আল্লাহর পথে অর্থব্যয়-মুহতারামা ফাজিলা তাহের রচিত বইটি বাজারে নাই। আজ থেকে প্রায় ৩৪ বছর আগে বইটি বাজারে আসে। তারপর আর প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু পাঠকদের অন্তরে সেই বইটি নাম ভাস্মর রয়েছে। পাঠকদের চাহিদা বিবেচনায় আমরা বইটির পিডিএফ সংযোজন করলাম।
আল্লাহর পথে অর্থব্যয় পিডিএফ এখানে।
আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়
ফজিলা তাহের
প্রফেসর'স বুক কর্ণার
১৯১, ওয়ারলেস রেলগেট, বড় মগবাজার, ঢাকা-১২১৭
ফোনঃ ৯৩৪১৯১৫, মোবাইলঃ ০১৭১৬৬৭৭৭৫৪
প্রকাশকঃ
এ এম. সফিকুল ইসলাম
প্রফেস'র বুক কর্ণার
১৯১, ওয়ারলেস রেল গেইট
বড় মগবাজার, ঢাকা-১২১৭
ফোনঃ ৯৩৪১৯১৫
মোবাঃ ০১৭১৬-৬৭৭৭৫৪
প্রকাশকালঃ
দ্বিতীয় প্রকাশ
মে ২০০৬ ইং
বর্ণবিন্যাসঃ
জবা কম্পিউটার
বুক্স এণ্ড কম্পিউটার কম্পপ্লেক্স
৪৫, বাজারবাজার, ঢাকা-১১০০
মূল্যঃ ৩০.০০ টাকা মত্র
ISBN : 984-8284-22-2
দুটি কথা
মহান আল্লাহ্ তা'য়ালা মানুষকে যত নিয়ামত দান করেছেন এর মধ্যে ধন-সম্পদ অন্যতম
। মহান রাব্বুল আলামীন এ নিয়ামত শুধু দানই করেননি এর আয়-উপার্জন, ব্যয় ব্যবহারের পদ্ধতিও কুরআনে করীম এবং প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ
মোস্তফা (সাঃ)-এর হাদীসের মাধ্যমে তা বলে দিয়েছেন। কেবলমাত্র আল্লাহ্ তা'য়ালার দেয়া পদ্ধতি অনুসরণ করলেই ধন-সম্পদ ইত্কালীন কল্যাণ ও পরকালীন
মুক্তির উপায় হতে পারে। অন্যথায় এ বিরাট নিয়ামতই হয়ে দাঁড়ায় অশান্তি,
বিপর্যয় ও আযাবের কারণ। আমরা মুসলমানগণ জীবনের অন্যান্য বিষয়ের মত
এক্ষেত্রেও ক্ষণস্থায়ী এ জীবনে ধন-সম্পদের আধিক্য ও প্রাচুর্যের স্রোতে সমাজের
অধিকাংশ মানুষই নিজেকে এমনভাবে গা-ভাসিয়ে দেয় পরকালে আল্লাহ্ তা'য়ালার দরবারে এর জন্যে জবাবদিহির কোন অনুভূতিই আছে বলে মনে হয় না।
অনেকেই আবার সওয়াবের আশায় দান-খয়রাত করে থাকেন কিন্তু কুরআন ও হাদীসের আলোকে
আল্লাহ্ তা'য়ালার পথে অর্থ-ব্যয়ের গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিগুলো
সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করেন না। বৰ্তমান গ্রন্থে অর্থ-সম্পদের আয়
উপার্জন ও ব্যয়-ব্যবহার সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে। আলোচনার
মূল উৎস হিসেবে প্রধানত কুরআনে করীম এবং পবিত্র হাদীসের সাহায্য নেয়া হয়েছে ।
কলেবর বৃদ্ধির ত আশংকায় মূল আয়াত এবং হাদীসের আরবী ভাষা উল্লেখ করা হয়নি।
যতটুকু সম্ভব আয়াত ও হাদীসের সহীহ তরজমা পেশ করা হয়েছে। সূরাসহ আয়াত নম্বর এবং
হাদীসের রেওয়ায়েতকারীসহ উৎসও উল্লেখ করা হয়েছে। ছোট আকারে হলেও বিভিন্ন
অসুবিধার মধ্যে দয়াময় আল্লাহ্ তা'য়ালা প্রথম পুস্তিকা প্রকাশের
সুযোগ দেয়ায় তাঁরই শুকরিয়া আদায় করছি। পাঠক সমাজের পক্ষ থেকে যে কোন মূল্যবান
পরামর্শ ও আলোচনা সাদরে গৃহীত হবে ।
ফজিলা তাহের
৪ রমজান
১৪১১ হিজরী
সূচীপত্র
বিষয়
(১) আল্লাহ্ তা'য়ালাই
ধন-সম্পদের প্রকৃত মালিক
(২) রিযিকের মালিক আল্লাহ্ তা'য়ালা
(৩) রিযিক কম-বেশী হওয়ার তাৎপর্য
(৪) ধন-সম্পদ একটি বড় পরীক্ষার বিষয়
(৫) ধন-সম্পদ দ্বারা আল্লাহ্ তা'য়ালার প্রিয় হওয়ার মাপকাঠি নয়
(৬) আল্লাহ্র পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয়ের প্রকৃত
তাৎপর্য
(৭) আল্লাহ্র পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয়ের
গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি
(৮) আল্লাহ্র পথে অর্থ ব্যয়ের পুরস্কার
(৯) ধন-সম্পদ জমা করে রাখার পরিণাম
(১০) আল্লাহ্র পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয়ে
সাহাবায়ে কিরামদের ভূমিকা
(১১) আনসারদের আত্মত্যাগের কিছু প্রশংসনীয়
দৃষ্টান্ত
(১২) হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)
আল্লাহ্ তা'য়ালাই ধন-সম্পদের প্রকৃত মালিক
পবিত্র কুরআনে করীমে ইরশাদ হচ্ছে “ওয়া-লিল্লাহি মা ফিস্সামাওয়াতি ওয়া মা ফিল আরদ” অর্থাৎ আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ্।” (আলে-ইমরানঃ
১২৯, বাকারাঃ ২৮৪)
“লা-হু মুকুস্ সামাওয়াতি ওয়াল আরদ”
অর্থাৎ আসমান সমূহ ও যমীনের সার্বভৌমত্বের
নিরংকুশ মালিক একমাত্র তিনিই (আল্লাহ) । (সূরা হাদীদঃ ২)
মানুষ যে কোন কিছুরই আসল মালিক নয়, এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে সে কোন কিছুই সৃষ্টি করতে পারে
না। শুধুমাত্র তার চেষ্টা ও শ্রমকে কাজে লাগাতে পারে । যেমন, মানুষ শুধু বীজ বুনে দিতে পারে, কিন্তু বীজকে
অঙ্কুরিত করা এবং কুঁড়িকে বৃক্ষে ও ফুল ফলে রূপ দেয়া সুশোভিত করা সম্পূর্ণ অন্য
একজন মহান সত্তার কাজ । তাই আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেছেনঃ
“যা কিছু তোমরা বপন কর, সে সম্পর্কে ভেবে
দেখেছ কি? সে বীজ তোমরা উদগত কর, না
আমি তার উদগমনকারী।” (সূরা ওয়াকিয়াঃ ৬৩-৬৪)
প্রকৃত অর্থে অর্থ-সম্পদ, ধন-দৌলত মহান আল্লাহ্ প্রদত্ত একটি বিশেষ নিয়ামত । তিনি
দুনিয়ার সমস্ত নিয়ামত মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছেন । মানুষ আল্লাহ্ তা'য়ালার দেয়া এ সব নিয়ামতের আমানতদার মাত্র। সুতরাং সত্যিকার বুদ্ধিমান
ব্যক্তি সে, যে এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে ধন-সম্পদের আমানতদার
থাকা অবস্থায় মহান আল্লাহ্র পথে একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে উদার
হাতে ব্যয় করে। আর চরম নির্বোধ সে ব্যক্তি যে তা নিজের কাছে সঞ্চয় করে রাখার
ব্যর্থ চেষ্টা করে। তাই আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেছেনঃ “হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যা কিছু ধন-সম্পদ দিয়েছি তা থেকে ব্যয় কর,
সে দিনটি আসার আগে যেদিন কোন বেচাকেনা চলবে না, বন্ধুত্ব কোন কাজে আসবে না এবং কারো সুপারিশ ও কোন উপকারে আসবে না।”
(সূরা আল-বাকারাঃ ২৫৪)
রিযিকের মালিক আল্লাহ্ তা'য়ালা
মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মানুষের
সৃজনকারক, লালন-পালনকারী এবং রিযকদাতা । রিযক হচ্ছে
জীবন ধারনের উপায় । কোন প্রাণীই রিযক ব্যতীত বাঁচতে পারে না । বেঁচে থাকার
তাকিদেই রিযকের প্রয়োজন। তবে রিযকের মূল উৎস হচ্ছেন আল্লাহ্ । কুরআনে করীমের অনেক
আয়াতে আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেছেনঃ “আল্লাহ্ইতো
তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, এরপর তোমাদেরকে রিযক দান করেছেন।”
(সূরা হুদঃ ৬)
“কত জীব-জন্ত এমন রয়েছে, যারা নিজেদের রিযক বহন করে চলে না। আল্লাহ্ই তাদের রিযক দান করেন আর
তোমাদের রিযক দাতাও তিনিই ।” (সূরা আনকাবূতঃ ৬০)
“যে লোক আল্লাহকে ভয় করে কাজ করবে, আল্লাহ্ তার জন্যে অসুবিধাজনক অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাবার কোন না কোন পথ
করে দেবেন এবং তাকে এমন উপায়ে রিযক দান করবেন যে সম্পর্কে তার কোন ধারণাও হবে না।”
(সূরা আত্-তালাকঃ ২-৩)
এ আয়াতগুলো থেকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে জানা
যায় যে, পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীরই রিযকের দায়িত্ব
আল্লাহ্ তা'য়ালার উপর এবং তিনিই তাদের রিযক দান করেন । তবে
রিযক দানের বিষয়টি যত সহজ মনে হয়, আসলে তত সহজ নয় । এ
যমীনের বুকে বিভিন্ন প্রকার প্রাণী, জীবজন্তু ও উদ্ভিদের
লক্ষ লক্ষ প্রজাতির খাদ্য সামগ্রী এত পর্যাপ্ত পরিমাণ এবং এত-বেশী সহজলভ্য ও
আয়ত্বাধীন করে দিয়েছেন যে, কোন একটি প্রাণীই তার
প্রয়োজনীয় রিযক থেকে বঞ্চিত হয় না। এরূপ বিজ্ঞানসম্মত; সুক্ষ্ম
ও নির্ভূল ব্যবস্থাপনা একজন সর্বজ্ঞানীর সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও ইচ্ছা ব্যতীত
কিছুতেই সম্ভব নয়। আর তা একমাত্র আসমান ও যমীনের সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্
তা'য়ালার পক্ষেই সম্ভব। সুতরাং রিযক প্রদানের নিগূঢ় রহস্য
সম্পর্কে বিশ্বাসী হৃদয়-মন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে যে কোন মানুষের ঈমানের মজবুতী
শতগুন বেড়ে যায় এতে কোন সন্দেহ নেই । নবী করীম (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা যদি আল্লাহ্ তা'য়ালার উপর যথার্থ তাওয়াক্কুল
কর, নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের রিযক প্রদান করবেন, যেমন তিনি পাখীকুলকে রিযক প্রদান করে থাকেন। পাখী সকাল বেলায় ক্ষুধার্ত
অবস্থায় (রিযকের সন্ধানে) বের হয়ে পড়ে, কিন্তু সন্ধ্যায়
পেট ভরে বাসায় ফিরে আসে।” এখানে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একথাই
বলতে চেয়েছেন যে, পাখী যদি বাসায় বসে থাকত তাহলে রিযক আপনা
আপনি তার কাছে আসত না। ঠিক তেমনিভাবে কর্মবিমুখ মানুষ অলসতা করে ঘরে বসে থাকলে
রিযক তার কাছে এমনিতেই আসবে না। এটা আল্লাহ্ তা'য়ালার
সাধারণ প্রাকৃতিক বিধান নয় । সে জন্যেই আল্লাহ্ পাকের নির্দেশঃ “সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা যমীনে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহ্র অনুগ্রহ সন্ধান
করবে আর আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করবে যেন তোমরা সফলকাম হও।” (সূরা আল জুমুআঃ ১০)
রিযক কম-বেশি হবার তাৎপর্য
একটি বিষয় ভেবে দেখার মত যে, মহান আল্লাহ্ পৃথিবীর সব মানুষকে সমান রিযক দান করেন না। এমন
কোন মানব সমাজ দুনিয়ার কোথাও নেই যেখানে প্রতিটি মানুষই সমান সম্পদের অধিকারী।
আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ (হে নবী) লোকদের বলুনঃ আমার রব তাঁর
বান্দাদের মধ্যে যাকে চান প্রচুর রিযক দান করেন, আর যাকে চান
পরিমিত পরিমাণ দেন।” (সূরা সাবাঃ ৩৬/৩৯)
সর্বজ্ঞানী আল্লাহ্ পাকের রিযক দানের এরূপ
ইচ্ছার কথা কুরআনে করীমের আরও অনেক আয়াতে ব্যক্ত হয়েছে। যেমন, সূরা আন-কাবূতঃ ৬২, সূরা রা'আদঃ ২৬ রূমঃ ৩৭, আজ জুমারঃ ৫২, আশ-শুরাঃ ১২, বনী ইসরাঈলঃ ৩০, আন
নূরঃ ৩৮, আল কাসাসঃ ৮২, আলে ইমরানঃ ৩৭,
আল বাকারাঃ ২১২ দ্রষ্টব্য ।
তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, রিযকদানের ক্ষেত্রে এরূপ কম-বেশী করার কারণ কি? নিশ্চয়ই এর মধ্যে মহাজ্ঞানী আল্লাহ্ তা'য়ালার অতি
বড় সুক্ষ্ম হিকমত লুকিয়ে রয়েছে। তাই কুরআন ও হাদীসের আলোকে রিযক কমবেশী দেয়ার
অন্যতম তিনটি মূলনীতি এখানে বর্ণিত হল
প্রথমতঃ এ নম্ভর পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করার
মূল উদ্দেশ্য বুঝতে পারলে মহান আল্লাহ্ পাকের রিযক দানের উপরোক্ত নীতির যথার্থতা
অনুধাবন করা কিছুটা সহজ হবে। পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে মূলতঃ পরীক্ষা করার
উদ্দেশ্যে। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মানুষকে জীবন দান করেছেন সে সাথে দিয়েছেন
সর্বোত্তম আকার-আকৃতি ও দৈহিক অবয়ব। তিনি উচ্চমানের বিবেক- বুদ্ধি, জ্ঞান-মেধা এবং প্রয়োজনীয় মানবিক গুণাবলী দিয়ে মানুষকে
ভাল-মন্দ বুঝার তৌফিকও দান করেছেন। শুধু তাই নয়, আসমান ও
যমীন থেকে বেশুমার রিযক ও নিয়ামত দিয়ে জীবন ধারণের সমস্ত উপায় উপাদানও দান
করেছেন । সে সাথে সমস্ত নিয়ামতের ভাগ ব্যবহার করার ক্ষমতাও দান করেছেন ।
এরপর আল্লাহ্ তা'য়ালা নবী রাসূলগণের মাধ্যমে কিতাবের সাহায্যে জানিয়ে
দিয়েছেন যে, আসলে পরীক্ষাই হল মানুষ পয়দা করার মুল
উদ্দেশ্য । তিনি আরো বলে দিয়েছেন যে, এ পৃথিবীতে মানুষ কোন
দায়িত্বহীন জীব নয়। তাকে খিলাফতের উচ্চতম দায়িত্ব ও মর্যাদা দিয়ে পাঠানো
হয়েছ। আর সে জন্যেই মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে সাজানো এ
পৃথিবীও চিরন্তন নয় । একদিন সমস্ত কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। সৃষ্টি হবে নতুন করে
জীবন ও জগত । সেদিন প্রত্যেকটি মানুষকেই মহান আল্লাহ্ পাকের সামনে হাযির হতে হবে
এবং জবাবদিহি করতে হবে দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি কৃতকর্মের। তাই আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “যিনি তোমাদেরকে যমীনে খলীফা বানিয়েছেন
এবং তোমাদের পরস্পরকে, পরস্পরের তুলনায় অধিক মর্যাদা দান
করেছেন, যেন তিনি তোমাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন তাতে তিনি
পরীক্ষা করতে পারেন । ” সূরা (সূরা আনআমঃ ১৬৫)
তিনি আরো বলেনঃ “আর চোখ তোলে ও দেখ না দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্যস্বরূপ
ভোগবিলাসের যে উপকরণ আমরা এদের মধ্যে বিভিন্ন লোকদের দিয়েছি । এতো আমরা দিয়েছি
তাদেরকে পরীক্ষার সম্মুখীন করার জন্য । (সূরা ত্বাহাঃ ১৩১)
এরপর রিযক কম-বেশী দেয়ার দ্বিতীয় যে
মূলনীতি তা আল্লাহ্ তা'য়ালা ব্যক্ত
করেছেন এভাবে “দুনিয়ার জীবনে তাদের মধ্যে জীবিকার
উপায়-উপকরণ তো আমরাই বন্টন করে দিয়েছি। তাদের মধ্যে কিছু লোককে অপর কিছু লোকের
উপর আমরা প্রাধান্য দিয়েছি, এজন্যে যেন এরা পরস্পর হতে কাজ
নিতে পারে।” (সূরা যুখরূফঃ ৩২)
আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে যে, “কিছু লোককে অপর কিছু লোকের উপর প্রাধান্য দিয়েছি এজন্যে যেন
এরা পরস্পর হতে কাজ নিতে পারে।' অর্থাৎ সামাজিক জীবনে মানুষ
হবে একে অপরের প্রতি মুখাপেক্ষী, পরস্পর নির্ভরশীল এর ফলেই
পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবে মানব সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি । একে
অপরের সাথে মিলেমিশে মানবিক গুণাবলীর বিকাশের মাধ্যমে জীবনকে সুখ ও স্বাচ্ছন্দে
ভরে তুলবে এবং মানুষ হবে মানুষের সত্যিকার অর্থেই সহযোগী ও শুভাকাঙ্খী। গরীব যেমন
ধনীর ধনের মুখাপেক্ষী হয়, ধনীও তেমনি গরীবের শ্রমের
মুখাপেক্ষী। এভাবে দেখা যায় যে, প্রত্যেকেই নিজের
প্রয়োজনেই একে অন্যের উপর নির্ভরশীল । একথা অত্যন্ত সত্য যে, মানুষ একে অপরের মুখাপেক্ষী ও সহযোগী না হলে মানব সভ্যতা একদিনেই অচল হয়ে
যেতে বাধ্য হবে। আর সেজন্যেই ধন-সম্পদের সম বন্টন নয় বরং ইনসাফপূর্ণ বন্টন মহান
আল্লাহ্ প্রদত্ত অর্থ ব্যবস্থার একটি অন্যতম মূলনীতি। কেননা, এ বিশ্ব জাহানে কোথাও সমবন্টন নীতি কার্যকর নেই এবং তা বাস্তবও নয়। মূলতঃ
এটা অপ্রাকৃতিক ও অস্বাভাবিক । পৃথিবীতে এমন কোন মানব সমাজ কোথাও নেই যেখানে
প্রতিটি মানুষই সমান সম্পদের অধিকারী। মানব রচিত মতবাদ মন ভুলানো যত সুন্দর সুন্দর
কথাই বলুক না কেন সর্বজ্ঞানী আল্লাহ্ তা'য়ালার এ বিধানকে
বদলাতে পারে এমন ইখতিয়ার কারো নেই। সকল মানুষের স্মৃতিশক্তি, সৌন্দর্য, মেধা-মনন ও চিন্তাশক্তিও সমান নয়। তবে
হ্যাঁ বর্তমান তথাকথিত আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় এবং সমগ্র বিশ্ব জোড়ে মানব সমাজে
ধনী গরীবের যে, আকাশ পাতাল বৈষম্য তা সম্পূর্ণ মানুষেরই
সৃষ্টি। মূলতঃ প্রতিটি মানুষই আল্লাহ্ তা'য়ালার অত্যন্ত
মুহাব্বাতের সৃষ্টি। তিনি কখনোই এটা চান না যে তাঁর কোন বান্দাহ না খেয়ে ধুঁকে
ধুঁকে মারা যাক । অসহায় মযলুম ও বঞ্চিতদের প্রতি দয়াময় আল্লাহ্ বিশেষ ভাবেই
সহানুভূতিশীল। পৃথিবী ভরা অফুরান্ত সম্পদ ও নিয়ামত দান করে তিনি মানুষের জন্যে যে
জীবন বিধান ‘আল কুরআন' দিয়েছেন তাতে
সে চিরকল্যাণকর আদেশ ও বিধি নিষেধ বলে দিয়েছেন যা সঠিকভাবে কার্যকর করতে পারলে
সমাজের শাসক-শোষক, গরীব-ধনী ও বঞ্চিতদের মধ্যে এতবেশী ফারাক
কিছুতেই সৃষ্টি হতে পারে না ।
রিযক কমবেশী দেয়ার তৃতীয় যে মূলনীতি সে
সম্পর্কে আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ
আল্লাহ্ যদি তাঁর সকল বান্দাকে উন্মুক্ত প্রচুর রিযক দান করতেন তাহলে তারা যমীনের
বুকে আল্লাহ্দ্রোহীতার তুফান সৃষ্টি করে দিত। কিন্তু তিনি একটা পরিমাণ অনুযায়ী
যতটা ইচ্ছা তা নাযিল করেন। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ও
দৃষ্টিবান।” সূরা (আশ-শুরাঃ ২৭)
অর্থাৎ সম্পূর্ণ নির্ভুল ও প্রত্যক্ষ জ্ঞানের
ভিত্তিতেই আল্লাহ্ তা'য়ালা তাঁর
বান্দাদের মধ্যে রিযক বন্টন করে থাকেন । তিনিই সৃষ্টিকর্তা। সৃষ্টিলোক সম্পর্কে
সার্বিক জ্ঞান আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো থাকতে পারে না। আয়াতের শেষাংশে বলা
হয়েছে-“নিশ্চয়ই তিনি তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ও
দৃষ্টিবান । অর্থাৎ আল্লাহ্ই ভাল জানেন তাঁর বান্দাদের মধ্যে কার জন্যে রিযক
প্রশস্ত হওয়া দরকার এবং কার জন্যে অভাব অনটন ও পরিমিত পরিমাণ রিযকই অধিক কল্যাণকর
। যে লোক আল্লাহ্ পাকের রিযক দানের এ নীতির উপর পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাসী হতে পারে,
সে যতই গরীব হোক না কেন, সর্বাবস্থায় আল্লাহ্
তা'য়ালার উপর সন্তুষ্ট থাকেন ।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস্ (রাঃ) থেকে
বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “সে ব্যক্তি সফলকাম হয়েছে, যে ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং
তার কাছে প্রয়োজন মাফিক রিযক আছে, আর আল্লাহ্ তাকে যা
দিয়েছেন, তার উপরই তাকে তুষ্ট রেখেছেন।” -(মুসলিম) হযরত আলী (রাঃ)-এর রিওয়ায়েতে নবী করীম (সাঃ) বলেনঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা'য়ালার কাছ থেকে অল্প রিযক
নিতে সম্মত হয়ে যায়, আল্লাহ্ও তার অল্প আমলে সন্তুষ্ট হয়ে
যান।-(মযহারী)
তবে একথাও সত্য যে, আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ইচ্ছা করলে পৃথিবীর সকল মানুষকেই
প্রত্যক্ষ ভাবে সমান রিযক দিতে পারতেন। যেমন, জীব, জন্তু, কীট-পতঙ্গ ও পশুপাখীকে দিয়ে থাকেন। এদের
মধ্যে কেউ ধনী কেউ গরীব হয়
না এবং কেউ কাউকে কিছু দেয়ও না। সবাই
প্রকৃতির দস্তরখানা থেকে আহার গ্রহণ করে থাকে । কিন্তু মানুষের মধ্যে তিনি একজনকে
দিয়ে অন্যজনকে দেয়ার মাধ্যম করেন। যাতে দাতা নেকী অর্জন করে এবং গ্রহীতা তার
অনুগ্রহ স্বীকার করে।
এক্ষেত্রে আরও একটি সত্য এটাই যে, পৃথিবীতে অধিক ধন সম্পদ ও ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য বিপর্যয়ের
কারণও। সকল মানুষকেই সব ধরনের রিযক ও নিয়ামত প্রচুর পরিমাণে দেয়া হলে নিজেদের
মধ্যে পারস্পরিক হানাহানি ও মারামারি সীমা ছাড়িয়ে যেত। ফলে কেউ কারো কাছে নতি
স্বীকার করত না। কেউ কারো প্রয়োজন অনুভব করতনা। আবার অর্থ সম্পদের একটি বিশেষ
বৈশিষ্ট্য এটাই যে, ধন-দৌলত যত বাড়ে তা পাওয়ার আকাঙ্খা,
মোহ, লোভ- লালসা ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে এর
অনিবার্য পরিণতি এটাই হত যে, একে অপরের সম্পত্তি হস্তগত করার
জন্যে পৃথিবীতে আল্লাহ্দ্রোহীতায় সীমা ছাড়িয়ে যেত। এমতাবস্থায় সর্বজ্ঞানী
আল্লাহ্ পাক সকল মানুষকে সব ধরনের রিযক ও নিয়ামত সমান ভাবে না দিয়ে এমন ভাবে দিয়েছেন
যে, কাউকে ধনসম্পদ বেশী দিয়েছেন, কাউকে
রূপ সৌন্দর্য অধিক দিয়েছেন । আবার কাউকে স্বাস্থ্য ও শক্তি এবং কাউকে জ্ঞান,
বিবেক বুদ্ধি ও মনন শক্তি অধিক দিয়েছেন । ফলে প্রত্যেকেই কোন না
কোন বিষয়ে একে অপরের মুখাপেক্ষী, পরস্পর পরস্পরের উপর
নির্ভরশীল। এরূপ পারস্পরিক মুখাপেক্ষীতা, নির্ভরশীলতা,
সহযোগীতা ও সহমর্মিতার উপরই মানব সভ্যতার ভিত প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।
ধন-সম্পদ একটি বড় পরীক্ষার
বিষয়
কুরআনে করীমের দৃষ্টিতে দুনিয়ার জীবন
সামগ্রী দু' প্রকারের। মাতায়ে হাসান ও
মাতায়ে গুরুর ।
মাতায়ে হাসান অর্থাৎ উত্তম জীবন সামগ্রী যা
পেয়ে মানুষ আল্লাহ্ তা'য়ালার শোকর
আদায়কারী বান্দাহ হয়ে জীবন যাপন করে, আত্মতৃপ্তি লাভ করে,
স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে এবং আল্লাহ্পাকের একান্ত অনুগত বান্দাহ হয়ে
ইবাদত বন্দেগী করে । এ জীবন সামগ্রী কেবল বৈষয়িক সুখভোগেই শেষ হয়ে যায় না,
পরকালীন অনন্ত জীবনের মুক্তি ও সুখ শান্তির জন্যও হয় প্রধান সহায়ক
। আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “আর তোমরা
তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা চাও এবং তাঁরই দিকে ফিরে আস । তাহলে তিনি
তোমাদেরকে একটি নির্দিষ্ট সময় পবৃন্ত উত্তম জীবন সামগ্রী দান করবেন। (সূরা হুদঃ
৩)
দ্বিতীয় প্রকার জীবন সামগ্রী মাতায়ে গুরুর
অর্থাৎ যা পেয়ে মানুষ ধোকা প্রতারণায় পড়ে যায় এবং পার্থিব জীবনের সুখভোগ, আরাম-আয়েশ ও স্বার্থকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে । এরূপ জীবন
সামগ্রী মানুষ যত পায়, ততবেশী পাওয়ার জন্য লালায়িত ও
ব্যাকুল হয়ে পড়ে। আল্লাহ্পাক বলেনঃ “নারী, সন্তান, সোনারুপার স্তুপ, নিশানাযুক্ত
ঘোড়া, গৃহপালিত পশু ও কৃষি জমি এগুলোর প্রতি আকর্ষণ ও
ভালবাসা দিয়ে মানুষের মনকে সুশোভিত করা হয়েছে । প্রকৃতপক্ষে এগুলো পৃথিবীর
সাময়িক জীবনের সামগ্রী মাত্র। ভাল আশ্রয় তো আল্লাহ্ তা'য়ালারই
কাছে । (সূরা আল ইমরানঃ ১৪)
যদি ও এসব জীবন সামগ্রী আল্লাহ্ তা'য়ালারই দেয়া নিয়ামত, কিন্তু মানুষ তা
পেয়ে রিযকদাতা আল্লাহ্কেই ভুলে গিয়ে ধনদৌলত, ভোগবিলাসের
নেশার মত্ত হয়ে দুহাতে শুধু আয় উপার্জন ও সঞ্চয় করে রাখে বলেই তা কঠিন পরীক্ষার
বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্য আল্লাহ্তা'য়ালা বলেনঃ “পার্থিব জীবনটা একটা প্রতারণা ও ধোকার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়”
। (সূরা হাদীদঃ
২০)
হযরত কা'ব ইবনে মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ
(সাঃ) বলেছেনঃ “সম্পদ ও আভিজাত্যের প্রতি মানুষের লোভ তার
ধর্মের যতটুকু ক্ষতি করতে পারে, বকরীর পাল ধ্বংস করার জন্য
ছেড়ে দেয়া দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়ে ও বকরীর পালের ততটুকু ক্ষতি করতে পারে না।”
(তিরমিযী)
কুরআনে করীমে বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই তোমাদের ধন-মাল ও সন্তান- সন্তুতি একটি পরীক্ষার
বিষয়। আল্লাহ্ই এমন সত্তা যার কাছে বড় প্ৰতিফল রয়েছে” । (আনফালঃ ২৮, তাগাবুনঃ ১৫)
উপরোক্ত দুটি আয়াতেই আল্লাহ্তা'য়ালা ঈমানদারদের লক্ষ্য করে কথাগুলো বলেছেন । তবে পৃথিবীর
প্রতিটি মানুষের জন্যেই তার অর্থ-সম্পদ, সন্তান-সন্তুতি বংশ
পরিবার একটা বড় পরীক্ষার বিষয়। কেননা, এসবের প্রতি
প্রেম-ভালবাসা ও মায়া মোহের কারণেই অধিকাংশ মানুষ ঈমান ও আল্লানুগত্যের সঠিক পথে
টিকে থাকতে পারে না । কিয়ামতের দিন এমন এক ব্যক্তিকে উপস্থিত করা হবে যাকে দেখে
অন্যেরা বলবে তার নেক কাজগুলোকে তার পরিজনেরা খেয়ে ফেলেছে ।” (রুহুল মা'আনী)
হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন যে, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেনঃ আদম সন্তানের বয়স বাড়ার সাথে
সাথে দুটি বস্তু বাড়ে, সম্পদের মোহ এবং সুদীর্ঘ জীবন (এর
আকাঙ্খা)। (বুখারী)
হযরত কা'ব ইবনে ইয়াদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি “প্রত্যেক জাতির জন্য একটি
ফিতনা (পরীক্ষার বস্তু) আছে, আর আমার উম্মতের ফিতনা হচ্ছে
সম্পদ।” (তিরমিযী)
প্রসংগত একটি প্রশ্ন জাগে, আল্লাহ্ তা'য়ালা যাদেরকে অধিক ধন-সম্পদ
দান করেছেন সমাজে যারা বিত্তবান ও সম্পদশালী তাদের কে কি তিনি শুধু শুধুই কঠিন
পরীক্ষার সম্মুখীন করবেন? নিশ্চয়ই না। দয়াময় আল্লাহ্
তাদেরকে যেমন পরীক্ষায় ফেলেছেন, আবার সে পরীক্ষা থেকে
পরিত্রাণ লাভের জন্য সহজ নির্দেশ ও দান করেছেন । তিনি বলেন “আল্লাহ্
তোমাকে যে ধন-সম্পদ দান করেছেন তা দিয়ে আখিরাতের আবাস ভূমি লাভের জন্য সচেষ্ট হও।”-(সূরা কাসাসঃ ৭৭)
আখিরাতের আবাস ভূমি লাভের সহজ পথও আল্লাহ্ তা'য়ালা বলে দিয়েছেনঃ “অতএব তোমরা
আল্লাহকে ভয় কর আর শোন ও আনুগত্য কর এবং ধন মাল ব্যয় কর। এটা তোমাদের জন্যই
কল্যাণকর। যে লোক নিজের মনের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত, কেবল
মাত্র সেই কল্যাণ ও সাফল্য লাভ করতে পারবে।” (সূরা তাগাবুনঃ
১৬)
আয়াতের শেষাংশের আলোকে একথা অত্যন্ত
সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ্ তা'য়ালার পথে অর্থ ব্যয়ের একটি বড় বাঁধা হচ্ছে, সংকীর্ণ
অর্থাৎ মানসিকতা লোভ ও কার্পণ্য। হৃদয়ের এরূপ নীচতা হীনতার দরুনই মানুষ অন্যের
ন্যায় সংগত অধিকার আদায় করা তো দূরের কথা এর কোন যৌক্তিকতা ও স্বীকার করতে চায়
না । শুধু তাই নয়, নিজে তো কাউকে কিছু দেবে না অন্য কেহ যদি
কাউকে কিছু দেয় তাও সহ্য করতে পারে না । এরূপ জঘন্য মানসিকতা মহান ইসলামের নৈতিক
শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত এবং সকল প্রকার অকল্যাণ ও বিপর্যয়ের অন্যতম কারণও। আর
সেজন্য আল্লাহ্ তা'য়ালা আবারও বলেনঃ বস্তুতঃ যেসব লোককে
তাদের মনের সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করা হয়েছে তারাই প্রকৃত কল্যাণ লাভ করবে।”
(সূরা হাশরঃ ৯)
আসলেই অন্তরের ঐশ্বর্যশীলতা ও উদারতা অর্জন
করা একটি বড় কঠিন কাজ ৷ এটা আল্লাহ্ পাকের একটি অতুলনীয় নিয়ামত ও। এ নিয়ামত
আল্লাহ্ যাকে দান করেন, সে পরম
সৌভাগ্যবান। আর সেজন্যই মহানবী (সাঃ) বলেন “ধন সম্পদ বেশী
থাকলেই ধনী হওয়া যায় না, বরং প্রকৃত ধনী হলেন, আত্মার ধনে ধনী।” (বুখারী, মুসলিম)
হযরত ইবনে মসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, নবী করীম
(সাঃ) বলেছেন, দু'জন লোক ব্যতীত আর
কারো প্রতি ঈর্ষা পোষণ করা যায় না । একজন হচ্ছে যাকে আল্লাহ্ ধন-সম্পদ দান করেছেন
এবং আল্লাহ্র রাস্তায় খরচ করার যোগ্যতা, ক্ষমতাও দান করেছেন
এবং সে তার সাহায্যে ফায়সালা করে ও অপরকে তা শিক্ষা দিয়া থাকে।” -(বুখারী, মুসলিম)
আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “সে দিন না ধন সম্পদ কোন কাজে আসবে,
না সন্তান সন্তুতি কেবল এ অবস্থা ব্যতীত যে, কোন
ব্যক্তি প্রশান্ত অন্তর নিয়ে আল্লাহ্র দরবারে হাজির হবে। (সূলা আশ্-শো'য়ারাঃ ৮৮-৮৯) অর্থাৎ কিয়ামতের দিন কোন কিছুই মানুষের উপকারে আসবে না।
একমাত্র ঈমান ও নেক আমলে পরিপূর্ণ আল্লানুগত প্রশান্ত হৃদয় ব্যতীত। অর্থ সম্পদ,
ধনদৌলত মানুষের জন্য কল্যাণকর হতে পারে যদি সে এটা আল্লাহ্র
রাস্তায় ব্যয় করে থাকে । তা না হলে লক্ষপতি কোটিপতি ও সেদিন শুধু কাংগালই হবে না,
কঠিন পীড়াদায়ক আযাবেও নিমজ্জিত হবে। সন্তান সন্তুতি ও সেদিন
উপকারে আসতে পারে যদি তাদেরকে সঠিকভাবে দ্বীনী শিক্ষা দেয়া হয় । আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্তুতি
তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করে দেবে না, তবে যারা ঈমান আনবে ও
নেক আমল করবে তারা তাদের আমলের বহুগুণ প্রতিদান পাবে এবং তারা সুউচ্চ ইমারতসমূহে
পরম নিশ্চিন্তে অবস্থান করবে।” (সূরা সাবাঃ ৩৭)
এমতাবস্থায় একটি সত্য অত্যন্ত সূক্ষ্ণ ভাবে
ভেবে দেখা প্রয়োজন যে, ধন-সম্পদ যত
অধিকই হোক না কেন মানুষের জীবনে যতটুকু প্রয়োজন তার অধিক কোন কাজে আসেনা । তার
চেয়েও বড় সত্য এটাই যে, মানুষ যত বেশীই অর্থ-সম্পদের মালিক
হোন না কেন, এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে সে যত বেশিই সুখভোগ
আরাম-আয়াশেই দিন অতিবাহিত করুন না কেন, তা অবশ্যই একদিন শেষ
হয়ে যাবে এবং এখানকার জীবনের সামগ্রী, সুখভোগ সব এখানেই
পরিত্যাগ করে এক অজানা অসীম অনন্ত জীবনের দিকেই যাত্র করতে হবে।' তবে ইসলাম দুনিয়ার জীবন সামগ্রীর ভোগ ব্যবহার করতেও একেবারে নিষেধ করেনি
অথবা আরাম আয়েশ, সুখ-স্বাচ্ছন্দকে অকারণ দুরে ঠেলে দিতেও বলেনি।
তাই অত্যন্ত গভীরভাবে ভেবে দেখা অত্যাবশ্যক যে, মানুষের
জীবনে ধনৈশ্বর্য ও সুখ ভোগের প্রয়োজন কতটুকু?
মানুষের যেহেতু প্রয়োজনের কোন শেষ নেই। তাই
তার আশা-আকাঙ্খা, ভোগ বিলাসেরও
কোন সীমা নেই। বরং অর্থ-সম্পদের প্রতি অত্যধিক মায়ামোহ, লোভ
লালসা থাকার দরুণ সে যত পায় তার চাওয়া পাওয়ার পরিধি আশা- আকাঙ্খা এবং প্রয়োজন
ও ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই প্রশ্ন জাগে, মানুষের
প্রয়োজনের সীমা কতটুকু? এ প্রশ্নের সঠিক জবাব নির্ণয় করা
খুবই কঠিন ।
কেননা, মানুষের জীবনে এমন কিছু নূন্যতম মৌলিক প্রয়োজন আছে, যা অস্বীকার করা যায় না। যেমন, অন্ন, বস্ত্র শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসা । কিন্তু এরপরেও
বাস্তব এবং সত্য কথা হচ্ছে, জীবনে ধন-সম্পদের প্রয়োজন
কতটুকু তার সীমা নির্ধারণ করা অনেকটা আপেক্ষিক বিষয়। কেননা, আল্লাহ্ তা'য়ালার উপর তাওয়াক্কুল ও তার সাথে
সম্পর্ক, মানুষের মানসিকতা, ধ্যান-ধারণা,
চিন্তাভাবনা এবং আকীদা বিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতেই তা নির্ধারিত হয়।
যে ব্যক্তি পার্থিব জীবনের ধনৈশ্বর্য, সুখভোগ ও বিলাশ
বৈভবকেই জীবনের চরম সফলতা মনে করে তার জন্যে প্রয়োজনের কোনই শেষ নেই । আবার যে
ব্যক্তি পরকালের অনন্ত জীবনের সুখ ভোগ ও আরাম আয়েশকে অধিক গুরুত্ব দেয় তার জন্যে
দুনিয়ার জীবনের প্রয়োজন অতি সামান্য। যারা একমাত্র আল্লাহ্ তা'য়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে পরিমিত খেয়ে পরে অল্পে তুষ্ট থেকে অতি
সাধারণভাবে জীবন যাপন করতে অধিক পছন্দ করেন তাদের জন্যেও প্রয়োজন অতি অল্প ।
নবী করীম (সাঃ) বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন
আল্লাহ্ তা'য়ালা বলবেন, “আমার বাছাইকৃত-মনোনীত বান্দাগণ কোথায়? ফেরেশতাগণ
বলবেন, ইয়া আল্লাহ্, তারা কারা?
আল্লাহ্ পাক বলবেন, তারা এ সকল গরীব মুসলমান
যারা আমার দেয়া হিস্সার উপর তুষ্ট ছিল, আমার নির্ধারিত
তাকদীরের উপর সন্তুষ্ট ছিল। তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করে দাও। অতপর তারা বেহেশতে প্রবেশ
করে খেতে থাকবে এবং পান করতে থাকবে অথচ তখন ও লোকেরা হিসেবে ব্যস্ত থাকবে।”
এমতাবস্থায় মানুষের জীবনে প্রয়োজনের সীমা
নির্ধারণ করা সত্যিই একটি কঠিন বিষয় । তবে আমরা এতটুকু বলতে পারি যে, যেহেতু ইসলামের সকল নীতিমালাই অত্যন্ত বাস্তব এবং সুদুর
প্রসারী কল্যাণকর। এ ক্ষেত্র ও তার কোন ব্যতিক্রম নেই ।
আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “আর তোমাকে জিজ্ঞেস করছে, আমরা আল্লাহ্র পথে কি ব্যয় করব? বলে দাও যা কিছু
তোমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়।” (সূরা বাকারাঃ ২১৯)
ধন-সম্পদ দ্বারা আল্লাহর প্রিয়
হবার মাপকাঠি নয়
ইসলাম সমগ্র মানব জীবনের জন্যে একটি
ইনসাফপূর্ণ জীবনবিধান । এ জীবনাদর্শের সকল নীতিমালাই অত্যন্ত বাস্তব, অপূর্ব সুন্দর এবং অতীব জীবনানুগ । ইসলামের দৃষ্টিতে
অর্থনৈতিক সমস্যাই মানব জীবনের একমাত্র মৌলিক সমস্যা নয় । এতে নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও মানবিক মূল্যবোধকেই অধিক গুরুত্ব দেয়া হয় । মানবিক অধিকার
ও মর্যাদার প্রশ্নে সকল মানুষই সমান । একমাত্র ঈমান, নেকআমল
ও আল্লাহভীতির মানদন্ডেই একে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে। তাই আল্লাহ্
তা'য়ালা বলেনঃ “নিশ্চয়ই তোমাদের
মধ্যে আল্লাহ্র কাছে সেই বেশি সম্মানিত যার মধ্যে অধিক তাওয়া বা আল্লাহভীতি
রয়েছে।” (সূরা হুজরাতঃ ১৩)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ্
তোমাদের আকার আকৃতি ও ধন মালের দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না । তিনি দেখবেন তোমাদের দিল
ও আমল ।”
সুতরাং একটি সত্য বিশেষ ভাবেই উপলব্ধি করার
মত যে, ধন সম্পদের আধিক্য ও প্রাচুর্য দেখে কাউকে
আল্লাহ্ তা'য়ালার কাছে অধিক প্রিয় ও পছন্দনীয় মনে করা ঠিক
নয়। কেননা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) যখন এ বলে দোয়া করেছিলেন যে, “হে আমার প্রতিপালক! এ শহরকে (মক্কা) শান্তি ও নিরাপত্তার শহর বানিয়ে দিন।
আর এর অধিবাসীদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহ্ ও আখিরাতকে মানবে তাদেরকে সব রকমের ফলের
আহার্য দান করুন।” জবাবে তাঁর রব বললেনঃ “আর যে মানবে না, দুনিয়ার গুটি কয়দিনের জীবনের
সামগ্রী আমি তাকেও দেব।” (সূরা বাকারাঃ ১২৬)
এ আয়াতে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার কয়দিনের রিযক আল্লাহ্ তা'য়ালা মুমিন, ফাসিক, কাফির,
বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী, নির্বিশেষে
সবাইকেই দান করবেন। এমনকি, আল্লাহ্ তা'য়ালার
কাছে অপ্রিয় ও অপছন্দনীয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি অনেককেই বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদের
মালিক করে থাকেন । আর শেষ পর্যন্ত এ ধন-সম্পদই তার জন্যে কঠিন আযাবের কারণ হয়ে
দাঁড়ায় । আল্লাহ্ পাক বলেনঃ “সব লোক একই নীতির অনুসারী
হয়ে যাবে যদি এ আশংকা না থাকত, তাহলে দয়াময় আল্লাহকে যারা
অস্বীকার করে তাদের ঘরের ছাদ ও এর সিঁড়িগুলো যার সাহায্যে তারা নিজেদের
বালাখানাসমূহে আরোহন করে, আর তাদের দরজা এবং তাদের আসনসমূহ
যাতে তারা হেলান দিয়ে বসে সবই স্বর্ণ ও চাঁদির আনিয়ে দিতাম। এগুলো সবই তো
দুনিয়ার জীবনের ভোগ সামগ্রীমাত্র। আর পরকাল আপনার রবের কাছে কেবলমাত্র মুত্তাকী
লোকদের জন্য নির্দিষ্ট।” (সূরা যুখরুফঃ ৩৩-৩৫)
অর্থাৎ ধনৈশ্বর্য আল্লাহ্ তা'য়ালার কাছে এতই হীন ও নগণ্য বিষয় যে, সমস্ত
মানুষের কুফরীর দিকে ঝুঁকে পড়ার আশংকা না থাকলে প্রত্যেক কাফিরের বাড়ী ঘরকেই
তিনি সোনারূপা দিয়ে বাঁধাই করে দিতেন।
নবী করীম (সাঃ) বলেনঃ “দুনিয়া যদি আল্লাহ্ তা'য়ালার কাছে
মশার একটি পাখার সমানও মর্যাদা রাখত তাহলে আল্লাহ্ তাআলা কোন কাফিরকে পৃথিবী থেকে
এক ঢোক পানিও দিতেন না।” (তিরমিযী)
এ থেকে জানা যায় যে, পার্থিব জীবনের ধন-দৌলতের প্রাচুর্য সত্যিকার অর্থেই মানুষের
জীবনের মর্যাদা ও আল্লাহ্ তা'য়ালার প্রিয় হবার মাপকাঠি হতে
পারে না। কেননা, ধন-সম্পদের আধিক্য ও প্রাচুর্য তো বেশীর ভাগ
ক্ষেত্রেই সমাজের নিকৃষ্ট ও জঘন্য চরিত্রের লোকদের কাছে স্তূপাকার হয়ে আছে যাদের
চরিত্রের দুর্গন্ধ সমগ্র সমাজ পরিবেশকেই দুঃসহ করে তুলছে।
তাছাড়া, অতীত কালের বহু জাতির উত্থান পতনের দৃষ্টান্ত থেকেও জানা যায় যে, অনেক জাতির উপরই আকস্মিকভাবে আল্লাহ্ তা'য়ালার গযব
নেমে এসেছে। এর মূল কারণ এটা ছিল যে, আল্লাহ্ পাক যখন
তাদেরকে প্রভূত ধন-দৌলত ও প্রতিপত্তি দান করেছেন তখন ভোগবিলাস ও ক্ষমতায় মদমত্ত
হয়ে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। শুধু তাই নয়, প্রবৃত্তির
দাসত্ব ও বস্তুবাদের নেশায় উন্মাদ হয়ে যুগে যুগে প্রেরিত নবী-রাসূলকে তারা
অস্বীকার করেছে, তাঁদের মুকাবিলা করেছে, সে সাথে তাওহীদের দাওয়াতকেও তারা প্রত্যাখ্যান করেছে ।
আমরা জানি, আরবের প্রাচীনতম জাতিগুলোর মধ্যে আ'দ জাতি যেমন উঁচু
স্তম্ভ বিশিষ্ট স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করত, অনুরূপভাবে সামুদ
জাতির বৈশিষ্ট্য ও এটাই ছিল যে, তারা পাহাড় পর্বত খোদাই করে
এর মধ্যেই বড় বড় ইমারত ও ঘরবাড়ী তৈরি করত ।
হযরত হুদ (আঃ) তাঁর জাতির লোকদের উদ্দেশ্যে
বলেনঃ “তোমাদের এ কি অবস্থা, সব উঁচু স্থানেই যে অর্থহীনভাবে স্মৃতিচিহ্ন রূপে নিদর্শন নির্মাণ করতেছ,
আর বড় বড় দালান কোঠা, প্রাসাদ রচনা করছ যেন
তোমরা চিরদিন এখানেই থাকবে।” (সূরা আশ-শো'আরাঃ ১২৮-১২৯)
আসলে তারা এসব করা নিজেদের বড়ত্ব, অহংকার, গৌরব, ধনৈশ্বর্য,
শক্তিসামর্থ এবং শিল্প নৈপুণ্য প্রদর্শন করার জন্যে। এত সবের প্রকৃত
কোন প্রয়োজনই ছিল না। বস্তুতঃ একটি ধ্বংসোন্মুখ জাতির সমাজ ও তমদ্দুনের অবস্থাও
ঠিক এরূপই হয়ে থাকে। একদিকে সমাজের গরীব দুঃখী অসহায় ও নিগৃহীত লোকদের মাথা
গুজার এতটুকু ঠাঁই হয়না, অপর দিকে ধনী ও উপরতলার লোকদের
প্রয়োজনাতিরিক্ত ভোগবিলাস আরাম-আয়েশের জন্যে বড় বড় প্রাসাদ এবং প্রদর্শনীমূলক
স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হতে থাকে। বস্তুগত উন্নতির সাথে সাথে নৈতিক অধপতনও হতে থাকে।
একদিকে বড় বড় অট্টালিকা ও
প্রাসাদের পর প্রাসাদ তৈরি হচ্ছিল অপর দিকে
সমাজে শির্কও পৌত্তলিকতার প্রসার ঘটছিল। ফলে হযরত হুদ (আঃ) কে তাঁর জাতির লোকেরা এ
বলে প্রত্যাখ্যান করে যে, “তুমি নসিহত কর
আর নাই কর, আমাদের জন্য সবই সমান। আমাদের এসব (কর্ম)
পূর্ব-পুরুষদিগের রীতি-নীতিমাত্র। শাস্তি প্রাপ্ত হব না।” (সূরা
আশ্-শো'আরাঃ ১৩৬-১৩৮)
অপর দিকে হযরত সালেহ (আঃ) তাঁর জাতির (সামুদ)
লোকদের কাছে যে হকের দাওয়াত পেশ করেন তাতে সমাজের গরীব, দুর্বল ও নিম্ন শ্রেণীর লোকেরাই শুধু সাড়া দেয়, উচ্চশ্রেণীর লোকেরা তা প্রত্যাখ্যান করে ।
আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার দাম্ভিকেরা বলল,
তোমরা যা বিশ্বাস করো আমরা তা অস্বীকার করি।” (সূরা আরাফঃ ৭৬)
শেষ পর্যন্ত এ দু'টি জাতির উপরই আল্লাহ্ তা'য়ালার কঠিন
আযাব নেমে আসে। আ'দ জাতির ধ্বংস হওয়ার যে বিবরণ কুরআনে
করীমে বর্ণিত হয়েছ তা থেকে জানা যায় যে, সহসা এক প্রচন্ড
ঝড় উঠে। লোকেরা তা দূর থেকে দেখে ভাবতে থাকে যে, মেঘের
সঞ্চার হয়েছে বৃষ্টি হবে ধারণায় তারা আনন্দে মেতে উঠে। কেননা বহুদিন ধরে বৃষ্টি
হচ্ছিল না। আসলে তা মেঘ ছিল না। ছিল আল্লাহ্র কঠিন আযাবের ঘনঘটা। সাতদিন সাতরাত
পর্যন্ত ক্রমাগতভাবে প্রচন্ডবেগে এ ঝড় বইতে থাকে। এর তীব্রতা এতই সাংঘাতিক ছিল যে,
মানুষকে ও উড়িয়ে নিয়ে বহু দূরে নিক্ষেপ করেছিল। এটা যেমন ছিল
শুষ্ক, তেমনি ছিল অতিশয় উত্তপ্ত। শেষ পর্যন্ত তাদের নগর ও
জনপদের শুধুমাত্র ধ্বংসাবশেষই তাদের পরিণতির কাহিনী বলার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে ।
অতপর সামুদ জাতির উপর কঠিন আযাবের যে ভয়াবহ
চিত্র তাও কুরআনে করীমে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “কি কঠিন ছিল আমার শান্তি ও সতর্কবাণী।
আমরা তাদের উপর শুধুমাত্র একটি প্রচন্ড ধ্বনি দিয়ে আঘাত হেনেছিলাম। ফলে তারা ছাগল
ভেড়ার খোয়াড় প্রস্তুতকারীর শুষ্ক শাখা ও তৃণাদির ন্যায় চূর্ণবিচূর্ণ ভূষি হয়ে
গেল।” (সূরা কামারঃ ৩০-৩১)
সেজন্যেই আল্লাহ্ পাক বলেনঃ “এ লোকেরা কি কখনো যমীনে ঘুরে ফিরে বেড়ায়নি? তাহলে তারা এসব লোকদের পরিণাম | পারণাম দেখতে পেত
যারা তাদের পূর্বে
চলে গিয়েছে।” (সূরা রূমঃ ৯)
তাছাড়া কুরআন পাকে বর্ণিত কারুণের দৃষ্টান্ত
থেকেও আমরা একই সত্য উপলব্ধি করতে পারি। আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “কারুণ মুসার জাতিরই এক ব্যক্তি ছিল।
কিন্তু সে নিজের জাতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে যায়। আমি তাকে এতবেশী ধন-দৌলত
দিয়েছিলাম যে, একদল শক্তিশালী লোকের পক্ষে এর চাবিগুলো বহন
করা কষ্টসাধ্য ছিল। একবার যখন তার জাতির লোকেরা তাকে বলল, আনন্দে
আত্মহারা হয়োনা, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ দাম্ভিকদেরকে ভালবাসেন না
। ” (সূরা কাসাসঃ ৭৬)
এর জবাবে কারুণ বলেছিল, “এ সব কিছুই তো আমি আমার নিজস্ব জ্ঞান গরিমায় প্রাপ্ত
হয়েছি।” (সূরা কাসাসঃ ৭৮)
আল্লাহ্ পাক বলেনঃ “শেষ পর্যন্ত আমরা কারুণকে এবং তার প্রাসাদকে যমীনে বিলীন করে
দিয়েছি। তার পক্ষে সাহায্যকারী এমন কেহই ছিল না যে আল্লাহ্র মুকাবিলায় তার
সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে আর সে নিজেও আত্মরক্ষা করতে পারেনি।” (সূরা কাসাসঃ ৮১)
অপর একটি বিষয়ও ভেবে দেখার মত যে, পার্থিব ধনৈশ্বর্য ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে বিভ্রান্ত হয়ে মানুষ
যুগ যুগ ধরে শুধু নবী রাসূল ও নবী-রাসূল দেরকেই অস্বীকার করেনি তাদের মুকাবিলায়
নিজেদের অবস্থার উপর নিশ্চিন্ত ও সন্তুষ্ট থাকার এ দলীলও উপস্থাপন করেছে যে,
আল্লাহ্ যদি আমাদেরকে অপছন্দ করবেন তবে আমাদেরকেই পার্থিব ধন-সম্পদ,
মানসম্মান ও সন্তান সন্তুতিতে কেন সমৃদ্ধ করবেন? সুতরাং পরকালেও আমরা শান্তি পাবো না ।
আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ "তারা আরও বলেছে যে, আমরা তোমাদের অপেক্ষা অধিক ধন-সম্পদ ও সন্তানের অধিকারী। সুতরাং আমরা
কিছুতেই শাস্তি পাওয়ার যোগ্য নই।” (সূরা সাবাঃ ৩৫)
সূরা কাহাফেও আল্লাহ্ তা'য়ালা একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত দিয়ে মানুষের এ রূপহীন মানসিকতার
চিত্র তুলে ধরেছেন। প্রতিবেশী দু'জন ব্যক্তির মধ্যে একজনকে
আংগুরের দু'টি বাগান দেয়া হয়েছিল । দুটি বাগানেই খুববেশী
আংগুর হত এবং তাতে আল্লাহ্ তা'য়ালা নহর ও প্রবাহিত করে
দিয়েছিলেন। বাগানের মালিককে প্রচুর ধন সম্পদও দেয়া হয়েছিল। এত কিছু পেয়ে একদিন
সে কথা প্রসঙ্গে তার প্রতিবেশি বন্ধুকে বললঃ “আমি তোমার
অপেক্ষা বেশি ধনী লোক, আর তোমার থেকে বেশী জনশক্তিও আমার
রয়েছে। অতপর সে তার বাগানে প্রবেশ করে নিজের পক্ষে নিজেই জালেম হয়ে মনে মনে বলতে
থাকে, “আমি মনে করি না যে, এ সম্পদ
কোনদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। আর আমি এ-ও আশা করিনা যে, কিয়ামতের
নির্দিষ্ট সময় কখনো আসবে। তা সত্বেও যদি কখনো আমাকে আমার রবের সামনে উপস্থিত করা
হয়-ই তাহলে সেখানেও আমি এটা অপেক্ষা অধিক সম্মানের স্থান লাভ করব।” (সূরা কাহাফঃ ৩৪-৩৬)
শেষ পর্যন্ত তার সমস্ত ফল বিনষ্ট হয়ে গেল
এবং সে আংগুরের বাগানকে শুষ্ক ও উল্টানো দেখে নিজের নিয়োগকৃত পুঁজির জন্যে হাত
মলতে লাগল আর বলতে লাগল, “হায় আমি যদি
আমার প্রতিপালকের সাথে কাউকে শরীক না করতাম।” (সূরা কাহাফঃ
৪২)
এ দৃষ্টান্ত থেকে জানা যায় যে, শুধুমাত্র আল্লাহ্ তা'য়ালার অস্তিত্বকে
অস্বীকার করলেই কুফরী হয় না, নিজের বড়ত্ব, অহংকার, গর্ব এবং পরকাল অমান্য করা ও শির্ক করার মত
সমান অপরাধ। চিরদিনই দেখা গেছে, সংকীর্ণমনা লোকেরা পৃথিবীর
সামান্য কিছু প্রাচুর্য লাভ করতে পারলেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গর্ব অহংকারে
নিমজ্জিত হয়ে আল্লাহ্তায়ালার নাফরমানীর কাজে লিপ্ত হয়েছে। কুরআনে করীমের অনেক
আয়াতেই মহান আল্লাহ্ মানুষের এরূপ ভাল ধারণার প্রতিবাদ করেছেন । তিনি বলেনঃ
“ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্তুতি দুনিয়ার জীবনের সাময়িক
সৌন্দর্যমাত্র। আসলেতো টিকে থাকা নেক আমলই আপনার রবের কাছে পরিণামের দৃষ্টিতে অতীব
উত্তম। আর এর প্রতিই ভাল আশা পোষণ করা যায়।” (সূরা কাহাফঃ
৪৬)
“যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে তাদের জন্যে
পার্থিব জীবন খুবই প্রিয় ও মনোমুগ্ধকর করে সাজিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ধরণের লোকেরা
ঈমানের পথ অবলম্বনকারীদেরকে বিদ্রুপ করে। কিন্তু কিয়ামতের দিন তাকওয়া অবলম্বন-
কারীরাই তাদের মুকাবিলায় উন্নত মর্যাদায় আসীন হবে। আর পৃথিবীর জীবিকার ক্ষেত্রে
আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত দান করে থাকেন ।
(সূরা আল বাকারাঃ ২১২) “তোমাদেরকে যা কিছু দেখা হয়েছে তা শুধু পার্থিব জীবনের সামগ্রীও চাকচিক্য
মাত্র। আর যা কিছু আল্লাহ্র কাছে রয়েছে তা এটা অপেক্ষা উত্তম ও অধিক স্থায়ী।
তোমরা কি বিবেক বুদ্ধিকে কাজে লাগাবে না?” (সূরা কাসাসঃ ৬০)
আর সেজন্যেই হয়ত বাস্তব জীবনে বিশেষভাবে
পরিলক্ষিত হয় যে, আল্লাহ্ তা'য়ালার কাছে অত্যন্ত প্রিয় ও পছন্দনীয় হওয়া সত্ত্বেও নেক ও সৎকর্মশীল
বান্দাদেরকেই তিনি একটা পরিমিত পরিমাণ রিযক দান করেন এবং তার মধ্যেই অসীম কল্যাণ
লুকিয়ে থাকে । আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “আপনার প্রতিপালকের দেয়া রিযকই অধিক উত্তর ও স্থায়ী।”
এ আয়াতে হালাল ও বৈধ উপায়ে অর্জিত
অর্থসম্পদকেই আল্লাহ্ পাকের দেয়া রিযক বলা হয়েছে। নিজের শ্রমের বিনিময়ে যে পাক
রিযক উপার্জন করা হয় তা-পরিমাণে যত কমই হোক না কেন, মুমিন মুত্তাকী বান্দাদের জন্যে এটাই অধিক উত্তর ও স্থায়ী। এতে এমন
কল্যাণ নিহিত থাকে, যা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জিন্দিগী
পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত ।
হযরত আদ্ ইবনে হাতিম (রাঃ) থেকে বর্ণিত।
তিনি বলেন, রাসূলে করীম (সাঃ) বলেছেনঃ
“তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষা কর, যদিও
তা খেজুরের অর্ধাংশ দিয়েও হয়।” (বুখারী, মুসলিম)
সে জন্যেই আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ “তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী
করবে না, তবে যারা ঈমান আনবে এবং নেক আমল করবে তাদের জন্যেই
আমলের দ্বিগুণ প্রতিফল রয়েছে এবং তারা সু-উচ্চ প্রাসাদে পরম নিশ্চিন্তে অবস্থান
করবে।” (সূরা সাবাঃ ৩৭)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, একমাত্র ঈমান, তাকওয়া ও নেক আমলের
মানদন্ডেই আল্লাহ্ তা'য়ালার কাছে প্রিয় ও পছন্দনীয় হওয়া
সম্ভব ।
অধিক ধন-সম্পদ, জীবনের প্রাচুর্য-ঐশ্বর্য আল্লাহ্ পাকের কাছে প্রিয় কবার মাপকাঠি তো নয়ই
বরং মুমিনের জীবনে তা আশংকার বিষয়। হযরত ইবনে আবী হাতের আবু সায়ীদ খুদরীর (রাঃ)
রেওয়ায়েতে বর্ণনা করেন। নবী করীম (সাঃ) বলেছেনঃ “আমি
তোমাদের ব্যাপারে যে বিষয়ের সবচেয়ে বেশী ভয় ও আশংকার করি তা হচ্ছে, দুনিয়ার ধন-সম্পদ ও সৌন্দর্য যার দরজা তোমাদের সামনে খুলে দেয়া হবে।”
ইতিহাস থেকেও জানা যায় যে, পার্থিব জীবনের
ধনৈশ্বর্য ও সুখ-সম্পদ যখন সাহাবায়ে কিরামের হাতে এসে পড়ে তখন তাঁরা বলেন যে,
আমাদেরকে যখন বিভিন্নভাবে দুঃখ কষ্ট ও বিপদ মুসিবত দিয়ে পরীক্ষা
করা হয়েছে তখন আমরা সবর ধারণ করতে পেরেছি। কিন্তু এখন আমাদেরকে ধর-সম্পদ, প্রাচুর্য দ্বারা পরীক্ষা করা হচ্ছে আমাদের প সঠিকভাবে সবর ধারণ কঠিন হয়ে
যাচ্ছে।
তবে একথাও ঠিক যে, অবিশ্বাসী কাপির এবং সমাজের প্রতিপত্তিশালী পাপাচারীদের
বিলাসী ও জাঁক-জমকপূর্ণ জীবন-যাপনে সর্বকালেই মানুষের মনে এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে
যে, এরা আল্লাহ্ তা'য়ালার কাছে
অপ্রিয় ও লাঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও তাদের হাতেই এতসব জীবন সামগ্রীর সমাহার কেন?
অপর দিকে সৎকর্মশীল ঈমানদারদের জীবনে দারিদ্র ও নিঃস্বতাই বা কেন?
এমন কি হযরত উমর ফারুক (রাঃ) এর ন্যায় মহানুভব ব্যক্তিত্বের মনেও এ
প্রশ্ন ক্ষণিকের জন্যে হলেও উদয় হয়েছিল। একবার রাসূল (সাঃ) তাঁর বিশেষ কক্ষে
একান্তে বসে ছিলেন। হযরত উমর (রাঃ) সে কক্ষে প্রবেশ করে দেখলেন যে, রাসূলে করীম (সাঃ) এটি মোটা খেজুর পাতার তৈরি মাদুরে শুয়ে আছেন এবং তাঁর
পবিত্র দেহে খেজুর পাতার দাগ ফুটে উঠেছে। এ অসহায় দৃশ্য দেখে হযরত উমর ফারুক
(রাঃ) কান্না রোধ করতে পারলেন না। তিনি অশ্রু বিগলিত কণ্ঠে বলে উঠলেনঃ “ইয়া রাসূলুল্লাহ! পারস্য ও রোম সম্রাটগণ এবং তাদের অমাত্যরা কেমন সব
নিয়ামত ও সুখ ভোগ করছে। আর আপনি সমগ্র সৃষ্ট জীবের মধ্যে আল্লাহ্ তা'য়ালার মনোনীত ও প্রিয় রাসূল হয়েও আপনার এ দুর্দশাগ্রস্থ জীবন এ কেমন
কথা? রাসূল (সাঃ) এ কথার জবাবে বললেনঃ “হে খাত্তাব তনয়, তুমি এখন পর্যন্ত এ সন্দেহ-সংশয়ের
মধ্যে রয়েছ? অথচ পরজগতে তাদের কোন অংশ নেই। সেখানে শুধু
আযাবই আযাব। কিন্তু মুমিনদের ব্যপারে এর বিপরীত।” বিশ্বের
সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, রাহ্মাতুললিল আলামীন পার্থিব জীবনের
সুখ-ভোগ সৌন্দর্য ও আরাম আয়াসের প্রতি এতবেশি নিরাশক্ত ছিলেন । আর সেজন্যে মহান
আল্লাহ্ পাক ও তাঁর প্রিয় হাবীব সম্পর্কে বলেনঃ “তোমাদের
জন্যে রাসূলের জীবনই সর্বোত্তম আদর্শ।” (সূরা আয্হাবঃ ২১)
তিনি আরো বলেনঃ হে নবী! আপনি বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার
অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ্ ও তোমাদের ভালবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ রোধ ক্ষমা ক করে
দেবেন । আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আল-ইমরানঃ ৩১)
আয়াতে অত্যন্ত সুস্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তা'য়ালাকে ভালবাসার প্রধান
শর্তই হচ্ছে তাঁর প্রিয় হাবীব রাসূলে করীম (সাঃ) কে অনুসরণ করা এবং তাঁকে
ভালবাসা। সুতরাং সারা জাহানের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব রাসূলে পাক (সাঃ)-কে অনুসরণ ও
ভালবাসার প্রকৃত রূপ কেমন সে সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে
মুগাফ্ফাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী
করীম (সাঃ)-কে বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহ্র কসম আমি
নিশ্চয়ই আপনাকে ভালবাসি । তিনি বললেনঃ কি বলছ তা ভেবে দেখ। লোকটি বলল, আল্লাহ্ শপথ করে বলছি, নিশ্চয়ই আমি আপনাকে ভালবাসি
। এরূপ সে তিনবার বলল। তারপর রাসূল (সাঃ) বললেনঃ তুমি যদি আমাকে ভালবাস তাহলে
দারিদ্রের জন্যে মোটা পোশাক তৈরি করে নাও। কেননা, পানি যে
গতিতে তার শেষ গন্তব্যের দিকে ধেয়ে যায়, আমাকে যে ভালবাসে
দারিদ্র্য ও নিঃস্বতা তার চেয়েও দ্রুত গতিতে তার কাছে পৌছে যায় । (তিরমিযী)
রাসূলে করীম (সাঃ) এর বাস্তব জীবনেও আমরা
তাঁর এ কথায় সঠিক প্রতিফলন দখতে পাই । হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত ।
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এই বলে
দোয়া করতেনঃ “আয় আল্লাহ্! মুহাম্মদ এর পরিবারবর্গকে ক্ষুধা
নিবারণ পরিমাণ রিযিক দান করুন।” (বুখারী, মুসলিম)
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি
বলেনঃ একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমার কাঁধে হাত রেখে বলেনঃ “দুনিয়াতে মুসাফির বা পথচারীর ন্যায় জীবন-যাপন কর।” (বুখারী)
হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি
বলেন, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন যে, আমার কাছে ওহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকলেও তা কিছু আমার কাছে ঋণ
পরিশোধের জন্য ব্যতীত তিনদিন থাকবে, তা আমি পছন্দ করব না ।”
(বুখারী)
হযরত ফুযালা ইবনে উবায়েদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত।
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন
সাহাবাদের নিয়ে নামায আদায় করতেন, তখন তার পিছনে দাঁড়ান
ব্যক্তিদের মধ্য থেকে ক্ষুধার কারণে কেউ কেউ মাটিতে ঢলে পড়ে যেতেন। আর তাঁরা
আস্হাবে সুফ্ফার অন্তর্গত ছিলেন । এমনকি বেদুঈনরা তাঁদের দেখে পাগল বলে আখ্যায়িত
করত। নবী করীম (সাঃ) নামায শেষ করে তাদের দিকে মুখ ফিরেয়ে বলতেনঃ তোমরা যদি জানতে
পারতে যে, আল্লাহ্ তা'য়ালার কাছে
তোমার জন্যে কি মর্যাদা ও সামগ্রী মওজুদ রয়েছে, তাহলে
ক্ষুধা ও অভাব আরো বৃদ্ধি হবার আকাঙ্খা করতে।” (তিরমিযী)
নুমান ইবনে বশীর (রাঃ) থেকে বর্ণিত । তিনি
বলেন, যেসব লোকের পার্থিব সম্পদ, সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও ধনৈশ্বর্য অর্জিত হয়েছে, তাদের
সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বলেনঃ “আমি
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দেখেছি সারাদিন তাঁর (নাড়ি ভুঁড়ি) পেচিয়ে থাকত, অথচ তার পেটে দেয়ার জন্যে এমন কোন নষ্ট পুরানো খেজুর ও মিলত না।”
(মুসলিম)
আমরা জানি যে, রাসূল (সাঃ)-এর নিজ হাতে গড়া সাহাবাগণও প্রায় সকলেই গরীব ছিলেন এবং
তাঁরা এমনিই নবী প্রেমিক ছিলেন যে, প্রায় প্রত্যেকেই
অত্যন্ত সাধারণ জীবন-যাপন করতেই অধিক ভালবাসতেন। তবে দু'চার
জন যারা ধনী ছিলেন তাঁদের মধ্যে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) একজন । তিনি তাঁর
সমস্ত ধনসম্পদ একমাত্র আল্লাহ্ তা'য়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের
লক্ষ্যে এমন ভাবে ব্যয় ব্যবহার করেন যার ফলে তিনি সে বিরাট মর্যাদা সম্পন্ন পরম
সৌভাগ্যবান সাহাবাগণের একজন যারা নিজেদের জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন
অর্থাৎ সাহাবা আবদুর রহমান ইবন আউফ (রাঃ) সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি আশারায়ে
মুবাশশারার একজন। তিনি রাসূল (সাঃ)-কে এতবেশী ভালবাসতেন যে, একবার
তিনি তাঁর বন্ধুদের দাওয়াত দেন । ভাল ভাল খাবার এলে তা দেখে সাহাবা আবদুর রহমান
(রাঃ) কান্না শুরু করে দেন। সকলেই জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? তিনি
বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিদায় নিয়েছেন, অথচ তিনি নিজের
ঘরে যবের রুটিও পেট ভরে খেতে পাননি
আমরা জানি যে, আল্লাহ্ তা'য়ালার সমস্ত মাখলুকাতের মধ্যে নবী করীম
(সাঃ)ই সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব । অথচ উপরোক্ত আলোচনা থেকে অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে,
তিনি কত বেশি সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করতেন এবং রাসূল (সাঃ)-এর
আর্থিক অবস্থা কতই না করুণ ছিল। সুতরাং এমতাবস্থায় মানুষের জীবনে অর্থ সম্পদই যদি
শ্রেষ্ঠত্ব মর্যাদার মাপকাঠি হত তাহলে আল্লাহ্ তা'য়ালা
নিশ্চয়ই তাঁর প্রিয় হাবীবকেই সর্বাধিক ধন-সম্পদের অধিকারী করতেন অথবা তাঁকেই
সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী বানাতেন। তাই সর্বশেষ এ কথাটিও চিন্তা ভাবনা করার দাবী রাখে যে,
জন্মসূত্রে পৃথিবীর সব মানুষই সমান অর্থ সম্পদের অধিকারী হয় না ।
কেউ ধনী, কেউ গরীব আবার কেউ বা নিঃস্ব। এমনকি সকলের যোগ্যতা
মেধা ও সমান নয়। আবার অর্থ সম্পদ আয় উপার্জনেরও সকলের সমান সুযোগ সুবিধা থাকেনা।
একই রকম সুযোগ সুবিধা থাকা সত্বেও আবার সবাই সমান লাভবানও হয় না, কেউ কম কেউ বা বেশি ।
সুতরাং যে বিষয়টি মানুষের জন্মসূত্রে সমান
পর্যায়ের হয় না, এর
আয়-উপার্জনের ক্ষেত্রেও সকলেই সমান সুযোগ সুবিধা পায় না এমন কি, সমান সুযোগ-সুবিধা পেয়েও একই রকম ফল লাভ করা সম্ভব হয় না, তেমন একটি বিষয়কে মর্যাদা এবং আল্লাহ্ তা'য়ালার
প্রিয় হওয়ার মাপকাঠি বানানো নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্পাকের হ ইনসাফের দৃষ্টিভঙ্গির
সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে না ।
আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয়ের
প্রকৃত তাৎপর্য
আল্লাহ্ তা'য়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে তাঁরই নির্দেশিত পথে এবং মহানবী (সাঃ)
এর দেখানো পদ্ধতিতে অর্থ-সম্পদের ব্যয় ও ব্যবহারই হচ্ছে আল্লাহ্র পথে অর্থ ব্যয়।
কুরআনে করীমের অনেক আয়াতে ঈমানদার লোকদের অতীব উত্তম মৌলিক গুণাবলী বর্ণনা
প্রসঙ্গে আল্লাহ্পাক বলেনঃ “ওয়ামিম্মা রাযাকনাহুম ইউফিকুন”
অর্থাৎ আর যে রিযক আমি তাদেরকে দিয়েছি, তা
থেকে তারা ব্যয় করে।”
শুধু তাই নয়, মহান আল্লাহ্ প্রদত্ত আল্ কুরআন থেকে হিদায়াত ও রহমত লাভের একটি অন্যতম
শর্ত হচ্ছে, আল্লাহ্ তা'য়ালার পথে
অর্থ-সম্পদ ব্যয় করা। কেননা, পবিত্র কুরআনের শুরুতেই
আল্লাহ্পাক ঘোষণা করেনঃ
“আলিফ-লাম-মিম, এটা-আল্লাহ্
তা'য়ালার কিতাব। এর মধ্যে কোন সন্দেহ নেই । এটা হিদায়াত
সেই মুত্তাকীদের জন্যে যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, নামায
কায়েম করে এবং আমি যে রিযক তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।” (সূরা আল বাকারাঃ ১-৩)
সাধারণত দান, সদকা, যাকাত, ফিত্রা, উশর এবং বিভিন্ন জনকল্যাণ ও সেবুমূলক কাজে যে অর্থ ব্যয় করা হয় তা সবই
আল্লাহ্র পথে অর্থ ব্যয় বুঝায় । কিন্তু যে সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আল্লাহ্
দ্বীন কায়েম নেই, ইনসাফ ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত নেই,
সে সমাজে দান সাদকা, যাকাত ফিত্রা, উশর যতই আদায় করা হোক না কেন তার দ্বারা সঠিক ভাবে ফায়দা লাভ করা সম্ভব
নয় । আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ । একথা অত্যন্ত সত্য যে,
সমাজের অর্থ-সম্পদশালী লোকেরা ব্যক্তিগত ভাবে নিজেদের সমস্ত সম্পদও
যদি দান করে দেয় তাহলেও দেখা যাবে যে, সমাজের ফকির, মিস্কীন, অসহায় নারী শিশু, অভাবী
পঙ্গু ও ছিন্নমূল লোকদের সমস্যা সমাধান হবে না । সমাজের সকল আর্তপীড়িত, অভাবী পঙ্গু অসহায়দের মৌলিক চাহিদা পূরণ ইন্সাফ ও ন্যায় বিচার
প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে কিছুতেই সম্ভব নয়। সেজন্যেই যে সমাজে আল্লাহ্র দ্বীন
প্রতিষ্ঠিত নেই সে সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রতিটি মুমিন মুসলমানের উপর
ইকামাতে দ্বীনের দায়িত্ব পালন করা অবশ্য কর্তব্য-ফরয। আল্লাহ্ তা'য়ালার সুস্পষ্ট নির্দেশঃ “তোমরা ঈমান আন আল্লাহ্ ও
তাঁর রাসূলের প্রতি আর জিহাদ করো আল্লাহ্র পথে নিজেদের ধনমাল ও জান প্রাণ দিয়ে ।
এটাই তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা জান।” (সূরা আস্-ছফঃ ১১)
তিনি আরো বলেনঃ “আর জিহাদ কর আল্লাহ্র পথে নিজেদের ধনমাল ও জান প্রাণ দিয়ে।
এতেই তোমাদের সার্বিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে-যদি তোমরা জান।” (সূরা
আত্-তওবাঃ ৪১)
উপরোক্ত আয়াতে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর সাথে
ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহর অত্যন্ত গভীর সম্পর্ক বিদ্যামান। সুতরাং আমরা নিঃসন্দেহে
বলতে পারি যে, আল্লাহ্র পথে অর্থ ব্যয়ের
সর্বোত্তম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে, ইনফাক ফি
সাবিলিল্লাহ । এমন কি আল্লাহ্পাকের নির্দেশিত বাধ্যতামূলক যে দান অর্থাৎ যাকাতের
আটটি খাতের মধ্যেও “ফি সাবিলিল্লাহ'র
একটি খাত আলাদা রয়েছে। কেননা, দ্বীন কায়েমের প্রয়োজনে যে
অর্থ ব্যয় তা সওয়াবের দৃষ্টিতে যেমন উত্তম তেমনি বাস্তবতার আলোকেও অধিক ফলপ্রসু
ও কল্যাণকর। শুধু তাই নয় ইহ্কাল ও পরকাল উভয় জিন্দেগীতে এ কাজের সুফল পরিব্যাপ্ত
।
আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “তোমরা কি হজ্বযাত্রীদের পানি পান করানো
এবং মসজিদুল হারামের সেবা ও রক্ষণাবেক্ষণ করাকে সে ব্যক্তির কাকজের সমান মনে কর যে,
আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী এবং আল্লাহ্র পথে সংগ্রাম করে?
আল্লাহ্র তো এ দু' শ্রেণীর লোক এক ও সমান নয়।”(সূরা আত্-তওবাঃ ১৯)
অর্থাৎ ঈমান ও ইকামাতে দ্বীনের দায়িত্ব পালন
করাই আল্লাহ্র নিকট অধিক পছন্দনীয় আমল। এমন কি মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়েও
তাঁরাই সর্বোত্তম যাঁরা এ মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দেন । তাই আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ
“আল্লাহর কাছে তো সে লোকদেরই অতি বড় মর্যাদা,
যাঁরা ঈমান আনে, দ্বীনের জন্যে নিজেদের
ঘর-বাড়ী ত্যাগ করে এবং ধনমাল ও জান-প্রাণ দিয়ে আল্লাহ্র পথে সংগ্রাম সাধনা করে ।
তাঁরাই প্রকৃত সফলকাম।” (আতওবাঃ ২০)
হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল “হে আল্লাহ্র রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে ভাল কে? উত্তরে নবী করীম (সাঃ) বলেনঃ 'যে মুমিন আল্লাহ্র পথে
তাঁর জান প্রাণ ও ধনমাল দিয়ে জিহাদ করে।” (বুখারী, কিতাবুল জিহাদ)
উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা একথা অত্যন্ত
সুস্পষ্ট যে, ঈমান আনা এবং আল্লাহ্ তা'য়ালার দ্বীনের স্বার্থে সংগ্রামে সাধনা করাই আল্লাহ্ তায়ালার কাছে অধিক
পছন্দনীয় ও সওয়াবের কাজ এবং সর্বোত্তম আমল ও। সুতরাং এরূপ সর্বোত্তম আমলের জন্যে
অর্থ ব্যয় করাই হবে সর্বোত্তম খাতে ব্যয় এটাই স্বাভাবিক ।
প্রসঙ্গতঃ একটি প্রশ্ন জাগে, দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে অর্থব্যয়ের আহ্বান কেন? মূলতঃ মানুষের জীবনের চরম পরীক্ষার জন্যেই এ আহ্বান। কেননা ঈমানের
অনিবার্য দাবীই হচ্ছে, আল্লাহ্ তা'য়ালার
পথে ধনমাল ও জান প্রাণ দিয়ে সাহা করা । অথচ এ দু'টি বস্তুই
মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। বিশেষ করে অর্থ-সম্পদ ও ধন দৌলতের মায়া-মোহ এবং সুখ
ভোগের জন্যেই বেশীর ভাগ মানুষ ইকামাতে দ্বীনের আন্দোলনের বিরোধিতা করে থাকে । এটা
ঐতিহাসিক ভাবেও সত্য। কেননা, যুগ যুগ ধরে দেখা গিয়েছে যে,
যখনই কোন নবী-র -রাসূলগণ তাওহীদের বাণী নিয়ে এসেছেন সমাজের স্বচ্ছল
ধনিক শ্রেণীর (মুতরাফ) লোকেরাই সর্বপ্রথম এবং সকলের আগে তাঁদের মুকাবিলা করেছে,
তাঁদেরকে বরদাশত করতে পারেনি, প্রচন্ড
বিরোধিতা করেছে। তাই আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “এমন কখনো হয়নি যে, কোন জনবসতিতে আমরা একজন
সতর্ককারী পাঠিয়েছি, আর সে জনসবতির সুখী সমৃদ্ধ স্বচ্ছল
লোকেরা বলেনি যে বাণী তোমরা নিয়ে এসেছ আমরা তা মানছি না। তারা চিরকালই এরূপ বলেছে
যে, আমরা তোমাদের অপেক্ষা অধিক ধন-সম্পদের অধিকারী আর আমরা
কিছুতেই শাস্তি পাওয়ার যোগ্য নই।” (সূরা সাবাঃ ৩৪-৩৫)
এমন কি নবী করীম (সাঃ) যখন মক্কায় সবেমাত্র
তাওহীদের দাওয়াত দিতে শুরু করেন তখনও সমাজের সরদার গোত্রপতি ও প্রভাব
পতিপত্তিশালী ওতবা, শায়বা, উমাইয়া, আবু সুফিয়ান, আবু
জাহল, আবু লাহাব নবী (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
এমন কি দ্বীনী দাওয়াতের কাজ বেড়ে যাবার সাথে সাথে ক্ষমতাসীন কায়েমী
স্বার্থবাদীদের বিরোধিতাও শত গুণ বেড়ে যায় । তাদের অত্যাচার নির্যাতনে অতিষ্ঠ
হয়ে নবী করীম (সাঃ) সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে শেষ পর্যন্ত মাতৃভূমি পরিত্যাগ করে হিযরত
করতে বাধ্য হন ।
অপর দিকে যুগ যুগ ধরে ইকামাতে দ্বীনের
আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, সাধারণতঃ সমাজের দুর্বল, বিত্তহীন, বঞ্চিত মুস্তাদআফীন শ্রেণীর লোকেরাই তাওহীদের দাওয়াতে অনুকূল সাড়া দিয়ে
এসেছে এবং নবী রাসূলদের সাথী হয়েছে। এক্ষেত্রেও দেখা গেছে যে, সমাজের প্রভাব পতিপত্তিশালীদের একটা বড় অভিযোগ এ ছিল যে, সমাজের নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা ঈমান এনেছে সুতরাং অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা কি
করে তাদের সঙ্গী সাথী হবে? যেমন হযরত নূহ (আঃ)-এর সময়ে তারা
বলেছে-“আর আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদের
মধ্যে যারা হীন, নীচ নির্বোধ তারাই তোমার পথ অবলম্বন করেছে ।”
(সূরা হুদঃ ২৭)
অতপর নবী করীম (সাঃ)-এর সময়েও দেখা গেছে যে, এ নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি। ইসলামের প্রাথমিক কালে মক্কার
গরীব, দাস, নিগৃহীত ও বিত্তহীন লোকেরাই
সর্বপ্রথম নবী (সাঃ)-এর দাওয়াত কবুল করেছিল । দু' চার জন
যারা সমাজের উঁচু শ্রেণীর ছিল তাদের অবস্থা ছিল অনেকটা ব্যতিক্রম। রোম সম্রাট
কায়সারের দরবারে আবু সুফিয়ানের বিবৃতি থেকেও এ সত্যটি অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে
উঠে। যেমন, “তিনি (রোম সম্রাট) বললেনঃ বিত্তবান ও প্রভাবশালী
(আশরাফ) লোকেরা তাঁর (হযরত মুহাম্মদ সাঃ) অনুসারী হচ্ছে না দুর্বল শ্রেণীর (যয়ীফ)
লোকেরা? আমি (আবু সুফিয়ান) বললামঃ দুর্বল ও বিত্তহীন
লোকেরা। (সম্রাট বললেন) তুমি বলছ, দুর্বল ও বিত্তহীন লোকেরাই
তাঁর অনুসরণ করছে । প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের লোকেরাই রাসূলদের অনুসারী হয়ে থাকে।”
(বুখারী)
এছাড়া কুরাইশ বংশের সরদার ও গোত্রপতি
বিত্তবান লোকেরা নবী করীম (সাঃ)-কে এ বলে ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও অভিযোগ করত যে, নবীর চার পাশে জাতির ক্রীতদাস, আযাদ করা
গোলাম ও সাধারণ শ্রেণীর লোকেরাই ভীড় জমায় । তারা আরো বলত যে, এ ব্যক্তির সঙ্গীসাথী হয়েছে কি সব লোকেরা-বেলাল, আম্মান,
সুহাইব ও খাব্বাব, এদেরকেই কি আল্লাহ্ আমাদের
অপেক্ষা সম্মানিত করার যোগ্য বলে মনে করেছেন?
তবে শুধু নবী করীম (সাঃ)-এর যুগ পর্যন্তই নয়, পরবর্তী সময়েও যখনই সত্য মিথা ও ন্যায় অন্যায়ের আন্দোলন
হয়েছে সমাজের নেতৃস্থানীয় ক্ষমতাসীন স্বচ্ছল ধনিক শ্রেণীর লোকেরাই সকলের আগে এর
বিরোধীতা ও মুকাবিলা করেছে এবং সত্যের দাওয়াতকে দাবিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা
করেছে। অপর দিকে সমাজের মুস্তাদ’আফীন শ্রেণীর লোকেরা সত্য ও
ন্যায়ের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। এমন কি বর্তমান সময়েও আমরা একই অবস্থা দেখতে
পাচ্ছি যে, ইসলামী আন্দোলনের বেশীর ভাগ লোকেরাই গরীব,
বিত্তহীন এবং পার্থিব জীবনের সুখভোগ ও স্বার্থ বঞ্চিত। মুষ্টিমেয়
কিছু লোক মধ্যবিত্ত। সমাজের ধনিক শ্রেণীর কিছু লোকের সমর্থন থাকলেও সক্রিয়ভাবে
অংশ গ্রহণ করে খুবই কম সংখ্যক লোক । সর্বজ্ঞানী আল্লাহ্ তা'য়ালা
মনে হয় সেজন্যেই ধন-মাল ও জান-প্রাণ দিয়ে জিহাদ করার এত বেশি তাকিদ দিয়েছেন ।
তবে আল্লাহর পথে ধন-মাল ব্যয় করা সত্যিকার
অর্থেই একটি বড় কঠিন কাজ । কেননা, মানুষ প্রকৃতিগতভঅবেই লোভী ও সংকীর্ণমনা। ধন-দৌলত ও অর্থ-সম্পদের প্রতি
মোহ ভালবাসা এবং তা সঞ্চয় করে রাখার আগ্রহ মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি ।
আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “ধন সম্পদের মায়ায় তোমরা বড় বেশি
কাতর।” (সূরা অযরঃ ২০)
পৃথিবী ভরা অফুরন্ত ধন সম্পদ ও অগণিত
নিয়ামতেও মানুষের মন কখনই অসুবিধা হয় না। মানুষের এরূপ অবস্থাকে নবী করীম (সাঃ)
বর্ণনা করেছেন এভাবে, “আদম সন্তান যদি
দু' উপত্যকা ভর্তি সম্পদ পায় তবুও সে তৃতীয় উপত্যকা পেতে
আগ্রহী হবে। আদম সন্তানের পেট মাটি ছাড়া অন্য কোন বস্তু দিয়ে ভরতে পারে না।”
অর্থাৎ মাটির নীচে (কবরে) যাবার পরই মানুষের লোভ লালসার এ ধারার
সমাপ্তি হতে পারে।) মহান আল্লাহ্ বলেনঃ “এমন কি (এ চিন্তায়)
তোমরা কবরের মুখ পর্যন্ত গিয়ে উপস্থিত হও।” -(সূরা তাকাসুরঃ
২)
অর্থাৎ মানুষ তার গোটা জীবনই পার্থিব জীবনের
সুখ ভোগ স্বার্থ এবং ধন সম্পদের আয় উপার্জনের চিন্তায় কাটিয়ে দেয়। এমনকি এ
জীবনের চিরসমাপ্তির শেষ মুহূর্তটি পর্যন্তও মানুষ এ চিন্তা থেকে নিস্কৃতি পেতে
পারে না। মৃত্যুর হিমশীতল ছোবল ব্যতীত সম্পদের মায়ামোহ ত্যাগ করা মানুষের পক্ষে
খুবই কঠিন ।
হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের মধ্যে
থেকে পৃথিবীতে যে সব চেয়ে ধনী ছিল তাকে হাযির করা হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা
হবে। অতপর তাকে জিজ্ঞেস করা হবে ‘হে আদম সন্তান! তুমি কি
কখনো কোন কল্যাণ দেখেছো? তুমি কি কখনো স্বস্তি ও শান্তিতে
দিন যাপন করেছো? সে বলবে, “না, আল্লাহ্র শপথ করে বলছি, হে আমার রব! কখনো না । আর
জান্নাতীদের মধ্যে থেকেও একজনকে হাযির করা হবে যে পৃথিবীতে সবচেয়ে দুর্দশা ও অভাব
গ্রস্ত ছিল । অতপর তাকে বেহেশতে প্রবেশ করানো হবে এবং জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি কি কখনো কোন অভাব দেখেছ? তুমি কি কখনো দুর্দশা
ও অভাব-অনটনের মধ্যে দিন যাপন করেছ? সে বলবে, “না, আল্লাহ্ শপথ করে বলছি, আমি
কখনো অভাব অনটন দেখিনি আর আমার উপর দিয়ে তেমন কোন দুর্দশার সময়ও অতিবাহিত হয়নি।”
(মুসলিম)
আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “অতপর সে (কারন) জাঁক-জমকের সাথে তার
সম্প্রদায়ের লোকদের সামনে বের হল যারা পৃথিবীর জীবনের আকাংখী ছিল, তারা তাকে দেখে বলতে লাগল, “হায়, কারূনকে যা দেয়া হয়েছে আমাদেরকেও যদি সেরূপ দেয়া হত। নিশ্চয়ই সে বড়ই
ভাগ্যবান। কিন্তু যারা প্রকৃত ইলমের অধিকারী ছিল তারা বললঃ “তোমাদের
অবস্থার জন্যে দুঃখ হয়, আল্লাহ্র সওয়াব তার জন্যে উত্তম যে
ঈমান আনে ও নেক আমল করে ।” (সূরা আল কাসাসঃ ৭৯-৮০)
সুতরাং যারা দুনিয়ার জীবনের তুলনায় পরকালের
অনন্ত জীবনের গুরুত্ব অধিক অনুভব করতে পারে এবং অত্যন্ত ইয়াকীনের সাথে বিশ্বাস
করে যে, একদিন আল্লাহ্ পাকের সামনে হাযির হয়ে
ধন-সম্পদের আয় উন্নতি, ভোগ ব্যবহার ব্যয়সহ জীবনের সকল
কৃতকর্মের অত্যন্ত সূক্ষাতিসূক্ষ জবাবদিহি করতে হবে তাদের পক্ষে ধনৈশ্বর্য ও
সম্পদের মায়ামোহ ত্যাগ করা তেমন কঠিন হওয়ার কথা নয় । কেননা তারা নিশ্চিতভাবে
বিশ্বাস করে যে, পৃথিবীর জীবনের তুলনায় পরকালের নিয়ামত
অধিক উত্তম ও স্থায়ী।
আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ তোমাদেরকে যা কিছু দেয়া হয়েছে তা শুধু পৃথিবীর কয়েক দিনের
জীবনের সামগ্রী মাত্র আর যা কিছু আল্লাহ্র নিকট রয়েছে তা যেমন উত্তম উৎকৃষ্ট
তেমনি স্থায়ীও। (সূরা শুরাঃ ৩৬)
তিনি আরো বলেনঃ “কিন্তু তোমরা তো পৃথিবীর জীবনকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছ । অথচ
পরকাল অধিক কল্যাণময় ও চিরস্থায়ী। (সূরা আল-আলাঃ ১৭)
অর্থাৎ পরকালের খে ভোগ আরাম, আয়েশ, আনন্দ দুনিয়ার সমস্ত নিয়ামতের
তুলনায় অধ তৃপ্তিদায়ক, কল্যাণকর এবং অনন্ত জীবনব্যাপী
স্থায়ী থাকবে। সেজন্যেই মুমিন মুত্তাকী বান্দাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “তাদের আমলের প্রতিদান স্বরূপ তাদের
জন্যে চোখ শীতলকারী যে সব সামগ্রী গোপন রাখা হয়েছে তা কোন প্রাণীই জানেনা।”
(সূরা আস-সাজদাঃ ১৭)
হযরত আবু হোরাইয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত । তিনি
বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “আমি
আমার নেক বান্দাদের জন্যে এমন সব জিনিস প্রস্তুত করে রেখেছি, যা কোন চোখ কখনও দেখেনি, কোন কান তার বর্ণনা কখনও
শোনেনি। আর কোন মানুষ কোন দিন তা ধারণা বা কল্পনাও করতে পারে না।” (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী)
সুতরাং আল্লাহ্ তা'য়ালার পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করার জন্যে পরকালের উত্তম ও অনন্ত
জীবনের অগ্রাধিকার, জান্নাতের নিয়ামত লাভের তীব্র আকাংখা,
সুগভীর আল্লাভীতি, ঈমান ইয়াকীন, উদার মানসিকতা এবং সমাজের অসহায় ও নির্যাতিত মানুষের প্রতি সুতীব্র দরদ,
বেদনাবোধ ও সহানুভূতি থাকা প্রয়োজন ।
আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয়ের
গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি
১মঃ তা সম্পূর্ণ পবিত্র ও হালাল উপায়ে উপার্জিত ধন-সম্পদ থেকে হবে। কুরআনে করীমে
আল্লাহ্ তা'য়ালা তাঁর নবীকে উদ্দেশ্যে
করে বলেছেনঃ “আর আপনি চোখ তোলে ও তাকাবেন না, পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য স্বরূপ ভোগবিলাসের যেসব উপকরণ আমি ইহাদের মধ্যে
বিভিন্ন লোকদের দিয়েছি। এতো আমরা দিয়েছি তাদেরকে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে । আপনার
প্রতিপ প্রতিপালকের দেয়া (হালাল) রিযকই উত্তম ও স্থায়ী)।”(সূরা
ত্বাহাঃ ১৩১)
এ আয়াতে হালাল উপায়ে অর্জিত অর্থ-সম্পদকেই
আল্লাহ্ তা'য়ালার রিযক বলা হয়েছে।
কেননা, তিনি পবিত্র ও হালাল বস্তু ব্যতীত কোন কিছুই গ্রহণ
করেন না। এ প্রসঙ্গে নবী করীম (সাঃ) বলেনঃ “হে লোকেরা
নিশ্চয়ই আল্লাহ্পাক পবিত্র। তিনি শুধু পাক পবিত্র ধন সম্পদই সাদকা হিসেবে গ্রহণ
করেন।” (মুসলিম) সুতরাং যারা অবৈধ উপায়ে ও নাজায়েজ পন্থায়
অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়ে নিজেদের জীবনে জাঁক-জমক ও চাচিক্যের সমাহার করে নেয়,
তাদের প্রতি লোভ করা ঈমান লোকদের কিছুতেই শোভা পায়না-উচিতও নয়।
নিজেদের শ্রম ও মেহনতের বিনিময়ে যে পাক পবিত্র রিযক উপার্জন করা হয় তা পরিমাণে
যত কমই হোক না কেন মুমনি-মুত্তাকি বান্দাদের জন্যে এটাই অধিক উত্তর ও স্থায়ী।
তাতে এমন শান্তি ও কল্যাণ নিহিত থাকে যা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জিন্দেগী পর্যন্ত
পরিব্যাপ্ত ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ “যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুর পরিমাণও দান করে
আল্লাহ্ তা তাঁর ডান হাতে গ্রহণ করেন। অতপর দানকারীর জন্যে তা বাড়াতে থাকেন,
যেভাবে তোমাদের মধ্যে কেউ আপন ঘোড়ার বাচ্চাকে লালন পালন করতে থাকে।
অবশেষে একদিন তা পাহাড় সমতূল্য হয়ে যায়।” (বুখারী ও
মুসলিম)
তবে একথা অত্যন্ত সত্য যে সমাজ বা রাষ্ট্র
ব্যবস্থায় সুদ, ঘুষ, চোরা
কারবার, স্বজনপ্রীতি, জালিয়াতী,
আত্মসাত এরূপ দুর্নীতি ও অপকীর্তিতে পরিপূর্ণ সে সমাজ ব্যবস্থায়
হালাল ও বৈধ উপায়ে আয় উপার্জন করে পবিত্র ও সৎভাবে জীবন যাপন করা সহজ সাধ্য
বিষয় নয়। তাই বলা যায়, কোন মানব সমাজে যদি প্রত্যেকেই
জায়েজ ও বৈধ পন্থায় অর্থ-সম্পদ আয় উপার্জন করে তাহলে সৎ ও সততার সাথে জীবন যাপন
করা সহজ হয়। আর সেজন্যেই আল্লাহ্পাকের নির্দেশঃ “হে
ঈমানদারগণ! তোমরা পরস্পর অবৈধ উপায়ে একে অপরের অর্থ-সম্পদ খেয়ে ফেল না।”
ইসলামী জীবনাদর্শে জায়েজ ও বৈধ উপায়ে রুজী
রোজগার করা একটি অতি বড় ফযীলত ও মর্যাদার বিষয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ (রাঃ)
থেকে বর্ণিত। রাসূলে করীম (সাঃ) বলেনঃ “যে ব্যক্তি মুসলমানদের কোন জনপদে শষ্য নিয়ে আসে এবং সে দিনের বাজার দরে
তা বিক্রয় করে আল্লাহ্ তা'য়ালার নৈকট্য লাভ করবে।”
(ইবনে মারদুইয়া)
২য় মূলনীতিঃ ধন-সম্পদের ভাল ও উৎকৃষ্ট অংশ করা উচিত ।
আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “হে ঈমানদারগণ, যে
অর্থ তোমরা উপার্জন করেছ এবং যা আমি জমি থেকে তোমাদের জন্যে বের করে দিয়েছি তা
থেকে উৎকৃষ্ট অংশ আল্লাহ্র পথে ব্যয় কর।” (সূরা বাকারাঃ
২৬৭)
তিনি আরো বলেনঃ “তোমাদের প্রিয় ও পছন্দনীয় জিনিস (আল্লাহ্র পথে) ব্যয় না
করা পর্যন্ত তোমরা কিছুতেই প্রকৃত কল্যাণ (সূরা আল ইমরানঃ ৯২)
আলোচ্য আয়াতের আলোকে আমরা সামান্য ভেবে
দেখতে পারি, আসলেই কি আমরা আমাদের প্রিয়
ও পছন্দনীয় বস্তু আল্লাহ্ তা'য়ালার পথে ব্যয় করতে পারি?
৩য়ঃ এরপর আল্লাহর পথে অর্থসম্পদ খরচ করার একটি বিশেষ গুরুত্বপুর্ণ মূলনীতি হচ্ছে
যে, কাউকে কিছু দিয়ে দিয়ে নিজের অনুগ্রহের
কথা বলে দান গ্রহীদার মনে কষ্ট দেয়া যাবে না ।
আল্লাহ্পাক বলেনঃ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে
নিজেদের দান-খয়রাতকে সে ব্যক্তির মত বরবাদ করে দিও না, যে
নিছক লোক দেখানোর জন্যে নিজের ধনমাল ব্যয় করে। অথচ সে আল্লাহ্ উপর ঈমান রাখে না
এবং পরকালেও বিশ্বাস করে না।” (সূরা বাকারাঃ ২৬৪)
এ আয়াতটি বিশেষভাবেই ভেবে দেখার মত। সহজ
ভাষায় এটাই বলা যায়, কাউকে কিছু দান
করে যে বলে বেড়ায় মহান আল্লাহ্ এবং আখিরাতের উপর তার যে সুদৃঢ় বিশ্বাস নেই
রিয়াকারীই তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। কেননা, সে আল্লাহ্ তা'য়ালার নিকট থেকে প্রতিদানের কোন আশাই রাখেনা। এমন কি একদিন যে বান্দার
প্রতিটি কাজের অত্যন্ত সূক্ষাতিসূক্ষ হিসেব গ্রহণ করার পর প্রতিফল দান করা হবে তার
উপরও কোন বিশ্বাস নেই। অথচ আমরা যদি সামান্য সচেতনতার সাথে নিজেদের আত্ম সমালোচনা
করি তাহলে এ সত্য অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবেই ধরা পরবে যে, কাউকে
কিছু দেয়ার পর তা প্রকাশ করে দেয়ার মধ্যেই যেন বেশি ফায়দা মনে করা হয় ৷
নবী করীম (সাঃ) বলেছেনঃ “যে লোক দেখানোর জন্যে দান-খয়রাত করে সে শির্ক করল।” (মিশকাত)
সুতরাং আল্লাহ্র পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করার
ক্ষেত্রে লোক দেখানো বা অন্যের প্রশংসা পাওয়ার মনোভাব থাকা উচিত নয়। একমাত্র
আল্লাহ্ তা'য়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের
জন্যেই নেক আমল করা উচিত। তাহলে বান্দার আত্মিক ও নৈতিক বৃত্তির সংশোধন হয়ে
আধ্যাত্মিক প্রশান্তি লাভ সহজ হয়। ফলে সে আল্লাহ্পাকের এতবেশী প্রিয় পাত্র ও
মুহাব্বাতের হয়ে যায় যে, তার আমলনামায় সামান্য কিছু গোনাহ
থাকলে আল্লাহ্ তা মাফ করে দেন। তাই তো তিনি বলেনঃ “যদি
তোমাদের দান সাদ্কাগুলো প্রকাশ্যে কর তাহলে তাও ভাল, তবে
যদি গোপনে অভাবীদের দাও তাহলে তোমাদের জন্যে এটাই অধিক ভাল। এভাবে তোমাদের অনেক
গুনাহ্ নির্মূল হয়ে যায়।” (সূরা বাকারাঃ ২৭১)
তবে যে দান ফরজ যেমন যাকাত, ফিত্রা, উশর এবং আল্লাহ্ তা'য়ালার দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল, ক্লিনিক, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইয়াতিম খানা, মাদ্রসা, মসজিদ,
সমাজকল্যাণ এবং সমাজসেবা মূলক প্রতিষ্ঠান এসবক্ষেত্রে অন্যকে
উৎসাহিত করার জন্যে প্রকাশ্যে দান করাই অধিক ভাল। আর সেজন্যেই আল্লাহ্পাক বলেনঃ
“যারা নিজেদের অর্থ-সম্পদ দিন রাত গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে তার
প্রতিদান রয়েছে তার রবের নিকট এবং তাদের কোন ভয় ও দুঃখ নেই। (সূরা বাকারাঃ ২৭৪)
৪র্থ মূলনীতিঃ হৃদয়ের স্বতঃস্ফুর্ত আবেগ উদ্দীপনা, তাকিদ, আগ্রহ এবং সন্তুষ্টির সাথে আল্লাহ্র পথে
ধন-মাল ব্যয় করতে হবে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই এ আশাও করা যায় যে, অন্তর্যামী আল্লাহ্ তা'য়ালাও একদিন অধিক সন্তুষ্টির
সাথেই তাঁর বান্দাহর প্রতিদান দেবেন। আর সে জন্যে এরূপ সুদৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সাথে
ধন-মাল ব্যয় করা উচিত যা নাকি পরকালেও অনন্ত জীবনে সঞ্চিত মওজুদরূপে পাওয়া যাবে।
তাই তো আল্লাহ্পাক বলেনঃ “তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত দাও আর আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিতে থাক । যাকিছু ভাল ও কল্যাণ তোমরা
নিজেদের জন্যে অগ্রিম পাঠিয়ে দেবে তা আল্লাহ্র নিকট সঞ্চিত মওজুদ রূপে পাবে। এটাই
অতীব উত্তম । আর এর শুভ প্রতিফলও খুব বড় । (সূরা মুজাম্মিলঃ
২০)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত
। তিনি বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ)
জিজ্ঞেস করলেনঃ “তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যার নিজের ধনমাল তার উত্তরাধিকারীর ধনমালের তুলনায় অধিক প্রিয়? সাহাবাগণ বললেন, “হে আল্লাহ্র রাসূল! আমাদের মধ্যে
এমনতো কেউ নেই, যার নিকট তার নিজের ধনমাল তার উত্তরাধিকারীর
ধন-মালের তুলনায় অধিক প্রিয় নয়।” রাসূলে করীম (সাঃ) বললেনঃ
তোমরা চিন্তা-ভাবনা করে বুঝে জবাব দিও। সাহাবাগণ বললেন, আমরা
সত্য কথাই বলতেছি। তখন রাসূলে করীম (সাঃ) বললেনঃ তোমাদের নিজেদের ধনমালতো তাই যা
তোমরা তোমাদের নিজেদেরই পরকালীন কল্যাণের জন্যে অগ্রিম পাঠিয়ে দিয়েছ। আর যা কিছু
তোমরা পিছনে রেখে যাবে তাই তোমাদের উত্তরাধিকারীদের ধন-মাল।” (বুখারী, নাসাঈ, মুসনাদে আবু
ইয়ান)
এ হাদীসে রাসূলে করীম (সাঃ) সাধ্যমত আল্লাহ্
তা'য়ালার পথে ধনমাল দান সদকা করা এবং পরিমিত
খাওয়া পরার মাধ্যমে সম্পদ আগে পাঠানোর কথা বলেছেন । যাতে পরকালে তার দ্বারা
সত্যিকার অর্থেই উপকৃত হওয়া যায় ।
৫ম অর্থাৎ সর্বশেষ মূলনীতি হচ্ছে যে, একমাত্র আল্লাহ্ তা'য়ালার সন্তুষ্টি
এবং তাঁরই কাছ থেকে প্রতিদান লাভের আশায় অত্যন্ত খালেস নিয়তে অর্থ সম্পদ ব্যয়
করতে হবে। কুরআনে করীমে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ভাষায় আল্লাহ্ পাক বলেনঃ “আর যে পবিত্র হবার উদ্দেশ্যে নিজের ধন-মাল দান করে, সে
অতীব পরহেযগার লোককে (ঐ আগুন) থেকে দূরে রাখা হবে। তার উপর কারো এমন কোন অনুগ্রহ
নেই যার বদলা তাকে দিতে হবে। সেতো শুধু তার মহান রবের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে
একাজ করে। অবশ্যই তিনি (তার উপর) সন্তুষ্ট হবেন।” (সূরা লাইলঃ
১৭-২১ )
উপরোক্ত আয়াতে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, যারা মুক্তাকী এবং একমাত্র আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের
আশায় নিজেদের ধন-মাল দান করেন তাদেরকে অবশ্যই জাহান্নামের অতীব ভয়াবহ কঠিন আগুন
থেকে দূরে রাখা হবে। শুধু তাই নয়, দয়াময় আল্লাহ্ তাদের
উপর সন্তুষ্ট হয়ে এমন পুরস্কার দেবেন যার ফলে তারাও সন্তুষ্ট হয়ে যাবে।
এক্ষেত্রে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর বদান্যতা ও হৃদয়ের একান্ত স্বতঃস্ফুর্ত
দানশীলতার অতীব উত্তম দৃষ্টান্ত স্মরণযোগ্য ।
মক্কায় যে সব অসহায় ক্রীত দাসদাসী ইসলাম কবুল
করেছিল এবং এ অপরাধে (?) তাদের মালিকগণ
তাদের উপর অমানবিক অত্যাচার নির্যাতন চালাচ্ছিল। মানবতার দরদী বন্ধু হযরত আবু বকর
সিদ্দীক (রাঃ) তাদেরকে নগদ মূল্যে ক্রয় করে মুক্ত করে দিতেন। এর ফলে অনেক
ক্রীতদাস ও গোলাম প্রভুদের অমানুষিক অত্যাচার ও জুলুম নিপীড়ন থেকে নিস্কৃতি
পাচ্ছিল । ইবনে জরীর ও ইবনে আসাকির হযরত আমের ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাঃ)
থেকে একটি বর্ণনা উদ্বৃত করেছেন। বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, হযরত
আবু বকর (রাঃ) কে দরিদ্র ক্রীতদাস দাসীদের মুক্তির জন্যে উদার হাতে অর্থ সম্পদ
ব্যয় করতে দেখে তাঁর পিতা তাঁকে বললেনঃ হে পুত্ৰ, আমি
দেখতেছি তুমি শুধু দুৰ্বল লাকদেরকে মুক্ত করতেছ। শক্তিশালী দৃঢ় কর্মক্ষম যুবকদের
জন্যে তুমি এ অর্থ য় করতে তবে তারা তোমার শক্তি বৃদ্ধির কারণ হতে পারত। উত্তরে
হযরত বু বকর সিদ্দীক (রাঃ) বললেনঃ আব্বাজান! আমিতো এ কাজের দরুন কমাত্র আল্লাহ্ তা'য়ালার কাছ থেকেই প্রতিদান পেতে চাই ।”
আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়ের
পুরস্কার
আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়ের সবচেয়ে বড়
পুরস্কার হচ্ছে জান্নাত। আল্লাহ্ পাক নিজেই এ ঘোষণা দিয়ে বলেনঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ জান্নাতের বিনিময়ে মু'মিনদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন । (সূরা আত্ তাওবাহঃ ১১১)
এ আয়াতের সঠিক মর্মার্থ অনুধাবন করা বেশ
কঠিন। কেননা, ঈমানের মূল স্পিরিট এ
আয়াতের গভীরেই নিহিত। তাই প্রথমেই প্রশ্ন জাগে, মানুষের জান
ও মালের প্রকৃত মালিক তো আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাহলে এ ক্রয় বিক্রয়ের প্রশ্ন
কেন? তবে আল্লাহ্ তা'য়ালা দুনিয়ার এ
ক্ষণস্থায়ী জীবনে যে জিনিসটি সম্পূর্ণরূপে মানুষকে দান করেছেন তা হচ্ছে, মানুষের ইচ্ছের স্বাধীনতা এবং ক্ষমতা প্রয়োগের ইখতিয়ার। মহান আল্লাহ্
মানুষকে তার জান ও মালের উপর আমানতদার হিসেবে তা ভোগ দখল এবং ব্যয় ব্যবহার করার
সম্পূর্ণ ইখতিয়ার ও দিয়েছেন। সে ইচ্ছা করলে একান্ত অনুগত বান্দাহ হয়ে একমাত্র
আল্লাহ্ পাকের সন্তুষ্টি লঅভের আশায় এ আমানতের সঠিক ব্যয় ব্যবহার করতে পারে অথবা
খিয়ানতও করতে পারে। এর প্রকৃত তাৎপর্য এটাই যে, মানুষের
বিশ্বাস ও আমল এ উভয়য়ের উপর তার নিজস্ব যে আজাদী ও ইখতিয়ার তা আল্লাহ্ তা'য়ালার কাছে বিক্রয় করে দিতে হবে অর্থাৎ একমাত্র তাঁরই মর্জি ও নির্দেশ
অনুযায়ী তা ভোগ ও ব্যয় ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে কেউ যদি ইসলামকে মেনে নিয়ে
নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করে কিন্তু নিজের জান ও ধন মালের নিরংকুশ মালিক যদি
নিজেকেই মনে করে এবং আল্লাহ্ পাকের নির্দেশের বরখেলাপ করে তা ব্যয় ব্যবহার করে
তবে দুনিয়ার জীবনে সে যতই বড় মুমনি রূপে পরিচিত হোক না কেন আল্লাহ্ তা'য়ালার কাছে সে কিছুতেই মুমিন হিসেবে বিবেচিত হবে না। কেননা, যে চুক্তির বিনিময়ে আল্লাহ্পাক তাঁর বান্দাহকে জান্নাতের ওয়াদা করেছেন
ক্রয় বিক্রয়ের সে চুক্তির কাজটিই সে সম্পন্ন করেনি। অথচ কুরআনে করীমের উক্ত
আয়াতে আল্লাহ্ কাজটিই সে সম্পন্ন করেনি। অথচ কুরআনে করীমের উক্ত আয়াতে আল্লাহ্ ও
বান্দার মধ্যে পারস্পরিক ক্রয়-বিক্রয়ের এ চুক্তির কথাই সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে।
প্রকৃত অর্থে এর নামই হচ্ছে ঈমান ।
শুধু তাই নয়, মানুষ যদি আল্লাহ্র দেয়া অর্থ-সম্পদ সত্যিকার আমানতদার হিসেবে তাঁরই পথে
ব্যয় ব্যবহার করে তবে দয়াময় আল্লাহ্ তা নিজের জন্যে ঋণ হিসেবে গ্রহণ করেন যেন
তা কয়েক গুণ বাড়িয়ে ফিরত দিতে পারেন। তিনি বলেনঃ “তোমাদের
মধ্যে এমন কে আছে যে আল্লাকে ‘করযে হাসানা' দিতে প্রস্তুত, যাতে আল্লাহ্ তা কয়েক গুণ বাড়িয়ে
তাকে ফিরত দেবেন এবং তার জন্যে রয়েছে অতীব উত্তর প্রতিদান।” (সূরা হাদীদঃ ১১)
‘করযে হাসানা'র শাব্দিক
অনুবাদ হচ্ছে ‘উত্তম ঋণ' অর্থাৎ খালেস
নিয়তে নিঃস্বার্থভাবে কাউকে কিছু দেয়া। এতে কোন প্রকার রিয়াকারি অথবা সুনাম
সুখ্যাতি অর্জন করার হীন মনোভাব থাকবে না। এমনকি একমাত্র আল্লাহ্ তা'য়ালার সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্য কোন রূপ প্রতিদান ও আশা করা যাবে না । এবং
তা এমন কাজে ব্যয় করতে হবে যা আল্লাহ্পাক পছন্দ করেন । এরূপ উত্তর ঋণ দান
প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা'য়ালা উক্ত আয়াতেই দু'টি ওয়াদা করেছেন । প্রথমত তার অতিরিক্ত নিজের কাছ থেকেও উত্তর প্রতিদান
সওয়াব দান করবেন। সূরা তাগাবুনে দয়াময় আল্লাহ্ এর অতিরিক্ত গুনাহ মাফ করে দেযার
ওয়াদাও করেছেন । তিনি বলেনঃ যদি তোমরা আল্লাহকে 'করযে
হাসানা' দাও তবে তিনি তোমাদেরকে তা কয়েক গুণ বাড়িয়ে ফিরত
দেবেন এবং তোমাদের গুণাহসমূহ মাফ করে দেবেন।” (সূরা তাগাবুনঃ
১৭)
তবে একথা অত্যন্ত সত্য যে, আল্লাহ্ তা'য়ালার পথে অর্থসম্পদ ধন-মাল
ব্যয় করার সঠিক ফযিলত বর্ণনা করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা, যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহ্পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় তাঁরই নির্দেশ
অনুযায়ী ব্যয় করে তাকে বিনিময় দান আল্লাহ্ নিজ দায়িত্বে রেখেছেন। তিনি এরূপ
একটি অতীব উত্তম নেক আমলের প্রতিদান নিজ হাতে এবং নিজের ইচ্ছায় বহুগুণ বাড়িয়ে
দেবেন এটাই স্বাভাবিক ।
আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “যারা নিজেদের ধনমাল আল্লাহ্র পথে খরচ
করে, তাদের এ খরচকে এমন একটি দানার সাথে তুলনা করা হয় যা
যমীনে রোপন করার পর তা থেকে সাতটি ছড়া উৎপন্ন হয় এবং প্রতিটি ছড়ার একশতটি করে
দানা থাকে । এভাবে আল্লাহ্ যাকে চান বহুগুণ পুরস্কার দিতে পারেন। আল্লাহ্ মুক্ত
হস্ত ও মহাজ্ঞানী।” (সূরা বাকারাঃ ২৬১)
অর্থাৎ হৃদয়ের যতবেশী আবেগ উদ্দীপনা গভীর
নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে আল্লাহ্র পথে অর্থ ব্যয় করা হয়, দয়াময় আল্লাহ্ তা'য়ালাও ঠিক ততবেশী
প্রতিদান দিয়ে থাকেন। যে আল্লাহ্ একট বীজ থেকে সাত'শটি
শষ্যকণা উপন্ন করতে পারেন, যিনি এত বিপুল পরিমাণ বরকত দান
করেন তাঁর পক্ষে মানুষের জন্যে দানের ও সাত শো গুণ বাড়িয়ে দেয়া মোটেই কোন
অভাবনীয় ও কঠিন কাজ নয়। এ বাস্তব সত্যটি বর্ণনা করার পর আয়াতের শেষাংশে মহান
আল্লাহ্পাকের দু'টি গুণের কথা বলা হয়েছে। প্রথমত তিনি মুক্ত
হস্ত অর্থাৎ আল্লাহ্ তা'য়ালার হাত কখনোই সংকীর্ণ নয়। মানুষ
যদি আল্লাহ্পাকের নির্দেশ অনুযায়ী একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টি লাভের আশায়
অর্থ-সম্পদ ব্যয় ব্যবহার করে, তবে এমন সব উপায়ে ও পথে
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাকে রিযক দান করেন যা মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। অতপর,
আল্লাহ্পাকের দ্বিতীয় যে গুণটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে
তিনি সর্বজ্ঞ-মহাজ্ঞানী অর্থাৎ আল্লাহ্ কোন বিষয়েই বে-খবর নন। মানুষ যা কিছু
ব্যয় করে এবং যেরূপ মনোভাব, হৃদয়া বেগ ও প্রেরণার সাথে
ব্যয় করে সে সম্পর্কেও তিনি সম্পূর্ণ অবহিত । ফলে মানুষ যথাযথ প্রতিদান ও সওয়াব
লাভে বঞ্চিত হবে এমনটি কখনোও হতে পারে না । আর সেজন্যেই আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ
“আর আল্লাহ্র পথে তোমরা যা কিছুই খরচ কর,
তার পূর্ণ প্রতিদান তোমরা অবশ্যই পাবে । তোমাদের প্রতি কোনরূপ যুলুম
করা হবে না ।” (সূরা আনফালঃ ৬০)
হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি
বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ দানকারী আল্লাহ্ তা'য়ালার নিকটতম, জান্নাতের নিকটতম এবং
মানুষের ও নিকটতম হয়ে থাকে । আর দূরে থাকে জাহান্নাম থেকে। অপর দিকে কৃপণ ব্যক্তি
অবস্থান করে আল্লাহ্ থেকে দূরে, জান্নাত থেকে দূরে, মানুষ থেকে দূরে, জাহান্নামের কাছে। অবশ্য অবশ্যই
একজন জাহেল দাতা একজন বখিল আবেদের তুলনায় আল্লাহ্ তা'য়ালার
কাছে অধিকতর প্রিয়।” (তিরমিযী)
প্রকৃত অর্থেই আল্লাহ্ তা'য়ালার পথে তাঁরই দেয়া অর্থ-সম্পদ এমনি খালে নিয়ত ও আবেগ
উদ্দীপনার সাথে ব্যয় ব্যবহার করা উচিত যার ফলে পরকালীন অনন্ত জীবনে উহার স্থায়ী
ও চিরন্তন প্রতিদান থেকে কিছুতেই বঞ্চিত না হতে
হয়
হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। একবার নবী
করীম (সাঃ)-এর ঘরে একটি বকরী যবাই করে এর গোশত বন্টন করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)
ঘরে এসে জিজ্ঞেস করেনঃ তা থেকে কি অংশ অবশিষ্ট থাকল? হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ একটি রান ব্যতীত আর কিছুই তো নেই। তা শুনে নবী করীম
(সাঃ) বললেনঃ বরং এর একটি রান ব্যতীত আর সবই অবশিষ্ট রয়ে গেছে।” (তিরমিযী)
অর্থাৎ হাদীসটির মর্মকথা হচ্ছে যে পরিমাণ
গোশত আল্লাহ্ তা'য়ালা রাস্তায়
দান করা হয়েছে তার সওয়াব আল্লাহ্র কাছে নির্ধারিত হয়ে গেছে, রানটুকু ছাড়া যা নিজেদের জন্যে রাখা হয়েছে।
অপর একটি হাদীস থেকে জানা যায়, নবী করীম (সাঃ) বলেন “যে ব্যক্তি হালাল
উপার্জন থেকে একটি খেজুর পরিমাণও দান করে (আল্লাহ্ হালাল ব্যতীত গ্রহণ করেন না)
আল্লাহ্ তা'য়ালা তা তাঁর ডান হাতে গ্রহণ করেন। এরপর
দানকারীর জন্যে তিনি তা বাড়াতে থাকেন, যেমন করে তোমাদের
মধ্যে কেউ আপন ঘোড়ার বাচ্চাকে লালন পালন করতে থাকে। অবশেষে একদিন তা পাহাড়
সমতুল্য হয়ে যায় । (বুখারী ও মুসলিম)
অপর একটি হাদীসে আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে
বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলে করীম
(সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ
হে আদম সন্তান, খরচ কর তাহলে তোমার প্রতিও খরচ করা হবে।”-(বুখারী ও মুসলিম)
এ পর্যন্ত আমরা কুরআনে করীম এবং রাসূলুল্লাহ
(সাঃ)-এর হাদীস থেকে আল্লাহ্ তা'য়ালার পথে
অর্থব্যয়ের অসীম সওয়াব ও পুরস্কারের কথা জানতে পেলাম । আরো অনেক আয়াত ও হাদীসে
এ কাজের অশেষ সওয়াব ও ফায়দার কথা বলা হয়েছে। তবে একটি বিষয় অত্যন্ত সুস্পষ্ট
যে, আল্লাহ্র পথে জানমালের কুরবানী দেয়া যদিও সর্বাবস্থায়ই
বিশেষ সওয়াব ও প্রশংসার কাজ কিন্তু সময় ও পরিস্থিতির নাজুকতায় এ আর্থিক ত্যাগ ও
কুরবানীর ও মূল্যায়ন হয়ে থাকে । এমন একটা সময় আসে যখন কুফরী শক্তি অত্যন্ত
প্রবল হয়ে থাকে এবং প্রতি মুহূর্তে ইসলাম ও বাতিলের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত চলতে
থাকে। এমতাবস্থায় দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী জীবনাদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে
জানমালের যে কুরবানী দেয়া হয় তা আল্লাহ্ তা'য়ালার কাঝে
অধিক উত্তম বলেই গণ্য হয় । এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক বলেনঃ “তোমাদের
মধ্যে যারা বিজয়ের পর ব্যয় ও জিহাদ করবে, তারা কখনোই সেসব
লোকদের সমান হতে পারে না, যারা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় ও জিহাদ
করেছে। তাদের মর্যাদা পরে ব্যয় ও জিহাদ' কারীদের তুলনায়
অনেক বেশি ও বিরাট যদি ও আল্লাহ্ উভয়ের কাছের ভাল প্রতিশ্রুতি দান করেছেন।”
(সূরা হাদীদঃ ১০)
নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা'য়ালার পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করা ঈমানদান লোকদের চরিত্রের একটি
অপরিহার্য মৌলিক বৈশিষ্ট্য। সে সাথে তাদের নেক আমল সমূহের মধ্যেও একটি অন্যতম নেক
আমল । তাই তার অসীম প্রতিদান স্বরূপ আল্লাহ্পাকের ঘোষণাঃ “যারা
ঈমান আনে এবং নেক আমল করে তাদেরকে আমরা জান্নাতের সুউচ্চ অট্টালিকাসমূহে থাকতে দেব,
যার নিম্মদেশ থেকে ঝর্ণাধারাসমূহ প্রবাহিত হবে। সেখানে তারা চিরদিনই
থাকবে। আমলকারী লোকদের জন্যে তা কতই না উত্তম প্রতিদান।” (সূরা
আল-কাবুতঃ ৫৮)
ধন-সম্পদ জমা করে রাখার পরিণাম
জান
একথা অত্যন্ত সত্য যে, কোন সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সকল মানুষই যদি হালাল ও বৈধ
উপায়ে এবং আল্লাহ্ তা'য়ালার নির্দেশিত পন্থায় অর্থ সম্পদ
আয় উপার্জন করে তাহলে সে সমাজ বা রাষ্ট্রে ধনী-গরীবের আকাশ পাতাল ফারাক কক্ষনোই
সৃষ্টি হতে পারে না। আবার শুধু মাত্র মহান আল্লাহ্পাকের সন্তোষ অর্জনের লক্ষ্যে
কুরআন ও হাদীসের নির্দেশ অনুযায়ী যদি ধন-সম্পদের ব্যয় ব্যবহার করা হয়, তাহলেও সমাজে অনাকাঙ্খিত অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হতে পারে না। সেজন্যই
হালাল ও বৈধ উপায়ে কেউ যদি কোটিপতিও হয় ইসলাম তার পথে প্রতিবন্ধক নয়। তবে ধন
সম্পদে আয় উপার্জন ও ব্যয় ব্যবহারকে ইসলাম এমনভাবে সংযত করার নির্দেশ দান করে
যার ফলে তা মানুষের নিজের চরিত্রের এবং সমাজের কোন অনিষ্ট ও অকল্যাণের কারণ হতে
পারে না। তাই ইসলামী জীবনাদর্শে মত, জুয়া, জ্বেনা এবং যে কোন প্রকার নেশাজাত দ্রব্য ব্যবহারে অর্থ সম্পদ বিনাশ করা
সম্পূর্ণ রূপে হারাম। কুরআনে করীমের ঘোষণাঃ “হে ঈমানদারগণ!
মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার দেবী ও পাশা
(ভাগ্য নির্ণায়ক বস্তু) এ সবই ঘৃণ্য বস্তু ও শয়তানী কাজ। তোমরা তা পরিহার কর ।
আশা করা যায় যে, তোমরা কল্যাণ লাভ করবে।” (সূরা মায়িদাঃ ৯০)
আয়াতে অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, নৈতিকতার পরিপন্থী যে কোন কাজ করা নিষেধ। তাছাড়া অধিক
ভোগবিলাস করা সোনা রূপার পাত্র ব্যবহার ও জায়েয নয়। মেলা, মিনাবাজার,
বিয়ে-শাদী জন্মদিন এবং বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে দু'হাতে অর্থ-সম্পদ অপচয় এবং অপ্রয়োজনে ধনৈশ্বর্যের জৌলুস দেখানোও উচিত নয়।
আবার ধন-সম্পদ যক্ষের ধনের ন্যায সঞ্চয় ও
জমা করে রাখাও ইসলামে সম্পূর্ণ নিষেধ। আর সেজন্যেই আল্লাহ্ তা'য়ালা মু'মিন লোকদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা
প্রসঙ্গে বলেনঃ “তারা খরচ করল না (অনর্থক খরচ করে, না কৃপণতা করে বরং দুই সীমার মাঝখানে মধ্যম নীতির উপর দাঁড়িয়ে থাকে।”
(সূরা ফুরকানঃ ৬৭)
এ প্রসঙ্গে রাসূলে করীম (সাঃ) বলেনঃ “নিজের অর্থ-সম্পদের ক্ষেত্রে মধ্যমনীতি অবলম্বন করা থেকে
ব্যক্তির বুদ্ধি বিচক্ষণতার পরিচয় ব্যক্তির বুদ্ধি বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া
যায়।” (আহমদ, তাবরানী)
কিন্তু বর্তমান সমাজ কাঠামোর নৈতিক অবক্ষয়, মানবিক মূল্যবোধের বিপর্যয় এবং বুভুক্ষ কংকালসার মানুষের
পাশাপাশি এক শ্রেণীর অর্থলুলোপ মানুষের অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়ার তীব্র আকর্ষণের
মূল কারণ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, ধন-সম্পদ কুক্ষিগত
করে রাখার নিষ্ঠুর পুঁজিবাদী মানসিকতা এবং অকল্পনীয় ভোগবিলাস ও আরাম-আয়াশের
প্রতি অন্ধ মোহ, সংকীর্ণ মানসিকতা ও পরকালের প্রতি অবিশ্বাসই
মূলতঃ এর জন্যে দায়ী । অথচ কুরআনে করীমে যেসব কাজের সবচেয়ে কঠোর ভাষা নিন্দা করা
হয়েছে ধন- সম্পদ পূঞ্জিভুত করে রাখা তার মধ্যে অন্যতম। কেননা, জাহান্নাম সেদিন তাদেরকেই নিজের দিকে ডাকতে থাকবে। আল্লাহ্পাক বলেনঃ
“(জাহান্নাম) ঐ লোককে তার দিকে ডাকতে থাকবে যে (সত্য থেকে)
পালিয়েছে এবং মুখ ফিরিয়েছে আর ধনমাল জমা করেছে, অতপর
আঁকড়িয়ে রেখেছে।” (সূরা মায়ারিজঃ ১৭-১৮)
তাছাড়া, আল্লাহর কুরআন এবং রাসূলে করীম (সাঃ) এর হাদীসের কথা অমান্য করে যারা
অন্যায় ভাবে অর্থসম্পদ জমা করে রাখে তাদের মর্মান্তিক পরিণাম পরিণতি সম্পর্কে
আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “যারা সোনা
রূপা (টাকা-পয়সা, সম্পদ) জমা করে রাখে এবং আল্লাহ্র পথে খরচ
করে না, তাদেরকে অতি পীড়াদায়ক আযাবের সংবাদ দাও। একদিন
অবশ্যই আসবে যখন এ সোনা রূপার উপর জাহান্নামের আগুন উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দিয়েই
সে লোকদের কপাল, পার্শ্বদেশ ও পিঠে দাগ দেয়া হবে। (আর বলা
হবে) এটাই হচ্ছে সে সম্পদ যা তোমরা নিজেদের জন্যে সঞ্চয় করে রেখেছিলে । নাও,
এখন তোমাদের সঞ্চিত সম্পদের স্বাদ গ্রহণ করো।” (সূরা তওবাঃ ৩৪-৩৫)
আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ তোমাদের কারো সঞ্চিত ধন-কিয়ামতের
দিন মাথায় টাক পড়া হিংস অজগর সাপে পরিণত হবে। সে ধন সম্পদের মালিক একে দেখে ভয়ে
পালাতে থাকবে। কিন্তু অজগর তাকে খোঁজ করতে থাকবে আর বলবে, আমি
তোমার সঞ্চিত সম্পদ। নবী (সাঃ) বলেন, আল্লাহ্র কসম তাকে খোঁজ
করতে করতে সাপ যখন তার পিছু ধাওয়া করতে থাকবে সে হাত হাত প্রসারিত করে দেবে। সাপ
সেটাকে নিজের মুখের গ্রাস বানিয়ে নিবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরো বলেন, পশুর মালিক যদি এর হক (যাকাত) আদায় না করে কিয়ামতের দিন পশু দ্বারা সে
আক্রান্ত হবে। পশু নিজের পায়ের ক্ষুর দ্বারা তার মুখে আঁচড় দিতে থাকবে।”
(বুখারী)
সূরা ‘হুমাযাহ' হে আল্লাহ্ তা'য়ালা
এর চেয়েও অধিক কঠোর ভাষায় সমাজের বিত্তবান ও ধনী লোকদের স্বার্থপরতা, ধন-দৌলতের মায়ামোহ লিপ্সা এবং তা জমা করে রাখার নিষ্ঠুর পরিণতির চিত্র
অত্যন্ত হৃদয়-বিদারক ভাবে তুলে ধরেছেন ।
তিনি বলেনঃ “যে লোক ধন-মাল জমা করেছে এব তা গুণে গুণে রেখেছে (তার জন্যও ধ্বংস) সে মনে
করে যে, তার ধনমাল সব সময় তার সাথেই থাকবে। কক্ষনও নয়,
অবশ্যই তাকে এমন জায়গায় ফেলে দেয়া হবে যা (ভেংগে) টুকরা টুকরা
করে । আর তুমি কি জান, সে চূর্ণবিচূর্ণকারী স্থানটি কি?
(সেটা) আল্লাহ্র আগুন, (যাকে) বেশি করে
জ্বালানো হয়েছে, যা দিল পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছবে। নিশ্চয়ই (এ
আগুনকে) তার উপর ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হবে।” (সূরা
হুমাযাহঃ ২-৮)
কুরআনে করীমের অন্য কোন স্থানে জাহান্নামের
আগুনকে “আল্লাহ্র আগুন” বলা
হয়নি। এখানে আল্লাহ্র আগুন বলায় এর মর্মান্তিক এবং প্রাণ বায়ু বের হয়ে যাবার
মত কঠোর আযাবের কথাই প্রকাশ পেয়েছে। সে আগুন শুধু শরীরকেই পুড়ায় না, দিলকে পর্যন্ত জ্বালিয়ে ছাড়ে। সেদিন এ আগুন থেকে বের হবারও কোন সুযোগ
থাকবে না। ঢাকনা দিয়ে আটকে রাখা অবস্থায় আগুনের মধ্যেই। পড়ে থাকতে হবে।
জাহান্নামের এরূপ কঠিন শাস্তির কথা আল্লাহ্ তা'য়ালা প্রকাশ
করেছেন এভাবে যে, “লা ইয়ামুতু ফিহা ওয়ালা ইয়াহইয়া”
অর্থাৎ সে সেখানে মরবেও না, বেঁচেও থাকবে না'
(সূরা ত্বাহাঃ ৭৪, আলাঃ ১৩)
জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে ঝুলে থাকবে। এতে দুঃখ
কষ্ট ও যন্ত্রণার পর্যায়ে পৌঁছে যাবে।
এর চেয়েও বাস্তব সত্য এটা যে, ধন-সম্পদ যক্ষের ধনের ন্যায় কুক্ষিগত করে রাখার এমনি নির্মম
পরিণাম মানুষ শুধু পরকালের অনন্ত জীবনেই ভোগ করবে না। প্রকৃতপক্ষে দুনিয়ার জীবনেই
এর আযাব শুরু হয়ে যায় । প্রথমতঃ ধন-সম্পদ আয় উপার্জনের তীব্র আকাঙ্খা, কামনা বাসনা। অতপর তা হাসিলের জন্য নানা প্রকার চেষ্টা তদবীর, ফিকির ফন্দী বলা যায় দিনের আরামও রাতের ঘুমকে হারাম করেই মানুষ ধন-সম্পদ
নামের সোনার হরিণের পিছনে ছুটতে থাকে । এরপর অর্জিত ধন-সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ
অর্থাৎ হিফাযত করে রাখা এবং তা দ্বিগুণ-চতুর্গুণ বৃদ্ধি করার চিন্তা ভাবনাও এক
ধরণের মানসিক যন্ত্রণা । কেননা, ধন-সম্পদ যে যত পায় তার
চাওয়া পাওয়ার আকাঙ্খা লোভ-লালসাও তত বেড়ে যায়। আবার হঠাৎ কোন দুর্ঘটনায়
সঞ্চিত ধনমাল, যদি কোন ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয় তাহলে মাথায়
আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। পরিশেষে এ অর্থসম্পদ ছেড়ে পৃথিবী থেকে চিরবিদায়ের সময়েও
অনুতাপ, অনুশোচনা, যন্ত্রণার কোন অন্ত
থাকে না। বস্তুত এ সবই একেক ধরণের আযাব। শুধু তাই নয় বাস্তব জীবনেও দেখা যায় যে,
ধন-দৌলতের জন্যে অনেক পরিবারে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনদের
মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহ, সংঘাত-সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়ে শেষ পর্যন্ত
পরস্পরের মধ্যে খুন-খারাবীর ন্যায় অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনাও ঘটে থাকে। এভাবে দেখা
যায় যে, অঢেল অর্থ সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিকে এ পৃথিবীতেই
হাজার বিপদ মুসিবত ও দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয় ।
তাই আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “আর তাদের ধন-মালের
প্রাচুর্য ও সন্তান সন্ততি যেন আপনাকে ধোঁকায় না ফেলে । আল্লাহ্ তো ইচ্ছাই করেছেন
যে, এ সবের দ্বারা তাদেরকে দুনিয়াতেই আযাবের মধ্যে রাখবেন,
এবং তাদের প্রাণ কুফরের অবস্থায় বের হয়ে যাবে।” (সূরা আত্-তাওবাহঃ ৫৫-৮৫)
তিনি আরো বলেনঃ “আর ধনমাল তার কোন কাজে আসবে, যখন সে
ধ্বংস হয়ে যাবে?” (সূরা লাইলঃ ১১)
অর্থাৎ একদিন তাকে অবশ্যই মরতে হবে এবং
পার্থিব জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল প্রকার সুখভোগ, আরাম-আয়েশ, সঞ্চিত ধনমাল এবং যা কিছু সে সারা জীবন
আপ্রাণ চেষ্টা সাধনা করে সংগ্রহ করেছে তার সবই তাকে এখানেই রেখে চলে যেতে হবে এটা
চিরসত্য। পরকালের অনন্ত অসীম জীবনের জন্যে কিছু সংগ্রহ করে সাথে নিয়ে না গেলে
পৃথিবী ভরা সঞ্চিত অর্থ-সম্পদও তার কোন কাজে আসবে না ।
আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ “ভাল ভাবে জেনে নাও, নিশ্চয়ই যারা সত্য প্রত্যাখান করেছে, সমগ্র
দুনিয়ার ধনমালও যদি তাদের করায়ত্ত হয় এবং তার সাথে আরো সমপরিমাণ একত্র করে
দেয়া হয়, আর তারা যদি তা ফিদিয়া হিসেবে দিয়ে কিয়ামত
দিনের আযাব থেকে রক্ষা পেতে চায় তবুও তা তা তাদের কাছে থেকে কবুল করা হবে না।
তারা তীব্র যন্ত্রণাদায়ক আযাব ভোগ করতে বাধ্য হবে।” (সূরা
মায়িদাঃ ৩৬)
আর সে জন্যেই হাশরের ময়দানে দাঁড়িয়ে
অসহায় ও নিঃসীম জীবনে যখন মানুষের বোধদয় হবে তখন চরম আক্ষেপের সাথে বলতে থাকবে-
“হায়! আমার ঐ মৃত্যু (যা দুনিয়ায় হয়েছিল)
তাই যদি আমার শেষ হত । (আজ) আমার ধনমাল আমার কোন কাজে আসল না। আমার সব ক্ষমতা,
কর্তৃত্ব নিঃশেষ হয়ে গেছে। (সূরা হাক্কাহঃ ২৭-২৯)
কিন্তু সেদিন মানুষের চেতনা ও বোধশক্তি
জাগ্রত হলেও কোন লাভ হবে না। আল্লাহ্পাক বলেনঃ “আর ঐ দিন জাহান্নামকে সামনে আনা হবে। সেদিন মানুষ বুঝতে পারবে। কিন্তু তখন
বুঝলেও আর কি (লাভ) হবে? সে (তখন) বলবে, “হায়! আমি যদি আমার এ জীবনের জন্যে আগে কিছু ব্যবস্থা করতাম। ঐ দিন
আল্লাহ্ যে আযাব দেবেন তেমন আযাব আর কেউ দেবে না ।” (সূরা
ফযরঃ ২৩-২৫)
আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয়ে
সাহাবায়ে কিরামদের ভূমিকা
নিঃসন্দেহে, দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে শেষ নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর নেতৃত্বে
সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) গণ জান ও মালের যে কুরবানী পেশ করেছেন এবং আত্মত্যাগের যে
অতুলণীয় অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন দুনিয়ার ইতিহাসে তা অদ্বিতীয়,
নজিরবিহনী । রাসূলে করীম (সাঃ) দুনিয়ার বুকে যে সর্বোত্তম সমাজের
ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) হচ্ছেন সে সমাজের প্রথম নমুনা।
রাসূলে পাকের (সাঃ) সুহবতের বরকতে তাঁরা মহান মানবতার বাস্তবরূপ ধারণ করেছিলেন।
ঈমান, তাকওয়া, আদল, ইহসান, দিয়ানাত এবং খাওফে খোদার তাঁরা ছিলেন মুর্ত
প্রতীক। সাহাবায়ে কিরামদের মধ্যে এ অনুভূতি সদাজাগ্রত ছিল যে, দ্বীন ইসলামের ঝান্ডা সমুন্নত করা এবং মানব জাতির মধ্যে ইনসাফ ও ন্যায়
বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্যেই তাঁদের পৃথিবীতে আগমন। তাঁরা ছিলেন একে অপরের প্রতি
শ্রদ্ধা ও সহানুভূতিশীল । সমাজের নিগৃহীত, গোলাম, দাস, বিত্তহীন, গরীব ও মুহতাজ
শ্রেণীর প্রয়োজন ও চাহিদাকে তারা সব সময় অগ্রাধিকার দিতেন। সর্বোপরি ঈমান,
আল্লাহভীতি, আল্লানুগত্য, আত্মত্যাগ ও সদাচরণ সাহাবায়ে কিরামদে যোগ্যতাকে আলোড়িত করে দিয়েছিল। হক
ও ইনসাফের ব্যাপারে তাঁরা যেমন নিজেদেরকে দায়িত্বশীল মনে করতেন, তেমনি মনে করতেন অন্যদেরকেও। নবী করীম (সাঃ) বলেছেনঃ
“আমার উম্মতের মধ্যে একটি ফিরকাই নিশ্চিত
জান্নাতী হবে। জিজ্ঞেস করা হল তারা কারা? বললেনঃ যারা আমার ও
আমার সাহাবীদের আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে।” (মিশকাত)
রাসূলে করীম (সাঃ) এর সাহাবীদের মধ্যে যারা
মক্কা থেকে হিযরত করে মদীনায় গিয়েছিলেন তাঁরা মুহাজির এবং মদীনায় যাঁরা
মুহাজিরদের সাহায্য সহযোগীতায় এগিয়ে এসেছিলেন তাঁরা আনসার নামে পরিচিত। দ্বীন
ইসলামকে বিজয়ী করার জন্যে জান-মালের কোরবানীর ক্ষেত্রে উভয়ের ভূমিকাই অত্যন্ত
প্রশংসনীয় এবং আমাদের সামনে অনুসরণীয় আদর্শও। আমরা জানি যে, চরম অত্যাচার, নির্যাতন, ঠাট্টা, বিদ্রূপ, উপহাস সহ্য
করে রাসূল (সাঃ) মক্কায় যাদেরকে নিজ হাতে গড়ে তুলেছিলেন তাদের ধন সম্পদের মায়া
মোহ এতটা কমে গিয়েছিল যে, আল্লাহ্র নির্দেশ পাওয়া মাত্র
মাতৃভূমির সকল মায়া ত্যাগ করে মদীনায় হিযরত করতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ
করেননি। এ মুহাজিরদের সম্পর্কেই আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেনঃ 'এ সম্পদ অভাবগ্রস্ত মুহাজিরদের জন্যে যারা নিজেদের ঘরবাড়ী ও
বিত্ত-সম্পত্তি হতে বিতাড়িত ও বহিস্কৃত হয়েছে। তাঁরা আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও
সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ্ও তাঁর রাসুলের সাহায্যের জন্যে সদা প্রস্তুত হয়ে
থাকে। এরাই সত্য পথের পথিক।” (সূরা হাশরঃ ৮)
অপর দিকে মহান আল্লাহ্ তা'য়ালা আনসারদের প্রশংসা করেছেন এভাবে- “মুহাজিরদের
আগমনের পূর্বে যারা এ নগরীতে (মদীনায়) বসবাস করেছেন ও ঈমান এনেছে তারা ভালবাসে সে
লোকদেরকে যারা হিযরত করে তাদের কাছে এসেছে। মুহাজিরদের যাই দেয়া হয় তার জন্যে
তারা অন্তরে আকাঙ্খা পোষণ করে না, আর তারা মুহাজিরদেরকে
নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয় নিজেরা যতই অভাব গ্রস্থ হোব না কেন। (সূরা হাশরঃ ৯)
অনুরূপভাবে সূরা আনফালঃ ৬৪-৭২, সূরা আল ফাত্হঃ ২৯০১৮, সূরা আত তওবাঃ
১০০ আয়াতসহ কুরআন পাকের আরও কিছু আয়াতে কোথাও প্রত্যক্ষভাবে আবার কোথাও পরোক্ষ
ভাবে আনসার ও মাহাজিরদের প্রশংসা করা হয়েছে।
আনসারদের আত্মত্যাগের কিছু
প্রশংসনীয় দৃষ্টান্ত
মুহাজিরগণ হিযরত করে মদীনায় এসে উপস্থিত হলে
আনসারগণ রাসূলে করীম (সাঃ) এর কাছে এসে প্রস্তাব করলেন, আমাদের বাগ-বাগিচা ও খেজুর বাগান আছে । আপনি আমাদের ও মুহাজির
ভাইদের মধ্যে ভাগ করে দিন। নবী করীম (সাঃ) বললেনঃ এ সব লোকেরা বাগ-বাগিচায়
চাষাবাদের কাজ জানে না। তারা যেখান থেকে এসেছে সেখানে বাগ-বাগিচা নেই । এমনকি হতে
পারে না যে, এসব বাগবাগিচায় চাষাবাদের কাজ তোমরা করবে আর তা
থেকে ফসলের অংশ তাদেরকে দেবে? আনসারগণ বললেনঃ আমরা শুনলাম ও
মেনে নিলাম।-(বোখারী, ইবনে জরীর)। এ কথা শুনে মুহাজিরগণ
বললেনঃ এ রকমের ত্যাগ ও ক্ষতি স্বীকার করতে প্রস্তুত লোক আমরা কখনো দেখিনি । এরা
নিজেরাই শ্রম দান করবেন আর ফসলের অংশ আমাদেরকে দেবেন। আমরা তো মনে করি সব সওয়াব
তারাই প্রাপ্ত হবে। রাসূলে করীম (সাঃ) বললেনঃ না, তোমরা
যতক্ষণ পর্যন্ত প্রশংসা করতে থাকবে এবং এদের জন্যে কল্যাণের দোয়া করতে থাকবে
তোমরাও সওয়াব পেতে থাকবে। (আহমদ)
পরে বনু নজীরের অঞ্চল বিজিত হলে রাসূলুল্লাহ
(সাঃ) বললেনঃ এখন একটা বন্দোবস্ত করা যেতে পারে, তোমাদের ধন-সম্পত্তি ও ইহুদীদের পরিত্যক্ত জমি ও খেজুর বাগান একত্রিত করে
তা তোমাদের ও মুহাজিরদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে। তাছাড়া দ্বিতীয় এ উপায় করা
যেতে পারে যে, তোমরা তোমাদের নিজেদের সম্পত্তি নিজেদের হাতেই
রাখবে এবং পরিত্যক্ত জমি জায়গা মুহাজিরদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে। আনসারগণ
বললেন, এ জমি-জায়গাগুলোই আপনি তাঁদের মধ্যে ভাগ করে দিন। আর
আমাদের বিষয় সম্পত্তি থেকেও আপনি যা চান তাঁদের মধ্যে ভাগ করে দিতে পারেন। এ কথা
শুনে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) চিৎকার করে বলে উঠলেনঃ “হে
আনসারগণ! তোমাদেরকে আল্লাহ্ তা'য়ালা অশেষ কল্যাণ দান করুন।”
অতপর বাহরাইন এলাকা যখন ইসলামী রাষ্ট্রের
অন্তর্ভূক্ত হয়, আনসারগণ,
তখনও ঠিক অনুরূপ বদান্যতা ও উদারতার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
রাসূলে করীম (সাঃ) এ এলাকার বিজিত-জমি জায়গা আনসারদেরকেও দিতে চেয়েছিলেন ।
কিন্তু তাঁরা বললেনঃ আমরা তা থেকে কোন অংশ নিব না যতক্ষণ না, ঠিক সম পরিমাণ অংশ আমাদের মুহাজির ভাইদের দেয়া হবে। মুহাজির ও আনসারদের এমনি
অপূর্ব আত্মত্যাগ, পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা এবং ভ্রাতৃত্ববোধের জন্যে আল্লাহ্ তা'য়ালা
তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে বলেনঃ “মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে
যারা সর্বপ্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাঁদের অনুসরণ করে, আল্লাহ্ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও তাতে সন্তুষ্ট এবং তিনি তাদের
জন্যে প্রস্তুত করে রেখেছেন জান্নাত, যার নিম্ন দেশে
ঝর্ণাধারা সতত প্রবহমান । বস্তুত এটাই বিরাট সাফল্য।” (সূরা
আত্-তওবাঃ ১০০)
শুধু তাই নয়, অহীর মাধ্যমে আল্লাহ্ তা'য়ালার নির্দেশ শোনার সাথে
সাথে মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে তা বাস্তব জীবনে আমল করার যে অপূর্ব দৃষ্টান্ত আমরা
দেখতে পাই তা পৃথিবীর ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে ।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, যখন “তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে,
আল্লাকে “করযে হাসানা” দিতে
প্রস্তুত, যাতে আল্লাহ্ তা কয়েক গুণ বাড়িয়ে ফেরত দিতে পারেন।”
(সূরা হাদীদঃ ১১)
এ আয়াতটি নাযিল হয় এবং রাসূলে করীম
(সাঃ)-এর পাক জবান থেকে লোকেরা শুনতে পায় তখন হযরত আবুদ দাহ্দাহ আনসারী নিবেদন
করেনঃ “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহ্ তা'য়ালা কি আমাদের কাছে ঋণ চান? নবী করীম (সাঃ) বললেন,
হে আবুদ দাহদাহ, হাঁ, তিনি
ঋণ চান। সাথে সাথে আবুদ দাদাহ বললেন, আপনি আপনার হাতখানা
আমাকে একটু দেখান তো। হুযুর (সাঃ) নিজের হাতখানি তাঁর দিকে বাড়িয়ে দেন। আসারী
আবুদ দাহ্দাহ রাসূলে করীম (সাঃ)-এর হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললেনঃ
“আমি আমার বাগানখানি আমার খোদাকে ঋণ দিলাম।” হযরত
আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ বলেনঃ সে বাগানটিতে ছয়শত খেজুর গাছ ছিল। এর মধ্যে তাঁর ঘরও
ছিল । তাঁর পরিবার পরিজনও সে ঘরে বসবাস করত । রাসূলে করীম (সাঃ)-এর সাথে এরূপ
কথাবার্তা বলার পর তিনি সোজা নিজের ঘরে গিয়ে উপস্থিত হন এবং স্ত্রীকে ডেকে বলেনঃ
“দাহদাহর মা, ঘর থেকে বের হয়ে আস । আমি এ
বাগানখানা আমার আল্লাকে ঋণ দিয়েছি। “তাঁর স্ত্রী বললেনঃ
দাহদাহর পিতা, তুমি এ কাজ করে খুবই মুনাফার কারবার করেছ।”
অতপর, সাথে সাথে তিনি তাঁর সমস্ত মাল-সামান ও
ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাগান থেকে বের হয়ে য় আসেন।” (ইবনে আবু
হাতিম)
হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, মদীনার আনসারদের মধ্যে আবু তালহা আনসারী (রাঃ) খেজুর বাগানের
কারণে সবচেয়ে বেশী সম্পদশালী ছিলেন । তাঁর সমস্ত সম্পদের মধ্যে “বীরেহাআ” নামের বাগানটি তাঁর কাছে সব চেয়ে বেশী
প্রিয় ছিল । এ বাগানটি মসজিদে নববীর নিটেই ছিল । রাসূলে করীম (সাঃ) সেখানে যাতায়াত
করতেন এবং বাগানের মিঠা পানি পান করতেন। হযরত আনাস (রাঃ) বলেনঃ যখন এ আয়াত নাযিল
হলঃ “তোমাদের প্রিয় এবং পছন্দনীয় বস্তু (আল্লাহ্র পথে) খরচ
না করা পর্যন্ত তোমরা কিছুতেই প্ৰকৃত কল্যাণ লাভ করতে পারবে না।” (সূরা আলে-ইমরানঃ ৯২)
তখন হযরত আবু তালহা আনসারী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ
(সাঃ)-এর কাছে এসে . বললেন, হে আল্লাহ্র
রাসূল! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা'য়ালা আপনার উপর নাযিল করেছেনঃ
“তোমার প্রিয় বস্তু (আল্লাহ্র পথে) খরচ না করা পর্যন্ত তোমরা
কিছুতেই প্রকৃত কল্যাণ লাভ করতে পারবে না।” ‘বীরেহাআ'
নামের বাগানটি আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় সম্পদ। আমি এটা আল্লাহ্ তা'য়ালার জন্যে সাদকা করে দিলাম। এর বিনিময়ে আমি আল্লাহ্র কাছে সওয়াব ও
প্রতিদানের আশা রাখি । ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহ্ তা'য়ালার
মর্জি মাফিক আপনি এটা কাজে লাগান । রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ আচ্ছা, আচ্ছা, এটা তো লাভজনক সম্পদ, এটাতো
লাভজনক সম্পদ। তুমি কি বলেছ আমি তা শুনেছি। এটা তোমার কাছে আত্মীয়দের দেয়াটাই
আমি উপযুক্ত মনে করি। হযরত আবু তালহা (রা) বললেন, আমি তাই
করব হে আল্লাহ্র রাসূল। অতপর হযরত আবু তালহা আনসারী (রাঃ) বাগানটি তাঁর কাছে
আত্মীয় ও চাচাত ভাইদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)
সর্বশেষ দ্বীন ইসলামের জন্যে জানমালের ত্যাগ
ও কোরবানীর ক্ষেত্রে যে দুজন মহান ব্যক্তিত্বের কথা স্মরণ না করলে সমস্ত আলোচনাই
অসমাপ্ত থেকে যাবে তাঁরা হলেন, হযরত
খাদীজাতুল কুবরা (রাঃ) এবং হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)।
আমরা জানি, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর আল্লাহ্ তা'য়ালার অহী
নাযিল হওয়ার ঘটনা শুনে যিনি সর্বপ্রথম ঈমান এনেছিলেন এবং রাসূলে করীম (সাঃ)-কে
নবুওয়াতের স্বীকৃতি দিয়ে সুদৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে গভীর শান্তনার বাণী
শুনিয়েছিলেন তিনিই উন্মুল মুমেনীন হযরত খাদীজা (রাঃ) শুধু তাই নয়, ইসলামী আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে চরম দুর্দিনে যে তিনজন অন্যতম
ব্যক্তিত্ব রাসূল (সাঃ)-কে সার্বিক সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে দ্বীন প্রতিষ্ঠার
ষ্ঠার কাজকে গতিশীল করে তুলেছিলেন তাঁদের মধ্যেও হযরত খাদিজা (রাঃ)-এর ত্যাগ ও
কুরআণী নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে। অপর দু'জন ছিলেন
চাচা আবু তালেব এবং হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)। প্রচুর ধন সম্পদের অধিকারীণী হযরত
খাদীজা (রাঃ) নিঃসম্বল মুহাম্মদ (সাঃ)-কে স্বামী রূপে বরণ করার পর তাঁর সমস্ত
অর্থসম্পদ রাসূল (সাঃ)-এর হাতে সোপর্দ করে দেন। নবুওয়ত প্রাপ্তির পর রাসূলে করীম
(সাঃ) হযরত খাদীজার সমস্ত সম্পদ দ্বীন ইসলামের জন্য ওয়াকফ করে দেন।
নবুওয়াতের সপ্তম বছর মুহাররম মাসে কুরাইশরা
মুসলমানদেরকে বয়কট করে। তাঁরা ‘শিয়াবে
আবু তালিবে' আশ্রয় গ্রহণ করেন। নবী করীম (সাঃ)-এর সাথে হযরত
খাদীজাও সেখানে অন্তরীন হন। প্রায় তিনটি বছর বনী হাশিম নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের মাঝে
অতিবাহিত করে । এ সময়ে কুরাইশদের নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতা এত বেশি চরম পর্যায়ে
পৌঁছেছিল যে, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর মাসুম শিশুদের
আর্তচিৎকারে ও তাদের মনে সামান্য দয়ার সৃষ্টি হত না। খাদ্যাভাবে অনেক সময় গাছের
ডাল ও পাতা খেতে হত। এমনি সংকটময় মুহূর্তে ও উন্মুল মুমেনীন হযরত খাদিজা (রাঃ)
দীর্ঘ তিনটি বছর অন্যান্যদের সাথে চরম ধৈর্য ও নিষ্ঠার সাথে অমানুষিক দুঃখ কষ্ট
সহ্য করেন । অথচ জীবনে কখনো তিনি এরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হননি। নিঃসন্দেহে
আল্লাহ্র দ্বীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ মহিয়সী সংগ্রামী মহিলা আমাদের সামনে এক
স্বর্ণোজ্বল ইতিহাস রেখে গিয়েছেন। আর সেজন্যেই আমরা দেখি যে, নবী করীম (সাঃ) যতদিন বেঁচেছিলেন সবসময়ই হযরত খাদীজা (রাঃ) এর কথা স্মরণ
করেছেন। এমন কি যখনই বিবি খাদীজা (রাঃ) এর কোন না কোন স্মৃতি নবীজি (সাঃ) মনে
পড়তো অথবা তাঁর কোন সখী বা বোনের শব্দ শুনতে পেতেন তখন নবী করীম (সাঃ)-এর সাথে
খাদীজা (রাঃ) এর বোন হালা সাক্ষাৎ করতে আসেন। রাসূল (সাঃ) তাঁর কণ্ঠস্বর শুনেই বলে
উঠেন। “হালা’ এসেছে? নবীজি (সাঃ)-এর মানসপটে তখন প্রিয়তমা স্ত্রী স্মৃতি ভেসে উঠছিল। এ অবস্থা
দেখে হযরত আয়িশা (রাঃ) বলে ফেললেনঃ ‘আপনি একজন বৃদ্ধার কথা
মনে করছেন, যিনি মারা গেছেন । অথচ আল্লাহ্ তাঁর চেয়ে অনেক
উত্তম স্ত্রী আপনাকে দান করেছেন। জবাবে নবী করীম (সাঃ) বললেন, “আল্লাহ্ শপথ, কক্ষনো নয়! আল্লাহ্ তাঁর চেয়ে উত্তর
স্ত্রী আমাকে দান করেননি । খাদীজা (রাঃ) ঐ সময় আমার প্রতি ঈমান এনেছেন যখন সকল
লোক আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছে। তিনি ঐ সময় দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে নিজের ধন-সম্পদ
দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন যখন অন্য কেহ আমাদের ধন-সম্পদ দেয়ার জন্য প্রস্তুত
ছিল না।” একথা নিঃসন্দেহ যে, এটাই
হচ্ছে হযরত খাদীজাতুল কুবরার (রাঃ) সর্বোত্তম মুল্যায়ন ।
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)
নবী করীম (সাঃ)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির সংবাদ
শুনে মক্কার প্রভাবশালী গোত্রপতি এবং ধনী নেতৃবৃন্দরাই সর্বপ্রথম তাঁর বিরোধিতা
করে একমাত্র আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ব্যতীত । বলা যায়, অনেকটা হযরত খাদীজা (রাঃ) এর ন্যায় বিনা দ্বিধায় তিনি
রাসূলে করীম (সাঃ) এর প্রতি ঈমান আনয়ন করেন । নবীজি (সাঃ) যখন নবুওয়াতের প্রথম
ঘোষণা দেন, আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর কাছে তখন চল্লিশ হাজার
দিরহাম ছিল। ইসলামের জন্য তিনি তাঁর সকল সম্পদ ওয়াকফ করে দেন। কুরাইশদের যেসব
দাসদাসী ইসলাম গ্রহণের কারণে নিগৃহীত ও নির্যাতিত হচ্ছিল এ অর্থ দিয়ে তিনি সে সব
দাস-দাসী খরীদ করে আযাদ করে দিতেন। তের বছর পর তিনি যখন হুযুর (সাঃ)-এর সাথে
মদীনায় হিযরত করেন তখন তাঁর কাছে এ অর্থের মাত্র আড়াই হাজার দিরহাম অবশিষ্ট ছিল
। অল্প দিনের মধ্যে তাও তিনি ইসলামের জন্য ব্যয় করেন। হযরত বিলাল, খাব্বাব, আম্মার, আম্মারের মা
সুমাইয়্যা, সুহাইব, আবু ফুকাইহ প্রমুখ
দাস-দাসী হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর অর্থের বিনিময়ে দাসত্বের শৃংখল থেকে
মুক্তি লাভ করেন । তাই পরবর্তীকালে নবী করীম (সাঃ) বলেছেনঃ “আমি
প্রতিটি মানুষের ইহ্সান পরিশোধ করেছি। কিন্তু আবু বকরের (রাঃ) ইসানসমূহ এমন যে,
তা পরিশোধ করতে আমি অক্ষম । তার প্রতিদান আল্লাহ্ দেবেন।
উন্মুল মু'মিনীন হযরত আয়িশা (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দিনে অন্ততঃ একবার আবু বকরের
বাড়ীতে আসতেন। যে দিন হিযরতের অনুমতি পেলেন সেদিন দুপুরে তিনি আমাদের বাড়ীতে
আসলেন। সাধারণতঃ এমন সময় কখনো তিনি আসতেন না। তাকে দেখা মাত্র আবু বকর বলে উঠলেন,
নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে। তা না হলে এমন সময় আল্লাহ্ তা'য়ালা আসতেন না। তিনি ঘরে প্রবেশ করলে আবু বকর তাঁর খাটের এক পাশে সরে
বসলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ তোমার এখানে অন্য যারা আছে তাদেরকে আমার কাছ থেকে
সরিয়ে দাও। আবু বকর বললেনঃ হে আল্লাহ্র রাসূল, আমার দুই
মেয়ে ব্যতীত আর কেউ নেই । আপনার কি হয়েছে? রাসূলুল্লাহ
(সাঃ) বললেনঃ আল্লাহ্ আমাকে হিযরত করার অনুমতি দিয়েছেন। আবু বকর জিজ্ঞেস করলেন,
আমিও কি আপনার সাথে যেতে পারবো? রাসূলুল্লাহ
(সাঃ) বললেনঃ হ্যাঁ, যেতে পারবেন । হযরত আয়িশা (রাঃ) বলেনঃ
সেদিনের আগে আমি জানতাম না যে, মানুষ আনন্দের আতিশয্যের
এতবেশী কাঁদতে পারে। আমি আবু বকরকে সেদিন কাঁদতে দেখেছি। অতপর আবু বকর (রাঃ) বললেনঃ
“হে আল্লাহর রাসূল! এ দেখুন আমি এ উট দুটি এ কাজের জন্যই প্রস্তুত
করে রেখেছি।”
আমরা জানি যে, হিযরতের পর আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) রাসূলে করীম (সাঃ)-এর সাথে সকল অভিযানে
অংশ গ্রহণ করেন। নবম হিজরীর তাবুক অভিযানে তিনি ছিলেন মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহী।
শুধু তাই নয় এ সময় মুসলমানগণ যে ঈমানের পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, স পরীক্ষাতেও তিনি সত্যিকার ভাবেই কৃতকার্য হন। তাবুক অভিযানের জন্য
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ), হযরত উমর (রাঃ), হযরত উসমান (রাঃ) এবং আবদুর রহমান
ইবন আউফ (রাঃ) সহ আরো অনেক প্রখ্যাত সাহাবা স্মরণযোগ্য পরিমাণ অর্থ সম্পদ সাহায্য
করেন। এ সময় আবদুর রহমান আট হাজার দিনার নবী করীম (সাঃ)-এর হাতে তুলে দেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায় যে, আবদুর রহমান ইবন আউফ (রাঃ)
সাহাবাগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু সত্য ন্যায়ের নির্ভীক
সৈনিক হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর আবেদনে সাড়া দিয়ে বাড়ীতে যা
কিছু অর্থসম্পদ ছিল তার সবই তিনি নবী (সাঃ)-এর হাতে তুলে দেন। এ তাবুক অভিযানের
ঘটনারই উল্লেখ করে হযরত উমর (রাঃ) বলেনঃ “একবার নবী করীম
(সাঃ) আমাদের কাছে সাহায্যের আবেদন করেন। সে সময় আমার কাছে অর্থ সম্পদ জমা ছিল
আমি মনে মনে ভাবলাম, 'আজ আমি আবু বকর (রাঃ)-কে পরাজিত করব।
তাঁর চেয়ে বেশি দান করে আজ হার মানাব। এ কথা ভেবে খুব আনন্দের সাথে আমার সমুদয়
মালের অর্ধেক নিয়ে নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে গিয়ে উপস্থিত হলাম । তিনি আমাকে
জিজ্ঞেস করলেন, পরিবারের জন্যে কি রেখে এসেছো? আমি বললাম, কিছু রেখে এসেছি। তিনি আবার বললেন,
কি রেখে এসেছ? আমি বললাম, অর্ধেক রেখে এসেছি। এর পর হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) তাঁর সমস্ত মালামাল
নিয়ে উপস্থিত হলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবু বকর, ঘরে কি রেখে এসেছ? তিনি
বললেন, আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে রেখে এসেছি।”
অতপর হযরত উমর (রাঃ) বললেনঃ “আমি কোন সময়ই দান সাদকায় হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে অতিক্রম
করতে পারিনি।” উপরোক্ত ঘটনা ব্যতীত ও সাহাবাগণের এ
সর্বশ্রেষ্ঠ দলটি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে উসলামের ইতিহাসে
এমন সব অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যা আমাদের কাছে
গল্পের মত মনে হয়। হযরত আনাস (রাঃ) বলেনঃ “আবদুর রহমান ইবন
আউফ হিযরত করে মদীনায় এলে রাসূলে পাক (সাঃ) সা'দ ইবন রাবী'র সাথে তাঁর ভ্রাতৃ সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। সা'দ
ছিলেন মদীনার খাযরাজ গোত্রের নেতা ও ধনাঢ্য ব্যক্তি । তিনি আবদুর রহমানকে বললেন,
আনসারদের সকলে জানে আমি একজন ধনী ব্যক্তি। আমি আমার সকল সম্পদ সমান
দু'ভাগে ভাগ করে দিতে চাই। আমার দু'জন
স্ত্রী ও আছে। আমি চাই, আপনি তাদের দু'জনকে
দেখে একজনকে পছন্দ করুন। আমি তাকে তালাক দেব । অতপর আপনি তাকে বিয়ে করে নেবেন ।
আবদুর রহমান বললেনঃ আল্লাহ্ আপনার পরিজনের মধ্যে বরকত ও কল্যাণ দান করুন। ভাই,
এসব কোন কিছুর প্রয়োজনই নেই। আমাকে শুধু বাজারের পথটি দেখিয়ে দিন।”
নিঃসন্দেহে হযরত সা'দ ইবন রাবী আনসারের এরূপ
আত্মত্যাগ ও কুরবানীর দৃষ্টান্ত মুসলিম উম্মাহ তথা মানব জাতির ইতিহাসে অপূর্ব
অতুলনীয় ।
সমাপ্ত
প্রকাশনায়
প্রফেসর'স প্রকাশনী
১৯১, বড়মগবাজার, ঢাকা-১২১৭
No comments:
Post a Comment
আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।