পাশ্চাত্য
সভ্যতার মৌলিক চিন্তাধারার সাথে পরিচয় ঘটার পর তিনটি বিষয়ে আমি ব্যাপক অধ্যয়নের
প্রচেষ্টা চালাই। সেই তিনটি বিষয় হচ্ছেঃ ডারউইনের বিবর্তনবাদ, কার্ল মার্ক্সের কমিউনিজম বা সাম্যবাদ এবং ফ্রয়েডের
মনস্তত্ত্ব। আমার বিবেচনায় পাশ্চাত্য থেকে আসা এই তিনটি বিষয়ই হচ্ছে ইসলামের
সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সাংঘর্ষিক মতবাদ। এই তিনটিকে যদি যথার্থ বলে মেনে নেয়া হয়, তাহলে ইসলামকে সত্য মানার উপায় থাকে না। আর ইসলাম যদি সত্য
মানা হয়, তাহলে এই তিনটি মতবাদ নিশ্চিত রূপেই ভ্রান্ত ও
অসত্য বলতে হয়। অথচ আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের দেশে এই তিনটি মতবাদের ব্যাপক
প্রচার চলছে এবং এর শিক্ষাদান করা হচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর এই শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের
দেশের শিক্ষিত লোকদের মন-মগজে এই তিনটি মতবাদ গভীরভাবে বদ্ধমূল হয়ে আছে এবং
সাধারণ কথা-বার্তা ও আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে এরই প্রতি তাদের গভীর প্রত্যয় ব্যক্ত
হচ্ছে। কিন্তু আমার কথা হল, এই তিনটি মতবাদের প্রতি বিশ্বাস থাকার অর্থই
হচ্ছে ইসলামের প্রতি চরম অবিশ্বাস – মুখে যতই বিশ্বাসের ভান করা হোক না কেন।
কেননা, ডারউইনীয় মতবাদ আল্লাহ্র অস্তিত্বের প্রতি প্রচণ্ড অস্বীকৃতি (Negation), কার্ল মাক্স-এর মতবাদ ‘রিসালাতে'র প্রতি অস্বীকৃতি এবং ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্ব ইসলামী নৈতিক চরিত্রের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
অথচ আমার সারাজীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও সাধনা দ্বীন-ইসলামের অকাট্য সততা আদর্শগত ও বাস্তবভাবে প্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু বাস্তবভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে আদর্শগত ও নীতিগতভাবে ইসলামের সত্যতা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হওয়া একান্তই আবশ্যক। কারও মন-মগজে যদি ঐকান্তিক ও সুদৃঢ় প্রত্যয় থাকে ডারউইনীয় বিবর্তনবাদ, মার্কসীয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ও ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্বের প্রতি, তাহলে সেখানে ইসলামের প্রতি ঈমান প্রবেশাধিকার পেতে পারে না; শুধু তাই নয়, তা নিতান্তই হাস্যকর বিবেচিত হবে। 'হ্যাঁ' ও 'না' ন্যায় ও অন্যায়, পাপ ও পুণ্য, রাত ও দিন এবং সত্য ও মিথ্যা যেমন কোনক্রমেই অভিন্ন নয়, ঠিক তেমনি ইসলাম কখনই এই তিনটি মতবাদের সঙ্গে কোন দিক দিয়েই একবিন্দু সাযুজ্যপূর্ণ হতে পারে না। একটির প্রতি বিশ্বাস রেখে অন্যটির জন্য কাজ
করা যেমন সম্ভব নয়, ডারউইনবাদ, মার্কসবাদ ও ফ্রয়েডবাদে বিশ্বাস রেখে ইসলাম বিশ্বাস করা ও পালন করাও তেমনি অসম্ভব। তাই ইসলামী জীবন-বিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সূচনাতেই নীতিগত ও আদর্শগতভাবে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এই মতবাদ তিনটির ভিত্তিহীনতা অকাট্য যুক্তির ভিত্তিতে প্রমাণ করার জন্য আমাকে লেখনী চালনা করতে হয়েছে। তবে শুরুতেই আমি মার্কসীয় দর্শন তথা কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্রের অযৌক্তিকতা ও অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণের উদ্দেশ্যে ১৯৫৫ সনে 'কমিউনিজম ও ইসলাম ও ১৯৬৩ সনে 'সমাজতন্ত্র ও ইসলাম' নামে ভিন্ন ভিন্ন দুটি বই প্রকাশ করি। ১৯৬২ সনে ঢাকায় অনুষ্ঠিত
ইসলামী সেমিনারে 'মার্কসীয় দর্শন' পর্যায়ের এক ভাষণে আমি এ মতবাদটির ভুল-ভ্রান্তি ও
অবৈজ্ঞানিকতা প্রমাণ করি, যা সেই বছরেই ইসলামী সেমিনার সংকলন “চিন্তাধারা'য় প্রকাশিত হয়। অতঃপর ১৯৭৭ সনে আমার লিখিত ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্ব' শীর্ষক একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা'য় প্রকাশিত হয় ।
স্বতন্ত্র একটি প্রবন্ধে ডারউইনের ক্রমবিকাশবাদ সম্পর্কেও আমি বিস্তৃত আলোচনা করি
যা কোনভাবে এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি।
আমার দৃষ্টিতে উক্ত তিনটি মতবাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ডারউইনের বিবর্তনবাদ। মার্কস ও ফ্রয়েড উভয়ই নিজ নিজ মতবাদের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন বিবর্তনবাদকে। বিবর্তনবাদ সত্য হলে এ দুটিও সত্য। আর বিবর্তনবাদ 'নিছক প্রতারণা' ও 'সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক' প্রমাণিত হলে ও দুটি মতবাদ সম্পূর্ণ মিথ্যা হয়ে যায়। এই কারণে ডারউইনের বিবর্তনবাদ সম্পর্কে আমাকে আরও গভীর, সূক্ষ্ম ও ব্যাপক অধ্যয়ন চালাতে হয়েছে। সেই অধ্যয়নেরই ফল বর্তমান গ্রন্থ 'বিবর্তনবাদ ও সৃষ্টিতত্ত্ব'।
আমার এসব আলোচনা পর্যায়ে আমি বিজ্ঞান আলোচনার ‘আরোহ’ ও ‘অবরোহ’ এই উভয় পদ্ধতিকেই অনুসরণ করতে চেষ্টা করেছি। তবে ইসলাম বিরোধী মতবাদসমূহের সমালোচনায় আমি
সাধারণভাবে 'অবরোহ'—অর্থাৎ নিতান্তই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে ব্যবহার করেছি আর ইসলামী জীবনবিধানের ইতিবাচক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে আমাকে স্বাভাবিকভাবেই আরোহী পদ্ধতিকে অনুসরণ করতে হয়েছে ।
বিবর্তনবাদ পর্যায়ে এই গ্রন্থের সমস্ত আলোচনা-ই বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক তত্ত্ব ও তথ্যসম্বলিত। অবশ্য শেষের দিকে আমি কুরআনের সৃষ্টিতত্ত্ব উপস্থাপন করেছি আধুনিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের আলোকে। আমার কথাঃ ডারউইনের বিবর্তনবাদ বা Theory of evolution সম্পূর্ণ মিথ্যা, অবৈজ্ঞানিক ও প্রতারণাপূর্ণ এবং কুরআন উপস্থাপিত সৃষ্টতত্ত্বই একমাত্র বিজ্ঞানসম্মত ।
আমার সমগ্র আলোচনায় অন্ধবিশ্বাসকে একবিন্দু প্রশয় না দিয়েই চেষ্টা করেছি, যেন প্রতিটি বিষয়-ই সাধারণ বৈজ্ঞানিক সত্যরূপে প্রতিভাত হতে পারে এবং তা সুধীসমাজে ঠিক এই দৃষ্টিকোণেই গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতে পারে ।
এই গ্রন্থের বক্তব্য বিষয় কারুর কিছু বক্তব্য থাকলে সরাসরি আমাকেই বলা যাবে। এই বই পাঠের পর সারা জাহানের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর প্রতি কারুর মনে ঈমান সৃষ্টি হলে আমার এ শ্রম সার্থক হবে। কেননা শুধু এই উদ্দেশ্যেই আমি এই গ্রন্থ রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলাম। আল্লাহ্ আমার এই ঐকান্তিক চেষ্টা ও শ্রম কবুল করবেন, মহান আল্লাহর নিকট এটাই আমার প্ৰাৰ্থনা ।
মুহাম্মদ
আব্দুর রহীম
মুস্তাফা
মনযিল, ঢাকা
জানুয়ারী ২৮, ১৯৮২
No comments:
Post a Comment
আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।