ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কাঙ্খিত মান
আব্বাস আলী খান
প্রকাশনা বিভাগ
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
প্রকাশকের কথা
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী-এর নির্বাচিত আমীর
মুহতারাম অধ্যাপক গোলাম আযমকে সরকার অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ রাখার ফলে ১৯৯২ সালের
সদস্য সম্মেলনে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত আমীর মরহুম আব্বাস আলী খান নেতৃত্ব প্রদান করেন। উদ্বোধনী ও সমাপনী ভাষণ ছাড়াও “কর্মীদের
কাঙ্ক্ষিত মান” বিষয়ের উপর তিনি আলোচনা রাখেন।
১৯৯২ সালের রুকন সম্মেলনে প্রদত্ত মরহুম
আব্বাস আলী খানের উক্ত উদ্বোধনী ও সমাপনী ভাষণ ও মূল বক্তব্য পুস্তিকাকারে বের
করার আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
দাওয়াতি যজবা ও কর্মীমান বৃদ্ধি এবং শাহাদাতের তামান্না সৃষ্টিতে পুস্তিকাটি
সহায়ক হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আল্লাহ
তা'আলা আমাদের এ প্রচেষ্টা কবুল করুন।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের
কাঙ্ক্ষিত মান
আন্দোলনের পটভূমি :
এ উপমহাদেশে প্রথম ইসলামী আন্দোলন পরিচালিত
হয়েছিল সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরেলভীর (রহ) নেতৃত্বে বিগত শতাব্দীর প্রথম দিকে। এ উদ্দেশ্যে তিনি ‘তাহরিকে মুজাহেদীন' সংগঠন
কায়েম করেন। উদ্দেশ্য ছিল সত্যিকার ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা
কায়েম করা। সাইয়েদ সাহেব ও তাঁর
সঙ্গী-সাথীদের জিহাদী জযবা ও শাহাদতের তামান্না ছিল ঈর্ষার বস্তু। মুজাহিদ বাহিনীর প্রত্যেকের আদর্শিক ও চারিত্রিক মান ছিল
অতুলনীয়। যার ফলে উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে
সত্যিকার অর্থে
“খিলাফত আলা মিনহাজিন্নাবুয়্যৎ অর্থাৎ নবী মুস্তাফার সা.
প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের অনুকরণে একটি খোদার প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্র
ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল। কিন্তু ইসলামের দুশমন
কাফেরদের সাথে কতিপয় বিশ্বাসঘাতক মুসলমানের যোগসাজশের ফলে এ ব্যবস্থা স্থায়ী হতে
পারেনি। ১৮৩১ সালে বালাকোটে এক রক্তাক্ত সংঘর্ষে
সাইয়েদ সাহেব তাঁর অনেক সঙ্গীদেরসহ শাহাদাত বরণ করেন।
সাইয়েদ সাহেবের শাহাদাতের পর 'কাফেলায়ে
হকের' মধ্য থেকে যাঁরা জীবিত ছিলেন, তাঁরা জিহাদী আন্দোলনকে জীবন্ত রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। অতঃপর ১৮৫৭ সালের আযাদী আন্দোলনে তাঁদের সকল শক্তি নিঃশেষ
হয়ে যায়। তথাপি সাইয়েদ সাহেব ও তাঁর সঙ্গী-সাথীগণ
খোদার পথে নিঃস্বার্থে জীবন বিলিয়ে দেয়ার যে বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তার
প্রেরণা মুসলমানদের মন থেকে একেবারে মুছে ফেলা যায়নি। খোদার পথের মুজাহিদীন তাঁদের জিহাদের প্রেরণা, শাহাদাতের তামান্না ও
আমল-আখলাকের দ্বারা সাহাবা কিরামের রা. আমল-আখলাকেরই নমুনা পেশ করেছেন। কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকালে তাঁদের দিন কাটতো ঘোড়ার পিঠে
এবং রাত কাটতো অশ্রুশিক্ত জায়নামাযে।
সাইয়েদ সাহেবের জিহাদী প্রেরণা ও শাহাদাতের
অভিলাষ কত প্রকট ছিল তা তাঁর কথা ও কাজে প্রমাণিত। তিনি বলেন-
আমি সপ্ত রাজ্যের বাদশাহীকে ঘাসতুল্যও গণ্য
করি না। দীন প্রতিষ্ঠার কাজে যখন
আল্লাহর সাহায্য শুরু হবে এবং খোদাদ্রোহীরা ছিন্নমূল হয়ে যাবে, তখন
আমার চেষ্টা-চরিত্রের তীর স্বয়ং লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যাবে। আমি খোদা ছাড়া অন্যান্য সব কিছু থেকে চক্ষু ও কর্ণ বন্ধ করে দিয়েছি। খোদা ছাড়া কারো সাহায্য ও সন্তুষ্টি আমার কাম্য নয়। রত্ন খচিত রাজমুকুট এবং সেকান্দার বাদশাহর তখত্ ও তাজ আমার
দৃষ্টিতে একটি যবের দানার সমতুল্যও নয়। আমার
শুধু এতোটুকু আরযু-অভিলাষ যে, দুনিয়ার সর্বত্র রাব্বুল আলামীনের হুকুম জারি হোক। ............. আমি আগাগোড়া এভাবেই চেষ্টা-চরিত্র করে আসছি
এবং ইনশাআল্লাহ যতোদিন বেঁচে থাকবো, এ চেষ্টা করতেই থাকবো। কেউ আমার সহযোগিতা করুক বা না করুক, তাতে
কিছু যায় আসে না। জয়-পরাজয় আমার কাঙ্ক্ষিত নয়। এ তো আল্লাহ তাআলার ইখতিয়ারে। তিনি চাইলে তাঁর দীনকে বিজয়ী করতে পারেন। আর নাও করতে পারেন।
আমি তাঁর একজন অনুগত বান্দাহ মাত্র। যদি একাকীও রয়ে যাই, তথাপি এ কাজে আমার জীবন বিলিয়ে
দেব।*
* [সীরাতে সাইয়েদ আহমদ শহীদ, মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী |
বিলম্বে হলেও জিহাদের এ সুপ্ত চেতনার
বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। হালী, আকবর
ইলাহাবাদী, শিবলী, সাইয়েদ সুলায়মান নদভী, মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ প্রমুখ
ইসলামী মনীষীগণ মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী চেতনা জাগ্রত রাখেন।
হযরত সাইয়েদ আহমদ বালাকোটে শাহাদাতের অমৃত
পান করে দুনিয়া থেকে বিদায় হলেন। কিন্তু
ইসলামী আন্দোলনকে আমানত হিসাবে রেখে গেলেন উপমহাদেশের আলেম সমাজের কাছে। তার একশ' বছর পর আমানতের দায়িত্ব গ্রহণ করে এক আলেমে দীন নওজোয়ান
মুজাহিদ সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী। তিনি আন্দোলনের সূচনা করেন একটি মাসিক
পত্রিকা তরজমানুল কুরআনের মাধ্যমে। তিনি
খোদাদ্রোহীতা, শির্ক, বৈরাগ্যবাদ ও পাশ্চাত্যের আধুনিক জড়বাদী সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতা ও ব্যর্থতার
বিশদ বিবরণ দিয়ে বলেন যে,
এখন মানবজাতির মুক্তি একমাত্র ইসলামের মধ্যেই নিহিত আছে। তিনি বলেন, কতিপয় ধর্মীয়
আচার-অনুষ্ঠানাদির সমষ্টির নাম ইসলাম নয়। ইসলামই
একমাত্র বিশ্বজনীন সত্য ও সঠিক মতবাদ ও মানব জাতির জন্যে খোদা প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ
জীবন বিধান। তার অর্থ শুধু এ নয় যে, ইসলামের
প্রচারকার্য চালাতে থাকুন,
এতে সারা দুনিয়া জয় করে ফেলবেন। আসল কথা প্রতিটি সভ্যতার মূলোৎপাটনের জন্যে প্রয়োজন হয় একটি শক্তির, একটি
সংগঠিত মযবুত দলের। আবার নতুন সভ্যতার জন্যেও প্রয়োজন হয় নতুন
চিন্তাধারার ও নতুন দলের। অতএব দুনিয়াকে ভবিষ্যত
অন্ধকার যুগের বিপদ থেকে মুক্ত করার জন্যে এবং ইসলামের অবদান থেকে উপকৃত হওয়ার
জন্যে এতোটুকুই যথেষ্ট নয় যে, তার একটা সঠিক মতবাদ বিদ্যমান আছেই। বরঞ্চ সঠিক মতবাদের সাথে একটা সৎ জামায়াত বা দলেরও প্রয়োজন আছে।
অতঃপর এ জামায়াত বা দলটির প্রতিটি সদস্যকে
ঈমান ও আমলের দিক দিয়ে অতি উচ্চস্তরের বা মানের হতে হবে। তারপর তিনি বলেন,
বর্তমান তাহযীব-তামাদ্দুন ও রাজনীতির ভ্রান্ত সমাজব্যবস্থার
বিরুদ্ধে কার্যত বিদ্ৰোহ ঘোষণা করতে হবে। এ
তাহযীব-তামাদ্দুন ও তার অনুসারীদের থেকে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। এ সভ্যতা ও সমাজব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল প্রকার
সুযোগ-সুবিধা, সুখ-সম্ভোগ ও উন্নতি-অগ্রগতির আশা-আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করতে হবে। অতঃপর এ ভ্রান্ত সমাজব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে তার জায়গায়
একটি সঠিক ব্যবস্থা কায়েম করার জন্যে যে সকল বৈষয়িক ক্ষতি, দুঃখ-কষ্ট
ও বিপদ-মসিবত অপরিহার্য তা বরদাস্ত করে যেতে হবে। এ বিপ্লবের জন্যে প্রয়োজন সর্বাত্মক প্রচেষ্টার এবং কুরবান করতে হবে জান, মাল ও
মূল্যবান সময়। স্বীকার করতে হবে মানসিক ও দৈহিক সকল প্রকার
শ্রম। প্রস্তুত থাকতে হবে জেল, ফাঁসি ও
সকল প্রকার নির্যাতনের জন্যে। এসব
কিছুই বরণ করতে হবে হাসিমুখে।
প্রয়োজন হলে নিজের জীবনও বিলিয়ে দিতে হবে এ পথে। এমন দুর্গম পথ অতিক্রম করা ব্যতীত দুনিয়ায় না অতীতে কোন বিপ্লব সংঘটিত
হয়েছে, আর না এখন হতে পারে।
মাওলানা মওদূদী ইসলামী বিপ্লবের জন্যে ‘সৎ
জামায়াতের প্রয়োজনীয়তা'
শীর্ষক একটি মূল্যবান প্রবন্ধ একচল্লিশ সালের এপ্রিল মাসের
তরজমানুল কুরআনে প্রকাশ করেন। এ
প্রবন্ধের দ্বারা আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত হয়ে মাওলানার আহ্বানে এ বছরের আগস্ট মাসে
লাহোরে ৭৫ জন আল্লাহর নেক বান্দাহ একত্রে মিলিত হন এবং ‘জামায়াতে
ইসলামী' নামে একটি বিপ্লবী আদর্শবাদী দল গঠিত হয়। জামায়াত গঠনের এ সংক্ষিপ্ত পটভূমি বর্ণনার পর এখনকার আলোচ্য বিষয়- তার
কর্মীবাহিনীর সদস্যদের মান অবশ্যই হতে হবে উচ্চস্তরের।
এসব আন্দোলন বা দলের কর্মীদের দু'ধরনের
মান অপরিহার্য হয়ে থাকে। এক. সাংগঠনিক মান। সংগঠনের প্রতি নিষ্ঠা ও আনুগত্য। দ্বিধাহীনচিত্তে সংগঠনের সকল নির্দেশ পালন। বৈঠকাদিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ, কর্ম তৎপরতার নিয়মিত রিপোর্ট পেশ প্রভৃতিকে সাংগঠনিক মান
হিসাবে গণ্য করা হয়। একটি ইসলামী বিপ্লবী
দলের কর্মীদেরও এ ধরনের মান অপরিহার্য। তবে
সেই সাথে আর এক ধরনের মান অধিকতর অপরিহার্য। তা হলো
ইসলামী যে মান আল্লাহ তাআলার পছন্দনীয়, যে মান কুরআন পাক তৈরি করতে চায়, যে মান
তৈরি করেন নবী করীম সা. সাহাবা কিরামেরা। এক
ব্যক্তি বহু ডিগ্রীধারী পণ্ডিত হতে পারেন, বিবিধ জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী
হতে পারেন, একজন নানাবিধ অনলবর্ষী বক্তা হতে পারেন. কুরআন-হাদীসে পারদর্শী হতে পারেন, সাংগঠনিক
যোগ্যতার অধিকারী হতে পারেন। কিন্তু
তাঁর মধ্যে যদি তাওয়াভিত্তিক গুণাবলীর অভাব থাকে, প্রতিটি কথা ও কাজের মধ্যে যদি ইসলামী
আদর্শের প্রতিফলন পরিলক্ষিত না হয়, তিনি যদি নিজেকে ইসলামের মূর্ত
প্রতীক বানাতে অপারগ হন,
তাহলে প্রথম ধরনের মান ইসলামী বিপ্লবের জন্যে অর্থহীন হয়ে
পড়ে।
একজন খাঁটি মুমিনের অথবা ইসলামী আন্দোলনের
কর্মীর কি কি ব্যক্তিগত গুণাবলী অপরিহার্য তার বিশদ বিবরণ কুরআন পাকে ও হাদীসের
গ্রন্থাবলীতে বর্ণিত হয়েছে। আজকের
বক্তব্যে বিশদ বিবরণের অবকাশ নেই বিধায় সংক্ষেপেই কিছু আলোচনা করব।
ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্যে কর্মীদের ব্যক্তিগত
গুণাবলী অর্জনের পূর্বে অথবা সাথে সাথে তার তাহরিকী মেযাজ-প্রকৃতি (আন্দোলনী
মেযাজ-প্রকৃতি) তৈরী হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাহরিকী মোজ-প্রকৃতি কাকে বলে চুয়াত্তর সালের একুশে মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত
ইসলামী জমিয়তে তালাবার শিক্ষা শিবিরে এ প্রশ্নের জবাবে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ'লা
মওদূদী রহ.বলেন-
মেযাজ-প্রকৃতির এ বিশেষ ধরনকে স্বয়ং তারিকী
(আন্দোলন সম্পর্কিত) শব্দটিই সুস্পষ্ট করে দেয়। তাহরিকী মেযাজ-প্রকৃতি হচ্ছে এই যে, যে তারিকী বা আন্দোলন নিয়ে
আপনারা মাঠে নেমেছেন,
সে আন্দোলনের মধ্যে আপনাদেরকে পুরোপুরি পাকাপোক্ত হতে হবে। এর মধ্যে নিমগ্ন হয়ে যাবেন। এর জন্য মনের মধ্যে আগ্রহ-উৎসাহ সৃষ্টি করতে হবে। একে দুনিয়ার সকল কিছু থেকে প্রিয় মনে করতে থাকবেন। নিজের মনের,
দেহের এবং অন্যান্য যেসব শক্তি সামর্থ আপনাদেরকে দান করেছেন, তা
সবকিছু তাঁর পথে নিয়োজিত করার জন্যে উঠেপড়ে লাগবে। আপনাদের মধ্যে এ দৃঢ় সংকল্প পয়দা হতে হবে যেন আপনারা আপনাদের সব কিছুই
একাজে নিয়োজিত করেন। এটাই হলো তাহরিক বা
আন্দোলনের মেঘাজ-প্রকৃতি।
এখন প্রশ্ন হলো, এ
মেযাজ-প্রকৃতি কিভাবে তৈরী করা যায়। এর বহু
উপায়-পদ্ধতি আছে। সে সবের মধ্যে একটি- যেমন ধরুন আপনারা এ
তরবিয়তগাহ্ বা প্রশিক্ষণ শিবির কায়েম করেছেন। এখানে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে আপনাদের মধ্যে তরিকী মেযাজ-প্রকৃতি তৈরীর
চেষ্টা করতে পারেন।
দ্বিতীয়ত ইসলামী সাহিত্য পড়াশুনা করুন, তা বুঝবার চেষ্টা করুন, হৃদয়ে গেঁথে নেয়ার চেষ্টা
করুন, দেখুন এসব পড়াশুনার পর আপনাদের মধ্যে কোন পরিবর্তন
সূচিত হয়েছে বা হচ্ছে কিনা। না হয়ে থাকলে বার বার পড়ুন, আল্লাহর
সাহায্য প্রার্থনা করুন। দেখবেন তিনি আপনাদের মদদ করেছেন। কিন্তু সবচেয়ে যে জিনিস
ফলপ্রসূ হতে পারে তা হলো এই যে, যে আন্দোলনের সাথে নিজেকে
সম্পৃক্ত করেছেন, তাতে বাস্তবে কার্যতৎপর হয়ে পড়ুন। তাহলে
দেখবেন বিভিন্ন ধরনের বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবেন। আপনার ভবিষ্যত
বিপজ্জনক মনে হবে। অনেক সময় মারপিটও খেতে হবে। জেল-জুলুম ও নির্যাতনও হতে পারে
আপনাদের উপরে। তারপর দেখবেন, এ কাজে আপনার উৎসাহ-উদ্যম
বেড়েই চলেছে। এ কাজকে তখন জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য মনে করবেন । অবস্থা
যতোই কষ্টদায়ক হোক, বিপজ্জনক হোক, এর
মধ্যে একটা মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে থাকবেন। এই হলো, তাহরিকী
মেযাজ-প্রকৃতি ।
এখন রইলো ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের ব্যক্তিগত গুণাবলী। এই গুণাবলী “যে যতো বেশী অর্জন করতে পারবে তার মান ততো বেশী উচ্চস্তরের হবে। মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর মুমিন বান্দাহকে যেসব গুণাবলীতে ভূষিত দেখতে চান এবং তার যে মান বা Standard হতে পারে, তার কোন নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই যে সেখানে পৌঁছার পর কামালিয়াত বা পূর্ণত্ব হাসিল করা যাবে। কোন মানুষের পৌঁছাও অসম্ভব। তবে বান্দাহকে সর্বদা উচ্চ থেকে উচ্চতর গুণাবলী অর্জনের চেষ্টা, সাধনা আজীবন করে যেতে হবে। এটাই তার কাজ।
ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের
কর্মীদের কাঙ্ক্ষিত মান:
আমাদের আলোচনা কর্মীদের কাঙ্ক্ষিত মান নিয়ে।
এ মান কাকে বলে এবং তা কি হতে পারে? এর জবাব ত
একটাই। তাহলো এই যে, যে মান আল্লাহ তাআলার ইন্সিত, যে মান তিনি পছন্দ করেন, যে মানে তিনি সন্তুষ্ট হন।
যার ফলে বান্দাহর সকল গোনাহ মাফ করে দেন এবং আখিরাতে পুরস্কারস্বরূপ তাকে জান্নাত
দান করেন। এ মানের কথা স্বয়ং তিনি কুরআনে ঘোষণা করেছেন:
إِنَّ
الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَٰئِكَ هُمْ خَيْرُ
الْبَرِيَّةِ ، جَزَاؤُهُمْ
عِندَ رَبِّهِمْ جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ
فِيهَا أَبَدًا ۖ رَّضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ۚ ذَٰلِكَ لِمَنْ
خَشِيَ رَبَّهُ
যারা (সত্যিকার অর্থে আল্লাহর উপর) ঈমান
এনেছে এবং নেক আমল করেছে. তারা নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম সৃষ্টি। তাদের প্রতিদান হচ্ছে এই যে, তাদের খোদার কাছে তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী জান্নাতসমূহ। সেগুলোর তলদেশ থেকে প্রবহমান হয়ে থাকবে ঝর্ণাধারা। তারা এর মধ্যে বসবাস করতে থাকবে চিরকাল। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর
প্রতি সন্তুষ্ট। আর এসব কিছু তার জন্যে, যে
(প্রতি মুহূর্তে) খোদাকে ভয় করে চলেছে। (আল
বাইয়্যেনাতঃ ৭-৮)
কথা তো অতি পরিষ্কার। যারা খোদার উপর মযবুত ঈমান এনেছে এবং ঈমানের দাবী অনুযায়ী নেক আমল করেছে। নিজে নিজে কোন কিছুকে নেক আমল মনে করলে হবে না। নেক আমল তো একমাত্র তাই যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল
সুস্পষ্টরূপে নেক আমল বলে ঘোষণা করেছেন। নবী
করীম সা. ও তাঁর সাহাবায়ে কিরাম যা করেছেন, তাই নেক আমল। নেক আমল করার ব্যাপারে তাঁদেরই অনুসরণ-অনুকরণ করতে হবে।
এ ধরনের নেক আমল যারা করে, আল্লাহ
তাদেরকে সৃষ্টিকুলের সর্বোত্তম সৃষ্টি বলে ঘোষণা করেছেন। এমনকি ফেরেশতাদের চেয়েও তাদেরকে উত্তম বলা হয়েছে। এ জন্যে যে ফেরেশতাদেরকে কোন কর্মস্বাধীনতা দেয়া হয়নি। নাফরমানী করার কোন শক্তি ও স্বাধীনতা তাদের নেই। পক্ষান্তরে মানুষকে ভালো ও মন্দ কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। নাফরমানী করার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতার
সদ্ব্যবহার করে নাফরমানী না করে ফরমাবরদারী করেছে। নেক আমল করেছে। সে কারণেই আল্লাহ তাদের
প্রতি সন্তুষ্ট তারাও আল্লাহর প্রতিটি কাজের উপর রাযী ও সন্তুষ্ট। বিপদে-আপদে, দুঃখ-কষ্টে সকল অবস্থায় তারা
আল্লাহতে নিবেদিতপ্রাণ এবং আল্লাহর প্রতিটি ফয়সালার প্রতি সন্তুষ্ট।
সবশেষে যে কথাটি বলা হয়েছে তা অতি মূল্যবান
গুরুত্বপূর্ণ। তা এই যে, ঈমানসহ নেক আমল এবং তার জন্যে
আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাতের পুরস্কার- এ সবকিছু নির্ভর করছে খোদাভীতির উপর। যে ব্যক্তি খোদার ব্যাপারে বেপরোয়া, ভয়হীন
ও দুঃসাহসী হয়ে জীবন যাপন করেনি বরঞ্চ প্রতি মুহূর্তে ও পদে পদে খোদাকে ভয় করে
চলেছে। খোদার কাছে ধরা পড়া যেতে পারে, এমন কোন
কাজই তার দ্বারা যেন কখনো না হয়, তার জন্য পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করে চলেছে, সেই হলো
খোদার প্রিয় বান্দাহ এবং তার জন্যেই রয়েছে আখেরোতের পুরস্কার।
বিষয়টি যতোটা পরিষ্কার ততোটা সহজসাধ্য মোটেই নয়। নেক আমল ও তার জন্যে ব্যক্তির যে প্রয়োজনীয় গুণাবলী তা অর্জন করা হঠাৎ রাতারাতি কিছুতেই সম্ভব নয়। এর একটা Process আছে, কর্মপদ্ধতি আছে, তা অবলম্বন করেই নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। কুরআন-হাদীসেও এর বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। তারই শরণাপন্ন আমাদের হতে হবে।
দাওয়াত ও আন্দোলনের কাজের জন্যে
ব্যক্তিগত গুণাবলী
হাদীসে যেসব ব্যক্তিগত গুণাবলীর কথা বলা
হয়েছে তা নিম্নরূপঃ
১। মুজাহাদায়ে নফস
ব্যক্তিগত গুণাবলীর মধ্যে প্রাথমিক ও মৌলিক
গুণ এই যে, আমাদের প্রত্যেককে নিজের মনের সাথে লড়াই করে প্রথমে তাকে মুসলমান ও খোদার
অনুগত বানাতে হবে। এ কথাকেই হাদীসে এভাবে বলা হয়েছে-
الْمُجَاهِدُ
مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ فِي طَاعَتِ اللهِ.
সত্যিকার মুজাহিদ সেই, যে
আল্লাহর আনুগত্যের জন্যে নিজের নফসের সাথে সংগ্রাম করেছে।
অর্থাৎ বাইরের দুনিয়ায় খোদাদ্রোহীদের
মুকাবিলায় বেরুবার পূর্বে সে বিদ্রোহীকে আপনার অনুগত করুন যে আপনার ভেতরেই
বিদ্যমান। এবং যে খোদার আইন ও তাঁর সন্তুষ্টির
বিরুদ্ধে চলার জন্যে সর্বদা চাপ সৃষ্টি করে। যদি এ
বিদ্রোহী আপনার মধ্যে পালিত-বর্ধিত হয় এবং আপনার উপর এতোটা প্রভাবশালী হয় যে, আল্লাহর
সন্তুষ্টির বিরুদ্ধে সে তার দাবী মানিয়ে নিতে পারে তাহলে বাইরের বিদ্রোহীদের
বিরুদ্ধে আপনার যুদ্ধ ঘোষণা হবে একেবারে অর্থহীন। এ বৈপরীত্য বা দু'মুখো নীতি ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের জন্যে অত্যন্ত মারাত্মক। অতএব প্রথমে স্বয়ং খোদার সামনে মস্তক অবনত করুন, তারপর
অপরের কাছে আনুগত্যের দাবী করুন।
২। হিজরত (ব্যাপক অর্থে)
জিহাদের পর অর্থাৎ নফসের বিরুদ্ধে জিহাদের পর
দ্বিতীয় মর্যাদা হলো হিজরতের।
হিজরতের আসল উদ্দেশ্য বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়া বা দেশ ত্যাগ করা নয়। বরঞ্চ খোদার নাফরমানী থেকে পালিয়ে খোদার সন্তুষ্টি লাভের
দিকে অগ্রসর হওয়া। প্রকৃত মুহাজির যদি দেশ ত্যাগ করে, তাহলে এ
জন্যে যে, তার স্বদেশে খোদার আইন অনুযায়ী জীবন যাপন করার কোন সুযোগ তার নেই। কিন্তু কেউ যদি দেশ ত্যাগ করে এবং আল্লাহর আনুগত্য অবলম্বন
না করে, তাহলে সে নির্বুদ্ধিতার কাজ করে। এ
মর্মকথাটিও হাদীসে সুস্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে।
নবী করীম সা. কে একবার জিজ্ঞেস করা হলো-
مَالْهَجْرَةٌ
اَفْضَلُ يَارَسُوْلَ الله .
হে আল্লাহর রাসূল! কোন্ হিজরত সবচেয়ে উত্তম? জবাবে
তিনি বলেন-
أَنْ
تَهْجُرَ مَا كَرِهُ رَبُّكَ
অর্থাৎ তুমি সে সব কাজ পরিহার করবে- যা
আল্লাহ অপছন্দ করেন।
আসলে ভেতরের বিদ্রোহী যদি অনুগত না হয়, তাহলে
মানুষের দেশত্যাগ করা খোদার নিকটে একেবারে মূল্যহীন। অতএব ইসলামী আন্দোলন যাঁরা করেন, তাঁদের বাইরের শক্তির বিরুদ্ধে
সংগ্রামের পূর্বে ভেতরের বিদ্রোহী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। পারিভাষিক কাফেরকে মুসলমান বানাবার পূর্বে আপন নফসকে
মুসলমান বানাতে হবে। নবী করীম সা.-এর একটি
হাদীসের আলোকে কথাটি এভাবে বলা যায়; নিজেকে সেই ঘোড়াটির মতো বানিয়ে
নিন, যে একটি রশি দিয়ে একটা খুঁটির সাথে বাঁধা আছে। সে যতোই ঘুরাফেরা করুক, সে সেই সীমারেখা অতিক্রম করতে পারে না রশি যতটুকু তাকে যেতে
দেয়। এ ঘোড়াটির অবস্থা একটি রশিমুক্ত স্বাধীন
ঘোড়া অপেক্ষা ভিন্নতর হয়ে থাকে।
স্বাধীন ঘোড়াটি যেখানে খুশী সেখানে বিচরণ করতে পারে এবং যা খুশী তাই খেতে পারে। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে স্বাধীন ঘোড়াটির মতো না হয়ে
খুঁটিতে বাঁধা ঘোড়াটির মতোই হতে হবে।
৩। ফানা ফিল ইসলাম হয়ে যাওয়া
প্রকৃত দাওয়াত ও তাবলীগ হচ্ছে এই যে, আপনি
আপনার দাওয়াতের মূর্ত বহিঃপ্রকাশ ও নমুনা বিশেষ। এ নমুনা যেখানেই মানুষের চোখে পড়বে, তারা আপনার কাজের ধরন থেকেই বুঝে
নেবে যে, এ একজন খোদার পথের পথিক। আপনি
নিজেকে এমনভাবে ফানা ফিল ইসলাম করুন যাতে আপনি যার সামনেই আসুন ইসলামী আন্দোলনের
পূর্ণ চিত্র যেন পরিস্ফুট হয়ে পড়ে। নবী
করীম সা. এটাকে এভাবে বলেছেন, এদের সাথে দেখা হলেই আল্লাহর ইয়াদ আসবে, আল্লাহর
কথাই মনে পড়বে।
এ অবস্থা আপনার হঠাৎ বা অল্পদিনে হবে না। এ মর্যাদা ক্রমান্বয়ে হাসিল করা যেতে পারে। এ পথে বহু কুরবানী ও অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। এভাবে সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকলেই এক সময়ে আপনার মধ্যে
ফানা ফিল ইসলামের অবস্থা সৃষ্টি হবে। তখন
আপনি দাওয়াতের মূর্ত প্রতীক হতে পারবেন।
এর জন্যে কুরআন-হাদীস অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে
পড়াশুনা করতে হবে। তারপর দেখবেন, ইসলাম কোন্ ধরনের মানুষ চায়, নবী
করীম সা. কোন ধরনের মানুষ তৈরী করতেন। কোন
ধরনের গুণাবলী ছিল যা এ আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে প্রথম পয়দা করা হয়। কোন ধরনের গুণাবলী অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তৈরী করা এবং
কোনগুলো তার পরে। কোন গুণাবলী কোন স্তরের জন্যে কাঙ্ক্ষিত ছিল
এবং কি পরিমাণে তা উন্নীত করা হয়েছিল। অতঃপর
কোন স্তরে তা পৌঁছার পর আল্লাহ তাআলা এ জামায়াতকে সম্বোধন করে বলেন, এখন
তোমরাই দুনিয়ার সর্বোৎকৃষ্ট দল হয়ে পড়েছ। তোমরা
এমন যোগ্যতা লাভ করেছ যে,
তোমরাই মানব জাতির ইসলাহ্ করতে পার। স্বয়ং আপনাদের প্রস্তুতির জন্যে এ নমুনা সামনে থাকা উচিত। এখন আমি নবী পাকের সা. একটি হাদীস উল্লেখ করে এ প্রসঙ্গ
শেষ করতে চাই।
أمَرَنِي
رَبِّي بِتِسْع (۱) خَشْيَةُ اللَّهِ فِي السِّرِّ وَالْعَلَانِيَة (۲) كَلِمَةُ
الْعَدْلِ فِي الْغَضَبِ والرِّضَا (۳) الْقَصْدُ فِي الْفَقْرِ والغِنى، (٤) وأن
أصل من قطعني، (٥) وأعطي من حرمني، (٦) وَاعْفُو مَنْ ظَلَمَنِي (۷) وَأَنْ
يَكُونَ صَمْتِي فِكْرًا (۸) وَنُطْقِى ذكرًا (٩) وَنَظري عبرة
১। গোপন
প্রকাশ্য সকল অবস্থায় যেন আল্লাহকে ভয় করে চলি। খোদাভীতি ও আখেরাতে জবাবদিহির অনুভূতি- এ দু'টি ব্যতীত ইসলামী চরিত্র তৈরী, নেক আমল
করা এবং সকল প্রকার পাপাচার থেকে দূরে থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়।
২। কারো
প্রতি সদয় থাকি অথবা ক্রুদ্ধ সকল অবস্থায় ইনসাফ যেন কায়েম করি।
৩।
দারিদ্র অথবা আর্থিক সাচ্ছল্য উভয় অবস্থায় যেন সততা ও ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে
পারি।
৪। যে
আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে তার সাথে যেন সম্পর্ক স্থাপন করি।
৫। যে
আমাকে বঞ্চিত করবে তাকে যেন দান করি।
৬। কেউ
আমার উপর জুলুম করলে তাকে যেন মাফ করে দিই।
৭। আমার
নীরবতা যেন সৎ চিন্তায় পরিণত হয়।
৮। আমার
কথায় যেন আল্লাহর স্মরণ হয়।
৯। আমার
দৃষ্টি যেন হয় শিক্ষণীয়
এসব কাঙ্ক্ষিত গুণাবলীর উল্লেখ করার পর নবী সা.
বলেন, আমাকে হুকুম করা হলো আমি যেন আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকারের কাজ করি। এর থেকে জানা যায় যে, নেক কাজের প্রচার ও প্রসার এবং
অন্যায় অত্যাচারের অবসানের জন্যে যে উম্মতে ওয়াসাতের উত্থান, তার
প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে এ গুণাবলী অপরিহার্য। এসব গুণাবলীর মাধ্যমেই উপরিউক্ত মহান দায়িত্ব পালন করা সম্ভব : এ গুণাবলীর
অভাবে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীগণও তাদের দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবে না।
মনে রাখতে হবে উপরিউক্ত ন'টি আদেশ
নবীকে সা. করা হলেও তা প্রকৃতপক্ষে করা হয়েছে আমদেরকে। আল্লাহ চান যে,
আমরা যেন এ হুকুমগুলো যথাযথ পালন করে তাঁর প্রিয় বান্দাহ
হতে পারি।
(দ্রঃ হিকমতে মওদূদী- তর্জুমানুল কুরআন, অক্টোবর, ১৯৯২)
গুণাবলী অর্জনের উপায় কি?
এই যে সব নেক আমল, যে সবের
কথা কুরআন-হাদীসে উল্লেখ আছে, এই যে কর্মীদের চারিত্রিক মান ও গুণাবলী, এই যে
খোদাভীতি ও আখেরাতে জবাবদিহির অনুভূতি, এই যে খোদার পথে জীবন বিলিয়ে
দেয়ার অভিলাষ- এগুলো অর্জনের উপায় কি? খোদা কি শুধু এ সরে হুকুমই
দিয়েছেন, না কোন সহজসাধ্য পন্থা-পদ্ধতি বলে দিয়েছেন?
সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.)- যাঁর ফেলে
যাওয়া আন্দোলনেরই আমরা হাল ধরে রাখার চেষ্টা করছি। তিনি বলেছেন :
জীবনের সর্বক্ষণ নিজেকে খোদার বান্দাহ বলে
মনে করা, অনুগত গোলামের ন্যায় মালিকের অধীন হয়ে থাকা এবং মালিকের হুকুম পালনের জন্যে
সর্বদা প্রস্তুত থাকার নামই ইবাদত। আর
নামায মানুষকে এ ইবাদতের জন্যেই প্রস্তুত করে। এরূপ ইবাদতের জন্যে মানুষের মধ্যে যতগুলো গুণের দরকার, নামায
তার সবই মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে। দাস
হওয়ার অনুভূতি,
খোদা, তাঁর রাসূল ও তাঁর কিতাবের প্রতি ঈমান, আখেরাতের
প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস,
খোদাভীতি, খোদাকে আলিমুল গায়েব বলে স্বীকার করা, তাঁকে
সব সময় নিজের নিকটে অনুভব করা, খোদার হুকুম পালনের জন্যে সর্বদা নিজেকে প্রস্তুত রাখা, খোদার
হুকুমগুলো ভালো করে জানা- নামায এসব এবং এ ধরনের বহু গুণই মানুষের মধ্যে সৃষ্টি
করে এবং তাকে খোদার খাঁটি বান্দাহ রূপে গড়ে তোলে।
এখন জানা গেল, নামাযই সর্বোত্তম ইবাদত যা
নামাযীর মধ্যে সকল বাঞ্ছিত গুণাবলী সৃষ্টি করে। নামাযই মানুষকে খোদার নৈকট্যলাভের সুযোগ করে দেয়।
আল্লাহ বলেন : এবং সিজদা কর ও খোদার
নিকটবর্তী হয়ে যাও। (আলাক : ১৯)।
হাদীসে আছে- বান্দাহ ঐ সময়ে তার খোদার
সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়,
যখন সে খোদার সামনে সিজদায় থাকে (মুসলিম)। আকায়েদের ব্যাপারে যেমন খোদার সত্তা ও গুণাবলীর উপর ঈমান
গোটা দীনের উৎস,
তেমনি আমলের ব্যাপারে নামায হচ্ছে গোটা দীনের আমলের ভিত্তি। এটাই কারণ যে কুরআন পাকে সকল ইবাদতের মধ্যে নামাযের
সবচেয়ে বেশী তাকীদ করা হয়েছে। তা
কায়েম করা উপর এতো জোর দেয়া হয়েছে যে, তার উপরেই যেন গোটা দীন
নির্ভরশীল। এখন দেখা যাক নামায কিভাবে সে মহৎ গুণাবলী
সৃষ্টি করে।
নামাযের আকার-আকৃতি
নামায সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ
এখানে নেই। তার কিছু মৌলিক বিষয়ের উপর সংক্ষেপে
আলোকপাত করতে চাই। প্রথমে নামাযের আকার-আকৃতির প্রতি একবার
দৃষ্টি দেয়া যাক।
নামাযের জন্য যখন বান্দাহ দাঁড়িয়ে যায়-
তখন সে বিনয় নম্রতা ও আনুগত্যের এক মূর্ত ছবি হয়ে দাঁড়ায়। দেখা যায় যে,
হাতের উপর হাত বেঁধে দৃষ্টি নিম্নমুখী করে, ঘাড় নত
করে, পা দু'টি সমানভাবে কেবলামুখী করে, ডান-বাম ও অগ্র-পশ্চাৎ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনে সিজদার
স্থানে নিবদ্ধ করে। সে গাম্ভীর্য ও নীরবতার এক চিত্র, আদব ও
শিষ্টাচারের এক মূর্ত প্রতীক। কখনো
আপন স্ৰষ্টা ও মালিকের সামনে মস্তক অবনত করে, কখনো নাক ও কপাল মাটিতে রাখে, কখনো
হাত তুলে তাঁর কাছে দোয়া ও কাকুতি-মিনতি করে। মোটকথা, বিনয় ও দীনতা-হীনতার যতো বহিঃপ্রকাশ হতে পারে তা তার মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। এভাবে একজন নামাযীর যে চিত্র দৃষ্টিগোচর হয়, তা
সুস্পষ্টভাবে এ সাক্ষ্য দেয় যে, বান্দাহ তার মালিক ও মনিবকে দেখতে পাচ্ছে। আর দেখতে না পেলেও এ বিশ্বাস তার অবশ্যই হয় যে, তার
মনিব তাকে দেখছে। এটাই হলো সেই নামায যাকে বলে ইহসানের নামায। এ নামায ফেকার নামায থেকে এক ভিন্ন মেযাজ-প্রকৃতির হয়। তাকিয়ায়ে নফস্ ইহসান ও হাকীকী তাসাওউফের দৃষ্টিকোণ থেকে
নির্ভরযোগ্য নামায এ ধরনেরই হয়ে থাকে।
নামাযের দু'টি রূপ আছে। একটি জাহিরী, অন্যটি বাতিনী। এ নামায নামাযীর বাতিনীর ই বহিঃপ্রকাশ। এ নামাযে নামাযীর মনের বিনয় নম্রতাও প্রকাশ পায়। এতে খোদার সামনে বান্দাহর কোমরই শুধু ঝুঁকে পড়ে না, তার
দিলও ঝুঁকে পড়ে। শুধু তার কপালই ধূলোমলিন
হয় না, বরঞ্চ তার রূহ পর্যন্ত সিজদারত হয়। যে
নামাযের মেযাজ-প্রকৃতি ও ধরন এমন হয় না, যে নামাযের সাথে মন ও দিল
খোদামুখী হয় না,
জাহির ও বাতিন একাত্ম ও একীভূত হয় না, সে
নামাযকে সত্যিকার নামায বলা যায় না। তা হতে
পারে নিফাকের নামায রেমী ও গতানুগতিক অথবা রিয়া বা প্রদর্শনীমূলক। নামায ঠিক নামাযের মতো না হওয়ার কারণেই তো সামগ্রিকভাবে
নামাযের ঘেঘাষিত সুফলগুলো থেকে আমরা বঞ্চিত রয়ে যাচ্ছি।
নামাযের দোয়া
এখন একবার নামাযের দোয়াগুলোর প্রতি এক নজর
দেয়া যাক।
নামাযের সূচনা হয় ইবরাহীমী দোয়ার মাধ্যমে। অর্থাৎ সাইয়েদুনা হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর দোয়ার মাধ্যমে।
إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ
السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا ۖ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ
বান্দাহ এ দোয়ার মাধ্যমে সকল গায়রুল্লাহর
সম্পর্ক ছিন্ন করে একেবারে একমুখী হয়ে তার রবের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সংকল্প
ঘোষণা করে। এ দোয়ার মাধ্যমে সে তার একমাত্র খোদার
খোদায়ীতে আসমান ও যমীনের কারো অংশীদারিত্ব স্বীকার করে না। বরঞ্চ দৃঢ় সংকল্পসহ শিরক্ থেকে তার সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা করে এবং
একনিষ্ঠ মুসলিম হওয়ার সাক্ষ্য দান করে। এ
দোয়া বা কালেমা একটি কালেমা মাত্র নয়। বরঞ্চ
এর পেছনে রয়েছে সাইয়েদুনা হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালামের সত্য ঘোষণার এক
স্মরণীয় দীর্ঘ ইতিহাস।
এ স্মরণীয় কালেমা মুখে উচ্চারণ করার পর
বান্দাহ যখন নামাযে প্রবেশ করে, তখন এর মহান অর্থ ও ইতিহাস তার রূকে ইবরাহীমী নিষ্ঠা ও
সততার সাথে একাত্ম করে দেয়। সে
অনুভব করে যে, সে একজন মুসল্লী মাত্র নয়। বরঞ্চ
খোদার এক সিপাহী সৈনিক। সে তার রবের সামনে একজন
বিশ্বস্ত অনুগত বান্দাহ হওয়ার শপথ করে। শুধু
তাই নয়, বরঞ্চ দুনিয়ার সকল বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তাঁর পথে সকল কিছু কুরবান করার সংকল্পও ঘোষণা করে। তারপর হস্তদ্বয় উত্তোলন করে প্রকাশ্যে খোদার শ্রেষ্ঠত্ব
ঘোষণা করে।
অতঃপর সে সূরায়ে ফাতিহা পড়া শুরু করে। এ এমন এক দোয়া, যার চেয়ে উৎকৃষ্ট দোয়া আসমান ও
যমীনে আর কিছু নেই। এ দোয়া স্বয়ং খোদার শিখানো
দোয়া। এতে বান্দাহ্ যে পদ্ধতিতে তার রবের কাছে
চায় তার চেয়ে উৎকৃষ্টতর পদ্ধতির ধারণাই করা যেতে পারে না। যা সে চায় তার চেয়ে আর কিছু চাওয়ার থাকতেও পারে না। খোদা স্বয়ং বলে দিয়েছেন যে, তাঁর কাছে চাওয়ার পদ্ধতিটা কি। তিনি এ কথাও বলে দিয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে চাওয়ার বস্তু কি। যখন চাওয়ার ভূমিকাও হয় সঠিক এবং যা চাওয়া হচ্ছে তাও যদি
হয় চাওয়ার, যাঁর কাছে চাওয়া হচ্ছে, চাওয়া যদি শুধু একমাত্র তাঁর কাছেই হয়, চাওয়ার
পাওয়া যাঁর কাছে আশা করা যায়, তিনি যদি সকল দয়ালু থেকে দয়াময় হন, তাহলে
দোয়া কবুল হওয়া সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে কি?
নবী করীম সা. বলেছেন, বান্দাহ
যখন এ দোয়া পড়ে বা করে,
তখন দয়াময় খোদা এক একটি শব্দকে কিভাবে কবুল করে নেন। হাদীসটি নিম্নরূপ: হযরত আবু হুরায়রাহ রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী সা. বলেছেন, আল্লাহ
তাআলা ইরশাদ করেন,
আমি নামাযের এ দোয়াকে আমার এবং বান্দাহর মধ্যে ভাগ করে
দিয়েছি। এর অর্ধেক আমার, অর্ধেক
আমার বান্দাহর। বান্দাহ যা কিছু চায়, তা সে
পেয়ে যায়। যখন বান্দাহ الْحَمْدُ
لِلَّهِ رَبِّ
الْعَالَمِينَ বলে, তখন
আল্লাহ বলেন, আমার বান্দাহ আমার শুকরিয়া আদায় করলো। যখন বান্দাহ
الرَّحْمَٰنِ
الرَّحِيمِ বলে, তখন আল্লাহ বলেন,
আমার বান্দাহ আমার প্রশংসা করলো। যখন সে مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ বলে,
তখন আল্লাহ বলেন, বান্দাহ আমার শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা
করলো। যখন সে বলে, إِيَّاكَ
نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ তখন আল্লাহ বলেন, এ অংশটি আমার ও আমার বান্দাহর
সমান সমান। আমি আমার বান্দাহকে ওসব কিছুই দিলাম, যা সে
চেয়েছে।
তারপর বান্দাহ যখন বলে, ٱهْدِنَا ٱلصِّرَٰطَ ٱلْمُسْتَقِيمَ، صِرَٰطَ
ٱلَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ ٱلْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا
ٱلضَّآلِّينَ তখন আল্লাহ বলেন, এ আমার বান্দাহর অংশ। সে যা কিছু চেয়েছে তা আমি তাকে দিলাম। (মুসলিম)
নামাযী যখন এ দোয়া নামাযের মধ্যে পড়ে, তখন
সঙ্গে সঙ্গে এ ধারণা করতে থাকে যে, তার এক একটি শব্দকে দুনিয়ার
বাদশাহ রাব্বুল আলামীন কিভাবে কবুল করে নিচ্ছেন, তখন তার রূহ আনন্দে গদগদ হয়ে
পড়ে। তার দোয়ার এক একটি শব্দ তার কাছে
মণি-মুক্তার চেয়েও মূল্যবান মনে হয়।
সূরা ফাতিহা থেকে সালাম ফিরে নামায শেষ করা
পর্যন্ত আরও বহু কিছু বলার আছে। ফাতিহার পর কুরআনের কিছু অংশ বা কোন গোটা সূরা পড়তে হয়। তারপর রুকু-সিজদা আছে। কাওমা ও জাশ আছে,
দু'রাকায়াতের পর তাশাহ্হুদ আছে। এ সবের
প্রতিটি মুহূর্তে নামাযীর দিলের এক বিশেষ অবস্থা সৃষ্টি হওয়া দরকার। দাঁড়িয়ে, বসে, রুকু-সিজদায়
কি পড়ছে তার অর্থের দিকে খেয়াল করে তার বাস্তব প্রতিফলন দিলে ও দেহে হওয়া দরকার। বিশেষ করে সিজদায় বান্দাহ তার মনীবের নৈকট্য লাভ করে। এ ধারণা ও বিশ্বাসের পর সিজদায় খোদার নৈকট্যের একটা
আস্বাদ উপভোগ ও পরম মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে পারে।
সূরা ফাতিহার পর বান্দাহ্ কুরআন পাকের কোন
সূরা অথবা তার কোন অংশ পড়ে। কুরআন
পাকের যে কোন অংশই পড়া হোক না কেন, এ কিতাবের অলৌকিক বৈশিষ্ট্য এই
যে, তার প্রত্যেক অংশে প্রকৃত সেই জিনিসই পাওয়া যায়- যার শিক্ষা ও দাওয়াতের
জন্যে কুরআন নাযিল হয়েছে। খোদার
সঠিক প্রশংসা, জীবন যাপনের সঠিক পন্থা, আখেরাতের বিবরণ, পুরস্কার ও শাস্তির উল্লেখ
প্রত্যেক অংশেই পাওয়া যায়।
প্রকাশভঙ্গী শুধু ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। কোথাও
বলা হয়েছে আইনের আকারে। কোথাও উপদেশ-নসিহত
হিসাবে, কোথাও গল্প ও কাহিনীস্বরূপ এবং কোথাও উপমা-উদাহরণস্বরূপ। কোথাও ধমকের সুরে,
কোথাও দরদ ও ভালোবাসার ভঙ্গীতে। কিন্তু এটা সম্ভব নয় যে, কুরআনের কোন অংশ পাঠ অথবা শ্রবণ করা হবে (তা তিন আয়াত
পরিমাণেই হোক না কেন) আর ব্যক্তির সামনে ফলপ্রসূ ও হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গীতে সেই
মর্মকথা তুলে ধরা হবে না,
যা তার জীবনের দিক ও লক্ষ্য সঠিক রাখার জন্যে জরুরী। তারপর রুকু ও সিজদার তসবিহগুলো পাঠ করতে হয়। এসব তসবিহতে বান্দাহ আপন প্রভুর সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে
পাক-পবিত্র থাকা এবং সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার স্বীকৃতি দান করে। এ স্বীকৃতি প্রকাশ সে এভাবে করে যে, প্রথমে সে মাটির দিকে দীনহীনভাবে
মাথাসহ তার দেহের উপরিভাগ অবনত করে (রুকু) তার মনীবের আনুগত্য প্রকাশ করে। অতঃপর কপাল ও নাক অর্থাৎ মাথা মাটিতে রাখে। যেন মনীবের দরগাহের চৌকাঠে তার মাথা রেখে নিজেকে তাঁর
মর্জির উপরে পুরোপুরি সঁপে দেয়। ইবাদত
ও আনুগত্যের এর চেয়ে উত্তম বহিঃপ্রকাশ আর কি হতে পারে?
সমগ্র নামাযের আলোচনা না করে সূরা ফাতিহা পাঠ
পর্যন্ত আলোচনা সীমিত রাখছি। কারণ
সূরা ফাতিহা হচ্ছে নামাযের রূহ্। আমার
মনে হয় সূরা ফাতিহা পর্যন্ত দোয়া ও নামায তার প্রকৃত মর্মসহ সঠিকভাবে আদায় হয়ে
গেলে, গোটা নামাযের হক আদায় করা সহজ হয়ে যাবে।
এখন প্রশ্ন এই যে, নামায
সম্পর্কে যতোটুকুই বলা হলো,
আমরা কি তার হক আদায় করতে পারছি। এ আত্মসমালোচনা আমাদের প্রত্যেকের হওয়া উচিত। কারণ নামাযই যদি আমাদের ঠিক না হলো তাহলে আর এমন কি নেক আমল আছে, যা
নিয়ে আখেরাতে আমরা নাজাত পেতে পারি? আন্দোলনের কর্মীদের কাঙ্ক্ষিত
গুণাবলী ও মান, জান ও মাল কুরবানীর প্রেরণা, আল্লাহর হক আদায়ের সাথে বান্দাহরও হক আদায় করা, আমানতদারী
ও ইনসাফ কায়েম করা,
প্রতি মুহূর্তে খোদার ভয় ও আখেরাতের জবাবদিহির অনুভূতি- এ
সমুদয় গুণাবলী তো নামাযই সৃষ্টি করে।
তারপর প্রশ্ন হলো, নামাযের
যে সঠিক রূপটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি তা ঠিক ঠিক আদায় করা কি কোন সহজ কাজ, না কঠিন? সত্যিকার
নামায যে বড়ো কঠিন জিনিস,
যে ধরনের নামায আল্লাহর নিকট প্রিয় তা যে বড়ো কঠিন এ কথা তো আল্লাহ স্বয়ং বলেছেনঃ
وَإِنَّهَا
لَكَبِيرَةُ الأَ عَلَى الْخَاشِعِينَ الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُمْ مُلْقُوا رَبِّهِمْ
وَأَنَّهُمْ إِلَيْهِ رَاجِعُونَ
নামায অবশ্যই বড়ো কঠিন জিনিস। কিন্তু তাদের জন্যে নয়, যারা আল্লাহর বিনীত ও অনুগত
বান্দাহ। তারা মনে করে তাদের রবের কাছে ফিরে গিয়ে
মিলিত হতে হবে।
এ নামায কঠিন তাদের জন্যেও যারা বড্ডো
তাড়াহুড়া করে নামায পড়ে। মসজিদে
যাদের মন বেশীক্ষণ থাকতে চায় না। তাই
তারা ঝপট্ উঠাবসা করে সকলের আগেই মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। মসজিদ যেন তাদের একটা কয়েদখানা। অথচ নবী সা. বলেন,
সে ব্যক্তির স্থান আল্লাহর আরশের ছায়ার নীচে হবে, যার মন
সর্বদা মসজিদে লেগে থাকে। (বুখারী)
অর্থাৎ কোন সময়ই মসজিদের চিন্তা তার মন থেকে
দূর হয় না। এক ওয়াক্ত নামায আদায়ের পর অধীর আগ্রহে
দ্বিতীয় ওয়াক্তের অপেক্ষা করতে থাকে। এ
প্রসঙ্গে আর একটা কথা এই যে, নামায যেমন আল্লাহর কাছে অতি প্রিয়। ঠিক শয়তানের কাছে ততো বেশী অসহনীয়। তাই সে
নামাযীর মনে নানান ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি করতে চায়। সে নামাযীর মনকে নামায থেকে হাটে-বাজারে, মাঠে-ময়দানে, বনে-বাদাড়ে
টেনে নিয়ে যেতে চায়। যে নামাযের হক আদায়
করতে চায় তাকে শয়তানের সকল ওয়াসওয়াসা বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। প্রতি মুহূর্তে তাকে মনে করতে হবে আল্লাহ তাকে দেখছেন। শুধু তার বাইরেটাই দেখছেন না ভেতরটাও দেখছেন। তার মনটা কোথায় আছে তাও দেখছেন। অতএব মনটা যেখানেই থাক সেখান থেকে টেনে নামাযে আনতে হবে। নামাযের রুকু-সিজদায় পঠিতব্য প্রত্যেকটি শব্দের অর্থের দিকে খেয়াল করে পড়তে হবে।
এ ধরনের নামায হঠাৎ একদিন দু'দিনে হবে না। এর জন্যে ক্রমাগত চেষ্টা-সাধনা করতে হবে। ধৈর্য, সময় ও শ্রম দিতে হবে। সীরাতুন্নবী, সীরাতে সাহাবা পাঠ করে জানতে হবে কিভাবে তারা নামায পড়তেন। আল্লাহর পথে সংগ্রামকারীগণ কিভাবে নামায পড়তেন। তাঁরা শুধু ফরয নামাযই পড়তেন না, নিয়মিত নফলও পড়তেন। বিশেষ করে তাহাজ্জুদ নামাযে তাঁরা চোখের পানিতে জায়নামায সিক্ত করতেন। আমাদেরও সেই অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
সংকল্প গ্রহণ
আমাদেরকে প্রথমে আল্লাহর নেক ও প্রিয়
বান্দাহ হওয়ার দৃঢ় সংকল্প করতে হবে। অতঃপর
এ উদ্দেশ্যে প্রাণ-পণ চেষ্টা-চরিত্র, শ্রম ও সাধনা করতে হবে। একটি ছাত্র ভালো হওয়ার দৃঢ়সংকল্প হৃদয়ে পোষণ করে। কি করে সে ক্লাসে পরীক্ষায় প্রথম হবে। কি করে বৃত্তিধারী হবে, কি করে সে বোর্ড বা
ইউনিভার্সিটিতে ভালো স্থান লাভ করবে এ চিন্ত'য় সে সর্বদা বিভোর থাকে। তদনুযায়ী সে কঠোর পরিশ্রম ও চেষ্টা-সাধনা করে সাফল্য লাভ
করে। ঠিক তেমনি আমাদেরকে প্রথমে আল্লাহর নেক ও
প্রিয় বান্দাহ হওয়ার দৃঢ়-সংকল্প করতে হবে। তারপর আল্লাহ ও রাসূলের বলে দেয়া পন্থায় কঠোর পরিশ্রম ও চেষ্টা-সাধনা করতে
হবে। প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর মদদও চাইতে হবে
একান্ত মনে। ভালো হওয়ার সবচেয়ে ফলপ্রসূ পন্থা যেহেতু
নামাযকে বলা হয়েছে,
সে জন্যে সর্বপ্রথম নামাযকে নামাযের মতো করে আদায় করতে হবে। তা যদি করতে পারি, তাহলেই একজন আন্দোলনের কর্মী, একজন
মুজাহিদের কাঙ্ক্ষিত গুণাবলী ও মান অর্জন করা সম্ভব হবে। সাংগঠনিক মান,
নৈতিক ও আদর্শিক মান, ইলমী ও ফিকরী মান (বুদ্ধিবৃত্তিক
ও চিন্তাধারার মান) সবই অর্জন করা সম্ভব হবে।
সত্যিকার নামায ও তাঁর সৃষ্ট মহৎ গুণাবলীর
দ্বারা আমরা একদিকে যেমন আল্লাহর নিকটে মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হবো, অপরদিকে
সমাজের দীনদার ও ইসলাম-প্রিয় লোকও আমাদেরকে সম্মানের চোখে দেখবে। আমাদের নামায যদি আল্লাহর ফযলে রিয়া থেকে মুক্ত হয়ে ইহসানের
নামায হয়, তাহলে ইন্শাআল্লাহ আমাদের জামায়াত একটি দীনী জামায়াত হিসাবে পরিচিত লাভ করতে
পারবে। এ ব্যাপারে আমাদের উলামায়ে কিরামের
দায়িত্ব সর্বাধিক। আশা করি তাঁরাই অন্যান্যদের রাহনুমায়ী
করবেন- পথ-নির্দেশনা দেবেন।
মাওলানা মওদূদী রহ.ইসলামী বিপ্লবের সাফল্যের শর্তাবলীর মধ্যে একটি অন্যতম প্রধান শর্তের উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, সাফল্যের সকল শর্ত যদি পূরণ হয়, কিন্তু দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যদি ইসলামী শাসন মেনে নিতে রাযী না হয়, তাহলে আল্লাহ তায়ালা জবরদস্তি করে তাদের উপর খোদায়ী শাসন চাপিয়ে দেবেন না। নবীগণের ইতিহাস তার সাক্ষী।
ব্যাপক জনমত সৃষ্টি
আমাদের গঠনমূলক কাজের সাথে সাথে ব্যাপক জনমত
সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যাপক দাওয়াতী কাজ সর্বশক্তি দিয়ে করতে হবে। এ বিষয়ে মাওলানা মওদূদী জামায়াত গঠনের সূচনা লগ্নেই
বলেছিলেন-
আমাদের গঠনমূলক সকল চেষ্টা-সাধনা ব্যর্থ হয়ে
যাবে, যদি তার পেছনে মযবুত জনমত সৃষ্টি না হয়। গঠনমূলক কাজ ব্যতীত যেমন কোন ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে না, তেমনি
বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইসলামী দাওয়াতের প্রচার ও প্রসার ব্যতীত এ ধরনের কোন
বিপ্লব সম্ভব নয়।
শুধু এদেশেই নয় বরঞ্চ সাধ্যমত দুনিয়ার
সর্বত্র আমাদেরকে আমাদের দাওয়াত পৌঁছাতে হবে। কারণ কোন একটি দেশে সত্যিকার বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে না যতোক্ষণ না ব্যাপক
আকারে বিশ্ব জনমত তার সপক্ষে গঠন করা গেছে। কোটি
কোটি মানুষকে আমাদের পয়গামের সাথে পরিচিত হতে হবে। কোটি কোটি মানুষকে অন্ততপক্ষে এতো পরিমাণে প্রভাবিত হতে হবে যে, যার
জন্যে আমরা সংগ্রাম করছি তাকে যেন তারা সত্য বলে মেনে নেয়। লক্ষ লক্ষ মানুষকে আমাদের নৈতিক ও বাস্তব সাহায্য-সহযোগিতার জন্যে এগিয়ে
আসতে হবে। সেই সাথে বিরাট সংখ্যক এমন নিবেদিতপ্রাণ
কর্মী তৈরী হতে হবে যারা উৎকৃষ্টতম চরিত্রের অধিকারী হবে এবং এ মহান উদ্দেশ্যের
জন্যে কোন ভয়-ভীতি,
আশঙ্কা, ক্ষতি ও বিপদ-আপদ বরদাশত করতে কুণ্ঠিত হবে না। (কার্য বিবরণী, ১ম খণ্ড )
উপরের আলোচনায় এ কথা সুস্পষ্ট যে, ইসলামী বিপ্লবের সপক্ষে দেশে ও বিদেশে বলিষ্ঠ জনমত সৃষ্টি নির্ভর করে ব্যাপক দাওয়াতী কাজের উপর। অতএব আমাদের জামায়াত যদি জনগণের কাছে একটি দীনী জামায়াত হিসাবে পরিচিত হয়, আমাদের আমল-আখলাক যদি মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে, আমাদের দাওয়াত যদি সর্বস্তরে ব্যাপকতর করতে পারি এবং দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যদি ইসলামী শাসনের সপক্ষে আন্তরিকতার পরিচয় দেয়, তাহলে ইসলামী বিপ্লবকে কেউ রুখতে পারবে না।
অশ্লীলতা ও সকল অনাচার-পাপাচার
থেকে দূরে থাকা
নামায শুধু মহৎ গুণাবলী অর্জনেই সাহায্য করে
না, বরঞ্চ সকল অশ্লীলতা,
পাপাচার-অনাচার থেকে নামাযীকে দূরে রাখে। সেই সাথে মানুষের সকল মানসিক ব্যাধিও নিরাময় করে। যেমন গর্ব, অহঙ্কার, ঔদ্ধত্য, পারস্পরিক
মনোমালিন্য, হিংসা-বিদ্বেষ,
গীবত, পরচর্চা, পরনিন্দা, পদমর্যাদার লোভ-লালসা প্রভৃতি।
নামায যেহেতু হরহামেশা অন্তরে খোদাভীতি
জাগ্রত রাখে, সেজন্যে জুলুম,
বেইনসাফী, অপরের হক নষ্ট করা, আমানত- খেয়ানত প্রভৃতি থেকেও
দূরে থাকতে সাহায্য করে।
আমার মতে চারিত্রিক মানদণ্ড হচ্ছে প্রধানত
আর্থিক লেনদেন। যার অর্থিক লেনদেন যতো ভালো, সে ততো
চরিত্রবান। পক্ষান্তরে লেনদেন ভালো না হলে তাকে
চরিত্রবান বলা যায় না।
আমাদের অনেকের কাছে Public Fund - জনগণের অর্থ বা বায়তুল মাল আমানত
থাকে। এ আমানতের পুরোপুরি হিফাযত ঈমানেরই দাবী। হিফাযত না করা অথবা আমানত খিয়ানত করা যে কত বড়ো গুনাহ
এবং তার পরিণাম যে কত ভয়াবহ তা মনে হলে শরীর রোমাঞ্চিত হয়।
এ সম্পর্কে একটি হাদীসের উল্লেখ করতে চাই :
عَنْ ابْنِ عُمَرَ رَضــ قَالَ لَمَّا كَانَ يَوْمُ خَيْبَرَ أَقْبَلَ نَفَرُّ مِنْ صَحَابَة النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- فَقَالُوا فَلاَنَّ شَهِيدٌ فَلاَنَّ شَهِيدٌ حَتَّى مَرُّوا عَلَى رَجُلٍ فَقَالُوا فَلاَنَّ شَهِيدٌ فَقَالَ رَسُولُ الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَلا إنَّى رَأَيْتُهُ فِي النَّارِ في بُرْدَةِ غَلَّهَا أوْ عَبَاءَةِ ثُمَّ قَالَ رَسُولُ الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَا ابْنَ عُمَرَ اذْهَبَ فَنَادٍ فِى النَّاسِ إِنَّهُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ إلا الْمُؤْمِنُونَ - قَالَ فَخَرَجْتُ فَنَادَيْتُ إنَّهُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ إلا الْمُؤْمِنُونَ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, (খয়বর
যুদ্ধের দিনের ঘটনা। যুদ্ধে মুসলমানগণ বিজয়ী হয়েছেন। শত্রু ময়দান ছেড়ে
পালিয়েছে।) সাহাবীদের কয়েকজনসহ নবী সা. ময়দান ঘুরেফিরে দেখছেন। তাঁরা নবীকে
বললেন, অমুক অমুক শহীদ হয়েছে। অতঃপর তাঁরা সামনে অগ্রসর হওয়ার পর এক মৃত ব্যক্তিকে
দেখতে পেলেন। তাঁরা বললেন,
অমুক ব্যক্তিও শহীদ। নবী সা. বললেন, না, কখনো না। তাকে তো আমি জাহান্নামে দেখতে পেলাম। কারণ সে একটি চাদর অথবা কোর্তা চুরি করেছিল।
অতঃপর নবী সা. বলেন, হে ইবনে
উমর যাও এবং লোকের মধ্যে ঘোষণা করে দাও যে, মুমিন ছাড়া কেউ বেহেশতে প্রবেশ
করতে পারবে না। তিনি (ইবনে উমর রা.) বললেন, অতঃপর আমি বের হয়ে এ ঘোষণা
করলাম-মুমিন ব্যতীত কেউ বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। (মুসলিম) উল্লেখ্য- নবী সা.
অন্যত্র বলেছেন :لا إِيْمَانَ لِمَنْ لَا اَ مَا نَةَ لَهُ
যার
মধ্যে আমানতদারী নেই- তার ঈমান নেই।
এর থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা দরকার যে, ইসলামকে বিজয়ী করার আন্দোলন করতে গিয়ে আমানত খিয়ানত করে আমরা যেন জাহান্নামের পথ বেছে না নিই। একজন আল্লাহর দুশমনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে জীবন দিয়েও উপরিউক্ত ব্যক্তি জান্নাত লাভ করতে পারলেন না। কারণ তিনি মালে গনীমত বা আমানত খিয়ানত করেছিলেন। আমরা যদি খোদানাখাস্তা আমানত খিয়ানত করি, তারপর এ কারণ কি নাজাত পাব যে, ইসলামী আন্দোলন করেছিলাম? আল্লাহ আমাদেরকে এর থেকে রক্ষা করুন।
অতিরিক্ত কিছু গুণাবলী
ইসলামের বিজয়ের জন্যে আমাদের সাংগঠনিক, আদর্শিক, চারিত্রিক, ইলমি ও
ফিকরী মানের সাথে আরও কিছু গুণাবলী অপরিহার্য।
এক- প্রশাসনিক যোগ্যতা, দুর্নীতিমুক্ত
প্রশাসনিক যোগ্যতা। দুর্নীতিমুক্ত বিশেষণ যোগ করার অর্থ এই যে, প্রভূত
যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ দুর্নীতিপরায়ণ হয়, তাহলে সে যোগ্যতার সাথে দুর্নীতি
করতে পারে। তাই প্রয়োজন দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক
যোগ্যতা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, অফিসাদি
ও দেশ পরিচালনার বিশেষ যোগ্যতা আমাদের অবশ্যই অর্জন করতে হবে। যাদের মধ্যে দেশ পরিচালনার যোগ্যতা থাকে এবং অকল্যাণ থেকে কল্যাণ বেশী করতে
সক্ষম, আল্লাহ তায়ালা তাদের উপরেই এ দায়িত্ব অর্পণ করে থাকেন। তা তারা মুসলমান হোক অথবা অমুসলমান।
বর্তমান মুসলিম জাতির অযোগ্যতা ও অনৈক্যের কারণে সংখ্যায় একশ' কোটির
অধিক হওয়া সত্ত্বেও সারা দুনিয়ার কাছে তারা শুধু মারই খাচ্ছে।
দুই- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (SCIENCE & TECHNOLOGY)। আমাদেরকে এ দু'টি পুরোপুরি আয়ত্ত করতে হবে। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির Islamization বা ইসলামীকরণ করতে হবে। অর্থাৎ
এ দুটোকে মুসলমান বানাতে হবে। তাহলেই
মানবজাতির অশেষ কল্যাণ সাধিত হবে।
তিন- মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও আরও দু'টি
ভাষায়- 'আরবী ও ইংরেজীতে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কারণ
বিশ্বের কোন একটি দেশে ইসলামী বিপ্লব হবে না যদি তার সপক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টি না
হয়। এজন্যে যারা আরবী ভাষা জানেন, তাদেরকে
আরবী ভাষায় এবং যারা ইংরেজী ভাষা জানেন তাদেরকে ইংরেজী ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা
করার যোগ্যতা লাভ করতে হবে। তাহলে
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামের সপক্ষে বলিষ্ঠ জনমত গড়ে তোলা সম্ভব হবে। বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখলে হবে না, বিশেষ
গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।
এখন আমি মাওলানা মওদূদীর রহ.কিছু মূল্যবান
কথার উদ্ধৃতি পেশ করে আলোচ্য বিষয়টি শেষ করতে চাই।
ইসলামী আন্দোলনের বিজয়ের অপরিহার্য শর্তাবলী
সম্পর্কে বলতে গিয়ে মাওলানা বলেন-
ইসলামের নামে কোন দল যদি ক্ষমতা লাভ করে, অথচ সে
দলের নেতা-কর্মীদের ইসলামী চরিত্র পাকাপোক্ত হয়নি, তারপর যদি তারা খিয়ানতকারী
প্রমাণিত হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করে, ব্যক্তিস্বার্থ ও প্রবৃত্তির লালসা চরিতার্থ করার জন্যে
ইনসাফ ও আমানতের কবর রচনা করে, জাতীয় অর্থ আত্মসাৎ করা শুরু করে, নিজেকে
আইনের ঊর্ধ্বে মনে করে,
জাতীয় লাভের সাথে সাথে চারিত্রিক অধঃপতন শুরু হয়, তাহলে
চিরদিনের জন্যে এখানে ইসলাম বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যবে। শুধু এ দেশেই নয় সারা দুনিয়ার ইসলাম সম্পর্কে নৈরাশ্য
সৃষ্টি হবে।
এ জন্যে এটাকে আল্লাহর রহমত মনে করুন যে, তিনি
আপনাদেরকে ঈমান ও চরিত্রের দিক দিয়ে পাকাপোক্ত করার উদ্দেশ্যে অগ্নিপরীক্ষার ভেতর
দিয়ে অতিক্রম করাচ্ছেন এবং সময়ের পূর্বে আপনাদের উপরে দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে
দিচ্ছেন না। যখন আল্লাহ তায়ালা জানবেন যে, এখানে
এমন একটি জামায়াত তৈরী হয়েছে— যার মধ্যে খাঁটি সোনা পাওয়া যায় এবং খাদ থেকে
তারা পাক-পবিত্র হয়েছে,
যাদের আমানতদারী ও খোদাভীতি নির্ভরযোগ্য, যারা
গর্ব, অহংকার, ঔদ্ধত্য, আমিত্ব ও প্রবৃত্তির লালসা-বাসনা থেকে মুক্ত হয়েছে, যারা
নিজের শ্রেষ্ঠত্বের জন্যে নয় বরঞ্চ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর দীনের প্রাধান্য
প্রতিষ্ঠাই
চায়, তখন আল্লাহর ফযলে আশা করা যায় যে, তিনি
এমন পার্থিব সাফল্যও দান করবেন, যেমন তিনি তাদের পূর্বসূরীদের দান করেছেন। (দ্রঃ মজলিসে মওদূদীঃ এশিয়া মে-১৯৯২)।
আমরা যেন শেষোক্ত গুণাবলীতে আমাদেরকে ভূষিত
করতে পারি। আল্লাহ তাআলার কাছে এই আমাদের আকুল নিবেদন, এই
আমাদের আর
'আমাদের জীবনে আল্লাহর দীন বিজয়ী হবে এ নিশ্চয়তা তো কেউ দিতে পারে না। বিজয়ী হোক বা না হোক এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আমাদেরকে
দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমাদের
দুয়ারে হঠাৎ যখন মৃত্যু তার পরওয়ানা নিয়ে হাযির হবে, তখন
আমাদের নামায়ে আমলে যেন এতো পরিমাণে নেক আমল থাকে, যদ্দরুন মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে
আল্লাহর ফেরেশতাগণ যেন এ সুসংবাদ দেন-
وَأَبْشِرُوا
بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ
তোমাদেরকে যে জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছে তার সুসংবাদ গ্রহণ কর। আল্লাহ রহমানুর রহীম এ সৌভাগ্য যেন আমাদের দান করেন-আমীন।
উদ্বোধনী ভাষণ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম
শ্রদ্ধাভাজন দেশী-বিদেশী মেহমানবৃন্দ এবং
খোদার রাহে নিবেদিতপ্রাণ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর রুকন ভাই ও বোনেরা-
আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া
বারাকাতুহু।
সর্বপ্রথমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে জানাই লাখো লাখো শুকরিয়া, যিনি তাঁর খাস মেহেরবানীতে তিন দিনব্যাপী এ রুকন সম্মেলন অনুষ্ঠানের সুযোগ করে দিয়েছেন। অতঃপর তাঁর পিয়ারা হাবীব ও সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ মুস্তাফা সালাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর কোটি কোটি দরুদ ও সালাম, যাঁর পদাঙ্ক অনুসরণে আমাদের দেশে ও দুনিয়ার বুকে পুনরায় খিলাফত আলা মিনহাজিন্নাবুয়্যৎ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টার জন্যে আমরা জান ও মাল কুরবানীর শপথ গ্রহণ করেছি।
সম্মানিত সুধীবৃন্দ,
আজ আপনাদের খেদমতে আমার বক্তব্য পেশ করার আগে
আমাকে অত্যন্ত বেদনা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতে হচ্ছে যে, এ
উদ্বোধনী ভাষণ তো পেশ করার কথা জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর নির্বাচিত আমীর
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা অধ্যাপক
গোলাম আযমের। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তাঁকে
কারা প্রাচীরের অন্তরালে এক নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে বাধ্য করা হয়েছে। এর পটভূমিও আমাদের জেনে রাখা দরকার।
স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পর এ দেশে সকল
ইসলামী দল ও সকল প্রকার ইসলামী তৎপরতা সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ইসলামের গতিপথ রুদ্ধ করার শক্তি কারো ছিল না কোন
দিন। খোদার রাহে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ সংগ্রাম
করতে চাইলে তাঁরই মেহেরবানীতে সে পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। তাঁর খাস রহমতে খোদার পথের সৈনিকগণ ইসলামী আন্দোলনকে এদেশে জীবন্ত ও গতিশীল রাখতে সক্ষম হন। অতঃপর
১৯৭৯ সালের ২৫শে মে থেকে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর প্রকাশ্য সাংগঠনিক তৎপরতা
শুরু হয় এবং ক্রমশ তা শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। জামায়াতের গঠনতন্ত্রের দাবী অনুযায়ী ১৯৮৩, ১৯৮৬ ও ১৯৮৯ সালে তিন বছর পর পর জামায়াতের
ত্রিবার্ষিক রুকন সম্মেলন ঢাকা শহরে ও উপকণ্ঠে যথাযোগ্য মর্যাদা ও সাফল্যসহ
অনুষ্ঠিত হয়। এভাবে আন্দোলনের অগ্রগতি অব্যাহত থাকে।
জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনের
বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রায় ন'বছর যাবত আপোসহীন ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের ফলে জামায়াতে ইসলামী দেশে-বিদেশে
একটি শক্তিশালী দল হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। এ
কারণে জামায়াত দেশের ক্ষমতালোভী ও ইসলামবিমুখ রাজনৈতিক দলগুলোর ঈর্ষার বস্তু হয়ে
পড়ে। তারা সর্বদা চেষ্টা করতে থাকে জামায়াতের
অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করার। অতঃপর এরশাদ সাহেবের
পতনের পর জামায়াতেরই উত্থাপিত দাবী অনুযায়ী কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে '৯১-এর
ফেব্রুয়ারীতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে জামায়াত যদিও ১৮টি আসন লাভ করে তথাপি এ বিজয় স্বার্থান্ধ মহলকে
ভীত ও উদ্বিগ্ন করে তোলে। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে
৩৫টি আসন লাভ করে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের জন্যে
প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসন লাভ করতে ব্যর্থ হয়। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, জামায়াতের সমর্থনে বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগ-জাপা সরকার গঠন
করতে পারে। সকল দিক বিবেচনা করে জামায়াত জাতীয়
স্বার্থেই বিএনপিকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং বিএনপি সরকার গঠন করে। অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্বের সমস্যাটি পূর্ববর্তী সকল
সরকারই জিইয়ে রাখে। আমরা আশা করেছিলাম
এবারের বিএনপি সরকার কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ সমস্যাটির সমাধান করবেন। কিন্তু এ সরকার কৃতঘ্নতারই পরিচয় দিলেন।
ইতোমধ্যে বিশ্বপরিস্থিতির এক বিরাট পটপরিবর্তন
ঘটে। বিরাট বিশাল রাশিয়ার সোসালিস্ট রিপাবলিক
খণ্ড-বিখণ্ড ও ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং সেই সাথে কমিউনিজমও মৃত্যুবরণ করে। এর পেছনে যে অপরাজেয় শক্তি কাজ করে তা হলো আফগান
মুজাহেদীনের অপ্রতিহত জিহাদী প্রেরণা ও খোদার রাহে শাহাদাতের তামান্না-অভিলাষ। এ শুধু রাশিয়া ও কমিউনিজমের পরাজয়ই ত্বরান্বিত করেনি; বরঞ্চ
সারা দুনিয়ার ইসলামের এক নবজাগরণের জোয়ার সৃষ্টি করে। এতে ইসলাম বিরোধী শক্তি দারুণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। রাশিয়া ও কমিউনিজমের পতনের পর তারা একমাত্র প্রধান শক্তি মনে করে উল্লসিত
হয়- এবং তথাকথিত নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার শ্লোগান তোলে। এর বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করা না হলেও স্পষ্ট বুঝতে পারা যায় যে, সর্বত্র
উদীয়মান ইসলামী শক্তি নির্মূল করাই এ তথাকথিত নতুন বিশ্বব্যবস্থার লক্ষ্য। তার ফলে দেশে দেশে মুসলিম দলন শুরু হয়। আলজেরিয়া ও বসনিয়া এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
এদিকে বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের উজ্জ্বল
ভবিষ্যৎ ইসলাম বিরোধী মহলকে উদ্বিগ্ন তোলে। বাংলাদেশের
বিগত সাধারণ নির্বাচন আধিপত্যবাদী শক্তিকেও অনেকটা হতাশ করে। এ হতাশা দূর করার জন্যে তারা এক নতুন কৌশল গ্রহণ করে। তাদেরই পরিকল্পনায় হঠাৎ ঢাকা থেকে ডজনখানেক দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ লাভ করে। এসবের উদ্দেশ্য বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন ও তার নেতৃত্বের
বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বানোয়াট অপপ্রচারের এক বিরামহীন অভিযান শুরু করা। এসব প্রচারণার আর একটি উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট
করে আগ্রাসী ও আধিপত্যবাদী শক্তির জন্যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। একটি নির্বাচিত সরকারের উচিত ছিল এসব প্রচারণা বন্ধ করা। কিন্তু সরকার তার চরম দুর্বলতার কারণে এসব প্রচারণা বন্ধ
না করে তাদের প্রশ্রয় ও উৎসাহ দান করে।
ভারতপন্থী ও বামপন্থী দলগুলো জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবিরকে নির্মূল করার
লক্ষ্যে চরম উস্কানিমূলক বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে আবহাওয়া উত্তপ্ত করে তোলে। তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী জামায়াত ও শিবিরের নেতা-কর্মীকে
টার্গেট বানিয়ে সশস্ত্র হামলা চালাতে থাকে। দেশের
সংবিধান, আইন, আদালত, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতা উপেক্ষা করে গণআদালতের নাটক মঞ্চস্থ করা
হয়। সরকার একদিকে গণআদালতকে বে-আইনী ও এ কমিটিকে
অবৈধ ঘোষণা করে তার সদস্যদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। অপরদিকে অজ্ঞাত কারণে উক্ত কমিটির কাছে আত্মসমর্পণ করে
অধ্যাপক গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণ করেন।
সরকারের এ দুর্বলতার সুযোগে ভারত ১১ই
সেপ্টেম্বর থেকে তাদের 'পুশব্যাক' অপারেশনের মাধ্যমে বাংলাভাষী ভারতীয় মুসলমান নাগরিকদের জোরপূর্বক বাংলাদেশে
ঠেলে দেয়ার বৈরীসূলভ কাজ শুরু করে। এ
তথাকথিত 'পুশব্যাক' কর্মসূচির মাধ্যমে ভারত তার মুসলিম নাগরিকদের একদিকে নির্মূল করতে চায়, অপরদিকে
ভয়ানক চাপ সৃষ্টি করে বাংলাদেশকে তার তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়।
ইসলামী আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতার বিনা অপরাধে
ও বিনা বিচারে কারাজীবন যাপন, নির্মূল কমিটি ও তার মুরব্বীদলের জামায়াত-শিবির নির্মূল
অভিযান এবং সেই সাথে সরকারের দুর্বলতা ও ইসলাম বিমুখতা - এসব কিছুই ইসলামী
আন্দোলনের পথে অতি স্বাভাবিক।
বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যেই তার নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমকে জেলে
আটক রাখা হয়েছে।
এখানে আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই যে, অধ্যাপক গোলাম আযমের উপর যে জুলুম সরকার করছেন অবিলম্বে তার অবসান হতে হবে। দেশের জনগণের পক্ষ থেকে এবং বহির্বিশ্বের ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনের পক্ষ থেকে অধ্যাপক গোলাম আযমের মুক্তির দাবী জানানো হয়েছে। এই সম্মেলনের পক্ষ থেকে আমি পুনরায় আমাদের প্রিয় নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমকে মুক্তি দিয়ে দেশ ও জনগণের সেবা করার সুযোগ দানের জন্য সরকারের নিকট জোর দাবী জানাচ্ছি।
সম্মানিত ভাই ও বোনেরা,
আমরা বিশ্বাস করি, ইসলামী
আন্দোলনের পথ কোনোদিন কুসুমাস্তীর্ণ হয় না। বরঞ্চ
এ যে ভয়ানক বন্ধুর,
কন্টাকাকীর্ণ ও বিপদ-সংকুল, তা ভালো করে জেনে বুঝেই আমরা এ
পথে পা বাড়িয়েছি এবং পেছনে আমাদের নৌকা জ্বালিয়ে দিয়ে এসেছি যাতে পেছনে ফেরার
কোন উপায় না থাকে। আল্লাহর পিয়ারা নবীগণ ও এমন পথেই চলেছেন। তাঁরাও পদে পদে অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁরা নানানভাবে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হয়েছেন, আপন
জন্মভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, কারাগারে অথবা পাহাড়ের গুহায়
বছরের পর বছর বন্দী জীবন যাপন করেছেন। তাঁদের
অনেককে খোদাদ্রোহী শক্তি নির্মমভাবে হত্যা করেছে, জীবন্ত প্রোথিত করেছে। এতদসত্ত্বেও নবীগণের ইসলামী আন্দোলনেরই জয় হয়েছে। খোদাদ্রোহীরা দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। রাব্বুল আলামীনের এটাই শাশ্বত বিধান।
আল্লাহ তাআলার প্রেরিত জলিলুল্ কদর- বা
মহাসম্মানিত নবীগণ যে আন্দোলন করেছিলেন তা ছিল একামতে দীনের আন্দোলন- পরিপূর্ণ দীন
প্রতিষ্ঠার আন্দোলন,
অর্থাৎ জীবনের সকল ক্ষেত্র থেকে সকল বাতিল খোদা ও শক্তির
দাসত্ব-আনুগত্য উচ্ছেদ করে একমাত্র রাব্বুল আলামীনের বন্দেগী ও দাসত্ব-আনুগত্য
প্রতিষ্ঠা করা। জামায়াতে ইসলামী সে আন্দোলনই করছে। আর আমরা যখন সেই আন্দোলনই করছি যা নবীগণ করেছিলেন, তখন
তাঁরা যেসব অগ্নিপরীক্ষা ও নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছিলেন, তার
থেকে আমরা নিরাপদ থাকব কি করে?
এ প্রসঙ্গে ১৯৪২ সালে পাঠানকোট দারুল ইসলামে
অনুষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামীর প্রথম সম্মেলনে কর্মীদের উদ্দেশে জামায়াত প্রতিষ্ঠাতা
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী রা. যে মূল্যবান ভাষণ দেন, তার কিছু এখানে উদ্ধৃত করছি। তিনি বলেন-
“এ পথের দাবী এই যে,
আমাদের মধ্যে যেন বিরোধিতাকে খোশ আমদেদ জানাবার প্রবণতা
সৃষ্টি হয়। সত্য পথ হোক অথবা বাতিল পথ, এ
ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার নীতি এই যে, যে ব্যক্তি যে পথই অবলম্বন করুক, তাকে সে
পথে অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। আর হক
পথের বৈশিষ্ট্যই তো এই যে শুরু থেকে আখের তক সে পথ অগ্নি-পরীক্ষায় পরিপূর্ণ। অংকের একটি মেধাবী ছাত্র একটা কঠিন অংক পেলে যেমন খুশী হয়
যে, এতে করে তার প্রতিভার যাচাই হবে, তেমনি এক দৃঢ়-সংকল্প মুমিন
পরীক্ষার সম্মুখীন হতে আনন্দ পায়। কারণ
এর দ্বারা সে তার আনুগত্য প্রমাণ করার সুযোগ পায়। মিটমিটে প্রদীপ সামান্য বাতাসের আঘাতেই নিভে যায়। কিন্তু একটি প্রজ্বলিত চুলা বাতাসে অধিকতর প্রজ্বলিত হয়। আপনারা নিজেদের মধ্যে এ যোগ্যতা সৃষ্টি করুন যে, একটি
প্রজ্বলিত চুলা সিক্ত জ্বালানি দ্বারা নির্বাপিত না হয়ে যেমন তাকে তার ইন্ধন
বানিয়ে নেয়, তেমনি আপনারাও যেন বিরোধিতার দ্বারা দমিত না হয়ে আহার ও শক্তি সঞ্চয় করতে
পারেন। যতোদিন পর্যন্ত আমাদের মধ্যে এ যোগ্যতার
সৃষ্টি না হয়েছে,
ততোদিন পর্যন্ত আশা করা যায় না যে, আমরা
খোদার দীনের কোন ভালো খেদমত করতে পারব।
আপনারা জানেন যে, আল্লাহ
আমাদের কাছে এ দাবী করবেন না যে, আমাদেরকে হযরত আবু বকর রা. এবং হযরত উমরের রা. রাষ্ট্রের
মতো একটি রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে। এমনটি
করার সাধ্য কারো নেই এবং এর আদেশও আল্লাহ করেননি। অবশ্যি আমাদের কাছে এ দাবী করা হয়েছে যাতে আমরা দীন প্রতিষ্ঠার জন্যে সকল
প্রকার চেষ্টা-চরিত্র করি এবং এ চেষ্টায় জীবনের সবকিছুই নিয়োজিত করতে পারি
অর্থাৎ নিজের জীবনও এবং ধনসম্পদও। তার
সাথে আমাদের সকল প্রিয় বস্তু ও। দীনের
জন্যে আমাদের প্রচেষ্টা আমরা চালিয়ে যাব ঐকান্তিকতা ও উৎসাহ্- উদ্যমের সাথে। খোদার কাছে এটাই হচ্ছে আমাদের ঈমান ও নিফাকের কষ্টিপাথর। যে হৃদয়ে দীন প্রতিষ্ঠার প্রেরণা নেই, সেখানে
ঈমানের কোন স্থান নেই।”
মাওলানা আরও বলেন, “প্রত্যেক
সত্যানুসন্ধী ব্যক্তির অপরিহার্য কর্তব্য এই যে, সে যেন তার মধ্যে ইকামতে দীনের
তীব্র অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে। অতঃপর
সে চেষ্টা করবে যাতে তার মনের মধ্যে এর আগুন জ্বলে ওঠে। এ চেষ্টা-চরিত্রের পরিণাম কি হবে তা আলোচনা বহির্ভূত। এমনও হতে পারে যে,
আমাদেরকে করাত দিয়ে চিরে ফেলা হবে। মাটির উপর দিয়ে টেনে-হেঁচড়ে নেয়া হবে। জ্বলন্ত কয়লার উপর নিক্ষেপ করা হবে এবং আমাদের মৃতদেহ কাক-চিলের খাদ্য হবে। এতোসব করে হয়তো আমাদের এ সৌভাগ্য হবে না যে, বর্তমান
বাতিল ব্যবস্থাকে আমরা একটা সত্য সুন্দর ব্যবস্থায় পরিবর্তিত করতে পারব। কিন্তু এ ব্যর্থতা কোন ব্যর্থতা নয়। ব্যর্থতার কোন আশঙ্কা অথবা নিশ্চয়তা আমাদেরকে এ দাবী থেকে মুক্তিদান করবে না, যে দাবী
ইকামতে দীনের জন্যে আল্লাহতাআলা করেছেন। এ একটা
অটল অপরিহার্য কর্তব্য যা আমাদেরকে যে কোন মূল্যে, যে কোন অবস্থায় পালন করে যেতে
হবে।
মাওলানা আরও বলেন, “ইসলামী
আন্দোলনের একটা বৈশিষ্ট্য ও মেযাজ-প্রকৃতি আছে। এর একটি বিশেষ কর্মপদ্ধতি আছে যার সাথে অন্য কোন আন্দোলনের কোনই মিল নেই। আজ পর্যন্ত যারা বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনের সাথে জড়িত এবং
যারা সেসব পদ্ধতিতে অভ্যস্ত, তারা এ জামায়াতে যোগদান করলে তাদের অনেক কিছুই পরিবর্তন
করতে হবে। এখানে কর্মপদ্ধতি কুরআন পাক ও সীরাতে
মুহাম্মদী সা. এবং সাহাবায়ে কিরামের রা. জীবন চরিত থেকে শিখে নিয়ে তার অভ্যাস
করতে হবে।”
সর্বশেষে মাওলানা বলেন, “এ
আন্দোলনের প্রাণ হলো খোদার সাথে দৃঢ় ও গভীর সম্পর্ক। তাঁর সাথে আমাদের সম্পর্ক যদি দুর্বল হয়, তাহলে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম
করার এবং তা সাফল্যের সাথে পরিচালনা করার যোগ্য আমরা হতে পারব না।”
মাওলানার উপরিউক্ত মূল্যবান কথাগুলো হৃদয়ে গেঁথে রেখেই আমাদের আন্দোলন, আমাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড, আমাদের দৈনন্দিন কর্মতৎপরতা পরিচালিত করতে হবে। প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণের পূর্বে আমাদেরকে সতর্কতার সাথে লক্ষ্য করতে হবে যে, আমরা শরীয়তের সীমা সামান্য পরিমাণেও লংঘন করছি কিনা। ইসলামী আদর্শ ও নীতি-নৈতিকতা থেকে সরে পড়ছি কিনা। যদি তা হয়, তাহলে এটাকে ইসলামী আন্দোলন বলা যাবে না, যে আন্দোলনের দাবী আল্লাহ করেছেন।
শ্রদ্ধেয় সুধীবৃন্দ ও সম্মানিত
রুকন ভাই-বোন !
আপনাদের জানা আছে, উপমহাদেশের
মুসলমানগণ তাদের মৌল আকীদাহ-বিশ্বাস, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি
সংরক্ষণের লক্ষ্যে স্বতন্ত্র মুসলিম জাতি হিসাবে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার জন্যে একটি
পৃথক আবাসভূমির দাবীতে সংগ্রাম করে। তার
ফলশ্রুতিতে ভারত বিভক্ত হয় এবং পাকিস্তান ও ভারত নামে দু'টি
স্বাধীন রাষ্ট্র অস্তিত্ব লাভ করে। এ
বিভাগ ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ভারত যেমন মেনে নিতে পারেনি, তেমনি
একাত্তরের শেষে বাংলাদেশ নামে মুসলমানদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্বও ভারত
মেনে নিতে পারেনি। কারণ ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতের বহুদিনের স্বপ্ন
অখণ্ড ভারতে ‘রামরাজ' প্রতিষ্ঠা। এ কারণেই ভারত চেয়েছিল- বাংলাদেশকে তার
একটি তাবেদার রাষ্ট্র হিসাবে দেখতে।
দুর্ভাগ্যবশত কোন মহৎ আদর্শ, চরিত্র
না থাকায় এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়ার কারণে বাংলাদেশের
প্রথম ক্ষমতাসীন সরকার জাতিকে সঠিক দিকদর্শন দিতে পারেনি। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের যে সংবিধান তৈরী হয়, তাতে ভারতীয় হিন্দু কংগ্রেসের
চারটি আদর্শিক স্তম্ভ- সমাজতন্ত্র, সিকিউলারিজম, জাতীয়তাবাদ
ও গণতন্ত্র বাংলাদেশের চার রাষ্ট্রীয় স্তম্ভ হিসাবে নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হওয়া
সত্ত্বেও এখান থেকে ইসলাম,
ইসলামী মূল্যবোধ এবং মুসলিম সংস্কৃতি বিলোপের অভিযান শুরু
হয়। ইসলামী আন্দোলন ও সকল ইসলামী দল নিষিদ্ধ
ঘোষণা করা হয়।
যেসব প্রতিশ্রুতি আশাবাদ নিয়ে আওয়ামী লীগ
স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হয় মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনেই তা
ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। উপরন্তু একদলীয় বাকশালী
শাসনের যাঁতাকলে জাতি ইতিহাসের এক চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। ১৯৭৫-এর ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের পর নিকৃষ্ট স্বৈরশাসনের
শৃঙ্খলমুক্ত হলেও বাংলাদেশের শতাব্দীকালের জন-আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণই রয়ে যায়। পর্যায়ক্রমে নতুন শাসকগোষ্ঠীও ক্ষমতায় টিকে থাকার
রাজনীতির মধ্যেই হারিয়ে যায়।
বাংলাদেশের বিগত ২১ বছরের ইতিহাসে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামগ্রিক ব্যর্থতা
জনগণের দুর্ভোগ,
অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা, রাজনৈতিক পশ্চাৎপদতাকে আরও প্রকট
করে তোলে। স্বার্থান্ধতা, দলীয়
সংকীর্ণতা, জাতিকে বিভক্ত করার অপরিণামদর্শিতা দেশকে চরম সংকটে নিক্ষেপ করে। এযাবত যারা ক্ষমতায় আসেন, তারা জাতির প্রত্যাশা পূরণে
ব্যর্থ হন। আরও প্রমাণিত হয় যে, এ দেশের
জনগণের দীর্ঘদিনের আকাঙ্খা অনুযায়ী ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা ছাড়া
মানুষের সত্যিকার কল্যাণ,
শান্তি ও নিরাপত্তা আসতে পারে না
ইসলামী মূল্যবোধ, ইসলামী চেতনা ও চরিত্র সত্যিকার দেশপ্রেম সৃষ্টি করতে পারে এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করে। আজ সময়ের সবচেয়ে বড়ো দাবী জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করা। জামায়াতে ইসলামীর গোটা জনশক্তির কাছে এবং সকল মুসলমানের কাছে আমার আকুল আবেদন- ঘরে ঘরে ইসলামের বিশ্বজনীন দাওয়াত পেশ করর মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলুন। এক নতুন শক্তিশালী মুসলিম জাতিসত্তা গড়ে তুলুন। তাহলেই সকল বিদেশী আধিপত্যবাদী শক্তির সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে একটি সুখী, সুন্দর ও স্বাধীন বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে।
বন্ধুগণ!
আগেই বলেছি, হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতের
বহুদিনের স্বপ্নসাধ অখণ্ড ভারতে রামরাজ প্রতিষ্ঠা। রামরাজ প্রতিষ্ঠার পূর্বে ভারত থেকে মুসলমানদের নির্মূল করা তারা অপরিহার্য
বলে মনে করে। রামরাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে শিবাজীকে তার
প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে ১৯০৬ সালে সারা ভারতে মহা সমারোহে শিবাজী দিবস পালন করা
হয়। কোলকাতার বিরাট সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন
বালগঙ্গাধর তিলক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিবাজীর বন্দনা গেয়ে 'শিবাজী' নামক
কবিতা পাঠ করেন। কবিতার একস্থানে তিনি এ সংকল্প ঘোষণা করেন :
“এক ধর্মরাজ্য হবে এ ভারতে- এ মহাবচন,
করিব সম্বল”
বালগঙ্গাধর তিলক, রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের স্বপ্ন
বাস্তবায়নের কাজ হিন্দু ভারত শুরু করল বাবরী মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে।
তার এ অন্যায় বর্বরোচিত, অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক
কাজের জন্য গোটা বিশ্বের পক্ষ থেকে ভারতকে নিন্দা ও ঘৃণা কুড়াতে হচ্ছে।
ভারত একটি বৃহৎ দরিদ্র দেশ হওয়া সত্ত্বেও এশিয়ার মধ্যে একটি মিনি সুপার পাওয়ার সাজার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা তার ভুলে যাওয়া উচিত নয়। গর্বিত, উদ্ধত, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মুসলমান হত্যাযজ্ঞের নায়ক প্রকৃতির বিধান অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য হয়ে থাকে।
শ্রদ্ধেয় সুধীবৃন্দ ও সম্মানিত
রুকনগণ!
সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে একবার লক্ষ্য
করুন। ধনী-গরীব, নারী-পুরুষ, ছোটো-বড়ো
নির্বিশেষে বিরাট সংখ্যক লোকের যে নৈতিক অধঃপতন ঘটেছে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। চুরি-ডাকাতি, হত্যা, ব্যভিচার, সর্বস্তরে
দুর্নীতি, একে অপরের প্রতি আস্থাহীনতা, ব্যাপক লুটতরাজ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ ও
অপচয়, অন্যায়, অবিচার প্রভৃতির কারণে সমাজদেহে যে পচন ধরেছে, ইসলাম ছাড়া অন্য কোন উপায়ে তার
নিরাময় হতে পারে কি?
খোদাদ্রোহী জড়বাদী সভ্যতা ও জীবন দর্শন তো
পাপাচার-অনাচারের জন্মদাতা। এ
সভ্যতা ও জীবন দর্শনের অনুসারী যারা, তারা ব্যাধিগ্রস্ত সমাজের সুস্থতা
ফিরিয়ে আনবে কি করে?
আমাদের সমাজদেহে যেসব ব্যাধির প্রকোপ ঘটেছে, ইসলামী
আদর্শ ও নীতি-নৈতিকতা ছাড়া তার কোন প্রতিকার-প্রতিবিধান আমাদের সমাজপতি, বুদ্ধিজীবী
ও শাসকগোষ্ঠীর কাছে আছে কি?
নেই,
থাকতে পারে না। বরঞ্চ ইসলামের
অভাবেই এসব ব্যাধি সমাজ জীবনকে জর্জরিত করে এবং এক সময়ে গোটা জাতিকে ধ্বংস করে
ইতিহাসই তার সাক্ষী। অন্য কোন উপায়ে এসব
ব্যাধি নিরাময় করা সম্ভব হলে নবী আগমনের কোন প্রয়োজন হতো না।
এসব চিন্তা করে জড়বাদী পাশ্চাত্য সভ্যতার
ক্রোড়ে লালিত-পালিত অনেক চিন্তাশীল সুধীও ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। তাঁদের দৃষ্টিতে সুস্থ সমাজ গঠনের কোন কলা-কৌশল
পাশ্চাত্যের কাছে নেই।
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ মুস্তফার সা.
আগমনও ছিল একটা সমাজ বিপ্লব বা সমাজ পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে। মানুষের মনগড়া সমাজ ব্যবস্থা, সভ্যতা-সংস্কৃতি, শিক্ষা-দীক্ষা, চিন্তা-চেতনা, নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয়
বিশ্বাস, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় ও লাভ-লোকসানের মানদণ্ড— এসব কিছু পরিবর্তন করে ইসলামী আদর্শ, জীবন
দর্শন ও নীতিমালার ভিত্তিতে নতুন করে সমাজ গড়েছেন। তার পরিবর্তন ছিল মন্দ থেকে ভালোর দিকে। মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্তির দিকে, দুঃখ-দারিদ্র থেকে সুখ-শান্তি ও
স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে। অধঃপতন থেকে উন্নতি ও
সমৃদ্ধির দিকে। ইতরামি, নোংরামি ও অশ্লীলতা থেকে ভদ্রতা, রুচিশীলতা
ও শালীনতার দিকে। জুলুম, অবিচার ও নিষ্ঠুরতা থেকে সুবিচার, দয়া-দাক্ষিণ্য
ও স্নেহ-মমতার দিকে। ভোগ থেকে ত্যাগ ও
নিঃস্বার্থ সমাজ সেবার দিকে। এমনি এক
সার্বিক সমাজ বিপ্লব ও সমাজ পরিবর্তন তিনি করেছিলেন। নবী করীমের সা. সমাজ বিপ্লব ও সমাজ পরিবর্তনের জন্যে ছিল বিশেষ দাওয়াত, কর্মসূচি
ও কর্মনীতি। এ কাজের জন্যে প্রাথমিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন
তিনি একটি চরিত্রবান কর্মীবাহিনী গঠনের প্রতি এ চরিত্রবান কর্মী বাহিনীই ইসলামী
সমাজ বিপ্লবের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সফল বিপ্লব সাধন করে। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নবী করীমের সা. দাওয়াত, কর্মসূচি
ও কর্মনীতি অনুসরণ করেই ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছে। নবীর রেখে যাওয়া কাজের যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল উম্মতে মুসলিমার উপরে, জামায়াতে
ইসলামী সে দায়িত্বই কাঁধে নিয়েছে। এটা
কোন সহজসাধ্য কাজ নয়। এ কাজের জন্যে যে গভীর
জ্ঞান ও প্রজ্ঞা,
যে যোগ্যতা ও গুণাবলীর প্রয়োজন তা শক্তি সামর্থ অনুযায়ী
অর্জনের প্রয়োজনেই জামায়াতে ইসলামী জ্ঞান ও চারিত্রিক মানের ভিত্তিতে লোক তৈরী
করছে। উদ্দেশ্য, আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম
অব্যাহত গতিতে চালিয়ে যাওয়া। কুরআন
পাকের পাতায় পাতায় বার বার এ কাজকেই বলা হয়েছে জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ- আল্লাহর
পথে জিহাদ।
এ কাজ আর কেউ করুক বা না করুক, উম্মতে মুসলিমার উপর এ কাজের যে দায়িত্ব রয়েছে, সে অনুভূতিসহ আমাদের সীমিত শক্তি-সামর্থ, উপায়-উপকরণ ও যোগ্যতা নিয়ে এ কাজ আমাদের করতে হচ্ছে যাতে এ দায়িত্বের জবাবদিহি আমরা করতে পারি আখিরাতে আমাদের মহান প্রভুর দরবারে। আমরা আমাদের জান-মাল, শক্তি-সামর্থ, উপায়-উপকরণ সবকিছু তাঁর হাতেই সোপর্দ করেছি। আন্দোলনের প্রতি পদে পদে, প্রতিপক্ষের সৃষ্ট সংঘাত-সংঘর্ষে তিনিই আমাদের একমাত্র সহায়। এ দৃঢ় প্রত্যয় আমাদের আছে যে, দুনিয়া ও আখিরাতে তিনি আমাদের একমাত্র বন্ধু, ওয়ালী ও অভিভাবক। এর পরে কারো ভয়ে ভীত- শঙ্কিত হওয়ার কোন কারণই থাকতে পারে না।
জামায়াতে ইসলামী প্রকৃতপক্ষে কি
করতে চায়?
আল্লাহর কিতাব, রাসূলের আদর্শ ও খিলাফতে রাশিদার
পদাঙ্ক অনুকরণে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্রে পরিণত করাই
জামায়াতে ইসলামীর লক্ষ্য। এজন্য
যে ধরনের উন্নত নৈতিক চরিত্রের নেতৃত্ব ও নিষ্ঠাবান ত্যাগী কর্মীবাহিনী প্রয়োজন
তা গঠন করার সাধনাই জামায়াত করে যাচ্ছে।
আধুনিক ও মাদ্রাসা শিক্ষিত এবং অল্পশিক্ষিত
লোক, বিশেষ করে যুব সমাজকে এ পথে আকৃষ্ট করার উপযোগী বিপুল ইসলামী সাহিত্য ভাণ্ডার
জামায়াত তৈরী করেছে। বিভিন্ন ভাষায় তা সারা
বিশ্বে ছড়িয়ে আছে এবং চিন্তারাজ্যে বিপ্লব সাধন করছে। সেসব সাহিত্য অধ্যয়ন করার জন্যে সম্মানিত সুধীবৃন্দের নিকটও আকুল আবেদন
জানাই।
এ সাহিত্যই অগণিত আধুনিক শিক্ষিত লোক এবং
মাদ্রাসা শিক্ষিত উলামায়ে কিরামের মধ্যকার দূরত্ব দূর করে একসাথে দেশ গড়ার
কর্মসূচি রচনা করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমরা এ
দেশের বার কোটি মানুষকে একদিকে যেমন নৈতিক দিক দিয়ে উন্নত মানসিক গুণে গড়ে তুলতে
চাই, তেমনি বৈষয়িক দিক দিয়ে তাদেরকে আল্লাহর দেয়া পার্থিব নিয়ামত বৈধ উপায়ে
ভোগ করার সুযোগও করে দিতে চাই। ইসলাম
মানুষের দৈহিক ও আত্মিক উভয়মুখী উন্নতির বিধানই দিয়েছে।
আল্লাহ মানুষের জন্যেই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যেই প্রাকৃতিক সম্পদ দান করেছেন। আল্লাহর আইন ও সৎলোকের শাসনের অভাবেই মানুষ আজ সুসংগঠিত স্বার্থপর ও শোষকদের অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী নিঃস্বার্থ নেতৃত্বের পরিচালনায় দেশের ঈমানদার, সৎ ও যোগ্য লোকদের সংগঠিত করে জনগণকে শোষকদের খপ্পর থেকে উদ্ধার করতে চায়।
জামায়াতে ইসলামীর রুকন ভাই ও
বোনেরা!
এখন আমি ইসলামী আন্দোলনের ঐসব নিবেদিতপ্রাণ
ভাই-বোনদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাই, যারা লক্ষ লক্ষ সহযোগী সদস্য ও
কর্মীর মধ্য থেকে এ আন্দোলনের দায়িত্বশীল হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। আপনারা আল্লাহর দীন বিজয়ী করার জন্যে জানমাল এবং শ্রম ও
মেধা বিনা দ্বিধায় কুরবানী করার যে শপথ নিয়ে জামায়াতের রুকন হয়েছেন তা যাতে
সার্থক হয় সে বিষয়ে আরও বলিষ্ঠতা অর্জনের উদ্দেশ্যেই এ সম্মেলন।
জামায়াতের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এ রুকন সম্মেলনই সংগঠনের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। এ সম্মেলন কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ ও মজলিসে শুরার যে কোন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও তাদের যাবতীয় কার্যাবলীর সমালোচনা করে তাদের সংশোধন করার দায়িত্বও এ সম্মেলনের রয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের পথে কি কি সমস্যা রয়েছে এবং এসবের সমাধান কিভাবে হতে পারে এ বিষয়ে এ সম্মেলনে আপনারা যে মতামত দেবেন, তা জামায়াত নেতবৃন্দের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শের মর্যাদা রাখে। আশা করি আপনারা এসব বিষয়ে যোগ্য ভূমিকা পালন করে সম্মেলনের উদ্দেশ্য সফল করবেন। এ ত্রিবার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে জামায়াতের লক্ষ লক্ষ কর্মী, সহযোগী সদস্য এবং শুভাকাঙ্ক্ষী সমন্বয়ে কোন প্রকাশ্য অধিবেশনের আয়োজন করা সম্ভব হলো না বলে কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি। অথচ এ সম্মেলনের জন্য সবাই কমবেশী আর্থিক ও নৈতিক সহযোগিতা দান করেছেন। তাঁদের সক্রিয় সহযোগিতা ব্যতীত এ সম্মেলন অনুষ্ঠান সম্ভব হতো না। তাই তাঁদের সবার প্রতি জানাই আন্তরিক শুকরিয়া। উল্লেখ্য যে, যে স্থানে আমরা এ সম্মেলন করছি তাও প্রায় দশ হাজার লোকের তিনদিন যাবত অবস্থান ও যাবতীয় কাজকর্ম করার জন্যে খুবই অপ্রশস্ত ও অপ্রতুল। তার জন্যে আপনাদের ভয়ানক কষ্ট ও অসুবিধা ভোগ করতে হবে। বিকল্প ব্যবস্থা সম্ভব ছিল না বিধায় ইসলামী আন্দোলনের খাতিরেই আপনারা এসব কিছু হাসিমুখে বরণ করে নেবেন বলে আমার বিশ্বাস।
বন্ধুগণ!
আজ আমি ঐসব আল্লাহর বান্দাহর নাম পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি, যাঁরা ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধে সরকার কর্তৃক জেল-জুলুম ভোগ করেছেন ও করছেন এবং অন্যান্য বিরোধী শক্তির হাতে নির্যাতন, অপমান ও দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে চলেছেন। বিশেষ করে. ইসলামী আন্দোলনের ছাত্রসহ সকল শহীদ ভাইয়ের জন্যে আল্লাহর দরবারে পুনঃআকুল আবেদন জানাই যেন তিনি তাঁদেরকে ঐসব শহীদের সাথী হওয়ার সৌভাগ্য দান করেন যাঁরা রাসূলে পাকের সা. আন্দোলনে শাহাদাতের গৌরব লাভ করেছেন।
ভাই ও বোনেরা!
আপনারা অবশ্যই উপলব্ধি করেন যে, আমরা এক
অতি দুর্লংঘ পথে যাত্রা করেছি। আমাদের
কাজ সমাজের কোন আংশিক সংস্কার-সংশোধন নয়, বরঞ্চ একটি
পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব। বাতিল ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে
পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বিপ্লব করার সংগ্রাম করতে গেলে, যারা এ বাতিল ব্যবস্থার ধারক ও
বাহক এবং এ ব্যবস্থার সাথে যাদের স্বার্থ জড়িত, তারা কি আমাদেরকে বরদাশত করতে
পারে? ইসলামের পথ যারা রুদ্ধ করতে চায় তারা আমাদের বিরুদ্ধে নানান কল্পিত অভিযোগ
রচনা করে আমাদেরকে লোকচক্ষে হেয় করতে অবশ্যই চাইবে। আমাদের উপর সশস্ত্র হামলাও করবে। আর
এটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক যার সাক্ষ্য দিচ্ছে সাম্প্রতিক কালের কিছু ঘটনা যার
কিঞ্চিৎ ইঙ্গিত আগে কিছুটা দিয়েছি।
আল্লাহর নবীগণ এ ধরনের বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। এ পথে এসব অগ্নিপরীক্ষা আসবেই। কুরআন
পাকেও এ কথা সুস্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। এখানে
একটি কথা বলে রাখতে চাই। বিদেশী আধিপত্যবাদী
শক্তি এবং তাদের এ দেশীয় সেবাদাসেরা একমাত্র জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী
ছাত্রশিবিরকে তাদের পথে বিরাট প্রতিবন্ধক মনে করে। তাই তারা এ দু'টি সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নির্মূল অভিযান শুরু করেছে। তাদের হাতে এ যাবত প্ৰায় ষাটজন ইসলামী ছাত্রশিবির ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা
ও কর্মী শাহাদাতবরণ করেছেন।
এতোসংখ্যক লোকের শাহাদাতকে অনেকেই জামায়াতে ইসলামী বা ইসলামী অন্দোলনের পরাজয়
বলে অভিহিত করতে চান। অবশ্যি বস্তুবাদী
দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃষ্টিকোণ থেকে জয়-পরাজয়ের যে মানদণ্ড তাতে তারা ঠিকই বলছেন। কিন্তু ইসলামের শাশ্বত নীতি ও দৃষ্টিকোণ থেকে জয়
-পরাজয়ের মানদণ্ড ভিন্নতর। কুরআন
পাকের সূরা ইয়াসীনে এক আল্লাহর বান্দার শাহাদাতের উল্লেখ আছে। শুধুমাত্র আল্লাহর বন্দেগীর দাওয়াত দেওয়ার অপরাধে তাঁর
আপন জাতির লোক তাঁকে হত্যা করে।
পার্থিব জীবনের সীমান্ত অতিক্রম করার সাথে সাথেই তাকে বলা হয় “বেহেশতে
প্রবেশ কর। (অতঃপর বেহেশতে প্রবেশকারী) সে ব্যক্তি বলেন, আমার
প্রভু আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে যে উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন, হায়রে
আমার জাতি যদি তা জানতে পারতো!” (সুরা ইয়াসীনঃ ২৬-২৭)
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন, ‘এবং যে
ব্যক্তি কোন মুমিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে তার পরিণাম হয় জাহান্নাম। সেখানে তাকে থাকতে হবে চিরকাল। আল্লাহ তার উপর ক্রোধান্বিত হন, তার উপর অভিসম্পাত করেন এবং তার
জন্যে নির্ধারিত করেন কঠোর শাস্তি।' (সূরা নিসা : ৯৩)
উপরের আয়াত দুটোতে আল্লাহর পথে নিহত
ব্যক্তির এবং তাকে হত্যাকারীর পরিণাম বলে দেয়া হয়েছে। একজনের চিরন্তন জান্নাত লাভ এবং অপরজনের চিরন্তন জাহান্নামের শাস্তি ভোগ। জয় এবং পরাজয় কোনটি তা একটি সুস্থ বিবেক বলে দিতে পারে। অবশ্যি যে বা যারা খোদা এবং আখিরাতের প্রতি সঠিক অর্থে
বিশ্বাস পোষণ করে না,
তাদের কথা আলাদা।
ইসলামের পথে যাঁরা চলেন, তাঁদের
পরাজয় বলে কোন কিছু নেই। খোদার পথে শাহাদাত তো
একজন মুমিনকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করে। ইসলাম
থেকে যারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সত্যিকার পরাজয় তো তাদের।
আজ দুনিয়ার সর্বত্রই ইসলামের প্রতি মানুষের
বিপুল আগ্রহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে হবারই কথা, কারণ এ যে বিশ্বজনীন মতবাদ ও আদর্শ। মানব স্বভাব-প্রকৃতির সাথে এ সম্পূর্ণ সঙ্গতিশীল। ইউরোপ-আমেরকিার দেশগুলোতে আজ ইসলামের গুঞ্জরণ শুনা যাচ্ছে।
সমাজতন্ত্রের শ্লোগান ছিল একটি বিরাট প্রতারণা মাত্র। সেসব দেশের মানুষের নেশা ভেঙ্গে যায় এবং সমাজতন্ত্র তার লালনাগারেই অপমৃত্যু বরণ করেছে। পাশ্চাত্য সভ্যতা ও দর্শনের প্রাসাদ ও মাকড়সার জালের মতো ছিন্নভিন্ন হতে চলেছে। এখন মানব জাতির মুক্তির এই পথ ইসলাম- যা বিশ্বস্রষ্টা মানব জাতির জন্যই নির্ধারিত করে রেখেছেন। সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে ইসলামের মূল কথা- আল্লাহর আইন ও সৎলোকের শাসন।
ভাইসব!
আমাদের লক্ষ্য যেহেতু সমাজের সর্বস্তরে সৎ ও
চরিত্রবান লোকের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, সে জন্যে প্রথমে আমাদের
প্রত্যেককে সৎ ও চরিত্রবান হতে হবে। আমাদের
সততা, তাকওয়া, আমানতদারী ও দিয়ানতদারী, কথা-বার্তা, লেন-দেন, আচার-আচরণ, জীবন
যাপন প্রণালী সেই মানেরই হতে হবে যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল পছন্দ করেন। সেই সাথে সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছতে হবে ইসলামের
দাওয়াত নিয়ে। হৃদয়গ্রাহী ও দরদভরা ভাষায় দাওয়াত পেশ
করতে হবে। আমাদের কাজ তো শুধু দাওয়াত পেশ করা, ফলাফল
আল্লাহর হাতে। তবে আমাদের যদি ইখলাস ও নিষ্ঠা থাকে, আমাদের
চরিত্র যদি মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে, তাহলে আমাদের দাওয়াত বিফলে
যাবার কথা নয়।
আল্লাহ বলেন, হিকমত ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে
তোমার প্রভুর পথে আহ্বান জানাও।
আমাদের দাওয়াত এ খোদায়ী নির্দেশ অনুযায়ী
হতে হবে। আমাদের ভাষা হবে মার্জিত। মন্দের জবাব দিতে হবে ভালোর মাধ্যমে। সত্যি সত্যিই যে আমরা মন্দের স্থলে ভালো প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, একথা
শুধু মুখে নয়, নিজের কাজ ও ইনশাআল্লাহ প্রকাশভঙ্গির দ্বারা প্রমাণ করতে হবে। এরপর বিশ্বাস করুন, আল্লাহর রহমত আমাদের সাথী হবে
এবং যতোটা কাজ আমরা নিজেরা করব তার চাইতে অনেক বেশী কাজ আল্লাহর ফেরেশতাগণ আমাদের
সহযোগী হয়ে সম্পন্ন করবেন।
তারপর কাজ যেহেতু আমরা আল্লাহর করছি এবং আমাদের চরম লক্ষ্য যেহেতু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ, সে জন্যে তাঁর সাথে আমাদের সম্পর্ক হতে হবে অত্যন্ত গভীর, নিবিড় ও মযবুত। রাতের নিভৃত প্রহরে অশ্রুকাতর কণ্ঠে তাঁর দরবারে ধরনা দিতে যেন আমরা ভুল না করি। আমাদেরকে নিষ্কলুষ ও পরিশুদ্ধ এবং পাপমুক্ত করার কাজে সাহস ও শক্তি দান করার আকুল আবেদন জানাতে হবে তাঁর কাছে। তিনিই আমাদের একমাত্র ভরসার স্থল, তিনিই একমাত্র বন্ধু ও অভিভাবক।
শেষ কথা
আজ আমরা আল্লাহ পাকের খাস রহমতে দেশের
বিভিন্ন শহর ও গ্রামগঞ্জ থেকে এ শীতের ভেতরে এখানে একত্রে সমবেত হয়েছি এবং তিন
দিন অবস্থান করব বলে নিয়ত করেছি। আমাদের
এ সমাবেশের ভেতর দিয়ে যেন একটা পরিপূর্ণ ইসলামী সমাজের ছবি মূর্ত হয়ে ওঠে সেদিকে
আমাদের বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের
কথাবার্তায় ও আলাপচারিতায়, চলাফেরা ও খাওয়া-দাওয়ায় থাকবে পরিপূর্ণ ইসলামী আদব ও
শিষ্টাচার, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা,
সময়নিষ্ঠা ও আপন আপন দায়িত্ব পালনের পূর্ণ অনুভূতি। থাকবে না কোন হৈ-হুল্লোড়, কোলাহল, চেঁচামেচি
ও হাটবাজারের শোরগোল। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে
থাকতে হবে সংগঠনের আনুগত্য পালনের বলিষ্ঠ মনোভাব। থাকতে হবে সেবা ও ত্যাগের প্রেরণা, গ্রহণ-ভোগের মানসিকতা নয়। এসব সম্ভব হতে পারে, যদি আমরা অনুভব করি যে, আমরা
ইসলামের ঝাণ্ডা উঁচু করে জিহাদের ময়দানে রয়েছি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ আমাদের বাইরে ও ভেতরের সব কিছুই দেখছেন।
আমরা আমাদের সীমিত শক্তি, সামর্থ
ও উপায়-উপকরণ দিয়ে এ সম্মেলনের ব্যবস্থা করেছি এবং তাও শহর থেকে বহু দূরে। সেজন্যে বহু ত্রুটি-বিচ্যুতিসহ প্রয়োজন পূরণে বহু ঘাটতি
রয়ে যাবে। তা অম্লান বদনে মেনে নিলেই সংগঠনের প্রতি
সুবিচার করা হবে বলে মনে করি।
সবশেষে কষ্ট স্বীকার করে সম্মেলনে উপস্থিত
হওয়ার জন্য আমি আপনাদের সকলকে, বিশেষ করে আমন্ত্রিত সম্মানিত মেহমানগণকে জানাই আন্তরিক
মুবারকবাদ। আল্লাহ আমাদের সংগ্রাম জয়যুক্ত করুন। আমীন।
এ ক'টি কথা বলে আল্লাহ রাব্বুল
আলামীনের নামে ও তাঁর রহমতের উপর ভরসা করে এ ত্রিবার্ষিক রুকন সম্মেলন উদ্বোধন
করছি। আল্লাহ তাআলা এ সম্মেলনকে সকল দিক দিয়ে সফল
করুন। আমীন।
আল্লাহ হাফেয। বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ।
সমাপনী ভাষণ
নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লী আ'লা
রাসূলিহীল কারীম আম্মা বা'দ- আমার সকল প্রিয় ভাই ও বোনেরা!
আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া
বারাকাতুহু।
সর্বপ্রথম আমি রাহমানুর রাহীম আল্লাহ তাআলার
লাখো লাখো শুকরিয়া আদায় করছি। বরঞ্চ
শুকরিয়া আদায়ের ভাষা আমার নেই যে, তিনি তাঁর খাস মেহেরবানীতে
আমাদের এ তিন দিনের রুকন সম্মেলন অত্যন্ত সুন্দরভাবে, সুষ্ঠুভাবে, যথাযোগ্য
মর্যাদাসহ শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে শেষ করার তাওফীক দিয়েছেন।
তারপর আমি আপনাদের সকলের আন্তরিক শুকরিয়া জানাই যে, আপনারা দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে- টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, ওদিকে সাতক্ষীরা থেকে সিলেট পর্যন্ত দেশের সকল স্থান থেকে শত শত মাইল অতিক্রম করে, অনেক কষ্ট স্বীকার ও অর্থ ব্যয় করে এখানে এসেছেন। তাঁদেরকেও আমি শুকরিয়া জানাই- যাঁরা সম্মেলনের সার্বিক প্রস্তুতির কাজ সম্পন্ন করার জন্য দিন-রাত নিঁদ ও আরামকে হারাম করে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তাঁদের ও আপনাদের কোন পারিশ্রমিক দেয়ার শক্তি আমার নেই। আলবৎ এতটুকু শুধু বলব- ‘জাযাকুমুল্লাহো খায়রান ফিদ্দরাইন- আল্লাহ তাআলা আপনাদের দুই জাহানের খায়র-ভালাই ও কল্যাণ দান করুন।
আমার প্রিয় ভাই ও বোনেরা
আমার মতো একজন নালায়েকের উপর আপনারা যে
বিরাট দায়িত্ব দিয়েছেন,
সে দায়িত্ব মুতাবেক আমার নৈতিক কর্তব্য ছিল অনেক কিছু করা
ও বলার। কিন্তু আমার অযোগ্যতা ও অসুস্থতা- এ দু'টি
কারণের জন্য আমি আমার দায়িত্ব পালনের হক আদায় করতে পারিনি। সেজন্যে আল্লাহ তাআলা যেন আমাকে মাফ করে দেন।
একটু পরেই ইনশাআল্লাহ আমাদের সম্মেলন শেষ
হয়ে যাবে এবং আমরা সকলে নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যাব। বাড়ি ফিরে যাবার প্রাক্কালে স্বাভাবিকভাবে মনের যে একটা অবস্থা হয়, সে
অবস্থায় কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কোন চিন্তামূলক বিষয় শুনতে সাধারণত মন চায় না। অবশ্যি আপনাদের ব্যাপার তো আলাদা। তথাপি এ অবস্থাকে সামনে রেখে আমি সংক্ষেপে কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো। যদি আল্লাহ তাআলা আমাকে সে তাওফীক দান করেন।
আমরা তিনদিন এখানে কাটাবার পর আজ ইনশাআল্লাহ
বিদায় নেব। বিদায়ের আগে ভেবে দেখতে হবে যে. আমরা কি
নিয়ে ফিরে যাচ্ছি। আমরা কোন্ রূহানী সওগাত নিয়ে বাড়ি ফিরব? আপনারা
এতো কষ্ট করে, এতো অর্থ ব্যয় করে ঢাকায় কোন আনন্দমেলা দেখতে আসেন নি। কোন বিলাস ভ্রমণেও আসেন নি বরঞ্চ আপনারা এসেছেন জিহাদের ময়দানে। এ ময়দানের কি প্রয়োজন, এ ময়দানের কি চাহিদা, এর
জন্যে কতোখানি জবার প্রয়োজন, কতটা প্রেরণার প্রয়োজন, কোন্ যোগ্যতা, গুণাবলী
ও মান অর্জনের প্রয়োজন- এ সব জানার জন্যে, এসব শেখার জন্যেই তো আপনারা
এসেছেন। রূহানী যে সওগাতের কথা বললাম আসলে রূহানীয়াত
বলে একটি বস্তু আছে- যেটা বর্তমান কালের আহলে তাসাওউফের মধ্যে প্রচলিত। সেটাতো এক ভিন্ন জিনিস। আমি সে রূহানীয়াতের কথা বলছি না। আমি
বলছি হাকিকী রূহানিয়াতের কথা। তাহলো, এই যে, রূহের
খোরাক হচ্ছে আল্লাহর যিকির। যার
দ্বারা দেলে তাকওয়ার পয়দা হয়। এ
তাওয়াই আবার দেলের মধ্যে খোদাপ্রেম সৃষ্টি করে। খোদার জন্যে প্রেম ও ভালোবাসা সৃষ্টি হলেই তাঁর জন্যে অকাতরে জানমাল কুরবান
করার প্রেরণা সৃষ্টি হয়। মানুষের মধ্যেই দেখুন। পিতা সন্তানকে ভালোবাসে। তাকে সুখে রাখার জন্যে পিতা জীবন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। তেমনি সন্তান পিতা-মাতাকে ভালোবাসে তাদের জন্য অশেষ
দুঃখ-কষ্ট স্বীকার করতে এবং জীবন দিতে আনন্দ পায়। আবার দেখুন,
অনেক লোক তাদের রাজনৈতিক নেতাকে এতোটা ভালোবাসে যে তার
জন্যে জান-প্রাণ দিতেও প্রস্তুত হয়। আর
যিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন- সারা জাহানের মালিক, তাঁর প্রতি যদি আমাদের গভীর
প্রেম, ভালোবাসা ও ইশক্ পয়দা হয়, তাহলে তাঁর জন্যেই তো সব কিছু- জানমাল ও সকল প্রিয় বস্তু
কুরবানী করতে এতোটুকু দ্বিধা হবার কথা নয়। এই যা
কিছু বললাম- আল্লাহ যিকির,
তাকওয়া, আল্লাহর প্রেম ও ভালোবাসা- তাঁর জন্যে জীবন বিলিয়ে দেয়া, রূহের এ
ধারাবাহিক প্রক্রিয়া- এই হলো হাকীকী রূহানিয়াত। আর এ সবের জবাই হলো রূহানী সওগাত। আশা
করি আমরা সকলেই নারী ও পুরুষ- যেন এ রূহানী সওগাত নিয়ে ঘরে ফিরে যেতে পারি, যা হবে
আমাদের আগামী দিনের আল্লাহর পথে চলার পাথেয়। যা আল্লাহর পথে আমাদেরকে অবিচল রাখবে।
তাপরর আমার গতকালের বক্তব্যে যেমন বলেছিলাম যে, হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরেলভী রহ. বালাকোটে শাহাদাতের পেয়ালা পান করে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে গেলেন। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনকে তিনি আমানত হিসাবে রেখে গেলেন উপমহাদেশের উলামা সমাজের কাছে। তেমনি আমি মনে করি, সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী রহ., যাঁর লেখা, যাঁর সাহিত্য, ইসলামকে নতুন করে তার আসল রূপে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় তা পরিবেশন করার তাঁর যোগ্যতা ও ক্ষমতা যা আমাদেরকে জিহাদের ময়দানে টেনে এনেছে- সেই মাওলানা মরহুম যারা জামায়াতে ইসলামী করে এবং দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন উপায়ে, বিভিন্ন পদ্ধতিতে ইসলামী আন্দোলন করে তাদের সকলের কাছে জামায়াতে ইসলামী তথা ইসলামী আন্দোলনকে আমানতস্বরূপ রেখে গেছেন। এ আমানতের হক আমাদের আদায় করতে হবে। এ আমানতের খিয়ানত যেন আমরা না করি। আমরা যেন সঠিকভাবে তাঁর বলে দেয়া পথে অর্থাৎ খোদা ও তাঁর রাসূলের বলে দেয়া নির্দিষ্ট পথে- তিনি যে কর্মসূচি ও কর্মপন্থা বলে দিয়েছেন তা অনুসরণ করে যেন নিজের জানমাল কুরবান করার জন্য তৈরী হয়ে যাই। আমাদের আমল- আখলাকে যদি আল্লাহ খুশী হযে যান এবং তিনি যদি মনে করেন যে, হ্যাঁ, এমন একটি দল তৈরী হয়েছে যাদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা দেয়া যেতে পারে এবং সামান্যতম ক্ষমতার অপব্যবহারও তারা করবে না। আমানতদারী ও দিয়ানতদারী তারা করবে, তাহলে ইসলামী বিপ্লব কেউ রুখতে পারবে না।
আমার প্রিয় ভাই ও বোনোরা
গোটা কুরআন পাক আপনার পড়ে যান, দেখবেন
রাহমানুর রাহীম আল্লাহ তাআলা যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, মানুষকে
অত্যন্ত ভালোবাসেন,
মানুষের হিদায়াতের জন্যে যেখানে কিছু কথা বলেছেন, কিছু
নসিহত করেছেন সেখানে প্রত্যেকটি কথার সাথে তিনি বলেছেন, ইত্তাকুল্লাহ-
অর্থাৎ আল্লাহকে ভয় কর। এমনকি আল্লাহর নবীগণও এ
কথাই বলেছেন, যেমন হযরত নূহ (আ.) বলেছেন-
يَٰقَوۡمِ
إِنِّي لَكُمۡ نَذِيرࣱ مُّبِينٌ أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱتَّقُوهُ
وَأَطِيعُونِ
হে আমার জাতির লোকজন! আমি তোমাদের জন্যে একজন
সুস্পষ্ট ভাষায় সাবধানকারী (নবী)।
তোমাদেরকে (সাবধান) করে দিচ্ছি তোমরা সকলে আল্লাহর দাসত্ব কর। আল্লাহর হুকুম মেনে চল, তাকে ভয় করে চলো এবং আমার আনুগত্য করে কাজ কর।
এ তাকওয়ার কথা প্রত্যেক ব্যাপারে
অনিবার্যভাবে বলা হয়েছে। এ তাকওয়া মানে হচ্ছে
আল্লাহর ভয়।
আল্লাহর ভয় মানে হচ্ছে- একীন ও দৃঢ়
প্রত্যয় ( Firm
Coviction) এবং সেই সাথে এ অনুভূতি যে প্রতিটি মুহূর্তে সর্বত্র আল্লাহ
তাআলা আমার সাথে আছেন। তিনি হাযির ও নাযির আছেন। আমি যা কিছু প্রকাশ্যে ও গোপনে করছি তিনি তো দেখছেনই বটে, তাঁর
নিয়োজিত অফিসারগণ অর্থাৎ ফেরেশতাগণ সবকিছুর ভিডিও ফিল্ম তৈরী করছেন। কোন কিছু লুকোবার উপায় নেই। সেই সাথে এ অনুভূতি যে, এমন কিছু করবো না এবং করতে পারি না যা আমার মনীবকে নারায
করে, অসন্তুষ্ট করে। মনীব যদি বান্দাহর প্রতি নারায হয়, তাহলে
তা বান্দাহর একেবারে সর্বনাশ। তখন
তার আর কিছুই করার থাকে না। আমি এ
প্রসঙ্গে আপনাদের সামনে একটা ছোট্ট গল্প বলতে চাই। এটা হয়তো আপনারা অনেকেই জানেন। তথাপি
আপনাদের স্মরণের জন্যে আমি বলছি। এক বুযুর্গ
আলেম এ গল্পটা বলেছিলেন।
এক জায়গায় এক দরবেশ ছিলেন। এক আল্লাহর ওলী। এক
হাকিকী আল্লাহর ওলী। প্রতিদিন হাজার হাজর
মানুষ তাঁর দরবারে যেতো। তাঁর ওয়ায-নসিহত শুনতো
এবং হিদায়াতের আলো নিয়ে ঘরে ফিরতো। একবার
তিন ব্যক্তি তাঁর কাছে হাযির হলো।
বিভিন্ন জায়গা থেকে তিন ব্যক্তি। তারা
আরয করলোঃ হুযুর! আমরা আপনার কাছে কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে চাই, আপনার
ছাত্র হতে চাই। আপনার মুরীদ হতে চাই।
দরবেশ বললেন, না তোমাদের সে যোগ্যতা নেই। তোমরা আমার কাছে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারো না।
তারা কিন্তু বারবার ইসারাত করতে লাগলো। পীড়াপীড়ি করতে লাগলোঃ না হুযুর, ইনশাআল্লাহ
আমরা পারব। আপনি আমাদের আর মনযুর করুন। তিনি বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তবে তোমাদের আমি পরীক্ষা করে দেখব।
এই বলে তিনি তাদের প্রত্যেককে কিছু টাকা
দিলেন এবং বললেন,
যাও,
তোমারা প্রত্যেকে একটি করে ছাগল কিনবে। তারপর সেগুলোকে এমন স্থানে নিয়ে জবাই করবে যেন কেউ না দেখে। কারো নযরে না পড়ে। যাও।
তারা চলে গেল এবং দু'একদিন
পর ফিরে এলো। এসে একজন বললো, হুযুর!
আমি এক গহীন বনের ভেতর গিয়ে যেখানে মানুষ নেই, জনপদ নেই. এমন কি পশু-পাখীও নেই, সেখানে
ছাগলটাকে জবাই করে এসেছি।
দ্বিতীয় জন ঐ ধরনের কথাই বললো। তৃতীয় ব্যক্তি বললো, হুযুর! আমি তো জবাই করতে পারলাম
না। আমি যেখানেই যাই সেখানেই তো খোদা আমাদের
দেখে ফেলেন। আপনি তো বলেছিলেন কেউ যেন না দেখে। কোন মানুষ দেখছে না বটে, কোন পশুপাখি দেখছে না - কিন্তু
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তো দেখছেন। তাঁর
চোখকে তো আমি ফাঁকি দিতে পারি না। কাজেই
তা আমি জবাই করতে পারলাম না।
দরবেশ বললেন! তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে আমার
কাছে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
গল্পটা সত্য হোক মিথ্যা হোক, এর
মধ্যে যে বিরাট শিক্ষণীয় বিষয় আছে তাতে সন্দেহ নেই। আমরা যেখানেই যাই এবং যেখানেই থাকি, আমাদের মধ্যে এ বিশ্বাস যদি থাকে
যে, খোদা স্বয়ং আমাদের দেখছেন, আমাদের বাইরে ও ভেতর দুটোই দেখছেন এবং তাঁর অফিসারবৃন্দ
আমাদের খুঁটিনাটি সব কিছুই ভিডিও করছেন, তাহলে আমাদের কি কারো এমন সাধ্য
আছে যে এমন কাজ করবে যা আল্লাহকে নারায করবে? আল্লাহকে ভয় করে পাপ কাজ থেকে
দূরে থাকা এবং শুধু নেক কাজ করা যা আল্লাহকে খুশী করবে এই হলো তাকওয়া। এই তাকওয়া যদি বান্দাহর মনে সৃষ্টি হয়, তাহলে
তার মধ্যে খোদাপ্রেম সৃষ্টি হয়, সে খোদাপ্রেমিক হয়ে যায়। তখন খোদার জন্যে সব কিছু কুরবান করতে তার মোটেই কোন দ্বিধা হবে না। বরঞ্চ সে পরম শান্তি লাভ করবে। এ খোদাপ্রেমের জযবা পয়দা হলে মানুষ শাহাদাতের তামান্না-অভিলাষ পোষণ করে। এ শাহাদাতের তামান্নার পর যখন কেউ শহীদ হয়, হাকীকী
শহীদ এবং তার শাহাদাতের তামান্নার পেছনে অতি সামান্য পরিমাণেও কোন দুনিয়ার
স্বার্থ থাকে না। থাকে শুধুমাত্র খোদাকে খুশী করার নিয়ত, তখন শাহাদাতের
পরে তার মন একথাই বলে,
কবির ভাষায়।
جان دی دی ہوئی اسی کی
تھی
حق تو یہ ہے کہ حق ادا
نہ ہوا
জাঁ দি দি হুই উসি কি থি
হক ত ইয়ে হ্যায় কে হক আদা না
হুয়া।
আবার বলি শুনুন। যাঁরা আলিম এবং উর্দু জানেন, তাঁদের কারো জানা না থাকলে লিখে নিতে পারেনঃ
جان دی دی ہوئی اسی کی
تھی
حق تو یہ ہے کہ حق ادا
نہ ہوا
অর্থাৎ যে জানটা খোদার পথে বিলিয়ে দিলাম, সে
জানটা তো তাঁরই দেয়াছিল। এতে আমার কোন ক্রেডিট
আছে কি? এ জানতো তিনি আমার কাছে আমানত রেখেছিলেন। আমানত রাখা জিনিস আমি তাঁর কাছেই ফেরত দিয়েছি। এতে আমার বাহাদুরী কি?
কোন বাহাদুরী নেই। বরঞ্চ
হক তো ইয়ে হ্যায় কে হক আদা না হুয়া। আসল
কথা এই যে, তিনি আমাকে যে অফুরন্ত নিয়ামত দান করেছিলেন আমি তার কোন শুকরিয়া আদায় করতে
পারিনি। তাঁর কোন হ আমি আদায় করতে পারিনি। এই হচ্ছে হাকীকী খোদাপ্রেম- এই হচ্ছে ইশকে ইলাহী। এটা পয়দা হতে পারে হাকীকী তাকওয়ার মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এ দুটো অর্জন করার তাওফীক দান করুন।
আমি গতকাল বলেছিলাম যে, মাওলানা
মওদূদী রহ.ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের ব্যক্তিগত গুণাবলী কি হওয়া দরকার এ প্রসঙ্গে
ইসলামী জমিয়তে তালাবার এক শিক্ষা শিবিরে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, এক
নম্বরের গুণ হচ্ছে মুজাহাদায়ে নফস। নফসের
সাথে সংগ্রাম। আপনারা জানেন, নবী করীম সা. সমগ্র জিহাদ শেষ
হওয়ার পর সাহাবীদের বলেন,
এসো এখন আমরা জিহাদে আসগার থেকে জিহাদে আকবারের দিকে ফিরে
যাই।
তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, হে
আল্লাহর রাসূল! জিহাদে আকবার আবার কোনটা?
তিনি বললেন—নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ।
এখন প্রশ্ন এর আগে কি তাঁরা নফসের বিরুদ্ধে
জিহাদ করেন নি? অবশ্যই। নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করে বিজয়ী হয়েই তারা
সশস্ত্র জিহাদ করতে পেরেছেন। তা না
হলে তো এসব করতে পারতেন না।
কারণ যে নফসটা খোদাদ্রোহী হয়ে আছে, সে নফস তো
আপনাকে কিছুতেই খোদার পথে চলতে দেবে না। নফস তো এক বাতিল খোদা।
বাতিল খোদা যতো হতে পারে অর্থাৎ এমন সব শক্তি
ও সত্তা যেসব মানুষকে খোদার গোলাম হতে না দিয়ে নিজেদের গোলাম বানিয়ে নেয়, এসব
বাতিল খোদা False
gods বা Demi
gods -তাদেরকে প্রধানত পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। বাপ-দাদার প্রচলিত ভ্রান্ত রেসম রেওয়াজ ও কুসংস্কার। তাই সর্বযুগে নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে বিরোধীরা
বলেছেঃ
مَا
أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَ
আমাদের বাপ-দাদাকে আমরা যেমন করতে দেখেছি
আমরা তো তাই করব। বাদ-দাদার অন্ধ অনুসারীগণ সকল নবীর সময়ে এ
কথাটা বলেছে। দুই নম্বর হচ্ছে ধন-দৌলত। তারপর সন্তানাদি।
ধনদৌলত ও সন্তানাদিকে ফেত্না বলা হয়েছে-
অর্থাৎ মানুষের জন্য অগ্নিপরীক্ষা।
إِنَّمَا
أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ لَّكُمْ
চার নম্বর হচ্ছে গোমরাহ, পথভ্রষ্ট
ও খোদাদ্রোহী নেতা। সে রাজনৈতিক নেতাও হতে পারে এবং তথাকথিত
ধর্মীয় নেতাও হতে পারে। এ সব রাজনৈতিক নেতার এমন
সব অতি অনুগত বান্দাহ আছে যেমন অনুগত মানুষ আল্লাহর হয় তাদের নির্দেশে এমন কোন
অপকর্ম নেই, এমন কোন সাংঘাতিক কাজ নেই, যেমন হত্যা, লুট, ব্যভিচার
ইত্যাদি যা তারা করতে পারে না। বরঞ্চ
করতে তারা আনন্দ পায়,
কারণ এতে তাদের মনীব খুশী হয়। পথভ্রষ্ট ও পথভ্রষ্টকারী ধর্মীয় নেতাদের অনুসারীদের অবস্থাও তাই। আল্লাহ বলেন, তারা তাদের পীর-ওলী দরবেশকে
আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের খোদা বানিয়ে নিয়েছে। এসব ভ্রান্ত নেতা ও তাদের অনুসারীদের পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ
اذْ
تَبَراً الَّذينَ اتَّبِعُوا مِنَ الَّذينَ اتَّبَعُوا وَرَاوُ الْعَذَابَ وتقطعت الأسْبَابُ
وَقَالَ الَّذِينَ اتَّبَعُوا لَوْ أَنَّ لَنَا كَرَّةً فَنَتَبَرًا مِنْهُمْ كَمَا
تَبَرَّءُوا مِنَّا ط كَذَالِكَ يُرِيهِمُ اللَّهُ أَعْمَالَهُمْ حَسَرَاتِ عَلَيْهِمْ
وَمَا هُمْ بِخَارِجِينَ مِنَ النَّارِ
দুনিয়াতে যে সব নেতার অনুসরণ করা হয়, তারা
তাদের অনুসারীদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষণা করবে, এবং তা
সত্ত্বেও তারা অবশ্যই তারা বলবে, হায়! শাস্তি পাবে। আর
দুনিয়ায় যারা তাদের অনুসরণ করতো, আমাদের যদি আবার সুযোগ দেয়া হতো। তাহলে আজ এরা যেমন আমাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজেদের
দায়িত্বমুক্ত থাকার কথা বলছে, আমরাও তাদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দেখিয়ে দিতাম। তারা দুনিয়াতে যা কিছু করেছে তা এমনভাবে আল্লাহ তাদের
সামনে উপস্থিত করবেন যে তারা শুধু লজ্জিত ও দুঃখিত হবে। কিন্তু জাহান্নাম থেকে বেরুবার কোন পথ তারা খুঁজে পাবে না। (বাকারাহঃ ১৬৬-৬৭)
হাশরের মাঠে দু'ধরনের
মানুষই হবে। যারা দুনিয়ায় নেতৃত্ব দিয়েছে এবং যারা তাদের
অনুসরণ করেছে। ভ্রান্ত নেতৃত্ব ও তার অনুসরণকারীদের পরিণাম
বলে দেয়া হয়েছে।
পঞ্চম নম্বরের বাতিল খোদা হচ্ছে নফস। এ পাঁচ প্রকারের বাতিল খোদার মধ্যে নফস হচ্ছে প্রধান খোদা। নফ্স্ যে মানুষের খোদা হতে পারে এ কথা কুরআনেই বলা হয়েছে
أَفَرَأَيْتَ
مَن التَّخَذَ الهَهُ هَوَاهُ
নফসকে বা প্রবৃত্তিকে যারা খোদা বানিয়ে
নিয়েছে, তারা তার হুকুমেই চলে। এ
নফসের সাথে মুজাহাদা করে,
সংগ্রাম করে একে বশীভূত করতে হবে। নফসকে খোদার ফরমাবরদার-অনুগত বানাতে হবে। তাছাড়া তো আমরা খোদার পথে এক পাও অগ্রসর হতে পারব না।
আমরা ছোটো বেলায় আরবী সাহিত্যে পড়েছিলামঃ
أَشَدُّ
الجهاد جهاد الْهَوَى وَمَا كَرُمَ الرِّءَ الدَّ التَّقْوَا
সবচেয়ে বড়ো জিহাদ হলো নসের বিরুদ্ধে জিহদ
এবং তাওয়া ছাড়া আর কোন কিছু মানুষকে সম্মান দান করতে পারে না।
এই যে গতকাল নামায প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে
বলেছিলাম যে, বান্দাহ যখন সূরা ফাতিহা পড়ে, তখন তার মনের অবস্থা কি হয় বা
কি হওয়া উচিত। আমরা বোধ হয় সে সব ভুলে যাচ্ছি। আমাদের আত্মসমালোচনা করে দেখা দরকার। আমি শ্রদ্ধেয় উলামায়ে কিরামকে বলি, এই যে সূরা ফাতিহা পড়া সম্পর্কে
মুসলিম শরীফের হাদীসটি তা কি সহীহ হাদীস নয়? তা কি নবী সা. এমনি একটি
গল্পচ্ছলে বলেছিলেন?
তা তো নয়। আসল
সত্য কথা এই যে,
বান্দাহ একটা কথা বলছে আর আল্লাহ তার জবাব দিচ্ছেন। বান্দাহ বলছে আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ'লামীন-আল্লাহ
তার একটা জবাব দিচ্ছেন। তাহলে অন্তত দিলের কাজে
জবাবটা শুনা দরকার যা আল্লাহ দিচ্ছেন। এমনি
করে আপনি একটি কথা বলবেন। আল্লাহ তার জবাব দিবেন। তা আপনি দিলের কানে শুনবেন। এতে একটা তৃপ্তি,
একটা আনন্দ, একটা প্রশান্তি আপনার হবে। সূরা ফাতিহাকে আস্সবাউল মাসানী السَّبْعُ
المَثَانِي এ বলা হয়েছে। অর্থাৎ নামাযে বার বার পঠিতব্য সাতটি আয়াত। এ সাতটি আয়াত ধীরে ধীরে থেমে থেমে সাত বারে পড়তে হয়। তা না করে যদি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি সাতটি আয়াত, তাহলে
কি হবে? অনেকে ৪-৫ আয়াত বানিয়ে নেয়। এখানে
আমাদের মনটা কোথায় থাকে?
প্রতিটি শব্দের সাথে মন আপনার আমার থাকছে কিনা। সুন্দরভাবে থেমে থেমে আমরা সূরা ফাতিয়া পড়ছি কিনা, এটা
চিন্তা করা দরকার।
আমি আমার জীবনে সর্বপ্রথম যখন মাওলানা মওদূদী
রহ.এর পেছনে নামায পড়ি,
তখন শুনেছি তিনি সূরা ফাতিহাকে থেমে থেমে সাত বারে পড়েছেন। তাঁর মিষ্টি আওয়াজে ধীরে ধীরে এমনি নামায পড়াতে শুনে যে কি
আত্মতৃপ্তি লাভ করেছিলাম-সুবহানাল্লাহ। আল্লাহ
তাঁর মর্যাদা বাড়িয়ে দিন।
এটা তখনই হতে পারে যখন আপনার আমার নফ্স্
আল্লাহর ফরমাবরদার ও অনুগত হবে এবং নামাযে সাহায্য করবে। মনটাকে নামায থেকে টেনে টেনে কোথাও নেবে না। এজন্যে নফসের মুজাহাদা সর্বপ্রথম দরকার। যে গুণগুলো আল্লাহ তাআলা চান, তা পয়দা করার জন্যে নফসের
মুজাহাদা দরকার। তা না হলে আমাদের নামায ঠিক নামাযের মতো হবে
না-আর নামায যদি নামাযের মতো না হলো তো এমন আর কি ইবাদত আছে যার মাধ্যমে আমরা
নাজাত পেতে পারি?
কেউ বলতে পারেন- আমরা ইসলামী আন্দোলন করছি। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করছি। তার জন্যে জীবন দিতে প্রস্তুত আছি। নামায সেরকম নাইবা হলো, এতেই তো আল্লাহ আমাদেরকে মাফ করে দেবেন। কিন্তু একথা তো হাদীসেও আছে যে- আখেরাতে প্রথম পরীক্ষা
আপনার আমার যেটা হবে-তা নামাযের পরীক্ষা। একথা
কি ঠিক নয়? এর প্রথম পরীক্ষায় যদি পাশ করি তারপর পরবর্তী পরীক্ষা তুমি আল্লাহর দ্বীন
প্রতিষ্ঠার জন্যে কতখানি চেষ্টা করেছ- এ প্রশ্ন আসবে। প্রথম পরীক্ষায় পাশ করলেই তো পরবর্তী পরীক্ষা সহজ হবে। কিন্তু প্রথম পরীক্ষায় যদি আমরা ফেল করি তাহলে কি গতিটা হবে?
অতএব এ জন্যে আমাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে। এজন্যে কঠোর পরিশ্রম আমাদের করতে হবে।
তারপর দেখুন, আমরা ৫ ওয়াক্ত নামায পড়ি। ফরয ও সুন্নাত যদি একত্রে ধরা হয়-ফজরের চার রাকাআত, যোহরের
দশ, আসরের চার, মাগরিরেব পাঁচ এবং এশার বেতেরসহ (বেতেরকে কেউ সুন্নাত বলেছেন- আমাদের হানাফী
মতে ওয়াজিব) নয় রাকাআত। একুনে বত্রিশ রাকাআত। বত্রিশ রাকাআত নামায চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে। এই বত্রিশ রাকাআত নামাযের জন্যে যদি প্রয়োজন হয় একটি
ঘন্টার- একেবারে খুশূ ও খুযূ- একাগ্রতা ও বিনয়, নম্রতাসহ, কাওমা, জলসা, তা’দিলে
আরকান ঠিকমত আদায় করে,
প্রতিটি শব্দেরই অর্থের দিকে খেয়াল করে যদি পুরোপুরি একটি
ঘন্টা চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আমরা ব্যয় করতে পারি, তাহলেই ত কামীয়াব হয়ে যাচ্ছি। আর তা যদি না পারি, এ একটি ঘন্টা যদি আমাদের নফসকে
আমরা বশ করতে না পারি,
নফসকে যদি আমরা নামাযে হাযির করতে না পারি, তাহলে
সবই বৃথা গেল। তারপর সিজদায় গিয়ে যখন আমরা অনুভব করব যে, আল্লাহর
নৈকট্য লাভ হচ্ছে এবং আল্লাহর নৈকট্যের একটা স্বাদও উপভোগ করছি- তখন তো সিজদা থেকে
মাথা উঠতেই চাইবে না। এটা তখনই হতে পারে যখন
আমাদের নফ্স্ আল্লাহর অনুগত হয়েছে। আল্লাহ
তাআলা আমাদেরকে এ সব হাসিলের তাওফীক দান করুন।
এরপর আমরা বলে থাকি যে, আমাদের
আসল লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর রেযামন্দি হাসিল করা, সন্তুষ্টি অর্জন করা। অর্থাৎ আখেরাতে তাঁর সন্তুষ্টি হাসিল ও নাজাত লাভের জন্যে
দুনিয়াতে তাঁর হুকুম পালন আমরা করছি, তাঁর দীন গালিব করার- বিজয়ী
করার চেষ্টা করছি। এসব Means not end। আসল
লক্ষ্য কিন্তু আল্লাহর রেযামন্দি, তাঁর খোদি- তাঁর সন্তুষ্টি। এর জন্যে ইখলাসের প্রয়োজন।
লিল্লাহিয়াতের প্রয়োজন। এর মানে হচ্ছে আল্লাহর
সন্তুষ্টির সাথে সামান্যতম আর কোন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নেই। আল্লাহ তাআলা যখন বলেছেনঃ
ادْخُلُوا
فِي السِّلْمِ كَافَّةً.
তখন পুরোপুরিই মুসলমান হতে হবে। ষোল আনা মুসলমান হতে হবে। পৌনে ষোলআনা মুসলমান হওয়া আল্লাহ পছন্দ করেন না। ঠিক তেমনি আল্লাহ তাআলা আপনার আমার কাছে পুরোপুরি ইখলাস চান। ১০০% ইখলাস চান। ৯৯%
ইখলাস আছে এবং তার সাথে ১% দুনিয়াবী স্বার্থ আছে তাহলে এই ৯৯% ইখলাস আল্লাহর কাছে
একেবারে অগ্রহণযোগ্য-রিজেকটেড মাল।
গতকাল খয়বরের যুদ্ধ সংক্রান্ত একটি হাদীস
আমি বলেছিলাম। একজন খোদার রাহে জীবন দিয়েও জান্নাতে যেতে
পারলো না। কেন? তার এতো ইখলাস থাকা সত্ত্বেও-
৯৯% ইখলাসের সাথে হয়তো ১% সামান্য কিছু দুনিয়াবী স্বার্থ ছিল। তো এ জন্যে তার সমস্ত ইখলাসকে আল্লাহ তাআলা একেবারে Reject করে
দিলেন। অতএব আমরা যা কিছু করব, তার চরম
ও পরম লক্ষ্য হবে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করা। নবী সা. বলেছেন-
مَن
أحبَّ للَّهِ وأبغضَ للَّهِ ، وأعطى للَّهِ ومنعَ للَّهِ فقدِ استَكْملَ الإيمانَ
যে ভালোবাসলো আল্লাহর জন্যে, শত্রুতা
করলো আল্লাহর জন্যে,
কাউকে দিল আল্লাহর জন্যে, এবং কাউকে না দিলেও তা আল্লাহর
জন্যে, সে তার ঈমানকে পূর্ণতা দান করলো।
আপনি কাউকে যদি ভালোবেসে থাকেন, তার
সাথে বন্ধুত্ব করে থাকেন,
তাহলে তা হতে হবে একমাত্র আল্লাহর রেযামন্দির জন্যে, সন্তুষ্টির
জন্যে। এ জন্যে নয় যে, আপনি
বিপদে তার কাছে সাহায্য পাবেন। অথবা
আপনি মরে গেলে তারা আপনার সন্তানদের দেখাশুনা করবে। এরূপ কোন দুনিয়াবী উদ্দেশ্যে নয়- বরঞ্চ স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে
তাঁর সাথে বন্ধুত্ব করলে আল্লাহ তাআলা খুশী হবেন। আর কারো সাথে দুশমনী যদি করতে হয় তা আল্লাহর জন্যেই। নিছক কোন ব্যক্তিগত স্বার্থে আপনি কাউকে দুশমন বানাতে পারেন না। আমি একটি ঘটনা বলব, যা আপনারা জানেন। আমি কিন্তু এমন কোন কথা বলছি না যা আপনারা জানেন না। আমি আপনাদের থেকে সবচেয়ে বড়ো একজন আলেম, বড়ো
জ্ঞানী, বড়ো মুত্তাকী,
পরহেযগার- তাও নই।
আপনাদেরই মতো একজন। বরঞ্চ আপনাদের অনেকের চেয়ে অধম। আমি শুধু আপনাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আপনারা এ ঘটনা হয়তো জানেন যে, হযরত
আলী রা. এর সাথে হঠাৎ পথে এক কাফেরের সাথে লড়াই হয়। হযরত আলী রা. কাফেরকে মাটিতে ফেলে দিয়ে তার বুকের উপর উঠে বসেন। তারপর তাকে কতল করবেন এমন সময় বাঁচার কোন আশা নেই মনে করে
কাফেরটি হযরত আলীর রা. মুখে থুথু ফেলে দিল। তখন
হযরত আলী রা. তাকে ছেড়ে দিলেন। সে অতি
বিস্ময়ে বললো, আলী! একি ব্যাপার?
তুমি আমার বুকের উপর উঠে বসেছ। আমাকে কতল করে ফেলবে। কিন্তু
তুমি আমাকে ছেড়ে দিলে কেন?
তিনি বললেন, দেখ তোমার সাথে আমার ব্যক্তিগত
কোন শত্রুতা নেই। তুমি আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও ইসলামের দুশমন। তাই তুমি আমার দুশমন। সেজন্যেই তোমাকে কতল করতে যাচ্ছিলাম। যখন
তুমি আমার মুখে থুথু দিলে,
তখন আমার ব্যক্তিস্বার্থে আঘাত লাগলো। এরপর তোমাকে কতল করলে তো তা আল্লাহর জন্যে হলো না। আমার লক্ষ্য ব্যর্থ হবে, এজন্যে তোমাকে ছেড়ে দিলাম।
এটাই হচ্ছে সত্যিকার লিল্লাহিয়াত, সব কিছু
আল্লাহর জন্যে। কাউকে কিছু দিলে আল্লাহর জন্যেই দিতে হবে। দেয়ার থেকে হাত গুটিয়ে রাখলে তার পেছনেও থাকবে আল্লাহর
রেযামন্দি। নবী সা. বলেন, এই লিল্লাহিয়াত যার, এই
চরিত্র যার, এই লক্ষ্য যার— সেই
‘ইস্তাকমালাল্ ঈমান'- ঈমানকে পূর্ণতা দান করেছে। কামালিয়াত দান করেছে।
আমার প্রিয় ভাই ও বোনেরা
সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে এবং যে নির্দিষ্ট সময়
তা শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কথা তো বলার অনেক
আছে যা বলতে আমি পারছি না। একটি
কথা আমাকে অবশ্যই বলতে হচ্ছে। সেটা
হলো এই যে, বাতিলপন্থীরা আমাদের জামায়াতে ইসলামীকে, ছাত্র শিবিরকে তাদের অস্তিত্বের
জন্যে অত্যন্ত বিপজ্জনক মনে করে। তার
জন্যে প্রায়ই আমাদের উপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করে এবং প্রায় ষাটজন- একেবারে
সঠিক সংখ্যা আমার জানা নেই,
কিছু বেশী বা কমও হতে পারে- তারা হত্যা করেছে। এ ব্যাপারে আমার মতে আমরা একটা ভুল করছি। এর জন্যে আমরা তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হচ্ছি। তার জন্যে কত বিক্ষোভ, মিছিল, প্রতিবাদ, সমাবেশ
ইত্যাদি আমরা করছি। এর একশ' ভাগের এক ভাগও যদি আমরা আল্লাহর
আদালতে ধরনা দিতাম,
তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকেই বিচার হয়ে যেতো। আমি আপনাদেরকে একটা সত্য ঘটনা বলতে চাই। ১৯৬৩ সালে লাহোরে, নিখিল পাকিস্তান জামায়াতে
ইসলামীর সম্মেলন হয়েছিল। সেখানে আমি তো ছিলামই, আমার
জানা মতে সেখানে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে এখানে উপবিষ্ট মাওলানা ইউসুফ এবং জনাব
শামসুর রহমান সাহেব আরও হয়তো অনেকে ছিলেন, যাঁদের এখানে দেখছিনা। সে সম্মেলনকে লক্ষ্য করে জামায়াতে ইসলামীকে খতম করার একটা
ষড়ডন্ত্র করেছিলেন আইয়ুব খান। এ
উদ্দেশ্যে পাঞ্জাবের গভর্নর কালাবাগের নবাব আমীর মুহাম্মদ খানকে দায়িত্ব দেয়া
হয়। প্রায় দশ হাজার ডেলিগেট বিভিন্ন স্থান থেকে
এসেছেন। উন্মুক্ত উদ্বোধনী অধিবেশন ছিল বলে প্রায়
পঞ্চাশ হাজার মানুষের সমাবেশ।
মাওলানা মওদূদী উদ্বোধনী ভাষণ দেয়া শুরু করেছেন। সরকার কর্তৃক
লেলিয়ে দেয়া মদ খেয়ে মাতাল হওয়া কিছু গুণ্ডা-বদমায়েশ
রিভলবার হাতে আমাদের কর্মীদেরকে ধাক্কা দিয়ে সরাসরি প্যান্ডেলের ভেতরে চলে আসে। সামনে অগ্রসর হয়ে দু'এক রশি দূর থেকে সে পট্ পট্ করে
মাওলানাকে লক্ষ্য করে গুলী ছুঁড়তে থাকে। তখন
চারদিক থেকে আওয়াজ উঠছে— মাওলানা! বসে পড়ুন- মাওলানা! বসে পড়ুন। কিন্তু আল্লাহর মুজাহিদ নিৰ্ভীক বান্দাহ বুক ফুলিয়ে
দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বলেছেন- আগার মাই বয়ঠ যাঁও ত খাড়া
রাহে কৌন? যা হোক, তাদেরকে জোর করে প্যান্ডেল থেকে বের করে দেয়া হয়। ওদিকে প্যান্ডেলের বাইরে তারা আল্লাহ বখ্শ্ নামে এক জামায়াত কর্মীকে খুন করে। আরও অনেক ভাঙচুর করে। লাহোরে জামায়াতের ক্যাম্প, বহু স্টল, পুস্তকের দোকান তছনছ ও লণ্ডভণ্ড করে।
অনেকে মাওলানাকে বলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা
দায়ের করতে। মাওলানা বলেন, আমি তো মামলা দায়ের করেছি সেই
সর্বোচ্চ আদালতে যেখান থেকে প্রকৃত সুবিচার হবে ইনশ আল্লাহ। এ এক ইতিহাস যে তিন মাস যেতে না যেতেই আল্লাহর আদালতে মাওলানা যে মোকাদ্দমা
দায়ের করেছিলেন তার ফলে ঐ কালাবাগের নবাব তাঁর আপন পুত্রের গুলীতে প্রাণ হারান। সুবহানাল্লাহ। আল্লাহ
বলেন-
يريدُونَ
أَنْ يَتَحَاكَمُوا إلى الطَّاغُوتِ وَقَدَ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا به
তারা তাগুতের কাছে বিচার-ফায়সালার জন্যে
যায় অথচ তাদেরকে বলা হয়েছে তাগুতকে অমান্য ও অস্বীকার করার জন্য। (আন নিসা-৬০)
আমরা বাতিলের কাছে বিচারের জন্যে মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ
সভা ইত্যাদিতে আমাদের শ্রম ও অর্থ নষ্ট করছি কেন? আচ্ছা ঠিক আছে কিছু না হয় করলাম। কিন্তু কত পরিমাণ আল্লাহর দরবারে ধরনা দিচ্ছি? তাঁর দরবারে
যদি আমরা ধরনা দিতাম এই বলে যে, হে আল্লাহ! এ বিচারের ভার তোমাকে দিলাম। তাহলে আরশে পাক থেকে সঠিক বিচার আসতো। বিষয়টি ভেবে দেখার জন্যে সকলকে অনুরোধ করছি।
কথা আমি শেষ করেছি। আমাদের মধ্যে ঈমানী জযবা অবশ্যই থাকবে। জিহাদী
জযবা থাকবে। সেই সাথে থাকবে পুরোপুরি শাহাদাতের তামান্না।
শাহাদাত শব্দের অর্থ সাক্ষ্যদান। আপনি যে আল্লাহ তাআলার হাকীকী বান্দাহ। আপনি যে প্রতি মুহূর্তে তাঁর হুকুম পালন করে চলেছেন, বাস্তব
জীবনে তাঁর সাক্ষ্য দিচ্ছেন, এটাই ত শাহাদাত। এমন কি
আপনি আপনার জীবন দিয়েও এ সাক্ষ্য দিলেন যে, আপনি আল্লাহর অনুগত বান্দাহ। সাধারণত ইসলামের শত্রুর মুকাবিলা করতে গিয়ে যে মারা গেল, নিহত
হলো, তাকে আমরা শহীদ বলে থাকি। কিন্তু শাহাদাতের তামান্না আপনারআছে প্রকট এবং আল্লাহর হুকুম পালন করে যাচ্ছেন। প্রতিটি মুহূর্তে আপনি সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, আপনি আল্লাহর
একজন প্রকৃত অনুগত বান্দাহ। এর
পরেও আল্লাহ তাআলা আপনাকে বিছানায় স্বাভাবিক অবস্থায় আপনার মৃত্যু ঘটিয়ে আপনাকে
শাহাদাতের মর্যাদা দিতে পারেন। কয়েক
মিনিটের মধ্যেই এ বিষয়ে একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করব। একটু সবর করুন।
নবম হিজরীতে নবী করীম সা. ত্রিশ হাজার
মুজাহিদীন নিয়ে তবুকের অভিযানে রওয়ানা হয়েছেন। সঙ্গে তাঁর জাননেসার সাহাবীগণ। এর
জন্যে তাঁরা অকাতরে অর্থদান করেছেন। হযরত
উমর রা. তাঁর গোটা সম্পদ দু'ভাগ করে একভাগ নিজের জন্য রেখে আর এক ভাগ আল্লাহর জন্যে
দিয়েছেন। হযরত আবু বকর রা. সকলের উপরে বাজিমাত করলেন। তাঁর সমুদয় অস্থাবর সম্পদ একেবারে sweep করে
ঝেড়েমুছে নিয়ে এলেন। নিশ্চয় তখন কোন ট্রাক
বা ঠেলা গাড়ি ছিল না। নিয়ে এলেন উটের পিঠে
করে। যে কেউ তা দেখলেই বলবে যে, তাঁর
ঘরে একটা সুঁই-সুতাও নেই। তা দেখে নবী সা. বলে
উঠলেন-
مَا
أَبْقَيْتَ لَأَهْلِكَ يَا أَبَا بَكْرٍ
আবু বকর! তোমার পরিবারের জন্যে কি রেখে এসেছ? জবাবে
তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাম ছাড়া আর কিছু নেই। যা হোক, তাঁরা সকলেই চলেছেন তবুকের দিকে। হঠাৎ পথিমধ্যে নবীর সামনে হাযির হলেন খোদার ইশকে পাগল এক মুজাহিদ আব্দুল্লাহ
যুল বাজাদাইন। তিনি কিছুকাল আগে মুসলমান হয়েছেন। তিনি অত্যন্ত আবেগ ভরা কণ্ঠে আরয করলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ। আপনি একটু হাত তুলে দোয়া করুন! আমি যেন কাফেরদের হাতে
শহীদ হতে পারি।
নবী সা. বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, দেখ তো
দুধারের কোন গাছ থেকে একটু ছাল আনতে পার নাকি। ছাল নিয়ে আসার পর নবী তাঁর হাতে বেঁধে দিয়ে দোয়া করলেন ঃ পরওয়ারদেগার। তুমি আবদুল্লাহর খুন কাফেরদের জন্যে হারাম করে দাও।
আবদুল্লাহ চিৎকার করে বলে উঠলেন, ইয়া
রাসূলাল্লাহ আপনি এ কি দোয়া করলেন? আমি তো শহীদ হতে চাই।
নবী সা. বললেন, আবদুল্লাহ তোমার শাহাদাতের
তামান্না আল্লাহ কবুল করেছেন। তুমি
যদি জ্বর হয়েও মর তাহলে তুমি হবে হাকীকী শহীদ।
সকলে তবুকে পৌঁছে গেলেন। সেখানে তাঁরা মতান্তরে বিশ, পঁচিশ অথবা এক মাস অবস্থান করেন। প্রতিপক্ষ না আসায় কোন যুদ্ধ হয়নি। যা হোক, সেখানে পৌছার
পর একদিন নবীর কাছে খবর এলে- খোদা-প্রেমে পাগল সেই আবদুল্লাহ যুলবাজাদাইন জ্বরে
মৃত্যুবরণ করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
নবী পাক সা. বললেন- তাড়াতাড়ি দাফনের
ব্যবস্থা কর। দাফনের ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন হযরত আবদুল্লাহ
বিন মাসউদ রা.। তিনি বলেন, কবরের পাশে সকলে সমবেত। রাত্রিবেলা। হযরত
বেলাল রা. মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।
মাইয়েত নেয়ার জন্যে একজন কবরে দাঁড়িয়ে আছেন। দু'জন মাইয়্যেত কবরে নামিয়ে দিচ্ছেন। কবরে
দাঁড়ানো ব্যক্তি যাঁরা মাইয়েত নামিয়ে দিচ্ছেন তাদেরকে ধমকের সুরে বলছেন-
ادبا
إلى أخي كُمَا
তোমাদের ভাইকে আদবের সাথে নামাও।
কবরে দাঁড়ানো ব্যক্তি ছিলেন স্বয়ং রহমতের
নবী সা. এবং যাঁরা মাইয়্যেত নামিয়ে দিচ্ছিলেন তাঁদের একজন নবীর পর সবচেয়ে উত্তম
ব্যক্তি হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা., দ্বিতীয় জন হযরত উমর ফারুক রা.।
নবী পাক সা. মাইয়েতকে কবরে শুইয়ে উপরে উঠে
বললেন- তোমরা সব সরে যাও।
সাহাবীগণ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে চারিদিকে সড়ে
দাঁড়ালেন। হুযুর সা. তাঁর হস্ত মুবারক দিয়ে চারদিকের
বালু পাথর দিয়ে কবর ঢাকলেন। অতঃপর
হাত তুলে দোয়া করলেন ঃ পরওয়ারদেগার! আমি আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত আবদুল্লাহর প্রতি
রাযী ছিলাম। তুমি রাযী হয়ে যাও।
রাবী হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) বলেন, হুযুর সা.
যখন এ দোয়া করলেন,
তখন আমার মুখ থেকে আপনাআপনি এ কথা বেরিয়ে পড়লো- হায়রে, এ কবরে
আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইন না হয়ে যদি আমি আবদুল্লাহ হতাম।
আমার প্রিয় ভাই ও বোনেরা
আমি আর কথা বাড়াতে চাই না। আপনাদের কাছে বোরিং হতে পারে। সেজন্যে কথা এখানেই শেষ করছি। আমি যে
কি বললাম জানি না। আল্লাহ পাক আমাকে যা বলালেন বললাম। এ সব যদি আল্লাহর মনোমত কথা হয়, তাহলে
প্রতিটি দিলে গেঁথে রাখার এবং সেভাবে সারা জীবন আমল করার তাওফীক আল্লাহ তাআলা দান
করুন- আমীন।
وَآخَرُ دَعْوَانَا أن الْحَمْدُ لله رَبِّ الْعَالَمِينَ.
No comments:
Post a Comment
আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।