আদর্শ সমাজ গঠনে নারী : শামসুন্নাহার নিজামী - আমার প্রিয় বাংলা বই

সাম্প্রতিকঃ

Post Top Ad

Responsive Ads Here

January 07, 2025

আদর্শ সমাজ গঠনে নারী : শামসুন্নাহার নিজামী

 

 

আদর্শ সমাজ গঠনে নারী

শামসুন্নাহার নিজামী

আধুনিক প্রকাশনী

ঢাকা

 

প্রকাশকের কথা

সমাজ গঠন ও সামাজিক বিপ্লব যেমন দাবী করে সমাজের প্রতিটি বিভাগ ও প্রান্তে এক সর্বাত্মক পরিবর্তন, তেমনি স্বাভাবিকভাবে এই মহতী প্রচেষ্টার পথে প্রয়োজন সমাজের প্রতিটি নারী-পুরুষের সমন্বিত ও সুষম ভূমিকারআদর্শ সমাজ গঠনে নারী' পুস্তিকায় নারী সমাজের প্রতি এই আহ্বানই জানান হয়েছে

ভাঙ্গনমুখী এ সমাজকে দ্রুত অবনতির হাত থেকে রক্ষা করে সম্ভাবনাময় প্রতিশ্রুতিশীল আদর্শ সমাজ গঠনের প্রচেষ্টায় আমাদের নারী সমাজ এগিয়ে আসলেই এ পুস্তিকা প্রকাশের প্রচেষ্টা সফল হবে

 

আদর্শ সমাজ গঠনে নারী

আদর্শ অর্থ অনুসরণীয় যা দেখে মানুষ অনুপ্রেরণা পায়, অনুকরণ বা অনুসরণ করতে চায় তাকেই আদর্শ বলা হয় আদর্শ সমাজ বলতেও তাই এমন একটা সমাজকেই বুঝায় যা দেখে দুনিয়ার মানুষ অনুপ্রাণিত হতে পারে এবং উক্ত সমাজের অনুকরণ বা অনুসরণ করতে পারে

আদর্শ সমাজ একটা আদর্শ জীবন দর্শনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠতে পারে আর ইসলাম ছাড়া সেই জীবন দর্শন কিছুই হতে পারে না মানুষের জন্যে একটি সুখী-সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা দুনিয়ার ইতিহাসে কেবল ইসলামই দিতে পেরেছে সত্যিকারের শান্তি, কল্যাণ এবং ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ সমাজ খোদা প্রদত্ত জীবন বিধানকে বাদ দিয়ে আদৌ কায়েম হতে পারে না

তথাকথিত স্বাধীন বিশ্ব বা পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা মানুষের সমাজে শান্তি স্থাপনে যেমন ব্যর্থ হয়েছে তেমনি ব্যর্থ হয়েছে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব পশ্চিমা গণতন্ত্রে রাজনৈতিক স্বাধীনতা স্বীকার করা হলেও সর্বস্তরের মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান সেখানে অনুপস্থিত পক্ষান্তরে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা অপেক্ষাকৃত বেশী গুরুত্ব পেয়ে থাকলেও মানুষের রাজনৈতিক অধিকারের লেশমাত্র সেখানে নেই উভয় বিশ্বেই মনুষ্যত্ব ও নৈতিকতা চরমভাবে অবহেলিত মানবতার মুক্তির জন্যে দেবার মত কিছুই নেই এদের কাছে

 

ইসলামী সমাজই আদর্শ সমাজ

কাজেই একটা আদর্শ সমাজ গঠনের জন্যে আমরা ইসলাম ছাড়া অন্য কোন একটি মতাদর্শেরও অনুসরণ করতে পারি না আজকের দিনেও আমরা সেই একটি মাত্র আদর্শকে অবলম্বন করেই সুখী-সুন্দর এক সমাজ কায়েম করতে পারি, যে আদর্শ বলে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা. আজ থেকে চৌদ্দশত বছর আগে আরব মরুর অসভ্য মানব গোষ্ঠী নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক নজীর বিহীন সুখী-সুন্দর সমাজ

আমাদের মহান নেতা রাসূলে আরাবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সা. প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজ ব্যবস্থাই একমাত্র 'আদর্শ সমাজ' নামে অভিহিত হতে পারে উক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোই মু'মিন জীবনের একমাত্র কাজ এ কাজে আত্মনিয়োগ না করে ঈমানের দাবী পূরণ করার আদৌ কোন উপায় নেই এ প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করা যেমন পুরুষের জন্যে অপরিহার্য তেমন নারী সমাজের জন্যেও তা অবশ্য কর্তব্য

 

ইসলামী সমাজ গঠনে নারী সমাজ

ইসলাম প্রতিষ্ঠার এ দায়িত্ব শুধু পুরুষের একার নয় কেবল পুরুষকেই এ ব্যাপারে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে না নারীরও এ ব্যাপারে দায়িত্ব রয়েছে মহান আল্লাহ পাকের দরবারে এ জন্য তাকেও জবাবদিহি করতে হবে পূর্ণ মাত্রায়

পবিত্র কুরআনের ঘোষণাঃ

﴿وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ ۚ أُولَٰئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ ۗ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ﴾ ﴿وَعَدَ اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ۚ وَرِضْوَانٌ مِّنَ اللَّهِ أَكْبَرُ ۚ ذَٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ﴾

মুমিন পুরুষ ও মু'মিন মহিলা পরস্পর বন্ধু ও সাথী তারা যাৰতীয় ভাল কাজের নির্দেশ দেয়, সব অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করে এরা এমন লোক, যাদের উপর আল্লাহর রহমত অবশ্যই নাযিল হবে নিসন্দেহে আল্লাহ সর্বজয়ী, সুবিজ্ঞ ও জ্ঞানী এই মু'মিন পুরুষ ও নারীদের সম্পর্কে আল্লাহর ওয়াদা এই যে, তাদেরকে এমন বাগ-বাগিচা দান করবেন, যার নীচ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবহমান এবং তারা সেখানে চিরদিন থাকবে এই চির সবুজ-শ্যামল বাগিচায় তাদের জন্যে পবিত্র পরিচ্ছন্ন বসবাসের জায়গা থাকবে আর সবচেয়ে বড় কথা এই যে, তারা আল্লাহর সন্তোষ লাভ করবে এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সাফল্য -সূরা আত তাওবাঃ ৭১-৭২

এই দায়িত্ব কিভাবে পালন করতে হবে এবং সে দায়িত্ব পালনের জন্যে নারীকে পুরুষের পাশাপাশি কিভাবে কাজ করতে হবে তার নির্দেশও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দিয়েছেনঃ

﴿فَاسْتَجَابَ لَهُمْ رَبُّهُمْ أَنِّي لَا أُضِيعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِّنكُم مِّن ذَكَرٍ أَوْ أُنثَىٰ ۖ بَعْضُكُم مِّن بَعْضٍ ۖ فَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَأُخْرِجُوا مِن دِيَارِهِمْ وَأُوذُوا فِي سَبِيلِي وَقَاتَلُوا وَقُتِلُوا لَأُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلَأُدْخِلَنَّهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ثَوَابًا مِّنْ عِندِ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عِندَهُ حُسْنُ الثَّوَابِ﴾

আমি তোমাদের মধ্যে কারও কাজকে বিনষ্ট করে দেব না, পুরুষ হোক কি স্ত্রী—তোমরা সবাই সমজাতের লোক কাজেই যারা একমাত্র আমারই জন্যে নিজেদের জন্মভূমি পরিত্যাগ করেছে, আমারই পথে নিজেদের ঘর- বাড়ী থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে ও নির্যাতিত হয়েছে এবং আমারই জন্যে লড়াই করেছে ও নিহত হয়েছে তাদের সব অপরাধই আমি মাফ করে দেব এবং তাদেরকে এমন বাগ-বাগিচায় স্থান দেব যার নীচ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হবে আল্লাহর নিকট এটাই তাদের প্রতিফল আর উত্তম প্রতিফল একমাত্র আল্লাহর কাছেই পাওয়া যেতে পারে -সূরা আলে ইমরানঃ ১৯৫

প্রশ্ন উঠতে পারে নারীরা কখনও কি এ দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এসেছে? তারাও কি কোন অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে এ মহান আদর্শ বাস্তবায়নের সংগ্রাম সাধনায়? এ সম্পর্কে ইতিহাসের আলোকে আমরা কিছুটা আলোচনা করব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই শুধু হযরত মুহাম্মদ সা.-এর সময়েই নয় বরং তার আবির্ভাবের পূর্বে যে সমস্ত নবী-রাসূল এসেছিলেন তাদের সহযোগিতা এবং সাহায্যেও এগিয়ে এসেছিলেন কিছু মহিয়সী মহিলা তাদের সাহায্য-সহযোগিতা এবং ত্যাগ ছাড়া এ ইতিহাস হয়তবা অসম্পূর্ণই থেকে যেত

 

কয়েকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

অতীত যুগ

দ্বীন প্রতিষ্ঠার এ দায়িত্ব শুধু রাসূল সা.-এর যুগেই মুসলমানদের জন্যে ফরয করা হয়নি বরং অতীতে যত নবী-রাসূল এসেছেন তারাও এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন এবং তাদের অনুসারীগণ (পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে) তাঁদেরকে সঠিকভাবে অনুসরণ করেছেন তাদের জীবনী পর্যালোচনা করলে আমরা তাদের সমাজ সচেতনতা এবং বিপ্লবী ভূমিকার কিছু পরিচয় পাব

হযরত আছিয়াঃ হযরত মূসা আ.-এর যুগের এক আদর্শ নারী হযরত আছিয়া দুনিয়ার জীবনে তার প্রাচুর্য ছিল সীমাহীন ভোগ-বিলাস, আরাম- আয়েশ প্রভৃতি কোন উপকরণেরই অভাব ছিল না তার ফেরাউন ছিল মিসরের সম্রাট এবং খোদায়ীর দাবীদার হযরত আছিয়া ছিলেন তারই সম্রাজ্ঞী

কিন্তু দুনিয়াতে আল্লাহ পাক কিছু মহামানবকে সৃষ্টি করেন যারা দুনিয়ার সমস্ত সুখ-সম্পদ এবং আরাম-আয়েশকে পায়ে ঠেলে সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকার জন্যে বরণ করেন হাজারো দুঃখ-কষ্ট হযরত আছিয়াও ছিলেন এ রকমই একজন মহীয়সী মহিলা তিনি অস্বীকার করলেন ফেরাউনের খোদায়ী দাবীকে অর্থাৎ প্রভুত্ব ও কর্তৃত্বকে, মানুষের উপর ফেরাউনের মনগড়া আইন ও শাসন চাপিয়ে দেয়ার স্বৈরাচারী নীতিকে পক্ষান্তরে তিনি সাড়া দিলেন নিঃস্ব নিসম্বল আল্লাহর বান্দাহ হযরত মূসা আ.-এর আহ্বানে রাব্বুল আলামীন আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য গ্রহণ করে তিনি বিরাগভাজন হলেন ফেরাউনের যালেম ফেরাউন কঠোর নির্যাতন চালালো তার উপর কিন্তু তবুও সত্যের এ পথ থেকে তিনি বিচ্যুত হননি

হযরত হাজেরাঃ হযরত ইবরাহীম আ.-এর স্ত্রী হযরত হাজেরার জীবনী ও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য আমরা দেখতে পাই হযরত ইবরাহীম আ. যখন আল্লাহর নির্দেশে স্ত্রী হাজেরা এবং তার শিশু পুত্র ইসমাঈলকে জনহীন মরুপ্রান্তরে নির্বাসন দিলেন তখন ধৈর্যের মূর্তপ্রতীক হাজেরা এটা আল্লাহর নির্দেশ জেনেই সন্তুষ্টচিত্তে এ ফায়সালা মেনে নিলেন তিনি শান্তভাবে শিশু পুত্রের পাশে বসলেন এবং বললেনঃ যে আল্লাহ এ নির্দেশ দিয়েছেন তিনি নিশ্চয়ই আমাদেরকে ধ্বংস হতে দিবেন না কি অপূর্ব নির্ভরশীলতা!

এদিকে ঐ অবস্থায় স্ত্রী-পুত্রকে রেখে ইবরাহীম আ. দোয়া করলেনঃ

﴿رَّبَّنَا إِنِّي أَسْكَنتُ مِن ذُرِّيَّتِي بِوَادٍ غَيْرِ ذِي زَرْعٍ عِندَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِيُقِيمُوا الصَّلَاةَ فَاجْعَلْ أَفْئِدَةً مِّنَ النَّاسِ تَهْوِي إِلَيْهِمْ وَارْزُقْهُم مِّنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَشْكُرُونَ﴾

প্রভু হে! আমি আমার বংশের এক অংশকে জনমানবহীন এক মরুপ্রান্তরে তোমার ঘরের পাশে এনে বসিয়েছি, যেন তারা নামায কায়েম করে সুতরাং প্রভু হে! মানুষের মনকে তুমি এদিকে আকৃষ্ট করে দাও ফল-মূল থেকে তাদের খাদ্য সামগ্রী দান কর, যেন তারা তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়” -সূরা ইবরাহীমঃ ৩৭

এই দোয়া আল্লাহ অক্ষরে অক্ষরে পূরণ করেছেন বায়তুল্লাহর (কাবা) পাশে আবাদ হয়েছে মক্কা নগরী হজ্জ্ব তাকে পরিণত করেছে সমস্ত আরব জাহানের কেন্দ্রস্থলে এটা পরিণত হয়েছে একটা বাণিজ্যিক বন্দরে দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে সবরকমের জিনিস আসছে কুরআন মজিদে একথা আল্লাহ পাক এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ

﴿وَقَالُوا إِن نَّتَّبِعِ الْهُدَىٰ مَعَكَ نُتَخَطَّفْ مِنْ أَرْضِنَا ۚ أَوَلَمْ نُمَكِّن لَّهُمْ حَرَمًا آمِنًا يُجْبَىٰ إِلَيْهِ ثَمَرَاتُ كُلِّ شَيْءٍ رِّزْقًا مِّن لَّدُنَّا وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ﴾

ইহা কি সত্য নয় যে, আমরা এক শান্তিপূর্ণ হেরেমকে তাদের জন্যে আবাসস্থল বানিয়ে দিয়েছি, যেখানে সবরকম ফল-ফসল আসে আমাদের পক্ষ থেকে রিযিক হিসেবে? কিন্তু তাদের মধ্যে অনেক লোকেই তা জানে না” -সূরা আল কাসাসঃ ৫৭

ইবরাহীম আ. বিবি হাজেরাকে শিশু পুত্র সহ রেখে আসার পর সেই নির্জন প্রান্তরে বুকের সুধা দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তুলতে লাগলেন পুত্রকে এরপর যখন ইবরাহীম আ. আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হলেন সবচেয়ে প্রিয় বস্তু আল্লাহর রাহে কুরবানী করতে তখন তিনি প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাঈল আ.-কে কুরবানী করার সিদ্ধান্ত নিলেন এই অগ্নি পরীক্ষায় হযরত হাজেরা দ্বিধা-সংকোচহীন চিত্তে তুলে দিলেন প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রকে স্বামীর হাতে একটুও দ্বিধা সংকোচ করলেন না বাস্তব কর্মে প্রমাণ করলেন ঈমানদার মানুষের কাছে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই সবচেয়ে প্রিয় এ সম্পর্কে কুরআনের ঘোষণাঃ

﴿قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ ۗ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ﴾

“(হে নবী!) বলে দাও যে, যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রীরা ও তোমাদের আত্মীয়-স্বজন তোমাদের সেই ধন-মাল যা তোমরা উপার্জন করেছ সেই ব্যবসায় যার মন্দা হওয়াকে তোমরা ভয় কর, আর তোমাদের সেই ঘর যাকে তোমরা খুবই পসন্দ কর—তোমাদের নিকট আল্লাহ ও তার রাসূল এবং আল্লাহর পথে চেষ্টা-সাধনা করা অপেক্ষা প্রিয় হয়, তোমরা অপেক্ষা কর যতক্ষণ না আল্লাহ তার চূড়ান্ত ফায়সালা তোমাদের সামনে পেশ করেন আর আল্লাহ তো ফাসেক লোকদের কখনই হেদায়াত করেন না” -সূরা আত তাওবাঃ ২৪

আল্লাহর এ নির্দেশের বাস্তব প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই বিবি হাজেরার জীবনে ধোঁকাদানকারী শয়তানকে তিনি পাথর নিক্ষেপ করে বিতাড়িত করেছিলেন সে ঘটনা স্মরণ করে আজও হজ্জের মৌসুমে হাজীদেরকে পাথর নিক্ষেপ করতে হয় এদিকে পুত্র ইসমাঈল আ.-ও আল্লাহর রাহে নিজেকে সপে দেন কুরবানীর জন্যে বিন্দুমাত্র ভয়-ভীতি, শংকা-সংশয় তাকে বিচলিত করতে পারেনি যেমন মা তেমন পুত্র বটে

হযরত রহিমাঃ সত্যের আর এক সেবক, ইসলামী আদর্শের আর এক পতাকাবাহী খোদা প্রেমের অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হযরত আইয়ুব আ.-এর স্ত্রী হযরত রহিমার জীবনীও আমাদের জন্যে এক উজ্জ্বল উদাহরণ

হযরত আইয়ুব আ. যখন কঠিন রোগাক্রান্ত, যখন তার সুসময়ের বন্ধু- বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন একে একে সবাই তাঁকে ছেড়ে গেল তখন সাথে রয়ে গেলেন তার স্ত্রী রহিমা আইয়ুব আ.-কে দিনের পর দিন সেবা-যত্ন দিয়ে কঠিন রোগ যন্ত্রণার মধ্যেও সান্ত্বনা দিয়ে এসেছেন এই ত্যাগী নারী স্বামীর সেবা করতে গিয়ে কোন দুঃখ-কষ্টকেই তিনি পরোয়া করেননি সবকিছুই অকাতরে মেনে নিয়ে চরম কষ্টের মধ্যেও রোগাক্রান্ত স্বামীকে তিনি সুশ্রূষা করেছেন এমন ত্যাগ তিতিক্ষার নজীর ইতিহাসে সত্যিই বিরল

হযরত মরিয়ম আ. হযরত ঈসা আ.-এর মাতা হযরত মরিয়ম আ. যাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নির্দিষ্ট করে নিয়েছিলেন নিজের বিশেষ নিদর্শন প্রকাশের জন্যে ছোট বেলা থেকেই বিবি মরিয়ম ছিলেন আল্লাহভীরু এবং ইবাদত-বন্দেগীতে অভ্যস্ত কুরআন মজীদের সূরা মরিয়মের দ্বিতীয় রুকূ তে আল্লাহ পাক বর্ণনা করেছেনঃ

﴿وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ مَرْيَمَ إِذِ انتَبَذَتْ مِنْ أَهْلِهَا مَكَانًا شَرْقِيًّا﴾﴿فَاتَّخَذَتْ مِن دُونِهِمْ حِجَابًا فَأَرْسَلْنَا إِلَيْهَا رُوحَنَا فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَرًا سَوِيًّا﴾﴿قَالَتْ إِنِّي أَعُوذُ بِالرَّحْمَٰنِ مِنكَ إِن كُنتَ تَقِيًّا﴾﴿قَالَ إِنَّمَا أَنَا رَسُولُ رَبِّكِ لِأَهَبَ لَكِ غُلَامًا زَكِيًّا﴾﴿قَالَتْ أَنَّىٰ يَكُونُ لِي غُلَامٌ وَلَمْ يَمْسَسْنِي بَشَرٌ وَلَمْ أَكُ بَغِيًّا﴾﴿قَالَ كَذَٰلِكِ قَالَ رَبُّكِ هُوَ عَلَيَّ هَيِّنٌ ۖ وَلِنَجْعَلَهُ آيَةً لِّلنَّاسِ وَرَحْمَةً مِّنَّا ۚ وَكَانَ أَمْرًا مَّقْضِيًّا﴾

“(আর হে নবী!) এই কিতাবে মরিয়মের অবস্থা বর্ণনা কর যখন সে আপন লোকজন থেকে আলাদা হয়ে পূর্ব প্রান্তে নিঃসম্পর্ক হয়ে রয়েছিল এবং পর্দা টাঙ্গিয়ে তার পিছনে লুকিয়ে বসেছিল (অর্থাৎ এ'তেকাফে বসেছিল) এই অবস্থায় আমরা তাঁর নিকট নিজের রূহকে (অর্থাৎ ফেরেশতাকে) পাঠালাম, আর সে তার সামনে এক পূর্ণাঙ্গ মানুষের আকার ধারণ করে আত্মপ্রকাশ করল মরিয়ম সহসা বলে উঠলঃ তুমি যদি সত্যিই কোন আল্লাহভীরু ব্যক্তি হয়ে থাক তবে আমি তোমা থেকে রহমতের আশ্রয় প্রার্থনা করছি সে বললঃ আমি তো তোমার খোদার প্রেরিত, আর এ জন্য প্রেরিত হয়েছি যে, তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করব (মরিয়ম) বললঃ আমার পুত্র হবে কেমন করে যখন আমাকে কোন মানুষ স্পর্শ পর্যন্ত করেনি, আর আমি কোন চরিত্রহীনা নারীও নই (ফেরেশতারা) বললঃ এভাবেই হবে তোমার খোদা বলেন যে, এরূপ করা আমার পক্ষে খুবই সহজ আর আমরা এটা করব এ উদ্দেশ্যে যে, এই পুত্রকে লোকদের জন্যে একটি নিদর্শন বানাবো আর নিজের তরফ থেকে এক রহমত বানাবো এ কাজ অবশ্যই হবে” -সূরা মরিয়মঃ ১৬-২১

এভাবে আল্লাহর নির্দেশের কাছে আত্মসমর্পণ করে বিবি মরিয়ম সহ্য করলেন হাজারো লাঞ্ছনা-গঞ্জনা লোকেরা তাকে বলতে লাগলঃ

﴿فَأَتَتْ بِهِ قَوْمَهَا تَحْمِلُهُ ۖ قَالُوا يَا مَرْيَمُ لَقَدْ جِئْتِ شَيْئًا فَرِيًّا﴾﴿يَا أُخْتَ هَارُونَ مَا كَانَ أَبُوكِ امْرَأَ سَوْءٍ وَمَا كَانَتْ أُمُّكِ بَغِيًّا﴾

“(হে মরিয়ম!) তুমিতো বড়ই পাপের কাজ করেছ হে হারুনের বোন! তোমার পিতা তো কোন খারাপ লোক ছিল না, তোমার মাও ছিল না কোন চরিত্রহীন নারী” -সূরা মরিয়মঃ ২৭-২৮

আল্লাহ পাক মরিয়মকে এ সময়ে অসহায় অবস্থায় ফেলে দেননি বরং এ সময়ে আল্লাহ তাকে নির্দেশ দিলেনঃ

﴿فَكُلِي وَاشْرَبِي وَقَرِّي عَيْنًا ۖ فَإِمَّا تَرَيِنَّ مِنَ الْبَشَرِ أَحَدًا فَقُولِي إِنِّي نَذَرْتُ لِلرَّحْمَٰنِ صَوْمًا فَلَنْ أُكَلِّمَ الْيَوْمَ إِنسِيًّا﴾

তাকে বলঃ আমি রহমানের জন্যে রোযার মানত মেনেছি এ কারণে আমি আজ কারও সাথে কথা বলব না” -সূরা মরিয়মঃ ২৬

এর পর পর মরিয়ম আ. বাচ্চাটির দিকে ইশারা করলেন

﴿قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا﴾﴿وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيْنَ مَا كُنتُ وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيًّا﴾﴿وَبَرًّا بِوَالِدَتِي وَلَمْ يَجْعَلْنِي جَبَّارًا شَقِيًّا﴾﴿وَالسَّلَامُ عَلَيَّ يَوْمَ وُلِدتُّ وَيَوْمَ أَمُوتُ وَيَوْمَ أُبْعَثُ حَيًّا﴾

শিশুটি বলে উঠলঃ আমি আল্লাহর বান্দা তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন ও নবী বানিয়েছেন বরকতওয়ালা করেছেন—যেখানেই আমি থাকি না কেন আর নামায ও যাকাত দেয়ার নিয়ম পালনের হুকুম করেছেন, যতদিন আমি জীবিত থাকব এবং আপন মায়ের হক আদায়কারী বানিয়েছেন তিনি আমাকে স্বৈরাচারী ও খারাপ চরিত্রের বানাননি সালাম আমার প্রতি, যখন আমি ভূমিষ্ঠ হয়েছি, যখন আমি মরব এবং যখন আমি আবার পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠব” -সূরা মরিয়মঃ ৩০-৩৩

দোলনায় শায়িত শিশু লোকদের সাথে এভাবে কথা বলে প্রমাণ করলেন যে, তিনি নিশ্চয় আল্লাহর প্রেরিত নবী এবং তার মাতা পবিত্র সতী সাধ্বী নারী আর এই অবস্থায় ধৈর্যধারণ করার পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ তাকে সে যুগের শ্রেষ্ঠ নারীর মর্যাদা দিলেন

হযরত আবু হুরাইরা রা. বলেন, “হযরত মুহাম্মদ সা. বলেছেনঃ দুনিয়ার সমস্ত নারীর উপর চারজন নারীর মর্যাদা রয়েছে—মরিয়ম বিনতে ইমরান, ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া, খাদিজা বিনতে খোয়াইলিদ এবং ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ

হযরত ইবনে আব্বাস বলেনঃরাসূলে খোদা সা. মাটির উপর চারটি রেখা এঁকে বলেনঃ জান এটি কি? সাহাবীরা বলেনঃ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন রাসূল সা. বললেনঃ জান্নাতী নারীদের মধ্যে চারজন সর্বশ্রেষ্ঠ খাদিজা বিনতে খোয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ, মরিয়ম বিনতে ইমরান এবং আছিয়া বিনতে মুবাহিম অর্থাৎ ফেরাউনের স্ত্রী এভাবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এরূপ আরও অনেক মহিয়সী নারীর সন্ধান পাওয়া যায় যারা রেখে গেছেন অমর কৃতিত্ব ও অনুসরণীয় আদর্শ

 

হযরত মুহাম্মদ সা.-এর যুগে

হযরত মুহাম্মদ সা.-এর যুগেও মহিলা সাহাবাগণ পিছিয়ে ছিলেন না অতীত যুগের নারীদের মত বরং আরও অগ্রসর হয়ে তাঁরা দ্বীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন এই মহিলাগণই প্রথম মুসলিম, প্রথম শহীদ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন এসব মহিলার সংখ্যা অসংখ্য এই স্বল্প পরিসরে সবার সম্পর্কে আলোচনা করা সম্ভব নয় তাই অল্প কয়েকজন উল্লেখযোগ্য মহিলার জীবনী আমরা এখানে আলোচনা করব

হযরত খাদিজাতুল কুবরা রা. হযরত মুহাম্মদ সা.-এর প্রথম সহধর্মিনী হযরত খাদিজাতুল কুবরার রা. জীবনে আমরা দেখতে পাই স্বামীর সহযোগিতা, ত্যাগ ও তিতিক্ষার এক উজ্জ্বল আদর্শ প্রচুর বিত্তশালিনী, অপূর্ব সুন্দরী, জ্ঞানে-গুণে মহিয়সী খাদিজাতুল কুবরা রা. সে সময়ে আরববাসীর কাছে পরিচিত ছিলেন তাহিরা নামে তাহিরা অর্থ পূত-পবিত্র সত্যিই সে চরম অন্ধকার আরবেও খাদিজা রা. ছিলেন সর্বগুণে গুণান্বিতা, নিষ্কলুস চরিত্রের অধিকারিণী এই চরিত্র বলেই তিনি ভূষিতা হয়েছিলেন তাহিরা উপাধিতে সেই শ্রেষ্ঠ নারী নিসম্বল মুহাম্মদ সা.-কে পতিরূপে বরণ করার পর নিজের সমস্ত সম্পদ উৎসর্গ করলেন তাঁর পদতলে সেই ধনরত্ন ব্যয়িত হতে লাগল দুঃস্থ মানবতার সেবায় তাদের গৃহ হয়ে উঠল শাস্তি আর কল্যাণের কেন্দ্রস্থল

এরপর যখন হযরত মুহাম্মদ সা. মহাসত্যের সন্ধানে মানবতার মুক্তি ও কল্যাণ অন্বেষণে ধ্যানমগ্ন হলেন হেরার গুহায় তখন তাকে সর্বোতভাবে প্রেরণা যুগিয়েছেন এই মহিয়সী মহিলা নারীকূল শ্রেষ্ঠ হযরত খাদিজা রা. হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন স্বামীর জন্যে বন্ধুর পথ অতিক্রম করে খাদ্য সরবরাহ করতেন দিনের পর দিন এভাবে যখন হযরত সা.-এর উপর প্রথম অহী অবতীর্ণ হল তখন তিনি ভীত শংকিত অবস্থায় বাড়ী ফিরে এলেন হযরত সা. খাদিজা রা.-কে বললেন তাঁর গায়ে কম্বল জড়িয়ে দিতে সহৃদয়া জীবন সঙ্গিনী হযরত খাদিজা রা. অত্যন্ত দরদ ভরা কন্ঠে প্রকৃত ঘটনা জানতে চাইলেন, সেবায় আত্মনিয়োগ করলেন মন-প্রাণ দিয়ে রাসূলে পাক সা. সবকিছু তাকে খুলে বললেন তখন তাঁর যোগ্য সহধর্মিনী তাকে প্রচুর সান্ত্বনার বাণী শোনালেন ও তাঁর অশান্ত মনকে শান্ত করলেন শুধু তাই নয় বরং স্বামীর উপর অবর্তীণ বিষয়কে সত্য বলে মেনে নিলেন এ ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাই তিনিই প্রথম মুসলিম এবং তার স্বামীর প্রধান বিশ্বস্ত সাথী

ইসলামের প্রথম যুগে যখন মুসলমানগণ মুশরেকদের হাতে চরমভাবে নির্যাতিত হচ্ছিল তখনও হযরত খাদিজা রা. অবিচল চিত্তে স্বামীর সহযোগিতা করেছেন, সহ্য করেছেন অনেক নিপীড়ন নির্যাতন অথচ দুনিয়ার জীবনকে উপভোগ করার মত কোন উপাদানের অভাবই তার ছিল না কিন্তু সত্যের জন্যে, সত্যের সেবক স্বামীর জন্যে তিনি অকাতরে সবকিছু ত্যাগ করেছেন দুশমনের বিরোধিতারও পরোয়া করেননি

ঐতিহাসিক ইবনে সা'আদ ইয়াহহিয়া ইবনে ফোরাত এর উদ্ধৃতি দিয়ে সে সময়ের ইসলামের একটি চিত্র অংকন করেছেন সেই বর্ণনাটি আফীফ ফিন্দী নিম্নরূপে বর্ণনা করেছেনঃ

আমি জাহেলী যুগে মক্কায় এসেছিলাম স্ত্রীর জন্যে আতর এবং কাপড় কিনতে সেখানে আমি আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালিবের কাছে ছিলাম ভোর বেলা কা'বা শরীফের প্রতি আমার দৃষ্টি পড়ে এ সময় আব্বাস ও আমার সাথে ছিলেন এমন সময়ে একজন যুবক আসেন এবং আকাশ পানে তাকিয়ে কেবলার দিকে মুখ করে দাঁড়ান একটু পরে একজন শিশু এসে যুবকটির ডান পাশে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ পরে একজন নারী এসে এদের পিছনে দাঁড়ায় এরা দু'জন যুবকটির পিছনে নামায আদায় করে চলে গেল তখন আমি আব্বাসকে লক্ষ্য করে বললাম, 'আব্বাস! আমি লক্ষ্য করছি এক বিরাট বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে' আব্বাস বললেন, 'তুমি কি জান এ যুবক এবং মহিলাটি কে? আমি জবাব দিলাম, না ' তিনি বললেন, যুবকটি হচ্ছেন আমার ভ্রাতৃষ্পুত্র মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মোত্তালেব আর শিশুটি হচ্ছে আলী যে নারীকে তুমি উভয়ের পিছনে নামায আদায় করতে দেখেছ, তিনি হচ্ছেন মুহাম্মদের স্ত্রী খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ আমার ভাতিজার ধারণা, তার ধর্ম ইসলাম এবং তিনি যা কিছু করেন আল্লাহর হুকুমেই করেন আমার যতদূর জানা আছে, সারা দুনিয়ায় এ তিনজন ছাড়া আর কেউ তাদের দ্বীনের অনুসারী নেই

বর্ণনাকারী বলেন, “একথা শুনে আমার মনে আকাংখা জেগেছে যে, চতুর্থ ব্যক্তি যদি আমি হতাম

দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে হযরত মুহাম্মদ সা.-কে যে কত অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে, সে সম্পর্কে ধারণা করার জন্যে কেবল এটুকুই যথেষ্ট যে, দীর্ঘদিন তাকে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে গোপনে নামায আদায় করতে হয়েছে এমন বিপদ সংকুল সময়ে হযরত খাদিজা রা. কেবল একমতই ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন তাঁর বিপদে সান্ত্বনা দাত্রী সর্বপ্রকার বিপদে তিনি সম্ভাব্য সকল উপায়ে সাহায্য করেছেন জীবন চরিত গ্রন্থে এর অংসখ্য উদাহরণ বর্তমান রয়েছে

হযরত মুহাম্মদ সা. এবং খাদিজা রা.-এর সস্তানদের মধ্যেও আমরা এসব সৎগুণাবলীর প্রতিফলন দেখতে পাই তাঁদের চারটি কন্যা চারজনই নারীকুলের জন্য রেখে গেছেন মহান আদর্শ বিশেষ করে সর্ব কনিষ্ঠা কন্যা ফাতিমা রা.-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এসব ছিল এই অপূর্ব মিলনেরই অমৃত ফল

হযরত খাদিজার রা. মৃত্যুতে আমরা দেখতে পাই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবও পত্নী বিয়োগের শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন এই বছরটিকে তিনি শোকের বছর বলে অভিহিত করেন খাদিজা রা. কি শুধু হযরত মুহাম্মদ সা.-এর পত্নীই ছিলেন? তিনি ছিলেন একাধারে আদর্শ গৃহিনী, আদর্শ সঙ্গিনী, শোকে এবং বিপদে সান্ত্বনা দাত্রী, সাহায্যকারিণী, উত্তম পরামর্শ দাত্রী এবং আদর্শ মাতা হযরত মুহাম্মদ সা.-এর পরবর্তী জীবনেও দেখা যায় যে, হযরত আয়েশার রা. মত সুন্দরী বুদ্ধিমতী স্ত্রী পেয়েও তিনি খাদিজা রা.-এর কথা সবসময় স্মরণ করতেন

উম্মে আম্মারা রা. খাদীজা রা. ছাড়া আরও অনেক মহিলাকে আমরা দেখতে পাই যারা ইসলামের জন্য জীবন বাজী রেখেছেন জীবন দিয়েও প্রমাণ করে গেছেন কুরআনের বাণীকে –তোমরা ততক্ষণ সৎকর্মশীল হতে পার না যতক্ষণ না সবচেয়ে প্রিয় জিনিসকে আল্লাহর রাহে কুরবান করতে পার

শহীদের দরযা অতি উচ্চস্তরের হাদীস শরীফে আছে, হযরত মুহাম্মদ সা. বলেছেনঃযদি আমি আল্লাহর রাহে শহীদ হতাম, পুনরায় বেঁচে উঠতাম, আবার শহীদ হতাম এভাবে তিনি সাতবার একথা বলেন” (বুখারী) এ থেকেই আমরা বুঝতে পারি কত সৌভাগ্যবান তারা যারা শহীদ হতে পেরেছেন আল্লাহর রাহে আর সর্বপ্রথম এই সৌভাগ্য প্রাপ্ত হয়েছেন একজন মহিলা নাম তার উম্মে আম্মারা রা. ইসলামের প্রথম শহীদ হওয়ার গৌরব কোন পুরুষকে আল্লাহ পাক দেননি, দিয়েছেন এক মহিলাকে ইসলাম গ্রহণের পর তিনি কাফেরদের হুমকি এবং কঠোর নির্যাতনের সম্মুখীন হতে লাগলেন কিন্তু কোন কিছুরই পরোয়া তিনি করলেন না অবশেষে শত্রুদের তীরের আঘাতে তিনি শহীদ হন জীবন দিয়ে প্রমাণ করেন যে, নারীরা শারীরিক দিক দিয়ে দুর্বল হলেও ঈমানের দিক দিয়ে দুর্বল নয়

হযরত উম্মে সালমা রা. নারীরা স্বভাবতই ধীরস্থির এবং প্রত্যুৎপন্নমতি বিজ্ঞান স্বীকার করে যে, তাড়াতাড়ি কোন কিছুর সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য নারীর মগজ যত বেশী উপযোগী পুরুষের ততটা নয় এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাই আমরা উম্মুল মু'মিনীন হযরত উম্মে সালমার রা. জীবনে হোদায়বিয়ার সন্ধির সময় হযরত মুহাম্মদ সা. বুঝতে পেরেছিলেন যে, তখনকার পরিস্থিতিতে সন্ধি করাই শ্রেয় কিন্তু আপতদৃষ্টিতে সন্ধির শর্তগুলো মুসলমানদের জন্যে অবমাননাকর মনে হচ্ছিল, তাছাড়া সেখানকার সব কয়জন মুসলমানই ছিলেন আল্লাহর রাহে জান-মাল উৎসর্গ করার জন্য নিবেদিত প্রাণ কাজেই আপাত অপমানজনক শর্তে সন্ধি করে হজ্জব্রত পালন না করে ফিরে যাওয়া কারুরই মনপুত হচ্ছিল না তাই হযরত মুহাম্মদ সা. বার বার নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও কেউ ইহরাম ভাংতে রাজী ছিল না হযরত মুহাম্মদ সা. হয়রান হয়ে পড়েছিলেন এবং তিনি যখন তাবুতে প্রবেশ করলেন তখন তাঁর চেহরায় সেই ভাব সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছিল উম্মুল মু'মিনীন হযরত সালমা রা. তখন তাঁর রাগের কারণ জিজ্ঞেস করে বিস্তারিত জানতে পারেন তখন তিনি পরামর্শ দেন, “আপনিই সর্বপ্রথম মাথা মুগুণ করে পশু কুরবানী করে দিনহযরত মুহাম্মদ সা. সেই পরামর্শ মোতাবেক কাজ করলেন সাথে সাথে অন্যান্য মুসলমানরাও হযরত মুহাম্মদ সা.-এর অনুসরণ করলেন কোন দ্বিরুক্তি না করেই মিমাংসা হয়ে গেল এতবড় একটা সমস্যার সবাই সন্ধি চুক্তি মেনে নিয়ে ফিরে গেলেন সে বছরের মত সেই সন্ধি মুসলমানদের পক্ষে যে কত বড় সহায়ক হয়েছিল তা আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই

হযরত ফাতেমা রা. বিনতে খাত্তাবঃ ইসলামের খলীফা হযরত ওমর ফারুকের রা. ইসলাম গ্রহণের মূলেও ছিল তার বোন ফাতেমা রা. ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ক্রোধান্ধ ওমর রা. একদিন উন্মুক্ত তরবারি হাতে যাচ্ছিলেন সমস্ত কিছুর মূল হযরত মুহাম্মদ সা.-কে হত্যা করার জন্যে পথিমধ্যে একজন তাকে বলল, “আরে, তোমার নিজের ঘরেই তো ৰিপৰ্যয় প্রবেশ করেছে তোমার নিজের বোন এবং ভগ্নিপতি ইসলাম গ্রহণ করেছেখবর পাওয়া মাত্র তিনি ছুটলেন তাঁর বোনের বাড়ীর দিকে তাঁরা তখন সূরা ত্বাহার কয়েকটি আয়াত পড়ছিলেন ওমরকে রা. দেখা মাত্র তারা সেগুলো লুকিয়ে ফেললেন তিনি বুঝতে পেরে ফাতেমার স্বামীকে দারুন মারপিট করতে লাগলেন তাঁর গোটা শরীর রক্তাক্ত হয়ে গেল ফাতেমা রা. তাঁর স্বামীকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এলেন ক্রুব্ধ ওমর নিজের বোনকেও অনরূপ মারপিট করতে লাগলেন কিন্তু সত্যের পথে তাঁরা ছিলেন অবিচল তাদের ধৈর্য এবং অবিচল চিত্তের কাছে শেষ পর্যন্ত ওমরের রা. ক্রোধ পরাজিত হলো আল্লাহর রহমতে তার মন নরম হয়ে গেল তিনি ফাতেমাকে বললেন, “দেখি তোমরা কি পড়ছিলে? ফাতেমা তখন কুরআনের কিছু অংশ এনে দিলেন এবং অজু করে আসতে বললেন ওমর রা. অজু করে এলেন এবং কয়েকটি আয়াত মনোযোগের সাথে পড়লেন তার মনে এক অপূর্ব ভাবের সৃষ্টি হল তিনি সাথে সাথে কম্পিত হৃদয়ে হযরত সা.-এর নিকটে হাজির হলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন এটা ছিল ইসলামের ইতিহাসের একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা

হযরত ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ সা. নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমা রা. এর জীবনী আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাই তাঁর চরিত্রে বহু গুণের সমন্বয় স্বামী সেবা এবং সংসার জীবনে কৃচ্ছ্রসাধনার এক উজ্জ্বল আদর্শ রেখে গেছেন তিনি নারী সমাজের জন্য নবী নন্দিনী হয়েও তিনি কখনও তাঁর স্বামীর কাছে কোনরূপ প্রাচুর্যের দাবী করেননি সংসারে তিনি প্রচুর পরিশ্রম করতেন কিন্তু তাই বলে ইসলামের মূল জিনিস তার কাছে কখনও অবহেলিত হয়নি অনেক সময় দেখা গেছে তিনি একাধারে পায়ের সাহায্যে বাচ্চাদের দোল দিচ্ছেন, হাতে ময়দা পিষার জন্যে চাকা ঘুরাচ্ছেন আবার কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করছেন আটা পিষতে পিষতে তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে গেছে পানির মশক টানতে টানতে তার বুকে দাগ হয়ে গেছে তবুও তিনি কখনও স্বামীর সংসারের প্রতি অবহেলা দেখাননি

মা হিসেবেও আমরা তাকে আদর্শনীয়া দেখতে পাই শিশুকাল থেকেই তিনি হাসান হুসাইনকে গড়ে তুলেছিলেন সম্পূর্ণ ইসলামী আদর্শে এমন মা না হলে এমন সুন্দর সন্তান কি কখনও সম্ভব হয়? যারা বেহেশতে যেয়ে হবেন কিশোরদের নেতা ফাতেমা রা. নিজেও যেমন ছিলেন পিতার সর্বাপেক্ষা আদরের তেমনি তিনি তার সন্তানদেরও গড়ে তুলেছিলেন পিতার আদর্শে

শুধু এ কয়জন মুষ্টিমেয় মহিলাই নন—হযরত আয়েশা রা. সহ আরও অসংখ্য মহিলা সাহাবাদেরকে আমরা দেখতে পাই যাদের ত্যাগ তিতিক্ষা আর আত্মদান ইসলামকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এ অল্প পরিসরে সবার সম্পর্কে আলোচনা করা সম্ভব নয়

 

বর্তমান যুগে

এতো গেল নবী করীম সা.-এর স্বর্ণ যুগের নারীদের ইতিহাস বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাই যে, এ সমাজেও এ ধরনের মহিলার অভাব নেই যারা ইসলামকে নিজের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছেন এবং এর জন্য যে কোন কুরবানী করতেও পিছপা হননি

উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যায়, মিসরের হামিদা কুতুব ও আমিনা কুতুবের নাম তাঁরা শহীদ সাইয়্যেদ কুতুবের বোন এবং আরবী সাহিত্যের অঙ্গনে দু'টি অনন্যা ব্যক্তিত্ব তাঁদের একজন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক তারা তাদের লেখনীর মাধ্যমে মুসলমান সমাজকে জাগাতে চেষ্টা করেছেন কারাগারেও তারা ছিলেন তাদের সত্য সেবী ভাইয়ের সাথী ইসলামী আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকার অপরাধে (?) মিসর সরকার কর্তৃক প্রদত্ত কারাবাসকেও তারা বরণ করেছেন মোটকথা ইসলামের জন্য ত্যাগ স্বীকারের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে কোন দিক দিয়েই এরা পিছপা ছিলেন না ৷

এ প্রসঙ্গে আমেরিকার এক মহিলার নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য তাঁর নাম মরিয়ম জামিলা আমেরিকার এক ইহুদী পরিবারে তার জন্ম পূর্বের নাম ছিল মার্গারেট মার্কাস ছোটবেলা থেকেই ইহুদীবাদের গলদ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয় এ জন্য তাকে অনেক দুঃখ-কষ্ট সইতে হয়েছে এমনকি নিজ পরিবারেও যথেষ্ট লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে শেষ পর্যন্ত নিজের দেশ, বাড়ী-ঘর, স্বজন ছেড়ে পাকিস্তানে এসেছেন হিজরত করে তিনি তার শিক্ষাগত যোগ্যতার সবটুকু মুসলিম জাগরণের কাজে লাগানোর জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এ পর্যন্ত অনেক বই লিখেছেন তার মধ্যে— Islam Vs, the west, Islam in theory and practice, Islam and modernism প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য

বর্তমান বিশ্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে মহিলাদের ভূমিকার কথা বলতে গেলে যে নামটি কোনক্রমেই বাদ দেয়া যায় না তিনি হলেন জয়নব আল গাজালী পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর নির্মম অত্যাচার নিপীড়ন সহ্য করে ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবী কাফেলাকে সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্যে যেসব বিপ্লবী মানুষ জীবন বাজী রেখেছেন তাদেরই একজন জয়নব আল গাজালী আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে তথা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহই যে সবকিছুর ঊর্ধে একথা তিনি জীবনে বাস্তবায়িত করেছেন এই মহিয়সী নারীর জন্মস্থান মিসরে সাম্রাজ্যবাদী চক্রের ক্রীড়নক হিসেবে প্রেসিডেন্ট নাসের যখন মিসরের মুক্তিকামী জনগণের উপর জঘন্যতম অত্যাচার চালাচ্ছিল তখন যেসব জিন্দা দিল মানুষ ন্যায় ও সত্যের পক্ষে বাতিলের বিরুদ্ধে আওয়াজ বুলন্দ করেন, জয়নব আল গাজালী তাদের অন্যতম তাঁদের নেতৃত্বে পরিচালিত প্রচণ্ড গণ আন্দোলনের সম্মুখে প্রেসিডেন্ট নাসের বেসামাল হয়ে পড়েন অন্য দিকে সোভিয়েট সরকার মিসরের এই আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্যে প্রেসিডেন্ট নাসেরের উপর চাপ প্রয়োগ করেন প্রেসিডেন্ট নাসের এ আন্দোলনের মূল শক্তি যে জনগণ এ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন তাই প্রথমে তিনি ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পাতেন জয়নব আল গাজালীকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীপদের লোভ দেখান কিন্তু তিনি এসব কিছু প্রত্যাখান করে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যোগ দেন

নাসের যখন কোনক্রমেই এই মহিয়সী মহিলাকে ষড়যন্ত্রের ফাঁদে ফেলতে পারলেন না তখন তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় সড়ক দুর্ঘটনার এক নাটকীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার চেষ্টা করা হয় কিন্তু আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান অবশেষে শেষ রক্ষার জন্য তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় সেখানে তার উপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতনের ষ্টীমরোলার

কিন্তু কারাগারের সীমাহীন অত্যাচার-যুলুমের পরেও তিনি স্বৈরাচারী খোদাদ্রোহী সরকারের কাছে নতী স্বীকার করেননি শারীরিক, মানসিক যাবতীয় নির্যাতন সহ্য করে তিনি অটল-অবিচল থেকেছেন আল্লাহর পথে

 

বর্তমান যুগে নারী সমাজের কর্তব্য

জ্ঞানার্জন

ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার এই মহান দায়িত্ব নারী এবং পুরুষ উভয়ের জন্য পূর্বের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারি পুরুষেরাই শুধুমাত্র এ দায়িত্ব পালন করেনি বরং নারীরাও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে

এ দায়িত্ব পালনের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন জ্ঞানার্জন করা প্রকৃত ইসলামী জ্ঞান ছাড়া আমাদের দায়িত্ব যে কি তা আমরা বুঝতেই পারব না আর না বুঝে কেমন করে সে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব?

পবিত্র কুরআনের ঘোষণাঃ

﴿أَفَمَن يَعْلَمُ أَنَّمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ الْحَقُّ كَمَنْ هُوَ أَعْمَىٰ ۚ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ﴾

"এটা কি করে সম্ভব যে, যে ব্যক্তি তোমার খোদার এই কিতাবকে যা তিনি তোমার প্রতি নাযিল করেছেন সত্য বলে জানে, আর যে ব্যক্তি এই মহাসত্যের ব্যাপারে অন্ধএরা দু'জনেই সমান হয়ে যাবে? উপদেশ তো বুদ্ধিমান লোক মাত্রই কবুল করে থাকে” -সূরা আর রাদঃ ১৯

ইসলামে জ্ঞানার্জন ফরয বা অবশ্য করণীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে রাসূল সা.-এর প্রতি অবতীর্ণ ওহীর প্রথম কথাই ছিল ٱقْرَأْ অর্থাৎ পড় এবং এই পড়াটাকেও অনির্দিষ্ট না করে ﴿ٱقْرَأْ بِٱسْمِ رَبِّكَ ٱلَّذِى خَلَقَ﴾ অর্থাৎপড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেনকথাটি জুড়ে দিয়েছেন অর্থাৎ জ্ঞানার্জন করতে হবে কিন্তু তার মূল ভিত্তি হবে আল্লাহ সম্পর্কে জানা হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছেঃ

طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةً عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ وَمُسْلِمَةٍ

জ্ঞানার্জন প্রত্যেক মুসলিম নর এবং নারীর জন্যে ফরয

এখানেও জ্ঞান বলতে ইসলামী জ্ঞানের কথাই ইঙ্গিত করা হয়েছে বলা হয়েছেজ্ঞানার্জনের জন্যে প্রয়োজন হলে সুদূর চীনে যাওযে জ্ঞান মানুষকে খোদা বিমুখ করে দেয়—যা মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে নেয় এখানে সে জ্ঞানের কথা বলা হয়নি যে শিক্ষা মানুষকে মুসলমানের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলে, মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্য, হারাম-হালাল, ন্যায়-অন্যায় প্রভৃতি সম্বন্ধে নির্দেশ দেয় সেটাই প্রকৃত ইসলামী জ্ঞান আর এই জ্ঞানার্জনের তাগিদই দেয়া হয়েছে ইসলামে এই জ্ঞান আমরা পেতে পারি তিনটি সূত্র থেকে

কুরআনঃ কুরআনই হচ্ছে ইসলামী জ্ঞানের প্রধান উৎস এটা আল্লাহর বাণী মানুষের জন্যে করণীয় যাবতীয় বিধি-বিধান আল্লাহ পাক দিয়ে দিয়েছেন এ পবিত্র গ্রন্থে এই কুরআন আমরা পাঠ করে থাকি এবং কুরআন পাঠ বলতে আরবী ভাষায় মূল কুরআন সূর করে পড়াকেই বুঝি কিন্তু আমরা বাংলা ভাষাভাষী লোকেরা আরবী খুব কমই জানি এবং বুঝি কুরআন না বুঝে শুধু সুর করে পড়ার জন্যে নাযিল হয়নি বরং পবিত্র কুরআনেরই কথা ﴿هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ﴾ এটা মুত্তাকিদের জন্যে জীবনযাপন বিধানআসলে এটা হলো জীবন পথের নির্দেশিকা কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছেঃ

﴿هَٰذَا بَيَانٌ لِّلنَّاسِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةٌ لِّلْمُتَّقِينَ﴾

ইহা সমস্ত মানুষের জন্যে একটি বিস্তারিত বর্ণনা আর মুত্তাকিদের জন্যে হেদায়াত এবং নসীহত স্বরূপ” -সূরা আলে ইমরানঃ ১৩৮

কুরআনে আরও বলা হয়েছেঃ

﴿وَأَنَّ هَٰذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ ۚ ذَٰلِكُمْ وَصَّاكُم بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ﴾

ইহাই আমার সোজা ও সরল পথ, অতএব তোমরা এই পথেই চল” -সূরা আল আনআমঃ ১৫৩

এভাবে কুরআনের বিভিন্নস্থানে আল্লাহ পাক মানুষকে এই সঠিক সত্য পথের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন

কুরআনের আয়াতসমূহকে সাধারণত দু'ভাগে ভাগ করা যায় প্রথম অংশ মানুষের বিবেক-বুদ্ধির আয়ত্বের ঊর্ধে যেমনঃ আরশ, কুরসী, লৌহ মাহফুজ, বেহেশত, দোযখ ইত্যাদি সংক্রান্ত আয়াতসমূহ এগুলোকে আয়াতে মুতাশাবেহাত বলা হয় এগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে মাথা ঘামাতে রাসূলুল্লাহ সা. নিষেধ করেছেন কারণ এগুলো মানুষের বিবেক-বুদ্ধির আয়ত্বের বাইরে কুরআন পাঠকালে এগুলোর উপর দ্বিধাহীন চিত্তে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে

দ্বিতীয় অংশকে বলা হয় মোহকাম এগুলো সুস্পষ্ট এবং সাধারণ মানুষের বিবেক-বুদ্ধির আয়ত্বাধীন কুরআনের নিজস্ব ঘোষণায় এগুলোই কুরআনের মূল বক্তব্য (হুন্না উম্মুল কিতাব) এই মোহকাম আয়াতগুলো আবার তিন ভাগে বিভক্ত— হালাল, হারাম এবং আমছাল হালাল অর্থ মানুষের জন্যে কিছু কাজ বা জিনিসকে বৈধ করা হয়েছে যেগুলো সম্পর্কে সম্যকভাবে ওয়াকিফহাল হতে হবে হারাম অর্থ অবৈধ কুরআনে যা যা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সেগুলো পরিহার করে চলার সংকল্প নিতে হবে আমছাল অর্থ উদাহরণ ও দৃষ্টান্তাবলী তৌহিদ, • রিসালাত ও আখেরাতের সত্যতা প্রমাণ করার জন্য আল্লাহ তা'আলা বহু উদাহরণ, উপমা এবং বহু ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন বর্ণনা করেছেন আল্লাহর দ্বীনকে উপেক্ষা করার মর্মান্তিক পরিণতির কথা কুরআন পাঠকালে এগুলো থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে

হাদীসঃ কুরআন পাঠের সাথে সাথেই হাদীস পাঠের গুরুত্ব অনস্বীকার্য এর মাধ্যমে আমরা নবী সা.-এর বাস্তব জীবন এবং জীবনের খুঁটিনাটি দিক সম্পর্কে জানতে পারি হাদীস কুরআনের ব্যাখ্যা এবং মানুষের ব্যবহারিক জীবন সম্পর্কে রাসূল সা. কর্তৃক উপস্থাপিত বাস্তব দিক

আল্লাহ পাক মানুষের জন্যে কোন ফেরেশতাকে নবী হিসেবে পাঠাননি বরং যে সমাজের জন্যে বা যে কাওমের জন্যে আল্লাহ নবী পাঠিয়েছেন তিনি সেই কাওমেরই মানুষ সেই সমাজেরই একজন সুখে-দুখে বেড়ে উঠা মানুষ সেই সাধারণ মানুষ নবুওয়াত পাওয়ার পরই কিভাবে আল্লাহর হুকুম মেনে চলতে পারে তারই বাস্তব নমুনা দেখিয়েছেন নবী-রাসূলগণ যাতে করে মানুষের একথা বলার কোন সুযোগ না থাকে যে, এ বিধান বাস্তবে মেনে চলা অসম্ভব কুরআনের ঘোষণাঃ أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ  আমি তো একজন মানুষ মাত্র, তোমাদেরই মত” -সূরা কাহাফঃ ১১০

শেষ নবী মুহাম্মদ সা.-ও আরবের বুকে সাধারণ আর দশজন মানুষের মতই জীবনযাপন করেছেন সেই সমাজেরই একজন মানুষ হিসেবে কিভাবে, আল্লাহর আইনের পুরাপুরি আনুগত্য করা যায় তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ আমরা দেখতে পাই নবী মুহাম্মদ সা.-এর জীবনে আমাদেরকেও ঐভাবেই আনুগত্য করতে হবে তাই হাদীসের গুরুত্ব অনস্বীকার্য

ইসলামী সাহিত্যঃ কুরআন এবং হাদীস অধ্যয়নের সাথে সাথে ইসলামী সাহিত্য পাঠ অপরিহার্য কারণ কুরআন এবং হাদীসকে আরও ভালভাবে বাস্তব জীবনের জন্যে গ্রহণোপযোগী করে জানতে হলে বিভিন্ন মনীষীর রচিত ইসলামী সাহিত্য পাঠ করতে হবে কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক এসব সাহিত্য আধুনিক জীবন জিজ্ঞাসার জবাব দিতে সক্ষম

ইসলামের প্রাথমিক যুগের মেয়েরাও জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলেন না অন্যান্য মহিলার মধ্যে উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়েশা রা.-এর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আয়েশা রা. অনেক হাদীস রেওয়ায়াত করেছেন যেগুলোর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি রাসূলে করীম সা.-এর পারিবারিক এবং সাংসারিক জীবনের বিভিন্ন দিক যদি আমরা হযরত আয়েশা রা. ও অন্যান্য উম্মুল মু'মিনীন কর্তৃক রেওয়ায়াতকৃত হাদীসগুলো এবং তাদের পারিবারিক বিভিন্ন ব্যাপার না জানতে পারতাম, তবে নবী জীবনের অনেক দিক থেকে যেত অজ্ঞাত আয়েশা রা. জীবনের অধিকাংশ সময় কাটাতেন জ্ঞানার্জনে সাংসারিক অন্যান্য কাজের চেয়ে রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছ থেকে জ্ঞানার্জনই তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল তাঁর জীবনের এই দিকটি মুসলিম মহিলাদের জন্য অবশ্য অনুকরণীয়

 

আমল

ইসলাম মানুষকে শুধু জ্ঞানার্জনেই উৎসাহিত করেনি আমলহীন ঈমান মানুষের কোন কাজে আসে না তাই আল্লাহ এরশাদ করেছেনঃ

﴿يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ﴾﴿كَبُرَ مَقْتًا عِندَ ٱللَّهِ أَن تَقُولُوا۟ مَا لَا تَفْعَلُونَ﴾

হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা কেন সেই কথা বল যা কার্যত কর না? আল্লাহর নিকট ইহা অত্যন্ত ক্রোধ উদ্রেককারী ব্যাপার যে, তোমরা বলবে এমন কথা যা কর না” -সূরা আস সাফঃ ২-৩

কাজেই আমাদের উচিত 'ঈমান অনুযায়ী বাস্তব জীবনে কাজ করা আর বাস্তব জীবনে আমল করা ছাড়া ঈমানের দাবীও পূর্ণ হয় না হাদীস শরীফেও ঈমানের সংজ্ঞায় বলা হয়েছেঈমান তাকেই বলে যা অন্তরে বিশ্বাস করা হয়, মুখে তার স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং কাজে পরিণত করা হয়কাজেই আমাদের উচিত অর্জিত জ্ঞানকে বাস্তব জীবনে কাজে লাগানো জ্ঞান ছাড়া যেমন কোন কিছু পুরোপুরি পালন করা সম্ভব নয়, তেমনি বাস্তব কাজ ছাড়াও জ্ঞান মূল্যহীন রাসূলে খোদা সা.-এর শেখানো একটি দোয়া থেকে জ্ঞানার্জনের লক্ষ্য উপলব্ধি করা যেতে পারেঃ

اللَّهُمَّ أَرِنَا الْحَقَّ حَقَّ فَرْزُقْنَا اِتِّبَاعَهُ وَاَرِنَا الْبَاطِلاً بَاطِلاً وَرَزَقْنَا اجْتِنَبَهُ

হে খোদা! সত্যকে সত্য রূপে জানার সুযোগ দাও, তাকে আঁকড়ে ধরার শক্তি দাও আর মিথ্যাকে মিথ্যা রূপে জেনে তাকে বর্জন বা পরিহার করার তৌফিক দাও

এভাবে আল্লাহর রাসূল ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা ও হক-বাতিলের সঠিক পরিচয় লাভের যেমন চেষ্টা করতেন তেমনি সাহায্য চাইতেন মহান আল্লাহর কাছে বাস্তবে তার রূপ দিতে মহানবীর এই সাধনা ও প্রার্থনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, জ্ঞানের লক্ষ্য হচ্ছে তাকে বাস্তবে রূপ দেয়া

 

বাস্তব জীবনে নারী

বাস্তব জীবনে মেয়েদের পরিচয় মেয়ে হিসেবে, বোন হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে এবং মা হিসেবে মেয়ে হিসেবে যখন সে পিতার পরিবারভুক্ত থাকে তখন তার আশেপাশে থাকে মা, বোন, ভাই, বাপ ইত্যাদি আরও অনেকে একটি মেয়ে যদি ঈমানী শক্তিতে বলিয়ান হয়, তার যদি যথেষ্ট পরিমাণে ইসলামী জ্ঞান থাকে তবে সে পরিবেশের উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে পারে সে তার ভাই-বাপকে ইসলামের পথে উদ্ধুদ্ধ করতে পারে অনুপ্রেরণা যোগাতে পারে তাদের প্রতিটি কর্মে বোনের অনুপ্রেরণা, মেয়ের উৎসাহ অনেককে ভাল কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে মিসরের হামিদা কুতুব কয়েদখানাকেও ভয় করেননি সত্যসেবী ভাইয়ের সহযোগিতা করতে গিয়ে জয়নাব আল গাজালীর স্বামী যখন ইখওয়ানের সাথে সম্পর্কিত হবার কারণে নাসের সরকারের নির্যাতনের আশংকা করছিলেন তখন স্ত্রীর স্পষ্ট ঈমান দৃপ্ত জবাব তাকে শুধু আশ্বস্তই করেনি বরং তিনি দোয়া করেছিলেন, “দোয়া করি এই মহত্তর কাজে অবিচল থাকার জন্যে আল্লাহ তোমাকে সৎ সাহস এবং উৎসাহ দান করুন আমার জীবদ্দশাতে যদি আমি ইখওয়ানের সাফল্য দেখে যেতে পারি তাহলে কতইনা সুখী হবো খোদা যেন তোমাদের প্রচেষ্টায় ইসলামী সরকার কায়েম করেন হায়! নবীন হয়ে যদি আমিও তোমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারতাম

মেয়েরা যখন বড় হয়ে সংসারে প্রবেশ করে তখন তার দায়-দায়িত্ব বেড়ে যায় সে তখন একজনের গোটা একটা বাড়ীর দায়-দায়িত্ব হয়ত তার

ঘাড়ে এসে পড়তে পারে সেখানে সবার উপর তার দায়িত্ব আরও ব্যাপক দুনিয়াতে কোন স্বামীই স্ত্রীর সহযোগিতা ছাড়া গঠনমূলক কোন কাজ করতে পারে না কর্মক্লান্ত পুরুষ যদি সারাদিনের কঠোর পরিশ্রমের পর ঘরে ফিরে তার স্ত্রীর নির্মম মুখ আর কঠোর মেজাজ দেখে, প্রতি পদে পদেই যদি সে তার স্ত্রী কর্তৃক বাধার সম্মুখীন হয়, যদি সে অনুভব করে যে, তার জীবন যে মহৎ উদ্দেশ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে তার প্রতি তার স্ত্রীর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি নেই তবে সে তার কর্ম প্রেরণা কোথায় পাবে? বাইরের ঝড়-ঝঞ্ঝা, দুঃখ-কষ্টের মুকাবিলা করার শক্তি সাহস কোথা থেকে আসবে? ঘরের বিরক্তিকর পরিস্থিতি স্বভাবতই তাকে বহির্মুখী করে দেবে এবং তার সমস্ত প্রতিভা লোপ পেতে থাকবে সে হয়ে উঠবে উচ্ছৃংখল আর উচ্ছৃংখল মানুষ দ্বারা দুনিয়ার কোন ভাল কাজ সম্ভব হয় না স্বামীর সাফল্যে স্ত্রীর ভূমিকা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত শাস্ত্রের লুকাসিয়ান প্রফেসর পদার্থ বিজ্ঞানী ষ্টিফেন উইলিয়াম হকিং এর বয়স ছেচল্লিশ বছর বিংশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী তাকে বলা হয় মহাকাশ সম্রাট গ্যালিলিও, নিউটন এবং আইনষ্টাইনের সর্বশ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকারী হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন ষ্টিফেন উইলিয়াম হকিং জড়বৎ একতাল মাংসপিণ্ড পঙ্গু অথর্ব দেহ কাপড়-জামার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে একদিকে কাত হওয়া একটি মাথা হাত নাড়ানোর ক্ষমতা নেই মুখের ভাষা বহু আগেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে তবু তার দিকে চেয়ে আছে হাজার হাজার পদার্থ বিজ্ঞানী উন্মুখভাবে তারা প্রতীক্ষা করে আছেন কবে তিনি তুলে ধরবেন এই জীবন ও জগৎ বিশ্বচরাচরের অপার রহস্য ও তার হাজার হাজার প্রশ্নের উত্তর নিউটন যে চেয়ারে আসীন ছিলেন কর্মসূত্রে সেই চেয়ারে আসীন হয়েছেন ষ্টিফেন উইলিয়াম হকিং আজ দুই দশক ধরে সর্বাঙ্গ পক্ষাঘাতদুষ্ট এক জড়ব‍ জীবন বহন করে বেড়াচ্ছেন তিনি রোগের নাম চিকিৎসা শাস্ত্রের পরিভাষায়আমিও ট্রোফিক ল্যাটারাল স্কেলরোসিস' একুশ বছর বয়সের সময় তিনি হাটতেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ত্রিশ বছর বয়সে হুইল চেয়ারে এখন নিজের শরীরের মাংসপেশীর উপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই হকিং এর বছরতিনেক আগে এক অপারেশনের দরুন বাকশক্তিও নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে তবু তিনি কথা বলেন একটি মার্কিন কোম্পানীর তৈরী এক স্বর-সংশ্লেষক যন্ত্র দিয়ে একটি কম্পিউটর মেশিন যাতে চাবি টিপে শব্দ বানালে সেটা খ্যানখ্যান ধাতব স্বরে কথা বলে আঙ্গুলের ডগার সজীবতার যে সামান্য তলানি আছে সেটা দিয়েই তিনি চালান তার কথাবার্তা তবুও অদম্য উৎসাহ ষ্টিফেন হকিং- এর একদিকে হুইল চেয়ারে বন্দী অকেজো দেহ অন্যদিকে কাত হওয়া মস্তিষ্কের মহাশূন্য বিচরণ

তিনি গবেষণা করে যাচ্ছেন বিংশ শতাব্দীর উদ্বিগ্ন বিজ্ঞানীদের প্রশ্ন গবেষণার শেষ পর্যন্ত যদি জীবিত না থাকেন? হকিং এর সহজ উত্তর, অতশত ভাবি না মাথার কাছে মৃত্যুর উদ্যত খড়গ নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি পঁচিশ বছর এরপরে যদি প্রাণ বায়ু নিঃশেষিত হয়, তবে হোক না আলোকবর্তিকা বহন করার জন্যে তো আছেন আমার উত্তরসূরীরা এতো খোলামেলা ভাষায় রোগকে অস্বীকার করার মানসিক শক্তি কয়জনের থাকে?

ষ্টিফেন হকিং সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে যে নামটি অনিবার্যভাবে আসে তিনি হলেন তার স্ত্রী ও ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপিকা জেন হকিং সুদীর্ঘ বাইশ বছর স্বামীর পাশে অনুপম ধৈর্যের প্রতীক হিসেবে বিচরণ করেছেন তিনি স্বামীর এই মারাত্মক ব্যাধি যেন সংক্রমিত না হয় তাদের তিন সন্তানের দেহে এ জন্যে সদাসতর্ক এ মহিলা একই সঙ্গে স্বামীর সমস্ত বেদনা হতাশার সামনে ধৈর্য এবং আশার প্রদীপ জ্বেলে ধরেছেন জেন হকিং আর সেই আশায় উদ্ভাসিত ষ্টিফেন হকিংও তাঁর জীবনের অবশিষ্ট সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করে চলেছেন মহারহস্য উদ্ঘাটনে সাফল্যের স্বর্ণ তোরণ হয়তো চোখে দেখা যায় না, কিন্তু জানা যায় কোন্ পথের প্রান্তে তার অবস্থান হকিং তার জড়বৎ দেহকে হুইল চেয়ারের বন্ধনীতে বেঁধে অগ্রসর হচ্ছেন সেই পথে দ্রুতবেগে হুইল চেয়ার চালানো তার অভ্যাস যেন কোনমতে জীবনের তলানীটুকু নিঃশেষ হওয়ার আগেই সময়কে পরাজিত করে গন্তব্যস্থলে উপনীত হতে পারেন ৷

এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি স্ত্রীর সহযোগিতার কারণে মানুষ যেমন অসাধ্য সাধন করতে পারে তেমনি তার অসহযোগিতা এবং অবহেলা একটা অনন্য প্রতিভাকে সমূলে বিনষ্ট করে ধ্বংসের পথে টেনে আনতে পারে কাজেই সবকিছু বিচার-বিবেচনা করে এ পথে চলা দরকার

মুসলিম স্ত্রী হিসেবে তার দায়িত্ব আরও অনেক বেশী একজন আদর্শ মুসলিম স্ত্রী তাঁর স্বামীকে সব সৎকর্ম, মহৎ উদ্দেশ্যের দিকে অনুপ্রেরণা যোগাবে, সমস্ত মন্দ ও অসৎকর্ম থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করবে তার স্বামীর মধ্যে সৃষ্টি করবে জিহাদী প্রেরণা দুনিয়ার সমস্ত অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি তাকে যোগাবে সে তার স্বামীর চরিত্রে কোন কাপুরুষতা, ইসলাম বিমুখতা সহ্য করার জন্যে তৈরী থাকবে না সে হবে ধৈর্য এবং জ্ঞানের মূর্তপ্রতীক সে তার স্বামীকে বুঝিয়ে দিবে যে, ইসলামের পথে যে কোন ত্যাগ এবং কুরবানীকে মেনে নিতে সে রাজী আছে, কিন্তু শয়তানী পথে হাজারো আরাম বিলাসও সে বরদাশত করবে না যেমন বলেছিলেন ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া এই প্রসঙ্গে হযরত মুহাম্মদ সা.-এর যুগে এক মহিলার ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য তার স্বামী অসুস্থ পুত্রকে রেখে বাইরে গেছেন কাজে ইতিমধ্যে সে ছেলে মারা গেছে রাত্রিতে কর্মক্লান্ত হয়ে যখন তিনি ফিরে এলেন তখন তার স্ত্রী ছেলেকে কাফনে ঢেকে শুইয়ে রেখেছেন তিনি যখন সন্তানের খবর জিজ্ঞেস করলেন তখন বুদ্ধিমতি স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর খবর না দিয়ে বললেন, আশা করা যায় সে এখন শান্ত আছে তারপর তিনি স্বামীর সেবা-যত্ন করলেন সকালে যখন সুস্থ হয়ে গোসল সেরে নামায পড়তে যাবেন তখন তিনি তার পুত্রের মৃত্যু খবর জানালেন ঐ সাহাবা যখন হযরত সা.- এর কাছে যেয়ে সমস্ত ঘটনা ব্যক্ত করলেন তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তোমার স্ত্রীর উপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং পুরস্কার স্বরূপ তোমাদের গত রাতের মিলনে আল্লাহ পাক তার এক প্রিয় বান্দাই সৃষ্টি করবেন তাদের সেই পুত্রই পরবর্তীকালে ইসলামের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে গেছেন দেখুন মায়ের কি অপূর্ব ধৈর্য পুত্রের শোকে বিচলিত হওয়া সত্বেও তিনি ক্লান্ত স্বামীকে তৎক্ষণাৎ বিব্রত করেননি বরং সেবা দিয়ে তাকে আবার কর্মোপযোগী করে তুলেছেন এবং রেখে গেছেন আমাদের জন্যে এক উজ্জ্বল আদর্শ

এরপর আসে মা হিসেবে মেয়েদের ভূমিকার কথা আজকের নারী সমাজের সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান কাজ হচ্ছে আদর্শ মা হওয়ার চেষ্টা করা একজন আদর্শ মা একটি পরিবারের ভিত্তি এবং একটি আদর্শ পরিবার একটা আদর্শ সমাজের ভিত্তি আজকে বিজ্ঞানের চরম উন্নতির যুগে প্রমাণিত হয়েছে বাপ-মায়ের চরিত্র সন্তানের মধ্যে প্রতিফলিত হয় বিশেষ করে সন্তান যখন মায়ের গর্ভে থাকে তখন মায়ের স্বভাব, হাব-ভাব, আচার- আচরণ ইত্যাদি সন্তানের মানসিকতা গঠনের উপর একটা স্থায়ী ছাপ ফেলে এবং সন্তান যখন বড় হয় তখন তার মধ্যে সেই গুণাগুণগুলো লক্ষ্য করা যায় কাজেই দুঃশ্চরিত্র বা খারাপ স্বভাবের মাতা-পিতার সন্তান কখনও আদর্শ সন্তান হতে পারে না ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই, যত জ্ঞানী গুণী এবং উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি এই দুনিয়াতে এসেছেন তাদের প্রত্যেকের মাতাই ছিলেন অনেক মহৎ গুণসম্পন্না

উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি ওমর ইবনে আবদুল আজিজের কথা তাঁর নানী দুধ বিক্রি করে সংসার চালাতেন একদিন দুধে পানি দেয়ার জন্যে তাঁকে বলা হয়েছিল তখন ছিল দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর রা.-এর খেলাফত কাল দুধে পানি মিশানো তখনকার দিনে ছিল সরকারীভাবে নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ কিন্তু তাকে বলা হয়েছিল যে খলীফা তো আর এখানে নেই কাজেই দুধে পানি মিশালে কেউ তাকে দেখতে পাবে না তখন তিনি যদিও ছোট্ট বালিকা মাত্র তবুও গভীর খোদা প্রেম ছিল তার অন্তরে তিনি বললেন যে, খলীফা না দেখলেও আল্লাহ তো দেখতে পাচ্ছেন কাজেই তিনি দুধে পানি মেশাতে পারবেন না হযরত ওমর ফারুক ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এই কথোপকথন শুনতে পান এবং এই বালিকাকে পুরস্কৃত করেন সেই মহিলারই নাতি ওমর ইবনে আবদুল আজিজ কাজেই এই খোদা প্রেমের মহৎগুণ মেয়ের মাধ্যমে নাতির মধ্যে পরিলক্ষিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক হযরত আবদুল কাদির জিলানীর (র) জীবনী আলোচনা করলেও আমরা দেখতে পাই যে, অপূর্ব সবগুণের সমাবেশ ছিল তাঁর মধ্যে তাঁর মা এবং বাপ উভয়েই ছিলেন তাকওয়া এবং পরহেজগারীতে শীর্ষস্থানীয় তাঁর পিতার আপেল খাওয়ার ঘটনা কারও অজানা নয় অন্যদিকে তাঁর মাতাও ছিলেন পর্দানশীলা, গভীর ইসলামী জ্ঞান সম্পন্না এবং অত্যন্ত সুন্দরী রমণী

সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরেলভী যিনি পাক-ভারত উপমহাদেশে মুজাহিদ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন, তাঁর মায়ের জীবনী আলোচনা করলেও আমরা দেখতে পাই, তিনি একজন আদর্শ মহিলা ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ আলী, শওকত আলী ভ্রাতৃদ্বয় যারা খেলাফত আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন তাদের মাতা একজন মহীয়সী মহিলা ছিলেন তিনি নানাভাবে প্রেরণা যুগিয়েছেন তাঁর পুত্রদেরকে বিজাতীয় শাসকদের বিরুদ্ধে লড়তে কাজেই আমরা দেখতে পাই একটি নারীর কারণে একটি যুগের সৃষ্টি হতে পারে

পুরুষেরা কর্মব্যস্ত পরিবারের সন্তান এবং অন্যান্য দিকে লক্ষ্য দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয় কিন্তু সাধারণত সন্তানেরা ছোট বেলায় সারাক্ষণই মায়ের কাছে থাকে সে মায়ের সমস্ত কাজ-কর্ম দেখে এবং তা অনুসরণ করার চেষ্টা করে মা সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষিকা

শিশু সন্তানদের ট্রেনিং এর ব্যাপারে হযরত লোকমান আ.-এর যে শিক্ষা কুরআনে সূরা লোকমানে উল্লেখ করা হয়েছে, আদর্শ মাতা হিসেবে সন্তানদেরকে সেই শিক্ষাই দিতে হবে

শিক্ষাগুলো নিম্নরূপঃ

একঃ শিশুদেরকে শিরকের বিরুদ্ধে সজাগ সচেতন করা এবং এ থেকে বিরত রাখা

দুইঃ আল্লাহ সম্পর্কে তাদেরকে সঠিক ধারণা দেয়া তিনি যে সূক্ষ্মদর্শী মানুষের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজকেও দেখেন একথা তাদের মনে দৃঢ়মূল

করে দেয়া

তিনঃ মা-বাপের সেবা করা

চারঃ ছোটবেলা থেকেই নামায পড়তে অভ্যস্ত করা

পাঁচঃ তাদেরকে যাকাত, দান-খয়রাতে অনুপ্রাণিত করা ও দুঃস্থ মানবতার সেবায় উদ্বুদ্ধ করা

ছয়ঃ সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজ থেকে বিরত রাখার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করা

সাতঃ অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার কাজে বাধা প্রতিবন্ধকতার মুকাবিলায় ধৈর্যের অনুপ্রেরণা দান

আটঃ মানুষের প্রতি মনোযোগী ও বিনয়ী হওয়া অহংকারী না হওয়া

নয়ঃ চাল-চলন, আচার-ব্যবহারের ব্যাপারে মার্জিত, ভদ্রোচিত ও মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা

দশঃ বিনয়ী ও ভদ্রোচিত ভাষায় মানুষের সাথে কথাবার্তা বলতে অভ্যস্ত

করা

ব্যক্তিগতভাবে এ শিক্ষা অনুযায়ী সন্তানকে গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও পারিপার্শ্বিকতা ছেলে-মেয়েদের মন-মানসিকতার উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে আমরা বর্তমান সমাজের দিকে তাকালে দেখতে পাই, চারিদিকে নোংরামি, অশ্লীলতা আর উলঙ্গপনার সয়লাব মেয়েরা নানাভাবে তাদের দেহ প্রদর্শন করে বেড়াচ্ছে কিন্তু যদি বাড়ীর মায়েরা এ ব্যাপারে সচেতন এবং ছোট বেলা থেকে এর বিরুদ্ধে ঘৃণার মনোভাব গড়ে তোলেন তবে এ সমস্যার সয়লাব থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া যায়

 

সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার প্রয়োজন

নারী সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রসঙ্গে এ পর্যন্ত যা কিছু আলোচনা করা হলো, তা কোন বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় সম্পাদন করা যায় না

এর জন্যে প্রয়োজন একটা সুসংবদ্ধ প্রচেষ্টার এজন্যেই আল্লাহর নির্দেশঃ

﴿وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا﴾

সকলে মিলে আল্লাহর রজ্জু শক্ত করে ধরো এবং দলাদলিতে পড়ো না” -সূরা আলে ইমরানঃ ১০৩

রাসূল সা.-ও জামায়াতবদ্ধ জিন্দেগীর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন, বলা হয়েছেতোমরা জঙ্গলের মধ্যে থাকলেও একজনকে নেতা বানিয়ে নাও' আরও বলা হয়েছেঃমেষের পাল থেকে একটি মেষ আলাদা হয়ে গেলে যেমন নেকড়ে বাঘের শিকার হয় তেমনই জামায়াত বা দল থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিও শয়তানের শিকার হয়' 'যদি কেউ ইসলামী জামায়াত থেকে এক বিঘত পরিমাণ দূরে সরে যায় সে যেন ইসলামের দড়িকেই গলা থেকে খুলে ফেলল'

এভাবে কুরআন-হাদীসে বহুস্থানে সংঘবদ্ধ জীবনের জন্যে তাগিদ করা হয়েছে

আমরা জানি বিভিন্ন ক্ষেত্রে আদর্শবাদী মহিলার অভাব নেই ৷ বৰ্তমান সমাজের নোংরা চিত্র অনেককেই বিষিয়ে তুলেছে ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ এ সমাজের পরিবর্তনও কামনা করেন এ উদ্দেশ্যে হয়তবা অনেকে পত্র-পত্রিকায় লিখে থাকেন কেউবা নানা রকম সামাজিক কার্যকলাপেও অংশ নিয়ে থাকেন কিন্তু এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা একটা সামগ্রিক পরিবর্তন ও ফলপ্রসু সমাজ বিপ্লব সৃষ্টিতে সক্ষম নয় এ জন্যে আদর্শবাদী ও ইসলামী ভাবাপন্ন মহিলাদের একটা ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা অপরিহার্য এর প্রাথমিক পদক্ষেপ স্বরূপ একমনা আদর্শবাদী মহিলাদের মধ্যে একটা পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে পরস্পরের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান করতে হবে সামষ্টিক চেষ্টা-সাধনার মাধ্যমে ইসলামের জ্ঞানার্জনের একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে এবং বাস্তবে তার অনুশীলনীরও কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে

স্থায়ীভাবে একমনা আদর্শবাদী মহিলারা নিয়মিত সাপ্তাহিক ও মাসিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন উক্ত অনুষ্ঠানসমূহে কুরআন, হাদীস ও ইসলামী সাহিত্য আলোচনার সাথে সাথে নিজেদের বাস্তব ও ব্যবহারিক জীবনের সমস্যা ও তার সমাধান নিয়েও আলাপ-আলোচনা করতে পারেন বর্তমান সমাজের অশালীন ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির জন্যে নারী সমাজের মধ্যে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা চালানো যেতে পারে নারীর মর্যাদা হানিকর ও কুরুচিপূর্ণ কার্যকলাপ বন্ধের জন্যে কর্তৃপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করা যেতে পারে

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংস্কারাকাংখী যেসব মহিলা রয়েছেন তাদের পরস্পরের মধ্যে মতবিনিময় ও যোগাযোগ থাকা বাঞ্ছনীয় চিঠি-পত্রের মাধ্যমে তা খুব সহজেই করা সম্ভব এমনি যোগাযোগের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্কই শুধু দৃঢ় হবে না, সত্য ও ন্যায়ের পথে এক বোন অন্য বোনকে অনেক দূরে অগ্রসর করে নিতে সাহায্য করতে পারবে আর এভাবে একে অপরকে আল্লাহর পথে চলতে সাহায্য করাও ঈমানের অপরিহার্য দাবী

এভাবে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে নারী সমাজ তার দায়িত্ব পালন করলেই প্রত্যেকটি পরিবার গড়ে উঠবে শান্তি সুখের আবাসস্থল রূপে এবং সমাজ গড়ে উঠবে কল্যাণকর আদর্শ সমাজ রূপে

এমন অনেক ঘটনাই আছে যা এ সত্যই প্রমাণ করে যে, ইসলামের জন্যে পুরুষেরা যা করেছে মেয়েরা তার চেয়ে কম কিছু করেনি ইসলামের খাতিরে নারীরা কষ্ট সহ্য করেছে তারা সব ধরনের বিপদকে বরণ করেছে, জীবন ও সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছে, আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয়জনকেও ত্যাগ করেছে, নির্বাসন ও অনাহারের কষ্ট স্বীকার করেছে এবং সত্য দ্বীনের পথে সংগ্রাম তাদের পিতা, স্বামী ও ভাইদের সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করেছে ঐ সমস্ত নারীদের কারণেই ইসলাম এক সময় বিশ্বে কর্তৃত্ব করেছে এবং আজও যদি এই জীবন ব্যবস্থাকে সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ করতে হয় তাহলে আধুনিক মুসলিম নারী সমাজকে ঐসব সর্বস্বত্যাগী মুসলিম নারীদের পদানুসরণ করে একইভাবে ঈমানের সত্যতা প্রদর্শন করতে হবে” -তরজমানুল কুরআন, মে ১৯৪৭ পৃষ্ঠাঃ ৭৫

মেয়েদেরকে সর্বপ্রথম তাদের নিজ নিজ পরিবার, তাদের পড়শী ও আত্মীয়-স্বজনের পরিবারকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করতে হবে অজ্ঞতা, নৈতিকতাহীনতা এবং মিথ্যা খোদার পূজা দূর করতে হবে নিজকে ও অন্যকে অতীত এবং বর্তমানের অজ্ঞ লোকদের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে দ্বীনের আলোকে অশিক্ষিতা অর্ধশিক্ষিতা মেয়েদের কাছে পৌঁছাতে হবে, শিক্ষিতা মহিলাদের চিন্তাধারাকে পরিশুদ্ধ করতে হবে এবং ধনী পরিবারগুলোতে আল্লাহ ও ইসলামের প্রতি অবহেলা দূর করার চেষ্টা করতে হবে নিজ পরিবারের সন্তানদেরকে একটা ইসলামী পরিবেশের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে যদি পরিবারের পুরুষরা নৈতিকতাহীন এবং ঈমানের সীমালংঘন কাজে প্রবৃত্ত হয় তবে মেয়েদেরকেই সোজা পথে আনার চেষ্টা চালাতে হবে এবং পুরুষরা যদি ইসলামের খাতিরে কাজ করতে থাকে তবে তাদেরকে উৎসাহ ও সহযোগিতা দ্বারা তাদের বোঝা কমাতে হবে” -তরজমানুল কুরআন, মে ১৯৪৭, পৃষ্ঠাঃ ১৭

ইসলামী সরকার নারীকে পুতুল বানাতে চায় না যদিও এমনটি অনেক বোকা লোক মনে করে থাকে তাকেও উন্নতির পথে সাহায্য করা হবে যত বেশী সে পারবে মনে করতে হবে ইসলাম মেয়েদেরকে নারী হিসেবেই সম্মানিত করতে চায় তাকে পুরুষদের মত বানাতে চায় না আমাদের সভ্যতা এবং পশ্চিমের সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য হলো এই যে, পশ্চিমা সভ্যতা নারীকে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন সম্মান কিংবা অধিকার দিতে চায় না যতক্ষণ সে একটি কৃত্রিম পুরুষে পরিণত না হয় এবং পুরুষের দায়িত্বভার গ্রহণ না করে ইসলামী সভ্যতা নারীকে নারী হিসেবে রেখেই সব ধরনের মর্যাদা, সম্মান এবং অধিকার দেয় এবং তার উপর শুধু সেইসব দায়িত্বের বোঝা চাপায় যা প্রকৃতি তাকে দিয়েছে”-মুসলিম খাওয়াতিন ছে ইসলাম কা মুতালাবাত, পৃষ্ঠাঃ ২৪ ৷

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।