আলী আহমদ মাবরুরঃঃ ছবির মানুষটাকে চেনেন? তার নাম মাওলানা মুহাম্মাদ মুসা। আমাদের
সময়ের সবচেয়ে প্রবীণ লেখক ও অনুবাদক। ৭৫ বছরের এ মানুষটি এখন আগের মতো আর কাজ করতে
পারেন না। কিন্তু একটি সময়ে কাজ করেছেন। রাতদিন উজাড় করে কাজ করেছেন। তার কাছে
গিয়েছিলাম সেদিন একটু দোয়া নেয়ার জন্য।
যারা ইসলামী সাহিত্য অঙ্গনে লেখালেখি ও
অনুবাদের কাজটি শুরু করেছিলেন, তাদের জন্য সবসময়ই আমার
দরদ ও কৃতজ্ঞতা কাজ করে। আমার মনে হয়, তারা
অনেক কঠিন সময়ে রাস্তাটি গড়ে দিয়ে গেছেন বিধায় আমরা এখন এত সহজে এর ওপর দিয়ে
হাঁটতে পারছি। আমার আফসোস হয়, আমি মাওলানা আব্দুর রহীম রহ, এর সহবত পাইনি। আব্দুল মান্নান তালিবকে
দেখেছি। কিন্তু তারও সান্নিধ্য পাইনি। হাফেজ আকরাম ফারুক মরহুমেরও সহবত পাইনি। তাই
তাদের সাথে যিনি সেই সময়গুলোতে একক ও যৌথভাবে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন সেই মাওলানা
মুহাম্মাদ মুসার সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা ছিল খুব বেশি।
আল্লাহ সেই ইচ্ছা পূরণ করেছেন। তার কাছে
গিয়েছি। অনেকটা সময় কাটিয়েছি। নিজের কিছু বই তাকে উপহার দিয়ে দুআ নিয়েছি। তার
স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই। তখন থেকেই তিনি একটু চুপচাপ ও নিষ্ক্রিয়
হয়ে গেছেন। তার ওপরও মনে জমা কষ্টও আছে বলে মনে হলো। হয়তো এই সব নানা অভিমানে আর
বয়সের ভাড়ে একটা সময় তিনি পুরোপুরি লেখালেখি থামিয়ে দেবেন।
মাওলানা মুসা অনেকগুলো মৌলিক বই লিখেছেন। তবে
অসাধারণ ৬৪টি বই অনুবাদ করেছন। তার একেকটি বইয়ের নাম দেখলেও ভালো লাগে। কী অসাধারণ
সবকাজ তিনি জীবনভর করে গেছেন।
তিনি আল কুরআনের বাংলা অনুবাদ করেছেন। সহিহ
মুসলিম, সহিহ বুখারি, সুনানে আবু দাউদ, হিসনুল মুসলিম, আল
আদাবুল মুফরাদ, শামায়েলে তিরমিজি, রিয়াদুস সলিহিন, মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ অনুবাদ করেছেন।
অসংখ্য বই সম্পাদনাও করেছেন। তাফহীমের ১০ খন্ডের সেট তার সম্পাদনা করা। তার
উল্লেখযোগ্য আরো কিছু কাজের মধ্যে আছে ইসলামী আকিদা, তাহাজ্জুদ
নামাজ ও তারাবীহ নামাজ, আল কুরআনের উসীলায় দুআ, কাবাঘরে ৩৬০ মূর্তি, ইসলামে শিশু অধিকার, মহানবি সা. এর অর্থনৈতিক শিক্ষা, সুন্নাহ ও হাদিস প্রভৃতি।
বাংলাদেশের লেখক অনুবাদকেরা কী পরিমান কষ্ট
করে এবং কী পরিমান অযতনে লেখালেখির এই কাজটি করে যান, তা অন্য দেশের মানুষ হয়তো কল্পনাও করতে পারবে
না। এর জন্য এককভাবে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা দায়ী নয়। সামগ্রিকভাবে আমাদের এখানকার
যে অব্যবস্থাপনা, ভালো মানুষের অবমূল্যায়নের
যে সিলসিলা- তাই এজন্য দায়ী। এ দেশে এরপরও প্রতিভাবান মানুষ জন্ম নেয়, নিজের মতো করে কাজ করে যায়। এ কারণে এই
মানুষগুলোর প্রতি আমার অনেক বেশি শ্রদ্ধা কাজ করে।
সারাজীবন কাজ করেও একজন মানুষ পদক পায় না।
আবার তেমন কিছু না করেও অনেকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি
পেয়ে যায়। এদেশে লেখক বা অনুবাদককে টাকা দিতে গেলে সবাই যেন গরীব হয়ে যায়। এই
সংকটে মরহুম কবি ফররুখ থেকে হালজমানার আহমেদ বাসির সবাই হয়তো পড়ে গেছেন। বাস্তবতা
হলো, কমফোর্টেবল পরিবেশে কাজ আমাদের এখানে খুব কম
পেশার লোকই কাজ করতে পারে।
মাওলানা মুসার সামনে খুবই দুর্বল একটি
ম্যাগনিফাইং গ্লাস দেখলাম। আরবি ক্লাসিক বইগুলোর ফন্ট বেশ ছোট থাকে। তিনি ঐ গ্লাস
ব্যবহার করে বই পড়েন। আরেকজন লেখক বললেন, বই
দিয়ে তো আর কিছু হয় না, দাওয়াতী কাজ হিসেবে বই
লিখি।
এতসব সংকটে থেকেও তাদের মন অনেকটা উদার থাকে-
এটি নিয়েও বিস্ময়ের শেষ নেই আমার। আমি বহু মানুষের সাথে দেখা করি। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে একদম কোটিপতি।
মাওলানা মুসার সামান্য আতিথিয়েতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। বিদায় বেলায়, ৭৫ বছরের মানুষটি আলো নিভু নিভু সিড়িঘরে
আমাকে এগিয়ে দিতে এলেন। তিনি সিড়ি ভেঙে নামবেনই। আমি করজোড়ে তাকে থামালাম। হঠাৎ
দেখি, আমার পকেটে হাত ঢুকিয়ে
দিলেন। বেশি নয়, অল্প টাকা। আমার দিকে
তাকিয়ে বললেন, কষ্ট করে আসছেন, কিছু তো দিতে পারলাম না। বাসায় একটু আরাম করে
চলে যায়েন। অন্ধকার সিঁড়িতে আমার চোখ ভিজে এলো।
পরে বাসে করে বাসায় ফিরতে ফিরতে মনে হলো, এত বড়ো লেখক ও অনুবাদক; হয়তো তিনিও যাতায়াতের ভাড়া নিয়ে কষ্ট করেছেন, তাই অন্য কেউ যাতে এ কষ্ট না পায় সেজন্য তিনি সতর্ক থাকেন।
📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘
আমার প্রিয় বাংলা বই হোয়াইটসআপ গ্রুপে যুক্ত হতে এখানেক্লিক করুন, টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং ফেইসবুক গ্রুপে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
No comments:
Post a Comment
আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।