সূরা কাফিরূন ও ইখলাস আমাদের যা শেখায় - আমার প্রিয় বাংলা বই

সাম্প্রতিকঃ

Post Top Ad

Responsive Ads Here

September 21, 2024

সূরা কাফিরূন ও ইখলাস আমাদের যা শেখায়

 


সূরা কাফিরূন ও ইখলাস আমাদের যা শেখায়

সংগ্রহ ও সম্পাদনাঃ মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম

(এটি কুড়িয়ে পাওয়া একটি লিখা আমার কম্পিউটারে কপিকৃত একটি লিখা লিখাটি কার, কখন কোথা থেকে সংগৃহিত-তা বলা মুশকিল লিখাটি আমার অনেক উপকারে আসবে মনে করে কতিপয় সম্পাদনা সহ সংরক্ষণ করলাম)

بسم الله الرحمن الرحيم

1.    বল, হে কাফিররা!

﴿قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ﴾

2.   তোমরা যার ইবাদাত কর আমি তার ইবাদাত করি না

﴿لَا أَعْبُدُ مَاتَعْبُدُونَ﴾

3.   এবং আমি যার ইবাদাত করি তোমরা তার ইবাদাতকারী নও

﴿وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ﴾

4.   আর তোমরা যার ইবাদত করছ আমি তার ইবাদাতকারী হব না

﴿وَلَا أَنَا عَابِدٌ مَا عَبَدْتُمْ﴾

5.   আর আমি যার ইবাদাত করি তোমরা তার ইবাদাতকারী হবে না

﴿وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ﴾

6.   তোমাদের জন্য তোমাদের দীন আর আমার জন্য আমার দীন

﴿لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِين﴾

بسم الله الرحمن الرحيم

1.    বল, তিনিই আল্লাহ, এক-অদ্বিতীয়

﴿قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ﴾

2.   আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন

﴿اللَّهُ الصَّمَدُ﴾

3.   তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি

﴿لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ﴾

4.   আর তাঁর কোন সমকক্ষও নেই

﴿وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ﴾

সূরাদ্বয়ের ফযিলতে

§ অনেকগুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে, এ ক্ষেত্রে বোধ করি এতটুকু বলাই যথেষ্ট হবে।

-       রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর দিন শুরু করতেন এ সূরাদ্বয়ের তেলাওয়াতের মাধ্যমে আর সূরাদ্বয়ের তেলাওয়াতের মাধ্যমেই শেষ করতেন দিন

-       কারণ তিনি অধিকাংশ সময়  ফজরের সুন্নাত ও সালাতুল বিতরে এ সূরা দুটো তেলাওয়াত করতেন

-       রমযান মাসে পৃথিবী ব্যাপি মসজিদগুলোতে এ সূরাদ্বয়ের তেলাওয়াতের গুঞ্জরণ চারিদিক মুখরিত করে তুলে

-       সূরা কাফিরূন দ্বীপ্ত ঘোষণা উচ্চারণ করে যে, তাওহিদ ও শিরকের আকিদার মাঝে কোনোরূপ সামঞ্জস্য নেই উভয় আকিদার মাঝে ন্যূনতম সাদৃশ্যকেও এ সূরা প্রত্যাখ্যান করে

-       আর সূরা ইখলাস তাওহিদের আকিদাকে দৃঢ় ও প্রতিষ্ঠিত করে এ দিক থেকে উভয় সূরাই তাওহিদের নিগুঢ় তত্ত্বকে প্রমাণ করে সুস্পষ্টরূপে (তাফসির ফী যিলালিল কুরআনঃ ৬/৪০০৫)

§ চলমান নিবন্ধে আমরা ‍‌‌‌আল কুরআনের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও তার রূপরেখার আলোকে কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় উৎসারিত করে নিবন্ধটি কয়েকটি পর্বে সাজাতে চেষ্টা করেছি মহান আল্লাহর নিকট আকুল আবেদন, তিনি আমাদেরকে সঠিক পথে অগ্রসর হবার তাওফিক দিন এবং বিষয় উন্মোচণে যথাযথ থাকতে সহায়তা করুন...

পর্বঃ ০১

§ আল্লাহ সম্বন্ধে যথাযথ জ্ঞানের অভাবই সূরাদ্বয় অবতারণের মূল কারণ তাই শানে নুযুল বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমেই নিবন্ধের সূচনা করছি তাছাড়া আল কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও সূরার অর্থ ও তার তত্ত্বগত বিষয়াদি অনুধাবনের ক্ষেত্রে শানে নুযুলের বিশাল ভূমিকা থাকে

সূরা ইখলাসের শানে নুযুলঃ

§ আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ভুল ধারণা এ সূরা অবতীর্ণ হবার মূল কারণ কতিপয় ইহুদি রাসূলুল্লাহ সা. এর নিকট এসে বলল, তুমি আমাদেরকে তোমার রব সম্পর্কে বলতো-তাঁর কিছু বিবরণ দাও আল্লাহ তাআলা তাওরাতে তাঁর পরিচয় তুলে ধরেছেন এবং কতিপয় গুণাবলী বর্ণনা করেছেন সুতরাং তুমি আমাদের বল, তিনি কিসের তৈরি? কোন শ্রেণীভুক্ত তিনি? তিনি কি স্বর্ণ না রৌপ্য নাকি তাম্র? তিনি কি খাবার ও পানীয় গ্রহণ করেন? পৃথিবীর উত্তরাধিকার তিনি কার থেকে পেয়েছেন আর তাঁর উত্তরাধিকারীই বা হবে কে? এর জবাবে আল্লাহ তাআলা এ সূরা (সূরা ইখলাস) নাযিল করেছেন

§ সাহাবি উবাইয় বিন কাব রা. বলেন, মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ সা.কে বলল, তুমি আমাদেরকে তোমরা রবের বংশ পরম্পরা বর্ণনা করে শুনাও, তখন আল্লাহ তাআলা নাযিল করলেনঃ

 ﴿قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ﴾﴿اللَّهُ الصَّمَدُ﴾ (আসবাবুন্নুযূল লিল ওয়াহিদি)

§ তারা বিশ্বাস করত আল্লাহ তাআলার বংশ পরম্পরা ও মেয়ে রয়েছে ফেরেশতারা হচ্ছে তাঁর মেয়ে ইহুদি-খ্রিষ্টানরাও অভিন্ন মত পোষণ করত

﴿وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ ذَلِكَ قَوْلُهُمْ بِأَفْوَاهِهِمْ يُضَاهِئُونَ قَوْلَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَبْلُ قَاتَلَهُمُ اللَّهُ أَنَّى يُؤْفَكُونَ﴾

“আর ইয়াহুদিরা বলে, উযাইর আল্লাহর পুত্র এবং নাসারারা বলে, মাসিহ আল্লাহর পুত্রএটা তাদের মুখের কথা, তারা সেসব লোকের কথার অনুরূপ বলছে যারা ইতঃপূর্বে কুফরি করেছেআল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন, কোথায় ফেরানো হচ্ছে এদেরকে?” (আত তাওবাহঃ ৩০)

সূরা কাফিরূনের শানে নুযুলঃ

§ সূরা কাফিরূন নাযিল হয়েছে কুরাইশের কিছু লোকের একটি আহবানের পরিপ্রেক্ষিতে তারা এসে বলল, হে মুহাম্মাদ, এসো তুমি আমাদের ধর্মের অনুসরণ কর, আমরা তোমার দ্বীনের অনুসরণ করব তুমি আমাদের উপাস্যদের উপসনা কর এক বছর, আমরা তোমার মাবূদের ইবাদত করব এক বছর এর মাধ্যমে তোমার আনীত দ্বীন যদি আমাদের অনুসৃত ধর্ম-কর্ম হতে উৎকৃষ্ট হয় তাহলে আমরা তাতে অংশ গ্রহণ করতে পারলাম এবং তা হতে আমাদের নির্ধারিত অংশ নিতে পারলাম আর যদি তোমার ধর্ম হতে আমাদেরটি উত্তম হয় তাহলে তুমি তাতে অংশ নিতে পারলে এবং তোমার নির্ধারিত অংশ গ্রহণ করতে পারলে নবীজি বললেন, নাউযুবিল্লাহ-তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরিক করা হতে পানাহ চাই এরপর আল্লাহ তাআলা নাযিল করলেনঃ

﴿قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ﴾﴿لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ﴾﴿وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ﴾﴿وَلَا أَنَا عَابِدٌ مَا عَبَدْتُمْ﴾﴿وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ﴾﴿لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ﴾

§ রাসূলুল্লাহ সা. সকালে মসজিদে তাশরিফ রাখলেন পূর্ব হতেই কুরাইশ সম্প্রদায়ের লোকজনে মসজিদ প্রাঙ্গন ছিল পরিপূর্ণ তিনি তাদের সম্মুখে পূর্ণ সূরা তেলাওয়াত করে শুনালেন তাদের হেদায়াতের প্রতি রাসূলুল্লাহর সীমাহীন আগ্রহ দেখে তারা আশা করছিল হয়ত তিনি তাদের প্রস্তাবে সম্মত হবেন কিন্তু সেদিন সকালের পর থেকে তারা আশা ছেড়ে দিল বরং বলা চলে একেবারে নিরাশ হয়ে গেল (আসবাবুন্নুযূল লিল ওয়াহিদি)

পর্বঃ ০২

আল্লাহ সম্বন্ধে সঠিক ধারণাঃ

§ আল্লাহ কে? কী তাঁর পরিচয়? মহা বরকতময় মহান রব সম্বন্ধে সঠিক ধারণাটি কী?

﴿اللَّهُ الصَّمَدُ . لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ . وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ﴾

“আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষীআর তাঁর কোন সমকক্ষও নেইতিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি।”

সাহাবি আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা.-এর মতে الصَّمَد (অমুখাপেক্ষী) অর্থঃ

১. সাইয়েদঃ নেতৃত্বের অধিকারী, যিনি নিজ নেতৃত্বে পূর্ণতায় সমাসীন

২. শরীফঃ মর্যাদাবান, যিনি আপন মর্যাদায় শীর্ষে অবস্থান করছেন

৩. আযীমঃ মহান, যিনি স্বমহিমায় চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত

৪. হালীমঃ সহনশীল, যিনি সহনশীলতায় সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে আছেন

৫. গণীঃ অভাবহীন, যিনি নিজ অমুখাপেক্ষিতায় পূর্ণাতায় পৌঁছেছেন

৬. জাব্বারঃ মহা পরাক্রমশালী, যিনি প্রভাব-বলয়ে পূর্ণতায় অধিষ্ঠিত

৭. আলিমঃ জ্ঞানবান, নিজ জ্ঞানে যিনি পূর্ণতায় উপনীত

৮. হাকীমঃ প্রজ্ঞাময়, নিজ প্রজ্ঞায় যিনি সকলকে ছাড়িয়ে আছেন

§ তিনি এমনই সত্তা, মর্যাদা ও বড়ত্বের সর্বশাখায় যিনি শীর্ষে আছেন যার সকল গুণাগুণ পূর্ণাঙ্গতার মাপকাঠিতে সর্বাধিক উত্তীর্ণ মহান আল্লাহ, এ-ই হচ্ছে তাঁর গুণাগুণ যা তিনি ব্যতীত আর কারো জন্য প্রযোজ্য নয়

§ তিনি চিরঞ্জীব সুপ্রতিষ্ঠিত ধারক, মহা দয়ালু অতি মেহেরবান, যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, এবং অনেক সৃষ্টিকে আমাদের অধীন করে দিয়েছেন...

﴿إِنَّ اللَّهَ فَالِقُ الْحَبِّ وَالنَّوَى يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَمُخْرِجُ الْمَيِّتِ مِنَ الْحَيِّ ذَلِكُمُ اللَّهُ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ﴾﴿فَالِقُ الْإِصْبَاحِ وَجَعَلَ اللَّيْلَ سَكَنًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ حُسْبَانًا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ﴾﴿وَهُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ النُّجُومَ لِتَهْتَدُوا بِهَا فِي ظُلُمَاتِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ قَدْ فَصَّلْنَا الْآَيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ﴾﴿وَهُوَ الَّذِي أَنْشَأَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ فَمُسْتَقَرٌّ وَمُسْتَوْدَعٌ قَدْ فَصَّلْنَا الْآَيَاتِ لِقَوْمٍ يَفْقَهُونَ﴾﴿وَهُوَ الَّذِي أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجْنَا بِهِ نَبَاتَ كُلِّ شَيْءٍ فَأَخْرَجْنَا مِنْهُ خَضِرًا نُخْرِجُ مِنْهُ حَبًّا مُتَرَاكِبًا وَمِنَ النَّخْلِ مِنْ طَلْعِهَا قِنْوَانٌ دَانِيَةٌ وَجَنَّاتٍ مِنْ أَعْنَابٍ وَالزَّيْتُونَ وَالرُّمَّانَ مُشْتَبِهًا وَغَيْرَ مُتَشَابِهٍ انْظُرُوا إِلَى ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَيَنْعِهِ إِنَّ فِي ذَلِكُمْ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾

“নিশ্চয় আল্লাহ বীজ ও আঁটি বিদীর্ণকারীতিনি মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে বেরকারীতিনিই আল্লাহ, সুতরাং (সৎপথ থেকে) কোথায় তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে?

(তিনি) প্রভাত উদ্ভাসিতকারীতিনি বানিয়েছেন রাতকে প্রশান্তি এবং সূর্য ও চন্দ্রকে সময় নিরূপকএটা সর্বজ্ঞ পরাক্রমশালীর নির্ধারণ

আর তিনিই সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য তারকারাজি, যাতে তোমরা এ দ্বারা পথপ্রাপ্ত হও স্থল ও সমুদ্রের অন্ধকারেনিশ্চয় আমি আয়াতসমূহকে বিস্তারিত বর্ণনা করেছি এমন কওমের জন্য যারা জানে

আর তিনিই সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এক নফস থেকেঅতঃপর রয়েছে আবাসস্থল ও সমাধিস্থলঅবশ্যই আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করেছি, এমন কওমের জন্য যারা ভালভাবে বুঝে

আর তিনিই আসমান থেকে বর্ষণ করেছেন বৃষ্টিঅতঃপর আমি এ দ্বারা উৎপন্ন করেছি সব জাতের উদ্ভিদঅতঃপর আমি তা থেকে বের করেছি সবুজ ডাল-পালাআমি তা থেকে বের করি ঘন সন্নিবিষ্ট শস্যদানাআর খেজুর বৃক্ষের মাথি থেকে (বের করি) ঝুলন্ত থোকাআর (তা দ্বারা উৎপন্ন করি) আঙ্গুরের বাগান এবং সাদৃশ্যপূর্ণ ও সাদৃশ্যহীন যয়তুন ও আনারদেখ তার ফলের দিকে, যখন সে ফলবান হয় এবং তার পাকার প্রতিনিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে এমন কওমের জন্য যারা ঈমান আনে।” (আল আনআমঃ ৯৫-৯৯)

﴿إِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ يُغْشِي اللَّيْلَ النَّهَارَ يَطْلُبُهُ حَثِيثًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومَ مُسَخَّرَاتٍ بِأَمْرِهِ أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ﴾

“নিশ্চয় তোমাদের রব আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেনঅতঃপর আরশে উঠেছেনতিনি রাত দ্বারা দিনকে ঢেকে দেনপ্রত্যেকটি একে অপরকে দ্রুত অনুসরণ করেআর (সৃষ্টি করেছেন) সূর্য, চাঁদ ও তারকারাজী, যা তাঁর নির্দেশে নিয়োজিতজেনে রাখ, সৃষ্টি ও নির্দেশ তাঁরইআল্লাহ মহান, যিনি সকল সৃষ্টির রব।” ( আল আরাফঃ ৫৪)

﴿هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً لَكُمْ مِنْهُ شَرَابٌ وَمِنْهُ شَجَرٌ فِيهِ تُسِيمُونَ﴾﴿يُنْبِتُ لَكُمْ بِهِ الزَّرْعَ وَالزَّيْتُونَ وَالنَّخِيلَ وَالْأَعْنَابَ وَمِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَةً لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ﴾﴿وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومُ مُسَخَّرَاتٌ بِأَمْرِهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ﴾﴿وَمَا ذَرَأَ لَكُمْ فِي الْأَرْضِ مُخْتَلِفًا أَلْوَانُهُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَةً لِقَوْمٍ يَذَّكَّرُونَ﴾﴿وَهُوَ الَّذِي سَخَّرَ الْبَحْرَ لِتَأْكُلُوا مِنْهُ لَحْمًا طَرِيًّا وَتَسْتَخْرِجُوا مِنْهُ حِلْيَةً تَلْبَسُونَهَا وَتَرَى الْفُلْكَ مَوَاخِرَ فِيهِ وَلِتَبْتَغُوا مِنْ فَضْلِهِ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ﴾﴿وَأَلْقَى فِي الْأَرْضِ رَوَاسِيَ أَنْ تَمِيدَ بِكُمْ وَأَنْهَارًا وَسُبُلًا لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ﴾ ﴿وَعَلَامَاتٍ وَبِالنَّجْمِ هُمْ يَهْتَدُونَ﴾﴿أَفَمَنْ يَخْلُقُ كَمَنْ لَا يَخْلُقُ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ﴾﴿وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَةَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا إِنَّ اللَّهَ لَغَفُورٌ رَحِيمٌ﴾

“তিনিই সে সত্তা, যিনি আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন, যাতে রয়েছে তোমাদের জন্য পানীয় এবং তা থেকে হয় উদ্ভিত, যাতে তোমরা জন্তু চরাও

তার মাধ্যমে তিনি তোমাদের জন্য উৎপন্ন করেন ফসল, যাইতুন, খেজুর গাছ, আঙ্গুর এবং সকল ফল-ফলাদিনিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে এমন কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে

আর তিনি তোমাদের জন্য নিয়োজিত করেছেন রাত ও দিনকে এবং সূর্য ও চাঁদকে আর তারকাসমূহও তাঁর নির্দেশে নিয়োজিতনিশ্চয় এতে অনেক নিদর্শন রয়েছে এমন কওমের জন্য যারা বুঝে

আর তিনি তোমাদের জন্য যমীনে যা সৃষ্টি করেছেন, বিচিত্র রঙের করে, নিশ্চয় তাতেও নিদর্শন রয়েছে এমন কওমের জন্য, যারা উপদেশ গ্রহণ করে

আর তিনিই সে সত্তা, যিনি সমুদ্রকে নিয়োজিত করেছেন, যাতে তোমরা তা থেকে তাজা (মাছের) গোশ্‌ত খেতে পার এবং তা থেকে বের করতে পার অলংকারাদি, যা তোমরা পরিধান করআর তুমি তাতে নৌযান দেখবে তা পানি চিরে চলছে এবং যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ অন্বেষণ করতে পার এবং যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় কর

আর যমীনে তিনি স্থাপন করেছেন সুদৃঢ় পর্বতমালা, যাতে তোমাদের নিয়ে যমীন হেলে না যায় এবং নদ-নদী ও পথসমূহ, যাতে তোমরা পথপ্রাপ্ত হও

আর (দিনের) পথ-নির্দেশক চিহ্নসমূহ, আর (রাতে) তারকার মাধ্যমে তারা পথ পায়

সুতরাং যে সৃষ্টি করে, সে কি তার মত, যে সৃষ্টি করে না? অতএব তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না?

আর যদি তোমরা আল্লাহর নিআমত গণনা কর, তবে তার ইয়ত্তা পাবে নানিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (আন নাহলঃ ১০-১৭)

﴿وَاللَّهُ أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ لَا تَعْلَمُونَ شَيْئًا وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ﴾﴿أَلَمْ يَرَوْا إِلَى الطَّيْرِ مُسَخَّرَاتٍ فِي جَوِّ السَّمَاءِ مَا يُمْسِكُهُنَّ إِلَّا اللَّهُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾﴿وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ بُيُوتِكُمْ سَكَنًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنْ جُلُودِ الْأَنْعَامِ بُيُوتًا تَسْتَخِفُّونَهَا يَوْمَ ظَعْنِكُمْ وَيَوْمَ إِقَامَتِكُمْ وَمِنْ أَصْوَافِهَا وَأَوْبَارِهَا وَأَشْعَارِهَا أَثَاثًا وَمَتَاعًا إِلَى حِينٍ﴾﴿وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِمَّا خَلَقَ ظِلَالًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنَ الْجِبَالِ أَكْنَانًا وَجَعَلَ لَكُمْ سَرَابِيلَ تَقِيكُمُ الْحَرَّ وَسَرَابِيلَ تَقِيكُمْ بَأْسَكُمْ كَذَلِكَ يُتِمُّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تُسْلِمُونَ﴾

“আর আল্লাহ তোমাদেরকে বের করেছেন, তোমাদের মাতৃগর্ভ থেকে এমতাবস্থায় যে, তোমরা কিছুই জানতে নাতিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন শ্রবণশক্তি, চক্ষু ও অন্তরযাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় কর

তারা কি আকাশে (উড়ন্ত অবস্থায়) নিয়োজিত পাখিগুলোর দিকে তাকায় না? আল্লাহ ছাড়া কেউ তাদেরকে ধরে রাখে নানিশ্চয় তাতে নিদর্শনাবলী রয়েছে সেই কওমের জন্য যারা বিশ্বাস করে

আর আল্লাহ তোমাদের ঘরগুলোকে তোমাদের জন্য আবাস করেছেন এবং তোমাদের পশুর চামড়া দিয়ে তাবুর ব্যবস্থা করেছেন, যা খুব সহজেই তোমরা সফরকালে ও অবস্থানকালে বহন করতে পারআর তাদের পশম, তাদের লোম ও তাদের চুল দ্বারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গৃহসামগ্রী ও ভোগ-উপকরণ (তৈরি করেছেন)

আর আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন, তা থেকে তোমাদের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করেছেন এবং পাহাড় থেকে তোমাদের জন্য আশ্রয়স্থল বানিয়েছেন, আর ব্যবস্থা করেছেন পোশাকের, যা তোমাদেরকে গরম থেকে রক্ষা করে এবং বর্মেরও ব্যবস্থা করেছেন যা তোমাদেরকে রক্ষা করে যুদ্ধেএভাবেই তিনি তোমাদের উপর তার নিয়ামতকে পূর্ণ করবেন, যাতে তোমরা অনুগত হও।” (আন নাহলঃ ৭৮-৮১)

§ আল্লাহ নিজ সম্বন্ধে মানুষদের যা জানিয়েছেন উপরোল্লেখিত অংশটুকুর আনুপাতিক হার সিন্ধুর তুলনায় বিন্দুর অনুরূপ

§ এগুলো নিদর্শনাবলী, আল্লাহর পরিচয় লাভের সহায়ক এসব নিদর্শন মহান রবের সাথে মানুষের সম্পর্ক তৈরি করে সুনিপুনভাবে এবং একান্ত স্বার্থকভাবে সৃষ্টি করে তাদের অন্তরে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা 

আল্লাহ সম্বন্ধে খ্রীষ্টান-নাসারাদের ধারণা কী? তাঁর সাথে নিখিল বিশ্ব ও মানুষের সম্পর্ক কী?

§ তারা বিশ্বাস করে আল্লাহর সন্তান আছেআল্লাহ তা হতে পবিত্র জন্ম দেয়া-নেয়া হচ্ছে আবির্ভূত হওয়া, বিস্তার লাভ করা বা শূন্যতার পর একটি অতিরিক্ত অস্তিত্ব যা বলতে গেলে এক প্রকার ঘাটতি আর এটি মহাপরাক্রমশালী-প্রতাপাপন্ন মাওলার ক্ষেত্রে সর্বতোভাবে অসম্ভব কারণ তিনি﴿لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ﴾   অর্থাৎ তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি।) সুতরাং যারা এরূপ বলবে তারা ইসলামি আকিদার দৃষ্টিকোণ থেকে চির জাহান্নামি-কাফের বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তাদের কোনো আমলই গ্রহণ করবেন না।

﴿وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ ذَلِكَ قَوْلُهُمْ بِأَفْوَاهِهِمْ يُضَاهِئُونَ قَوْلَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَبْلُ قَاتَلَهُمُ اللَّهُ أَنَّى يُؤْفَكُونَ﴾

“আর ইহুদিরা বলে, উযাইর আল্লাহর পুত্র এবং নাসারারা বলে, মাসিহ আল্লাহর পুত্রএটা তাদের মুখের কথা, তারা সেসব লোকের কথার অনুরূপ বলছে যারা ইতঃপূর্বে কুফরি করেছেআল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন, কোথায় ফেরানো হচ্ছে এদেরকে?” (আত তাওবাহঃ ৩০)

§ সাহাবি আবু মূসা আশআরি রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন, কোনো কষ্টদায়ক কথা শোনার পর (ধৈর্য্য ধারণের ক্ষেত্রে) আল্লাহ অপেক্ষা অধিক ধৈর্য্যশীল আর কেউ নেই তারা তাঁর সন্তান আছে মর্মে দাবি করে আর তিনি তাদের ক্ষমা করে দেন এবং জীবনোপকরণ দিয়ে থাকেন (বুখারি ও মুসলিম)

§ তাদের এ ধারণাটি জন্ম নিয়েছে গ্রীক পৌরাণিক প্রমিথিউসের পবিত্র অগ্নিরূপকথার ধারণা হতে এসব থিওরির মাধ্যমে সে তাদের চিন্তা-চেতনায় এরূপ অসার বিশ্বাসের ভিত রচনা করছে এবং হেদায়াতের সঠিক রাস্তা হতে দূরে ঠেলে দিয়েছে

§ তবে কোনো সন্দেহ নেই, জীবন ও ব্যক্তি সংশোধনের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সংক্রান্ত সঠিক ধারণা ও তাঁর সম্বন্ধে যথাযথ বোধ-বিবেচনার বিরাট ভূমিকা রয়েছে

পর্বঃ ০৩

একত্ববাদের বিশ্বাস ও তৎপ্রতি দাওয়াতঃ

§ আল্লাহ বলেন, قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ অর্থাৎ তিনি এক-অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো সমকক্ষ নেই অনুরূপভাবে উজির, প্রতিপক্ষ, সদৃশ, বিকল্প বলেও কিছু নেই إثبات তথা প্রমাণের ক্ষেত্রে أَحَدٌ শব্দটি কেবল আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে প্রয়োগ হয় তবে نفي তথা প্রত্যাখ্যান, এর বিপরীত যেমন لم يخرج من المسجد أحد -মসজিদ হতে কেউ বের হয়নি বলা অশুদ্ধ নয় এর মূল কারণ হচ্ছে আল্লাহ তাআলাই কেবল নিজ গুণাগুণ ও কর্মে এককভাবে পরিপূর্ণ

§ এ আয়াত এবং সূরা নাস ও সূরা ফালাকের প্রথম দুই আয়াতের মাঝে এক দিক থেকে সাদৃশ্য আছে অন্য দিক থেকে বৈপরীত্ব সাদৃশ্য হচ্ছে, এতে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সূরার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে উচ্চারণের নির্দেশ দিয়েছেন একইভাবে قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ -এও আল্লাহর পক্ষ হতে নিজের তাওহিদের কথা বলা হয়েছে যেমনিকরে তাওহিদের প্রচার ও দাওয়াতের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে (আল-যাওউল মনীর আলা তাফসিরি ইবনিল কাইয়িম)

§ অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ, হে মুহাম্মাদের সহচরবৃন্দ, হে মুসলিম সকল, আল্লাহকে এক বলে স্বীকার কর এবং তাঁর একত্ববাদের প্রতি সকল লোককে আহ্বান কর

§ সকল নবীর দাওয়াততো এ মহান বিষয়ের প্রতিই ছিলاعبدواالله ما لكم من إله غيره তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য আর কোনো ইলাহ নেই)

পর্বঃ ০৪

অমুসলিম-কাফেররা কি ইসলামে প্রবেশ করে আমাদের মনোতুষ্টি সাধন করবে?

§ আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ এবং আমি যার ইবাদাত করি তোমরা তার ইবাদাতকারী নও) অমুসলিমরা আল্লাহ তাআলার ইবাদত করবে এ আয়াত সে সম্ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করছে

§ এ আয়াত ও তা বার বার উদ্ধৃত হবার পেছনে বহু অর্থবহ কারণ নিহত আছে যেমন,

-      আল্লাহর ইবাদত থেকে তাদের বিরত থাকা ইচ্ছাকৃত বা প্রকৃতিগত স্বভাবের কারণে নয় বরং তাদের বিশ্বাসই ছিল তারা আল্লাহর ইবাদত করছেولا يزال كثير منهم كذلك (তাদের অধিকাংশের ধারণা ছিল তাই) তবে তারা ছিল আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞ (আল-যাওউল মুনীরঃ ৪৬৬/৬) যতই তারা বিশ্বাস করতো যে আল্লাহর ইবাদত সম্পাদনের মাধ্যমে তারা তাঁর নৈকট্য অর্জন করছে কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন কারণ সেগুলো মূলতঃ ইবাদত ছিল না ইবাদততো আল্লাহর সাথে শিরককে প্রত্যাখ্যান করে আর তারা শিরক হতে মুক্ত ছিল না তাছাড়া ‌লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু -এর দাবি হচ্ছে, সত্য মাবূদ আল্লাহ ব্যতীত সকল উপাস্যকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করতে হবে

-      আমি নিজ অবস্থান (তাওহিদ) থেকে যতই নিচে নেমে আসি না কেন তোমরা আল্লাহর সাথে শিরক বাদ দিয়ে নিজ অবস্থান থেকে নেমে আসবে না এমনকি আমি তাওহিদ ছেড়ে আল্লাহর সাথে শরিক স্থাপন করে তোমাদের মনোতুষ্টি সাধন করলেও

-      وَلَنْ تَرْضَى عَنْكَ الْيَهُودُ وَلَا النَّصَارَى حَتَّى تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ  অর্থাৎ আর ইহুদি ও নাসারারা কখনো তোমার প্রতি সন্তষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ কর।) সুতরাং আল্লাহর সাথে শরিক স্থাপন করে আমরা তাদের মনোতুষ্টি সাধন করতে পারলেও আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর একত্ববাদের স্বীকৃতি দিয়ে তারা আমাদের সন্তুষ্ট করবে এমন কোনো আশা নেই।তাছাড়া শাব্দিক অলংকরণের প্রতি দৃষ্টি দিলেও বিষয়টি প্রতিভাত হয়। কারণ, وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ -বলে ছুবূতের প্রমাণ বহনকারী কর্তাবাচক বাক্য ব্যবহার করে মহান আল্লাহ এটিই বুঝিয়েছেন যে শিরকের অভ্যাস তাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে একবারের জন্য হলেও এটি তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হবার নয়

পর্বঃ ০৫

§ অমুসলিমদের আগ্রহের প্রতি সাড়া দিয়ে আমারা তাদের মনোতুষ্টি সাধন করতে পারি না এবং করবও না, এমনকি মাত্র একবারের জন্য হলেও এটিই আমাদের আদর্শ এটিই আমাদের দীনের শিক্ষা لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ   وَلَا أَنَا عَابِدٌ مَا عَبَدْتُمْ আয়াতদ্বয়ের মাধ্যমে না করে দেওয়া হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সা. তাদের মিথ্যা উপাস্যদের ইবাদত করবেন না বাকি প্রসঙ্গটি একাধিকবার উল্লেখ করার পেছনে রহস্য হচ্ছে, একত্ববাদের ধারণা প্রগাঢ় করা ও শিরক থেকে মুক্তির বিষয়টি চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করা

§ শব্দগত দিক থেকে দুই আয়াতে কিছুটা ভিন্নতা আছে প্রথম আয়াতে না বাচক ক্রিয়া আর দ্বিতীয় আয়াতে কর্তাবাচক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে ক্রিয়াবাচক ও কর্তাবাচক শব্দের মাঝে পার্থক্য হচ্ছে, ক্রিয়াবাচক শব্দে  নবায়ন, ক্রমাগত ও সংঘটনের অর্থ পাওয়া যায় আর কর্তাবাচক শব্দ আবশ্যিক গুণ ও স্থির অর্থ বুঝিয়ে থাকে আয়াতদ্বয়ের মাধ্যমে যেন বলা হয়েছে, তোমাদের উপাস্যের ইবাদত করে তোমাদের মনোতুষ্টি সাধন আমার দ্বারা কখনও হবে না এটি আমার অভ্যাস নয়, কর্মও নয় (আল-যাওউল মুনীরঃ ৪৭০/৬)

§ সুতরাং আয়াতের মূল সম্বোধিত ব্যক্তিবর্গ- রাসূল অনুসারীদের পক্ষে অমুসলিমদের মনোতুষ্টি কল্পে এমন কোনো কাজ করা সঙ্গত হবে না যার মাধ্যমে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিংবা আকিদা বিনষ্ট হয় যদিও কাজটি অতিশয় নগণ্য বা মাত্র একবারের জন্য হয়                    

§ অমুসলিম-কাফেরদের অনুসরণ-আনুগত্য মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করে পবিত্র কুরআনের বহু জায়গায় সুস্পষ্ট ভাষায় মুসলমানদের সতর্ক করা হয়েছে যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنْ تُطِيعُوا الَّذِينَ كَفَرُوا يَرُدُّوكُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ فَتَنْقَلِبُوا خَاسِرِينَ﴾﴿بَلِ اللَّهُ مَوْلَاكُمْ وَهُوَ خَيْرُ النَّاصِرِينَ﴾

“হে মুমিনগণ, যদি তোমরা কাফিরদের আনুগত্য কর, তারা তোমাদেরকে তোমাদের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবেফলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে ফিরে যাবে বরং আল্লাহ তোমাদের অভিভাবক এবং তিনি উত্তম সাহায্যকারী।” (আলে ইমরানঃ ১৪৯-১৫০)

§ এরূপ আরো বহু আয়াত রয়েছে যাতে আল্লাহ তাদের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন তাদের চরিত্রের বাস্তব অবস্থা ও অন্তরে লুকিত দূরভিসন্ধি চিত্রিত করে দিখিয়েছেন যেমন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا بِطَانَةً مِنْ دُونِكُمْ لَا يَأْلُونَكُمْ خَبَالًا وَدُّوا مَا عَنِتُّمْ قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُخْفِي صُدُورُهُمْ أَكْبَرُ قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الْآَيَاتِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْقِلُونَ﴾﴿هَا أَنْتُمْ أُولَاءِ تُحِبُّونَهُمْ وَلَا يُحِبُّونَكُمْ وَتُؤْمِنُونَ بِالْكِتَابِ كُلِّهِ وَإِذَا لَقُوكُمْ قَالُوا آَمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا عَضُّوا عَلَيْكُمُ الْأَنَامِلَ مِنَ الْغَيْظِ قُلْ مُوتُوا بِغَيْظِكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ﴾﴿إِنْ تَمْسَسْكُمْ حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ وَإِنْ تُصِبْكُمْ سَيِّئَةٌ يَفْرَحُوا بِهَا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا إِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ﴾

“হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো নাতারা তোমাদের সর্বনাশ করতে ত্রুটি করবে নাতারা তোমাদের মারাত্মক ক্ষতি কামনা করেতাদের মুখ থেকে তো শত্রুতা প্রকাশ পেয়ে গিয়েছেআর তাদের অন্তরসমূহ যা গোপন করে তা মারাত্মকঅবশ্যই আমি তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ স্পষ্ট বর্ণনা করেছিযদি তোমরা উপলব্ধি করতে

শোন, তোমরাই তো তাদেরকে ভালবাস এবং তারা তোমাদেরকে ভালবাসে নাঅথচ তোমরা সব কিতাবের প্রতি ঈমান রাখআর যখন তারা তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করে, তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছিআর যখন তারা একান্তে মিলিত হয়, তোমাদের উপর রাগে আঙ্গুল কামড়ায়বল, ‘তোমরা তোমাদের রাগ নিয়ে মর’! নিশ্চয় আল্লাহ অন্তরের গোপন বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত

যদি তোমাদেরকে কোন কল্যাণ স্পর্শ করে, তখন তাদের কষ্ট হয়আর যদি তোমাদেরকে মন্দ স্পর্শ করে, তখন তারা তাতে খুশি হয়আর যদি তোমরা ধৈর্য ধর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছু ক্ষতি করবে নানিশ্চয় আল্লাহ তারা যা করে, তা পরিবেষ্টনকারী।” (আলে ইমরানঃ ১১৮-১২০)

পর্বঃ -৬

স্বাতন্ত্রবোধে উজ্জীবিত হওয়া কাম্য, বিগলিত নয়ঃ

§ দ্বীন-ইসলাম একটি স্বতন্ত্র মতবাদ। একটি স্বতন্ত্র বিশ্বাস। আপন স্বকীয়তায় উদ্ভাসিত একটি জীবন ব্যবস্থার নাম। আচার-আচরণ, রীতি-নীতি, প্রথা-ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংষ্কৃতি-অভ্যাস বরং জীবনের যাবতীয় ক্ষেত্রেই ইসলামের একটি স্বাতন্ত্র ও নিজস্বতা রয়েছে। সেটি রক্ষা করেই প্রতিটি মুসলিম নিজের যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করে থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,

§ لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِين অর্থাৎ তোমাদের একটি আলাদা মতবাদ রয়েছে, রয়েছে স্বতন্ত্র বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা ও জীবন বোধ- ব্যক্তিগত চাল চলনে যার প্রভাব তোমাদেরকে প্রভাবিত করে ঠিক একইভাবে আমাদেরও রয়েছে নিজস্ব মতবাদ, স্বকীয় বিশ্বাস, স্বতন্ত্র জীবনবোধ, রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য, সংষ্কৃতি ও আচরণবিধি যা প্রতিটি নিঃশ্বাসে প্রবাহ পায় সকল মুসলমানের দৈনন্দিন জীবনে সুতরাং আমরা আমাদের দ্বীন ও মতবাদ ছেড়ে তোমাদের অসার দ্বীন ও মতবাদ গ্রহণ করব, এমনটি হতে পারে না সেটি কেবল তোমাদেরকেই মানায় আমরা আমাদের দ্বীন ও বিশ্বাসের সাথে তোমাদের মতবাদের মিশ্রণ ঘটিয়ে শিরক করতে পারি না নিজেদের স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিতে পারি না একটি কাল্পনিক ও ধারণাপ্রসূত বাতিল মতবাদের মাঝে আর তোমরাও গোঁড়ামি ও নির্বুদ্ধিতার কারণে কখনও আমাদের সত্য ও যুক্তিনির্ভর দ্বীন গ্রহণ করবে না এটি অমুসলিমদের দ্বীন পরিত্যাগ ও সম্পর্কচ্ছেদ বিষয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ঘোষণা (আল-যাওউল মুনীরঃ ৪৭৫/৬)

§ মুহাজির ও আনসারদের মাঝে সম্পাদিত মৈত্রি-চুক্তিতে খোদ রাসূলুল্লাহ সা. কর্তৃক উচ্চারিত একটি মৌল-ধারা ছিল, পৃথিবীর সকল মানুষ বাদ দিয়ে মুসলমান নিজেরাই একটি স্বতন্ত্র  জাতি

§ ইহুদি, খ্রিষ্টান কিংবা অগ্নি পূজারি- এককথায় বিশ্বের তাবত মানুষ ধর্ম-কর্ম, আকিদা-বিশ্বাস, শিল্প-সংষ্কৃতি, আচার-আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে পারস্পরিক সমঝোতা রক্ষা করে একে অপরের অনুসরণ করে চলে এ ক্ষেত্রে উম্মতে মুহাম্মাদি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম তারা নিজেরা একটি স্বতন্ত্র জাতি আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল ধর্ম-কর্ম, চাল-চলন, শিল্প-সংষ্কৃতি, বেশ-ভূষা, আকিদা-বিশ্বাসসহ মানব জীবনের যাবতীয় অনুষঙ্গে তাদের রয়েছে স্বকীয় রীতি, নিজস্ব ধারা কোনো ক্ষেত্রেই তারা অন্য কোনো জাতি ও মানুষের সাদৃশ্য অবলম্বন করে না এ স্বকীয়তা বজায় রাখার তাগিদে অন্য ধর্মাবলম্বীদের অভ্যাসগত ও জাগতিক রীতি-নীতির অনুসরণকে তারা হারাম জ্ঞান করে ধর্মীয় বিষয়াদির কথাতো বলারই অপেক্ষা রাখে না

§ এ স্বাতন্ত্রবোধ তাদের মর্যাদাগত অবস্থানকে সংহত করেছে সুদৃঢ়ভাবে আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়েছে সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে এ স্বাতন্ত্রবোধ তাদের ঐতিহ্যের একটি মৌলিক উপাদান কেবলা পরিবর্তন ও সমজাতীয় কয়েকটি ব্যাপারে সামান্য চিন্তা করলেই বিষয়টি প্রতিভাত হয় সুন্দরভাবে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে এমনকি ইসলমের শুরুযুগেও কেবলা ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস পরবর্তী কালে এটি পরিবর্তন করে কেবলা করা হয় পবিত্র কাবাকে এতে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র প্রমাণ হয় সুস্পষ্টরূপে নবী আকরাম সা.ও নানা বিষয়ে সে স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছেন নিয়মিত ইহুদি মতবাদে  মোজা পরে সালাত আদায় ছিল অবৈধ, নবীজি তাঁর সাহাবাদের মোজা পরে সালাতের অনুমতি প্রদান করলেন তারা পাকা চুল, দাড়িতে রং লাগাতো না, নবীজি মুসলমানদেরকে মেহেদি ও কাতম জাতীয় পদার্থ দ্বারা সাদা চুল-দাড়িকে রঞ্জিত করার অনুমতি দিলেন আশুরা উপলক্ষে তারা একদিন সওম পালন করত, নবীজি মৃত্যু পূর্ববর্তী বছর তাদের বিরোধিতা কল্পে প্রত্যয় ঘোষণা করলেন, আগামী বছর বেঁচে থাকলে আমি দুই দিন সওম পালন করব

§ অমুসলিমদের বিরোধিতাকে রাসূলুল্লাহ মুসলমানদের স্বাতন্ত্র রক্ষার্থে আইনে পরিণত করলেন বললেন, (যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের মধ্য হতে গণ্য হবে) আরো বললেন, (তোমরা ইহুদিদের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে না) এ প্রসঙ্গে হাদিসের ভাণ্ডার খুবই সমৃদ্ধ (ড. আকরাম আল-উমরি, আল-সিরাতুন্নববিয়্যাহ ১/২৯২, আল্লামা ইবন তাইমিয়া, ইকতেজাউস সিরাতিল মুস্তাকীম)

পর্বঃ ০৭

§ কোনো ক্ষেত্রেই আমাদের ও অমুসলিমদের মাঝে কোনো মিল নেই বরং উভয়ের মাঝে সুস্পষ্ট দূরত্ব ও বৈপরীত্ব বিদ্যমান সুতরাং কোনো ক্ষেত্রেই তাদের সাথে আমাদের মিলন সম্ভব নয়, না আকিদা-বিশ্বাসে না চিন্তা-চেতনায় না মতবাদে এবং না রীতি-নীতিতে

§ আকিদা-বিশ্বাসে সম্ভব নয় কারণ আমরা বিশ্বাস করি আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবূদ নেই আর তারা পাথর, গাছপালা, মানুষ ইত্যাদিকে তাঁর সাথে শরিক করে, যে ব্যাপারে কোনো দলিল-প্রমাণ অবতীর্ণ হয়নি

§ আমরা সকল নবী-রাসূলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করি,

﴿آَمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آَمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ﴾

“রাসূল তার নিকট তার রবের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছে, আর মুমিনগণওপ্রত্যেকে ঈমান এনেছে আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেশতাকুল, কিতাবসমূহ ও তাঁর রাসূলগণের উপর, আমরা তাঁর রাসূলগণের কারও মধ্যে তারতম্য করি নাআর তারা বলে, আমরা শুনলাম এবং মানলামহে আমাদের রব! আমরা আপনারই ক্ষমা প্রার্থনা করি, আর আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তন স্থল।” (আল বাকারাহঃ ২৮৫)

§ আর তারা মুহাম্মাদ সা. এর রিসালাতকে অস্বীকার করে, তাঁকে গালমন্দ ও তিরস্কার করে।

§ চিন্তা-চেতনায় মিলন অসম্ভব কারণ, আমাদের চিন্তায় এ নিখিল বিশ্ব আমাদের দান করা হয়েছে এবং আমাদের কল্যাণে আমাদেরই অনুগত করে দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে এ প্রসঙ্গে প্রচুর আয়াত নাযিল হয়েছে। যেমনঃ

﴿وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ بُيُوتِكُمْ سَكَنًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنْ جُلُودِ الْأَنْعَامِ بُيُوتًا تَسْتَخِفُّونَهَا يَوْمَ ظَعْنِكُمْ وَيَوْمَ إِقَامَتِكُمْ وَمِنْ أَصْوَافِهَا وَأَوْبَارِهَا وَأَشْعَارِهَا أَثَاثًا وَمَتَاعًا إِلَى حِينٍ﴾﴿وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِمَّا خَلَقَ ظِلَالًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنَ الْجِبَالِ أَكْنَانًا وَجَعَلَ لَكُمْ سَرَابِيلَ تَقِيكُمُ الْحَرَّ وَسَرَابِيلَ تَقِيكُمْ بَأْسَكُمْ كَذَلِكَ يُتِمُّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تُسْلِمُونَ﴾

“আর আল্লাহ তোমাদের ঘরগুলোকে তোমাদের জন্য আবাস করেছেন এবং তোমাদের পশুর চামড়া দিয়ে তাবুর ব্যবস্থা করেছেন, যা খুব সহজেই তোমরা সফরকালে ও অবস্থানকালে বহন করতে পারআর তাদের পশম, তাদের লোম ও তাদের চুল দ্বারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গৃহসামগ্রী ও ভোগ-উপকরণ (তৈরি করেছেন)

আর আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন, তা থেকে তোমাদের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করেছেন এবং পাহাড় থেকে তোমাদের জন্য আশ্রয়স্থল বানিয়েছেন, আর ব্যবস্থা করেছেন পোশাকের, যা তোমাদেরকে গরম থেকে রক্ষা করে এবং বর্মেরও ব্যবস্থা করেছেন যা তোমাদেরকে রক্ষা করে যুদ্ধেএভাবেই তিনি তোমাদের উপর তার নিয়ামতকে পূর্ণ করবেন, যাতে তোমরা অনুগত হও।” (আন নাহলঃ ৮০-৮১)

﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ﴾﴿الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ﴾

“হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবের ইবাদাত কর, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করযিনি তোমাদের জন্য যমীনকে করেছেন বিছানা, আসমানকে ছাদ এবং আসমান থেকে নাযিল করেছেন বৃষ্টিঅতঃপর তাঁর মাধ্যমে উৎপন্ন করেছেন ফল-ফলাদি, তোমাদের জন্য রিয্‌কস্বরূপসুতরাং তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না।” (আল বাকারাঃ ২১-২২)

§ আল্লাহ তাআলাই এটি আমাদের দান করেছেন। এবং চেষ্টা-শ্রম ব্যয় করে আবাদ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে সে চেষ্টা চলবে তাঁর বাতানো রীতি-নীতি অনুযায়ী, নিজ খেয়াল-খুশি মত নয়।

§ আর অমুসলিমরা বিশ্বাস করে এ নিখিল বিশ্ব প্রাকৃতিক, প্রাকৃতিকভাবেই তার আবির্ভাব ঘটেছে। এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করল। তাদের বিশ্বাস হচ্ছে, নিজ বিবেক-বুদ্ধির কল্যাণে তারা চাহিদামত নানা জিনিস সৃষ্টি ও আয়ত্তে আনার ক্ষমতা রাখে। এ বিশ্বাসের মাধ্যমে রুবুবিয়্যাতের স্তরে পৌঁছে যাওয়ার দাবি করল। এমন অলীক বিশ্বাসের মাধ্যমে তারা সবকিছু গোলমেলে করে ফেলেছে।

§ কুরআন-সুন্নাহর কল্যাণে মানুষের জীবনের সামগ্রীক দিক (শুরু-শেষ-গন্তব্য ও পরিণতি) সম্বন্ধে আমাদের জানা আছে সবিস্তারে। অমুসলিমদের এ বিষয়ে স্বচ্ছ জ্ঞান না থাকার কারণে মানুষের আদি অবস্থা নিয়ে অমর্যাদাকর ধারণা করে বসে আছে। বিবর্তণবাদের মন্দ বিশ্বাসের কারণে তারা মনে করে মানুষের প্রাথমিক বিকাশ হচ্ছে বানর।

§ আমাদের বিশ্বাস পার্থিব জীবন একটি ব্যাপক জীবনের অংশ মাত্র, এর পর রয়েছে কবরের জীবন-বরযখ,  তার পর আছে পরকালীন জীবন-আখেরাত।

§ দুনিয়ার জীবনকে আমরা আখেরাতের জীবনের সুখ-সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্র মনে করি।

§ وَإِنَّ الدَّارَ الْآَخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ‌‌ অর্থাৎ এবং নিশ্চয় আখেরাতের নিবাসই হলো প্রকৃত জীবন)

§ আর অমুসলিমরা দুনিয়ার জীবনকেই মূল জীবন মনে করে তারা বরযখ, আখেরাত, হিসাব, প্রতিদান ইত্যাদিতে বিশ্বাসী নয় زَعَمَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنْ لَنْ يُبْعَثُوا অর্থাৎ,কাফিররা ধারণা করেছিল যে, তারা কখনোই পুনরুত্থিত হবে না।) তাই তারা তাতে গোলযোগ সৃষ্টি করে। স্বার্থ চরিতার্থ করতে মৃত্যুকে জয় করতে চায়।

§ আর মতবাদেও মিল সম্ভব নয়, কারণ আমাদের মতবাদ হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ যা মূলতঃ দোষ-ত্রুটিমুক্ত ওহী-এ-এলাহী। বাতেল এর সমপর্যায়ের মতবাদ পেশ করতে পারবে না কখনো। আর অমুসলিমদের মতবাদ হচ্ছে দিকভ্রান্ত মানুষের অসার মস্তিষ্ক প্রসূত দুর্বল ও কাল্পনিক কিছু মতবাদ। যাকে তারা কানুন ও সংবিধানের মর্যাদা দিয়ে রেখেছে।

§ বাকি থাকল রীতি-নীতি, তাতেও মিলন অসম্ভব। কারণ আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক এক কথায় সার্বিক জীবনাচার ও রীতি ওহী সূত্রে প্রাপ্ত। সে রীতি ও দর্শন আমাদের জীবন, স্বাধীনতা, অভ্যাস ও পারস্পরিক সম্পর্ককে মর্যাদা, শিষ্টতা, দায়বদ্ধতা, আত্মমর্যাদাবোধ ও আল্লাহভীতিতে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। ফলে সকল কাজ আমাদেরকে উক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সম্পাদন করতে হয়। ফলে জীবন হয় নিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল।

§ আর অমুসলিমদের জীবনাচারে তেমন কোনো বাধ্য-বাধকতা নেই। নেই কোনো দায়িত্বশীলতা। না ব্যক্তিগত ব্যাপারে না সমাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপারে এবং না অন্য কোনো ক্ষেত্রে। বরং সব ক্ষেত্রেই আছে কেবল স্বার্থপরতা, আত্মম্ভরিতা, দায়িত্বহীনতা ও উশৃঙ্খলতা। কেবল উন্মুক্ত স্বাধীনতা যা সবকিছু বরবাদ করে দেয়। এতো জন্তু-জানোয়ারের জীবন। আল্লাহ বলেন, (তারা চতুষ্পদ জন্তু সদৃশ বরং এর চেয়েও বিভ্রান্ত)। মুক্ত অর্থনীতি ও অবাধ যৌনাচারের নৈরাজ্যকর বৈশ্বিক পরিস্থিতি, পালনকর্তা আল্লাহকে অস্বীকারকারী কাফেরের বিকৃত চিন্তারই নাপাক ফসল।

§ জীবন চলার পথে তাদের সাথে আমাদের মিলন কিভাবে সম্ভব? তাদের ও আমাদের মাঝেতো উদয় ও অস্তাচলের দূরত্ব বিদ্যমান।

§ শ্রুতি মত- উম্মতের উল্লেখযোগ্য সংখ্যার একটি দল যখন তাদের সাথে মিলে-মিশে জীবন যাপন করার বাসনা লালন করছে, চলার পথে তাদের সাথী হতে প্রয়াস চালাচ্ছে। তাদের উদ্দেশে পরিস্কার বলতে পারি, এ বাসনা চরিতার্থ করার মাধ্যমে বাস্তবে তারা নিজেদেরকে তাদের কোলে নিক্ষিপ্ত করছে এবং তাদের পঙ্কিলতার ডোরে আবদ্ধ করারই প্রয়াস চালাচ্ছে। লাঞ্ছনা, অপমান, পরাজয় ও লোকসান ছাড়া প্রাপ্তি বলতে আর কিছুই মিলবে না, এ কথা নিশ্চিত বলা যায়। এছাড়া সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার আর কোনো ব্যবস্থা নেই। সত্য রেসালত এমন সতর্কবাণীই উচ্চারণ করে গেছে সহস্র বছর আগে। ছাওবান রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে এসেছে, (আমার উম্মতের একটি দল মুশরিকদের সাথে মিলিত হওয়া এবং তাদের একাধিক দল মূর্তি পুজা করা অবধি কিয়ামত সঙ্ঘটিত হবে না। (আবু দাউদঃ ৪২৫২)

পর্বঃ ০৮

§ অমুসলিমদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ও অব্যহতির সুস্পষ্ট ঘোষণা সূরা-কাফিরূনের প্রতিটি আয়াতের দাবী। তাদের ধর্মবোধ ও জীবন পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন যা একান্ত তাদের সাথেই সংশ্লিষ্ট। আর আমাদের ধর্ম ও জীবন পদ্ধতিও সম্পূর্ণ আলাদা, আপন স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল যা কেবল আমাদের সাথেই সংশ্লিষ্ট। কোনোভাবেই অমুসলিমদের সাথে মুসলমানদের মিল নেই, হতেও পারে না। কারণ, প্রত্যেকের ধর্ম ও জীবন পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা। তাইতো আমরা দেখতে পাই সূরা নাযিল হবার সাথে সাথেই নবীজি মসজিদুল হারামে তাশরিফ রাখলেন। এবং কুরাইশের একটি সমাবেশে আদ্যপান্ত তেলাওয়াত করে শুনিয়ে দিলেন।

পর্বঃ ০৯

আত্মিক ও মানসিক বিভক্তিঃ

§ কুফর ও কাফেরদের জীবনাচার, চাল-চলন, সভ্যতা-সংষ্কৃতি এক কথায় তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের প্রতি ঘৃণাবোধ এবং অসার মতবাদ এড়িয়ে চলার মানসিকতা লালন করা ঈমান ও তাওহীদের চূড়ান্ত দাবি। একজন মুসলমান নিজেকে তাওহীদের এ স্তরে উন্নীত করতে সমর্থ হলে ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে। সহিহ হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, (যে ব্যক্তি তিনটি বিশেষ গুণ অর্জনে সমর্থ হবে সে ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে। যার নিকট আল্লাহ ও রাসূল অপরাপর সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় হবেন, কেবল আল্লাহর জন্যই যে অপরকে ভালবাসবে এবং একবার কুফর হতে নিষ্কৃতি পাবার পর পুনরায় তাতে ফিরে যাওয়াকে (জ্বলন্ত) অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হবার ন্যায় ঘৃণা করবে।) (বোখারি ও মুসলিম)

§ এটিই হচ্ছে একজন মুসলিমের ঈমানের মৌল-দাবি। এমনটিই হওয়া উচিত তার অনুভূতি। তার আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে যে, আপন স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল সে এক স্বতন্ত্র সত্তা-অমুসলিমদের সাথে কোনো ক্ষেত্রেই তার কোনো মিল নেই। তাদের দীন ভিন্ন আর তার দীন ভিন্ন। উভয়ের পথ আলাদা আলাদা। তার ঈমান অমুসলিমদের সাথে তাল মিলিয়ে এক কদম চলারও অনুমতি দেয় না। তার দায়িত্ব হচ্ছে নিজস্ব অবস্থান থেকে বিন্দু পরিমাণও ছাড় না দিয়ে এবং কোনোরূপ তোষামোদ না করে তাবত অমুসলিমকে হেদায়াতের পথে চালানোর ব্রত গ্রহণ করা। (ফী যিলালিল কুরআনঃ ৩৯৯২/৬)

§ নবীজির সকল সাহাবির অবস্থা ছিল এমনই। নারী কিংবা পুরুষ যে-ই ইসলাম গ্রহণ করেছেন। উচ্চারণ করেছেন শাহাদাতের দীপ্ত কালিমা। জাহেলি আচার-আচরণের আচ্ছাদন শরীর থেকে ঝেড়েফেলেই তা করেছেন। জাহেলি সভ্যতার  যাবতীয় আবিলতা মাড়িয়েই ইসলামের অনাবিল শান্তিময় নীড়ে প্রবেশ করেছেন। মন ও মানসে, বাসনা ও অনুভূতিতে বিরাজিত ছিল কেবল ইসলাম আর ইসলাম। কুরআন তাদেরকে এমন করেই গড়ে তুলেছে। আর তারাও ছিলেন এমনই। আল্লাহই সাহায্য কর্তা।

পর্বঃ ১০

নীতি-আদর্শে অবিচলতাঃ

§ কাফেরদের মনোতুষ্টি কল্পে নীতির প্রশ্নে শিথিলতা প্রদর্শন কিংবা তাদের ভয়ে আপন আদর্শ হতে পশ্চাদাপসারণ ছিল রাসূলুল্লাহ সা. এর নীতি বিরুদ্ধ কাজ। এমনটি তিনি জীবনে একবারের জন্যও করেননি। জীবন বিপন্ন হলেও এ আদর্শ ধরে রেখেছেন আমৃত্যু। -ইসলাম  তার প্রতিটি অনুসারী হতে এমন দৃঢ়তাই কামনা করে - অথচ মক্কাতে তিনি ছিলেন অসহায় ও দুর্বল।

﴿وَاذْكُرُوا إِذْ أَنْتُمْ قَلِيلٌ مُسْتَضْعَفُونَ فِي الْأَرْضِ تَخَافُونَ أَنْ يَتَخَطَّفَكُمُ النَّاسُ فَآَوَاكُمْ وَأَيَّدَكُمْ بِنَصْرِهِ وَرَزَقَكُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ﴾

“আর স্মরণ কর, যখন তোমরা ছিলে অল্প, তোমাদেরকে দুর্বল মনে করা হত জমিনেতোমরা আশঙ্কা করতে যে, লোকেরা তোমাদেরকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাবেঅতঃপর তিনি তোমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন, নিজ সাহায্য দ্বারা তোমাদেরকে শাক্তিশালী করেছেন এবং তোমাদেরকে পবিত্র রিয্‌ক দান করেছেনযাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় কর।” (আল আনফালঃ ২৬)

§ বরং নবীজি প্রথম থেকেই জানতেন, তার বিরুদ্ধে আরবরা সব সঙ্ঘবদ্ধ, যে কোনো সময় সমবেতভাবে হামলা করতে পারে। তারপরও তিনি তাদের পরওয়া করেননি। নিজ নীতিতে ছিলেন পর্বতসম দৃঢ়পদ। ভীতি প্রদর্শন ও উৎসাহ প্রদান এক কথায় অমুসলিমদের কোনো চক্রান্তই তাঁকে আপন আদর্শ হতে হটাতে পারেনি বিন্দু পরিমাণও। সামরিক, অর্থনৈতিক কিংবা সাংষ্কৃতিক যত যুদ্ধই আমরা করি না কেন, নীতির প্রশ্নে  অবিচলতা বলে একেই। 

পর্বঃ ১১

অমুসলিমদেরকে সম্বোধন পদ্ধতিঃ

§ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ (অর্থাৎ হে কাফের সম্প্রদায়) কাফেরদের সম্বোধন করার এটি হচ্ছে একটি অভিনব পদ্ধতি যার সূচনা করেছে মহাগ্রন্থ আল কুরআন এ নজির অন্য কোথাও খোঁজে পাওয়া যায় না কুফর বিশেষণে চিহ্নিত করে এ সম্বোধনের মাধ্যমে তাদেরকে মূলতঃ খাট করা হয়েছে তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের যৌক্তিকতাকে প্রমাণিত করা হয়েছে এবং বিরক্তি ও ক্রোধ উদ্দিপক বিশেষণ উল্লেখ করে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, মুহাম্মাদ সা. তাদের ভয়ে ভীত নন

§ আবু বকর ইবনুল আনবারি রহ. বলেন, আয়াতের অর্থ হচ্ছে, যারা কুফরি করেছে তাদের বল, হে কাফেররা অর্থাৎ তিনি তাদের সমাবেশে তাদেরকে কুফরের পরিচিতি ও স্বীকৃতি দিয়ে বলছেন হে কাফেররা অথচ কুফরের প্রতি সম্বোধিত হওয়াকে তারা অপছন্দ করে ও বিরক্ত হয় (তাফসির আল-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর লি-ইবনে আশূর ৫৮১/৩০)

§ কারণ তাদের আকিদা হচ্ছে প্রকৃত মুমিনতারাই যেমন বিশ্বাস পোষণ করত কুরাইশ কাফেরবৃন্দ নিজেদেরকে ইবরাহীম আ.-এর অনুসারী বলে বর্তমান ও পূর্ব যুগের খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস হচ্ছে, তারা ঈসা আ.-এর অনুসারী মানবজাতিকে কল্যাণ ও আলোর পথে আহবানকারী তবে বাস্তবতা হচ্ছে, তারা কাফের এটিই তাদের প্রকৃত পরিচয় এ ছাড়া আর কোনো পরিচয় নেই তাদের তারা আসমানি কোনো ধর্মের অনুসারীও নয় তাদের মূল পরিচয় তারা কাফের এ নামেই আল্লাহ তাদের অভিহিত করেছেন এবং নিজ নবীকে সম্বোধন করতে আদেশ দিয়েছেন

§ আল্লামা ইবনু কাসির রহ. এ প্রসঙ্গে বলেন, (এ সম্বোধন পৃথিবীস্থিত সকল অমুসলিমকে শামিল করেছে) (তাফসিরুল কুরআনিল আজিম ৭২৬/৪)

পর্বঃ ১২

প্রকৃত স্বাধীনতাঃ

§ সূরা ইখলাসে সন্নিবেশিত বিষয়াদি সম্পর্কে বুঝ ও বিশ্বাস অন্তরে প্রগাঢ়রূপে স্থাপিত হলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, অন্তর লোভ-লালসা, কাম-রিপু ও প্রবৃত্তিগত চাহিদার বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে যাবতীয় ভয়-ডর-শঙ্কা কাটিয়ে কেবল অদ্বিতীয়-অমুখাপেক্ষী আল্লাহর প্রতি ধাবিত হবে এবং তাঁর কাছেই যাবতীয় আরজি-আরাধনা উপস্থাপন করবে কেবল তাঁকেই ভয় করবে তাঁর কাছেই আশা করবে তাঁর ওপরই নির্ভর করবে

§ একজন মানুষ তারই মত দুর্বল-সামর্থহীন অপর মানুষ বা অন্য কোনো সৃষ্টির ওপর নির্ভর করবে কি করে? কিভাবেই বা তাদের নিকট প্রত্যাশার হাত সম্প্রসারিত করবে? তাদের ভয় করবে? অথচ এতটাই অসহায় তারা, অপরতো দূরের কথা নিজেরই উপকার সাধন কিংবা ক্ষতিরোধ করার ক্ষমতা রাখে না নিজের সাহায্য করতে পারে না জীবন-মরণ-রিজিকের ব্যাপারে তাদের কোনো দখল নেই... এটিই আল কুরআনের মৌলিক শিক্ষা এ শিক্ষায়ই রাসূলুল্লাহ সা. নিজ সাহাবিদের গড়ে তুলেছেন নির্মাণ করেছেন মহা পরাক্রমশালী আল্লাহর ওপর তাদের বিশ্বাসের সুদৃঢ় সৌধ

§ বিশিষ্ট সাহাবি আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বলেন, একদিন আমি নবী করিম সা. এর পেছনে ছিলাম, তিনি আমার উদ্দেশে বললেন, হে বালক, আমি তোমায় কয়েকটি কথা শেখাব, তুমি আল্লাহর (বিধি-বিধান) বিষয়ে যত্নবান হও আল্লাহ তোমাকে হিফাযত করবেন আল্লাহর বিষয়ে যত্নবান হও, তাঁকে তোমার কাছে পাবে যখন কিছু প্রার্থনা করবে তখন তাঁর কাছেই প্রার্থনা করবে আর যখন সাহায্য চাইবে কেবল তাঁর কাছেই চাইবে শোন_ তোমার উপকার্থে যদি মানব জাতি সকলেই এক হয়ে চেষ্টা করে, তারা কেবল সে উপকারটুকুই করতে পারবে যা আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন আর যদি অপকার করার জন্য একত্রিত হয় তাহলে সে অপকারটুকুই কেবল করতে পারবে যা আল্লাহ তোমার বিপক্ষে লিখে রেখেছেন কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে, আর (লিখিত) কাগজ শুকিয়ে গেছে (তিরমিজি, সূত্র হাসান)

§ হাদিসটি জামে তিরমিজি ব্যতীত অন্যান্য গ্রন্থেও কিছুটা ভিন্নতায় বর্ণিত হয়েছে, যেমন, তুমি আল্লাহর (বিধি-বিধান) বিষয়ে যত্নবান হও তাঁকে তোমার সামনে পাবে সাচ্ছন্দের সময় আল্লাহর (বিধি-বিধান)-কে স্মরণে রেখে চলবে দুর্দিনে আল্লাহ তোমাকে স্মরণে রাখবেন জেনে রাখ, যা তোমার হয়নি তা হওয়ার ছিল না আর যা হয়েছে তা না হওয়ার ছিল না আরো জেনে রাখ, সাহায্য ধৈর্য্য-সবরের সাথে (সম্পৃক্ত) আর দুর্দশা-পেরেশানির সাথেই রয়েছে স্বস্তি-আনন্দ কষ্টের সাথেই রয়েছে সুখ (তিরমিজি ২৫১৬, ইমাম আহমদ ১/২৯৩ ক্রমিক নং ২৬৬৯)

§ এটিই হচ্ছে প্রকৃত স্বাধীনতা, নিখাদ আজাদি যা এখনো আমাদের অনেকেই বুঝে উঠতে পারছে না তাইতো অন্তরে দুনিয়া প্রীতিকে সাধনার আসনে বসিয়ে রেখেছে একান্ত নিবিষ্টতায় আয় আল্লাহ, আমাদের বুদ্ধির মুক্তি দান করুন

পর্বঃ ১৩

§ কুরআনি মৌলনীতির আলোকে জীবন যাপন করতে হলে আমাদের জন্য অনিবার্য করণীয় হচ্ছে, নিজ সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী-পরিজন ও সমাজকে কুরআনের এ দীপ্তিময় শিক্ষায় প্রশিক্ষণ প্রদান যেমনটি করেছেন স্বয়ং আল্লাহ নিজ নবী ও তাঁর সাহাবিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আর এটিই উদ্ভাসিত হয়েছে কুরআনের নিম্নোক্ত বাণীতে

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ﴾

“হে মুমিনগণ, তোমরা ইসলামে পূর্ণরূপে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো নানিশ্চয় সে তোমাদের জন্য স্পষ্ট শত্রু।” (আল বাকারাঃ ২০৮)

§ তাফসির কারকগণ বলেন, অর্থাৎ দ্বীনের প্রতিটি অনুষঙ্গে, তার কোনো একটিকেও বাদ দেওয়া চলবে না (তাইসিরুল কারিমির রহমান লিস-সাদিঃ ৭৭)

§ আমাদের আরো করণীয় হচ্ছে, নিম্নোক্ত আয়াতে গভীর মনোনিবেশ করা

﴿وَإِنْ كَادُوا لَيَفْتِنُونَكَ عَنِ الَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ لِتَفْتَرِيَ عَلَيْنَا غَيْرَهُ وَإِذًا لَاتَّخَذُوكَ خَلِيلًا﴾﴿وَلَوْلَا أَنْ ثَبَّتْنَاكَ لَقَدْ كِدْتَ تَرْكَنُ إِلَيْهِمْ شَيْئًا قَلِيلًا﴾﴿إِذًا لَأَذَقْنَاكَ ضِعْفَ الْحَيَاةِ وَضِعْفَ الْمَمَاتِ ثُمَّ لَا تَجِدُ لَكَ عَلَيْنَا نَصِيرًا﴾

“আর তাদের অবস্থা এমন ছিল যে, আমি তোমাকে যে ওহী দিয়েছি, তা থেকে তারা তোমাকে প্রায় ফিতনায় ফেলে দিয়েছিল, যাতে তুমি আমার নামে এর বিপরীত মিথ্যা রটাতে পার এবং তখন তারা অবশ্যই তোমাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত আর আমি যদি তোমাকে অবিচল না রাখতাম, তবে অবশ্যই তুমি তাদের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়তে তখন আমি অবশ্যই তোমাকে আস্বাদন করাতাম জীবনের দ্বিগুণ ও মরণের দ্বিগুণ আযাবতারপর তুমি তোমার জন্য আমার বিরুদ্ধে কোন সাহায্যকারী পাবে না।” (আল ইসরাঃ ৭৩-৭৫)

“এমন আশঙ্কার কারণ, তাদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ছিল রাসূলুল্লাহ তাদের প্রবৃত্তির চাহিদা চরিতার্থ করবেন যে ব্যাপারে আল্লাহ অনুমতি প্রদান করেননি। অনুরূপভাবে নবীজি আপন হৃদয়ে তাদের হেদায়াতের অদম্য বাসনা পোষণ করতেন।” (তাফসির আস-সাদিঃ ৪১৫)

§ নবীজির পবিত্র জীবন চরিত ও সাহাবাদের দৈনন্দিন যাপিত জীবনের চিত্র ছিল আলোচ্য কুরআনি বুঝের আদর্শরূপ।

§ এ বুঝের আলোকে আল্লাহ আমাদের জীবন গড়ার তাওফিক দান করুন।

সমাপ্ত



 

No comments:

Post a Comment

আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।