মধ্যমপন্থা
কী, কেন, কীভাবে
ইউসুফ আল কারজাভি
ভাষান্তরঃ শাইখুল আজম আবরার
প্রকাশকের কথা
ইউসুফ আল কারজাভি।
আজকের দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামি চিন্তাবিদ
ও আলিম। ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির ভারসাম্যপূর্ণ
ব্যাখ্যা প্রদানে তিনি অতুলনীয়। জাহেলিয়াতের নানা চ্যালেঞ্জের মুখে সৃষ্ট সন্দেহ-সংশয় নিরসনে প্রাজ্ঞতার সাথে কাজ করছেন।
১৯২৬ সালে মিশরে জন্ম নেওয়া এই মহান ব্যক্তিত্ব
‘ইখওয়ানুল মুসলিমিন’-এর অন্যতম আধ্যাত্মিক
নেতা। পড়াশোনা করেছেন আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রজীবনেই শিক্ষকদের নিকট হতে ‘আল্লামা’ খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন; লিখেছেন শতাধিক গ্রন্থ। আলিমদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘ইত্তেহাদুল আলামি লি উলামাইল মুসলিমিন’-এর সভাপতি ছিলেন। বিভিন্ন দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। বিশ্ব ইসলামি আন্দোলনের অন্যতম অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন
করে যাচ্ছেন।
অনুবাদক পরিচিতি
শাইখুল আজম আবরার।
জন্ম ও বেড়ে উঠা চট্টগ্রামে। বাংলাদেশের প্রচলিত মাদরাসা-ধারায় পড়াশোনা করেছেন। দাখিল ও আলিম যথাক্রমে ‘দারুল ইরফান একাডেমি’ ও ‘বায়তুশ শরফ মাদ্রাসা’ থেকে শেষ
কছেন। এরপর আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের ফ্যাকাল্টি অফ শারী’আহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ-এর অধীনে হাদিস বিভাগ থেকে অনার্স করেছেন এবং দা’ওয়াহ
বিভাগ থেকে মাস্টার্স করেছেন। বর্তমানে শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। একটি ইংরেজী ভার্সন স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি আইআইইউসি’র হাদিস বিভাগে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। তার মূল আগ্রহের জায়গা শিক্ষকতা, গবেষণা, অনুবাদ, লেখালেখি এবং ইসলামের
সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার লক্ষ্যে দাওয়াহর কাজ করা।
প্রকাশকের কথা
দুই ধরনের প্রান্তিকতার সাথে আমাদের বসবাস। একদিকে চরম বাড়াবাড়ি, অন্যদিকে চরম ছাড়াছাড়ি। বাড়াবাড়ি কিংবা শিথিলতার মাঝামাঝি কোনো অবস্থান কি আদৌ
আছে?
হ্যাঁ, আছে। আরবিতে আমরা এই মধ্যবর্তী অবস্থানের নাম বলছি ওয়াসাতিয়্যাহ; বাংলায়
যার অর্থ হিসেবে আমরা গ্রহণ করেছি ‘মধ্যমপন্থা’। আজকের এই দুনিয়ায় ‘মধ্যমপন্থা’র পাঠ ও চর্চা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়
হয়ে উঠেছে।
এই ছোট্ট পুস্তিকাটিতে চোখ বোলানোর আগে
প্রান্তিকতা ও মধ্যমপন্থা নিয়ে একটা ভাসাভাসা ধারণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। একুশ শতকের আজকের এই সময়ের মুসলিম উম্মাহর অন্যতম শ্রেষ্ঠ
চিন্তক ড. ইউসুফ আল কারজাভির লেখা ‘ওয়াসাতিয়্যাহ’ বইটির বাংলা অনুবাদ সম্পাদনা
করতে গিয়ে বিস্মিত হয়েছি,
অভিভূত হয়েছি।
প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি অনুচ্ছেদ যেন চিন্তা-দুনিয়াকে এক বিরাট ধাক্কা মেরে দেয়!
ইসলামে মধ্যমপন্থার অবস্থান, পরিসীমা
এবং প্রয়োগের প্রেক্ষিত বুঝতে এই গ্রন্থ আপনাকে দারুণ সহযোগিতা করবে, ইনশাআল্লাহ। আজকের এই কঠিন সময়ে মধ্যমপন্থার বোঝাপড়াটা খুব জরুরি। প্রান্তিকতার নামে কোনো বাড়াবাড়ি যেমন অপ্রত্যাশিত, ঠিক
তেমন শিথিলতার নামে বুনিয়াদি ভিত্তিকে ধ্বংস করাটা বোকামি ও অনভিপ্রেত!
মধ্যমপন্থি জাতি হিসেবে এই দুনিয়াকে গড়তে মুসলমানদের দায় ও দায়িত্ব অনেক বেশি।
ওস্তাদ ইউসুফ আল কারজাভির মতো স্কলারের
বইয়ের অনুবাদকর্ম সহজ কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু
আমাদের সব শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে দারুণ অনুবাদ করেছেন তরুণ সাহিত্যিক জনাব শাইখুল
আজম আবরার। সম্মানিত অনুবাদকের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা ও
শুভেচ্ছা। বইটির সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিবাদন।
প্রান্তিকতা মুছে যাক, মধ্যমপন্থা
স্পর্শ করুক প্রতিটা হৃদয়কে।
নূর মোহাম্মাদ আবু তাহের
বাংলাবাজার, ঢাকা
২০ সেপ্টেম্বর, ২০২০
দ্বিতীয় সংস্করণে
কথা
সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য। অজস্র দরুদ ও সালাম আমাদের নেতা, ইমাম, আদর্শ ও
বন্ধু রাসূল-এর জন্য। তাঁর পরিবারের সদস্য, সাহাবিবৃন্দ
এবং তাঁর নির্দেশিত পথে চলা মানুষের প্রতিও দরুদ ও সালাম।
পূর্বের যতগুলো জাতি-গোষ্ঠী ধ্বংসের মুখোমুখি
হয়েছে, তাদের প্রত্যেকেই দুটো পথের যেকোনো একটিকে অনুসরণ করেছে। একটি হলো-গুলু (غُلُوَ)-এর পথ, আর
অন্যটি হলো ইনহিলাল (انجلال)-এর পথ।
গুলু (غُلُوَ) শব্দের মানে হলো-ওয়াজিব বা
কর্তব্য এবং নিষেধাজ্ঞার ব্যাপ্তিকে অপ্রয়োজনীয় ও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বৃদ্ধি করা। আল্লাহ তায়ালা যে রুখসাত বা অবকাশগুলো দিয়েছেন, সেগুলোকে
পাত্তা না দিয়ে আল্লাহর বান্দাদের ওপর কঠোরতা, বাড়াবাড়ি ও কাঠিন্য আরোপ করা
এবং এর মাধ্যমে মানুষকে ঝামেলা আর সমস্যায় ফেলে দেওয়া।
এ কারণে রাসূল সা. বলেছেনঃ
إيَّاكُمْ
وَالْغُلُوَ فِي الدِّينِ فَإِنَّه أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمُ الْخُلُو فِي
الدِّينِ
‘সাবধান! তোমরা গুলু (غُلُوَ) বা বাড়াবাড়ি থেকে বেঁচে থাকো। কারণ, এই বাড়াবাড়ির
বিষয়টিই তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিদের ধ্বংস করেছে।’ ইবনে
মাজাহঃ ৩০২৯
তিনি আরও বলেছেনঃ
‘বাড়াবাড়ি ও কঠোরতা আরোপকারীরা ধ্বংস হয়েছে।’
বিষয়টির গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে রাসূল কথাটি
তিনবার পুনরাবৃত্তি করেছেন!
আর ইনহিলাল (انجلال) শব্দের মানে হলো-আল্লাহ প্রদত্ত আদেশ ও নিষেধাজ্ঞাগুলো অমান্য করে হারামগুলোকে
হালাল সাব্যস্ত করা। ওয়াজিব বা আবশ্যকীয়
কর্তব্যের বিষয়গুলোতে শিথিলতা প্রদর্শন করে আল্লাহ প্রদত্ত সীমাগুলোকে লঙ্ঘন করার
মধ্য দিয়ে বিশৃঙ্খলা,
ছাড়াছাড়ি ও শৈথিল্য প্রদর্শন করা।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সমূহ কল্যাণ নিহিত থাকে
মধ্যমপন্থার মধ্যেই। কারণ, মধ্যমপন্থা
হলো এমন একটি পদ্ধতি,
যেটি বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি এবং কঠোরতা ও শিথিলতা থেকে
মুক্ত। এ ছাড়া পবিত্র কুরআন ও রাসূল-এর সুন্নাহ এ
পথের দিকেই আহ্বান করেছে। এজন্য প্রসিদ্ধ
স্কলারগণও মুসলিম উম্মাহকে এই পথ অবলম্বন করতে উৎসাহিত করেছেন।
বস্তুত মুসলিম উম্মাহর সমূহ সমস্যা থেকে
উত্তরণের অন্যতম পথই হলো ‘ওয়াসাতিয়্যাহ বা মধ্যমপন্থা’।
মূলত এটি আমাদের ওপর আল্লাহ তায়ালার একটি
বিশেষ অনুগ্রহ যে,
তিনি আমাদের মধ্যমপন্থার মতো একটি ধ্রুপদী বা মৌলিক পদ্ধতির
অনুসারী হওয়ার তাওফিক দিয়েছেন। এর ওপর
স্থিরচিত্ত থাকার সামর্থ্য দিয়েছেন।
একটা সময় এই পদ্ধতিটি অনুসরণের কারণে অপবাদ
ও তিরস্কারের সম্মুখীন হতে হতো। কিন্তু
বর্তমানে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে এই পদ্ধতিটি বিভিন্ন কার্যকারণ ও প্রভাব
বিস্তারের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে।
আমি মূলত এই পদ্ধতিটির পরিভাষা ও অর্থ স্পষ্ট
করার নিমিত্তে কথাগুলো লিখতে বসেছি, যেন যে কেউ যাচ্ছেতাইভাবে
পরিভাষাটিকে অপব্যাখ্যা করতে না পারে। বইটির
প্রথম সংস্করণ প্রকাশ করার দায়িত্ব নিয়েছিল কুয়েতের المركز
للوسطية العالمي (আল-মারকাজ আল-আলামি লিল-ওয়াসাতিয়্যাহ) নামক সংস্থাটি। আর সারা বিশ্বের মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে
দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের দায়িত্ব নিল ‘দার আশ-শুরুক’ নামক
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি। নিঃসন্দেহে সমস্ত
প্রশংসা আল্লাহর জন্য বরাদ্দ, যাঁর অনুগ্রহের ওপর ভর করেই ভালো কাজগুলো পূর্ণতা লাভ করে।
আল্লাহর ক্ষমার একান্ত প্রত্যাশী
ইউসুফ আল কারজাভি
ভূমিকা
নির্মল বরকতময় অগণিত প্রশংসা মহান আল্লাহর
জন্য। দরুদ ও সালাম সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মাদ-এর
জন্য-যাকে আল্লাহ তায়ালা বিশ্ববাসীর জন্য দয়া হিসেবে প্রেরণ করেছেন; বিশেষ
করে মুমিনদের জন্য অনুগ্রহ হিসেবে পাঠিয়েছেন। যেমনটি আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
﴿وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً
لِّلْعَالَمِينَ﴾
‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য দয়া হিসেবেই পাঠিয়েছি।’ সূরা আম্বিয়াঃ
১০৭
তিনি আরও বলেনঃ
﴿لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ
إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ
وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن
قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ﴾
‘আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের কাছে তাদের নিজেদের মধ্য
থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন। তিনি
তাদের কাছে আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তাদের পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদের
কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দেন। বস্তুত
তারা ছিল পূর্ব থেকেই পথভ্রষ্ট।’ সূরা আলে ইমরানঃ ১৬৪
পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালা যেন মুহাম্মাদ , তাঁর
পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর দেখানো পথে যারা চলবে, তাদের
ওপর সন্তুষ্ট থাকেন।
এটি আমার ওপর আল্লাহর তরফ থেকে এক বিশেষ
অনুগ্রহ যে, তিনি আমাকে অনেক আগ থেকেই মধ্যমপন্থি চিন্তাধারা এবং এর পদ্ধতি গঠনের দিশা
দিয়েছেন। এটি এমন একটি পদ্ধতি, যেটি
আমার স্বভাব ও বোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ইসলামের স্বচ্ছ উৎস থেকে উৎসারিত
আমার বোঝাপড়ার সাথে সংগতিপূর্ণ।
তা ছাড়া এই পদ্ধতিটি যুগ ও উম্মাহর চাহিদার
সাথেও মানানসই। পাশাপাশি আমরা এমন একটি সময়ে বসবাস করছি-যেখানে
মানুষ একে অন্যের এত কাছাকাছি চলে এসেছে যে, পুরো পৃথিবীটাই একটি ‘গ্লোবাল
ভিলেজ’-এ পরিণত হয়েছে। এই সময়টিতে অন্যান্য
জাতি-গোষ্ঠীর সাথে মুসলিম উম্মাহর সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিটি বেশ
প্রাসঙ্গিক।
উপরন্তু এটি হলো এমন একটি পন্থা, যেটি
ইসলামের প্রকৃত বাস্তবতা ও মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠত্ব ফুটিয়ে তোলে। পাশাপাশি উম্মাহর মধ্যমপন্থি আচরণ এবং মানুষের বিশ্বাসগত ও
সভ্যতাগত স্বরূপকে বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করে।
এই পন্থাটিকে বাস্তবায়ন করতে আমি আমার
সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছি। বক্তব্য ও লেখনীর
মাধ্যমে এ পদ্ধতিটির দিকে নানাভাবে মানুষকে ডেকেছি। যখনই আমি কোথাও কোনো বক্তব্য দিয়েছি, কাউকে ফিকহের কোনো বিষয়ে
জানিয়েছি বা ফতোয়া দিয়েছি, কাউকে কোনো কিছু শিখিয়েছি কিংবা প্রশিক্ষণ দিয়েছি, তখন আমি
এই পদ্ধতিটাই অনুসরণ করেছি।
মানুষের সাথে যোগাযোগের যতগুলো মাধ্যম আমার হাতে ছিল, সবগুলো
মাধ্যমকে উপজীব্য করে আমি মানুষকে মধ্যমপন্থার দিকে ডেকেছি। সেসব মাধ্যমগুলোর অন্যতম কিছু মাধ্যম হলো-মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা
প্রদান করা, ক্লাসরুমে লেকচার দেওয়া, লেখালিখি করা, টিভি চ্যানেল ও ইন্টারনেটে
বিভিন্ন প্রোগ্রাম করা ইত্যাদি।
এই ছোট্ট পুস্তিকাটি আমি মধ্যমপন্থার পরিচয়
ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লিখতে বসেছি, যেন এ ব্যাপারে একটি স্বচ্ছ ও
সঠিক ধারণা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। যাতে করে মুসলিম জীবনের বোধ, কর্ম, আচরণ ও দাওয়াহর কাজের মধ্যে এই মধ্যমপন্থা ঠিকঠাকভাবে
প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
আমি মহান আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে এই
প্রার্থনা করছি,
তিনি যেন মধ্যমপন্থার বৈশিষ্ট্যগুলোকে কুরআন-সুন্নাহ এবং
যুগ-প্রেক্ষাপটের আলোকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা আমার জন্য সহজ করে দেন।
﴿وَمَا تَوْفِيقِي إِلَّا بِاللَّهِ ۚ
عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ أُنِيبُ﴾
‘কেবল আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আমার কোনো সক্ষমতাই নেই। আমি একান্তভাবে তাঁর ওপরই নির্ভর করি এবং তাঁর দিকেই ধাবিত হই।’ সূরা হুদঃ ৮৮
জানুয়ারি, ২০০৭ খ্রি.
আল্লাহর ক্ষমার একান্ত প্রত্যাশী
ইউসুফ আল কারজাভি
অনুবাদকের কথা
মুসলিম চিন্তা ও কাজে আমরা সাধারণত
দ্বিমাত্রিক প্রান্তিকতা খুঁজে পাই; একটি হলো বাড়াবাড়িমূলক
প্রান্তিকতা, অন্যটি হলো শিথিলতামূলক প্রান্তিকতা। এই
দ্বিমাত্রিক প্রান্তিকতার ডামাডোলে আমরা ইসলামের অনন্য স্পিরিটকে নিত্য খুঁইয়ে
বসছি একটু একটু করে। এর পেছনে অনেকগুলো মৌলিক
কারণ আছে। তন্মধ্যে অন্যতম একটি প্রধান কারণ হলো-ইসলামের
একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ‘ওয়াসাতিয়্যাহ’-কে বুঝতে ব্যর্থ হওয়া। বাংলা ভাষাভাষী সাধারণ পাঠককে বোঝানোর সুবিধার্থে আমরা এই
অসাধারণ টার্ম বা পরিভাষাটির অনুবাদ করেছি ‘মধ্যমপন্থা’ হিসেবে। কিন্তু পরিভাষার ক্ষেত্রে একই সঙ্গে মজার কিন্তু ব্রিতকর
বিষয় হলো-একশব্দে কোনো পরিভাষাকে প্রকাশ করার চেষ্টা আর মূষিকের পর্বত প্রসবের
চেষ্টার মধ্যে প্রায় কোনো পার্থক্য নেই বললেই চলে। যার ফলে একেকটি পরিভাষার ওপর গবেষকগণ অতীত ও বর্তমানে স্বতন্ত্র সমানতালে বই
রচনা করে গেছেন এবং যাচ্ছেন।
ভবিষ্যতেও এর ব্যত্যয় হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সম্মানিত পাঠকদের হাতে থাকা এই বইটিও সেই ধারাবাহিকতার ফসল। বইটির মূল রচয়িতাকে অনেকেই চেনেন। অনেকে ভুল প্রোপাগান্ডার কারণে তাঁকে ভুল বোঝেন। আপনিই যেই ধারারই হোন,
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ মুজতাহিদ আলিম ইমামুল
ওয়াসাতিয়্যাহ ড. ইউসুফ আল কারজাভির এই বইটি আপনার চিন্তার জগৎকে একটু হলেও নাড়া
দেবে বলেই আমাদের বিশ্বাস,
ইনশাআল্লাহ।
আপনি কেন বইটি পড়বেন?
প্রথমত, সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে
গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ হলো-সমস্যার সমাধান নিয়ে স্টাডি করা। এই বইটি পড়লে মুসলিম চিন্তা ও কাজের দ্বিমাত্রিক
প্রান্তিকতার অন্যতম একটি সমাধান ‘ওয়াসাতিয়্যাহ’ সম্পর্কে মৌলিক ধারণা পাবেন, ইনশাআল্লাহ।
দ্বিতীয়ত, ইসলাম যে আসলেই একটি মধ্যমপন্থি
দ্বীন এবং এই মধ্যমপন্থার প্রয়োগের ক্ষেত্র ও স্বরূপগুলো কী কী-সে সম্পর্কে একটি
প্রাথমিক ধারণা পাবেন,
ইনশাআল্লাহ।
তৃতীয়ত, Rand Corporation কর্তৃক
বিন্যাসিত শ্রেণি হিসেবে ‘মডারেট’ ও ‘ওয়াসাতিয়্যাহ’-এর মাঝে যে মৌলিক ও
মোটাদাগের পার্থক্য আছে,
বইটি পড়লে আশা করি সেই সম্পর্কেও বিজ্ঞ পাঠকের ধারণা হবে, ইনশাআল্লাহ।
প্রশংসার পুরোটাই সেই মহান রবের জন্য নিবেদন
করছি, যাঁর তাওফিকের পাখায় ভর দিয়ে ভালো কাজগুলো পূর্ণতা পায়। অগণিত দরুদ ও সালাম নিবেদন করছি প্রিয়তম রাসূল-এর জন্য; যাকে
আল্লাহ তায়ালা পুরো বিশ্বের জন্য মধ্যমপন্থার একজন আদর্শ হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন।
প্রতিটি অনুবাদ একজন অনুবাদকের কাছে সন্তানের
মতো, একেকটি অর্জনের মতো। একজন অনুবাদক হিসেবে এই
কাজটি আমার জন্য এক অনন্য অর্জন। তাই
অর্জনটির জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি আমার আম্মুর প্রতি, যার
কাছে আমার দ্বীনের পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়েছিল। এরপর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি আমার আব্বুর প্রতি, যার প্রতিষ্ঠিত অসাধারণ
মাদরাসায় আমার শৈশব-কৈশোরের পড়াশোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। পাশাপাশি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা আমার সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকামণ্ডলীর প্রতি, যাদের
তত্ত্বাবধানের ফলে আমার অনুবাদের দক্ষতা বিকশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। সর্বোপরি যার কথা উল্লেখ না করলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ঝুলি
অপূর্ণাঙ্গ রয়ে যাবে,
তিনি হলেন আমার লিবাস... আমার সহধর্মিণী, যার
প্রত্যক্ষ উৎসাহে আমার অনুবাদ, লেখালিখি ও রিসার্চের কাজ এগিয়ে যায়।
আল্লাহর দয়ার একান্ত প্রত্যাশী
শাইখুল আজম আবরার
হাদিস বিভাগ (অনার্স), দাওয়াহ
বিভাগ (মাস্টার্স)
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম
Shaikhulabrar@gmail.com
সূচিপত্র
মধ্যমপন্থার পরিচয়
t নিখুঁতভাবে ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা প্রণয়নে মানুষের
অক্ষমতা
t বিশ্বব্যাপী ভারসাম্যের নমুনা
t মধ্যমপন্থার বৈশিষ্ট্য ও উপকারিতা
t ইসলামের সাথে সংগতিপূৰ্ণ পন্থা
ইসলামে মধ্যমপন্থা
t বিশ্বাসের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা
t ইবাদতের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা
t নৈতিকতার ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা
t আইন ও বিধানের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা
t ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ ও সমাজবাদিতার মধ্যে সমন্বয়
মধ্যমপন্থার সাথে আমার সম্পর্কের
যোগসূত্র
t মধ্যমপন্থার ওপর আমার নির্ভরতা
t মুসলিম উম্মাহর জন্য মধ্যমপন্থার অপরিহার্যতা
আমার চোখে মধ্যমপন্থার বৈশিষ্ট্য
১. ইসলাম সম্পর্কে
সামগ্রিক বোধ ও উপলব্ধি
২. কুরআন ও সুন্নাহকে তথ্যের
মূল সূত্র হিসেবে গ্রহণ
৩. ঐশী তাৎপর্য ও মূল্যবোধকে
জোরদার
৪. শরিয়াহর স্তরের আলোকে
তাকলিফ
৫. নৈতিক ও চারিত্রিক
মূল্যবোধ
৬. উপযুক্ত ব্যক্তি
দ্বারা যথাযথ স্থানে সংস্কার ও ইজতিহাদ
৭. সুপ্রতিষ্ঠিত বিষয় ও
পরিবর্তনশীল বিষয়ের মাঝে ভারসাম্য স্থাপন
৮. ফতোয়ার ক্ষেত্রে সহজীকরণ
পদ্ধতির অনুসরণ
৯. দাওয়াহর ক্ষেত্রে
ইতিবাচকতার চর্চা
১০. প্রজ্ঞাপূর্ণ
ধারাবাহিকতার চর্চা
১১. পারস্পরিক বিপরীত
বিষয়গুলোর সমন্বয়
১২. শান্তি ও জিহাদ
১৩. ইসলামের অধীনে
ভূমিগুলোকে মুক্ত করার আবশ্যকীয়তা
১৪. ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের
অধিকার সংরক্ষণ
১৫. বিবেক ও
চিন্তা-ভাবনাকে সম্মান
১৬. মানবিক ও সামাজিক
মূল্যবোধ
১৭. নারীদের প্রতি ইনসাফ
এবং সম্মান প্রদর্শন
১৮. পরিবার ও এর বিকাশ
১৯. শাসক বাছাই করার
ক্ষেত্রে জনগণের অধিকার
২০. অর্থনীতিকে শক্তিশালী
ভিত্তির ওপর নির্মাণ
২১. ইসলামি উম্মাহ, একতা ও উম্মাহর জন্য ভালোবাসা
২২. বহুত্ববাদ ও
বৈচিত্র্যকে স্বীকার
২৩. তাকফির ও তাফসিক থেকে
বিরত থাকা
২৪ বিশ্বজুড়ে মুসলিম
সংখ্যালঘু
২৫. পৃথিবীর বিনির্মাণ, উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ
২৬. সংস্কার ও পরিবর্তনের
প্রয়োজনীয়তা
২৭. সব শক্তি ও
আন্দোলনসমূহকে এক প্ল্যাটফরমে আনা
২৮. নয়া ফিকহর দিকে
আহ্বান
২৯. সভ্যতায় মুসলিম
উম্মাহর অর্জন
৩০. ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্যের
মধ্যে ভালোগুলো থেকে উপকৃত হওয়া
একনজরে মধ্যমপন্থার বৈশিষ্ট্য
মধ্যমপন্থার
পরিচয়
ইসলামের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি
গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো মধ্যমপন্থা। আর এই
পন্থার পরিচয়, বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি নিয়ে আমি আমার الخصائص
العامة للإسلام (ইসলামের অনন্য বৈশিষ্ট্যসমূহ) নামক বইতে অনেক আগেই আলোচনা
করেছি।
এ ছাড়া পরিভাষাটিকে ভারসাম্য রক্ষা করা (التوازن) এবং ন্যায্যতা রক্ষা করা (الاعتدال) হিসেবেও অভিহিত করা হয়।
আমরা এখানে বোঝাতে চেয়েছি-দুটো বিপরীতমুখী
প্রান্তিকতার কোনো একটির দিকে ঝুঁকে না গিয়ে ন্যায্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, যেন
দুটোর কোনো একটি প্রান্ত তার প্রাপ্যের চেয়ে বেশি না পায় এবং অন্য প্রান্তের ওপর
কর্তৃত্ব খাটিয়ে অত্যাচার করতে না পারে।
এখন পরস্পর বিপরীতমুখী প্রান্তিকতার কিছু
নমুনা হলো-আল্লাহর অধিকার বনাম বান্দার অধিকার (রব্বানিয়্যাহ বনাম ইনসানিয়্যাহ), আধ্যাত্মিকতা
বনাম জাগতিকতা, আখিরাত বনাম দুনিয়া,
ওহি (প্রত্যাদেশ) বনাম আকল (যুক্তি/বুদ্ধিবৃত্তি), অতীত
বনাম বর্তমান, ব্যষ্টিক বনাম সামষ্টিক, আদর্শ (Ideal) বনাম বাস্তবতা (Real), পরিবর্তনশীলতা
বনাম অপরিবর্তনশীলতা প্রভৃতি।
ওপরের পরস্পর বিপরীতার্থক প্রান্তিক
বিষয়গুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা বলতে বোঝানো হচ্ছে-প্রতিটি প্রান্তকে তার
জায়গায় ঠিকঠাক রেখে প্রত্যেকের প্রাপ্য ও অধিকারগুলোকে ন্যায্যতা ও যথার্থতার
মাধ্যমে প্রদান করা। এই
বিষয়টি যথাক্রমে সূরা আল ইসরার ৩৫ ও সূরা আশ-শুআরার ১৮২ নং আয়াতে উল্লেখিত
হয়েছে। এতে কোনো ধরনের জুলুম বা কমতি, বাড়াবাড়ি
বা ছাড়াছাড়ি করা যাবে না।
পাশাপাশি গোঁড়ামি কিংবা শৈথিল্যও দেখানো যাবে না। এ দিকটা ইঙ্গিত করে কুরআন বলছেঃ
﴿وَالسَّمَاءَ رَفَعَهَا وَوَضَعَ
الْمِيزَانَ﴾﴿أَلَّا تَطْغَوْا فِي الْمِيزَانِ﴾﴿وَأَقِيمُوا الْوَزْنَ
بِالْقِسْطِ وَلَا تُخْسِرُوا الْمِيزَانَ﴾
‘আর আসমান; তাকে তিনি করেছেন সমুন্নত এবং ভারসাম্যের জন্য স্থাপন করেছেন একটি মিজান বা
ভারসাম্যদণ্ড, যেন তোমরা মিজান বা ভারসাম্যের মধ্যে বাড়াবাড়ি না করো। অতএব, তোমরা ন্যায্যতার মাধ্যমে ভারসাম্য রক্ষা করো, আর ভারসাম্যের মধ্যে কমতি করো না।’ সূরা আর-রাহমানঃ ৭-৯
অর্থাৎ কোনো ধরনের কমানো-বাড়ানো ছাড়াই
ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভারসাম্য রক্ষা করার নাম হলো মধ্যমপন্থা বা ওয়াসাতিয়্যাহ।
নিখুঁতভাবে
ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা প্রণয়নে মানুষের অক্ষমতা
নিখুঁতভাবে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি
মানুষের সক্ষমতার বাইরে। কারণ, মানুষের
বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞান সীমাবদ্ধ।
পাশাপাশি মানুষ তার প্রবৃত্তিগত চাহিদার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতেও অক্ষম। উপরন্তু তার ওপর ব্যক্তিগত, সামষ্টিক, দলীয়, আঞ্চলিক
ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ প্রভাব বিস্তার করে আছে; সেটা সে বুঝুক বা না বুঝুক।
ব্যক্তিগত বা সামষ্টিকভাবে মানবরচিত কোনো
পদ্ধতি বা পন্থা বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ি থেকে মুক্ত নয়; যেমনটা
বাস্তবতা ও ইতিহাস পর্যালোচনা করলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
এক আল্লাহই প্রতিটি বস্তুকে তার অধিকার
যথাযথভাবে দিতে পারেন;
চাই সেটি বস্তুগত হোক কিংবা আধ্যাত্মিক। তিনিই সেই সত্তা, যিনি প্রতিটি জিনিসকে পরিমিত ও
যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন। কোনো বিষয়ই তাঁর
জ্ঞানের বাইরে নয়। প্রতিটি বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব তিনি
রাখেন। তিনি তাঁর দয়া ও জ্ঞানকে প্রতিটি জিনিসের
ওপর বিছিয়ে রেখেছেন।
ফলে আল্লাহর সব সৃষ্টি ও কাজে এই ধরনের
সূক্ষ্ম ভারসাম্য দেখতে পাওয়াটা মোটেই বিচিত্র কোনো বিষয় নয়। কারণ, তিনি সমস্ত সৃষ্টি ও কাজের অধিকর্তা। আল্লাহর আদেশ এবং তাঁর প্রদত্ত সঠিক পথ ও সত্য দ্বীন ইসলামি জীবনব্যবস্থা ও
পদ্ধতির মধ্যে এই ভারসাম্যের প্রকাশ ঘটে।
একইভাবে আমরা আল্লাহর তৈরি মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে সেই ভারসাম্যের নমুনা দেখতে পাই, যে
মহাবিশ্বের সবকিছুই তিনি নিখুঁত করে সৃষ্টি করেছেন।
বিশ্বব্যাপী
ভারসাম্যের নমুনা
পৃথিবীর চারপাশে তাকালে আমরা রাত-দিন, আলো-আঁধার, ঠান্ডা-গরম, ভেজা-শুকনো
এবং নানা ধরনের গ্যাসসহ প্রভৃতি জিনিস দেখতে পাই। প্রতিটি উপাদানই পরিমিত, ভারসাম্যপূর্ণ ও নির্ধারিত। একটি উপাদান নিজ গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে তার বিপরীত অক্ষের উপাদানের সাথে
ধাক্কাধাক্কি ও ঠ্যালাঠেলি করে না।
তেমনিভাবে চন্দ্র-সূর্যসহ মহাবিশ্বে আল্লাহর
যত সৃষ্টি আছে, সবকিছুই মহাশূন্যে নিজ নিজ কক্ষপথে অবিরত চলমান। সেগুলোর কোনো একটিও নিজের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আরেকটির সাথে অপ্রয়োজনীয়
সংঘর্ষে লিপ্ত হয় না।
আর মহান আল্লাহ এ সম্পর্কে সত্যই বলেছেনঃ
﴿إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ﴾
‘নিশ্চয়ই আমি সমস্ত জিনিসকেই সুনির্দিষ্ট পরিমাণে সৃষ্টি করেছি।’ সূরা ক্বামারঃ ৪৯
﴿ مَّا تَرَىٰ فِي خَلْقِ الرَّحْمَٰنِ مِن
تَفَاوُتٍ ﴾
‘তুমি পরম করুণাময় সত্তার সৃষ্টির মাঝে কোনো খুঁতই দেখতে পাবে না।’ সূরা মুলকঃ ৩
﴿لَا الشَّمْسُ يَنبَغِي لَهَا أَن تُدْرِكَ
الْقَمَرَ وَلَا اللَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ ۚ وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ﴾
‘সূর্যের এই ক্ষমতা নেই যে সে চাঁদের নাগাল পাবে। আর রাতেরও এই ক্ষমতা নেই যে সে দিনকে ডিঙিয়ে আগে চলে যাবে। বস্তুত এদের প্রত্যেকেই তার নিজস্ব কক্ষপথে পরিভ্রমণ করছে।’ সূরা ইয়াসিনঃ ৪০
আর মুসলিম উম্মাহর কাছে ইসলাম চায়, সে যেন
মহাবৈশ্বিক এই ভারসাম্যকে তার জীবন, চিন্তা ও পদ্ধতিতে প্রতিফলিত করে। যাতে করে মুসলিম উম্মাহ অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর তুলনায়
বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও স্বতন্ত্র হতে পারে।
তাই আল্লাহ তায়ালা এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের
দিকে ইঙ্গিত করে মুসলিম উম্মাহকে উদ্দেশ্য করে বলেছেনঃ
﴿وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا
لِّتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا﴾
‘আর এভাবেই আমি তোমাদের একটি মধ্যমপন্থি উম্মাহ বানিয়েছি, যেন
তোমরা পৃথিবীর অন্য মানুষদের ওপর সাক্ষী হয়ে থাকতে পারো এবং রাসূল যেন তোমাদের
ওপর সাক্ষী হয়ে থাকতে পারেন।’ সূরা বাকারাঃ ১৪৩
মুসলিম উম্মাহকে তার পদ্ধতি ও ব্যবস্থাগত
মধ্যমপন্থার কারণেই মধ্যমপন্থি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ, এটি মধ্যমপন্থি একটি জাতির জন্য মধ্যমপন্থি একটি পদ্ধতি। এটি এমন একটি পদ্ধতি,
যে পদ্ধতিটি যেকোনো ধরনের বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ি ও
কঠোরতা-শিথিলতা থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ।
মধ্যমপন্থার
বৈশিষ্ট্য ও উপকারিতা
এটি মহান আল্লাহর একটি প্রজ্ঞাপূর্ণ
সিদ্ধান্ত যে, তিনি সর্বশেষ উম্মাহর জন্য মধ্যমপন্থাকে একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ও নিদর্শন
হিসেবে বাছাই করেছেন। পাশাপাশি মধ্যমপন্থাকে এমন
একটি রিসালাহর জন্য বাছাই করেছেন, যেটি মূলত সর্বশেষ রিসালাহ। আর এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর বার্তা প্রেরণের পরিসমাপ্তি টেনেছেন এবং সেই
সর্বশেষ রিসালাহ দিয়েই সর্বশেষ নবিকে প্রেরণ করেছেন।
ইসলামের সাথে
সংগতিপূৰ্ণ পন্থা
সাময়িক রিসালাহগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, একটি
প্রান্তিক সমস্যাকে তার বিপরীত প্রান্তিকতা দিয়ে সমাধান করা। যেমনঃ বাস্তববাদ (Realism)
প্রচারের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি প্রকাশিত হলে সেটিকে ঠিক তার
বিপরীত প্রান্তিকতা আদর্শবাদ (Idealism) দিয়ে ঠেকানো। বস্তুবাদ (Materialism)-এর বাড়াবাড়িকে ঠিক তার
বিপরীতে থাকা আধ্যাত্মিক (Spirituality)
প্রান্তিকতা দিয়ে সমাধান করা। যেমনটা আমরা ইহুদি-রোমান ধর্ম বনাম খ্রিষ্টান ধর্মের মধ্যে দেখতে পাই। ইহুদি ও রোমানদের বস্তুবাদ ও বাস্তববাদের বাড়াবাড়িকে
খ্রিষ্টান ধর্মে আধ্যাত্মিক ও আদর্শবাদের বাড়াবাড়ি ও প্রান্তিকতা দিয়ে সমাধান
করা হয়েছিল। একটা সময়ে এসে সাময়িক রিসালাহগুলো এমন চরম
অবস্থানে পৌঁছাল যে,
একটি বাড়াবাড়ির সমাধানে অন্য একটি বাড়াবাড়িকে একমাত্র
মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। এমন
বিশৃঙ্খল অবস্থায় এই বাড়াবাড়ির মাঝখানে একটি সহজ-সরল মধ্যমপন্থার প্রয়োজনীয়তা
প্রকটভাবে দেখা দেয়;
যার মাধ্যমে সত্যিকারের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। আর এই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখেই চিরস্থায়ী ও বিশ্বজনীন
ইসলামের আগমন ঘটে।
এ ছাড়াও মধ্যমপন্থার মধ্যে এমন অনেক অর্থ
নিহিত আছে, যা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহকে আলাদাভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে এবং সেইসঙ্গে
মুসলিম উম্মাহকে নেতৃত্ব ও স্থায়িত্বের জন্য যোগ্য করে তোলে।
১. ন্যায্যতা
মধ্যমপন্থার একটি অন্যতম অর্থ হলো-আদল তথা
ন্যায্যতা। ন্যায্যতা হলো এমন একটি গুণ, যেটি
দিয়ে কুরআনের মধ্যে মুসলিম উম্মাহকে বিশেষভাবে গুণান্বিত করা হয়েছে। আর এই গুণটির কারণেই সমগ্র মানবজাতির ওপর এই উম্মাহকে
সাক্ষী বানানো হয়েছে। কারণ, একজন
সাক্ষ্যদাতার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো আদল বা ন্যায্যতা। অতএব, কোনো সাক্ষ্যদাতার ভেতর যদি আদল বা ন্যায্যতার গুণ
অনুপস্থিত থাকে,
তাহলে তার সাক্ষ্য অগ্রহণযোগ্য ও প্রত্যাখ্যাত হিসেবে
বিবেচিত হবে। অন্যদিকে একজন ন্যায়নিষ্ঠ সাক্ষ্যদাতা এবং
একটি ন্যায়পরায়ণ বিচার সব মানুষের কাছেই সমানভাবে গ্রহণযোগ্য ও প্রত্যাশিত।
আয়াতে ‘আল-ওয়াসাত (الوسط)’ শব্দের ব্যাখ্যা আদল বা ন্যায্যতা দিয়ে করাটা আল্লাহর রাসূল-এর হাদিস দিয়ে
সাব্যস্ত করা হয়েছে। যেমনটা আবু সাইদ খুদরি
থেকে ইমাম আহমাদ ও ইমাম বুখারি তাঁদের স্ব-স্ব হাদিস গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। রাসূল ‘আল-ওয়াসাত’ (الوسط) শব্দের ব্যাখ্যা আদল বা ন্যায্যতা দিয়ে করেছেন।১ আল আদল (العدل), আত-তাওয়াসুত (التوسط), আত-তাওয়াজুন (التوازن) শব্দগুলো অর্থের দিক থেকে প্রায় কাছাকাছি। প্রকৃতপক্ষে আল আদল (العدل) মানে হলো, বিবাদমান
দুটো প্ৰান্ত বা পরস্পরবিরোধী একাধিক প্রান্তের মধ্যে কোনো একটির দিকে না ঝুঁকে
মাঝামাঝি অবস্থান করা। অন্যভাবে বলা যায়, বিভিন্ন
প্রান্তগুলোকে যথাযথ তুলনা করার মাধ্যমে কোনো ধরনের অন্যায়, কমতি ও
পক্ষপাতিত্ব ব্যতীত প্রত্যেককে তার প্রাপ্য ঠিকঠাকভাবে বুঝিয়ে দেওয়া।
যেমনটা কবি জুহাইর প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেনঃ
همو
وسط يرضى الأنام بحكمهم
إذا
نزلت إحدى الليالي العظائم
‘যদি কখনো বিপদ তাদের ঘাড়ে নিশ্বাস ফুঁকে
তারা ন্যায়নিষ্ঠ (ওয়াসাত), বিচারে তাদের জগৎ খুশি থাকে।’
কবি তাঁর কবিতায় তাদের ন্যায়নিষ্ঠতা ও
নিরপেক্ষতার গুণে গুণান্বিত করেছেন।
মুফাসসিরগণ ﴿قَالَ أَوْسَطُهُمْ
أَلَمْ أَقُل لَّكُمْ لَوْلَا تُسَبِّحُونَ﴾ (সূরা আল ক্বলমঃ ২৮) আয়াতে
আওসাতুহুম (أَوْسَطُهُمْ)-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, তারা
সবচেয়ে বেশি ন্যায়নিষ্ঠ।২ ইমাম রাজি তাঁর তাফসিরে এটিকে তাগিদ দিয়েছেন এবং বলেছেনঃ
‘কোনো একটি বস্তুর সবচেয়ে উপযুক্ত ও ন্যায্য অংশটি হলো তার মধ্যভাগ। কারণ, কোনো বস্তুর মাঝখানের অংশটি সব পাশ থেকেই সমান ও
ভারসাম্যপূর্ণ।৩
তাফসির স্কলার আবু আস-সাউদ বলেছেনঃ
“আল-ওয়াসাত হলো মূলত এমন বিষয়-যাকে প্রান্তিক বিষয়গুলো স্পর্শ করতে পারে না। যেমনঃ বৃত্তের কেন্দ্ৰ।’
এ ছাড়াও শব্দটিকে রূপকভাবে মানবীয় ভালো
আচরণ অর্থে ব্যবহার করা হয়। কারণ, বাড়াবাড়ি
বা শৈথিল্যের কারণে সৃষ্ট খারাপ আচরণগুলোর চাইতে ভালো আচরণগুলো মাঝামাঝিতে অবস্থান
করে।৪
ফলে আল-ওয়াসাত শব্দের অর্থ হলো-‘ন্যায়নিষ্ঠতা
ও মধ্যমপন্থা’। অন্যভাবে বললে এর অর্থ হলো কঠোরতা ও শিথিলতার দিকে না ঝুঁকে
ন্যায্য ও ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া।
২. সঠিকতা বা
স্থিরতা
ওয়াসাতিয়্যাহ-এর আরেকটি অর্থ হলো সঠিক পথে
স্থির থাকা, ঝোঁক ও বিচ্যুতি থেকে দূরে থাকা। আর
সঠিক পথ বা পদ্ধতির মানে হলো আল কুরআন যেমনটা বলছেঃ الصِّرَاطَ
الْمُسْتَقِيمَ। এই অংশটির ব্যাখ্যা করতে
গিয়ে একজন তাফসিরকারক বলেছেনঃ
‘এটি হলো সেই সঠিক ও সোজা পথ, যেটি সরল পথ থেকে বিচ্যুত
ও সীমালঙ্ঘনকৃত বিভিন্ন বক্র পথের মাঝখানে অবস্থান করে।’
আমরা যদি ধরে নিই, পরস্পর
বিপরীত প্রান্তে অবস্থিত দুটো বিন্দুতে অনেকগুলো রেখা মিলিত হচ্ছে, তাহলে
দেখা যাবে, এসব মিলিত হওয়া রেখাগুলোর মধ্যে সেই রেখাটি সরল ও সোজা-যেটি অন্যান্য বক্র
রেখাগুলোর মাঝখান বরাবর সোজা গিয়ে বিপরীতে থাকা অপর প্রান্তের বিন্দুতে মিলিত
হয়েছে।
ঠিক একইভাবে সরল-সঠিক পথটিও এমন পথগুলোর মাঝ
বরাবর হওয়াটা বাঞ্ছনীয়-যেগুলো সীমালঙ্ঘন করেছে। যাতে করে সঠিক পথ অনুসরণকারী উম্মাহ বা জাতি বক্র পথের অনুসরণ করা জাতিগুলোর
ঠিক মাঝামাঝি সোজা ও সরল অবস্থায় অবস্থান করতে পারে।৫
আর এ কারণেই ইসলাম মুসলিমদের প্রতিদিন
ন্যূনতম ১৭ বার আল্লাহর কাছে সিরাতুল মুস্তাকিম বা সরল-সঠিক পথ প্রদর্শন চাওয়া
শিখিয়েছে। এখানে উল্লিখিত ১৭ সংখ্যাটি মূলত দৈনিক পাঁচ
ওয়াক্ত ফরজ নামাজের রাকাত সংখ্যা। আর এই
অসাধারণ ব্যাপারটি তখনই ঘটে, যখন আমরা নামাজে সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত করি। সূরাটি তিলাওয়াত করতে গিয়ে আমরা বলিঃ
‘আমাদের সরল-সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। এটি
সেই পথ, যে পথ আপনি অভিশপ্ত ও পথভ্রান্তদের ব্যতীত অন্যদের অনুগ্রহ করে দান করেছেন।’ সূরা ফাতিহাঃ ৬-৭
আর ইসলামই কেবল এই অনন্য বৈশিষ্ট্য
মধ্যমপন্থাকে ধারণ করেছে। এ ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম
বা সম্প্রদায় এই বৈশিষ্ট্যটি অর্জন করতে পারেনি।
হাদিস দিয়ে ব্যাখ্যা করা বিভিন্ন তাফসির
গ্রন্থে অভিশপ্ত শব্দটি দিয়ে ইহুদি এবং পথভ্রষ্ট শব্দটি দিয়ে খ্রিষ্টানদের আখ্যা
দেওয়া হয়েছে।৬
আর এভাবে আখ্যা দেওয়ার কারণ হলো, ইহুদি ও
খ্রিষ্টানরা অধিকাংশ বিষয়ে যথাক্রমে বাড়াবাড়ি ও শৈথিল্য প্রদর্শন করত। যেমনঃ ইহুদিরা নবিদের হত্যা করেছিল, আর
খ্রিষ্টানরা নবিদের খোদা বানিয়েছিল।
ইহুদিরা হারামের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করেছিল, আর খ্রিষ্টানরা হালালের ক্ষেত্রে
বাড়াবাড়ি করেছিল।
যেমনঃ তারা বলে বেড়াত-পবিত্র মানুষদের জন্য
সবকিছুই পবিত্র। ইহুদিগণ বৈষয়িক বিষয়ের ক্ষেত্রে গোঁড়ামি
করেছিল, আর খ্রিষ্টানরা বৈষয়িক ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রদর্শন করেছিল। ইহুদিরা ধর্মীয় আচার ও ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রথাকে খুব
উগ্রভাবে পালন করত,
আর খ্রিষ্টানরা আচার আর ইবাদতের ক্ষেত্রে চরম শৈথিল্য
প্রদর্শন করত।
এক্ষেত্রে ইসলাম মুসলিমদের উভয় ধরনের
বাড়াবাড়ি থেকে সতর্ক থাকতে শিক্ষা দিয়েছে। আর মধ্যমপন্থাকে অর্থাৎ সরল-সঠিক পথকে আঁকড়ে ধরতে উৎসাহিত করেছে। এটি এমন একটি পথ, যে পথ তারাই অনুসরণ করেছেন, যাদের
ওপর আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন। নবিগণ, সত্যবাদীগণ, শহিদগণ
ও সৎ লোকদেরই তিনি এই পথ অনুগ্রহ করে দান করেছেন।
৩. শ্রেষ্ঠত্বের
প্রতীক
আর একইভাবে মধ্যমপন্থা হলো শ্রেষ্ঠত্বের
প্রতীক, সম্মান ও স্বাতন্ত্র্যের লক্ষণ; চাই সেটি দুনিয়াবি কোনো বিষয়ে
হোক কিংবা আধ্যাত্মিক কোনো বিষয়ে হোক। যেমনঃ দুনিয়াবি বিষয়ের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই, চুক্তি
সম্পাদন বা মীমাংসার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি থাকেন মাঝখানে। এ ছাড়া আরও দেখতে পাই,
কোনো একটি গোত্র বা গ্রুপের নেতা থাকেন মাঝখানে, আর
অনুসারীরা থাকেন তার চারপাশে। আর
আধ্যাত্মিক বিষয়ে আমরা এটি খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করি যে, কোনো
ধরনের প্রান্তিকতার চেয়ে মধ্যমপন্থাই উত্তম।
এ কারণেই আরবরা প্রবাদ বাক্যে বলে থাকেঃ خير
الأمور أوسطها প্রতিটা বিষয়ের মধ্যে উত্তম হলো মধ্যম বা মাঝামাঝি অংশটি।’
আর বিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেনঃ
‘একটি গুণ অবস্থান করে দুটো পাপ বা অপরাধের মাঝামাঝিতে।’
এ বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে ইবনে কাসির
আল্লাহর সেই বাণী أمة وسطا-এর ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ
‘এখানে আল-ওয়াসাত (الوسطية) অর্থ শ্রেষ্ঠ বা সেরা হওয়া। যেমন
বলা হয়ে থাকে, ঘর আর বংশীয় দিক দিয়ে কুরাইশগণ হলো সবেচেয়ে মধ্যমপন্থি। অর্থাৎ এর মানে হলো, কুরাইশরা ঘর আর বংশীয় দিক দিয়ে
সবচেয়ে উত্তম। আর রাসূল তাঁর গোত্রের ভেতর মধ্যমণি ছিলেন। অর্থাৎ রাসূল ছিলেন বংশগত দিক
থেকে সবচেয়ে উত্তম। এজন্যই
বলা হয়, الصلاة الوسطي (আস-সালাত আল-উসতা) বা
মধ্যবর্তী নামাজ। আর এই নামাজকেই সর্বোত্তম নামাজ হিসেবে
অভিহিত করা হয়েছে।৭
৪. শান্তি ও
নিরাপত্তার প্রতিচ্ছবি
মধ্যমপন্থা হলো শান্তি ও ঝুঁকিহীনতার
প্রতিচ্ছবি। সাধারণত প্রান্তিক অংশগুলোই সব থেকে বেশি
নিরাপত্তাহীনতা ও ঝুঁকির মধ্যে থাকে। কিন্তু
তার চারপাশ পরিবেষ্টিত অবস্থায় থাকার কারণে মাঝখানের অংশটি তুলনামূলক বেশি
নিরাপদে থাকে। এ কারণে কবি বলেছেনঃ
كانت
هي الوسط المحمي فاكتفت
بها
الحوادث حتى أصبحت طرفا
‘সেটি ছিল মাঝে (ওয়াসাত) থাকা সংরক্ষিত কেন্দ্ৰে
ক্ষতি আগে হয়েছিল যা ছিল সব প্রান্তে।’
ঠিক তেমনি মধ্যমপন্থি ব্যবস্থা, মধ্যমপন্থি
পদ্ধতি এবং মধ্যমপন্থি জাতিও অযাচিত ঝুঁকি ও বিপদ থেকে নিরাপদ থাকতে পারে
মধ্যমপন্থা অবলম্বনের কারণে।
৫. শক্তির প্রতীক
এ ছাড়াও মধ্যমপন্থা হলো শক্তি-সামর্থ্যের
প্রতীক। কারণ, কোনো বস্তুর মাঝখানের অংশটি
সচরাচর শক্তির কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়। এ
ছাড়া জীবনের দুটো দুর্বল পর্যায় হলো শৈশবকালের দুর্বলতা এবং বৃদ্ধ বয়সের
অক্ষমতা।
আপনি কি খেয়াল করে দেখেন-জীবনের দুটো দুর্বল
পর্যায়ের মাঝামাঝি অবস্থান করার কারণে একজন যুবক কীভাবে শক্তির প্রতিচ্ছবি হয়ে
ওঠে? এ ছাড়া আপনি কি দেখেননি, সূর্য তখনই তীব্র ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, যখন এটি
দিনের শুরু এবং দিনের শেষের ঠিক মাঝমাঝি অবস্থায় থাকে?
৬. ঐক্য ও সংহতির
কেন্দ্র
এ ছাড়াও মধ্যমপন্থা হলো ঐক্য ও সংহতির
কেন্দ্রস্থল। অনেক সময় প্রান্তে অবস্থান করা বিষয়গুলো
একাধিক ও বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকলেও মাঝখানের অংশটি একটাই হয়ে থাকে। প্রান্তিক বিভিন্ন বিষয়গুলো এই মাঝখানের অংশটিতে মিলিত ও
একীভূত হতে পারে। কারণ, এটি মাঝখানে থাকে এবং
কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। আর এই বিষয়টি বৈষয়িক
বা বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে কিংবা আধ্যাত্মিক ও নৈতিক দিক থেকে সমানভাবে সত্য ও
স্পষ্ট। বৃত্তের কেন্দ্র মাঝখানে থাকে
বলেই তার চারপাশের রেখাগুলো কেন্দ্রে মিলিত ও একীভূত হতে পারে। ঠিক একইভাবে মধ্যমপন্থি চিন্তাধারা হলো এমন একটি কেন্দ্র, যেখানে
প্রান্তিক চিন্তাগুলো এসে মিলিত ও একীভূত হয়। কারণ, মধ্যমপন্থি চিন্তার ক্ষেত্রে ন্যায্যতা ও ভারসাম্য বজায় থাকে। যেখানেই বাড়াবাড়ি ও প্রান্তিকতা পাওয়া যায়, সেখানেই
বুদ্ধিবৃত্তিক বৈচিত্র্য ও চিন্তার ভিন্নতা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আর তখন চিন্তাগত ভিন্নতার তীব্রতা ও আধিক্য নির্ভর করে সেই
প্রান্তিকতার আধিক্য ও তীব্রতার ওপর।
পক্ষান্তরে ভারসাম্য ও মধ্যমপন্থা হলো চিন্তার সংহতি এবং একতা বিনির্মাণের পথ, কেন্দ্র
ও উৎস। আর এ কারণেই ঐক্যবদ্ধ একটি উম্মাহ তথা
ইসলামের অনুসারীদের মধ্যে প্রান্তিক গোষ্ঠী ও চিন্তাধারাগুলো সাম্প্রদায়িকতা, বিভেদ ও
বিভক্তি উসকে দিয়েছিল। অথচ স্বাভাবিকভাবে এমন
সাম্প্রদায়িক ও বিভক্তিমূলক উসকানি ন্যায়নিষ্ঠ-ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যমপন্থি মাজহাব
বা গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান থাকাটা বেমানান ও দুষ্কর।
এতক্ষণ আমরা মধ্যমপন্থার যেসব বৈশিষ্ট্য ও
উপকারিতাসমূহ উল্লেখ করলাম,
সেগুলোর কারণেই ইসলাম তার সর্বজনীন বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে
মধ্যমপন্থাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং তার সমস্ত উপাদানসমূহে মধ্যমপন্থাকে
স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছে। আমরা পরবর্তী
অধ্যায়গুলোতে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে পারব।
ইসলামে মধ্যমপন্থা
ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা বৈশিষ্ট্যগুলো যদি
মধ্যমপন্থার বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকে, তাহলে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এই বৈশিষ্ট্যগুলো ইসলামের সব ক্ষেত্রেই সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে; চাই তা
তাত্ত্বিক ক্ষেত্র হোক কিংবা ব্যবহারিক, প্রশিক্ষণমূলক ক্ষেত্র হোক কিংবা
আইন সম্পর্কিত।
ইসলাম বিশ্বাস ও চিন্তা-ভাবনার (Concept) ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থি। ইবাদত ও ধার্মিকতায়
মধ্যমপন্থি। নৈতিকতা ও শিষ্টাচারের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থি। আইনকানুন ও রীতিনীতির ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থি।
বিশ্বাসের
ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা
ক. আমাদের চারপাশে এমন একটি গ্রুপ পাওয়া যায়, যারা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে
কুসংস্কারপন্থি। এরা বিশ্বাসের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করে। অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ ছাড়া সবকিছুকে বিশ্বাস করে এবং সত্য
বলে ধরে নেয়। পক্ষান্তরে আরেকটি গ্রুপ পাওয়া যায়, যারা
বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বস্তুবাদী। তারা
অনুভূতির বাইরের যেকোনো কিছুকে অস্বীকার করে থাকে। মানব ফিতরাতের (স্বভাবজাত প্রকৃতি) ধ্বনি কিংবা জ্ঞান ও বোধের ডাক অথবা
মুজিজার (অলৌকিকত্ব) আহ্বান-কোনোটাই তারা শুনতে চায় না।
কিন্তু বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ইসলামের অবস্থান
হলো, উল্লিখিত প্রান্তিক গ্রুপ দুটোর সাপেক্ষে মাঝামাঝি বা মধ্যমপন্থি। কারণ, ইসলাম এমন বিশ্বাস ও ঈমানের দিকে আহ্বান করে, যেগুলো
অকাট্য দলিল ও সন্দেহাতীত প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত হয়। আর বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এর বাইরে যেসব বিষয়গুলো অকাট্য দলিল ও সন্দেহাতীত
প্রমাণ দিয়ে সাব্যস্ত নয়,
সেসব বিষয়কে ইসলাম অনুমান ও ধারণা হিসেবে গণ্য করে। কারণ, ইসলামের একটি স্থায়ী স্লোগান হলোঃ
﴿قُلْ هَاتُوا بُرْهَانَكُمْ إِن كُنتُمْ
صَادِقِينَ﴾
‘আপনি বলুন! তোমরা তোমাদের বুরহান বা অকাট্য প্রমাণাদি নিয়ে এসো; যদি
তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো।’ সূরা বাকারাঃ ১১১
খ. আবার আরেকটি দল আছে,
যারা নাস্তিকতায় উদ্বুদ্ধ এবং কোনোভাবেই স্রষ্টায়
বিশ্বাসী নয়। স্রষ্টায় অবিশ্বাসের মাধ্যমে তারা মূলত
নিজেদের অন্তরে স্রষ্টায় বিশ্বাস করার মানবীয় ফিতরাতকে (স্বভাবজাত প্রকৃতি) গলা
টিপে হত্যা করে এবং পাশাপাশি মানুষের মধ্যে যে বুদ্ধিবৃত্তি আছে, সেটিকেই
চ্যালেঞ্জ করে বসে। আবার আরেকটি গোষ্ঠী আছে যারা একাধিক উপাস্যে
বিশ্বাসী; এমনকী এদের অনেকেই গাভির পূজা করে এবং মূর্তি ও পাথরকে উপাস্যের আসনে বসায়। আর এক্ষেত্রে ইসলাম স্রষ্টায় অবিশ্বাস এবং একাধিক
স্রষ্টায় বিশ্বাস-এই দুই প্রান্তিকতার মাঝামাঝিতে অবস্থান করে।
এ কারণে ইসলাম এমন একজন উপাস্যের প্রতি
বিশ্বাসের দিকে আহ্বান করে,
যিনি এক ও অদ্বিতীয় এবং যাঁর কোনো শরিক নেই। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাঁকে জন্ম দেয়নি। কেউ-ই তাঁর সমকক্ষ নয়। এর বাইরে যত যা কিছু আছে, সবগুলোই হলো তাঁর সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত। এসব সৃষ্টি মৌলিকভাবে কারও কোনো ক্ষতি কিংবা উপকার করতে পারে না। কাউকে জীবন বা মৃত্যু দিতে পারে না। কাউকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে না। এ
কারণে এসব সৃষ্টির কোনো কিছুকে উপাস্য বানানোর কাজটি হলো একাধারে শিরক, জুলুম
বা অবিচার এবং সুস্পষ্ট বিভ্রান্তি। আল্লাহ
সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেনঃ
‘তার চাইতে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে আছে, যে আল্লাহ ছাড়া অন্য এমন কাউকে
ডাকে, যে কিয়ামত পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিতে সক্ষম নয় এবং তারা তাদের আহ্বানের
ব্যাপারে বেখবর।’
সূরা আহকাফঃ ০৫
গ. আর ইসলাম হলো সেই দুটো প্রান্তিক দলের মাঝামাঝি, যার
একটি দল সৃষ্টিজগৎকেই একমাত্র অস্তিত্বশীল মনে করে থাকে। সৃষ্টিজগৎ ছাড়া বাকি সবকিছুকেই (যেসব কিছু চোখে দেখা যায় না বা হাতে ছোঁয়া
যায় না) অনুমান হিসেবে বিবেচনা করে। এরা
হলো বস্তুবাদী; যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় এমন সব বিষয়কে নাকচ করে দেয়। আর আরেকটি দল আছে যারা মনে করে, অস্তিত্বশীল জগৎটি মূলত পুরোটাই
কল্পনা, যার সত্যিকার অর্থে কোনো অস্তিত্ব নেই; অনেকটা মরীচিকার মতো। আর মরীচিকার অবস্থা বোঝাতে গিয়ে কুরআন যেমনটা বলেছেঃ
...তৃষ্ণাতুর পথিক যাকে পানি মনে করেছিল। কিন্তু
যখন সে সেখানে পৌঁছাল,
কিছুই পেল না...’ সূরা নুরঃ ৩৯
তারা মনে করে, সত্যিকার অর্থে এই জগতের
সবকিছুতে কেবল আল্লাহই বিদ্যমান আছেন।
প্রকৃতপক্ষে তিনি ছাড়া আর কোনো কিছুই বিদ্যমান নেই। এরা হলো মূলত তারা,
যারা ওয়াহদাতুল ওজুদ (Pantheism বা সর্বেশ্বরবাদ)-এর
প্রবক্তা।
কিন্তু ইসলাম জগতের অস্তিত্বকে সন্দেহহীন
একটি বাস্তবতা হিসেবে বিবেচনা করে। এর
পাশাপাশি এই বাস্তবতাকে অতিক্রম করে, এর চেয়ে আরও বড়ো বাস্তবতার
দিকে ইসলাম মনোনিবেশ করে। আর সেটি হলো সেই সত্তার
অস্তিত্বের বাস্তবতা;
যিনি এই জগৎকে সৃষ্টি করেছেন, একে সুবিন্যস্ত ও সুসংগঠিত
করেছেন এবং এর যাবতীয় কাজগুলো সুনিপুণভাবে পরিচালনা করছেন। আর তিনি হলেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা। যেমনটা কুরআন বলছেঃ
‘যেসব বুদ্ধিমান লোক উঠতে, বসতে ও শয়নে সব অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ ও
পৃথিবীর গঠনাকৃতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে, তাদের জন্য পৃথিবী ও আকাশের
সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের পালাক্রমে যাওয়া-আসার মধ্যে অগণিত নিদর্শন রয়েছে। (পাশাপাশি তারা স্বীকৃতিস্বরূপ বলে) হে আমাদের রব! আপনি
এসব কোনো কিছুই নিরর্থক বা উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেননি।’ সূরা
আলে ইমরানঃ ১৯০-১৯১
ঘ. ইসলাম হলো সেই দুটো প্রান্তিক গ্রুপের মাঝমাঝি, যাদের একটি গ্রুপ মানুষকে ইলাহ
বা উপাস্য হিসেবে সাব্যস্ত করে এবং মানুষের ওপর রুবুবিয়্যাহ বা প্রভুত্বের
বৈশিষ্ট্য আরোপ করে। আর আরেক গ্রুপ হলো তারা, যারা
মানুষকে অর্থনৈতিক,
সামাজিক ও ধর্মীয় শেকলে বন্দি বলে বিবেচনা করে। যেখানে মানুষ হলো প্রবাহিত বাতাসের মাঝে পাখির পালকের মতো, যার
উড়ে বেড়ানোর কোনো নিজস্ব ক্ষমতা নেই। সে
কেবল সেদিকেই যায়,
যেদিকে বাতাস তাকে নিয়ে যায়! অথবা মানুষ হলো সেই পুতুলের
মতো, যার সুতা নিয়ন্ত্রণ করে সমাজ, অর্থনীতি, ক্ষমতা
কিংবা ভাগ্য।
কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ হলো বিশেষভাবে
দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং বিশেষ কাজে নিয়োজিত।
পৃথিবীতে তার নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা আছে ঠিকই, কিন্তু আল্লাহর কাছে সে একজন দাস
মাত্র। মানুষ চাইলে আশপাশের কিছু বিষয় নির্ধারিত
পরিমাণে পরিবর্তন করতে সক্ষম। যেমনটা
কুরআন বলছেঃ
﴿إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ
حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ﴾
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ
পর্যন্ত তারা নিজেরাই নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন না করে...’ সূরা রা’দঃ ১১
ঙ. ইসলাম হলো সেই দুটো দলের মাঝামাঝি, যাদের একটি দল নবিদের পবিত্রায়ণ
করতে গিয়ে ইলাহর পর্যায়ে নিয়ে গেছে অথবা আল্লাহর সন্তান পর্যন্ত বানিয়ে ফেলেছে। আর আরেকটি দল নবিদের অবিশ্বাস করেছে, অপবাদ
দিয়ে বেড়িয়েছে এবং তাঁদের প্রচণ্ড কষ্ট দিয়েছে।
কিন্তু নবিগণ হচ্ছেন আমাদের মতো মানুষ। তাঁরা খাবার গ্রহণ করেন, হাট-বাজারে চলাফেরা করেন। তাঁদের অধিকাংশেরই স্ত্রী ও পরিবার ছিল। তবে নবি ও অন্যদের মধ্যে মূল পার্থক্যের জায়গাটি হলো-মহান
আল্লাহ তায়ালা তাঁদের ওহির মাধ্যমে অনুগ্রহ করেছেন এবং মুজিজা দিয়ে সাহায্য
করেছেন। যেমনটা আল্লাহ বলেছেনঃ
“তাদের রাসূলরা তাদের বলে-“আমরা মূলত তোমাদের মতো মানুষ ছাড়া আর কিছুই নই। কিন্তু আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা অনুগ্রহ
করেন। আর তোমাদের কাছে কোনো শক্তি বা ক্ষমতা এনে
দেবো, সে সামর্থ্য আমাদের নেই। শক্তি
বা ক্ষমতা তো কেবল আল্লাহর অনুমতিক্রমেই আসতে পারে। আর ঈমানদারদের আল্লাহর ওপরই ভরসা করা উচিত।”” সূরা ইবরাহিমঃ ১১
চ. ইসলাম হলো সেই দুটো দলের মাঝামাঝি যাদের একটি দল বিশ্বাস করে, অস্তিত্বের
বাস্তবতাকে জানার একমাত্র উৎস হলো আকল বা বুদ্ধিবৃত্তি। আর অন্য দলটি কেবল ওহি বা প্রত্যাদেশ ও ইলহাম বা ঐশী অনুপ্রেরণা ছাড়া আর
কিছুকেই মেনে নিতে চায় না। এরা
আকল বা বুদ্ধিবৃত্তির ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো ধরনের ভূমিকাকে স্বীকার করে না।
পক্ষান্তরে ইসলাম আকলের কার্যকারিতায়
বিশ্বাস রাখে এবং এর মাধ্যমে চিন্তা-গবেষণা করতে উদ্বুদ্ধ করে। পাশাপাশি চিন্তার বদ্ধতা ও অন্ধ অনুসরণকে নাকচ করে। ইসলাম আকলকে কাজে লাগানোর জন্য আদেশ করে এবং আদেশ-নিষেধ
বুঝে তা থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করে। সর্বোপরি দুটো বিশাল অস্তিত্ব সাব্যস্তের ক্ষেত্রে ইসলাম আকলের ওপর নির্ভর
করে। একটি হলো আল্লাহর অস্তিত্ব৮ এবং অন্যটি হলো নবুয়তের দাবির সত্যতা। কিন্তু ইসলাম এক্ষেত্রে বিশ্বাস করে, ওহি বা
প্রত্যাদেশ হলো আকল বা যুক্তি-বুদ্ধির সম্পূরক। যুক্তি-বুদ্ধি যেসব ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ও বৈপরীত্যে পতিত হয় এবং
কুপ্রবৃত্তির অনুগামী হয়,
সেসব ক্ষেত্রে ওহি হলো যুক্তি-বুদ্ধির পরিপূরক। আর আকল বা বুদ্ধিবৃত্তির যেসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টতা ও
সক্ষমতা নেই, সে সমস্ত বিষয়ে ওহি মূলত আকলকে পথ প্রদর্শন করে। যেমনঃ অদৃশ্য বিষয়সমূহ, বিশ্বাসের সে সমস্ত বিষয় যা
শুধু কানে শুনে বিশ্বাস করতে হয়, আল্লাহর জন্য ইবাদত করার পদ্ধতিসংক্রান্ত বিষয়সমূহ ইত্যাদি।
ইবাদতের ক্ষেত্রে
মধ্যমপন্থা
ইসলাম ইবাদত এবং আনুষ্ঠানিক আচারের ক্ষেত্রে
সেসব প্রান্তিক ধর্ম ও সম্প্রদায়গুলোর মাঝামাঝি, যেসব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের কোনো
কোনোটি তাদের দর্শন ও দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত বিষয় যেমনঃ
ইবাদত, ধার্মিকতা ও প্রভুভক্তিকে একেবারে বাদ দিয়েছে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বৌদ্ধ ধর্মের কথা বলা যেতে পারে; যেটি
তার দায়িত্ব ও কর্তব্যকে স্রেফ নৈতিক-মানবিক অংশে সীমাবদ্ধ করে রাখে। আবার এমন অনেক ধর্ম ও সম্প্রদায় আছে, যারা
তাদের অনুসারীদের কাছে দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ও উৎপাদনবিমুখ হয়ে কেবল ইবাদত
নিয়ে পড়ে থাকার দাবি করে।
উদাহরণস্বরূপ বৈরাগ্যবাদী খ্রিষ্টধর্মের কথা বলা যেতে পারে।
অন্যদিকে ইসলাম একজন মুসলিমের কাছে চায়, সে যেন
নির্ধারিত কিছু ইবাদত ও আচার পালন করে। যেমনঃ প্রতিদিন সে যেন সালাত আদায় করে, প্রতিবছর সাওম পালন করে, জীবনে
একবার যেন হজ পালন করে।
এতে করে একজন মুসলিম সার্বক্ষণিক আল্লাহর
সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারে এবং তাঁর সন্তুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয় না। এটুকু দায়িত্ব পালনের পর তার কর্তব্য হলো পৃথিবীর
পথে-প্রান্তরে বেরিয়ে পড়া এবং প্রচেষ্টারত ও উৎপাদনমুখী হয়ে আল্লাহ প্রদত্ত
রিজিক থেকে ভক্ষণ করা।
এক্ষেত্রে সব থেকে স্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে আমরা
জুমার সালাতের ক্ষেত্রে আদেশসূচক আয়াতগুলো উল্লেখ করতে পারিঃ
‘ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছ! জুমার দিন নামাজের জন্য যখন ডাকা হয়, তখন
তোমরা বেচাকেনা বাদ দিয়ে আল্লাহর স্মরণে দিকে (নামাজের দিকে) ধাবিত হও। এটিই তোমাদের জন্য বেশি ভালো-যদি তোমরা তা জানতে। তারপর যখন নামাজ শেষ হয়ে যায়, তখন
তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো, আল্লাহর অনুগ্রহ খুঁজে বেড়াও আর আল্লাহকে প্রচুর পরিমাণে
স্মরণ করতে থাকো। আশা করা যায়-এতে তোমরা সফলকাম হবে।’ সূরা জুমুআঃ ৯-১০
দ্বীন ও জীবনের সাথে একজন মুসলিমের সম্পর্ক
মূলত এমনই। এমনকী জুমার দিনে নামাজের আগ পর্যন্ত সে
বেচাকেনা ও কাজকর্ম করবে। এরপর বেচাকেনা থেকে শুরু
করে এ রকম অন্যান্য দুনিয়াবি ব্যস্ততা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর স্মরণ ও নামাজের দিকে
ধাবিত হবে। তারপর নামাজ শেষে সে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে
এবং নতুন করে জীবিকা অন্বেষণে নিয়োজিত হবে।
পাশাপাশি সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করার ব্যাপারটি সে কখনো ভুলে যাবে না। কারণ, আল্লাহকে স্মরণ করাটাই হলো কল্যাণ ও সফলতার মূল ভিত্তি।
নৈতিকতার ক্ষেত্রে
মধ্যমপন্থা
ক. নৈতিকতার ক্ষেত্রে ইসলাম দুটো গ্রুপের অবস্থানের মাঝামাঝিতে অবস্থান করে, যাদের
একটি গ্রুপ অতি বিশুদ্ধবাদী (Puritanical)। তারা
মানুষকে ফেরেশতা বা ফেরেশতার মতো কোনো কিছুর কাতারে দাঁড় করানোর কল্পনা-বিলাসে
মত্ত। ফলে তারা মানুষের জন্য এমনসব নৈতিক মূল্যবোধ
ও শিষ্টাচার নির্ধারণ করতে চায়, যা মানুষের পক্ষে মেনে চলা সম্ভব হয় না।
পক্ষান্তরে অন্য আরেকটি গ্রুপ অতি বাস্তববাদী। এরা মানুষকে পশু বা পশুর মতো কোনো কিছুর কাতারে দাঁড়
করাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ফলে
তারা মানুষের জন্য এমন আচার-আচরণ আরোপ করতে চায়, যা তার সাথে মানানসই হয় না।
এক্ষেত্রে প্রথম গ্রুপটি মানবীয় স্বভাবজাত
প্রকৃতিকে এত বেশি ভালো হিসেবে সাব্যস্ত করতে চায় যে, স্বভাবজাত
প্রকৃতিকে এরা খাঁটি ও অবিমিশ্র ভালো হিসেবে মনে করে। আর দ্বিতীয় গ্রুপটি মানবীয় স্বভাবজাত প্রকৃতি মাত্রই প্রচণ্ড খারাপ হিসেবে
সাব্যস্ত করতে চায়। ফলে এরা স্বভাবজাত
প্রকৃতিকে চূড়ান্ত মন্দ হিসেবে গণ্য করে।
কিন্তু এ ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান ও
দৃষ্টিভঙ্গি উভয় গ্রুপের অবস্থানের সাপেক্ষে মাঝামাঝিতে।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ হলো একটি যৌগিক
সৃষ্টি। মানুষের মধ্যে যেমন আকল (জ্ঞান, বুদ্ধি, বোধশক্তি)
আছে, তেমনি প্রবৃত্তিও আছে।
মানুষের ভেতর পশুর কিছু স্বভাব যেমন আছে, তেমনি ফেরেশতাদের কিছু
আধ্যাত্মিক স্বভাবও আছে। মানুষকে ভালো-মন্দ দুটো
প্রান্তেরই পথ প্রদর্শন করা হয়েছে। দুটো
পথের যেকোনো একটিকে বেছে নেওয়ার সক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সে চাইলে কৃতজ্ঞও হতে পারে কিংবা অকৃতজ্ঞও হতে পারে। মানুষের মধ্যে পাপে নিমজ্জিত হওয়ার প্রবণতাও আছে, আবার
তাকওয়া অর্জনের যোগ্যতাও আছে।
মানুষের দায়িত্ব হলো নিজেকে নিয়ে প্রচণ্ড সাধনা ও অনুশীলন করা-যাতে পরিশুদ্ধ হতে
পারে। যেমনটা আল্লাহ বলেছেনঃ
‘মানুষের নফসের সেই সত্তার শপথ! যিনি তাকে ঠিকঠাকভাবে গঠন করেছেন। তারপর এতে প্রবিষ্ট করিয়েছেন পাপ ও তাকওয়ার অনুপ্রেরণা। আর নিঃসন্দেহে সফল হয়েছে সেই ব্যক্তিটি, যে তার
নফসকে পরিশুদ্ধ করেছে (পাপ ও দুষ্কৃতি থেকে)। আর ব্যর্থ হয়েছে সেই ব্যক্তিটি, যে তাকে (নফসের ইতিবাচক
উদ্দীপনাকে) দাবিয়ে দিয়েছে।’ সূরা আশ-শামসঃ ৭-১০
খ. মানুষের প্রকৃতিসংক্রান্ত প্রশ্নে ইসলাম দুটো প্রান্তিক দলের বিপরীতে গিয়ে
মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে। এদের একটি দল মনে করে, মানুষ
মূলত একটি ঊর্ধ্বগামী রুহ-যাকে একটি শরীরের মধ্যে বন্দি রাখা হয়েছে। ফলে শরীরকে কষ্ট আর বঞ্চিত করা না হলে এই রুহকে পবিত্র ও
উন্নত করা যাবে না। যেমনঃ ব্রাহ্মণ ও
অন্যান্য অনেকে এমনটা বিশ্বাস করে থাকে। আর
অন্য দলটি মানুষকে কেবল একটি শরীর এবং বস্তুবাদী কাঠামো হিসেবে বিবেচনা করে। তাদের মতে-এতে রুহ বলতে কিছু নেই এবং এটি স্বর্গীয় কোনো
আবেশ দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিতও নয়।
কিন্তু ইসলামে মানুষ মানে হলো বস্তুবাদিতা ও
আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়। প্রথম মানব হজরত আদম-কে
সৃষ্টির বিষয়টি সেদিকেই নির্দেশ করে। আল্লাহ
তাঁকে মাটি কিংবা নরম মাটি অথবা শক্ত মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। আর এসব উপাদানগুলোর প্রত্যেকটিই মানুষের শারীরিক গঠনের
ক্ষেত্রে বস্তুগত উপাদানের অস্তিত্বের দিকে ইঙ্গিত করে। এভাবে মাটির মতো বস্তুগত উপাদান দিয়ে মানব শরীর সৃষ্টির পর এতে আরেকটি জিনিস
আল্লাহ তায়ালা অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
জিনিসটি হলো মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মূল রহস্য এবং সম্মানিত হওয়ার মূল উৎস। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের বলছেনঃ
‘যখন আমি তাঁকে পূর্ণ অবয়ব দান করব এবং তাঁর মাঝে আমার রুহ থেকে কিছু ফুঁকে
দেবো, তখন তোমরা সবাই তাঁর সামনে সিজদাবনত হয়ো।’ সূরা
হিজরঃ ২৯
আর এভাবেই মানুষ একমুঠো মাটি আর ফুঁকে দেওয়া
রুহের সমন্বিতরূপে পরিণত হলো। আরেকটু
সংক্ষেপে বললে-মানুষ হলো শরীর ও রুহের সমন্বয়। তার ওপর রুহের যেমন অধিকার আছে, তেমনিভাবে শরীরেরও অধিকার আছে। মানুষের কর্তব্য হলো উভয়কেই তার অধিকার ঠিকঠাক বুঝিয়ে
দেওয়া।
গ. ইসলাম হলো সেই দুটো দলের মাঝামাঝিতে অবস্থিত, যাদের
একটি দল আখিরাতকে পুরোপুরি অস্বীকার করে এবং দুনিয়ার জীবনকেই সবকিছু ভেবে বসে থাকে। দুনিয়ার জীবনটাকেই শুরু ও শেষ হিসেবে মনে করে। যারা এমন চিন্তা করে, তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা
বলেনঃ
‘আর এরা বলে,
দুনিয়ার এই জীবনটুকু বাদে জীবন বলতে আর কোনো কিছু নেই এবং
মৃত্যুর পর আমরা পুনরুত্থিতও হব না।’ সূরা আনআমঃ ২৯
এই চিন্তা লালনের ফলে তারা কুপ্রবৃত্তির মাঝে
নিমগ্ন হয় এবং নিজেদের জড়বাদ/বস্তুবাদ (Materialism)-এর দাসত্বের শৃঙ্খলে আটকে
ফেলে। এরা কেবল সেদিকেই ধাবিত হয়, যেখানে
তারা ব্যক্তিগত ও দুনিয়াবি স্বার্থ দেখতে পায়। আর এই ব্যাপারটি হলো যেকোনো সময়ের, যেকোনো স্থানের বস্তুবাদীদের
বৈশিষ্ট্য।
অন্যদিকে আরেকটি দল আছে; যারা
দুনিয়ার জীবনকে পুরোপুরি অস্বীকার করে। তাদের
অস্তিত্ব থেকে দুনিয়াকে বাদ দিতে চায়।
দুনিয়ার জীবনকে তারা খারাপ হিসেবে বিবেচনা করে একে প্রতিহত করতে চায়; এর থেকে
পালিয়ে যেতে চায়। ফলে তারা দুনিয়ার জীবনের
বৈধ বিষয় ও সৌন্দর্যগুলোকে নিজেদের জন্য নিষিদ্ধ করে নেয়। আশেপাশে থাকা মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং পৃথিবীকে সুন্দর করে
নির্মাণ এবং একে উৎপাদনশীল একটি ক্ষেত্রে পরিণত করার কাজ থেকে বিরত থাকে।
কিন্তু ইসলাম এই দুই ধরনের জীবনকেই বিবেচনায়
রাখে। দুনিয়া ও আখিরাত; দুটো
জীবনের যাবতীয় কল্যাণের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। দুনিয়াকে আখিরাতের জন্য শস্যক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করে। দুনিয়াকে সুন্দর করে নির্মাণের জন্য কাজ এবং মানুষের
প্রতি কর্তব্য পালন আল্লাহর জন্য ইবাদত হিসেবে সাব্যস্ত করে। আর তথাকথিত ধার্মিকদের ‘হালাল ও আলংকারিক বিষয়গুলোকে হারাম সাব্যস্ত করা’র
গোঁড়ামিকেও নাকচ করে দেয়।
পাশাপাশি তাদেরও প্রত্যাখ্যান করে, যারা কুপ্রবৃত্তি ও বিলাসিতায়
নিজেদের গা ভাসিয়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ
তায়ালা তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেনঃ
﴿وَالَّذِينَ كَفَرُوا يَتَمَتَّعُونَ
وَيَأْكُلُونَ كَمَا تَأْكُلُ الْأَنْعَامُ وَالنَّارُ مَثْوًى لَّهُمْ﴾
‘আর যারা কুফরি করে,
তারা ইচ্ছেমতো মজা লুটে এবং চারপেয়ে পশুর মতো
খাওয়া-দাওয়া করে। আর এদের চূড়ান্ত ঠিকানা হলো জাহান্নাম।’ সূরা মুহাম্মাদঃ ১২
এ ছাড়া আল্লাহ আরও বলেছেনঃ
﴿يَا بَنِي آدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِندَ
كُلِّ مَسْجِدٍ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ
الْمُسْرِفِينَ﴾﴿قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ
وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ ﴾
‘হে আদমের সন্তানরা! তোমরা প্রতিটি ইবাদতের সময়ে সুন্দর সাজে সজ্জিত হও। আর খাও এবং পান করো, কিন্তু সীমা অতিক্রম করো না। কারণ, আল্লাহ সীমা অতিক্রমকারীকে পছন্দ করেন না। হে মুহাম্মাদ! আপনি বলুন, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যেসব
সৌন্দর্য সামগ্রী সৃষ্টি করেছেন, সেগুলো কে হারাম করেছে?’ সূরা আরাফঃ ৩১-৩২
এ ছাড়া সুখী ও সমৃদ্ধ দুনিয়াবি জীবনকে আল
কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য প্রতিদান ও পুরস্কার হিসেবে সাব্যস্ত করেছে।
আল কুরআন বলছেঃ
﴿فَآتَاهُمُ اللَّهُ ثَوَابَ الدُّنْيَا
وَحُسْنَ ثَوَابِ الْآخِرَةِ ۗ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ﴾
‘অতঃপর আল্লাহ মুমিনদের দুনিয়াবি প্রতিদানও দিয়েছেন এবং আখিরাতের প্রতিদানও
দিয়েছেন। আল্লাহ মুহসিনদের ভালোবাসেন।’ সূরা আলে ইমরানঃ ১৪৮
এ ছাড়া আল কুরআন মুমিনদের একটি দুআও
শিখিয়েছে-যেখানে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জীবনের কল্যাণ চাইতে বলা হয়েছে। দুআটি হলোঃ
﴿رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً
وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ﴾
‘হে আমাদের রব! আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ দিন এবং আমাদের জাহান্নামের
আগুন থেকে বাঁচান।’
সূরা বাকারাঃ ২০১
এ রকম আরেকটি উদাহরণ হলো আল্লাহর রাসূল সা. এর
সেই দুআটি, যেখানে তিনি বলেছেনঃ
‘হে আল্লাহ! আপনি দয়া করে আমার
দ্বীনের মধ্যে উন্নতি দিন। কারণ, এটি হলো
আমার সমস্ত কাজের মূল। এরপর আমার দুনিয়ার
বিষয়ে উন্নতি দিন। কারণ, এতেই আমার জীবন ও জীবিকা। এরপর আমার আখিরাতে উন্নতি দিন। কারণ, এটি
আমার গন্তব্য ও প্রত্যাবর্তনস্থল। জীবনে
আমার জন্য সবদিক থেকে মঙ্গল বাড়িয়ে দিন এবং মৃত্যুকে আমার জন্য সমস্ত অনিষ্ট
থেকে অবকাশের মাধ্যম হিসেবে পরিণত করুন।৯
আইন ও বিধানের
ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা
একইভাবে আইনি ও সামাজিক নিয়মনীতির ক্ষেত্রে
ইসলাম মধ্যমপন্থা অবস্থান গ্রহণ করেছে। কোনো
কিছু হালাল ও হারাম সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে ইসলামের অবস্থান মধ্যমপন্থি। ইহুদিরা হারাম সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে খুব বাড়াবাড়ি
করেছিল। ফলে তাদের ভেতর হারামের পরিমাণ বেড়ে
গিয়েছিল; যা তারা নিজেদের ওপর হারাম করে নিয়েছিল। তাদের বাড়াবাড়ি ও জুলুমের ফলে আল্লাহও তাদের জন্য সেসব জিনিসকে হারাম
সাব্যস্ত করেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
﴿فَبِظُلْمٍ مِّنَ الَّذِينَ هَادُوا
حَرَّمْنَا عَلَيْهِمْ طَيِّبَاتٍ أُحِلَّتْ لَهُمْ وَبِصَدِّهِمْ عَن سَبِيلِ
اللَّهِ كَثِيرًا﴾﴿وَأَخْذِهِمُ الرِّبَا وَقَدْ نُهُوا عَنْهُ وَأَكْلِهِمْ أَمْوَالَ
النَّاسِ بِالْبَاطِلِ﴾
‘যারা ইহুদি ধর্ম অনুসরণ করেছে, তাদের এমন জুলুমের কারণে এবং
আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে ব্যাপকভাবে বিরত রাখার ফলে আমি তাদের ওপর অনেক বৈধ
জিনিসকে অবৈধ হিসেবে সাব্যস্ত করেছি।
পাশাপাশি তাদের সুদ গ্রহণ করতে এবং অন্যায়ভাবে মানুষের ধন-সম্পদ গ্রাস করতে নিষেধ
করা হয়েছিল।’
সূরা নিসাঃ ১৬০-১৬১
আর খ্রিষ্টানরা হালাল সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে
বাড়াবাড়ি করেছিল। এমনকী তাওরাতের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে হারাম
হিসেবে উল্লেখ থাকার পরও সেগুলোকে তারা বৈধ ঘোষণা করেছিল। অথচ ইনজিল স্পষ্টভাবে এই ঘোষণা দেয়ঃ
‘ঈসা সা. তাওরাতের বিধানগুলোকে নাকচ করে দিতে আসেননি; বরং
তিনি সেগুলোকে পূর্ণতা দিতে এসেছিলেন।১০
এরপরও খ্রিষ্টান যাজকগণ ঘোষণা করে বসেছিলেন
যে, পবিত্র ব্যক্তির জন্য সবকিছু নাকি পবিত্র।১১
এদিকে ইসলামও কিছু বিষয় হালাল করেছে, আবার
কিছু বিষয় হারাম সাব্যস্ত করেছে। কিন্তু
এই হালাল বা হারাম সাব্যস্তকরণের অধিকার মানুষকে দেওয়া হয়নি। ইসলাম এই অধিকারটি কেবল আল্লাহর জন্য বরাদ্দ রেখেছে। আল্লাহ তায়ালা কেবল সেসব জিনিসকে হারাম করেছেন, যেগুলো
অপবিত্র ও ক্ষতিকর। আর সেসব জিনিসকে হালাল করেছেন, যেগুলো
পবিত্র আর উপকারী। এজন্য আহলে কিতাবদের কাছে রাসূল-এর
বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি ছিলঃ
﴿يَأْمُرُهُم بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ
عَنِ الْمُنكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ
الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالَ الَّتِي كَانَتْ
عَلَيْهِمْ ﴾
‘তিনি তাদের সৎ কাজের আদেশ দেবেন, অন্যায় ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ
করবেন। তাদের জন্য পবিত্র জিনিসগুলোকে হালাল এবং
অপবিত্র ও নাপাক জিনিসগুলোকে হারাম সাব্যস্ত করবেন। আর তাদের ওপর চেপে থাকা বোঝাকে তিনি লাঘব করবেন এবং অযাচিতভাবে আবদ্ধ থাকা
শেকল থেকে তাদের মুক্ত করবেন। সূরা আরাফঃ
১৫৭
অন্যান্য সব বিষয়ের মতোই পারিবারিক
বিষয়াদিতেও ইসলামের বিধান হলো মধ্যমপন্থি।
ইসলামের অবস্থান হলো সেই দুটো দলের মাঝামাঝি, যাদের মধ্যে একটি দল
বাঁধাধরাহীনভাবে একাধিক বিয়েকে বৈধতা দেয় এবং অন্য দলটি খুব বেশি প্রয়োজনীয়
হওয়ার পরও একের অধিক বিয়ের যৌক্তিক প্রয়োজনকে অস্বীকার করে।
ইসলাম চারিত্রিক নির্মলতা এবং ব্যয়ভার বহনের
সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে বিয়ের বিধানকে প্রবর্তন করেছে। সেইসঙ্গে দুজন স্ত্রীর মধ্যে ন্যায্যতা বিধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। যদি কেউ ন্যায্যতা বিধানের ক্ষেত্রে আশঙ্কায় থাকে, তাহলে
তার জন্য একটিতেই সীমাবদ্ধ থাকা বাঞ্ছনীয়। যেমনটা
আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
﴿فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا
فَوَاحِدَةً﴾
‘যদি তোমরা ন্যায্যতা বিধান করতে পারার ব্যাপারে আশঙ্কায় থাকো, তাহলে
একটিতেই সীমাবদ্ধ থাকো।’ সূরা নিসাঃ ৩
তালাকের ক্ষেত্রেও ইসলামের অবস্থান হলো দুটো
প্রান্তিক পক্ষের মাঝামাঝি যাদের মধ্যে একটি পক্ষ কারণকে পাত্তা না দিয়ে কিংবা
বৈবাহিক সম্পর্ক জাহান্নামে পরিণত হলেও তালাক দেওয়াকে হারাম করেছে। উদাহরণস্বরূপ, এক্ষেত্রে ক্যাথলিকদের কথা বলা
যায়। আর ক্যাথলিকদের কাছাকাছি হলো অর্থোডক্স
খ্রিষ্টানরা, যারা কেবল ব্যভিচার ও পরকীয়ার ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে তালাকের
বৈধতা দেয় না।
আবার আরেকটি পক্ষ আছে, যারা
তালাকের ক্ষেত্রে একেবারে লাগাম ছেড়ে দিয়েছে। তালাকের মতো একটি বিষয়ের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের শর্তারোপ করেনি। পুরুষ কিংবা নারীদের মধ্য থেকে যে তালাক চাইবে, তার
হাতেই বিষয়টি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে
ঠুনকো কারণে এক নিমিষেই বৈবাহিক জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আর সেইসঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কের মতো একটি শক্তিশালী চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি
মাকড়সার জালের চেয়েও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
এক্ষেত্রে ইসলাম সেই অবস্থায় তালাকের বিধান
রেখেছে, যখন বৈবাহিক সম্পর্ক ঠিকঠাক করার সব মাধ্যম শেষ হয়ে যায় এবং কোনো ধরনের
মধ্যস্থতার পথ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু
এর পাশাপাশি তালাককে আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয় হালাল হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়াও একজন তালাকদাতা দুবার তালাক দেওয়ার পরও
তালাকপ্রাপ্তাকে নতুন করে বৈবাহিক অঙ্গনে ফিরিয়ে আনতে পারার মতো সুযোগ রেখেছে। যেমনটা আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
‘তালাক হলো দুবার। তারপর হয় সুন্দরভাবে
স্ত্রীকে রেখে দেবে,
অথবা সর্বোত্তমভাবে বিদায় করে দেবে।’ সূরা বাকারাঃ
২২৯
সামাজিক বিধান ও নিয়মকানুনের ক্ষেত্রে
ইসলামের অবস্থান ‘লিবারেল-পুঁজিবাদ’ ও ‘মার্ক্সবাদী সমাজতান্ত্রিকতা’র
মাঝামাঝি।
কারণ, পুঁজিবাদীরা সমাজের ওপর
ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেয়। একজন
ব্যক্তির অধিকার হিসেবে যা প্রাপ্য, পুঁজিবাদী সমাজে তার চেয়েও বেশি
দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে ব্যক্তির ওপর যা কর্তব্য হিসেবে
থাকে, তার চেয়েও কম প্রত্যাশা করা হয়। ফলে
ব্যক্তি সর্বদা সবকিছুতেই ‘আমার আমার’ করতে থাকে। কিন্তু তার কাঁধে থাকা দায়িত্বের ব্যাপারে খুব কমই কথা বলে।
আর মার্ক্সবাদী সমাজতান্ত্রিকরা ব্যক্তির
ভূমিকাকে পাত্তা না দিয়ে অধিকার খর্ব করে এবং ব্যক্তির যৌক্তিক স্বাধীনতাকে
বাধাগ্রস্ত করে। পাশাপাশি ব্যক্তির ব্যক্তিগত ঝোঁক বা
প্রবণতাকে বাদ দিয়ে সমাজের ভূমিকাকে বড়ো করে দেখায়।
ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ
ও সমাজবাদিতার মধ্যে সমন্বয়
ইসলামি বিধানের মধ্যে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ
ও সমাজবাদিতা একটি চমৎকার সমন্বিত রূপে প্রকাশিত হয়েছে। এতে ব্যক্তির যৌক্তিক স্বাধীনতা ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা
হয়েছে। অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে সুসমন্বয় ঘটেছে
এবং দায়িত্ব ও সুযোগ-সুবিধার মধ্যে সুষম বণ্টন সম্পন্ন হয়েছে।
অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন দর্শন ও মতবাদ, ব্যক্তি
ও সমাজ এবং এদের মধ্যকার সম্পর্কের ধরন কেমন হবে, সেটি নিয়ে কোনো কূল-কিনারা করতে
পারেনি। প্রশ্ন হলো, যেহেতু একটি সমাজ অনেকগুলো
ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত হয়, সেহেতু এখানে কি ব্যক্তি মূল ভিত্তি, যার ওপর
সমাজ নির্ভর করে আছে?
নাকি এখানে সমাজ মূল ভিত্তি, আর ব্যক্তি হলো গৌণ বিষয়? হ্যাঁ, সমাজ
ছাড়া ব্যক্তি অসম্পূর্ণ ও গুরুত্বহীন এবং সমাজই ব্যক্তিকে গঠন ও যথাযথ কাঠামো
প্রদান করে। এ ছাড়া সমাজ ব্যক্তিকে সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিষ্টাচারসহ
প্রভৃতি বিষয়ের উত্তরাধিকারী হওয়ার সুযোগ করে দেয়।
মানুষের মধ্যে একদল এক দিকে গেছে তো আরেক দল
গেছে অন্য দিকে। এ বিষয়ে দার্শনিক, আইনবিদ, সমাজতাত্ত্বিক, অর্থনীতিবিদ
ও রাজনৈতিকদের মাঝে মতবিরোধ কেবল তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। কিন্তু তাদের কেউ-ই কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেননি।
এরিস্টটল মানুষের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যে
বিশ্বাস করতেন। তিনি ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের ওপর ভিত্তি করে
তৈরি হওয়া বিধান ও নিয়মকানুনের পক্ষে মত দিতেন। অন্যদিকে তাঁর শিক্ষক প্লেটো সমাজবাদ বা সংহতিবাদে বিশ্বাস করতেন, যেমনটা
তাঁর বই দ্যা রিপাবলিক থেকে স্পষ্ট হয়।
একইভাবে মানুষের তৈরি করা সবচেয়ে পুরোনো
গ্রিক দর্শনও এই জটিলতার কোনো সমাধান দিতে পারেনি এবং মানুষকে এই কিংকর্তব্যবিমূঢ়
অবস্থা থেকে বের করতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, বড়ো ও
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে দর্শনের অবস্থা সব সময়ই এমন ছিল-প্রথমে একটি মত
আসে, তারপর ঠিক তার বিপরীত আরেকটি মত আসে। ফলে
দার্শনিকরা প্রকৃত বাস্তবতার ব্যাপারে কখনোই একমত হতে পারে না। এমনকী দর্শন শাস্ত্রের একজন বিশাল পণ্ডিত তো বলেই
দিয়েছিলেনঃ
‘দর্শন হলো এমন একটি বিষয়, যার কোনো সুনির্দিষ্ট মত নেই। কারণ, এটি প্রথমে একটা মত নিয়ে হাজির হয়, তারপর তার বিপরীত মতটি নিয়েও
হাজির হয়।’
পারস্যেও দুটো পরস্পর বিপরীত মতবাদের জন্ম
হয়েছিল। একটি হলো ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ (Individualism)। এই মতবাদটি সন্ন্যাব্রত, তপস্যা ও বিবাহহীনতার দিকে
আহ্বান করত যাতে পৃথিবীর ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করা যায়। কারণ, এই পৃথিবীটা অমঙ্গল,
পাপ আর যাতনায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। এই মতবাদের প্রবক্তা ছিলেন ‘মানি (Mani)’;১২ যিনি ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদের কঠোর প্রতিনিধিত্ব করতেন।
এই মতবাদের বিপরীতে আরেকটি মতবাদের জন্ম
হয়েছিল, যেটি চরম সমাজবাদিতার (Collectivism) প্রতিনিধিত্ব করে। এই মতবাদটির প্রবক্তা হলেন ‘মাজদাক (Mazdak)’;১৩ যিনি নারী ও সম্পদকে সমানভাবে
সবার মাঝে বণ্টন করার আহ্বান করতেন। এর ফলে
অনেক উচ্ছৃঙ্খল জনতা তাকে অনুসরণ করেছে। তারা
অরাজকতার মাধ্যমে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করেছিল। এমনকী তাদের থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন দেশের জনগণ আহাজারি করেছে।
অন্যদিকে ঐশী ধর্মগুলো জীবনের মধ্যে ভারসাম্য
এবং মানুষের মাঝে সুসমতা বিধান করতে এসেছে। যেমনটা
কুরআন বলছেঃ
﴿لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا
بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ
النَّاسُ بِالْقِسْطِ﴾
‘আমি আমার রাসূলদের সুস্পষ্ট নিদর্শন এবং হিদায়াত সহকারে প্রেরণ করেছি। তাঁদের সাথে কিতাব ও মিজান (ভারসাম্য স্থাপনের যন্ত্র)
নাজিল করেছি-যাতে মানুষ ইনসাফ করতে পারে।’ সূরা হাদিদঃ
২৫
কিন্তু সেই ঐশী ধর্মগুলোর অনুসারীগণ খুব
দ্রুত আল্লাহর বাণীকে বিকৃত ও পরিবর্তন করে ফেলে। এজন্য জীবনের ব্যাপারে তাদের অধিকাংশ কর্তব্যগুলো হারিয়ে যায়। ফলে তারা এর প্রথম বৈশিষ্ট্য ‘সবকিছুর উৎস হলেন প্ৰভু-কে
খুঁইয়ে বসে। যার কারণে আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই হালাল বা
হারাম করার ক্ষমতা তারা ধর্মের পাদরিদের ওপর ছেড়ে দেয়। যেমনটা আল্লাহ বলেছেনঃ
﴿اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ
أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا
لِيَعْبُدُوا إِلَٰهًا وَاحِدًا ۖ لَّا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۚ سُبْحَانَهُ عَمَّا
يُشْرِكُونَ﴾
‘তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের পাদরি, দরবেশ ও মরিয়মের পুত্র মাসিহকে
নিজেদের খোদায় পরিণত করেছে। অথচ
তাদের এক মাবুদ ছাড়া আর কারোর বন্দেগি করার হুকুম দেওয়া হয়নি। তিনি এমন এক মাবুদ; যিনি ছাড়া ইবাদত লাভের
যোগ্যতাসম্পন্ন আর কেউ নেই। তারা
যেসব শিরক করে বেড়ায়,
সেসব থেকে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র।’ সূরা তাওবাঃ
৩১
এ কারণে ইসলাম আসার আগে অতীতের কোনো ধর্ম এই
সমস্যার কোনো সমাধান দিতে পারেনি। কারণ, অতীতে
ইহুদিরা বিভক্ত হতো,
আর স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদকে সমর্থন করত। তাদের চিন্তা-চেতনা আর আচার-আচরণের ভিত্তি ছিল স্বার্থপরতা
আর আত্মকেন্দ্রিকতা। যেমনটা কুরআন তাদের
চিত্রায়িত করেছেঃ
﴿وَأَخْذِهِمُ الرِّبَا وَقَدْ نُهُوا عَنْهُ
وَأَكْلِهِمْ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ ﴾
‘তাদের সুদ গ্রহণ করতে এবং অন্যায়ভাবে মানুষের ধন-সম্পদ গ্রাস করতে নিষেধ করা
হয়েছিল।’১৪ সূরা নিসাঃ ১৬১
এদিকে খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারীরা সবকিছুর
আগে ব্যক্তির মুক্তিকে গুরুত্বারোপ করত। আর
সমাজের ব্যাপারটা ছেড়ে দিত কায়সার বা তৎকালীন শাসকের ওপর। অন্তত মাসিহ বা ঈসা সম্পর্কে ইনজিল যা বর্ণনা করেছে, সেটি থেকে
ন্যূনতম তা-ই বোঝা যায়।১৫ যেমনটা তিনি বলেছেনঃ
‘যেটি কায়সার বা রাজার জন্য, সেটি তার জন্য রেখে দাও। আর যেটি আল্লাহর জন্য বরাদ্দ, সেটি আল্লাহকে দাও।১৬
যদি আমরা ইতিহাসের দিকে তাকাই এবং বাস্তবতাকে
আমলে নিই, তাহলে আমরা কী দেখি?
বর্তমান বিশ্বে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ ও
সমাজবাদিতার মধ্যে বেশ ভালো একটি দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। পুঁজিবাদ দাঁড়িয়ে আছে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদের ওপর ভিত্তি করে। পুঁজিবাদ মনে করে, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ হলো
সবচেয়ে ভালো এবং ব্যক্তি হলো মূল কেন্দ্র। ফলে
পুঁজিবাদ ব্যক্তিকে প্রচুর অধিকার দেওয়ার মাধ্যমে প্রশ্রয় দেয়। যে প্রশ্রয় একটি সময়ে নিরঙ্কুশ (Absolute) হয়ে ওঠে। একজন ব্যক্তি লাভ করে মালিকানার অগাধ
স্বাধীনতা, কথা বলার শর্তহীন স্বাধীনতা, খরচ করার বাধাহীন স্বাধীনতা, ভোগ করার স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা যতক্ষণ পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে
অক্ষুণ্ণ রাখছে,
ততক্ষণ পর্যন্ত নিজের কিংবা অন্যের ক্ষতি হলেও কিছু যায় আসে
না। ফলে ব্যক্তি মজুতদারিতা, ঠকানো ও
সুদের মাধ্যমে সম্পদের মালিক হয় এবং আমোদ-প্রমোদ, মদ-নেশা ও লাম্পট্যপনায় সেই
সম্পদ ব্যয় করে। অন্যদিকে গরিব, দরিদ্র, নিঃস্ব
মানুষদের সম্পদ থেকে বঞ্চিত করে।
ভাবখানা এমন যে,
ব্যক্তির ওপর কোনো কর্তৃত্ব চলবে না, যেহেতু
সে-স্বাধীন।
অন্যদিকে সমাজবাদিতা বা সমাজতন্ত্র; বিশেষ
করে এর উগ্রবাদী ভার্সন যেমন মার্ক্সবাদ ব্যক্তির মর্যাদা হ্রাস করে। ব্যক্তির অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে তার কাঁধে শুধু দায়িত্বের
বোঝা চাপিয়ে দেয়। সমাজকেই এর মূলভিত্তি ও উদ্দেশ্য হিসেবে
বিবেচনা করে। ব্যক্তি হলো সমাজ নামক বিশাল একটি যন্ত্রের
ক্ষুদ্র অংশ বা ছোটো চাকা। এখানে
সমাজ মানে মূলত রাষ্ট্র,
আর রাষ্ট্র হলো শাসক দল। আপনি চাইলে আরও নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন, দলটির ঊর্ধ্বতন পরিষদ কিংবা কেবল
দলটির প্রধান। এটাই মূলত একনায়কতন্ত্র।
এখানে একজন ব্যক্তির মালিকানা কেবল নির্দিষ্ট
কিছু ভোগের সামগ্রী এবং অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে সীমিত। ব্যক্তির না বিরোধিতা করার অধিকার আছে, আর না দেশ ও জাতির জন্য রাজনীতি
করার অধিকার আছে। যদি সে প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে সমালোচনা করে, তাহলে
তার কপালে জোটে জেল,
নির্বাসন কিংবা ফাঁসির দড়ি।
মানব রচিত মতবাদ ও দর্শন আর মানুষের দ্বারা
বিকৃত হওয়া ধর্মগুলোর এটাই হলো অবস্থা। আর
উপরোল্লিখিত বিষয়গুলোই হলো ব্যক্তি ও সমাজের সাপেক্ষে তাদের অবস্থান। তাহলে এখন প্রশ্ন হলো, ইসলামের অবস্থান কী?
এক্ষেত্রে ইসলমের অবস্থান একমাত্র সঠিক। ইসলাম উপরোল্লিখিত দুটো পক্ষের কারও দিকেই ঝুঁকে পড়ে না। ইসলাম ডান বা বাম কোনো প্রান্তিক অবস্থান গ্রহণ করে না।
কারণ, ইসলামকে যিনি প্রণয়ন করেছেন, তিনি
হলেন মানুষের সৃষ্টিকর্তা। ফলে
সৃষ্টিকর্তা হিসেবে তাঁর জন্য এটি সমীচীন নয়, তিনি মানুষের জন্য এমন বিধান ও নিয়মকানুন
প্রণয়ন করবেন, যা তার (মানুষের) স্বভাবজাত প্রকৃতির বিপরীত ও বিরোধী। কারণ, তিনি মানুষকে তার স্বভাবজাত প্রকৃতিতে একই সময়ে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য ও
সমাজবদ্ধতার দ্বৈততা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।
ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য হলো ব্যক্তির প্রকৃতির মূল অংশ। এজন্য সে নিজেকে ভালোবাসে। সে
নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। নিজেকে
প্রকাশ করতে চায় এবং বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে নিজেকে স্বনির্ভর করতে চায়।
পাশাপাশি আমরা এও দেখতে পাই, মানুষের
মধ্যে অন্যের সাথে যূথবদ্ধ হয়ে বেঁচে থাকার একটি স্বভাবজাত ঝোঁক রয়েছে। এ কারণে ইচ্ছেমতো খাওয়া-দাওয়া করার সুযোগ থাকার পরেও
জেল-হাজতে একাকী বসবাস করাটা মানুষের জন্য কঠিন শাস্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ কারণে আগেকার বিজ্ঞ মানুষেরা বলতেন, মানুষ
স্বভাবত নগরকেন্দ্রিক। আর আধুনিক
সমাজতত্ত্ববিদগণ বলেছেন,
মানুষ সামাজিক প্রাণী।
ফলে সঠিক পদ্ধতি হলো, মানুষের
জীবনের ব্যষ্টিক ও সামাজিক এই দুটো দিকই বিবেচনা করা এবং একটির ওপর আরেকটিকে
সীমালঙ্ঘন করতে না দেওয়া। এতে
আশ্চর্যের কিছু নেই। ইসলাম এক্ষেত্রে একটি
মাঝামাঝি, ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায়নিষ্ঠ পদ্ধতি নিয়ে এসেছে। কারণ, ইসলাম হলো মানবীয় স্বভাবজাত ধর্ম। ইসলাম
সমাজকে বিবেচনার জন্য ব্যক্তির ওপর বাড়াবাড়ি করে না। আবার ব্যক্তির জন্য সমাজের ওপরও বাড়াবাড়ি করে না।
ইসলাম ব্যক্তিকে অগণিত অধিকার প্রদানের
মাধ্যমে অন্যায় প্রশ্রয় দেয় না। আবার
তাকে অযাচিত কর্তব্যের বেড়াজালে আটকে রেখে বিপদেও ফেলে না। বরং তার জন্য এমনভাবে কর্তব্য ঠিক করে, যেন তা ব্যক্তির সাধ্যের ভেতর
থাকে এবং কোনো ধরনের অসুবিধা বা জটিলতা তৈরি না করে। ইসলাম ব্যক্তির জন্য এমনভাবে অধিকারগুলো নিরূপণ করে, যেন
অধিকার আর কর্তব্যের মাঝে সামঞ্জস্য তৈরি হয়। সে তার প্রয়োজনে ঠিকভাবে সাড়া দিতে পারে, তার সম্মানকে সংরক্ষণ এবং
মানবিকতাকে রক্ষা করতে পারে।
এ কারণেই ইসলামের বিভিন্ন অনুশীলন বা প্রয়োগ
এবং বিভিন্ন নিয়মকানুন বা বিধান এই ভারসাম্য তথা মধ্যমপন্থার প্রতিনিধিত্ব করে। বিশেষত ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয়
ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এই মধ্যমপন্থার প্রতিফলন দেখা যায়। আর সর্বজনীনভাবে রাষ্ট্রীয় ও মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এই ভারসাম্য তথা
মধ্যমপন্থার প্রতিফলন দেখা যায়। এ
ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই।১৭
মধ্যমপন্থার সাথে
আমার সম্পর্কের যোগসূত্র
মধ্যমপন্থার ওপর
আমার নির্ভরতা
একেবারে শুরু থেকেই মহান আল্লাহ তায়ালা
আমাকে মধ্যমপন্থা ও মধ্যমপন্থি ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সম্মান দিয়েছেন। এই সম্মান অর্জন করার বিষয়টি আন্দাজে বা কাউকে অন্ধ
অনুসরণ করা কিংবা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণের ফলে ঘটেনি। বরং মধ্যমপন্থাকে তখনই আপন করে নিয়েছি, যখন আমার কাছে এটি সুস্পষ্ট ও
অকাট্যভাবে প্রতীয়মান হয়েছে, এই পন্থাই যথাযথভাবে ইসলামের সঠিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে
পারে।
আমি এখানে এমন ইসলামকে বোঝাতে চাইছি না, যা কোনো
নির্দিষ্ট শহর, নির্দিষ্ট সম্প্রদায়,
নির্দিষ্ট মতবাদ, নির্দিষ্ট দল বা কোনো নির্দিষ্ট
সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমি বরং সেই ‘আদি ইসলাম’-কে
বোঝাতে চাইছি, যেটিতে ছিল না কোনো ভেজাল, কোনো বিদায়াত বা মৌলিক বিষয়ে বাড়তি কিছু, উম্মাহকে
বিভক্তকারী পঙ্কিল কোনো মতভেদ বা বিতর্ক, অন্যান্য জাতির অমূলক বিশ্বাসের
ছিটেফোঁটা, বাইরে থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা অমূলক চিন্তা-চেতনা ও অদ্ভুত সভ্যতা-সংস্কৃতি।
এখানে ‘আদি ইসলাম’ বলতে
বোঝাতে চাইছি সেই ইসলামকে,
যা কুরআন ও বিশুদ্ধ সুন্নাহর ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেই ইসলাম, যার দিকে রাসূল ডেকে গেছেন
আল্লাহর তরফ থেকে ওহি প্রাপ্ত হয়ে। আর যে
ওহির বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছে স্বয়ং রাসূলের কথা, কাজ ও মৌন সম্মতি। এটি আল্লাহর রাসূল-এর সাহাবিদের সেই ইসলাম, যে
সাহাবিরা ছিলেন তাঁর নিজের হাতে গড়া ছাত্র। যারা
কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার কারণ এবং হাদিসের প্রেক্ষাপটের সরাসরি প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তাঁদের আন্তরিক স্বভাব, সত্য ঈমান আর উপভোগ্য ভাষা
দ্বীনকে সুন্দরভাবে বুঝতে সাহায্য করেছিল।
দ্বীনকে তাঁরা তাঁদের প্রথম শিক্ষকের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলেন এবং নিজেদের জীবনে
তার পরিপূর্ণ প্ৰয়োগ ঘটিয়েছিলেন।
তাঁরা হলেন রাসূলের এমন বন্ধু ও সাথি, যাদের
সম্পর্কে কুরআন প্ৰশংসা করেছে সূরা আল আনফালের শেষে, সূরা আল ফাতহের মাঝখানে ও শেষে। আর সূরা তাওবাতে আল্লাহ বলেছেনঃ
﴿وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ
الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ
اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا﴾
‘মুহাজির ও আনসারদের মধ্য থেকে যারা সবার আগে ঈমানের দাওয়াত গ্রহণ করার
ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে এবং যারা পরবর্তী সময়ে নিষ্ঠা সহকারে তাঁদের অনুসরণ
করেছে, আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাঁরাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট
হয়েছে।’
সূরা তাওবাঃ ১০০
এ ছাড়া তাঁদের সম্পর্কে ব্যাপক প্রচলিত
হাদিসে রাসূল প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেনঃ
خَيْرَ الْقُرُونِ
قَرْنِي ثُمَّ الَّذِينَ يَلُوْنَهُمْ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُوْنَهُمْ
‘সব থেকে উত্তম হলো আমার যুগ, তারপর উত্তম হলো আমার পরের যুগ, আর
তারপর উত্তম হলো আমার পরের পরের যুগ।’১৮
এটি সেই ইসলাম, যেটি সব ধরনের অযাচিত সংযোজন ও
বিদায়াত থেকে মুক্ত। যেটিকে আল্লাহ তায়ালা
উম্মাহর জন্য নিয়ামত করে প্রদান করেছেন। যেমন
তিনি বলেছেনঃ
﴿الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ
وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا﴾
‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের
প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’ সূরা মায়েদাঃ ৩
অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে
আল-ওয়াসাতিয়্যাহ (মধ্যমপন্থি) মানহাজের সঙ্গে আমার সখ্যতা। এক্ষেত্রে খুব সম্ভবত আমার রচিত প্রথম বইটি হলো আল-হালালু ওয়াল-হারামু
ফিল-ইসলাম (ইসলামে হালাল-হারামের বিধান)। ১৯৬০
সালে প্রকাশিত বইটির প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় এই মানহাজ* বা পদ্ধতি সম্পর্কে
সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আমি
সেখানে বলেছিলাম,
ইসলাম নিয়ে যারা গবেষণা করেন এবং কথাবার্তা বলেন, তাদের
অধিকাংশকেই আমি দুটি দলে বিভক্ত হতে দেখেছি।
(মানহাজ অর্থ পথ বা পদ্ধতি। মূলত একজন মানুষ যে পদ্ধতিতে নিজের চিন্তা ও জীবন পরিচালনা
করেন, তাই তার মানহাজ।)
পাশ্চাত্যে উন্নতির চাকচিক্য একদলের চোখকে
ধাঁধিয়ে দিয়েছে। ‘পাশ্চাত্যে উন্নতি’ নামের
এই বিশাল প্রতিমায় মুগ্ধ হয়ে তারা পাশ্চাত্যের সেবাদাসে পরিণত হয়েছে। ফলে তারা নৈকট্য লাভের জন্য মূর্তিটির সামনে নিজেদের
উৎসর্গমালা অর্পণ করে। তাদের বশ্যতা
স্বীকারস্বরূপ তার সামনে চোখ নত করে বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। পাশ্চাত্যের আদর্শ ও ঐতিহ্যকে তারা একেবারে নিখুঁত বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে, যেন এই
আদর্শ ও ঐতিহ্যের কোনো পর্যালোচনা ও বিরোধিতা করা যাবে না। ইসলামের কোনো বিষয় যখন সেই পাশ্চাত্য আদর্শ ও ঐতিহ্যের সাথে মিলে যায়, তখন
তারা আনন্দে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং ‘আল্লাহু আকবার’ বলে ওঠে।
আবার যখন ইসলামের কোনো বিষয় পাশ্চাত্য আদর্শ
ও ঐতিহ্যের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তখন তারা একটু কষ্ট পায়। তারপর চেষ্টা শুরু করে, কীভাবে সেই সাংঘর্ষিক বিষয়ের সাথে পাশ্চাত্য আদর্শ ও
ঐতিহ্যকে খাপ খাওয়ানো যায়। কীভাবে
নির্দোষ প্রমাণ করে কৈফিয়ত দেওয়া যায় অথবা অপব্যাখ্যা দিয়ে পার পাওয়া যায়। অবস্থাটা এমন যেন পশ্চিমা উন্নতি, দর্শন
আর ঐতিহ্যের সাথে মানিয়ে চলাটাই ইসলামের কর্তব্য। ইসলাম যা হারাম করেছে,
সেসব ব্যাপারে তাদের কথাবার্তা থেকে এমনটাই আমাদের কাছে
প্রতীয়মান হয়। আমাদের জানা মতে বিষয়গুলো হলো-মূর্তি বা ভাস্কর্য, জুয়া
বা লটারি, সুদ, অপরিচিতের সাথে নির্জনে মিলিত হওয়া, নারীদের নারীসূলভ আচরণের
বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া,
পুরুষের স্বর্ণ ও রেশম ব্যবহার করা ইত্যাদি।
আবার ইসলাম যা হালাল করেছে, সেসব
বিষয়ে তাদের কথাবার্তা থেকেও এমনটা প্রতীয়মান হয়। যেমনঃ তালাক, পুরুষদের একাধিক বিয়ে। ব্যাপারটা এমন যে, পাশ্চাত্য যা হালাল করেছে, সেটাই
তাদের দৃষ্টিতে হালাল,
আর পাশ্চাত্য যা হারাম করেছে, সেটাই কেবল তাদের দৃষ্টিতে হারাম। অথচ তারা একটি বিষয় ভুলে বসে থাকে সেটি হলো-ইসলাম হলো
আল্লাহর কথা। আর আল্লাহর কথাই সব সময় চূড়ান্ত। আল্লাহর কথা কাউকে অনুসরণ করে না; উলটো
সেটিকেই অনুসরণ করতে হয়। এটি সব সময় সবার ওপরে
থাকে, এর ওপরে কিছু থাকতে পারে না। প্রভু
তাঁর বান্দার অনুসরণ করবে কিংবা সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টির প্রবৃত্তির প্রতি বিনীত
হবে-এটি কীভাবে সম্ভব হতে পারে? এজন্য কুরআন বলছেঃ
‘আর আল-হক বা মহাসত্য আল্লাহ যদি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করতেন, তাহলে
আকাশ, পৃথিবী ও এর মাঝে যা কিছু আছে-সব ওলট-পালট হয়ে যেত।’ সূরা
মুমিনুনঃ ৭১
‘তাদের জিজ্ঞেস করুন,
তোমাদের তৈরি করা শরিকদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে
সত্যের দিকে পথ নির্দেশ করে? বলুন, এক আল্লাহই সত্যের দিকে পথ-নির্দেশ করেন। ফলে আনুগত্য লাভের জন্য তিনি বেশি উপযুক্ত, নাকি
যাকে সত্যের দিকে পথ-নির্দেশ না করলে পথ পায় না-সে বেশি উপযুক্ত? তোমাদের
আসলে কি হয়েছে যে তোমরা উলটা-পালটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসছ?’ সূরা
ইউনুসঃ ৩৫
এরা হলো একটা দল।
এদিকে আরেক দল হালাল-হারামের বিষয়ে কোনো
একটি বইয়ের কিছু উদ্ধৃতি বা বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট কিছু মতের ওপর
নিশ্চল হয়ে বসে থাকে। আর মনে করে, বইয়ের
সেই উদ্ধৃতি বা বক্তব্যটাই হলো ইসলাম। সে তার
মত থেকে একচুল পরিমাণও নড়তে চায় না। আর তার
মাজহাব বা মতের স্বপক্ষে কোনো দলিল বা প্রমাণ আছে কি না, সে
বিষয়ে কখনো নিরীক্ষা,
অন্যদের দলিল-প্রমাণের সঙ্গে তুলনা এবং পর্যবেক্ষণ ও তুলনার
মাধ্যমে সত্যকে বের করে আনার চেষ্টাও করে না।
যখন তাকে মিউজিক, গান, দাবা, নারীশিক্ষা, নারীদের
মুখ ও হাতের তালু খোলা রাখা অথবা এ ধরনের কোনো মাসয়ালা জিজ্ঞেস করা হয়, তখন তার
জিহ্বার গোড়া ও কলমের আগা দিয়ে যে শব্দটি বের হয়, সেটি হলো-’হারাম’। অথচ এই গ্রুপটি এক্ষেত্রে সৎকর্মশীল সালাফদের শিষ্টাচার
ভুলে বসে থাকে। সালাফগণ কেবল সেসব বিষয়ের ক্ষেত্রে হারাম
শব্দটি ব্যবহার করতেন,
যেসব বিষয় অকাট্যভাবে হারাম হিসেবে সাব্যস্ত আছে। এ ছাড়া বাকি বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে তারা বলতেন-’আমরা অপছন্দ
করি’ বা ‘আমরা পছন্দ করি না’
কিংবা এ ধরনের কোনো কথা।
আমি ওপরে উল্লেখিত দুটো প্রান্তিক দলের
কোনোটিতে অন্তর্ভুক্ত না হতে চেষ্টা করেছি।
একদিকে আমি আল্লাহকে রব হিসেবে, ইসলামকে
দ্বীন হিসেবে এবং মুহাম্মাদ-কে রাসূল হিসেবে মেনে নেওয়ার পর দ্বীনের খাতিরেই
পশ্চিমাদের দাসে পরিণত হওয়াকে মেনে নিতে পারিনি।
অন্যদিকে ভুল-ঠিক যাই করুক না কেন, সব
বিষয়ের ক্ষেত্রে কেবল একটি মাজহাবকে অন্ধ অনুসরণ করার বিষয়টি আমি আমার বিবেকের
খাতিরে মেনে নিতে পারিনি। যেমনটা ইবনুল জাওজি
বলেছেনঃ
‘একজন অন্ধ অনুসরণকারী যখন অগ্রহণযোগ্য কোনো বিষয়ের অন্ধ অনুসরণ করে, তখন এই
অন্ধ অনুসরণের অর্থ দাঁড়ায়-সে তার বিবেকের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করছে। কারণ, বিবেককে সৃষ্টি করা হয়েছে গভীর চিন্তা ও গবেষণার জন্য। আর এটি কত জঘন্য একটি কাজ যে, কাউকে
যখন আলোকিত করার জন্য মোমবাতি দেওয়া হয়, তখন সে সেটিকে নিভিয়ে দিয়ে
অন্ধকারে পথ চলে! ১৯
অবশ্যই আমি নিজেকে কখনো ইসলামি বিশ্বে
প্রচলিত কোনো ফিকহি মাজহাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করিনি। কারণ, সত্য কখনো একটি মাজহাবে অন্তর্ভুক্ত থাকে না। এ ছাড়া এসব মাজহাবের ইমামগণ নিজেদের কখনো নিষ্পাপ বলে
দাবি করেননি। সত্যকে জানার ক্ষেত্রে তাঁরা হলেন মুজতাহিদ
গবেষক। যদি তাঁরা ভুল করে থাকেন, তাহলে
তাঁদের জন্য একটি প্রতিদান। আর যদি
তাঁরা সঠিক হন, তাহলে তাঁদের জন্য দুটি প্রতিদান।
ইমাম মালিক রাহি. বলেছেনঃ
‘আল্লাহর নবি ছাড়া বাকিদের সবার কথার কিছু গ্রহণ করা হবে আর কিছু বর্জন করা
হবে।’
আর ইমাম শাফেয়ি রাহি. বলেছেনঃ
‘আমার মতটি সঠিক,
কিন্তু ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। আর অন্যের মতটি ভুল,
কিন্তু সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রাখে।’
একজন মুসলিম স্কলারের জন্য এটি সমীচীন নয় যে, তার
কাছে তুলনা ও প্রাধান্য দেওয়ার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তিনি কেবল একটি মাজহাবে
আটকে থাকবেন। বরং তার কর্তব্য হলো, নিজেকে
দলিল ও নির্ভরযোগ্য সূত্রের সাথে সংযুক্ত রাখা। কারণ, দলিল বা প্রমাণ শক্তিশালী হলে তার সূত্রও শক্তিশালী হবে। আর দলিল দুর্বল হলে তার সূত্রও দুর্বল হবে। বেশ আগে ইমাম মালিক রাহি. বলেছিলেনঃ
‘মানুষ দেখে তুমি সত্য চিনতে যেয়ো না; বরং আগে সত্যকে চেনো। এতে করে তুমি আপনাতেই সত্যের ধারকদের চিনতে পারবে।’২০
এই কথাগুলোই আমি আমার আগের একটি বই ইসলামে
হালাল-হারামের বিধান-এ উল্লেখ করেছিলাম।
আর আধুনিক ইসলামি পুনর্জাগরণের শুরু থেকে
(বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের শুরু থেকে) বিগত প্রায় চল্লিশ বছর ধরে
প্রয়োজনীয়তার খাতিরে মধ্যমপন্থার প্রতি আমার গুরুত্ব ও নির্ভরতা উত্তরোত্তর
বৃদ্ধি পায়।
এই দৃষ্টিভঙ্গি লালনের কিছু প্রমাণ খুঁজে
পাওয়া যাবে আমার বেশ কিছু বইয়ের শিরোনামের মধ্যে। শিরোনামগুলোতে ‘মাঝে’ বা ‘মাঝামাঝি’ শব্দটি বিদ্যমান। যেমনঃ
·
ইসলামি ফিকহঃ
মৌলিকত্ব ও সংস্কারের মাঝামাঝি
·
ইসলামি
পুনর্জাগরণঃ অস্বীকার ও চরমপন্থার মাঝামাঝি
·
ইসলামি
পুনর্জাগরণঃ বৈধ ইখতিলাফ ও নিন্দিত ভেদাভেদের মাঝামাঝি
·
ফতোয়াঃ
দৃঢ়তা ও উপেক্ষার মাঝামাঝি, ইজতিহাদঃ দৃঢ়তা ও শিথিলতার মাঝামাঝি
·
আমাদের
সংস্কৃতিঃ উদারতা ও বদ্ধতার মাঝামাঝি
·
আমাদের
আরব ইসলামি সংস্কৃতিঃ মৌলিকত্ত্ব ও আধুনিকতার মাঝামাঝি এবং অন্যান্য বইপত্র।
খেয়াল করলে দেখবেন, সবগুলো
শিরোনাম দুটো প্রান্তিকতার মধ্যে একটি মধ্যমপন্থি অবস্থানকে প্রতিপাদন করে।
এ ছাড়া মধ্যমপন্থার বৈশিষ্ট্য নিয়ে কিছু
বইতে আমি সংক্ষেপে আলোকপাত করেছি। যেমন-ইসলামি
পুনর্জাগরণঃ অস্বীকার ও চরমপন্থার মাঝামাঝি, ইসলামি পুনর্জাগরণ ও আরব ইসলামি
দেশগুলোর অভিপ্রায়,
ইসলামি আন্দোলনের ভবিষ্যৎ অগ্রাধিকার, ইসলামি
পুনর্জাগরণঃ পরিপক্বতা থেকে সচেতনতা, বিশ্বায়নের এই যুগে আমাদের
ইসলামি বার্তাসহ অন্যান্য বইতে। কিন্তু
আলাদা কোনো বইতে এ ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করিনি।
বেশ কিছু বছর ধরে কিছু তথাকথিত ধার্মিক
ব্যক্তিগণ এই পদ্ধতিটিকে অস্বীকার করে আসছিল। আমাদের ব্যাপারে তাদের অভিযোগ হলো, আমরা নাকি মধ্যমপন্থার নাম করে
দ্বীনকে সহজ করে ফেলছি। শরিয়াহর বিধানে শিথিলতা
নিয়ে আসছি। অন্যদিকে সেক্যুলার, মডার্নিস্ট, মার্ক্সিস্ট
আর তাদের মতো যারা আছে,
তাদের অভিযোগ হলো-আমরা নাকি প্রান্তিকতা ও বাড়াবাড়ি করছি। এটাই হলো ‘মধ্যমপন্থি’ অবস্থানের প্রকৃত রূপ। এটিকে বাড়াবাড়িকারী ও ছাড়াছাড়িকারী উভয় প্রান্তই
প্রত্যাখ্যান করে।
অতীতে যারা আমাদের সমালোচনা করত, তাদের
অনেকেই বর্তমানে আমাদের অনুসৃত মধ্যমপন্থার দিকেই আহ্বান করছে। এমনকী অনেক শাসকগণ মধ্যমপন্থাকে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে
শুরু করেছেন। কারণ, উম্মাহ যে বৈশ্বিক অবস্থা, যুগের
চাহিদা, আঞ্চলিক পরিস্থিতি ও দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো
এই দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলছে। এ
বিষয়গুলো মধ্যমপন্থা পদ্ধতিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার গুরুত্ব প্রতিপাদন করে।
আমি একাধিক দেশে মধ্যমপন্থার ওপর বিভিন্ন
সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছি। এখন সেখানে এই মানহাজকে
আলিঙ্গন করতে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সমস্ত
মর্যাদা, কৃতজ্ঞতা, প্রশংসা ও অনুগ্রহ কেবল আল্লাহর।
মুসলিম উম্মাহর
জন্য মধ্যমপন্থার অপরিহার্যতা
নিশ্চয়ই মধ্যমপন্থা মানহাজটি হলো বর্তমানে
ইসলামি উম্মাহর বিপথগামিতা,
নষ্টামি ও বিনাশ (যা উম্মতের বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে হুমকির
মুখে ফেলে) থেকে মুক্তির সোপান।
উম্মাহর অধিকাংশ বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রায়োগিক
বিষয়গুলোর প্রকৃত অবস্থা দুটো বিচ্ছিন্ন প্রান্তিকতার কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। একটি প্রান্তিকতা হলো-বাড়াবাড়ি বা চরমপন্থা, গোঁড়ামি
বা আতিশয্য। যে নামেই নামকরণ করুন না কেন, এখানে
মূল বিষয়ট হলো-এটি এমন একটি প্রান্তিকতা, যা উম্মাহর ওপর কঠোরতার বোঝা
চাপিয়ে দেয়। উম্মাহকে কষ্টে ফেলে দেয়। উম্মাহর জন্য আল্লাহ যা সহজ করেছেন, সেগুলোকে
কঠিন করে। দ্বীন উম্মাহর জন্য যা সহজসাধ্য করেছে, সেগুলোকে
জটিল করে ফেলে। শরিয়াহ যা কিছু প্রশস্ত করেছে, সেগুলোকে
সংকীর্ণ করে। এই প্রান্তিকতা উম্মাহকে ‘ছাড় গ্রহণ’ করার
সুযোগই দেয় না। ‘দারুরাহ বা আবশ্যক
প্রয়োজনীয়তা’ যে বিষয়গুলোকে প্রয়োজনীয় মনে করে, সেগুলোকে বৈধতা দেয় না।
কোন পরিস্থিতিতে বিধান সহজ হবে, সে
ব্যাপারে এদের ধারণা নেই। সময়, স্থান ও
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ফতোয়ার পরিবর্তনের বিষয়টি এরা মানতেই চায় না। কেবল অতীতকে আঁকড়ে ধরার কারণে এরা অধঃপতনে পতিত হয়। এরা বর্তমানের সাথে একসঙ্গে বসবাস করতে পারে না এবং
ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ওপরেও উঠতে পারে না। এদের
কাছে গভীর প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা হলোঃ
‘পূর্ববর্তীগণ পরবর্তীদের জন্য কিছু রেখে যায়নি (অর্থাৎ পূর্ববর্তীগণ সব
সমস্যার সমাধান করে গেছেন)। ফলে
নতুন করে কিছু করার কোনো সুযোগ এখানে নেই!”
এরা অপরকে গ্রহণ করতে পারে না। অপরের সাথে আলোচনা করে না। বিরোধীদের সাথে পরমতসহিষ্ণু হতে পারে না। পৃথিবীকে এরা শুধু সাদা-কালো চশমায় দেখে থাকে।
আর অন্য প্রান্তিকতাটি হলো-উপেক্ষাকরণ, শিথিলতা, অবহেলা, বিনষ্টকরণ। এরা না কোনো নির্দিষ্ট আকিদাকে আঁকড়ে ধরে, আর না
কোনো ফরজ বা আবশ্যকীয় ইবাদতে লেগে থাকে, আর না কোনো হারামকে হারাম হিসেবে
স্বীকার করে। দ্বীন হলো তাদের কাছে হাতে থাকা নরম ময়দার
খামিরের মতো; যখন যেভাবে ইচ্ছা সেটিকে আকৃতি দেয়। যেন এর
মধ্যে অপরিবর্তনযোগ্য কোনো বিষয়ই নেই। এর
সবকিছুই যেন নতুন নতুন ইজতিহাদের উপযোগী। যেন একে
ইচ্ছেমতো ডান থেকে বামে বা বাম থেকে ডানে সরিয়ে নেওয়া যায়। এর মধ্যে যে বিষয়গুলো সুপ্রতিষ্ঠিত, সেগুলোকে ইচ্ছেমতো প্রত্যাখ্যান
করা যায়। আর যে বিষয়গুলো প্রত্যাখ্যাত, সেগুলোকে
মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। যেন এর
মধ্যে যা কিছু সত্য সেগুলোকে মিথ্যা, আর যা কিছু মিথ্যা সেগুলোকে সত্য
হিসেবে ইচ্ছেমতো প্রতিপন্ন করা যায়।
সম্ভবত কুরআন-সুন্নাহকে নতুন আঙ্গিকে পাঠ
করতে গিয়ে তারা একটি নতুন ধর্ম প্রণয়ন করতে চায়। সেই ধর্ম এই দ্বীনের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়, যেটি আল্লাহর রাসূল তাঁর
সাহাবিদের শিখিয়েছেন এবং সাহাবিগণ শিখিয়েছেন তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম তাবেয়িদের। যে দ্বীনের ওপরে অবিচল থেকেছিলেন উম্মাহর সর্বোত্তম
প্রজন্মগুলো। যে দ্বীনকে উত্তরাধিকার হিসেবে সালাফ বা
পূর্ববর্তী সৎকর্মশীলগণ খালাফ বা পরবর্তীদের জন্য রেখে গেছেন এবং নাতি-নাতকুরাগণ
তাদের দাদা-নানা বা পূর্বপুরুষদের থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। তাদের নব উদ্ভাবিত দ্বীনটি এমন বিষয়কে হারাম সাব্যস্ত করে, যেসব
বিষয়কে মুসলিম উম্মাহ দীর্ঘ ১৪ শতাব্দীর চেয়েও বেশি সময় ধরে দৃঢ়তার সঙ্গে
হালাল হিসেবে বিশ্বাস করে আসছে। আর সে
দ্বীনটি এমন সব বিষয়কে হালাল সাব্যস্ত করে, যে বিষয়গুলোকে মুসলিম উম্মাহ
দীর্ঘ ১৪ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে হারাম সাব্যস্ত করে আসছে। তারা খুব সম্ভবত ইসলামের আকিদাহ, মূল্যবোধগুলোকে
পরিবর্তন করে দিতে চায়। আর ফরজ বিষয়গুলোকে
বিলোপ এবং ইসলামের মধ্যে এমন কিছু বিষয়কে বিধান হিসেবে প্রণয়ন করতে চায়, যার
ব্যাপারে আল্লাহ কখনোই অনুমতি দেননি।
তাদের আচরণ মেনে নিলে প্রত্যেক যুগ, প্রত্যেক
শহর, প্রত্যেকে গ্রুপ,
এমনকী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য একটি করে ধর্ম প্রণয়ন করতে
হবে। এমন অবস্থা হলে ধর্ম কখনোই উম্মাহকে একটি
অভিন্ন মত এবং আল্লাহর রজ্জুকে একসঙ্গে আঁকড়ে ধরার ওপর একত্রিত করতে পারবে না। বরঞ্চ এমন ধর্ম কখনো ‘উম্মাহ’ গঠন করতে পারবে না। কারণ, উম্মাহ গঠন করতে একটি বিশ্বাস, একটি
শরিয়াহ, একটি মূল্যবোধ এবং একটি রিসালাতের প্রয়োজন হয়। এমন অবস্থা হলে এই ধর্ম মানুষকে একত্রিত না করে বিভক্ত করবে। কাছে না টেনে দূরে সরিয়ে দেবে। গড়ার কাজ না করে ভাঙার কাজে আঞ্জাম দেবে। কারণ, পরিবর্তনশীলতার ধারাবাহিকতার ফলে এটি আজীবন শুধু পরিবর্তিত হতেই থাকবে। এদিকে পরিবর্তনশীলতার ধরন, সংস্কৃতি-কার্যকারণ, সমাজবিজ্ঞানের
শিক্ষা-দর্শন, ভাষাতত্ত্বের অধ্যয়ন,
নৃতত্ত্ব ও জ্ঞানতত্ত্ব বিদ্যা এবং নিকট কিংবা দূর ভবিষ্যতে
উদ্ভূত জ্ঞাত বা অজ্ঞাত বিভিন্ন তত্ত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের হবে; এমনকী
ক্ষেত্রবিশেষে পরস্পর বিপরীতমুখীও হবে।
মুসলিম উম্মাহর জাঁহাবাজ জ্ঞানী-গুণীগণ
উসুললুদ-দ্বীন (দ্বীনের মৌলিক বিশ্বাস বা আকিদা), উসুলুল ফিকহ (ফিকহর মূলনীতি), উসুলুত-তাফসির
(তাফসির শাস্ত্রের মূলনীতি), উসুলুল হাদিস (হাদিস শাস্ত্রের মূলনীতি)-এর মতো যেসব মৌলিক
বিষয়ের গোড়াপত্তন করেছেন,
সেসব বিষয়গুলো এই শিথিলপন্থি প্রান্তিক গোষ্ঠীর মাথার ওপর
কিংবা হাঁটুর নিচ দিয়ে যায়।
এদের আবার কিছু ‘নিষ্পাপ’ ইমাম
আছে, যাদের তারা অন্ধ অনুসরণ করে। তাদের
কাছ থেকেই তারা জ্ঞান অন্বেষণ করে, কিন্তু সেসব ইমামদের দাবিকে
পর্যবেক্ষণ বা পর্যালোচনা করে দেখে না।
ভাবখানা এমন, তারা যা বলে এবং বিশ্বাস করে, সেগুলোই কেবল সত্য! আর তারা যে মতামত পেশ করে, সবগুলোই
যেন সঠিক! এদিকে উম্মাহর ইমামদের কাছ থেকে যারা জ্ঞান অর্জন করে, তাদের
এরা তুলাধুনা করে। এদের সমালোচনা শুরু হয় সাহাবি, তাবেয়ি
ও তাঁদের কাছ থেকে জ্ঞান অন্বেষণকারী ইমামদের দিয়ে, যারা ছিলেন জ্ঞান অন্বেষণ ও
গভীরভাবে বোঝা এবং হিদায়াত ও কল্যাণের পথ অন্বেষণের ক্ষেত্রে অনুকরণীয় আদর্শ।
এসব সংস্কারপন্থি বা মর্ডানিস্ট কিংবা
পাশ্চাত্যবাদী-যে নামেই তাদের ডাকেন না কেন, তারা তাদের পশ্চিমা ইমাম বা
নেতাদের পেছনে পেছনে চলে। তাদের প্রতি ইঞ্চি এবং
প্রতি বিঘতে অনুসরণ করে। তারা যা বলে এবং
সিদ্ধান্ত নেয়,
সেগুলোকে তারা কোনো ধরনের আপত্তি, পর্যবেক্ষণ
ও নিরীক্ষা ছাড়াই ছড়িয়ে দেয়।
এত কিছুর পর হলফ করে দাবি করে যে তারা নাকি
মুক্ত, স্বাধীন, উদার ও আলোকিত! অথচ প্রকৃত ব্যাপারটি হলো, তারা কেবল ইসলামের তাৎপর্য ও
মূল্যবোধ থেকেই মুক্ত থেকেছে। সেদিক
থেকে তাদের মুক্ত হিসেবে বিবেচনা করার বিষয়টি ভুল নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রকৃত সত্যটি হলো, এটি মুক্তি নয়; বরং
বিলীন হয়ে যাওয়া। প্রকৃতপক্ষে তারা পাশ্চাত্য
চিন্তার দাস; যেমনটি আমি অনেক আগে থেকে আখ্যায়িত করে আসছি।
নিশ্চয় আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে মধ্যমপন্থি
হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন-’আর এভাবেই আমি তোমাদের একটি মধ্যপন্থি উম্মাহ বানিয়েছি।’ (সূরা বাকারাঃ ১৪৩) এটি সামষ্টিকভাবে সুরক্ষিত। সামষ্টিকভাবে উম্মাহ কখনো ভ্রান্তির ওপর একমত হবে না। তাই এই উম্মাহ তাদের পদ্ধতিকে নাকচ করে, যারা শিথিলতার কারণে ইসলামের
আওতা থেকে নিজেদের ছাড়িয়ে নিয়েছে।
একইভাবে এই উম্মাহ সেসব গোঁড়া, কট্টরদেরও নাকচ করে-যাদের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল সা. জানিয়েছিলেন, তারা
ধ্বংসপ্রাপ্ত। ‘বাড়াবাড়ি যারা করে, তারা
ধ্বংস হয়েছে’-কথাটি তিনি তিনবার বলেছিলেন।২১
এ কারণে নবিদের উত্তরাধিকার, আলিম; যারা
নবুয়তের জ্ঞান ও রিসালাতের উত্তরাধিকার ধারণ করেন এবং বাড়াবাড়িকারীর বিকৃতি, মিথ্যা
প্রতিপন্নকারীদের দাবি এবং অজ্ঞদের ভুল ব্যাখ্যাকে অপনোদন করেন, তারা
অবশ্যই মধ্যমপন্থার ওপর নির্ভর করবেন।
মানুষকে এটি ব্যাখ্যা করে বোঝাবেন। একে
সমর্থন এবং এর বৈশিষ্ট্যগুলোকে স্পষ্ট করবেন। এই মানহাজের ওপর ‘ইত্তিহাদুল আলামি লি-উলামাইল মুসলিমিন (Internation Union of Muslim
Scholars)’ নির্ভর করেছে।
সংগঠনটি তার সদস্যের মধ্যে ‘বিশটি রূপরেখা’ বিলি করেছে, যেগুলো
আমি লিখেছিলাম মধ্যমপন্থা মানহাজকে স্পষ্ট করার জন্য এবং উপস্থাপন করেছিলাম লন্ডনে
অনুষ্ঠিত সংগঠনটির প্রথম বার্ষিক সভায়, ২০০৪ সালের গ্রীষ্মে।
একদিন ভাইয়েরা সংগঠনটির নির্বাহী
কার্যালয়ের আমাকে ‘ইত্তিহাদ’-এর জন্য ‘ইসলামি সনদ’ লিখে দেওয়ার দায়িত্ব দেন। এই সনদ লিখতে আমি সেই মধ্যমপন্থাকে রূপদান করতে মনযোগী হই, যে
পন্থার দিকে আমিসহ অধিকাংশ আলিমগণ প্রতিনিয়ত আহ্বান করেন। তাঁরা হচ্ছেন সেসব আলিম, যারা তাদের শরিয়াহতে বিশ্বাস রাখেন, তাঁদের
উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান ও ঐতিহ্য থেকে ঐশী অনুপ্রেরণা অন্বেষণ করেন এবং
নিজেদের যাপিত সময়ের ব্যাপারে উদাসীন থাকেন না। আর সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যাঁর দয়ায় এই সনদের মধ্যে সেসব আলিমদের প্রত্যাশিত
বিষয়গুলো ফুটিয়ে তুলতে পেরেছি।
নির্বাহী পরিষদের ভাইয়েরা আমার রচিত সনদটিকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদও মোটা দাগে কিছু দৃষ্টি আকর্ষণী
ও সংযুক্তি দেওয়ার মাধ্যমে এই সনদকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সর্বশেষ ধাপে এসে চিন্তার মতপার্থক্য সত্ত্বেও সবাই এটিকে স্বীকৃতি
দিয়েছিলেন।
আনন্দের বিষয় হলো, উম্মাহর
আলিমদের মাধ্যমে এই ন্যায্য, ভারসাম্যপূর্ণ ‘মধ্যমপন্থা’ নামক চিন্তাটি নির্ভরযোগ্য
হিসেবে পরিগণিত হলো।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মধ্যমপন্থাকে
ভালোভাবে বোঝা। এটিকে পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়নের
জন্য কাজ করা, যেন জ্ঞান ও কাজ এবং চিন্তা ও আচরণ সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
আমার চোখে
মধ্যমপন্থার বৈশিষ্ট্য
একজন ব্যক্তি মধ্যমপন্থা মানহাজ অনুসরণ করছে
বলে তার দাবির কোনো অর্থই হবে না, যদি না সে এটিকে ভালোভাবে বুঝতে ও অনুধাবন করতে পারে। কেউ যখন মধ্যমপন্থা বোঝার ইচ্ছে পোষণ করেন, তখন
তিনি কোনো জ্ঞান,
নির্দেশনা ও কুরআন ছাড়া এতে নিবিষ্ট হতে পারবেন না। আর এ কারণে মুসলিম পাঠকদের জন্য মধ্যমপন্থার কিছু
বৈশিষ্ট্য বা নিয়ম উল্লেখ করাটা বাঞ্চনীয় মনে করছি-যাতে করে এই বৈশিষ্ট্যগুলো
মধ্যমপন্থা মানহাজটির জন্য কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক ও শরিয়াহসম্মত মূলনীতি প্রণয়ন
করতে পারে। এতে যে ব্যক্তি এই পন্থাটি অনুসরণ করতে
আগ্রহী হবে, সে যেন এগুলোকে নির্দেশনা খুঁজে পাওয়ার বাতিঘর হিসেবে নিতে পারে এবং এর আলোকে
সুস্পষ্টভাবে পথ চলতে সক্ষম হয়। মহান
আল্লাহ বলেনঃ
﴿أَفَمَن يَمْشِي مُكِبًّا عَلَىٰ وَجْهِهِ
أَهْدَىٰ أَمَّن يَمْشِي سَوِيًّا عَلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ﴾
‘ভেবে দেখ, যে ব্যক্তি মুখ নিচু করে পথ চলছে সে-ই সঠিক পথপ্রাপ্ত, নাকি যে
মাথা উঁচু করে সোজা হয়ে সমতল পথে হাঁটছে সে-ই সঠিক পথপ্রাপ্ত?’ সূরা
মুলকঃ ২২
এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মধ্যমপন্থাকে
আমরা এমন কোনো বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করব না-যেটি তরল, অস্থির
ও নরম জেলির মতো। যে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে এটিকে ব্যাখ্যা করবে, প্রত্যকে
দল নিজেদের এই পন্থার অনুসরণ করছে বলে দাবি করবে এবং নিজেরা যার দিকে আহ্বান করছে, তা-ই
মধ্যমপন্থা বলে দাবি করবে;
এমনটি হতে পারে না।
অনেক দিন ধরে সংক্ষেপে আমি মধ্যমপন্থা
মানহাজের জন্য বিশটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলে আসছি। এগুলো আমি একত্রিতভাবে উপস্থাপন করেছিলাম ‘আল ইত্তিহাদ আল-আলামি লি-উলামাইল
মুসলিমিন’-এর প্রথম সাধারণ বার্ষিক সভায়।
আলিমদের মধ্যে কিছু ভাই আমার কাছে সেসব
বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যাখ্যা করার অনুমতি চেয়েছিলেন। তখন বলেছিলাম,
এগুলোর ব্যাখ্যা সবচেয়ে ভালো করতে পারবেন তিনি, যিনি
এসব লিখেছেন। সে হিসেবে আমার জন্য সেসব বৈশিষ্ট্যগুলো
ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করাটা বাঞ্ছনীয়। বস্তুত
এসব বৈশিষ্ট্য আগেই আমার অনেকগুলো বইতে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল, কিন্তু
সেগুলো ছিল বিক্ষিপ্ত ও ছড়ানো-ছিটানো। তখন
শুধু কাজ ছিল সেগুলোকে একত্রিত করে, সাজিয়ে, দলিল-প্রমাণ
নিয়ে এসে মৌলিক বিষয়গুলোর সাথে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোকে এবং খণ্ডিত বিষয়গুলোর
সাথে সামগ্রিক বিষয়গুলো জুড়ে দেওয়া। এতে
করে পাঠকের কাছে কোনো ধরনের সংশয় ও অস্পষ্টতা থাকবে না।
লেখকরা যা লিখেন, সেটিকে
চিন্তা, উপস্থাপনা ও ধরনের দিক থেকে সর্বোচ্চ সুন্দর করার চেষ্টা করেন। সে আলোকে আমিও এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে ভালোভাবে দেখেছি এবং
বৈশিষ্ট্যগুলোর গঠন ও বিন্যাসকে আবারও সাজিয়েছি। একবার ভাগ করার পর আবার সেগুলোকে অধ্যায়ভিত্তিক সাজিয়েছি। তারপর সব মিলিয়ে বৈশিষ্ট্যগুলোর সংখ্যা ত্রিশে এসে
দাঁড়িয়েছিল। তারপর আবারও সেগুলোর সারসংক্ষেপ করেছি, যেন
আগ্রহী পাঠকের মুখস্থ করতে সুবিধা হয়।
আমি মূলত চেয়েছি, এর
মাধ্যমে ছাত্র ও আগ্রহীগণ যেন এই মধ্যমপন্থি মানহাজ সম্পর্কে জানতে পারে। এর চিত্র, বৈশিষ্ট্যগুলো যেন তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয় এবং এর ভিত্তি ও
উপাদানসমূহ যেন নির্ধারণ করা যায়।
এটিই হলো এ বিষয়ের সর্বশেষ বিন্যাস। আশা করব, এরপর এগুলোকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে আল্লাহ যেভাবে
ভালোবাসেন, ঠিক সেভাবেই ব্যবস্থা করে দেবেন। আমি
আল্লাহর কাছে সেই সক্ষমতা কামনা করি।
১. ইসলাম সম্পর্কে
সামগ্রিক বোধ ও উপলব্ধি
প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো, ইসলামের
পরিপূর্ণ বোধ এবং সামগ্রিক উপলব্ধি থাকা। ঠিক
সেভাবেই ইসলামকে বুঝতে চেষ্টা করা, যেভাবে মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলের
ওপর অবতীর্ণ করেছেন। ইসলামকে সামগ্রিকভাবে
বোঝার মধ্যে আকিদা২২ ও
শরিয়াহ২৩, জ্ঞান ও
কর্ম, ইবাদত২৪ ও মুয়ামালাত২৫, সংস্কৃতি ও নৈতিকতা, অধিকার
ও ক্ষমতা, দাওয়াহ২৬ ও রাষ্ট্র, দ্বীন ও
দুনিয়া, সভ্যতা ও উম্মাহ২৭-সবকিছুই
অন্তর্ভুক্ত হবে।
ইসলামের যাবতীয় শিক্ষা ও বিধানের সব ধরনের
খণ্ডিত রূপকে নাকচ করা হবে। খণ্ডিত
রূপের কিছু উদাহরণ হলো-’ইবাদত ছাড়া নৈতিকতা কিংবা নৈতিকতা ছাড়া ইবাদত। শরিয়াহ ছাড়া আকিদাহ, তালাকের বিধান ছাড়া বিয়ে, জিহাদবিহীন
শান্তি বা আত্মসমর্পণ,
ক্ষমতাবিহীন অধিকার, রাষ্ট্রবিহীন দ্বীন’ ইত্যাদি। ইসলাম নিজেই এসব খণ্ডিত বিষয়কে নাকচ করে। যেমনঃ কুরআনে আল্লাহ বলেছেনঃ
﴿وَأَنِ احْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ
اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَن يَفْتِنُوكَ عَن بَعْضِ
مَا أَنزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ﴾
‘কাজেই আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, সে আলোকে আপনি তাদের মধ্যে
ফয়সালা করুন এবং তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করবেন না। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। যেন
তারা আপনার ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে, তার খণ্ডিত অংশ দিয়ে আপনাকে
ঝামেলায় ফেলতে না পারে।’ সূরা মায়েদাঃ ৪৯
২. কুরআন ও
সুন্নাহকে তথ্যের মূল সূত্র হিসেবে গ্রহণ
ইসলামি জীবনযাপনের জন্য আইন-বিধান প্রণয়ন ও
পরিচালনার ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহকে তথ্যের মূল সূত্র ও প্রত্যাবর্তনস্থল হিসেবে
বিশ্বাস করতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ইসলামি উম্মাহ এই নিষ্পাপ
উৎস দুটো তথা কুরআন ও সুন্নাহকে তার আকিদা, আইন-বিধান প্রণয়ন, শিষ্টাচার, নৈতিকতা, বোধ ও
মানদণ্ডের ক্ষেত্রে মূল সুত্র ও প্রত্যাবর্তনস্থল হিসেবে গ্রহণ করবে।
পাশাপাশি ইসলামি শরিয়াহর সামগ্রিক মাকাসিদ২৮-এর আলোকে কুরআন-সুন্নাহর খণ্ডিত বা
আংশিক বক্তব্যকে বোঝাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। খেয়াল
রাখতে হবে, যেন একটি আরেকটির বিপরীত বা সাংঘর্ষিক না হয় কিংবা সামগ্রিকতার ওপর আংশিকতা
বা আংশিকতার ওপর সামগ্রিকতা প্রাধান্য না পায়। একদিক থেকে ‘আক্ষরিকতাবাদ (Literalism)’ ও অন্যদিক থেকে ‘অপব্যাখ্যা’-এ
দুটো ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে।
পাশাপাশি মুহকামাত বা সুস্পষ্ট বিধান রেখে মুতাশাবিহাত বা অস্পষ্ট বিধান অনুসরণ
করা চলবে না।
৩. ঐশী তাৎপর্য ও
মূল্যবোধকে জোরদার
যেহেতু ঐশী বার্তা ও মূল্যবোধ হলো দ্বীনের
মূল বিষয়, সেহেতু এগুলোকে জোরদার ও সুদৃঢ় করতে হবে। যেমনঃ আল্লাহ ও তাঁর একত্ববাদে বিশ্বাস করা। পরকাল ও পরকালীন হিসাব, প্রতিদান, জান্নাত-জাহান্নামে
দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা। অন্তরের কাজ হিসেবে
আল্লাহর ভয় ও তাকওয়া অর্জন করা।
মানুষকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে, সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য
আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হওয়া।
ইবাদতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা। এই ইবাদত বড়ো বড়ো চারটি আচারের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। সেগুলো হলো-নামাজ,
জাকাত, সিয়াম ও হজ। এগুলো
অবশ্য পালনীয় ইবাদত হিসেবে বিবেচিত। এসবের
পরে নফল কিছু ইবাদত আছে। যেমনঃ
কুরআন তিলাওয়াত,
আল্লাহর জিকির২৯, দুআ ও
ইস্তিগফার৩০।
পাশাপাশি কিছু এমন ইবাদত আছে, যেগুলো
অভ্যন্তরীণ ও অপ্রকাশ্য। যেমনঃ
শুদ্ধ নিয়ত, আল্লাহর জন্য ইখলাস,
আল্লাহর জন্য ভালোবাসা, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, আল্লাহর
দয়ার আশা পোষণ,
আল্লাহর শাস্তির ভয়, আল্লাহর নিয়ামত বা অনুগ্রহগুলোর
জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন,
তাঁর দেওয়া বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ, দুনিয়ার
প্রতি অনাসক্তি,
আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করা। এটাই হলো প্রকৃত সুফিবাদ, যা দাঁড়িয়ে আছে এই মূলনীতির ওপর-“সত্যের সাথে সৎ থাকা এবং
সৃষ্টির সাথে নৈতিক আচরণ করা।’
এক্ষেত্রে কর্তব্য হলো-এই ঐশী বিধান দাওয়াহ, প্রশিক্ষণ, সংস্কৃতি
ও মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা এবং সাধ্যমতো ছড়িয়ে দেওয়া।
এখানে আমরা তাদের অবস্থানকে নাকচ করি, যারা
সুফিবাদকে পুরোপুরি অস্বীকার করে এবং এ থেকে একেবারে মুখ ফিরিয়ে নেয়। একই সঙ্গে আমরা তাদের অবস্থানকেও নাকচ করি, যারা
সুফিবাদের নামে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়া আকিদার মধ্যে শিরক৩১, ইবাদতের মধ্যে বিদায়াত৩২ এবং নেতিবাচক প্রশিক্ষণ-এর চর্চা করে
থাকে।
৪. শরিয়াহর
স্তরের আলোকে তাকলিফ৩৩
শরিয়াহর যেসব স্তর আছে, সেসব
স্তরের আলোকে তাকলিফ ঠিক করতে এবং পালনীয় কর্তব্যের ব্যাপারে ভারসাম্যপূর্ণতার
বোধ থাকতে হবে। কুরআন-সুন্নাহ যেভাবে বলেছে এবং
কর্তব্যগুলোকে আলাদা করেছে,
ঠিক সে আলোকে তাকলিফের অবস্থান ঠিক করতে হবে। যেমনঃ কুরআনে এসেছেঃ
﴿أَجَعَلْتُمْ سِقَايَةَ الْحَاجِّ
وَعِمَارَةَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ كَمَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ
وَجَاهَدَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ﴾
‘তোমরা কি হাজিদের পানি পান করানো এবং মসজিদে হারামের রক্ষণাবেক্ষণ করাকে এমন
ব্যক্তিদের কাজের সমান মনে করে নিয়েছ, যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি
ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর পথে সংগ্রাম-সাধনা করেছে...’ সূরা তাওবাঃ ১৯
অতএব, ছোটো কাজকে বড়ো করে দেখা কিংবা
বড়ো কাজকে ছোটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। যে
কাজটি তাৎক্ষণিক হওয়ার দাবি রাখে, সেটিকে দেরিতে করা কিংবা যেটি
দেরিতে হওয়ার দাবি রাখে,
সেটিকে তাৎক্ষণিকভাবে করার কোনো সুযোগ নেই। এই ক্রমধারার আলোকেই আকিদাকে ইবাদতের আগে, মৌলিক
বিষয়কে শাখা-প্রশাখাগত বিষয়ের আগে, ফরজকে নফলের আগে, মূল
ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত ফরজকে অন্যান্য ফরজের আগে, ফরজে আইনকে৩৪ ফরজে কিফায়ার৩৫ আগে, শিরককে অন্যান্য গুনাহর আগে, বড়ো
গুনাহকে ছোটো গুনাহর আগে,
সর্বসম্মত হারামগুলোকে মতপার্থক্যযুক্ত হারামগুলোর আগে, গুণমানকে
(Quality) পরিমাণের (Quantity)
আগে,
মূল উপাদানকে বাহ্যিক গঠনের আগে, অভ্যন্তরীণ
বিষয়কে প্রকাশ্য বিষয়ের আগে, অন্তরের কর্মকে দৈহিক কর্মের আগে প্রাধান্য দেওয়া আবশ্যক। পাশাপাশি অকাট্য বিষয়কে সম্ভাবনাযুক্ত বিষয়ের আগে, কুরআন-সুন্নাহর
বক্তব্য দ্বারা প্রতিপাদিত বিষয়কে ইজতিহাদের মাধ্যমে প্রতিপাদিত বিষয়ের আগে, ঐক্যমত
আছে এমন বিষয়কে মতপার্থক্যযুক্ত বিষয়ের আগে প্রাধান্য দেওয়াটাও বাঞ্ছনীয়। এই বিষয়কে আমি ‘অগ্রাধিকারের ফিকহ (ফিকহুল আওলাউইয়াত)’
হিসেবে নামকরণ করেছি।
৫. নৈতিক ও
চারিত্রিক মূল্যবোধ
ইসলাম যেসব নৈতিক ও চারিত্রিক মূল্যবোধকে
গুরুত্ব দিয়েছে,
সেগুলোকে অনুসরণ করতে হবে। কারণ, ইসলাম চারিত্রিক ও নৈতিক মূল্যবোধকে ঈমানের শাখা হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। এ ছাড়া মহান আল্লাহ চারিত্রিক ও নৈতিক মূল্যবোধকে ফরজ
ইবাদতের ফলাফল বা পরিণতি হিসেবে ঘোষণা করেছেন। হাদিসে এসেছে-“নিশ্চয়ই আমাকে মহৎ চরিত্র ও নৈতিকতাকে পূর্ণ করতে পাঠানো
হয়েছে।৩৬
চরিত্রহীনতা ও নীতিহীনতাকে মুনাফিকের আচরণ
হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এখন
সেটি ব্যক্তিগত পর্যায়ের নৈতিকতাও হতে পারে। যেমনঃ সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা, কথা
দিয়ে কথা রাখা,
চুক্তি করলে সেটি যথাযথভাবে পূরণ করা, বিবাদের
সময় ন্যায়পরায়ণ থাকা,
নম্রতা ও লজ্জাশীলতা, দানশীলতা, সাহসিকতা, ব্যভিচার
থেকে সংযমী হওয়া।
আবার সেটি সামাজিক পর্যায়ের নৈতিকতাও হতে
পারে। যেমনঃ ন্যায্যতা ও ইহসান
(পরোপকার), পিতা-মাতার সাথে সুন্দর ব্যবহার, আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সাথে
সুন্দর সম্পর্ক,
দুর্বলদের দয়া দেখানো, ভালো ও তাকওয়ার কাজে পরস্পরকে
সহযোগিতা করা, সংঘবদ্ধ হয়ে থাকা,
নিকটাত্মীয়, মিসকিন, মুসাফিরদের
অধিকার ঠিকঠাকভাবে বুঝিয়ে দেওয়া, সম্পদ ব্যয় করার ক্ষেত্রে অপচয়
বা অপব্যয় না করা এবং কৃপণতা পরিহার করা।
যারা নিজেদের চরিত্র ও নৈতিকতা পরিশুদ্ধ করার
তোয়াক্কা না করে শুধু আচারসর্বস্ব ইবাদতকেই সবকিছু মনে করে, তাদের
অবস্থানকে অস্বীকার করতে হবে।
পাশাপাশি তাদের অবস্থানকেও অস্বীকার করতে হবে, যারা তাদের প্রভুর দেওয়া ফরজ
ইবাদতের তোয়াক্কা না করে চারিত্রিক নৈতিকতাকেই সবকিছু বলে মনে করে।
৬. উপযুক্ত
ব্যক্তি দ্বারা যথাযথ স্থানে সংস্কার ও ইজতিহাদ
দ্বীনের সংস্কার দ্বীনের অভ্যন্তরেই হতে হবে। ইজতিহাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ছাড়া শরিয়াহ এগিয়ে
যেতে পারে না, তাই ইজতিহাদের সূচনাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। এখন সেটি গঠনমূলক বা বাছাইমূলক ইজতিহাদ, সামগ্রিক বা খণ্ডিত ইজতিহাদ অথবা
ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক ইজতিহাদ হতে পারে। কিন্তু
এক্ষেত্রে অবশ্যই যোগ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তিকেই ইজতিহাদ করতে হবে। এখানে উপযুক্ত ব্যক্তি হলেন তারা, যাদের
মধ্যে প্রচলিত ইজতিহাদের শর্তগুলো পাওয়া যায়। আর ইজতিহাদ অবশ্যই যথাযথ স্থানে হতে হবে। অর্থাৎ অকাট্য বিষয়ে কোনো ইজতিহাদ চলবে না। কারণ, অকাট্য বিষয়গুলো উম্মাহর বিশ্বাসগত, বুদ্ধিবৃত্তিক, চেতনাগত
ও ব্যবহারিক ঐক্যকে বিনির্মাণ করে। অকাট্য
বিষয়গুলো সংখ্যায় খুব অল্প হলেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই বিষয়গুলো এমনভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত, যেগুলোতে কোনো অবস্থাতেই
পরিবর্তন আনার কোনো সুযোগ নেই।
এক্ষেত্রে তাদের অবস্থানকে নাকচ করতে হবে, যারা
ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করে দিতে চায় এবং সব আলিমকে অন্ধ অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক
হিসেবে প্রমাণ করতে চায়। পাশাপাশি তাদের
অবস্থানকেও নাকচ করতে হবে,
যারা যেকোনো ব্যক্তির জন্য যেকোনো বিষয়ে ইজতিহাদের দরজা
খুলে দেয়।
৭. সুপ্রতিষ্ঠিত
বিষয় ও পরিবর্তনশীল বিষয়ের মাঝে ভারসাম্য স্থাপন
শরিয়াহর মধ্যে থাকা সুপ্রতিষ্ঠিত বিষয়গুলো
এবং যুগের আলোকে পরিবর্তনশীল বিষয়গুলোর মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হবে। সুপ্রতিষ্ঠিত বিষয়গুলোর ব্যাপারে কোনোভাবেই উদাসীন হওয়ার
কোনো সুযোগ নেই। একইভাবে পরিবর্তনযোগ্য বিষয়গুলোকেও উপেক্ষা
করার সুযোগ নেই। আবার সুপ্রতিষ্ঠিত বিষয়গুলোকে পরিবর্তনশীল
বিষয়ে রূপান্তর করা কিংবা পরিবর্তনশীল বিষয়কে সুপ্রতিষ্ঠিত বিষয়ে পরিণত করারও
সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে ফতোয়া৩৭, দাওয়াহ ও প্রশিক্ষণের পদ্ধতির
মধ্যে সময়, স্থান, অবস্থা ও উরফ৩৮-এর
পরিবর্তনের প্রভাব লক্ষ রাখা আবশ্যক।
পাশাপাশি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ক্ষেত্রে অপরিবর্তনশীল সুপ্রতিষ্ঠিত বিষয়গুলোর
প্রতি লক্ষ রাখাও বাঞ্ছনীয়।৩৯ সেইসঙ্গে মাধ্যম ও উপলক্ষ্যের ক্ষেত্রে নমনীয় হওয়া এবং
এর ক্রমবিকাশকে মেনে নেওয়াটা আবশ্যক। এক্ষেত্রে
সামগ্রিক ও মৌলিক বিষয়গুলো অপরিবর্তনশীল থাকবে এবং শাখা-প্রশাখামূলক ও খণ্ডিত
বিষয়গুলোর পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নমনীয়তা থাকবে।
আধুনিকায়ন, জ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি, ইতিবাচক
অগ্রগতি; যা জীবন ও মানুষকে উন্নীত করে, সেগুলোকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে
গ্রহণ করব। সেইসঙ্গে আমরা পশ্চিমায়নকে প্রত্যাখ্যান
করব; যা মুসলিম উম্মাহকে আধুনিকতা, বিশ্বায়ন ইত্যদির নামে তার স্বরূপ থেকে বিচ্যুত করতে এবং
তাকে অন্যান্য জাতির অনুসরণে বাধ্য করতে চায়।
এক্ষেত্রে আমরা তাদের অবস্থানকেও নাকচ করব, যারা
শরিয়াহর দোহাই দিয়ে জীবনকে নিথর ও নিশ্চল করে রাখে এবং কোনো ধরনের উন্নতি ও
যৌক্তিক পরিবর্তনকে মেনে নিতে চায় না।
পাশাপাশি তাদের অবস্থানও আমরা নাকচ করব-যারা ইসলাম, ভাষা, সূর্য, চন্দ্র
সবকিছুই পরিবর্তন করে ফেলতে চায়।
৮. ফতোয়ার
ক্ষেত্রে সহজীকরণ পদ্ধতির অনুসরণ
ফিকহ ও ফতোয়ার ক্ষেত্রে সহজ ও লঘু করার
পদ্ধতিকে অনুসরণ করতে হবে। এমনটা
করা মানে কুরআনকে অনুসরণ করা। যেমনঃ কুরআনে এসেছেঃ
﴿ يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا
يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ﴾
‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজতা চান, তিনি তোমাদের জন্য কাঠিন্য চান
না।’
সূরা বাকারাঃ ১৮৫
﴿وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ
حَرَجٍ ﴾
‘দ্বীনের মধ্যে আল্লাহ তোমাদের জন্য কষ্টসাধ্য কিছুই রাখেননি।’ সূরা হজঃ ৭৮
একই সঙ্গে সহজতার অনুসরণ স্বয়ং রাসূল-এরও
পদ্ধতি। যেমনঃ তিনি বলেছেনঃ
‘তোমরা সহজ করো,
কঠিন করো না।
তোমাদের সহজ করার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে, কঠিন করার জন্য প্রেরণ করা হয়নি।৪০
এখন সহজীকরণের কিছু উদাহরণ হলো-কোনো বিষয়কে
ওয়াজিব ও হারাম সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাবধান ও সংযত থাকা, রুখসাহ৪১কে কেন্দ্র করে ফতোয়া দেওয়া; বিশেষ
করে অনিবার্য আবশ্যক প্রয়োজনীয় সময়ে।
ফাতোয়ার সময় ‘অনিবার্য আবশ্যক প্রয়োজনীয়তা (দ্বারুরাহ) হারামকে হালাল করে’, ‘প্রয়োজনীয়তা
(হাজাহ) মাঝে মাঝে অনিবার্য আবশ্যক প্রয়োজনীয়তায় (দারুরাহ) রূপান্তরিত হয়’-এর মতো
সর্বজনীন ফিকহি নীতিমালাগুলোকে অনুসরণ করতে হবে। শরিয়াহর সেসব উৎসের ব্যাপারে নমনীয় হতে হবে, যেসব উৎসের ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহর
স্পষ্ট বক্তব্য নেই। যেমনঃ
ইস্তিসলাহ৪২, ইস্তিহসান৪৩, ‘উরফ বা প্রথাকে বিবেচনা করা৪৪”, সাদ্দুজ জারিয়াহ।
এক্ষেত্রে কড়াকড়ি যদি করতেই হয়, সেটি
শাখা-প্রশাখাগত বিষয়ে না করে মৌলিক বিষয়ে করাটাই বাঞ্ছনীয়। কারণ, আল্লাহর রাসূল বাড়াবাড়ি, কড়াকড়ি, চাপাচাপি, কঠিন করা থেকে সতর্ক ও সাবধান করেছেন।
এখানে লক্ষ করার মতো একটি বিষয় আছে। সহজীকরণ পদ্ধতি যেখানে সকল যুগের জন্য কাঙ্ক্ষিত হিসেবে
বিবেচিত, সেখানে বর্তমান সময়ে এই পদ্ধতির প্রয়োগ হওয়াটা আরও অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। কারণ, বর্তমান সময় এমন একটি সময়, যেখানে আধ্যাত্মিকতার ওপর
বস্তুবাদ প্রাধান্য বিস্তার করার কারণে মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে গেছে। ভালো কাজের বিপরীতে প্রচুর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে, আর মন্দ
কাজ প্রচণ্ড চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছে। এখানে
কাঙ্ক্ষিত সহজীকরণের অর্থ এটি নয় যে, শুধু বাস্তবতাকেই আমলে নেওয়া বা
পাশ্চাত্যের সাথে তাল মিলিয়ে চলা কিংবা শাসকদের সন্তুষ্ট করা। কিংবা এর অর্থ এটিও নয়, সহজীকরণের নামে জোরপূর্বক
কুরআন-হাদিসের বক্তব্যকে বিকৃত করে হারামকে হালাল করা এবং হুকুম বা বিধানকে বিকৃত
করা। নিঃসন্দেহে এ রকম কাজ প্রত্যাখ্যাত। একইভাবে তাদের অবস্থানটিও প্রত্যাখ্যাত, যারা
আল্লাহ যা সহজ করেছেন,
সেগুলোকে কঠিন করে এবং আল্লাহর বান্দাদের জন্য সহজ করা
হয়েছে-এমন গ্রহণযোগ্য মতকে এড়িয়ে চলে।
৯. দাওয়াহর
ক্ষেত্রে ইতিবাচকতার চর্চা
প্রশিক্ষণের সময় ভালোভাবে বোঝানো, বোধকে
বিশুদ্ধ করা, মুমিনদের কর্তব্য স্মরণ করিয়ে তা অন্তরে গেঁথে দেওয়া, ইসলামের
তাৎপর্যগুলোকে ব্যাখ্যা করা, ইসলামবিরোধীদের আপত্তির প্রত্যুত্তর দেওয়া-এসব কার্যক্রমের
মাধ্যমে
মুসলিমদের কাছে ইসলামের দাওয়াহ পৌঁছে
দেওয়ার পদ্ধতিকে উন্নত করতে হবে।
পাশাপাশি অমুসলিমদের মাঝেও একইভাবে ইসলামের দাওয়াহ ছড়িয়ে দিতে হবে। কারণ, ইসলামের দাওয়াহ একটি বৈশ্বিক চিরস্থায়ী দাওয়াহ; যা
সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরিত হয়েছে। যেমনঃ কুরআনে এসেছেঃ
﴿وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً
لِّلْعَالَمِينَ﴾
‘আমি আপনাকে পুরো বিশ্ববাসীর জন্য দয়া হিসেবে প্রেরণ করেছি।’ সূরা আম্বিয়াঃ ১০৭
পাশাপাশি দাওয়াহর কাজকে ভালোভাবে পরিচালনা
এবং বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ভাষায় তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট
চ্যানেলসহ অন্যান্য সমসাময়িক মাধ্যমকে ব্যবহার করতে হবে। সেইসঙ্গে মৌলিক বিষয়গুলোকে যথাযথভাবে যত্ন করার পাশাপাশি সমসাময়িক পদ্ধতি ও
প্রেরণাকেও কাজে লাগাতে হবে।
মুসলিমদের দাওয়াহ দিতে হবে হিকমাহ বা
প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে, যেমনটা কুরআন বলেছে। আর বিরোধীদের দাওয়াহ দিতে হবে পারস্পরিক উত্তম
আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। এখন সেই ভিন্ন মতাবলম্বী
হতে পারে দ্বীনের মৌলিক বিষয়ের কিংবা দ্বীনের ভেতরে প্রচলিত বিভিন্ন মতবাদের অথবা
হতে পারে অন্য যেকোনো বিষয়ের।
দাওয়াহর ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদ্ধতি আর ফতোয়ার ক্ষেত্রে সহজ পদ্ধতির চর্চা করতে হবে। এই চর্চার ফলে নবি-এর আদেশ উৎসরিত যুগপৎ পদ্ধতিটি পূর্ণতা
পাবে। যেমনঃ রাসূল বলেছেনঃ
‘তোমরা সহজ করো,
কঠিন করো না।
ইতিবাচকতা ছড়িয়ে দাও,
বীতশ্রদ্ধ করো না।’৪৫
দাওয়াহর মধ্যে ইতিবাচকতা চর্চার অর্থ হলো, আমরা
ভয় দেখানোর আগে আশার আলো ছড়িয়ে দেবো।
শাস্তির কথা বলার আগে প্রতিদানের কথা বলব। হতাশা
ও নিরাশার বদলে আশান্বিত হওয়ার কারণগুলোতে গুরুত্বারোপ করব। ইসলাম সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকবে যে, এটি একটি আশাবাদী দ্বীন। এতে নৈরাশ্যবাদের কোনো স্থান নেই। এটি আশা পোষণ করার দ্বীন; এতে হতাশার কোনো স্থান নেই। এটি ভালোবাসা প্রকাশের দ্বীন; ঘৃণা ছড়ানোর দ্বীন নয়।
এটি পরস্পরকে কাছে টেনে নেওয়ার দ্বীন; অন্যকে
উপেক্ষা করার দ্বীন নয়। এটি পারস্পরিক
আলাপ-আলোচনার দ্বীন;
বিবাদ করার দ্বীন নয়। এটি সহানুভূতিশীল হওয়ার দ্বীন; কঠোর আচরণের দ্বীন নয়। এটি দয়া প্রকাশ করার দ্বীন; নিষ্ঠুরতা প্রকাশের দ্বীন নয়। এটি হলো শান্তির দ্বীন; যুদ্ধের দ্বীন নয়। এটি গড়ে তোলার দ্বীন; ভেঙে ফেলার দ্বীন নয়। এটি ঐক্যবদ্ধ করার দ্বীন; বিভক্ত করার দ্বীন নয়। সেইসঙ্গে দাওয়াহকে পরিপূর্ণতা লাভ করার জন্য ইবাদত, সংস্কৃতি, শরীরচর্চা
ও শিল্প-এসবের ওপর সমানভাবে গুরুত্বারোপ করতে হবে। কারণ, ইবাদত আত্মার খাদ্যের জোগান দেয়।
সংস্কৃতি বিবেকের খাদ্যের জোগান দেয়।
শরীরচর্চা দেহের শক্তির জোগান দেয়। আর
শিল্প অন্তরের খাদ্যের জোগান দেয়।
১০. প্রজ্ঞাপূর্ণ
ধারাবাহিকতার চর্চা
দাওয়াহ, প্রশিক্ষণ, ফতোয়া
প্রদান ও ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রজ্ঞাপূর্ণ ধারাবাহিকতার চর্চা করতে হবে। এসব বিষয়ে যথাযথ সময় আসার আগে তাড়াহুড়ো করে কিছু করা
যাবে না। ধারাবাহিকতার চর্চা করা একটি বৈশ্বিক পদ্ধতি। একই সঙ্গে ধারাবাহিকতার চর্চা করা ইসলামেরও পদ্ধতি। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
﴿فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُولُو الْعَزْمِ
مِنَ الرُّسُلِ وَلَا تَسْتَعْجِل لَّهُمْ﴾
‘হে রাসূল! আপনি দৃঢ় সংকল্প রাসূলদের মতো ধৈর্যধারণ করুন। আর তাদের ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করবেন না।’ সূরা আহকাফঃ
৩৫
এমনকী মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনকে ২৩ বছর
সময় নিয়ে অবতীর্ণ করেছিলেন, যেন মানুষ সেটি ধীরে-সুস্থে পড়ে নিজের জীবনের গতি-প্রকৃতির
সাথে ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং তাদের কাছে উদ্ভূত প্রশ্নগুলোর উত্তর
ধীরে-সুস্থে দিতে পারে। যেমনঃ
কুরআনে আল্লাহ বলেছেনঃ
﴿وَلَا يَأْتُونَكَ بِمَثَلٍ إِلَّا
جِئْنَاكَ بِالْحَقِّ وَأَحْسَنَ تَفْسِيرًا﴾
‘আর যখনই তারা আপনার সামনে কোনো অভিনব কথা বা প্রশ্ন নিয়ে এসেছে, তার
সঠিক জবাব যথাসময়ে আমি আপনাকে দিয়েছি এবং সর্বোত্তম পদ্ধতিতে বক্তব্য স্পষ্ট করে
দিয়েছি।’
সূরা ফুরকানঃ ৩৩
১১. পারস্পরিক
বিপরীত বিষয়গুলোর সমন্বয়
আধ্যাত্মিকতা বনাম বস্তুবাদ, আল্লাহমুখিতা
বনাম মানবিকতা, বিবেক বনাম অন্তর,
দুনিয়া বনাম আখিরাত, আল্লাহর অধিকার বনাম নিজের
অধিকার বনাম অন্যের অধিকার,
বস্তুগত সৃজনশীলতা বনাম অর্থনৈতিক সৃজনশীলতা এবং আধ্যাত্মিক
উন্নতি বনাম চারিত্রিক উন্নতি-এসব পরস্পর বিপরীত বিষয়গুলোর মধ্যে সুসমন্বয় সাধন
করার প্রতি জোর আহ্বান করতে হবে; যেন প্রতিটি দিক ও বিভাগ তার যথাযথ অংশ বুঝে পায়। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, যেন একটি দিক অন্য দিককে
অন্যায়ভাবে ছাপিয়ে যেতে না পারে।
১২. শান্তি ও
জিহাদ
শান্তির জন্য যারা সত্যিকার অর্থে হাত
বাড়িয়ে দেবে, তাদের শান্তির দিকে আহ্বান করতে হবে। কোনো
আবশ্যকীয় প্রয়োজন ছাড়া ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে মানবজাতিকে দূরে রাখতে হবে। রাষ্ট্রগুলোর মাঝে সন্ধি ও চুক্তি বজায় রাখার চেষ্টা করতে
হবে। যতটুকু পারা যায় শান্তির পাখাকে মেলে ধরতে
হবে। তবে এসবের পাশাপাশি দ্বীন তথা ইসলামের
সম্মান ও পবিত্রতা,
ইসলামের ভূমি, ইসলামের উম্মাহ বা জাতি, পৃথিবীর
বুকে নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষদের বাঁচানো এবং উদ্ধত ও স্বৈরাচারী শাসকদের থামানোর
জন্য আল্লাহর পথে জিহাদের আবশ্যকীয়তা মাথায় রাখতে হবে। শত্রুকে সন্ত্রস্ত রাখার জন্য সাধ্যে যেটুকু কুলায়, সে
আলোকে সর্বোচ্চ শক্তিশালী সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। সেইসঙ্গে জিহাদের প্রকারভেদ ও ক্ষেত্রগুলো বর্ণনা করতে হবে। যেমনঃ মানসিক ও আত্মিক জিহাদ, দাওয়াহর
মাধ্যমে জিহাদ, বেসামরিক জিহাদ,
অন্তর্নিহিত অন্যায় ও অপকর্মের বিরুদ্ধে জিহাদ থেকে শুরু
করে সর্বশেষ সামরিক জিহাদ।
এখানে আবশ্যকীয় জিহাদ হলো-সৎ কাজের আদেশ এবং
অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা,
ঘৃণ্য ও খারাপ কাজকে হাত-মুখ কিংবা অন্তর দিয়ে সাধ্যমতো
পরিবর্তন করা।
১৩. ইসলামের অধীনে
ভূমিগুলোকে মুক্ত করার আবশ্যকীয়তা
মুসলিম উম্মাহকে এ ব্যাপারে সচেতন করতে হবে
যে, উড়ে এসে জুড়ে বসা ভিনদেশি অপরিচিত শাসন থেকে ইসলামের ভূমিগুলোকে মুক্ত করার
জিহাদটি ফরজে আইন। এজন্য বৈদেশিক দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে
প্রতিরোধ গড়ে তোলাটা দ্বীনের আবশ্যকীয় ফরজ-যাতে তাদের ইসলামের ভূমি থেকে
বিতাড়িত করা যায়।
প্রথম যে ভূমি মুক্ত করাটা আবশ্যক, সেটি
হলো ফিলিস্তিনের ভূমি। এই ভূমি ইসরা ও মিরাজের
ভূমি হিসেবে খ্যাত। বাইরে থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা জায়োনবাদী
উপনিবেশবাদ এই ভূমিকে আগ্রাসনের মাধ্যমে দখল করে নিয়েছে। আগ্রাসনের ক্ষেত্রে সব পশ্চিমা রাষ্ট্রের সহায়তা নিয়েই তারা সেই ভূমিটি দখল, সেখানকার
স্থায়ী অধিবাসীদের বিতাড়ন, তাদের হত্যা, তাদের নিরাপত্তাকে নস্যাৎ করে
ফিলিস্তিনিদের দেহের ওপর তাদের রাষ্ট্রের ভিত গড়ে। জায়োনবাদী,
হিংস্র, বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক এবং উড়ে এসে জুড়ে বসা এই উপনিবেশবাদ অস্ত্র, বোমা আর
রক্তের মাধ্যমে মুসলিম ও আরব দেশের কেন্দ্রে, মুসলিমদের নাকের ডগায় তাদের
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।
এই রাষ্ট্রটি কেবল জবরদখলের মাঝেই সীমাবদ্ধ
নেই; বরং এর মূল চিন্তাধারা ও উদ্দেশ্য হলো ফোরাত নদী থেকে নীলনদ পর্যন্ত এবং এর
ভেতর উৎপন্ন ধান থেকে শুরু করে খেজুর পর্যন্ত সবকিছু দখল করা। এই দখলদার রাষ্ট্রটি পুরো ফিলিস্তিন শুধু নয়; এর সাথে আরব দেশের কিছু অংশেও
দখলের মাধ্যমে বসতি স্থাপন করেছে।
ফিলিস্তিন ও এর আশপাশে তারা এখনও বেহিসাবে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। এই হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ক্ষেত্রে তারা আমেরিকার টাকা
ও অস্ত্রের সাহায্য নিচ্ছে। আর
মার্কিন রাজনীতি এই অঞ্চলে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ইজরাইলকে ব্যবহার
করছে, যেন একেবারে এসব অঞ্চলকে আমূল পরিবর্তন করা যায়। এমনকী তারা এটির নামও পরিবর্তন করতে সচেষ্ট আছে; যেহেতু
এটি সবচেয়ে বড়ো বা নতুন মধ্যপ্রাচ্য।
মুসলিম উম্মাহর কর্তব্য হলো, এই
মার্কিনি-জায়োনবাদী দ্বৈত উপনিবেশবাদকে মোকাবিলা করা। এই উপনিবেশবাদ সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। এরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মোড়কে মূলত ইসলামের
বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করছে।
১৪. ধর্মীয়
সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ
ইহুদি, খ্রিষ্টান, মাজুসি
(অগ্নি উপাসক/Magianist)
বা অন্য যেকোনো ধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘুদের অধিকারের স্বীকৃতি
দিতে হবে। ইসলাম তাদের সাথে যেভাবে আচরণ করতে বলেছে, ঠিক
সেভাবে আচরণ করতে হবে। যেমনঃ
তারা যেভাবে নিজের ধর্ম পালন করতে চায়, সেভাবে করতে দেওয়া। তাদের বিশ্বাস বা ধর্মাচার বা ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক না
গলানো। মুসলিম উম্মাহর ফকিহদের ইজমা বা ঐক্যমতের
ভিত্তিতে তাদের ‘দারুল ইসলামের অধিবাসী’
হিসেবে গণ্য করে গুরুত্বারোপ করতে হবে। সে হিসেবে বর্তমানের ভাষায় তারা হলো জনগণ। ফলে মুসলিমগণ জনগণ হিসেবে যে অধিকারগুলো উপভোগ করবে এবং কর্তব্য হিসেবে যা
কিছু পালন করবে,
অমুসলিমরাও সেসব অধিকার উপভোগ করবে এবং কর্তব্য হিসেবে সেসব
দায়িত্ব পালন করবে। তবে অন্য ধর্মীয় অধিকার
ও কর্তব্য তাদের ওপর আরোপিত হবে না।
অর্থাৎ ইসলামি ইবাদত, ঐতিহ্য
ও প্রথা মেনে চলা তাদের ওপর আবশ্যক হবে না। আর
তাদের ধর্ম তাদের জন্য যা বৈধ করেছে, সেগুলো তাদের জন্য অবৈধ করা যাবে
না; যদিও সেগুলো ইসলামে হারাম বা অবৈধ সাব্যস্ত হোক না কেন। যেমনঃ শূকরের মাংস খাওয়া এবং মদপান করা। আর তাদের ‘আহলুজ জিম্মাহ (নিরাপত্তা পাওয়ার চুক্তিবদ্ধ
সংখ্যালঘু)’ হিসেবে নামকরণ করাটা ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা নয়। কারণ, উমর ‘জিম্মাহ’
শব্দের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এবং কুরআনে উল্লেখিত ‘জিজিয়া
(সংখ্যালঘুদের জন্য ধার্য রাষ্ট্রীয় কর)’ শব্দটি ‘বনু তাগলিব’ নামক
একটি গোত্রের আপত্তির কারণে বাদ দিয়েছিলেন। এরা
ছিল আরব খ্রিষ্টান। তাদের প্রস্তাব ছিল, দরকার
পড়লে তারা দ্বিগুণ কর প্রদান করবে, কিন্তু সেটিকে ‘জিজিয়া’ না বলে
মুসলিমদের প্রদত্ত ‘জাকাত’
নামে নামকরণ করতে হবে। কারণ, তারা আরব হওয়ার কারণে ‘জিজিয়া’ শব্দটি তাদের কাছে অপমানজনক ছিল। এমতাবস্থায় উমর তাদের এই প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন।
এ ছাড়া পবিত্র কুরআনও আমাদের অমুসলিমদের
সাথে ভালো ও ন্যায়পরায়ণ আচরণ করতে নিষেধ করে না, যতক্ষণ না তারা আমাদের সাথে
দ্বীনের ব্যাপারে যুদ্ধ করছে, আমাদের আপন নিবাস থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে এবং আমাদের তাড়িয়ে
দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করছে।
১৫. বিবেক ও
চিন্তা-ভাবনাকে সম্মান
বিবেক ও চিন্তা-ভাবনাকে সম্মান করা উচিত। সেইসঙ্গে আল্লাহর সৃষ্টিগত যেসব নিদর্শন নিজেদের মধ্যে ও
দিক-দিগন্তের মধ্যে ছড়িয়ে আছে, সেগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত ও গভীর চিন্তা-ভাবনা করার দিকে
আহ্বান করতে হবে। পাশাপাশি কুরআনের আয়াত বা নিদর্শনগুলোর
দিকে দৃষ্টিপাত ও গভীর চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। এমন বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানসুলভ কাঠামো এবং গভীরভাবে ভাবার প্রতি নজর দিতে হবে, যা
কুসংস্কারকে নাকচ করে। সাধারণ প্রমাণ ছাড়া
কোনো দাবিকে গ্রহণ করে না। এটি
এমন বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো,
যা আল কুরআন তার বিভিন্ন শিক্ষার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করেছে। চিন্তার বদ্ধতা ও পূর্বপুরুষ, নেতা, মুরব্বি
বা সাধারণ মানুষের অন্ধ অনুসরণকে প্রতিরোধ করতে হবে।
ওহি বা প্রত্যাদেশের বর্ণনা সাব্যস্ত হওয়ার
মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেককে বিবেচনা করতে হবে। কারণ, শরিয়াহর
বিধানগুলো বোঝার ব্যাপারে ইসলাম বিবেককে কাজে লাগানোর দিকেই আহ্বান করেছে। এ ছাড়া
দ্বীনের ব্যাপারে গভীর বোধ এবং দুনিয়াকে বোঝার বিষয়ে বিবেককেই একমাত্র উপকরণ
হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। আর বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত প্রত্যাদেশ এবং বিবেকের
দ্ব্যর্থহীন যুক্তি কখনো সাংঘর্ষিক হতে পারে না-এই বিষয়টিতে জোর দিতে হবে।
আল্লাহর প্রত্যাদেশ এবং মানুষের সুস্থ বিবেক কখনো সাংঘর্ষিক হবে না। কারণ, এ দুটো বিষয় হলো ‘আলোর ওপরে আলো’র মতো। যখন প্রত্যাদেশ ও বিবেকপ্রসূত যুক্তি সাংঘর্ষিক হবে, তখন এ দুটোর মধ্যে অকাট্য (قطعي) বিষয়টিকে সম্ভাবনাময় অনুমিত (ظني) বিষয়টির ওপর প্রাধান্য দিতে
হবে। আর যখন দুটি বিষয়ই সম্ভাবনাময় অনুমিত (ظني) বিষয় হবে, তখন বিবেকপ্রসূত যুক্তি অকাট্য সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রত্যাদেশকে
প্রাধান্য দিতে হবে।
আমরা তাদের অবস্থানকে নাকচ করি, যারা ইসলামের নামে বিবেক ও যুক্তিবে থামিয়ে দেয় এবং চিন্তার বদ্ধতা তৈরি
করে। পাশাপাশি তাদের অবস্থানকেও আমরা নাকচ করি, যারা
প্রত্যাদেশ বা ওহিকে বাদ দিয়ে বিবেকপ্রসূত যুক্তিবে সর্বদা প্রাধান্য দেয় এবং এর
মোড়কে ইসলামের বিকৃতি ঘটাতে চায় ।
১৬. মানবিক ও
সামাজিক মূল্যবোধ
মানুষকে সামাজিক মূল্যবোধ ও মানবিক ভিত্তির
দিকে আহ্বান জানাতে হবে। দুঃখজনকভাবে অধিকাংশ
মুসলিম এ বিষয়ে অবহেলা করে। আবার
কারও কারও এই বিষয়ে ভুল ধারণা আছে। তারা
মনে করে, এগুলো হলো পাশ্চাত্যের মূল্যবোধ ও ভিত্তি। কিন্তু বাস্তবতা হলো,
এগুলো ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধের মধ্যে অন্যতম। যেমনঃ বিচার, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ন্যায্যতা
বজায় রাখা, আইন ও সামাজিক বিষয়ে পরামর্শ করা, স্বাধীনতা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা
করা। এ ছাড়া মানবিক অধিকারের সুরক্ষা; বিশেষ
করে সমাজে যারা দুর্বল শ্রেণি আছে, তাদের অধিকার সংরক্ষণ করা দরকার। সামাজিক উন্নতির শর্ত হিসেবে বিবেচিত নাগরিক, ধর্মীয়
ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং সমাজের সকল সদস্যের মাঝে সমানাধিকার ও
ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা। আর সমতা ও ন্যায্যতা হলো
ইসলাম প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য; যেন মানুষ তাঁদের স্বাধীন ইচ্ছা
অনুযায়ী স্বেচ্ছায় ইসলামকে পছন্দ করে নিতে পারে। এ ছাড়া দাতব্য, প্রশিক্ষণমূলক, সামাজিক
ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন সংগঠন, ক্লাব ও ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা
করা বাঞ্ছনীয়। কারণ, এগুলো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে সেবার
হাত বাড়িয়ে দেওয়া যাবে। এতে করে সমাজ উন্নত হবে, অগ্রগতি
লাভ করবে এবং পশ্চাদপদতা ও পিছিয়ে পড়ার শেকল থেকে রক্ষা পাবে। পাশাপাশি সমাজ তার
নিজের, বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর এবং আশপাশে থাকা মানবতার
প্রতি তার দায়িত্বকে ঠিকঠাকভাবে পালন করতে পারবে।
১৭. নারীদের প্রতি
ইনসাফ ও সম্মান প্ৰদৰ্শন
একজন মানুষ মেয়ে, কন্যা, স্ত্রী, মা ও সমাজের
সদস্য হিসেবে ইসলাম নারীকে যেসব অধিকার, মর্যাদা ও সম্মান
দিয়েছে, সেগুলো ঠিকভাবে আদায় করার প্রতি জোর দিতে হবে।
সেইসঙ্গে পশ্চাদপত্তা ও পিছিয়ে পড়া সময়ের তলানি থেকে নারীদের উঠিয়ে আনতে হবে।
কারণ, পশ্চাৎপদ সময়ে নারীদের অধিকাংশ অধিকার পাওয়া থেকে
বঞ্চিত করেছিল। এমনকী মসজিদে নামাজ পড়া, নিজের মতো করে
জীবনসঙ্গী বাছাই করার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করেছিল। সেইসঙ্গে পাশ্চাত্যের
সাংস্কৃতিক যুদ্ধের দুর্বিপাকের তলানি থেকেও নারীকে উঠিয়ে আনতে হবে। কারণ,
তারা নারীকে তার স্বভাবজাত প্রকৃতি ও নারীত্ব থেকে বের করে দিতে
চায়। এরা চায় মুসলিম নারীরা যেন প্রতি কদমে কদমে পাশ্চাত্যের নারীদের অনুসরণ
করে। এমতাবস্থায় নারী বা পুরুষদের মধ্যে সংস্কার চাওয়া প্রত্যেকেই মানবিক
স্বভাবের কারণে অশুভ পাশ্চাত্য সংস্কৃতির এই অপরাধের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলাটাই
স্বাভাবিক ।
আমরা এমন কট্টরপন্থিদের চিন্তাকে নাকচ করি, যারা নারীদের ঘরে আটকে রাখতে চায়। এরা নারীকে জ্ঞান ও কাজের অধিকার থেকে
বঞ্চিত এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে চায়। অথচ আল্লাহ
তায়ালা বলেছেনঃ
﴿وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ
بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ﴾
‘মুমিন পুরুষ ও নারীগণ একে অন্যের সুহৃদ ও বন্ধু ।’ সূরা
তাওবাঃ ৭১
একই সঙ্গে আমরা তাদেরও নাকচ করি, যারা নারীর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের বিরুদ্ধে গিয়ে নারী ও পুরুষের মধ্যে
পার্থক্যগুলোকে নষ্ট করে দিতে চায় ৷ এর মাধ্যমে তারা সেই বৈশ্বিক স্বভাবজাত
প্রকৃতির বিরুদ্ধে যায়, যেটি ‘জোড় (Base
Pair)’ নিয়মের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এ ব্যাপারে কুরআনে এসেছেঃ
﴿وَمِن كُلِّ شَيْءٍ خَلَقْنَا زَوْجَيْنِ
لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ﴾
‘আমি প্রত্যেক জিনিসের জোড়া বানিয়েছি, হয়তো এ থেকে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ
করবে।’
সূরা জারিয়াতঃ ৪৯
বৈশ্বিক স্বভাবজাত প্রকৃতি ‘সম লৈঙ্গিক (Homosexuality)’ নিয়ম, যা পাশ্চাত্য বর্তমানে ছড়িয়ে দিচ্ছে-তার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। কারণ, পারস্পরিক বিপরীত দুটো লিঙ্গের (Gender) সমন্বয়ে প্রাণের অস্তিত্বের ধারা চলতে থাকে। একই ধরনের দুটো লিঙ্গের সমন্বয়ে প্রাণের অস্তিত্বের ধারা চলতে পারে না।
১৮. পরিবার ও এর
বিকাশ
একটি নিরাপদ ও সুস্থ সমাজ বিনির্মাণের প্রথম
স্তম্ভ হিসেবে পরিবারের বিষয়ে যত্নশীল হওয়া উচিত। ইসলামের সঠিক ও বিশুদ্ধ ভিত্তির ওপর পরিবারকে দাঁড় করানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা
উচিত। যেমনঃ বিয়ের ক্ষেত্রে
বাছাই প্রক্রিয়া যথাযথ হওয়া, প্রস্তাবকারী এবং যাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে উভয়ের মাঝে
দেখাদেখিটা ইসলামসম্মত হওয়া, স্ত্রীর জন্য ধার্যকৃত মোহর ও বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায়
অপব্যয় ও সীমালঙ্ঘন না হওয়া, সামাজিকতার নামে আত্মপ্ৰদৰ্শন ও ভণ্ডামি থেকে বিরত থাকা, বৈবাহিক
জীবনকে প্রশান্তি,
ভালোবাসা ও দয়ার ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো, বিবাহিত
যুগল একে অন্যের অধিকার সম্পর্কে যত্নশীল হওয়া, একে অন্যের সাথে ভালো আচরণ করা, টানাপোড়েনের
সময় ধৈর্যধারণ ও সহনশীল আচরণ করা, ঝগড়া-বিবাদ হলে মধ্যস্থতার
দারস্থ হওয়া, বোঝাপড়া অসম্ভব হলেই কেবল একান্ত বাধ্য হয়ে তালাকের দারস্থ হওয়া; অন্যথায়
তালাককে এড়িয়ে যাওয়া,
ব্যাপকতা ও নিষিদ্ধতার মাঝামাঝি থেকে বিধিনিষেধ ও
শর্ত-সাপেক্ষে পুরুষের বহু বিবাহের বৈধতা মেনে নেওয়া।
সেইসঙ্গে পিতা-মাতা, ভাই-বোন, চাচা-ফুফু, মামা-খালা, তাদের
সন্তানাদিসহ গঠিত একান্নবর্তী পরিবারের প্রতি আস্থাশীল হওয়া। কারণ, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা এবং সদ্ব্যবহার পাওয়ার অধিকার তাদের সবচেয়ে বেশি।
১৯. শাসক বাছাই
করার ক্ষেত্রে জনগণের অধিকার
বিশ্বস্ত ও শক্তিশালী শাসক বাছাই করার
ক্ষেত্রে জনগণের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। শাসকগণ তাদের দক্ষতা ও কর্মের মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করবে। জনগণের ইচ্ছাকে হেয় করবে না। আর এমন শাসক হয়ে জনগণের কাঁধে চেপে বসবে না-যাকে তারা ঘৃণা করে। যখন জনগণ শাসককে বাছাই করবে, তখন একদিকে শাসকের অধিকার আর
অন্যদিকে জনগণের কর্তব্য হলো শাসককে সাহায্য করা, তার কল্যাণকামী হওয়া এবং পাপ ও
অন্যায় নয়, এমন বিষয়ে শাসকের আনুগত্য করা। আর
জনগণের অধিকার; বরং কর্তব্য হলো-শাসকের কাজের জবাদিহিতা ও হিসাব চাওয়া, ভুল
করলে শুধরে দেওয়া,
বিভ্রান্ত হলে ঠিক করে দেওয়া, সঠিক পথ
ছেড়ে বিভ্রান্তিতে লেগে থাকলে তাকে অপসারণ করা। ন্যায্যতা,
পারস্পরিক পরামর্শ ও অধিকার সংরক্ষণের ওপর আইনব্যবস্থা
প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। পাশাপাশি আল্লাহ কুরআন ও
হাদিসের মধ্য থেকে যা কিছু বিধান হিসেবে প্রণয়ন করেছেন, সেগুলোকেও
মেনে চলতে হবে। জনগণের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য গণতান্ত্রিক
ব্যবস্থায় থাকা স্বয়ংক্রিয়তা, দায়িত্বানুভূতি ও উপায়-উপকরণ, শাসকের
নিয়ন্ত্রিত কর্তব্যের মতো বিষয়গুলোকে কাজে লাগিয়ে আমরা উপকৃত হতে পারি। আমরা গণতন্ত্রের সব বিষয়গুলো নির্বিচারে গ্রহণ করব না। যেমনঃ শরিয়াহর বিধান ও সামাজিক মূল্যবোধের
ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার যথেচ্ছা প্রয়োগ আমরা বর্জন করব। এভাবে গণতন্ত্রের ভালোগুলো গ্রহণ করব এবং খারাপগুলো বর্জন
করব।
২০. অর্থনীতিকে
শক্তিশালী ভিত্তির ওপর নির্মাণ
মুসলিম উম্মাহর অর্থনীতিকে এমনভাবে শক্তিশালী
ও পরিপূর্ণতা প্রদানে কাজ করতে হবে, যেন উম্মাহ সামরিক ও
বেসামরিকভাবে স্বনির্ভর হতে পারে।
সেইসঙ্গে এই অর্থনীতির ভিত্তি ইসলামের গভীর জ্ঞান ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের আলোকে
নির্মাণ করতে হবে। ইসলামি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে
তুলতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কৃত্রিমতা ও
আনুষ্ঠানিকতা থেকে এগুলোকে মুক্ত রাখতে হবে। এসব
ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যেন এগুলো মুসলিম সমাজের
উন্নতিতে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে।
পাশাপাশি স্বতন্ত্র ইসলামি অর্থনীতি প্রণয়নের জন্য তাত্ত্বিক পরিকল্পনা ও
ব্যবহারিক প্রচেষ্টা জারি রাখতে হবে। এতে
করে উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি,
ব্যবহার বা ভোগ করার সঠিক নির্দেশনা, মুদ্রার
আবর্তনের যথার্থতা,
বিলি-বণ্টনের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা ও নিরপেক্ষতা বাস্তবায়িত
হবে। এর ফলে ইসলামি অর্থনীতি মধ্যমপন্থার ওপর অটল
থাকবে। এটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে না-যা
ব্যক্তিকে সমাজের ওপরে প্রশ্রয় দিয়ে সীমালঙ্ঘনের সুযোগ করে দেয়। সেইসঙ্গে এটি সমাজবাদী ব্যবস্থাকেও গ্রহণ করে না-যা সমাজকে
ব্যক্তির ওপর প্রাধান্য দিয়ে সীমালঙ্ঘনের সুযোগ করে দেয়।
২১. ইসলামি উম্মাহ, একতা ও উম্মাহর জন্য ভালোবাসা
ইসলামি উম্মাহর অস্তিত্ব ও স্থায়িত্বে আস্থা
রাখতে হবে। এটি এমন একটি উম্মাহ, যা কখনো
মৃত্যুবরণ করবে না। কারণ, এটি সর্বশেষ রিসালাহ ইসলামকে
ধারণ করে আছে। সেইসঙ্গে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের
প্রয়োজনীয়তা এবং বিভিন্ন মতবাদ ও মতাদর্শ থাকা সত্ত্বেও মুসলিমদের মাঝে থাকা
দ্বীনি ভ্রাতৃত্বের ব্যাপারে আস্থাশীল হতে হবে। মুসলিমদের বিভিন্ন দল-উপদলগুলোকে এক উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করতে
হবে; যতক্ষণ পর্যন্ত তারা কাবার দিকে ফিরে নামাজ পড়বে, কুরআন ও
সুন্নাহতে বিশ্বাস রাখবে,
একমত হওয়া বিষয়গুলোতে পারস্পরিক সাহায্য আর ভিন্নমতের
বিষয়গুলোতে সহিষ্ণুতা ও আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন দল-উপদলকে
কাছাকাছি আনার চেষ্টা করবে। আর
বড়ো বড়ো বিষয়গুলোতে এক কাতারে এসে দাঁড়াবে। ‘উম্মাহর জন্য ওয়ালা (উম্মাহর জন্য বিনিড় ভালোবাসা)’ এই
ভিত্তিটির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এর
মানে হলো, মুসলিম উম্মাহকে ভালোবাসতে ও সাহায্য করতে হবে। মুসলিম উম্মাহকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো জাতির জন্য এই ভালোবাসা ও প্রীতি থাকা
চলবে না।
২২. বহুত্ববাদ ও
বৈচিত্র্যকে স্বীকার
ধর্মীয় বহুত্ত্ববাদ (Religious Pluralism), ঐতিহ্যিক বহুত্ববাদ,
ভাষিক বহুত্ববাদ, সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ, রাজনৈতিক
বহুত্ববাদকে স্বীকার করে নিতে হবে। কোনো
ধরনের সংকোচন ও শক্তি,
আধিক্য ও সম্পদের অহংকার বাদ দিয়ে বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে
সহাবস্থান, বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে আন্ত-বিনিময় (Cross-Fertilization of Cultures), পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া ও অভিযোজন সংঘটিত হওয়াটা জরুরি। সহিষ্ণুতা ও উদারতার সেই নির্যাসকে ছড়িয়ে দিতে হবে, যার
দিকে ইসলাম আহ্বান করেছে এবং যে বৈশিষ্ট্যের কারণে পুরো ইতিহাসজুড়ে ইসলাম আলাদা ও
স্বতন্ত্র হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে।
২৩. তাকফির ও
তাফসিক থেকে বিরত থাকা
যে ব্যক্তি কালিমা শাহাদাতের বাক্য দুটো পাঠ
করবে, কিবলার দিকে ফিরে নামাজ আদায় করবে এবং এমন কিছু তার পক্ষ থেকে প্রকাশ করবে
না-যা অকাট্যভাবে এই কালিমা শাহাদাতের বিপরীতে যায়, এমতাবস্থায় তার সম্পর্কে
সুধারণা বজায় রাখতে হবে। এক্ষেত্রে মূলনীতি হলো, একজন
মুসলিমের অবস্থাকে যতটা সম্ভব সঠিক ও যথাযথ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং যতক্ষণ
পর্যন্ত সুস্পষ্ট কারণ পাওয়া যাবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত একজন মুসলিমকে
কাফির৪৬ ও ফাসিক৪৭ হিসেবে সাব্যস্ত করা থেকে বিরত
থাকতে হবে; বিশেষ করে কোনো ব্যাখ্যা বা মন্তব্যের ব্যাপারে কুফর বা ফাসিক সাব্যস্ত করার
ক্ষেত্রে বিরত থাকতে হবে। কারণ, ইসলামে
প্রবেশের চাবি হলো-‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ,
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ; আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ
আল্লাহর রাসূল।’
অতএব, একজন মুসলিমকে ইসলাম থেকে তখনই খারিজ করে দেওয়া যাবে, যখন
প্রবেশের এই চাবিকে সে অস্বীকার করবে। কারণ, অকাট্য
কোনো বিষয় সন্দেহজনক বিষয় দিয়ে নাকচ বা দূরীভূত হয় না।৪৮
তাকফির হলো এমন একটি ধর্মীয় ও জ্ঞানগত ভুল, যে গর্তের
মধ্যে পড়ে যাওয়া কোনো মুসলিমের জন্য বৈধ নয়। কারণ, এর মাধ্যমে মুসলিম সমাজ থেকে একজন মুসলিমের ওপর বাস্তবিক বা নৈতিক কিংবা উভয়
ধরনের বিচ্ছিন্নতার বিধান সাব্যস্ত হয়। এ
কারণে সন্দেহাতীতভাবে অকাট্য প্রমাণ ব্যতীত তাকফির করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা
অবলম্বন করতে হবে। যেমনঃ কুরআনের অকাট্য
বিষয়গুলোকে মিথ্যা সাব্যস্ত করা বা দ্বীনের আবশ্যকীয় জ্ঞাত বিষয়সমূহকে অস্বীকার
করা অথবা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে স্পষ্টভাবে গালাগাল করা। এমনটাই হাদিসে এসেছেঃ
‘কেবল যখন তোমরা এমন বিষয়ে প্রকাশ্য কুফরি দেখতে পাবে, যে
বিষয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে বুরহান রয়েছে।’৪৯
এখানে বুরহান দ্বারা উদ্দেশ্য হলো অকাট্য
প্রমাণ। আর যেসব বিষয় অকাট্য নয়; বরং
ব্যাখ্যাসাপেক্ষ,
সেসব বিষয়ে সন্দেহ থাকার কারণে ব্যক্তি কুফরির তকমা থেকে
রেহাই পেয়ে যাবে।
২৪. বিশ্বজুড়ে
মুসলিম সংখ্যালঘু
বিশ্বজুড়ে যত মুসলিম সংখ্যালঘু আছে, তাদের
মুসলিম উম্মাহর অংশ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। ইসলামের সাথে অসামঞ্জস্য সমাজে বসবাসের কারণে আলাদা মর্যাদা বিবেচনায় রাখার
মাধ্যমে সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। সংখ্যালঘু মুসলিমরা যেন তাদের সমাজে ইসলাম মেনে বসবাস করতে পারে, সক্রিয়
ও উর্বর ভূমিকা রাখতে পারে,
তাদের নৈতিকতা ও লেনদেনের মধ্যে ইসলামকে মূর্ত করতে পারে, সেজন্য
মুসলিম উম্মাহকে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে। যাতে তারা বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিজেদের বিবেচনা ও বোধকে ইসলামের আলোকে ঢেলে
সাজাতে পারে। তাদের স্লোগান হয়ে উঠতে পারে-‘বিচ্ছিন্ন ও
নিঃসঙ্গহীনভাবে ইসলামের ওপর অটল থাকা এবং বিলীন না হয়ে সমাজের সাথে মিলেমিশে থাকা।’
২৫. পৃথিবীর
বিনির্মাণ, উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ এবং
পরিবেশ সংরক্ষণ
পৃথিবীকে নির্মাণ, বৈষয়িক
বা মানবিক সকল ধরনের উন্নতির বাস্তবায়ন, সব ধরনের উপাদানের মাধ্যমে
পরিবেশকে সংরক্ষণ,
বিকৃতি ও দূষণ থেকে পরিবেশকে রক্ষা, পরিবেশের
ভারসাম্য ও বৈশ্বিক ভারসাম্যকে হেফাজত, মানুষের জীবনযাপনকে যা কিছু সহজ
ও সুন্দর করে সেগুলোর ক্ষেত্রে পরস্পরকে সহযোগিতা এবং এটিকে আল্লাহর পথে জিহাদ ও
ইবাদাত হিসেবে বিবেচনা করা। আর
পৃথিবীতে বসবাসকারীদের কর্তব্য হলো-পৃথিবীকে সংরক্ষণ করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া, ধ্বংসাত্মক
ঝুঁকি, বিপদ এবং পৃথিবীর সংস্কারের পর যারা এতে বিকৃতি ছড়িয়ে দিতে চায়-তাদের
মোকাবিলা করা এবং একে অন্যের সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ না করে বৈশ্বিক ভারসাম্যের যত্ন
নেওয়া। যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ
﴿أَلَّا تَطْغَوْا فِي
الْمِيزَانِ﴾﴿وَأَقِيمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَلَا تُخْسِرُوا الْمِيزَانَ﴾
‘তোমরা মিজান বা ভারসাম্যের মধ্যে বাড়াবাড়ি করো না। তোমরা ন্যায্যতার সাথে ভারসাম্য স্থাপন করো এবং মিজানের মধ্যে হ্রাস করো না।’ সূরা আর-রাহমানঃ ৮-৯
এভাবেই তারা একটি ভারসাম্যপূর্ণ সভ্যতা
প্রতিষ্ঠিত করে,
যে সভ্যতাটি মানুষকে সম্মান করতে শেখায় এবং শুধু একটি
উন্নত প্রজাতির প্রাণী না হয়ে মানুষকে পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি
হিসেবে বিবেচনা করে।
২৬. সংস্কার ও
পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা
বিপর্যয় ও পশ্চাদ্গামিতা ঠেকানোর নিমিত্তে
যেসব ব্যক্তি পরিবর্তন ও সংস্কারের আহ্বান জানায়, তাদের উৎসাহিত করতে হবে। কারণ, পশ্চাদ্গামিতা উম্মাহর বুদ্ধিবৃত্তিকে ধ্বংস করে এবং
বিপর্যয় উম্মাহর বিবেককে অকেজো করে রাখে।
বিপর্যয় হলো অগ্রগতির পথে প্রথম বাধা। কিছু
বিপর্যয়ের উদাহরণ হলো-রাজনৈতিক বিপর্যয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, প্রশাসনিক
বিপর্যয় ও চারিত্রিক বিপর্যয়।
পরিবর্তন ও সংস্কারের দিকে আহ্বানকারী এসব ব্যক্তিদের কর্তব্য হলো-সামগ্রিক
পরিধিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে এক ধরনের প্রকৃত সংস্কার স্থাপন করা। প্রকৃত সংস্কার তখনই সম্ভব হবে, যখন তা
মুসলিমদের ইচ্ছার আলোকে,
মুসলিমদের হাত ধরে, মুসলিমদের প্রত্যাশার নিরিখে এবং
মুসলিমদের উদ্দেশ্য ও কল্যাণের আলোকে সম্পাদিত হবে। অন্যরা যে সংস্কার মুসলিমদের ওপর তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য, তাদের
নিজের বা তাদের বুদ্ধিজীবীদের হাত ধরে কার্যকর করার জন্য চাপিয়ে দেবে, সেটি
সংস্কার হিসেবে কখনো বিবেচিত হবে না।
সংস্কারের একদম শুরুর কাজ হবে সেসব রাজনৈতিক
স্বৈরাচারী নিয়মকানুনের সংস্কার সাধন, যা আমাদের মুসলিম জনগণকে শাসন
করছে, তাদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, কথা বলা ও লেখালিখির স্বাধীনতাকে
হরণ করছে, স্বাধীন প্রচারকারীদের জেলে পুরে রাখছে, নির্বাচনে কারচুপি করছে, প্রতিপক্ষকে
বিশেষ আইন ও সামরিক আদালতের মাধ্যমে দমন-পীড়ন করছে। আমূল পরিবর্তন ছাড়া এই বিপর্যয়ের কোনো প্রতিষেধক নেই। যেমনঃ জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের শাসক নির্বাচন করবে, শাসকদের
জবাবদিহিতার আওতায় আনতে সক্ষম হবে, বেঁকে গেলে শাসকদের সোজা করে
দেবে এবং অপকর্মের সীমা ছাড়িয়ে গেলে অপসারণ করতে সক্ষম হবে।
পরিবর্তনের মূল জায়গাটি হলো মানুষের
অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন। কারণ মানুষ বাইরে থেকে
নিয়ন্ত্রিত না হয়ে ভেতর থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়। মানুষকে কান টেনে বা ঘাড় ধরে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বুদ্ধিবৃত্তি ও বিবেকের পরিবর্তনের মাধ্যমেই তাকে নেতৃত্ব দিতে হয়। এখানে সংস্কারের প্রতীক হলো আল্লাহর সেই বাণীঃ
﴿إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ
حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ﴾
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সেই জাতির মধ্যে পরিবর্তন আনেন না, যতক্ষণ
না তারা নিজেদের মধ্যে নিজেরাই পরিবর্তন আনে।’ সূরা
রাদঃ ১১
২৭. সব শক্তি ও
আন্দোলনসমূহকে এক প্ল্যাটফরমে আনা
ইসলামকে সাহায্য করা ও উম্মাহর জাগরণে কাজ
করছে-এমন সব শক্তি,
দল,
সংগঠন ও আন্দোলনকে এক কাতারে এবং এক লক্ষ্যে নিয়ে আসার
জন্য কাজ করা উচিত। এক্ষেত্রে এটা আবশ্যক নয় যে, সবাইকে
একই আন্দোলন বা একই দলের অধীনে একত্রিত করতে হবে। এর চাইতে বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো-উদ্দেশ্য, কার্যক্রম ও নেতৃত্বের দিক থেকে
তারা ঐক্যবদ্ধ হবে। আর এটা মোটেও সহজ কাজ নয়। এক্ষেত্রে এটাই যথেষ্ট যে, তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও
সমন্বয়ের জায়গাটায় একটি যৌক্তিক ও সংগত মাত্রায় বিদ্যমান থাকবে, চূড়ান্ত
বা ভাগ্য-নির্ধারণী বিষয়গুলোতে তারা এক কাতারে এসে দাঁড়াবে এবং ইসলাম ও
মুসলিমদের শত্রুদের বিরুদ্ধে মোকাবিলার ক্ষেত্রে তারা হবে সিসাঢালা প্রাচীরের মতো। বিশেষত বিপদ ও সংকটের সময় এমনটা হওয়া আরও বেশি বাঞ্ছনীয়। কারণ, বিপদ একত্রিত করে দেয় বিপদগ্রস্তদের, কষ্ট এক
করে দেয় মতভেদকারীদের এবং সংকট দূরে সরে যাওয়া ব্যক্তিদের কাছে আসার সুযোগ
করে দেয়।
অধিকন্তু সক্রিয় মানুষের মাঝে মতভেদ ও
বিভিন্নতা ক্ষতিকর নয়;
যতক্ষণ সেটি পারস্পরিক বিরোধিতায় রূপ না নিয়ে
বৈচিত্র্যতার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে এবং লড়াইয়ের দিকে না গিয়ে কেবল বৈশিষ্ট্যের
মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে।
২৮. নয়া ফিকহর
দিকে আহ্বান
যেহেতু আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
﴿قَدْ فَصَّلْنَا الْآيَاتِ لِقَوْمٍ
يَفْقَهُونَ﴾
‘আমি আমার নিদর্শনগুলোকে বিশদভাবে বর্ণনা করেছি সেসব মানুষের জন্য, যারা
গভীরভাবে বোঝে।’
সূরা আনআমঃ ৯৮
আর রাসূল সা. বলেছেনঃ
‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান,
তাকে দ্বীনের ফিকহ বা গভীর বুঝ দান করেন।৫০
এর আলোকে কুরআন ও হাদিসের ফিকহ বা গভীর
জ্ঞানকে ঢেলে সাজানোর প্রতি জোর দিতে হবে। আর
বিষয়টি বিভিন্ন ধরনের অভীষ্ট ফিকহকে অন্তর্ভুক্ত করে। যেমনঃ বৈশ্বিক নিয়মের ফিকহ, শরিয়াহর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ফিকহ, পরিণতি
বা ফলাফলের ফিকহ,
ভারসাম্যের ফিকহ, অগ্রাধিকারের ফিকহ, মতবৈচিত্র্যতার
ফিক হ, সভ্যতা-সংস্কৃতির ফিকহ,
পরিবর্তনের ফিকহ ও বাস্তবতার ফিকহ।
এ যুগের আলিমদের কর্তব্য হলো-যার যার
সামর্থ্যের আলোকে বিভিন্ন প্রকারের এই ফিকহগুলো সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন করা। এর ফলে যেন দাওয়াহ বা আহ্বান করার সময় দূরদৃষ্টি নিয়ে
দাওয়াত দিতে পারে,
ফতোয়া দেওয়ার সময় প্রমাণ ও যুক্তির মাধ্যমে ফতোয়া দিতে
পারে, শেখানোর সময় স্পষ্টভাবে শেখাতে পারে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় জ্ঞানের
আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
২৯. সভ্যতায়
মুসলিম উম্মাহর অর্জন
পুরো বিশ্বকে উজ্জ্বল করেছে আমাদের মুসলিম
উম্মাহর এমন ঐতিহাসিক অর্জনগুলোকে যথাযথ মর্যাদায় সমাদর করা বাঞ্ছনীয়। যেমনঃ উপযুক্ত সময়ে বিভিন্ন জাতিকে দাসত্বের
শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য বিভিন্ন যুদ্ধে অর্জন করা বিজয়গুলো, যা
একদিনের জন্যও লাঞ্ছিত বা অনৈতিক সুবিধা ভোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি। সেইসঙ্গে বিশেষভাবে জোর দিয়ে উল্লেখ করতে হবে উম্মাহর
প্রতিষ্ঠিত সেই সভ্যতাকে যা জ্ঞান ও বিশ্বাসকে, ধার্মিকতা ও মানবিকতাকে, বৈষয়িক
উন্নতি ও চারিত্রিক উচ্চতাকে একটি সুতোয় গেঁথেছিল। এই সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে বিভিন্ন ধর্ম, উপকূল ও দেশের মানুষের অবদান
জড়িয়ে আছে-যাদের ব্যাপারে ইসলামি সভ্যতা কখনো সংকীর্ণতা প্রদর্শন করেনি। এই সভ্যতাটি দীর্ঘ আট শতাব্দীরও অধিক সময় জুড়ে পৃথিবীকে
শিক্ষার আওতায় এনেছে এবং আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। এই সভ্যতা থেকেই ইউরোপ পরীক্ষামূলক আরোহ পদ্ধতিকে (Inductive-Empirical Method) গ্রহণ করেছিল এবং ইবনে রুশদসহ অন্যান্যদের থেকে বিদ্যার্জন করেছিল।
আমরা এটা দাবি করছি না যে আমাদের ইতিহাস
নির্ভুল ও নিষ্পাপ;
কিন্তু অন্যান্য জাতির ঐতিহাসিক কলঙ্কের তুলনায় আমাদের
ভুলগুলো নেহাতই কম। সেইসঙ্গে আমরা আমাদের ইতিহাসকে বিকৃত করার
ধৃষ্টতাকেও মেনে নেব না;
বিশেষ করে সর্বোত্তম যুগের ইতিহাসের ক্ষেত্রে, যে
যুগের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহর রাসূল প্রশংসা করে গেছেন। মুসলিমদের কর্তব্য হলো-বৃদ্ধি করতে না পারলেও কমপক্ষে গৌরবময় অতীতকে
বর্তমানের সাথে যেন সমান সমান রাখে।
সেইসঙ্গে গৌরবময় অতীতের প্রশংসায় যেন ভেসে না থাকে এবং ট্রাজেডিগুলো নিয়ে
কান্নায় মেতে না থাকে। বরং আমাদের কর্তব্য হলো, অতীতের
অনুপ্রেরণাকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানকে এগিয়ে নেওয়া এবং ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করা।
৩০. ভিন্ন ভিন্ন
ঐতিহ্যের মধ্যে ভালোগুলো থেকে উপকৃত হওয়া
আমাদের বিভিন্ন প্রশস্ত ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে যা
কিছু উত্তম, সেগুলো থেকে উপকৃত হতে হবে। যেমনঃ ফিকহবিদদের বিন্যাস, উসুলবিদদের মৌলিকত্ব, হাদিস শাস্ত্রবিদদের সংরক্ষণ
ক্ষমতা, কালামবিদদের বুদ্ধিবৃত্তি, সুফিবাদীদের আধ্যাত্মিকতা, ইতিহাসবিদদের বর্ণনা, কবি ও
সাহিত্যিকদের কোমলতা,
প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের অনুধাবনলব্ধ জ্ঞান, জ্ঞানী
ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা। ইসলাম এবং এর উৎসের
সঙ্গে সম্পর্ক থাকা এসব ঐতিহ্যের সবটুকুই ইসলামি বুদ্ধিবৃত্তির নির্মাণ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এগুলো নিষ্পাপ ও নির্ভুল নয়। এগুলো সমালোচনা, পর্যালোচনা, পরামর্শ, বাছ-বিচারের
মাধ্যমে অগ্রাধিকার প্রদান কিংবা দুর্বল সাব্যস্ত হওয়ার উপযুক্ত। কিন্তু সামগ্রিকভাবে উম্মাহ কখনো ভ্রান্তির ওপর একত্রিত
হবে না। তাই ঐশী ওহির অকাট্য বিষয় এবং মানবিক
জ্ঞানের অকাট্য বিষয়ের আলোকে ঐতিহ্যের দিকে দৃষ্টিপাত করাটা আবশ্যক।
একইভাবে ঐতিহ্যকে যুগের চাহিদা ও পদ্ধতির
আলোকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং কাজে লাগানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এতে করে আমাদের ঐতিহ্য উম্মাহর অগ্রগতি ও শাশ্বত রিসালাহর
বাণী পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বের আঞ্জাম দিতে সক্ষম হবে।
একনজরে
মধ্যমপন্থার বৈশিষ্ট্য
1.
ইসলামের
সামগ্রিক বোধ ও পরিপূর্ণ উপলব্ধি থাকতে হবে। এই
সামগ্রিক ও পরিপূর্ণ বোধ আকিদা ও শরিয়াহ, জ্ঞান ও কর্ম, ইবাদত ও
মুয়ামালাত, সংস্কৃতি ও নৈতিকতা,
অধিকার ও ক্ষমতা, দাওয়াহ ও রাষ্ট্র, দ্বীন ও
দুনিয়া, সভ্যতা ও উম্মাহ-সব বিষয়েই থাকাটা বাঞ্ছনীয়।
2.
ইসলামি
জীবনযাপনের জন্য কুরআন ও বিশুদ্ধ সুন্নাহকে আইন-বিধান প্রণয়ন ও পরিচালনার
ক্ষেত্রে তথ্যের মূল সূত্র ও প্রত্যাবর্তনস্থল হিসেবে .বিশ্বাস করতে হবে। পাশাপাশি ইসলাম ও তার শরিয়াহর সামগ্রিক মাকাসিদ-এর
আলোকে কুরআন-সুন্নাহর খণ্ডিত বা আংশিক বক্তব্যকে বুঝতে চেষ্টা করাটাও সমান
গুরুত্বপূর্ণ।
3.
ঐশী
তাৎপর্য ও নৈতিক মূল্যবোধকে জোরদার ও সুদৃঢ় করতে হবে। মানুষকে যে কারণে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, সেই উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে
আল্লাহর ইবাদতে সংহত হতে হবে। এই
ইবাদতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করতে হবে। আর এই ইবাদত বড়ো চারটি আচারের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। এগুলোর পাশাপাশি কিছু নফল ইবাদত আছে। যেমনঃ কুরআন তিলাওয়াত,
আল্লাহর জিকির, দুআ ও ইস্তিগফার। এগুলোর পাশাপাশি কিছু ইবাদত আছে, যেগুলো
অভ্যন্তরীণ ও অপ্রকাশ্য। যেমনঃ
শুদ্ধ নিয়ত, আল্লাহর জন্য ইখলাস,
আল্লাহর জন্য ভালোবাসা, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, আল্লাহর
দয়ার আশা পোষণ,
আল্লাহর শাস্তির ভয় করা ইত্যাদি। এটাই হলো প্রকৃত সুফিবাদ, যা দাঁড়িয়ে আছে এই মূলনীতিটির ওপর-‘সত্যের সাথে সৎ থাকা
এবং সৃষ্টির সাথে নৈতিক আচরণ করা।’
4.
শরিয়াহর
যে স্তর আছে, সেসব স্তরের আলোকে তাকলিফ ও কাজের ব্যাপারে ভারসাম্যপূর্ণ বোধ থাকতে হবে। কুরআন-সুন্নাহ যেভাবে বলেছে এবং কর্তব্যগুলোকে আলাদা করেছে, ঠিক সে
আলোকে তাকলিফ-এর অবস্থান ঠিক করতে হবে। অতএব, যে
কাজটি তাৎক্ষণিক হওয়ার দাবি রাখে, সেটিকে দেরি করে করা কিংবা যেটি
দেরি করে করার দাবি রাখে,
সেটি তাৎক্ষণিকভাবে করা যাবে না। এই বিষয়কে আমি নামকরণ করেছি (অগ্রাধিকারের ফিকহ) ফিতহুল আওলাউইয়াত হিসেবে।
5.
কুরআন ও
হাদিসের ফিকহ বা গভীর জ্ঞানকে ঢেলে সাজানোর প্রতি জোর প্রদান করতে হবে। আর ফিকহুল আওলাউইয়াতের পাশাপাশি এ বিষয়টি বিভিন্ন ধরনের
অভীষ্ট ফিকহকে অন্তর্ভুক্ত করে। যেমনঃ বৈশ্বিক নিয়মের ফিকহ, শরিয়াহর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ফিকহ, পরিণতি
বা ফলাফলের ফিকহ,
ভারসাম্যের ফিকহ, অগ্রাধিকারের ফিকহ, মতবৈচিত্র্যতার
ফিকহ, সভ্যতা-সংস্কৃতির ফিকহ,
পরিবর্তনের ফিকহ এবং বাস্তবতার ফিকহ।
6.
ইসলাম
যেসব নৈতিক ও চারিত্রিক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিয়েছে, সেগুলোকে অনুসরণ করতে হবে; সেটি
হতে পারে ব্যক্তিগত পর্যায়ের নৈতিকতা কিংবা সামাজিক পর্যায়ের নৈতিকতা। যারা নিজেদের চরিত্র ও নৈতিকতায় প্রভাব বিস্তারের
তোয়াক্কা না করে শুধু আচারসর্বস্ব ইবাদতকেই সবকিছু মনে করে, তাদের
অবস্থানকে অস্বীকার করতে হবে।
পাশাপাশি তাদের অবস্থানকেও অস্বীকার করতে হবে, যারা চারিত্রিক নৈতিকতাকেই
সবকিছু মনে করে।
7.
দ্বীনের
সংস্কার দ্বীনের অভ্যন্তরে হতে হবে। যে
ইজতিহাদ ছাড়া শরিয়াহ এগিয়ে যেতে পারে না, সেই ইজতিহাদের সূচনাকে
পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে খেয়াল
রাখতে হবে-যেন অবশ্যই যোগ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তির পক্ষ থেকেই ইজতিহাদ সংঘটিত হয়।
8.
শরিয়াহর
মধ্যে থাকা সুপ্রতিষ্ঠিত বিষয়গুলো এবং যুগের আলোকে পরিবর্তনশীল বিষয়গুলোর মধ্যে
ভারসাম্য রাখতে হবে। পাশাপাশি উদ্দেশ্য ও
লক্ষ্যের ক্ষেত্রে অপরিবর্তনশীল সুপ্রতিষ্ঠিত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ রাখা
বাঞ্ছনীয়। একই সঙ্গে মাধ্যম ও উপলক্ষ্যের ক্ষেত্রে
নমনীয়তা ও ক্রমবিকাশকে মেনে নেওয়াটা আবশ্যক। একইভাবে সামগ্রিক ও মৌলিক বিষয়গুলো থাকবে অপরিবর্তনশীল, আর
শাখা-প্রশাখামূলক ও খণ্ডিত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে থাকবে নমনীয়তা।
9.
ফিকহ ও
ফতোয়ার ক্ষেত্রে সহজ ও লঘু করার পদ্ধতিকে অনুসরণ করতে হবে। আর কড়াকড়ি যদি করতেই হয়, সেটি শাখা-প্রশাখাগত বিষয়ে না করে উসুল বা মৌলিক বিষয়ে
করাটা বাঞ্ছনীয়। এখানে কাঙ্ক্ষিত সহজীকরণ অর্থ এটি নয় যে, শুধু
বাস্তবতাকেই আমলে নেওয়া বা পাশ্চাত্যের সাথে তাল মিলিয়ে চলা অথবা শাসকদের
সন্তুষ্ট করা।
10. প্রশিক্ষণের সময় ভালোভাবে বোঝানো, বোধকে
বিশুদ্ধ করা, মুমিনদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং অন্তরে গেঁথে দেওয়া, ইসলামের
তাৎপর্যগুলোকে ব্যাখ্যা করা, ইসলামবিরোধীদের আপত্তির প্রত্যুত্তর দেওয়া-এসবের মাধ্যমে
মুসলিমদের কাছে ইসলামের দাওয়াহ দেওয়ার পদ্ধতির উন্নতি সাধন করতে হবে। পাশাপাশি অমুসলিমদের মাঝেও একইভাবে ইসলামের দাওয়াহ
ছড়িয়ে দিতে হবে। কারণ, ইসলামের দাওয়াহ একটি বৈশ্বিক ও
চিরস্থায়ী দাওয়াহ। দাওয়াহর ক্ষেত্রে
ইতিবাচক পদ্ধতি আর ফতোয়ার ক্ষেত্রে সহজ পদ্ধতির চর্চা করতে হবে।
11. দাওয়াহ, প্রশিক্ষণ, ফতোয়া প্রদান ও পরিবর্তন নিয়ে আসার জন্য প্রজ্ঞাপূর্ণ। ধারাবাহিকতার চর্চা করতে হবে। এসব বিষয়ে যথাযথ সময় আসার আগে তাড়াহুড়ো করে কিছু করা যাবে না। ধারাবাহিকতার চর্চা একটি বৈশ্বিক পদ্ধতি এবং একই সঙ্গে এটি
একটি ইসলামি পদ্ধতি।
12. আধ্যাত্মিকতা ও বস্তুবাদ, আল্লাহমুখিতা ও মানবিকতা, বিবেক ও
অন্তর এসব পরস্পর বিপরীত বিষয়গুলোর মধ্যে সুসমন্বয় সাধন করার প্রতি আহ্বান করতে
হবে-যাতে করে প্রতিটি দিক ও বিভাগ তার যথাযথ অংশ বুঝে পায়। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, যেন একটি দিক অন্য দিককে অন্যায়ভাবে ছাপিয়ে যেতে না পারে। এভাবে ইবাদত, সংস্কৃতি, শরীরচর্চা
বা খেলাধুলা ও শিল্পচর্চা-সবকিছুর যত্ন নিলে দাওয়াহর মধ্যে পরিপূর্ণতা আসে। কারণ, ইবাদত আত্মাকে খোরাক দেয়, সংস্কৃতি বুদ্ধিবৃত্তিকে খোরাক
দেয়, শরীরচর্চা বা খেলাধুলা শরীরকে খোরাক দেয় এবং শিল্পচর্চা অন্তরকে খোরাক দেয়।
13. সত্যিকার অর্থে শান্তির জন্য যারা হাত বাড়িয়ে দেবে, তাদের
শান্তির দিকে আহ্বান করতে হবে। তবে এর
পাশাপাশি দ্বীন তথা ইসলামের সম্মান ও পবিত্রতা, ইসলামের ভূমি, ইসলামের
উম্মাহ বা জাতি,
পৃথিবীর বুকে নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষদের রক্ষা এবং উদ্ধত
ও স্বৈরাচারী শাসকদের থামানোর জন্য আল্লাহর পথে জিহাদের আবশ্যকীয়তা মাথায় রাখতে
হবে। একই সঙ্গে জিহাদের প্রকারভেদ ও ক্ষেত্রগুলো
বর্ণনা করতে হবে। যেমনঃ মানসিক ও আত্মিক
জিহাদ, দাওয়াহর মাধ্যমে জিহাদ, বেসামরিক জিহাদ ইত্যাদি।
14. মুসলিম উম্মাহকে এ ব্যাপারে সচেতন করতে হবে যে, উড়ে
এসে জুড়ে বসা ভিনদেশি অপরিচিত শাসন থেকে ইসলামের ভূমিগুলোকে মুক্ত করার জিহাদটি
ফরজে আইন বা ব্যষ্টিক আবশ্যকীয় কর্তব-যাতে করে তাদের ইসলামের ভূমি থেকে বিতাড়িত
করা যায়। আর এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যে ভূমিটি মুক্ত
করাটা আবশ্যক, সেটি হলো ফিলিস্তিন।
15. যেকোনো ধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘুদের অধিকারের স্বীকৃতি দিতে
হবে। ইসলাম তাদের সাথে যেভাবে আচরণ করতে বলেছে, ঠিক
সেভাবে আচরণ করতে হবে। যেমনঃ
তারা যেভাবে নিজের ধর্ম পালন করতে চায়, সেভাবে করতে দেওয়া, তাদের
বিশ্বাসগত বা ধর্মীয় অথবা ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানো পরিহার করতে হবে। তাদের ‘দারুল ইসলামের অধিবাসী’ হিসেবে গুরুত্বারোপ করতে হবে। সে হিসেবে বর্তমানের ভাষায় তারা হলো ‘জনগণ’। ফলে জনগণ হিসেবে মুসলিমরা যেসব অধিকার ভোগ করবে এবং যেসব
কর্তব্য পালন করবে,
অমুসলিমরাও সেসব অধিকার উপভোগ করবে এবং সেসব কর্তব্য পালন
করবে। তবে পৃথক ধর্মীয় অধিকার ও কর্তব্য তাদের
ওপর আরোপিত হবে না।
16. বিবেক ও চিন্তা-ভাবনাকে সম্মান করা উচিত। সেইসঙ্গে আল্লাহর সৃষ্টিগত যেসব নিদর্শন নিজেদের মধ্যে ও দিক-দিগন্তের
মধ্যে ছড়িয়ে আছে,
সেগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত ও গভীর চিন্তা-ভাবনা করার দিকে
আহ্বান করতে হবে। পাশাপাশি কুরআনের মধ্যে অবতীর্ণ আয়াত বা
নিদর্শনগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত ও গভীর চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। চিন্তার বদ্ধতা ও পূর্বপুরুষ, নেতা, মুরব্বি
বা সাধারণ মানুষের অন্ধ অনুসরণকে প্রতিরোধ করতে হবে। আর বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত প্রত্যাদেশ ও বিবেকের দ্ব্যর্থহীন যুক্তি কখনো
সাংঘর্ষিক হতে পারে না-এই বিষয়টিতে জোর দিতে হবে।
17. মানবিক ভিত্তি ও সামাজিক মূল্যবোধের দিকে আহ্বান জানাতে হবে। যেমনঃ ন্যায্যতা বজায় রাখা, পরামর্শ
করা, স্বাধীনতা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা এবং মানবিক অধিকারের সুরক্ষা করা।
18. ইসলাম নারীকে যেসব অধিকার, মর্যাদা ও সম্মান দিয়েছে, সেগুলো
ঠিকভাবে আদায় করার প্রতি জোর দেওয়া।
সেইসঙ্গে ইসলামের নামে পিছিয়ে পড়া ও পশ্চাদপদ সময়ের তলানি থেকে নারীদের উঠিয়ে
আনা। সেইসঙ্গে পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক যুদ্ধের
দুর্বিপাকের তলানি থেকেও নারীকে উঠিয়ে আনতে হবে। কারণ, এরা নারীকে তার স্বভাবজাত প্রকৃতি ও নারীত্ব থেকে বের করে দিতে চায়।
19. একটি নিরাপদ ও সুস্থ সমাজ বিনির্মাণের প্রথম স্তম্ভ হিসেবে ‘পরিবার’-এর
বিষয়ে যত্নশীল হওয়া উচিত।
বিবাহিত যুগলদের একে অন্যের অধিকার সম্পর্কে যত্নশীল হওয়া উচিত। বোঝাপড়া অসম্ভব হলেই কেবল তালাকের দারস্থ হওয়া, অন্যথায়
তালাককে এড়িয়ে যাওয়া উচিত ব্যাপকতা ও নিষিদ্ধতার মাঝামাঝি থেকে বিধিনিষেধ ও
শর্ত-সাপেক্ষে পুরুষের বহু বিবাহের বৈধতা মেনে নেওয়া।
20.বিশ্বস্ত ও শক্তিশালী শাসক বাছাই করার ক্ষেত্রে জনগণের অধিকারের প্রতি সম্মান
প্রদর্শন করতে হবে। শাসকগণ তাদের দক্ষতা ও কর্মের মাধ্যমে
জনগণের আস্থা অর্জন করবে। জনগণের ইচ্ছাকে হেয়
করবে না। আর এমন শাসক হয়ে জনগণের কাঁধে চেপে বসবে
না-যাকে তারা ঘৃণা করে। আর জনগণের অধিকার; বরং
কর্তব্য হলো-শাসকের কাজের জবাবদিহিতা ও হিসাব চাওয়া, ভুল
করলে শুধরে দেওয়া,
বিভ্রান্ত হলে ঠিক করে দেওয়া, সঠিক পথ
ছেড়ে বিভ্রান্তিতে লেগে থাকলে তাকে সুন্দর পন্থায় অপসারণ করা।
21. মুসলিম উম্মাহর অর্থনীতিকে এমনভাবে শক্তিশালী ও পরিপূর্ণতা
প্রদানে কাজ করতে হবে,
যেন উম্মাহ সামরিক ও বেসামরিকভাবে স্বনির্ভর হতে পারে। সেইসঙ্গে এই অর্থনীতির ভিত্তি ইসলামের গভীর জ্ঞান ও
ইসলামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের আলোকে নির্মাণ করতে হবে। ইসলামসম্মত এ রকম অর্থনীতি প্রণয়নের জন্য তাত্ত্বিক পরিকল্পনা ও ব্যবহারিক
প্রচেষ্টা জারি রাখতে হবে-যাতে করে পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার তুলনায়
আলাদা একটি ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে।
22. ইসলামি উম্মাহর অস্তিত্ব ও স্থায়িত্বে আস্থা রাখা। সেইসঙ্গে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের আবশ্যকীয়তা এবং বিভিন্ন
মতবাদ ও মতাদর্শ সত্ত্বেও মুসলিমদের মাঝে থাকা দ্বীনি ভ্রাতৃত্বের ব্যাপারে
আস্থাশীল হওয়া। মুসলিমদের বিভিন্ন দল-উপদলগুলোকে এক উম্মাহর
অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা-যতক্ষণ পর্যন্ত তারা কাবার দিকে ফিরে নামাজ পড়ে, কুরআন ও
হাদিসে বিশ্বাস রাখে।
23.যে ব্যক্তি কালিমা শাহাদাতের বাক্য দুটো পাঠ করবে, কিবলার
দিকে ফিরে নামাজ আদায় করবে এবং এমন কিছু তার তরফ থেকে প্রকাশ পাবে না-যা
অকাট্যভাবে কালিমা শাহাদাতের বিপরীতে যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত তার সম্পর্কে
সুধারণা বজায় রাখতে হবে। মূলনীতি হলো, একজন
মুসলিমের অবস্থাকে যতটা সম্ভব সঠিক ও যথাযথ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত সুস্পষ্ট কারণ পাওয়া যাবে না, ততক্ষণ
পর্যন্ত একজন মুসলিমকে কাফির ও ফাসিক হিসেবে সাব্যস্ত করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে কোনো ব্যাখ্যা বা মন্তব্যের ব্যাপারে কুফর বা
ফাসিক সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে বিরত থাকতে হবে।
24. বিশ্বজুড়ে যত মুসলিম সংখ্যালঘু আছে, তাদের
মুসলিম উম্মাহর অংশ হিসেবে বিবেচনা করে এবং ইসলামের সাথে অসামঞ্জস্য সমাজে বসবাসের
কারণে তার জন্য আলাদা মর্যাদা বিবেচনায় রাখার মাধ্যমে সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রতি যত্নশীল
হওয়া। সংখ্যালঘু মুসলিমরা যেন তাদের সমাজে ইসলাম
মেনে বসবাস করতে পারে,
সক্রিয় ও উর্বর ভূমিকা রাখতে পারে, তাদের
নৈতিকতা ও লেনদেনে যেন ইসলামকে মূর্ত করতে পারে, সেজন্য মুসলিম উম্মাহকে তাদের
সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে। যাতে
করে তারা বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিজেদের বিবেচনা ও বোধকে ইসলামের আলোকে ঢেলে সাজাতে
পারে। যাতে তাদের স্লোগান হয়ে উঠতে পারে-‘বিচ্ছিন্ন
ও নিঃসঙ্গহীনভাবে ইসলামের ওপর অটল থাকা এবং বিলীন না হয়ে সমাজের সাথে মিলেমিশে
থাকা। ‘
25.ধর্মীয় বহুত্ববাদ (Religious
Pluralism), ঐতিহ্যিক বহুত্ববাদ, ভাষিক বহুত্ববাদ, সাংস্কৃতিক
বহুত্ববাদ, রাজনৈতিক বহুত্ববাদকে স্বীকার করে নিতে হবে। কোনো ধরনের সংকোচন শক্তি, আধিক্য ও সম্পদের অহংকার ত্যাগ করে বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে
সহাবস্থান, বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে আন্ত-বিনিময় (Cross-Fertilization of Cultures), পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া ও অভিযোজন সংঘটিত হওয়াটা জরুরি।
26. পৃথিবীকে নির্মাণ করা, বৈষয়িক বা মানবিক সকল ধরনের
উন্নতি বাস্তবায়ন,
সব ধরনের উপাদানের মাধ্যমে পরিবেশকে সংরক্ষণ, বিকৃতি
ও দূষণ থেকে পরিবেশকে রক্ষা, পরিবেশের ভারসাম্য ও বৈশ্বিক ভারসাম্যকে হেফাজত, মানুষের
জীবনযাপনকে যা কিছু সহজ ও সুন্দর করে, সেগুলোর ক্ষেত্রে পারস্পরিক
সহযোগিতা করা এবং এটিকে আল্লাহর পথে জিহাদ ও ইবাদত হিসেবে বিবেচনা করা।
27.বিপর্যয় ও পশ্চাদ্গামিতা ঠেকানোর নিমিত্তে যেসব ব্যক্তিরা পরিবর্তন ও
সংস্কারের আহ্বান জানায়,
তাদের উৎসাহিত করতে হবে। কারণ, পশ্চাদ্গামিতা উম্মাহর বুদ্ধিবৃত্তিকে ধ্বংস করে ফেলে আর বিপর্যয় উম্মাহর
বিবেককে অকেজো করে রাখে। প্রকৃত সংস্কার তখনই
সম্পাদিত হবে, যখন তা মুসলিমদের ইচ্ছার আলোকে, আমাদের হাত ধরে, আমাদের
প্রত্যাশার আলোকে এবং আমাদের উদ্দেশ্য ও কল্যাণের আলোকে সম্পাদিত হবে। সংস্কারের একদম শুরুর কাজ হবে সেসব রাজনৈতিক স্বৈরাচারী
নিয়মকানুনের সংস্কার সাধন,
যা আমাদের মুসলিম জনগণকে শাসন করছে। আর পরিবর্তনের মূল জায়গাটি হলো মানুষের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন।
28.ইসলামকে সাহায্য করা এবং উম্মাহর জাগরণে কাজ করছে-এমন সব শক্তি, দল, সংগঠন ও
আন্দোলনকে এক কাতারে এবং এক লক্ষ্যে নিয়ে আসার জন্য কাজ করা উচিত। এক্ষেত্রে এটা আবশ্যক নয় যে, সবাইকে
একই আন্দোলন বা একই দলের অধীনে একত্রিত করতে হবে। অধিকন্তু সক্রিয় মানুষের মাঝে মতভেদ ক্ষতিকর নয়, যতক্ষণ
সেটি পারস্পরিক বিরোধিতায় রূপ না নিয়ে বৈচিত্র্যতার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে এবং
লড়াইয়ের দিকে না গিয়ে ভিন্নতা কেবল বৈশিষ্ট্যের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে।
29. পুরো বিশ্বকে উজ্জ্বল করেছে আমাদের মুসলিম উম্মাহর এমন
ঐতিহাসিক অর্জনগুলোকে যথাযথ মর্যাদায় সমাদর করা বাঞ্ছনীয়। যেমনঃ উপযুক্ত সময়ে বিভিন্ন জাতিকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে
মুক্তির জন্য বিভিন্ন যুদ্ধে অর্জন করা বিজয়গুলো। বিশেষভাবে জোর দিয়ে উল্লেখ করতে হবে উম্মাহর প্রতিষ্ঠিত সেই সভ্যতাকে, যা
জ্ঞান ও বিশ্বাসকে একটি সুতোয় গেঁথেছিল।
সেইসঙ্গে গৌরবময় অতীতের প্রশংসায় ভেসে থাকা এবং ট্রাজেডিগুলোকে নিয়ে কান্নায়
মেতে থাকা একদম চলবে না;
বরং আমাদের কর্তব্য হলো, অতীতের অনুপ্রেরণাকে কাজে
লাগিয়ে বর্তমানকে এগিয়ে নেওয়া এবং ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করা।
30.
আমাদের
বিভিন্ন প্রশস্ত ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে যা কিছু উত্তম, সেগুলো থেকে উপকৃত হতে হবে। যেমনঃ ফিকাহবিদদের বিন্যাস, উসুলবিদদের
মূলনীতি ঠিক করার অনন্য তৎপরতা, হাদিস শাস্ত্রবিদদের হাদিস সংরক্ষণ করার অসাধারণ উদ্যোগ, আকিদাহ
ও কালাম শাস্ত্রবিদদের বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান, সুফিবাদীদের আধ্যাত্মিক প্রেরণা, ইতিহাসবিদদের
বর্ণনা, কবি ও সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্ম, প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের অনুধাবনলব্ধ
জ্ঞান, জ্ঞানী ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয়গুলো থেকেও যথাযথ ফায়দা হাসিল করতে
হবে। পাশাপাশি এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, এগুলো
নিষ্পাপ ও নির্ভুল নয়। এগুলো সমালোচনা, পর্যালোচনা, পরামর্শ, বাছ-বিচাররের
মাধ্যমে অগ্রাধিকার প্রদান কিংবা দুর্বল সাব্যস্ত হওয়ার উপযুক্ত। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, সামগ্রিকভাবে উম্মাহ কখনো
ভ্রান্তির ওপর একত্রিত হবে না।
সমাপ্ত
বড্ড কঠিন সময় পাড়ি দিচ্ছে মুসলিম উম্মাহ। প্রান্তিকতার এই অস্থির সময়ে তাই মধ্যমপন্থার আলোকমশাল
জ্বালিয়ে দিতে হবে প্রতিটি অন্তরে। চরম
কিংবা নরম দুটোই বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
প্রান্তিকতার দেয়াল ভেঙে মুক্তির নতুন সূর্য আনতে ‘মধ্যমপন্থা হতে পারে সফল মাধ্যম।
মধ্যমপন্থার ব্যাখ্যা, ক্ষেত্র, পরিসীমা
ও প্রয়োগবিধি নিয়ে শাইখ ইউসুফ আল কারজাভির চমৎকার উপস্থাপনা ‘মধ্যমপন্থা’
(ওয়াসাতিয়্যাহ) পড়ে নতুন করে ভাবার খোরাক পাওয়া যাবে, ইনশাআল্লাহ।
টীকাঃ
১. হাদিসটি ইমাম বুখারি ‘আহাদিসুল-আম্বিয়া’-তে উল্লেখ
করেছেন; হাদিস-৩৩৩৯। ইমাম আহমাদ
তাঁর মুসনাদে উল্লেখ করেছেন; হাদিস-১১২৭১। ইমাম তিরমিজি ‘তাফসিরুল
কুরআন’-এ উল্লেখ করেছেন; হাদিস-২৯৬১। প্রত্যেকেই আবু
সাইদ খুদরি থেকে বর্ণনা করেছেন।
২. দেখুন তাফসির আত-তাবারি (১২/১৯৩), তাফসির ইবনে
কাসির (৪/৫২১), তাফসির আল কুরতুবি (২/১৪৮)
৩. তাফসির আল ফাখর আর রাজি (৪/১০৮,১০৯), প্রকাশনীঃ আল মাতবাআহ আল মিসিয়্যাহ ১৩৫৪ হি. (১৯৩৫ ইসায়ি)
৪. তাফসির আবি আস-সাউদ (১/১২৩), সাবিহ সংস্করণ
৫. প্রাগুক্ত।
৬. ইমাম আহমাদ তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন
(হাদিস-২০৩৫১)। হাদিসটির সনদ
যাচাই-বাছাইয়ের বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, হাদিসটির সনদ সহিহ বা বিশুদ্ধ এবং
সাহাবি ছাড়া সনদের বাকি সব বর্ণনাকারীগণ সিকাত বা শক্তিশালী। এক্ষেত্রে
সাহাবির ব্যাপারে জানা না থাকাটা হাদিসের মানের ক্ষেত্রে কোনো ক্ষতি করবে না।
এ ছাড়াও হাদিসটি আবু ইয়ালা তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে উল্লেখ
করেছেন (১৩/১০১)। আর বায়হাকি
তাঁর আশ-শুআব গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন (৪/৬১)। আর আল-হায়সামি তাঁর মাজমা’ আজ যাওয়ায়েদ
গ্রন্থে বলেছেন-হাদিসটি আবু ইয়ালা বর্ণনা করেছেন, আর তাঁর
সনদটি সহিহ বা বিশুদ্ধ।
৭. তাফসির ইবনে কাসির (১/১৯০)
৮. আল্লাহর অস্তিত্বের মতো একটি মৌলিক ও সবচেয়ে বড়ো
বাস্তবতাটি রাসূলের কাছে ওহি বা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়নি। কারণ, ওহি বা রিসালাত
হলো-যিনি ওহি দিচ্ছেন বা রাসূল প্রেরণ করছেন (অর্থাৎ মহান আল্লাহ) তাঁর সাব্যস্ত
হওয়ার একটি আনুষঙ্গিক ও পরের স্তরের বিষয়। বরং মানুষের আকল বা
যুক্তি-বুদ্ধির নিজের প্রয়োজনে এবং ফিতরাত বা মানবীয় স্বভাবজাত প্রকৃতির
মাধ্যমেই মূলত আল্লাহর অস্তিত্ব সাব্যস্ত হয়। এ ছাড়া আল্লাহর অস্তিত্ব
অস্বীকারকারীদের সাথে মুখোমুখি হলে যুক্তি-বুদ্ধির ব্যবহারের মাধ্যমেই তা সাব্যস্ত
করতে হয়।
৯. ইমাম মুসলিম হজরত আবু হুরায়রা থেকে জিকির, দুআ, তওবা ও ইস্তিগফার অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন।
১০. ইনজিল, বুক অফ ম্যাথিউ (৫/১৭)
১১.
Epistle of Pual to Titus: 1/15.
১২. Manichaeism নামক ধর্ম বা মতবাদের প্রবক্তা। -অনুবাদক
১৩. Mazdakism নামক ধর্ম বা মতবাদের প্রবক্তা। এই মতবাদটি Zoroastrianism-এর
পরিবর্ধিত রূপ।-অনুবাদক
১৪. অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার নিষেধ সত্ত্বেও তাদের
স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার ফলস্বরূপ তারা সুদের মতো একটি অন্যায় ব্যবস্থার
মাধ্যমে মানুষের সম্পদকে অন্যায়ভাবে গ্রাস করত। -অনুবাদক
১৫. দেখুন, ড. আস সেলজুকির লেকচার। ‘আর এভাবেই আমি
তোমাদের বানিয়েছি একটি মধ্যমপন্থি জাতি’, সিজন-১, আল-আজহারের
পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ফর ইসলামিক কালচার।
১৬. ইনজিল, বুক অফ লুক (২০/২৫); বুক
অফ ম্যাথিউ (২২/২১)
১৭. দেখুন আমাদের রচিত আল-খাসাইস আল ‘আম্মাহ লিল
ইসলাম (ইসলামের সর্বজনীন বৈশিষ্ট্যসমূহ) বইয়ের ‘আল-ওয়াসাতিয়্যাহ’ অধ্যায়টি, পৃষ্ঠা-১২৫
১৮. মুত্তাফাকুন আলাইহি। ইমাম বুখারি হাদিসটি তাঁর ‘ফাদাইল আসহাবিন
নাবি’ অধ্যায়ে নিয়ে এসেছেন, হাদিস-৩৬৫১। আর ইমাম মুসলিম
ফদাইলুস সাহাবা অধ্যায়ে নিয়ে এসেছেন, হাদিস-৩৫৯৪; মুসনাদ
আহমাদ, হাদিস-২৫৩৩; ইমাম তিরমিজি আল
মানাকিব অধ্যায়ে, হাদিস-৩৮৫৯; ইমাম
ইবনে মাজাহ আল-আহকাম অধ্যায়ে, হাদিস-২৩৬২-সবগুলো হাদিস ইবনে
মাসউদ থেকে বর্ণিত।
১৯. তালবিসু ইবলিস, পৃষ্ঠা-৮১
২০. দেখুনঃ আমাদের বই ইসলামে হালাল হারামের বিধান, পৃষ্ঠা-১০,
১২
২১. হাদিসটি ইমাম মুসলিম ‘আল-ইলম’ অধ্যায় (২৫৬৭০), ইমাম আহমাদ তাঁর মুসনাদে
(৩৬৫৫), ইমাম আবু দাউদ ‘আস-সুন্নাহ’ অধ্যায়ে (৪৬০৮) ইবনে মাসউদ-এর বরাতে বর্ণনা
করেছেন।
২২. আকিদাহঃ ইসলামের বিশ্বাসসংক্রান্ত কার্যপ্রণালিকেই (Modus Operandi) মূলত
আকিদাহ বলা হয়। যেমনঃ আল্লাহর একত্ববাদ, রিসালাত, আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসসহ প্রভৃতি বিষয়। বিস্তারিত জানতে দেখুন, ‘আল মাউসুআহ আল
ফিকহিয়্যাহ’ (ফিকহ বিশ্বকোষ), কুয়েত
ধৰ্ম মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত, খণ্ড-০৫, পৃষ্ঠা-২০৪)।-অনুবাদক
২৩. শরিয়াহঃ আল্লাহর কাছ থেকে যা কিছু বিধান ও আইনকানুন
হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে,
সেগুলোকে এক শব্দে শরিয়াহ বলে। বিস্তারিত জানতে দেখুন ‘দিরাসাহ
ফি ফিকিহ মাকাসিদ আশ-শারিয়াহ’, ড. ইউসুফ আল কারজাভি, ৩য় সংস্করণ, (কায়রোঃ দার আশ-শুরুক, ২০০৮ ইং), পৃষ্ঠা-১৬-২০।– অনুবাদক
২৪. ‘ইবাদতঃ ইবনু ‘আবিদিনের মতে-যেসব কাজ নিয়তের ওপর
নির্ভর করে এবং সম্পাদন করলে সওয়াব হয়, সেসব কাজকে ইবাদত
বলা হয়। বিস্তারিত
জানতে দেখুন-‘আল মাউসুআহ আল ফিকহিয়্যাহ’ (ফিকহ বিশ্বকোষ),
প্রাগুক্ত, খণ্ড-৩৩, পৃষ্ঠা-৯৩)।-অনুবাদক
২৫. মুয়ামালাতঃ মানুষের পারস্পরিক লেনদেন, বেচাকেনা,
বিয়েশাদি, খাওয়া-দাওয়া ইত্যদি বিষয়গুলোকে
এক শব্দে মুয়ামালাত বলে। -অনুবাদক
২৬. দাওয়াহঃ ইসলাম যা কিছু নিয়ে এসেছে, সেগুলোর
প্রচার-প্রসার ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার কার্যক্রমকে দাওয়াহ বলা হয়। বিস্তারিত
জানতে দেখুন-আল মাদখাল ইলা ‘ইলম আদ দাওয়াহ, আবুল
ফাতহ আল বায়ানুনি, ৩য় সংস্করণ, (বৈরুতঃ
মুয়াসসাসাহ আর-রিসালাহ, ১৯৯৫ ইং), পৃষ্ঠা-১৪। -অনুবাদক
২৭. উম্মাহঃ শব্দটির শাব্দিক অর্থ হলো জাতি, মানুষের গ্রুপ। কিন্তু ইসলামিক
প্রেক্ষাপটে যখন শব্দটি ব্যবহৃত হয়, তখন এটি দিয়ে মূলত সমস্ত মুসলিম
জাতিকে বোঝানো হয়।
এ ছাড়া ব্যাপকার্থে উম্মাহ শব্দটি দুই প্রকারঃ এক, উম্মাহ
ইস্তিজাবাহ (যে উম্মাহ ইসলামের ডাকে সাড়া দিয়েছে; অর্থাৎ
মুসলিমগণ)। দুই, উম্মাহ দাওয়াহ
(যে উম্মাহ ইসলামের আহ্বান শোনার উপযুক্ত; অর্থাৎ অমুসলিমগণ)। -অনুবাদক
২৮. মাকাসিদঃ কুরআন-সুন্নাহর বিধিবিধানের সাথে জুড়ে থাকা
লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও প্রজ্ঞাকে এক শব্দে মাকাসিদ বলে। বিস্তারিত জানতে
দেখুন-“দিরাসাহ ফি ফিকিহ মাকাসিদ আশ-শারিয়াহ’, ড. ইউসুফ আল কারজাভি, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২০-২২। -অনুবাদক
২৯. জিকিরঃ শাব্দিক অর্থ হলো স্মরণ করা, উল্লেখ করা
ইত্যাদি। পরিভাষায়
বিভিন্ন ইবাদত,
দুআ, কুরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য
শারিয়াহসম্মত কাজের মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করাকে জিকির বলা হয়। বিস্তারিত
জানতে দেখুন-‘আল মাউসুআহ আল ফিকহিয়্যাহ (ফিকহ বিশ্বকোষ)’, প্রাগুক্ত,
খণ্ড-২১, পৃষ্ঠা-২১৯,২২০)। -অনুবাদক
৩০. ইস্তিগফার-শাব্দিক অর্থ ক্ষমা চাওয়া। পরিভাষায়-নিজের
কৃত ভুল,
পাপ ও অপরাধের জন্য আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে ক্ষমা প্রার্থনা
করার প্রক্রিয়াকে ইস্তিগফার বলে। বিস্তারিত জানতে দেখুন ‘আল
মাউসুআহ আল ফিকহিয়্যাহ (ফিকহ বিশ্বকোষ)’, প্রাগুক্ত, খণ্ড-০৪,
পৃষ্ঠা-৩৪)। -অনুবাদক
৩১. শিরকঃ শব্দটির অর্থ-অংশ, অংশীদারিত্ব। আল্লাহর
প্রভুত্ব ও ইবাদাতের মধ্যে কাওকে অংশ হিসেবে স্বীকার করার নাম হলো শিরক। বিস্তারিত
জানতে দেখুন ‘আল মাউসুআহ আল ফিকহিয়্যাহ’ (ফিকহ বিশ্বকোষ),
প্রাগুক্ত, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৬)।-অনুবাদক
৩২. বিদায়াতঃ ইবাদতের ক্ষেত্রে এমন নতুন কিছুর উদ্ভাবন
কিংবা যোগ করা,
শারিয়াহর মধ্যে যার কোনো ভিত্তি নেই। বিস্তারিত জানতে দেখুন ‘আল
মাউসুআহ আল ফিকহিয়্যাহ’
(ফিকহ বিশ্বকোষ), প্রাগুক্ত, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা-২৩)।-অনুবাদক
৩৩. তাকলিফঃ কোনো একটি কাজ আবশ্যক হিসেবে করা বা না করা এবং
কোনো একটি কাজ করা বা না করার মধ্যে বাছাই করার যে গুরু-দায়িত্ব ইসলাম একজন
বান্দার ওপর অর্পণ করে,
সেই দায়িত্বকে তাকলিফ বলে। বিস্তারিত জানতে দেখুন আল
ওয়াজিজ ফি উসুলিল ফিকহ,
ড. আব্দুল কারিম জায়দান, প্রকাশনীঃ
মুয়াসসাসাহ কুরতুবাহ, পৃষ্ঠা-২৫। –অনুবাদক
৩৪. ফরজে আইনঃ যে সমস্ত আবশ্যকীয় কর্তব্য পালন করা
প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ফরজ, সেগুলোকে ফরজে আইন বলে। যেমনঃ নামাজ, রোজা ইত্যাদি। বিস্তারিত
জানতে দেখুন-আল ওয়াজিজ ফি উসুলিল ফিকহ, ড. আব্দুল কারিম জায়দান, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৩৬।-অনুবাদক
৩৫. ফরজে কিফায়াঃ যে সমস্ত আবশ্যকীয় কর্তব্য পালন করা
ব্যক্তি হিসেবে প্রত্যেকের জন্য ফরজ নয়; বরং নির্দিষ্ট আওতার মধ্যে কেউ কেউ
পালন করলে সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে, সেগুলোকে ফরজে
কিফায়া বলে। যেমনঃ জানাজার নামাজ। বিস্তারিত জানতে দেখুন-আল
ওয়াজিজ ফি উসুলিল ফিকহ,
প্রাগুক্ত। -অনুবাদক
৩৬. বুখারি ‘আল আদাবুল মুফরাদ’ (১/১০৪)
গ্রন্থে, আহমাদ তাঁর মুসনাদে (৮৯৫২) ‘সালিহ আল আখলাক’
শব্দে নিয়ে এসেছেন। এর তাখরিজকারীরা বলেছেন-‘সহিহ ও
শক্তিশালী’।
আর
হাকিম তাওয়ারিখুল মুতাকাদ্দিমিন মিনাল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালিন (২/৬৭০) গ্রন্থে
এনেছেন এবং বলেছেন-‘মুসলিমের শর্তয়ানুযায়ী সহিহ; যদিও তারা এটিকে এই
সনদে তাখরিজ করেননি।’ বায়হাকি ‘শু’আবুল ঈমান’ গ্রন্থে (৬/২৩০), বায়হাকি আস-সুনানুল কুবরা
গ্রন্থের কিতাবুশ শাহাদাতে (১০/১৯১) উল্লেখ করেছেন। হাদিসটির বর্ণনাকারী হলেন আবু
হুরায়রা।
৩৭. ফতোয়াঃ বিভিন্ন বিষয়ে নির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট, ব্যক্তি বা
গোষ্ঠীর তরফ থেকে উত্থাপিত প্রশ্নের বিপরীতে শরিয়াহর বিধান বর্ণনা করার
প্রক্রিয়াকে ফতোয়া বলা হয়। বিস্তারিত জানতে দেখুন-‘আল ফতোয়া বাইনাল ইনদিবাত ওয়া
আত-তাসায়্যুব,
‘ড. ইউসুফ আল-কারজাভি, ১ম সংস্করণ, (কায়রোঃ দার আস-সাহওয়া, ১৪০৮ হি.) পৃষ্ঠা-১১। -অনুবাদক ৩৮. ‘উরফঃ
শরিয়াহর পরিভাষায়,
সামাজিকভাবে সেসব স্থিরকৃত প্রচলন ও প্রথা যা সুস্থ প্রকৃতি ও
স্বভাব গ্রহণ করে থাকে। বিস্তারিত জানতে দেখুন-‘আল কাওয়াইদ আল ফিকহিয়্যাহ
আল-কুবরা,
ড. সালিহ বিন গানিম আস-সাদলান, ১ম সংস্করণ,
(রিয়াদঃ দার বিলানসিয়া, ১৪১৭ হি.), পৃষ্ঠা-৩২৫-৩৩৩।-অনুবাদক
৩৯. ইমাম ইবনুল কায়্যিম রচিত ফতোয়া দেওয়া-নেওয়া
সংক্রান্ত একটি বইয়ের নাম হলো ইলামুল মুয়াক্কিঈন। এই বইতে এ বিষয়ের গুরুত্ব
উপলব্ধি করে লেখক আলাদা একটি অধ্যায় নিয়ে এসেছেন। অধ্যায়টির নাম হলো-‘সময়, স্থান, অবস্থা, উদ্দেশ্য ও
উপকারিতার আলোকে ফতোয়ার পরিবর্তন ও পরিমার্জন’। বিস্তারিত জানতে দেখুন-ইলামুল
মুয়াক্কিঈন,
ইবনু কায়্যিম আল জাওযিয়্যাহ,’ সম্পাদনাঃ
মুহাম্মাদ আব্দুস সালাম ইবরাহিম, ১ম সংস্করণ, (বৈরুত দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যাহ, ১৯৯১ ইং), খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-১১।-অনুবাদক
৪০. বুখারি আল ওয়াদু-তে(২২০), আহমাদ তাঁর
মুসনাদে (৭২৫৫), আবু দাউদ আত-তাহারা-তে (৩৮০), তিরমিজি আত-তাহারা-তে (১৪৭), নাসায়ি আত-তাহারা-তে (৫৬)
উল্লেখ করেছেন। হাদিসটির বর্ণনাকারী আবু হুরায়রা।
৪১. রুখসাহঃ ফিকহের পরিভাষায়, যৌক্তিক ও
শরিয়াহসম্মত অজুহাতের কারণ কোনো কর্তব্য পালনে অক্ষম হলে যে সহজতর বিকল্প পালন
করার সুযোগ থাকে, সেই প্রক্রিয়াকে রুখসাহ বলে। বিস্তারিত
জানতে দেখুন-‘আল কাওয়াইদ আল-ফিকহিয়্যাহ আল-কুবরা,’ ড. সালিহ বিন গানিম
আস-সাদলান, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৩৩। – অনুবাদক
৪২. ইস্তিসলাহঃ শরিয়াহর প্রত্যেকটি বিধানের মধ্যেই বান্দার
মাসলাহা (কল্যাণ,
স্বার্থ ও উপকার) নিহিত থাকে। যেসব স্বার্থ, উপকার ও
কল্যাণের বিষয়ে কুরআন-হাদিসের কোনো ভাষ্য পাওয়া যায় না, তাকে
ইস্তিসলাহ বলে। এর আরেকটি নাম হলো মাসালিহ মুরসালাহ। ইমাম মালিক ও ইমাম আহ্মাদ বিন
হাম্বাল ইস্তিসলাহ-কে শরিয়াহসম্মত প্রমাণ হিসেবে গণনা করতেন। আর ইমাম গাজ্জালি শর্তযুক্ত
ইস্তিসলাহ মেনে নিয়েছেন। তাঁর শর্ত হলো-
ইস্তিসলাহ অবশ্যই সামগ্রিক, অকাট্য এবং
অবশ্যম্ভাবী-অপরিহার্য প্রয়োজন হিসেবে সাব্যস্ত হতে হবে। বিস্তারিত
জানতে দেখুন-আল ওয়াজিজ ফি উসুলিল ফিকহ, ড. আব্দুল কারিম জায়দান, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৩৮।-অনুবাদক
৪৩. ইস্তিহসানঃ একাধিক কিয়াসের মধ্যে তুলনামূলক বেশি
শক্তিশালী কিয়াসকে নির্দিষ্ট বা বাছাই করাকে ইস্তিহসান বলে। আর কিয়াস হলো ইল্লাত বা কারণ
একই হওয়ার ফলে কুরআন-হাদিসের টেক্সট উল্লেখ আছে-এমন কোনো বিষয়ের বিধানের আলোকে
কুরআন-হাদিসের টেক্সট পাওয়া যায় না এমন কোনো বিষয়ের বিধান নির্ণয় করার
প্রক্রিয়া। বিস্তারিত
জানতে অনুবাদক দেখুন-আল ওয়াজিজ ফি উসুলিল ফিকহ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৩০, ২৩১, ১৯৪। –
৪৪. সাদ্দুয জারিয়াহঃ যেসব কাজ কোনো অন্যায় বা ফাসাদ
কাজের দিকে টেনে নিয়ে যায়, সেসব কাজকে বাধা দেওয়া। দেখুন-আল-ওয়াজিজ
ফি উসুলিল ফিকহ,
ড. আব্দুল কারিম জায়দান, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৪৫। -অনুবাদক
৪৫. বুখারি আল ইলম অধ্যায়ে (৬৯নং), মুসলিম আল
জিহাদ ওয়াস সিয়ার অধ্যায়ে (১৭৩৪), আহমাদ তাঁর মুসনাদে
(১৩১৭৫), আবু দাউদ আল আদাব অধ্যায়ে (৪৭৯৪) হাদিসটি উল্লেখ
করেছেন। হাদিসটির
বর্ণনাকারী হলেন আনাস।
৪৬. কাফিরঃ আল্লাহর রাসূল-এর ওপর অবতীর্ণ হওয়া দ্বীন
ইসলামের আবশ্যকীয় জ্ঞাত বিষয়সমূহকে অস্বীকারকারীকে কাফির বলা হয়। দেখুন-‘আল
মাউসুআহ আল-ফিকহিয়্যাহ’
(ফিকহ বিশ্বকোষ), প্রাগুক্ত, খণ্ড-৪২, পৃষ্ঠা-৩৪৯)। – অনুবাদক
৪৭. ফাসিকঃ যে মুসলিম ইচ্ছাকৃতভাবে কবিরা গুনাহ সম্পাদন করে
এবং কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই ছোটো গুনাহের ওপর অটল থাকে, তাকে ফাসিক বলে। দেখুন-‘আল-মাউসুআহ
আল-ফিকহিয়্যাহ’
(ফিকহ বিশ্বকোষ), প্রাগুক্ত, খণ্ড-৩৬, পৃষ্ঠা-২৬৫)। -অনুবাদক
৪৮. এ ধরনের সূত্রগুলোকে শরিয়াহ বিজ্ঞানের পরিভাষায়
আল-কাওয়াইদ আল ফিকহিয়্যাহ বলে। উল্লেখিত সূত্রটির বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ মোটামুটি সকলেই
একমত। এই সূত্রের
অধীনে আরও অনেকগুলো অনুসিদ্ধান্ত থাকে। কুরআন ও হাদিসের নসকে (Text) আরোহ পদ্ধতিতে
সাজিয়ে গবেষণার মাধ্যমে এই সূত্রগুলোকে দাঁড় করানো হয়। বিস্তারিত
জানতে দেখুন ‘আল কাওয়াইদ আল-ফিকহিয়্যাহ আল-কুবরা’, ড. সালিহ বিন গানিম
আস-সাদলান, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৩,
৯৭। অনুবাদক
৪৯. বুখারি আল-ফিতান অধ্যায়ে (৭০৫৫নং), মুসলিম
আল-ইমারাহ অধ্যায়ে (১৭০৯নং) এবং আহমাদ তাঁর মুসনাদে (২২৬৭৯নং ও ২২৭২৫নং) উল্লেখ
করেছেন। হাদিসটির
বর্ণনাকারী হলেন উবাদাহ বিন সামিত।
৫০. ইমাম বুখারি ‘আল-ইতিসাম বিল-কিতাব ওয়াস-সুন্নাহ’ অধ্যায়ে
(৭৩১২নং), ইমাম মুসলিম ‘আজ-জাকাত’ অধ্যায়ে
(১০৩৭নং), ইমাম আহমাদ মুসনাদের মধ্যে (১৬৮৪২নং), ইবনে মাজাহ তাঁর বইয়ের শুরুতে (২২১নং) এবং তাবারানি ‘আল কাবির’ গ্রন্থে (১৯/৩২১) উল্লেখ করেছেন। হাদিসটির
বর্ণনাকারী হলেন মুয়াবিয়া।
No comments:
Post a Comment
আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।