَسَدُ وَالْبَغْضَاءُ ‘তোমাদের আগেকার উম্মতদের রোগ তোমাদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। তা হ’ল পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃণা’।
(৫) কারো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে হস্তক্ষেপ করলেঃ প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রয়েছে। আর সবাই চায় তার এই গোপনীয়তা গোপন থাকুক। কিন্তু কোন মুসলিম যদি অন্য কোন মুসলিম ভাইয়ের গোপনীয়তা প্রকাশ করে বা গোপন বিষয়ে কাউকে আঘাত করে তাহ’লে পরস্পরের ভালবাসা হ্রাস পাবে। এজন্য রাসূল (ছাঃ) অপ্রয়োজনীয় ও অনর্থক কথা ও কাজ থেকে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, مِنْ حُسْنِ إِسْلاَمِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لاَ يَعْنِيهِ ‘কোন ব্যক্তির ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হ’ল অনর্থক আচরণ পরিত্যাগ করা’।
(৬) নিজেকে প্রকাশ করার জন্য বেশী ব্যস্ত থাকাঃ ভালবাসা নষ্ট হওয়ার অন্যতম আরেকটি কারণ হ’ল অন্যকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা ও নিজেকে অন্যের উপরে প্রাধান্য দেওয়া।
(৭) ভালবাসায় অতিরঞ্জণ না করাঃ কোন বিষয়েই অতিরিক্ত ভাল নয়। ভালবাসার ক্ষেত্রেও মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা একান্ত যরূরী। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
أَحْبِبْ حَبِيبَكَ هَوْنًا مَا عَسَى أَنْ يَكُونَ بَغِيضَكَ يَوْمًا مَا وَأَبْغِضْ بَغِيضَكَ هَوْنًا مَا عَسَى أَنْ يَكُونَ حَبِيبَكَ يَوْمًا مَا-
‘তোমার বন্ধুর সাথে ভালবাসার আধিক্য প্রদর্শন করবে না। হয়ত সে একদিন তোমার শত্রু হয়ে যাবে। তোমার শত্রুর সাথেও শত্রুতার চরম সীমা প্রদর্শন করবে না। হয়ত সে একদিন তোমার বন্ধু হয়ে যাবে’।
(৮) ঝগড়াঃ যে কোন ঝগড়াই মানুষের ভালবাসাকে বিনষ্ট করে। এজন্য ইসলামে ঝগড়াকে এড়িয়ে চলার পরমর্শ দেওয়া হয়েছে এবং ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
وَلَا تُجَادِلُوْا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِلَّا الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا مِنْهُمْ وَقُوْلُوْا آمَنَّا بِالَّذِيْ أُنْزِلَ إِلَيْنَا وَأُنْزِلَ إِلَيْكُمْ وَإِلَهُنَا وَإِلَهُكُمْ وَاحِدٌ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُوْنَ-
‘আর তোমরা উত্তম পন্থা ছাড়া আহলে কিতাবদের সাথে বিতর্ক করো না। তবে তাদের মধ্যে এদের ব্যতীত, যারা যুলুম করেছে। আর তোমরা বল, অমরা ঈমান এনেছি আমাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে এবং তোমাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে তার উপর এবং আমাদের ইলাহ ও তোমাদের ইলাহ তো একই। আর আমরা তাঁরই সমীপে আত্মসমর্পণকারী’ (আনকাবূত ২৯/৪৬)। আবূ উমামাহ (রাঃ) থেকে বণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
انَا زَعِيمٌ بِبَيْتٍ فِي رَبَضِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْمِرَاءَ وَإِنْ كَانَ مُحِقًّا وَبِبَيْتٍ فِي وَسَطِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْكَذِبَ وَإِنْ كَانَ مَازِحًا وَبِبَيْتٍ فِي أَعْلَى الْجَنَّةِ لِمَنْ حَسَّنَ خُلُقَهُ،
‘যে ব্যক্তি ন্যায়সঙ্গত হওয়া সত্ত্বেও ঝগড়া পরিহার করল আমি তার জন্য জান্নাতের বেষ্টনীর মধ্যে একটি ঘরের যিম্মাদার। আর যে ব্যক্তি তামাশার ছলেও মিথ্যা বলে না আমি তার জন্য জান্নাতের মাঝখানে একটি ঘরের যিম্মাদার। আর যে ব্যক্তি তার চরিত্রকে সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে আমি তার জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থিত একটি ঘরের যিম্মাদার’।
লেখকঃ সহকারী শিক্ষক, ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল খিলগাঁও, ঢাকা-তুলাগাঁও, দেবিদ্বার, কুমিল্লা।
সূত্রঃ মাসিক আত তাহরীক।📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘
আমার প্রিয় বাংলা বই হোয়াইটসআপ গ্রুপে যুক্ত হতে এখানেক্লিক করুন, টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং ফেইসবুক গ্রুপে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
No comments:
Post a Comment
আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।