মরহুম সোহেল আহমদ চৌধুরীঃ স্মৃতিচারণ নানান মুখে - আমার প্রিয় বাংলা বই

সাম্প্রতিকঃ

Post Top Ad

Responsive Ads Here

October 01, 2022

মরহুম সোহেল আহমদ চৌধুরীঃ স্মৃতিচারণ নানান মুখে



১৮ নভেম্বর ১৯৯৫ সালের এদিনে আমাদের একান্ত আপনজন মুহতারাম ছোহেল আহমদ চৌধুরী ইন্তেকাল করেন। তিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ সদস্য, সিলেট মহানগরী ও ঢাকা মহগানগরী উত্তরের সভাপতি এবং মৃত্যুকালে সিলেট মহানগরী জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী ছিলেন।

১৪ই নভেম্বর ২০১২
ভাইজান,
জানতে বড় ইচ্ছে করে , আপনি এখন কেমন আছেন? কিন্তু উপায় নেই অপেক্ষা ছাড়া সেদিনের - যেদিন সকল কিছু জানার সুব্যবস্থা করে রেখেছেন মহান রাব্বুল আলামীন।
উনিশশত পঁচানব্বই সালের আঠার নভেম্বর এর পর থেকে আমাদের জীবনে এমন মুহুর্ত খুবই কম এসেছে যেখানে আপনার উপস্থিতি নেই। প্রকৃতপক্ষে মূহুর্তগুলোর সমষ্টি যে বিষয়বস্তু, ঘটনা, প্রতিবন্ধকতা অথবা সফলতার জন্ম দিয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিতে অনুভব করেছি আপনার রেখে যাওয়া স্মৃতির শক্তিশালী প্রভাব। ভাবতে অবাক লাগে ,এত অল্পসময়ে- এত বেশি কেমন করে দিয়ে গেলেন? আর যদি এত কিছু নিয়ে এসেছিলেন, তাহলে এত দ্রুত চলে গেলেন কেন? আসলে যারা দিতে জানে তারা নিতে জানেনা, আপনিও তাই তাড়াহুড়ো করে সব বিলিয়ে দিয়ে আমাদের চিরঋণী করে এ জীবন থেকে বিদায় নিলেন।
প্রথম পরিচয়ঃ ১৯৮৫ সালে অক্টোবরের কোন এক দিন সকাল ১০ টায় শাহী ঈদগাহ মসজিদে দু’তলায় ছিল উপশাখার সাধারণ সভা। মেহমান কি বলেছিলেন এখন আর মনে নেই। তবে মুখের ভাষার সাথে চোখ ও হাত সমান তালে নড়াচড়া করছিল। শ্রুতারা মাঝে মাঝে হাসছেন, আবার কখনও নিরব হয়ে যাচ্ছেন অথবা মাথা ঝাঁকাচ্ছেন আর বক্তার মুখ ক্রমেই লাল হয়ে যাচ্ছিল। আমরা সবাই যেন তাজা হয়ে সভা থেকে বের হলাম। সবার সাথে মেহমান হাত মিলিয়ে বিদায় নিলেন। আমার হাতে নরম হাতের একটা বেশ শক্ত চাপ অনুভব করলাম। ফখরুল (ইউকে প্রবাসী)ভাইয়ের সাথে হোন্ডায় করে মেহমান চলে গেলে শুনলাম বলাবলি হচ্ছে , আর ক’দিন-এই ছোহেল ভাই শহর শাখার সেক্রেটারি হয়ে যাবেন। বুঝলাম আমাদের আজকের মেহমান খুবই সম্ভাবনাময় ছাত্রনেতা। যার প্রতিভার স্ফুরণ সম্পর্কে একটি উপশাখার কর্মীরাও সম্যক ধারণা রাখে। আপনার সাথে এটাই ছিল আমার প্রথম সাক্ষাৎ । সেই থেকে ১৯৯৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১০ বৎসর আপনাকে দেখেছি কাছে থেকে- আপন করে।
ভালবাসা-যেন বৃষ্টির অবিরাম মুষলধারাঃ বৃষ্টির মুষলধারা যেমন কঠিন শক্ত মাটিকে করে তোলে উর্বরা, তেমনি শত সহস্র সমস্যাপীড়িত কর্মীকে আপনার নিখাদ ভালবাসা করে তুলতো সদা সতেজ আর ময়দানের জন্য পাগল পারা। এখনও অবাক বিস্ময়ে ভাবি, কেমন করে এতো ভালবাসতে পারতেন।
তখন আপনি সিলেট শহর শাখা শিবিরের সভাপতি আর আমি এইচ এসসি পরীক্ষার্থী- সংগঠনের সাথী। সকাল বেলা মনির ভাইর ৫ম তলায় (পায়রা ৭) সেই রুমটিতে হঠাৎ হাজির হলেন। মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে বসলেন ,“শাহীন ,তুমি কি অসুস্থ?” আামি এতই অসুস্থ ছিলাম যে, চেয়ারে বসে লেখা পড়া করতে পারছিলাম না। অত্যধিক পীড়াপীড়িতে বিস্তারিত বলতে বাধ্য হলাম। আর লক্ষ্য করলাম, আপনার দুচোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমাকে বললেন,‘তুমি এতো অসুস্থ ছিলে ,আমি জানলামনা কেন ? আমারতো জানার অধিকার আছে’। নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থেকে সেদিন আপনার হৃদয়ের ভালবাসার গভীরতা অনুভব করছিলাম। অনেকদিন আপনি বলেছেন, ‘আমি যদি বুকটা চিরে দেখাতে পারতাম, তোমাদের কত ভালবাসি’। এমন মায়াভরা আবেগময় উক্তি ক’জন বলেছে আর ক’জন শুনেছে? পায়রা ‘৮৬ তে বসে আলাপের এক পর্যায়ে বলেছিলেন ,রাসুল (সঃ) কোন কোন সাহাবীকে সরাসরি বলেছিলেন তিনি উনাদের ভালবাসেন, ‘আমিও তোমাকে বলছি ভাইয়া, আমি তোমাদের ভালবাসি’। আপনার এমন ভালবাসা ছিল আমাদের কাছে যাদুর পরশ কাটি। ব্যক্তিগত- পারিবারিক সমস্যা সব ভুলে গিয়ে আল্লাহর দ্বীনের পথে ঝাঁপ দেয়ার জন্য এর চেয়ে মহৌষধ আর কি হতে পারে? খালেদ ভাই ছিলেন সম্ভাবনাময় সাথী । প্রায় ৪ বছর মাথার ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছিলেন। একাধিকবার দাখিল পরীক্ষা দিতে পারেননি। সে নিয়ে আপনার কত টেনশন ছিল। একদিন সাথীদের শব্বেদারীতে শেষ রাতে মেডিকেল কলোনী মসজিদে খালেদ ভাইর সুস্থতার জন্য সকলকে নিয়ে আল্লাহর দরবারে যে আহাজারী করেছিলেন ,আজও তা আমাদের কানে বাজে। সুস্থ হয়ে খালেদ ভাই সদস্য হয়েছিলেন এবং ডিগ্রী পাশ করে ছাত্র জীবন শেষে ৩ মাসের মধ্যে রুকনিয়াতের শপথও নিয়েছেন। বাড়ী থেকে আসলে বা কোন কারনে কয়েকদিন দেখা না হলে প্রথম সাক্ষাতে আপনি হাসি মুখে দুহাত প্রসারিত করে পরম স্নেহে বুকে জড়িয়ে নিতেন। আাপনার ভালবাসা ছিল অফুরন্ত। সেখানে ছিলনা কোন কৃত্রিমতার লেশ। ছিল শুধু আন্তরিকতা আর কল্যাণ কামনা। অকৃত্রিম ভালবাসার কাঙাল জনশক্তির জন্য আপনি গড়ে তুলেছিলেন নির্ভরযোগ্য এক ঠিকানা।
উদারতা-যেন এক মহাসমুদ্রঃ আপনার হৃদয়ের উদারতা চলার পথের সকল বাধা প্রতিবন্ধকতাকে করেছিল চরমভাবে পরাজিত। বহুবিধ কষ্টগুলো হজম করেছেন বিস্ময়কর ভাবে। আপনি বলতেন ‘ইসলামী আন্দোলন করতে হলে সমুদ্রের মত উদার হতে হবে’। সমুদ্র যেমন করে পৃথিবীর সকল ময়লা -আবর্জনা গ্রহণ করে অতি স্বাভাবিক ভাবে, আমাদেরকেও তেমনি অভ্যস্থ হতে হবে। কারও বিরুদ্ধে আপনার কোন অভিযোগ ছিলনা। একান্ত ব্যাক্তিগত বিষয়গুলো আমাদের সাথে আলাপ করলেও এ বিষয়ে ছিলেন একেবারে নিরব। দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে নেহায়েৎ অন্যায়ভাবে কষ্ট পাওয়ার ঘটনাগুলোতে আপনার উদারতা লক্ষ্য করে বিস্ময়াবিভূত হয়ে পড়ি। আপনার বি.এ পরীক্ষার ফল নিয়ে অথবা দৈনিক জালালাবাদের জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে তিক্ত অভিজ্ঞতাকালীন আপনার ধৈর্য্য আজও কঠিন সময়ে আমাদের পথ প্রদর্শন করে। মনে পড়ে, সদস্যপ্রার্থী আবেদন পত্র দেয়ার সময় আমাকে বলেছিলেন ,‘সম্পূর্ন মিথ্যা ,বানোয়াট ও উদ্দেশ্য- প্রনোদিত হয়ে যদি কেউ কোন কথা বলেছেন বলে মনে কর তবুও তা ভুলে যেতে হবে’। মানুষের সংগঠন পরিচালনায় এ ‘ডকটিন’ সংকীর্ণতা ও ভুল ধারণার ছোবল থেকে আত্বরক্ষার্থে যথার্থই অপরিহার্য।
আমল-আল্লাহর ভয়ে কম্পমান পথিকঃ আপনার ব্যক্তিগত আমল ছিল সবকিছুর উর্ধ্বে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম আপনার চোখ লাল। আমরা বুঝতাম আপনি শেষ রাতে ইবাদাত করেছেন। আপনার বালিশের নীচে তাছবিহ্ থাকতো। প্রায়ই রোজা রাখতেন এবং অন্যদের উৎসাহিত করতেন। কোরআন তেলাওয়াত সহিহ করার জন্য বায়তুল আমান মসজিদের ইমাম হযরত মাওলানা মুজাম্মিল হুসাইন সাহেবের ক্লাশ করেছিলেন কত সহজভাবে। মাওলানা সাহেব বিভিন্ন সময় একথা গল্প করেন। আপনি ছিলেন আল্লাহর ভয়ে সর্বদা কম্পমান মুমিন। অবসর সময়ে উঠতে বসতে প্রায়ই বলতে শুনতাম ‘ আল্লাহ মাফ করে দাও’। আলাহ অপনাকে মাফ করে দিয়েছেন কি না ইহজীবনে তা জানার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু শত-সহস্র কণ্ঠ প্রতিনিয়ত আপনার জন্য ক্ষমা ও উত্তম মর্যাদা ভিক্ষা করছেন পরম করুনাময়ের দরবারে, এটি আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ভাইজান, আপনি কতো ভাগ্যবান!
নেতৃত্ব বাছাই-এক অসাধারণ প্রতিভাঃ নেতৃত্বের জন্য যোগ্য লোক বাছাই করা ছিল আপনার মহান ব্রত। কর্মীদেরকে অন্তর্ভেদী দৃষ্ঠি দিয়ে অবলোকন করতেন। সবার যোগ্যতা,দূর্বলতা ও স¤ভাবনা সম্পর্কে ছিল সুস্পস্ট ধারনা। সদ্য বিদায়ী সভাপতি হিসাবে সিলেট শহর শাখা শিবিরের পরামর্শ সভার বেঠকে সকল সদস্য ভাইদের সম্পর্কে যে বিবরণ দিচ্ছিলেন তা দেখে বিস্মিত হয়ে কোন কোন ভাই বলছিলেন, ‘এ কি, মনে হচ্ছে যেন ভিডিও রেকর্ড দেখে দেখে বলছেন।’ প্রত্যেকের বিস্তারিত খোজ খবর রাখতেন । আমাকে বলেছিলেন, ‘ভাইয়া, তোমার বাড়ীতে যাওয়ার পর আমি তোমার ব্যাপারে চুড়ান্ত সিদ্বান্ত নিয়েছি’। গরিবালয়ে আপনি কি দেখেছিলেন তা আমি আজও বুঝতে পারিনি। নেতৃত্ব বাছাইয়ে আপনি ছিলেন খুবই সতর্ক। বংশ পরিচয় থেকে শুরু করে পারিবারিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, মেধা,সাংগঠনিক দক্ষতা,আনুগত্য- আমল সহ সকল বিষয়ে আপনি লক্ষ্য রাখতেন। সমস্ত সিলেট বিভাগের সকল শাখায় দায়ীত্বশীলদের চেইন তৈরীতে পেরেশান থাকতেন। আমাকে বলেছিলেন, ‘তোমার ধারাবাহিক ১০তম সভাপতি আমি তৈরী দেখতে চাই’। প্রায়ই এ ব্যাপারে খোঁজ নিতেন। কাউকে ভালো করে চিনতে না পারলে বলতেন,‘ আমার কাছে একবার পাঠিয়ে দিও, একটু দেখতে চাই’। কোন কর্মী সমাবেশে গেলে আপনার চোখ নেতা খুঁজে বেড়াত। কাউকে পছন্দ হলে দায়ীত্বশীলকে ঐ ভাইয়ের ব্যাপারে খেয়াল রাখার জন্য বলে আসতেন। কষ্টিপাথর যেমন করে খাটি সোনা নির্ধারন করে ,আপনিও শত শত জনশক্তির মধ্য থেকে নেতৃত্ব বাছাইয়ে ছিলেন এক বিরল প্রতিভা ।শুধু সিলেটে নয় ,ঢাকা মহানগরীতে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা চালু করা ছিল আপনার একান্ত স্বপ্ন। যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই আপনার এ মিশন কার্যকর ছিল।
তাই আজ আপনি না থেকেও হয়ে আছেন অমর-চিরঞ্জীব।
সাহসিকতা-যেন মৃত্যুঞ্জয়ী মহাবীরঃ আপনার সাহসিকতা ছিল সর্বজনবিদিত। জাগতিক কোন প্রকার ভয়ভীতি আপনাকে স্পর্শ করতে পারেনি।“১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫” দীর্ঘ এ ১০বছরের সাহসী সিদ্বান্ত গুলোতে ছিল আপনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব। ময়দানের প্রয়োজনীয়তা অনুভবের সাথে সাথেই নিয়েছেন বলিষ্ট পদক্ষেপ।‘৮৯-তে এরশাদ ভাইকে আহত অবস্থায় ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই থেকে উদ্বারের পর জাসদ ছাত্রলীগের সশস্ত্রবাহিনী আলিয়া মাদ্রাসায় হামলা করেছিল।সন্ত্রাসীদের আগ্নেয়াস্ত্রের আলোর ঝলকানী আর অস্ত্রের ঝনঝন শব্দের মধ্যেও মাত্র কয়েকজন ভাইকে নিয়ে খালি হাতে সেই অন্ধকার রাতে হামলা প্রতিহত করেছিলেন। পুলিশ এসে উল্টো আমাদের ভাইদেরকে ধাওয়া করলে, করেছিলেন প্রতিবাদ।ফলশ্রুতিতে আপনাকে থানা হাজতে একরাত কাটিয়ে কোর্ট থেকে জামিনে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল।সেদিন আপনার আংগুল থেকে ঝরে যাওয়া রক্ত জিন্দাবাজারের রাস্তায় আজও মিশে আছে। ঢাকায় কলাবাগান ছাত্রাবাসে ইফতার মহফিলে ঘাদানীকরা হামলা করেছিল। তৎকালীন কেন্দ্রের সদস্য খায়ের ভাই বলেছেন,“হঠাৎ করে দেখলাম, ছোহেল ভাই দৌড় দিয়ে ওদের সামনে চলে গিয়েছেন। ছোহেল ভাইকে রক্ষা করার জন্য আমরাও বেরিয়ে পড়লে ওরা পলিয়ে যায়।” সেদিনের আপনার অসম সাহসী ভূমিকায়- আলাহর একান্ত মেহেরবানীতে রক্ষা পেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সভাপতি সহ নেতৃবৃন্দ আর কেন্দ্রীয় মেছ-কলাবাগান ছাত্রাবাস। ‘৮৭-র ৭ সেপ্টেম্বর এম.সি.কলেজে আপনার দূর্দান্ত সহসিকতা ইতিহাসের গতিধারা পরিবর্তন করে দিয়েছিল।সেই থেকে সকল ক্যাম্পাস সহ সিলেট মহানগরীতে ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের বলিষ্ট অবস্থানের নব যাত্রা শুরু হয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে আপনি ছিলেন “শাহাদাতের” তীব্র আকাংখী। তাই সকল সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভুল করেননি।আপনার দরাজ কন্ঠের সাড়া জাগানো বক্তব্য শ্রোতাদের উদ্বেলিত করত। জনশক্তি কঠিন সময়ে আলাহব রাস্তায় প্রাণ বিসর্জনের দৃপ্ত শপথ নিত নির্দ্বিধায়। কোর্ট পয়েন্ট, আলিয়া মসজিদের মিম্বর ও মিলনায়তন থেকে আজও মনে হয় সেই বজ্রকন্ঠ ধ্বনিত হচ্ছে।
তত্বাবধান- এক অত্যাধুনিক কারখানাঃ জনশক্তির তত্বাবধানে আপনি ছিলেন অসাধারণ- যেন এক উন্নত ব্যবস্থাপনা -অত্যাধুনিক কারখানা। এ ক্ষেত্রে ছিল আপনার নিরবিচ্ছিন্ন সাধনা। আমার স্ব্যাস্থ্য ভাল ছিল না । সে নিয়ে কত চিন্তা করতেন। খাবার সময় পেটে ভাত তুলে দিতেন যাতে কম না খেয়ে উঠি।এক সাথে খেতে বসলে আমার খাওয়ার শেষ পর্যায়ে আপনার দেওয়া শুরু হত। বাধা দিতে চেষ্টা করলেও চোখ রাঙ্গানো ও মুখের লাল অভিব্যাক্তি দেখে ব্যার্থ হতাম। নিয়মিত খাবার ব্যাপারে কড়া দৃষ্টি রাখতেন। আজ পুরোনো বন্ধুরা চিনতে সময় লাগে।আর আমার চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠে, আপনার বাসার ডাইনিং টেবিলে ভাত খাচ্ছি,পাশের চেয়ারে বসে আপনি প্লেটে ভাত তুলে দিচ্ছেন, খালাম্মা আপনার জন্য যে এক টুকরা মাছ বা গোশত বিশেষভাবে রেখেছিলেন তা আমার প্লেটে দিচ্ছেন আর দরজায় দাঁড়িয়ে খালাম্মা তা দেখছেন,আমি লজ্জা পেয়ে বাধা দেয়ার ব্যার্থ চেষ্টা করছি---এ দৃশ্য একদিনের নয়,অনেক অনেক বারের।দায়িত্বের বুঝা যখন বেড়ে গিয়েছিল,কেন্দ্রে যাওয়ার পর রাতের পর রাত বাসে-লঞ্চে কেটেছে, আর দিনের পর দিন প্রোগ্রাম করতে হয়েছে, তখন বুঝতে পেরেছি আপনি আমার স্বাস্থ্য নিয়ে এত চিন্তা কেন করতেন। আমাকে বলেছিলেন ইংরেজী ভাষা শিখতে হবে। কয়েকবার তাগাদাও দিয়েছেন। বিদেশী মেহমানদের সাথে মতবিনিময় করতে বা আন্তর্জাতিক সেমিনারে গিয়ে তাই আপনাকে মনে পড়েছে বেশী করে।
আপনি ভাবতেন সকলকে নিয়ে।একদিন বলেছিলেন, শাহীন শাহ, আমার জেড আবেদীনের যদি স্বাস্থ্য হয়ে যায় তাহলে কেমন লাগবে? মনে হচ্ছিল যেন লম্বা ফিগারের হালকা ছিপছিপা জয়নাল ভাই আকর্ষনীয় দেহাবয়ব নিয়ে আপনার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছেন। আপনার দূরদৃষ্টি আজও আমাদেরকে বিস্মিত করে। ঢাকার শাহ আলম ভূইয়া ভাই বলছিলেন, ‘৯০ তে এম এ পাশের পর বিদায়ের কথা বলায় ছোহেল ভাই বলেছিলেন ২০০০ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তখন যা ছিল কল্পনার অতীত পরে তা বাস্তব হলো। আমাকে আপনি কয়েকবার একই কথা বলেছিলেন। আমি সিলেট শহরের সভাপতি হওয়ার পর দায়িত্বের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সম্পর্কে ঘন্টার পর ঘন্টা বলেছেন। আপনার বাসার ড্রয়িংরুমে সেই সোফাটি দেখলে মনে হয় যেন সোফায় মুখোমুখী বসে লাল কাভারের ডায়রী থেকে পাতা উল্টাচ্ছেন আর পরম তৃপ্তির সাথে আমাকে খুটিনাটি সাংগঠনিক বিষয়গুলো বলে যাচ্ছেন।নতুন প্রজন্মের আজ এ সুযোগ কোথায়? সেদিন ইসলামী ব্যাংক সিলেট শাখার ম্যানেজারের রুম থেকে বের হয়ে দেখি আপনি হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করছেন।আমাকে দেখেই বললেন“তোমার খূঁেজ পায়রা ৮২তে গিয়েছিলাম। জরুরী কথা আছে। ”আপনাকে সাথে নিয়ে রুমে বসার পর বললেন,“আমি আজ একটি স্বপ্ন দেখেছি।মনে হল তুমি কোন সমস্যায় অছো” হৃদয়ের কতটুকু টান থাকলে তা সম্ভব হতে পারে? কোন ত্রুটি ধরা পড়লে আপনি খুবই সহজভাবে দৃস্টি আকর্ষন করতেন।আজও পায়ের গীরার নিচে কাপড় চলে গেলে আাপনার সেই কন্ঠস্বর বেজে ওঠে,“ভাইয়া ,আমি আর পরলাম না তোমাকে নিয়ে।”একদিন পায়রা ৮৬তে আপনার সেই টেবিলে আমাকে নিয়ে বসে প্রশ্ন করলেন, “তুমি আনুগত্য বলতে কি বুঝ?” পরে বললেন,“শুন,আমার এক নানা মারাগেলে আম্মাকে নিয়ে নানা বাড়ী যাওয়ার জন্য ছুটি দিয়ে সায়েফ ভাই বলেছেন ৪ টার ভিতর চলে আসতে। ট্রেন স্টেশনে নেমে দেখলাম, নানাবাড়ীতে গেলে ফিরতি ট্রেন মিস হবে এবং সময়মত ফেরৎ আসা সম্ভব হবে না । তাই একটু এগিয়ে মনে কষ্ট হলেও আম্মাকে নানাবাড়ীর রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে ট্রেন ধরলাম। আমি আনুগত্য বলতে এটাই বুঝেছি। মনে রেখ ,এই নানা আমাকে খুব আদর করতেন এবং ঐদিন সংগঠনের খুব জরুরী কোন কাজ ছিল না।” আপনার ইন্তেকালের খবর পেয়ে ঢাকা থেকে রাতের ট্রেনেই সিলেট এসে পৌছেছিলাম। কিন্তু বিকালে কেন্দ্রীয় সভাপতির ফোন পেয়ে ঢাকায় ফেরৎ যাওয়ায় আপনার জানাজা-দাফনে শরিক থাকতে পারিনি।মনের মাঝে এ ব্যাথাটুকু নাড়া দিয়ে উঠলে সান্তনা খুজি এটুকুতে যে আপনার শেখানো আনুগত্যের উপর আমল করতে পেরেছিলাম।
আজকের এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ভাই একান্তই আপনার আবিস্কার।এম.সি.কলেজ সভাপতি জহুরুল ভাইয়ের পরীক্ষার সুযোগে জুবায়ের ভাইকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিয়ে বলেছিলেন,“একটু ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে নিয়ে আসি, কাজে লাগবে। ”জলিল ভাই,ফখরুল ভাই, সুলতান ভাই,ঢাকা মহানগরীর রায়হান ভাই আর মাছুম বিলাহ ভাই সহ কতজনের জন্য কত চিন্তা আর সময় দিয়েছেন তার কোন ইয়ত্ত্বা নেই।গড়ে তুলেছিলেন ধারাবাহিক নেতৃত্ব তৈরী করার ক্ষেত্রে এক নতুন ইতিহাস। ভাইজান, ধন্য আপনি আর ধন্য আপনার জীবন।
প্রজ্ঞা- অনন্য, অসাধারণঃ আপনার অসাধারন সাংগঠনিক প্রজ্ঞা আজও আমাদের কাছে বিস্ময়কর মনে হয়।হোন্ডায় করে আাপনাকে নিয়ে চৌহাট্রার দিকে যাওয়ার সময় আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ দেখিয়ে হঠাৎ করে বলে উঠলেন, “আচ্ছা,এই মাঠে যদি ঈদের জামাত হয় আর ফরিদ ভাই ইমামতি করেন তাহলে কেমন হয়?” তারপর থেকে শুরু হয়ে শাহীঈদগাহ ও দরগাহ-র পরে সিলেটের সম্ভবত বৃহত্তম ঈদের জামাত এখানেই হয়ে আসছে। আপনি আজ নেই কিন্তু আপনার দ্বীনি ভাইবোনদের ঈদের এক বাড়তি আনন্দ হচ্ছে আলিয়া মাঠের ঈদের জামাত।
ঈদ উপলক্ষে রাজনৈতিক-সামাজিক নেতৃবৃন্দ এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বাসায় শিবির নেতৃবৃন্দের বহর নিয়ে আপনার ঈদ -অভিযান রাজনৈতিক অংগনে চমক সৃস্টি করেছিল।প্রবীণ রাজনীতিবীদ দেওয়ান ফরিদ গাজী সাহেবের বাসায় যাওয়ার পরে একবার উনি বলে উঠলেন,“আমি জানি তোমরা আসবে।’ জেলা জাসদের সভাপতি সদরউদ্দিন সাহেবের বাসায় গিয়ে যেভাবে আপনি সকলকে নিয়ে জামাতে নামাজ পড়েছিলেন তা এখনও আমাদের চোখে ভেসে উঠে। জাসদ নেতা লোকমান ভাইর বাসায় গিয়ে মনে হত যে উনি আসলেই আপনাকে ¯েœহ করতেন। এধরনের অনেকেই ঈদে অপেক্ষা করতেন।
কারবানীর ঈদে চামড়া তুলে ছাত্রকল্যান তহবিল গঠনের গোড়াপত্তন আপনার হাতেই।এজন্য আপনাকে নিরস কথা কম শুনতে হয়নি। কিন্তু আপনি ছিলেন লক্ষ্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আজ সারা দেশে ছাত্র আন্দোলনের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়ের উৎস।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর থেকে আপনার পেরেশানী আমরা কাছ থেকে দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তপক্ষ না পারলেও প্রথম ব্যাচের ছাত্রদের প্রথম থাকার ব্যাবস্থা করেছিলেন মদিনা মার্কেটের দু‘তলা বাড়িটি ভাড়া নিয়ে। পাশ্ববর্তী এলাকা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ক্যাম্পাস-নিকট বর্তী ৫৫শতকের সেই মূল্যবান প্লটটি ক্রয় করতে আপনার টেনশন বুঝা যায় যখন হোন্ডার পেট্রোল কিনতে গিয়ে বলে উঠেছিলেন,“--ডেসিমেল পেট্রোল দিন।”এ জমিটা নিতে ফরিদ ভাইয়ের বিশেষ ভূমিকার কথাটুকও আমাকে আপনি বলেছেন। আপনি থাকলে হয়তো এ প্রজেক্ট এতদিনে অনেক দুর এগিয়ে যেত।
কোন এক কাজে রেলস্টেশনে গিয়েছেন। তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান বদরউদ্দিন কামরান সাহেব দুই হাতে দুটি ব্যাগ নিয়ে নেমে আসলেন ট্রেন থেকে। হঠাৎ করে দেখি আপনি ব্যাগ দুটি ছো-মেরে নিয়ে এসে গাড়ীতে তুলে দিলেন। অসুস্থ রাজনীতির এ জোয়ারের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্বাবোধের এমন নজির বিরল।এজন্যই হয়তো ১৮ নভেম্বর ১৯৯৫ দিনগত রাতে যেন সিলেট নগরীর সকল রাস্তা ফাজিল চিশ্তমূখী হয়ে পড়েছিল।সারা রাত দিন হাজার হাজার মানুষের আপনার বাসামূখী স্রোত দেখে এলাকাবাসী হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন।আপনার সময়ের রাজপথ কাপানো ছাত্রনেতা সাবেক জাসদ ছাত্রলীগ সভাপতি জাকির আহমদ ভাই নাকি গভীর রাতে আপনার কফিনের পাশে গিয়ে চোখের পানি ফেলেছিলেন।
আপনার চারিত্রিক দৃঢ়তা, আকর্ষনীয় ব্যাক্তিত্ব ও আখেরাতমূখী জীবন আমাদের সার্বক্ষণিক প্রেরণার উৎস হয়ে
আছে। তবে ইউকে প্রবাসী ‘ফাহিমা ভাবী’কে বিয়ে করতে আপনার রাজি হয়ে যাওয়াটা রহস্যময় মনে হয়েছিল। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আপনার স্বভাবজাত দূরদৃষ্টিতে হয়তো কিছু ধরা পড়েছিল বলে কঠিনতম এ সিদ্বান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু আলাহতায়ালার প্রিয় হওয়ায় কোন কালিমা স্পর্শ করার আগেই তিনি আপনাকে উঠিয়ে নিয়েছেন আর আমাদেরকে রেখে আপনাকে ইউকে যেতে হয়নি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, অনন্য কর্ম আর হাতে গড়া অসংখ্য দ্বীনি ভাইয়ের হাত প্রতিনিয়ত আপনার জন্য সদকায়ে জারিয়ার ভান্ডার সমৃদ্ব করছে –ইনশাআল্লাহ। আপনার জন্য প্রকৃতই হিংসা হয়, আমরা দুনিয়া থেকে যাওয়ার আগে কিছুটা হলেও এমন কিছু বন্দোবস্ত কি সম্ভব হবে? আলাহ মালুম।
শেষ বিদায়ঃ ৪ সেপ্টেম্বর, ৯৫-কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েট সদস্য হিসেবে আমি ঢাকায় যাই। রেলস্টেশনে বিদায় দিতে আপনি এসেছিলেন--দ্বীনি ভাইদের হোন্ডার বহর আর গিফ্ট সবই আপনার ইশারায় হয়েছিল। এই ক‘দিনে বার বার টেলিফোন আর চিঠি লিখে উৎসাহ দিয়েছেন-গাইড করেছেন। নভেম্বরের ২য় সপ্তাহে সুনামগঞ্জে কর্মী সম্মেলনে যাওয়া-আসার পথে মাক্রোবাসে আমার পাশে বসে অনেক কথা বলেছিলেন। আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছিলেন- আপনাকে এই প্রথমবারের মত কিছুটা হতাশ মনে হচ্ছিল।পরে ঢাকায় এসেছিলেন, যাওয়ার দিন নীচে এসে দেখি মহসিন ভাই রেডী কিন্তু আপনি উনাকে রেখে আমাকে নিয়ে এসেছিলেন কমলাপুর। ট্রেন ছেড়ে দেয়ার পর জানালায় হাতের উপর মাথা রেখে একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়েছিলেন যতক্ষণ দেখা যায় । আমি কি জানতাম, এটিই আমাদের শেষদেখা - মাত্র৩/৪ দিনের মাথায় চিরদিনের জন্য আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন ?
১৮নভেম্বার পল্টন মসজিদ থেকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে মিছিল শেষ করে মাগরিবের নামাজের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তখনি কেউ এসে জোর গলায় বলছিল ‘‘সিলেটের ছোহেল ভাই মারা গেছেন।’’ আপনি বাদজোহর এম.সি.কলেজে বক্তব্য রেখে মেট্রোপলিটন হাসপাতালে চিকিৎসারত আপনার আম্মার কাছে গিয়ে হার্ট এটাকে আক্রান্ত হয়ে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে চির বিদায় গ্রহন করেন।(ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাইলাইহি রাজিউন)
ভাইজান, মহান মনিবের দরবারে প্রাণভরে এই আকুতি জানাই,তিনি যেন আপনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চতম আসনে আসীন করেন আর আমাদেরকে শেষ বিচারের দিনে একসাথে হাসর নসীব করেন। আমীন।।
লেখকঃ সিরাজুল ইসলাম শাহীন-ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রাক্তণ কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক ও সিলেট মহানগরী জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারী। বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী।


দুনিয়ার জিন্দেগী চুকিয়ে পরকালে প্রস্থানকারী একজন ছোহেল আহমদ চৌধুরীর কথা বলছি। ২৪ কি ২৫ বছর আগে এক সফরকে কেন্দ্র করে আমার এই লেখা। মৌলভীবাজার, বড়লেখা ডিগ্রিকলেজ শাখা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের নবীন বরণ অনুষ্ঠানের প্রধান মেহমান মরহুম ছোহেল আহমদ চৌধুরীকে সিলেট শহরের সুবিদবাজার হতে প্রোগ্রামস্থলে পৌঁছানোর দায়িত্ব থাকায় সফরসঙ্গী হিসেবে আমার সৌভাগ্য ছিল সেদিন। দায়িত্ব আর মর্যাদার নানা বিশেষণে বিশেষিত মরহুম এই নেতার ব্যক্তিগত একটি ছোট থলে হাতে নিতে নানাভাবে কৌশল করেও সফল হতে পারিনি। তিনি সহজ করে বলেছিলেন, "থলেতে কলম,খাতা,ব্রাশ,বই ও গামছা ছাড়া আর কিছুই নেই, আর এগুলো আমার একান্ত ব্যক্তিগত, এটি বহনকরার এখতিয়ার আপনার নেই," তার কথায় আমি থমকে গেলাম। তখন আমার ধারণা ছিল তিনি বড়মাপের নেতা এবং আমার অনেক বড় তাই সহসা হয়তো ব্যাগটি দেবেন, কিন্তু তা হলোনা। আমার চোখে প্রতীয়মান হলো তিনি সহজ-সরল নিরহংকার স্রেফ একজন মুসাফির মাত্র।
যাইহোক সেদিন পাহাড়িকা ট্রেনে করে খুব ভোরে কুলাউড়া পৌছাই। সেখানে সুজানগরের আব্দুস শাকুর,বেলাল আহমেদ, লিয়াকত হাসান ,ফয়েজ আহমদ ভাই সহ অনেকেই অপেক্ষমাণ ছিলেন। সড়কপথে বড়লেখা পৌঁছানোর ফাঁকে সুজানগরের আগর-আতর দেখে খুব খুশি হন। আব্দুস শাকুর ভাই উপহার স্বরুপ এক কৌটা আতর দিলে তিনি তাঁর মায়ের জন্য সামান্য চেয়ে নেন এবং তাথেকে তাঁর নবপরিণীতা স্ত্রীকেও কিছু দেবন বললেন। ততক্ষণে বেশকিছু ভাই আব্দস শাকুর ভাইয়ের বাড়িতে এসেগেলে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি সংক্ষিপ্ত কথা রাখেন। আমার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে বড়লেখা যাবার প্রাক্কালে বলেছিলেন, "আর একবার আসলে তোমার বাড়িতে যাব ইনশাআল্লাহ। " ক্ষণজন্মা এই মহান ব্যক্তির সাথে এটি ছিল আমার শেষ সফর। ১৯৬৪ সনে গোলাপগঞ্জের নিমাদলে জন্মগ্রহণকারী ছোহেল আহমদ চৌধুরী ১৮-ই নভেম্বর ১৯৯৫ সনে অসুস্থ প্রিয় মা জননীকে হাসপাতালে দেখতে গেলে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে সেখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
তাঁর প্রস্থানে খবর ছড়িয়ে পড়ে লোকমুখে পত্র-পত্রিকায়। সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে তাঁর নামাজে জানাজা সম্পন্ন হয়। জানাজার বিশালতা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে। প্রিয় এই নেতার প্রস্থানে মানুষ আবেগাপ্লুত হয়। ছোহেল আহমদ চৌধুরীর মৃত্যু আপনজন হারানোর বেদনাকে ছাড়িয়ে যায়। আল্লাহ তাঁকে পরকালে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে আশীন করুন। মহান আল্লাহর কাছে এই প্রত্যাশা। আমিন।
লেখকঃ সোহাইল আহমদ সোহেল-ফ্রান্স প্রবাসী, সম্পাদকঃ আগর-সাহিত্য পত্রিকা, সাবেক সভাপতিঃ ইসলামী ছাত্রশিবির সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসা।

মরহুম সোহেল আহমদ চৌধুরীর কথা খুব মনে পড়ে।তিনি ঢাকা মহানগরী ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি ছিলেন । অসাধারন সাংগঠনিক যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন তিনি। সহজেই অপরকে আপন করে নিতে পারতেন।
আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একদিন ঢাকায় তার সাথে সাক্ষাত হলো। তিনি বুকে জড়িয়ে নিলেন। মনে হলো বহু পূর্ব থেকেই তিনি যেন আমাকে চিনেন। তার আচরনে মুগ্ধ হলাম। সে দিনটির কথা আজও আমি ভুলতে পারিনা। ছাত্রজীবনের গন্ডি পেরিয়ে তিনি বৃহত্তর অংগনে পদার্পন করেই মূল আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ন দায়িত্বে নিযুক্ত হন।
১৯৯৫ সালের ১৮ নভেম্বর তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।মনে পড়ে আমি সবেমাত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকায় এসেছি। কেন্দ্রীয় বিদেশ বিভাগের দায়িত্ব পালন করছি। ময়মনসিংহ অন্চলের তত্বাবধানের দায়িত্ব আমার উপর। কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে টেনশন চলছে।
পরিস্হিতি মোকাবেলার জন্য সদস্য বৈঠক চলছে। কেন্দ্র থেকে টেলিফোনে জানানো হলো সোহেল আহমদ চৌধুরী এন্তেকাল করেছেন। খবরটা বিশ্বাস করতে পারছিলামনা। প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রনা নিয়ে সদস্যবৈঠকেই আমরা মহান আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ফেলে দোয়া করলাম।
আজ ২৫ বছর পার হলো। প্রতি বছর নভেম্বর মাস যায় আসে।কিন্তু সোহেল ভাই কোনদিন ফিরবেননা। মহান রবের দরবারে দোয়া করি,হে প্রভু! তুমি আমাদের প্রিয় ভাই সোহেল আহমদ চৌধুরীকে জান্নাতের মেহমান বানিয়ে নিও। আমীন।।
লেখকঃ প্রাক্তণ কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও প্রচার বিভাগ সম্পাদকঃ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, আইনজীবিঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

সোহেল আহমদ চৌধুরীঃ একজন নেতা, একটি ইতিহাস - ডাঃ সায়েফ আহমদ

(প্রথম পর্ব )

ভূমিকাঃ

প্রায় ২৭ বছর আগে ১৮ ই নভেম্বর ১৯৯৫ ইংরেজি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে মাবুদের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন । রেখে গেছেন সমৃদ্ধ এক ইতিহাস। তার হাতের তৈরি শত শত কর্মীরা সারা বিশ্বে আজ ছড়িয়ে আছে। তার মৃত্যুর পর তার সাথীরা "অনুভবের অলিন্দ" নামে একখানা স্মারকগ্রন্থ বের করেছিল। ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় তার সাথীদের ও ধীরে ধীরে দুনিয়া থেকে চলে যাবার সময় হয়ে যাচ্ছে। আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মী সোহেল আহমদ চৌধুরী। নামটি উচ্চারণ করলে এখনও আমার শরীরে শিহরণ জাগে। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান দ্বারা তার জীবনকে বিশ্লেষণ করা দুরূহ কাজ । প্রায় আড়াই বছর তিনি আমার সেক্রেটারি ছিলেন। তাকে আমি বড় কাছে থেকে দেখেছি। আমার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস এবং আস্তা আমাকে বিস্মিত করত। কত দিন-রাত কত বছর-মাস মোটরসাইকেলে সিলেটের অলিগলি বাসা বাড়ি আমরা ঘুরেছি সেগুলো এক বিস্মৃত ইতিহাস। জীবনের চড়াই-উতরাইয়ে মাঝে মাঝে সেই দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করে আত্মতৃপ্তি পাই কিন্তু যে স্বপ্নে আমরা একত্রিত হয়েছিলাম সেই স্বপ্ন তো স্বপ্নই থেকে গেল। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে সেই স্বপ্ন একদিন বাস্তবায়িত হবে ইনশাআল্লাহ।

তিনি ছিলেন একাধারে তুখোড় বক্তা, অসম্ভব সাহসী, মানবদরদি, মিতব্যায়ী, পরিবার, সমাজ ও কর্মীদের প্রতি পরম দায়িত্বশীল, মহা পরিকল্পনাবিদ, প্রচন্ড বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন, অত্যন্ত পরিশ্রমী, সদালাপী এক আদর্শ নেতা। আমার এই আলোচনা পর্বে তার জীবন ও কর্ম নিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষনীয় কিছু দিক তুলে ধরতে চাই।

(দ্বিতীয় পর্ব )

তিনি ছিলেন দূরদর্শী ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারীঃ

জ্ঞান বলতে বুঝায় কোনো কিছু সম্পর্কে সম্যক ধারণা করার মতো শক্তি বা বোধশক্তি। প্রজ্ঞা বলতে বুঝায় জ্ঞানকে হৃদয়ঙ্গম করে, নিজের অভিজ্ঞতা দ্বারা এর সুফলকে বাস্তবে প্রয়োগ করার মতো শক্তি। হিকমাহ অর্থাৎ প্রজ্ঞা এসেছে ইহ্‌কাম احكم থেকে, যার অর্থ কথা বা কাজে পরিপূর্ণতা। প্রজ্ঞা হচ্ছে জ্ঞানকে সঠিকভাবে ব্যবহার। আমাদের অনেক জ্ঞান থাকতে পারে, কিন্তু যদি প্রজ্ঞা না থাকে, তাহলে সেই জ্ঞানের সঠিক ব্যবহার হবে না। হিকমাহ হলো—সঠিক কাজটি, সঠিক সময়ে, সঠিক নিয়মে পালন করা।

একারণেই কুরআনে বলা হয়েছে যে, নবী-রাসূলরা শুধু আল্লাহর বাণীই শেখাবেন না, একইসাথে প্রজ্ঞা শেখাবেন, যেন আল্লাহর বাণীকে আমরা ঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারি।

رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ ۚ إِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

হে আমাদের রব, তাদের মধ্যে তাদের থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যে তাদের প্রতি আপনার আয়াত সমূহ তিলাওয়াত করবে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবে আর তাদেরকে পবিত্র করবে। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়”। (আল-বাক্বারাহঃ ১২৯)

ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ ۖ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ

তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান কর হিকমত (প্রজ্ঞা) ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়।” (আন-নাহলঃ ১২৫)

يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَن يَشَاءُ ۚ وَمَن يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا ۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ 

“তিনি যাকে চান, তাকে প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে প্রজ্ঞা দান করা হয়েছে, সে বিরাট কল্যাণ পেয়ে গেছে। আর চিন্তাশীল মানুষরা ছাড়া কেউ শিক্ষা নেবে না।” (আল-বাক্বারাহঃ ২৬৯)

আল্লাহ্‌ তা’আলা যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেন।” (মুসলিমঃ ২২৭৯)

যদি কুর‘আনের আয়াত শুনিয়ে, বিধি বিধান শেখালেই যথেষ্ট হতো, তাহলে প্রজ্ঞা শেখানোর কোনো দরকার ছিল না।

সুতরাং চিন্তাশীল মানুষরা হচ্ছে তারাই, যারা গভীরভাবে চিন্তা করে আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারে। শুধুমাত্র স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়লেই প্রজ্ঞাবান হওয়া যায় না। প্রজ্ঞা অর্জন করার জন্য চেষ্টা, সাধনা, অধ্যবসায়ের প্রয়োজন । প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি আগামী বছর, আগামী দশক কিংবা মৃত্যু পরবর্তী আগামী শতাব্দীতে কি হবে, তার চিত্র স্বীয় মানস-পটে পরিষ্কার আঁকতে পারেন।

সোহেল আহমদ চৌধুরীর প্রজ্ঞাঃ

আশির দশক এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সিলেটের ছাত্র ইসলামী আন্দোলনে প্রজ্ঞা সম্পন্ন নেতৃত্ব তাকে এক উচ্চ মর্যাদায উন্নীত করেছিল। সিলেট সরকারি স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাশ করার পর এমসি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়াশোনা করেন এবং মদনমোহন কলেজ থেকে ডিগ্রী পাস করে। তার বর্ণাঢ্য ছাত্রজীবনে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়নি যার জন্য পরবর্তীতে আক্ষেপ করতে হয়েছে। সিদ্ধান্তে তিনি ছিলেন ধীর-স্থির। তাড়াহুড়া বর্জন করতেন। সিদ্ধান্ত পরবর্তী প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করতেন। সিদ্ধান্তে অটল এবং অনড় থাকতেন। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন আদর্শের মূর্ত প্রতীক। তিনি অনেক দূরের বিষয় কল্পনা করতেন, নেতৃত্ব সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী, কাকে কোথায় দায়িত্ব দিলে পরিকল্পিত কাজ হবে, তা তিনি খুব ভালভাবে উপলব্ধি করতেন। প্রতিটি বিষয় পরামর্শ করতেন। অকপটে নিজের মতামত ব্যক্ত করতেন। নিজের মত ছাপিয়ে দিতেন না। যুক্তির সাথে কথা বলতেন। অন্যের যুক্তি শুনতেন। সিদ্ধান্ত নিতে কখনোই একগুঁয়েমি করতেন না।

(চলবে)

📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘📚📖📘

আমার প্রিয় বাংলা বই হোয়াইটসআপ গ্রুপে যুক্ত হতে এখানেক্লিক করুন, টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং ফেইসবুক গ্রুপে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন। 



No comments:

Post a Comment

আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।