ভাষা আন্দোলন
(শহীদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির সেল থেকে দেখা বাংলাদেশ
বই থেকে)
ভাষা আন্দোলন এ দেশের ইতিহাসে এক বিরাট
অধ্যায়। বাংলা আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা। মাতৃভাষার প্রতি মানুষের টান বা ভালোবাসা
সহজাত। আজ প্রায় ৩০ কোটির মতো মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। বাংলা জনসংখ্যার
বিবেচনায় বিশ্বের ৭ম ভাষা। বাংলা ভাষাভাষীরা আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা
ও মেঘালয়ে কোটি কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা
দেওয়ার দাবিতে আন্দোলনে জীবনদানের উল্লেখযোগ্য ঘটনা একমাত্র বাংলাদেশেই ঘটেছে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের অপরিণামদর্শী ভূমিকার কারণে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি
মাসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিলে গুলিতে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর।
পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পরপরই অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্র ‘তমদ্দুন মজলিস' নামক একটি সংগঠনের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন শুরু করেন। পরে অবশ্য অন্যরাও এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। প্রথমে ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলন হয় ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে এবং ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক ঘটনা।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে এলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, সেখানে যে স্মারকলিপি দেওয়া হয়, সেটা পাঠ করেন ডাকসুর তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক গোলাম আযম। সেই স্মারকলিপিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও নৌবাহিনীর সদর দফতর স্থাপনসহ অনেক দাবিদাওয়া স্থান পেয়েছিল। স্মারকলিপিটি রচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবদুর রহমান চৌধুরী (পরবর্তীকালে বিচারপতি)। রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি আদায়ের জন্য সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল। মওলানা ভাসানী, ড. নুরুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব, আতাউর রহমান খান বিভিন্ন সময় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তা ছাড়া ভাষা আন্দোলনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেন অলি আহাদ, আবদুল মতিন, মোহাম্মদ তোয়াহা প্রমুখ ।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার সময় শেখ
মুজিবুর রহমান ছিলেন ফরিদপুর কারাগারে। ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে তার প্রত্যক্ষভাবে
ভূমিকা পালনের সুযোগ হয়নি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগেই সরকার ১৪৪ ধারা জারি
করে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ব্যাপারে ছাত্রদের মধ্যে ছিল তীব্র উত্তেজনা। আওয়ামী মুসলিম
লীগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ১৪৪ ধারা না ভাঙার । ২১ ফেব্রুয়ারির সকালেই আওয়ামী
মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গিয়ে
ছাত্রনেতাদের জানিয়ে দিয়ে আসেন, আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে নয়। এ
সিদ্ধান্তে ছাত্রনেতারা ক্ষুব্ধ হয় এবং অলি আহাদসহ ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে ১৪৪
ধারা ভঙ্গের সাহসী ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ৷
কমিউনিস্টরা বিশেষ করে সংস্কারপন্থি কমিউনিস্টরা ভাষা আন্দোলনের ধারেকাছে আসেনি। তবে ব্যক্তিগতভাবে আবদুল মতিন ও মোহাম্মদ তোয়াহা ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং আবদুল মতিন ভাষা আন্দোলনের একজন জ্ঞানবান কর্মী ছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন চলাকালে এর সমর্থনে একটি বিবৃতির জন্য তাজউদ্দিন আহমেদ সাইকেল চালিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে গিয়েছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলন, তাই কোনো আঞ্চলিক ইস্যুতে বিবৃতি দেবে না—এই যুক্তিতে তারা বিবৃতি দিতে অস্বীকার করেছিল সেদিন। উপমহাদেশের আজাদি আন্দোলনেও কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা অস্পষ্টই ছিল। মস্কোর ইশারা ছাড়া তারা কোথাও কোনো ভূমিকা পালন করেনি। অনুশীলন সংঘ তথা সূর্যসেনরা ব্রিটিশবিরোধী যে আন্দোলন করেছিলেন, সেগুলো ছিল স্থানীয় আন্দোলন এবং অনেকটাই বিক্ষিপ্ত ও ব্যক্তি প্রচেষ্টার ফসল। উপমহাদেশের আজাদি যখন দোরগোড়ায় এবং ব্রিটিশ দখলদাররা ভারতের স্বাধীনতা দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে, তখন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি আজাদি আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তাদের স্লোগান ছিল—‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়' ।
যে ভাষা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের তেমন কোনো ভূমিকাই ছিল না, বায়ান্নর পর থেকে তারা সেই ভাষা আন্দোলনকে ছিনতাই করে এবং তাবৎ কৃতিত্ব দাবি করতে থাকে। ইসলামপন্থিরাই সে আন্দোলনের সূচনা করেছে এবং নেতৃত্ব দিয়েছে, তারা ইতিহাস থেকে ৬০-এর দশক থেকে একেবারেই ছিটকে পড়ে। কমিউনিস্টরা তাদের লোকদের ভাবমর্যাদা বৃদ্ধি করার জন্য ১৯৫২ সালে হাফপ্যান্ট পরত বা স্কুলে পড়াশোনা করত কিংবা ঘটনাক্রমে ভাষা আন্দোলনের
মিছিল দেখতে গিয়েছিল অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে সেদিন ক্যাম্পাসে
উপস্থিত ছিল, তাদেরকে পর্যন্ত
‘ভাষাসৈনিক’, ‘শব্দসৈনিক’ ইত্যাদি নানা বিশেষণে পরিচিত
করেছে নতুন প্রজন্মের সামনে। মফস্বল শহরে ছিল, হয়তো-বা কোনো একটা মিছিলে বুঝে
হোক বা না বুঝে হোক উপস্থিত ছিল, এমন লোকও টেলিভিশনে ভাষাসৈনিক হিসেবে সাক্ষাৎকার দেয় এবং
কৃতিত্ব নিয়ে থাকে। অথচ যারা ১৯৪৮ সাল থেকে এ আন্দোলন করলেন, এজন্য
লেখালিখি করলেন,
গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করলেন, তাদের কথা বা তাদের নাম মুখে আনা
হয় না ।
ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করার কারণে
বিক্ষুব্ধ জনতা দৈনিক সংবাদ পত্রিকার অফিস পুড়িয়ে দিয়েছিল । অথচ এই পত্রিকায়
সম্পৃক্তদের কেউ কেউ দাবি করে, তারাই নাকি ভাষা আন্দোলনের আসল দাবিদার! আওয়ামী লীগ ১৯৫২
সালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল; আর কমিউনিস্ট পার্টি তো একটি
বিবৃতি দিতেও রাজি হয়নি। অথচ বড়ো নির্লজ্জের মতো এরা ভাষা আন্দোলনের কৃতিত্ব
দাবি করে। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, শেখ মুজিবকেও ভাষা আন্দোলনে টেনে
এনে 'তিনিই এ আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন'—এমনসব নির্জলা মিথ্যা প্রচারণা
ইদানীং চলছে এবং কিছু ভাড়াটে লোক চোখ বুজে জাতিকে মিথ্যা শোনাচ্ছে। শেখ মুজিব
অনেক বড়ো নেতা। কিন্তু শেখ মুজিবকেও ভাষা আন্দোলনের বীর বানানোর তো কোনো প্রয়োজন
নেই বা এর কোনো মানেও হয় না। সে সময় তার তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকাও ছিল না। তিনি
তো এমনিতেই অনেক বড়ো নেতা আছেন; অহেতুক ভাষা আন্দোলনের নামে তার ব্যাপারে মিথ্যা কাহিনি
রচনার দরকারটা কী?
হিন্দু শাসনকালে বাংলা ভাষা নিষিদ্ধ করে ফরমান জারি করা হয়
বাংলা ভাষার ব্যাপারে আমরা আরও একটু পেছনে গিয়ে যদি অনুসন্ধান চালাই, তাহলে দেখতে পাই-পাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে আমাদের কয়েকজন ভাইকে তাদের অমূল্য জীবন দিতে হয়েছে। কিন্তু তারও অনেক আগে বাংলা ভাষার ওপর নেমে এসেছিল ইতিহাসের নিকৃষ্টতম জুলুম ও অত্যাচার। হিন্দু রাজাদের শাসনামলে বাংলা ভাষা সম্পর্কে
বলা হতো—'ওটা ম্লেচ্ছ যবনদের ভাষা, কাক-পক্ষিদের ভাষা।' বাংলা
ভাষার বিরুদ্ধে সংস্কৃত পণ্ডিতরা ফতোয়া দেয়- 'বাংলা ভাষায় কথা বললে রৌরব নামক
নরকে যেতে হবে।'
বাংলা ভাষা ব্যবহার করা দণ্ডনীয় অপরাধ- রাষ্ট্রীয়ভাবে এমন
ডিক্রি জারি করা হয়েছিল। এ সংক্রান্ত রেফারেন্স গ্রন্থ হাতের কাছে না থাকায়
বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করা সম্ভব হলো না।
আমি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে ফাঁসির
সেল (৪০ সেল, কাশিমপুর ২ কেন্দ্রীয় কারাগার) থেকে লিখছি। এখানে বই পাওয়ার উপায় নেই।
জেলার সুভাষ কুমার ঘোষকে শুরু থেকেই দেখেছি বইয়ের ব্যাপারে দারুণ কৃপণ
চার-পাঁচটার বেশি বই রাখা যাবে না। এসব কথা তিনি বলতেন, যখন
ডিভিশনে ছিলাম সাজা হওয়ার আগে। আর এখন তো এক মাস পর জানালা দিয়ে পরিবারের সাথে
সাক্ষাৎ করতে হয়। আমার বাড়িতে অনেক বইয়ের সংগ্রহ আছে। সেখানে যখন যেমন ইচ্ছা বই
হাতের কাছে পাওয়া যায় এবং প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়। তাই আমার এ লেখায়
অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো ভুল কথা এসে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। পুরোপুরি স্মৃতিশক্তির
ওপর অবলম্বন করে লেখা। আর এ বয়সে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায় মানুষের। অনেক নাম ও
ঘটনার সময় ও সাল ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয় ।
(রাত ১১:০০ টা; ৬ আগস্ট, ২০১৩)
No comments:
Post a Comment
আমার প্রিয় বাংলা বই-এর যে কোন লেখাতে যে কোন ত্রুটি বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের লিখুন।